দাড়ি রাখার বিধান :
প্রশ্ন: দাড়ি রাখার বা কাটার ইসলামী নির্দেশনা কি ?
কেউ বলে সুন্নাত, কেউ বলে নফল (নাউযুবিল্লাহ) নাকি, এটা আসলে ওয়াজিব? দাড়ি রাখার বা কাটার ইসলামী নির্দেশনা কি? দলীল সহ জানতে চাই
১।
প্রথমে একটি হাদিস দেখি: যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে মুহাব্বত করল সে যেন আমাকেই মুহাব্বত করল। আর যে আমাকে মুহাব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে বসবাস করবে। (তিরমিযী শরীফ, মেশকাত- পৃ: ৩০) দাঁড়ির হুকুম ও পরিমাপ: ইসলামী শরীয়তে একমুষ্টি পরমান লম্বা দাঁড়ি রাখা ওয়াজিব বা আবশ্যক। দাঁড়ি এক মুষ্টির কম রাখা বা একেবারে তা মুন্ডিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে হারাম এবং কবীরা গুনাহ। স্বয়ং হুজুর স. এর দাঁড়ি রাখা এবং তার অসংখ্য হাদীসে উম্মতের প্রতি দাঁড়ি রাখার সাধারণ নির্দেশই প্রমান করে যে, দাঁড়ি রাখা ওয়াজিব এবং না রাখা হারাম। কারন, শরীয়ত প্রবর্তক কর্তৃক কোন বিষয়ের প্রতি সাধারন নির্দেশ হলে তা পালন করা ওয়াজিব এবং বিপরীত করা হারাম হয়ে যায়। আরে এটা ফিক্বাহ শাস্ত্রের একটি মূলনীতিও বটে। এছাড়া সাহাবা, সালফে সালেহীন এবং ফুক্বাহাগণের দাঁড়ি রাখার নিরবচ্ছিন্ন আমল এবং তাদের বিভিন্ন উক্তিসমূহের দ্বারাও এক মুষ্টি পরিমাপ লম্বা দাঁড়ি রাখা ওয়াজিব এবং এর বিপরীত করা হারাম প্রমাণিত হয়। নিম্নে দাঁড়ি সম্পর্কিত কতিপয় হাদীস, সাহাবাগণের আমল ও ফুক্বাহাগণের উক্তিসমূহ উল্লেখ করা হল: হাদীস শরীফে দাঁড়ি: ১. হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূল স. ইরশাদ করেছেন, দশটি বিষয় সকল নবী রাসূলগণের সুন্নাত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাঁড়ি লম্বা করা অন্যতম। (মুসলিম শরীফ,১/১২৯) ২. হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. ইরশাদ করেছেন, তোমরা গোঁফ কাট এবং দাঁড়ি লম্বা কর, আর অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা কর। (মুসলিম শরীফ,১/১২৯) ৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল স. ইরশাদ করেন, মুশরিকদের বিরোধিতরা কর, দাঁড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর। (বুখারী শরীফ- ২/৮৭৫, মুসলিম) ৪. হুজুর স. বলেছেন যে, তোমরা ভালভাবে গোঁফ কাট এবং দাড়ি বাড়াও। (বুখারী শরীফ) ৫. হুজুর স. এরশাদ করেন যে, গোঁফ কাট এবং দাড়ি ছড়িয়ে রাখ। (কাজী এয়াজ শরহে মুসলিম নববী) ৬. হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম স. ইরশাদ করেন, দাড়ি বাড়াও , গোঁফ কাট এবং এ ক্ষেত্রে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করোনা। (মাসনাদে আহমদ) ৭. নবী করীম স. এর আমল দ্বারাও দাড়ি প্রমান পাওয়া যায়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, সাহাবী হযরত খাব্বাব রা.-কে কেউ জিজ্ঞেস করেন, হুজুর পাক স. কি জোহর ও আছর নামাযে কেরআত পাঠ করতেন? তিনি বলেন, হ্যা, পাঠ করতেন। লোকটি পুন:প্রশ্ন করেন, আপনি কিভাবে তা বুঝতেন ? তিনি বলেন হুজুর স.-এর দাড়ি মুবারকের দোলায় আমরা বুঝতাম যে, তিনি কিরআত পাঠ করছেন। (তাহাবী শরীফ) বলাবাহুল্য, কেরআত পাঠকালে ঐ দাড়ি দোলাই পরিদৃষ্ট হবে, যা যথেষ্ট দীর্ঘ হয়, ছোট ছোট দাড়ি কখনো দুলবে না।
(নাহিদ আকিব)
---------------------------
২।
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, তোমরা দাড়ি লম্বা করো এবং মোচ ছোট কর । দাড়ি সংক্রান্ত এ সহীহ হাদীসটি একাধিক হাদীস গ্রন্থে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে উমর রা. এর হাদীসে আছে-রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, তোমরা দাড়ি লম্বা করো, গোফ ছোট রাখো । কোন কোন হাদীসে উপরোক্ত বাক্যের পূর্বে আছে-“তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা করো”। রাসূল সা. এর দাড়ি মোবারক ছিল কালো, গভীর, ঘন প্রশস্ত । তাঁর বক্ষ মুবারক দাড়িতে ভরে যেতো । প্রিয় নবী সা. দাড়ি রেখেছেন এবং গোটা উম্মতকে দাড়ি রাখার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন । দাড়ি পুরুষের সৌন্দর্য, যেমন চুল নারীর সৌন্দর্য । দাড়ি রাখা ওয়জিব । চার মাযহাবের কোন মাযহাবে এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই । দাড়ি রাখা সুন্নত নয় । যেমন এ যুগের অনেকেই ধারণা করেন এবং দাড়ি রাখার ব্যাপারে মারাত্মক অবহেলা করেন । ফলশ্রুতিতে চব্বিশ ঘন্টা কবীরা গুনাহে লিপ্ত থকেন । আল্লাহর ক্রোধ তাদের প্রতি। এক কথায় দাড়ি লম্বা করা ওয়াজিব । আলেমদের চূড়ান্ত মত হল, আদেশ সূচক বাক্য দ্বারা কোন কাজকে জরুরী ও ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয় । দাড়ি এক মুষ্টির ভিতরে কাটা কিংবা ছাটা হারাম। (১)দাড়ি মুন্ডানো এবং ছোট করা মুশরিক অগ্নিপুজক এবং বিধর্মীদের আলামত আর মুসলমানদের জন্য বিধর্মীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হারাম । হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির বেশবুষা আকার আকৃতি সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে ঐ জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গন্য হবে। (জামে ছগীর ২/৮) (২)দাড়িবিহীন চেহারা নারী জাতির চেহারার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এধরনের সামঞ্জস্য অবলম্বন করা হারাম । হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা অভিসম্পাত করেন সেসব পুরুষের উপর যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। (৩)রাসূল সা. সারাজীবন লম্বা দাড়ি রেখেছিলেন, যদি দাড়ি মুন্ডানো কিংবা মুষ্টি পরিমাণের আগে কর্তন করা জায়িয হত, তাহলে তিনি সারা জীবনে কম পক্ষে একবার হলেও তা করে দেখাতেন । অথচ তার দ্বারা তা প্রমাণিত নয় । (৪) সকল সাহাবায়ে কেরামের দাড়ি লম্বা ছিল, কোন একটি দুর্বল হাদীসও এমন পাওয়া যায় না যদ্বারা বুঝা যায় যে, কোন একজন সাহাবী জীবনে কখনো দাড়ি মুন্ডিয়েছেন বা খাটো করেছেন। (৫) ফাতাওয়া শামীতে বর্ণিত আছে যে, পুরুষের জন্য দাড়ি মুন্ডন করা হারাম।
(জহুরুল হক)
---------------------
৩।
রাসূল সঃ বলেছেন, "اوفلوا اللحي" অর্থাৎ দাড়িকে বাড়াও, এই
আমলটি "মুতাওয়াতির আমল" অর্থাৎ কোন নবী রাসূল,
সাহাবায়ে কেরাম কিংবা কোন তাবেয়ি ' এদের কারো ব্যপারে
শুনা যায় না যে তারা দাড়ি কেটেছেন।
দাড়ি রাখা আমলটি সুন্নাত, তবে এর হুকুম হল ওয়াজিব।
কেননা হাদিসে দাড়ি রাখতে আদেশ করা হয়েছে,আর আদেশ
বাচক শব্দ ব্যবহৃত হলে তার হুকুম ওয়াজিব হয়।
( মো: আব্দুল্লাহ নোমান)
-------------------------------------
৪।
১. দাড়ি বাড়াও। (বুখারী, মুসলিম শরীফ) ২. দাড়ি পূর্ণ কর। (মুসলিম শরীফ) ৩. দাড়ি ঝুলন্ত ও লম্বা রাখ। (মুসলিম শরীফ) ৪. দাড়ি বহার রাখ। (মাজমাউল বিহার) ৫. দাড়ি বেশী রাখ (বুখারী, মুসলিম) ৬. দাড়িকে ছাড়, অর্থাৎ কর্তন করো না। (তাবরানী) দাঁড়ি ও সাহাবায়ে কেরামের আমল : ১.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.যখন হজ্জ্ব বা উমরা আদায় করতে, তখন স্বীয় দাঁড়ি মুষ্টি করে ধরতেন, অতঃপর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। (বুখারী শরীফ- ২/৮৭৫) ২. হযরত আবু হুরায়রা রা. স্বীয় দাঁড়ি ধরতেন, অতঃপর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। (মুসান্নাফ লি-ইবনি আবি শাইবা- ১৩/১১২) দাঁড়ি ও ফুক্বাহাদের উক্তি: ১. হানাফী মাযহাবের কিতাব শরহে মুনহাল ও শরহে মানজুমাতুর আদবের মধ্যে লিখেছেন, নির্ভরযোগ্য ফতোয়া হল দাড়ি মুন্ডানো হারাম। ২.মাওলানা আশেকে এলাহী মিরাঠী রহ. তার প্রণিত “’”দাড়ি কী কদর ও কীমত” কিতাবে চার মাজহাবের ফক্বীহগণের মতামত শাফেয়ী মাজাহাবের প্রামান্য গ্রন্থ “আল ওবাব” হতে উদ্বৃত করেছেন : ইমাম ইবনুর রাফ’আ বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. “আলউম্ম” কিতাবে লেখেন যে, দাড়ি কাটা হারাম। ৩. মালেকী মাজহাব মতেও দাড়ি মুন্ডন করা হারাম। অনুরূপভাবে ছুরত বিগড়ে যাওয়া মত ছেটে ফেলাও হারাম। (কিতাবুল ওবদা) ৪. হাম্বলী মাজহাবের কিতাব “শাহহুল মুন্তাহা” ও “শরহে মুজ্জুমাতুল আদব” এর উল্লেখ হয়েছে যে, নির্ভরযোগ্য মত হল দাড়ি মুন্ডন করা হারাম। অনুরূপ অন্যান্য গ্রন্থাকারও দাড়ি রাখা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে মাননীয় ইমামদের ইজমা (ঐকমত) বর্ণনা করেছেন। দাড়ি কর্তনকারী আল্লাহ পাকের দুশমনদের মধ্যে গণ্য হওয়ার সম্ভাবনা: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. নিজ রচিত “কিতাবুজ্জুহুদে” আকীল ইবনে মোদরেক সালামী হতে উদ্ধৃতি করেন যে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু বনী ইস্রাইলের এক নবীর নিকট এই অহী প্রেরন করেন যে, তিনি যেন নিজ কওম বনী ইস্রাইলকে এ কথা জানিয়ে দেন যে, তারা যেন আল্লাহ তা’য়ালার দুশমনদের বিশেষ খাদ্য শুকরের গোশত না খায় এবং তাদের বিশেষ পানীয় অর্থাৎ শরাব(মদ) পান না করে এবং তাদের শিক্ল ছুরত (আকৃতি) না বানায়। যদি তারা এমন করে অর্থাৎ শুকরের গোশত খায়, বা মদ পান করে, অথবা দাড়ি মুন্ডায় বা ছোট করে (ফ্রেন্সকাট করে) অথবা বড় বড় মোচ রাখে, তা’হলে তারাও আমার দুশমন হবে, যেমন তারা আমার দুশমন। (দালায়েলুল আসর) কওমে লূতের নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য ও ধ্বংসের কারন: প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আসাকেরসহ আরো কতিপয় মুহাদ্দিস হযরত হাসান রা. হতে নবী করীম স. এর এই মুবারক হাদীস বর্ণনা করেন যে, দশ প্রকার পাপে লূত সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছিল; তন্মধ্যে দাড়ি কাটা, গোঁফ বড় রাখা অন্যতম। আল্লাহ সুবানুহুতা’'য়ালা আমাদের সকলকে দাঁড়ি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করে যারা এখন দাঁড়ি রাখিনি তাদের দাঁড়ি রাখার তৌফিক দান করুন এবং যারা দাঁড়ি সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করেন তাদের হেদায়াত দান করুন। আমীন।
(বায়োজিদ হোসাইন)
---------------------------
৫।
মুসলমাদেরকে দাড়ি রাখতে ও লম্বা করতে রাসূল সাঃ নির্দেশ দিয়েছেন। দাড়ি ছোট করতে ও মুন্ডন করতে রাসূল সাঃ নিষেধ করেছেন। নিম্ন এ সম্পর্কে রাসূল সাঃ এর বাণী উল্লেখ করা হল। ১-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ গোঁফ নিশ্চিহ্ন করতে, আর দাড়ি বড় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬২৪} ২-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা গোঁফকে কর্তন কর, এবং দাড়িকে লম্বা কর। তোমরা অগ্নিপূজকদের বিপরীত কর। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬২৬} ৩-হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলার ভর্ৎসনা ঐ সব পুরুষদের উপর যারা মহিলাদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে এবং ঐ সব মহিলাদের উপর আল্লাহ তাআলার ভর্ৎসনা যারা পুরুষদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৫৪৬, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৭৫০} দাড়ি থাকা পুরুষের নিদর্শন। আর দাড়ি না থাকা মহিলাদের নিদর্শন। তাই দাড়ি কেটে মহিলাদের সাদৃশ্য গ্রহণ এ হাদীসের ভাষায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ৪-রাসূল সাঃ এর যুগে মুশরিক ও অগ্নি উপাসকদের মধ্যে দাড়ি ছোট করে রাখা বা দাড়ি মুন্ডন করার রীতি প্রচলিত ছিল। রাসূলুল্লাহ সাঃ তার উম্মতকে বিশেষভাবে এ সকল অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করতে এবং বড় দাড়ি রাখতে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন- হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন- তোমরা মুশরিকদের বিরোধীতা কর। দাড়ি লম্বা কর। আর গোঁফকে খাট কর। আর ইবনে ওমর রাঃ যখন হজ্ব বা ওমরা করতেন, তখন তিনি তার দাড়িকে মুঠ করে ধরতেন, তারপর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৫৫৩} রাসূল সাঃ এর দাড়ি রাসূল সাঃ এর দাড়ি লম্বা ছিল। সাহাবাগণের দাড়িও লম্বা ছিল। ১-হযরত আলী রাঃ রাসূল সাঃ এর বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, “তিনি অনেক বড় দাড়ির অধিকারী ছিলেন। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬৩১১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৯৪৬} ২-হযরত জাবির বিন সামুরা রাঃ বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি ছিল বেশি বা ঘন। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬২৩০, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৭৪৫৬} ফক্বীহদের দৃষ্টিতে দাড়ির বিধান উপর্যুক্ত হাদীসগুলোর আলোকে মুসলিম উম্মাহের ফক্বীহগণ একমত যে, দাড়ি বড় করা মুসলিমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং দাড়ি মুন্ডন করা বা “একমুষ্টি” এর কম রাখা নিষিদ্ধ। পারিভাষিক মূলনীতির আলোকে কোন কোন ফক্বীহ দাড়ি রাখা “ফরজ” বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ তা “ওয়াজিব”মত দিয়েছেন। কেউ বা “সুন্নাত” বলেছেন। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ ইবনে হাযম যাহিরী আলী ইবনে আহমাদ বলেন “দাড়ি ছেড়ে দেওয়া ও গোঁফ কর্তন করা ফরজ”। {আল মুহাল্লা-২/২২০} চতুর্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ আবু আওয়ানা ইয়াকুব ইবনে ইসহক বলেন “গোঁফ কর্তন করা এবং তা ছোট করা ওয়াজিব ও দাড়ি বড় করা ওয়াজিব”। { মুসনাদে আবী আওয়ানা-১/১৬১} ষষ্ঠ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও মালিকী ফক্বীহ কাযী ইয়াজ বলেন যে, “দাড়ি মুন্ডন করা, কাটা বা পুড়ানো মাকরূহ। তবে দাড়ির দৈর্ঘ ও প্রস্থ থেকে কিছু কাটা ভাল। দাড়ি কাটা বা ছাটা যেমন মাকরূহ, তেমনি প্রসিদ্ধির জন্য তা বেশি বড় করাও মাকরূহ”। {ফাতহুল বারী-১০/৩৫০, নাইলুল আওতার-১/১৩৬} একাদশ হিজরীতে প্রসিদ্ধ হাম্বলী ফক্বীহ মানসূর বুহুতী রহঃ বলেন যে, “দাড়ি মুন্ডন করা হারাম, এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কর্তন করা মাকরূহ নয়। {কাশশাফুল কিনা-১/৭৫} একাদশ শতকে প্রসিদ্ধ হানাফী ফক্বীহ আলাউদ্দীন হাসকাফী রহ^ তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আদ দুররুল মুখতার” এ লিখেন যে, “দাড়ি লম্বা করার সুন্নাত সম্মত পরিমাণ এক মুষ্টি। নিহায়া গ্রন্থে এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কর্তন করা ওয়াজিব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এক মুষ্টির কম পরিমাণ দাড়ি ছাটা কেউই বৈধ বলেন নি। মরক্কো অঞ্চলের কিছু মানুষ ও মেয়েদের অনুকরণপ্রিয় কিছু হিজড়া পুরুষ এরূপ সমর্বসম্মতভাবে নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হয়। {রদ্দুল মুহতার-২/৪১৭-৪৮১} কোন মুহাদ্দিস, ফক্বীহ, ইমাম বা আলিম এক মুষ্টির কম দাড়ি রাখার সুষ্পষ্ট অনুমতি দিয়েছেন বলে জানা যায় না। যারা দাড়ি থেকে কিছু ছাটার অনুমতি দিয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, একমুষ্টির অতিরিক্তই শুধু কাটা যাবে। তাই একমুষ্টি হওয়ার আগেই দাড়ি কাটা, মুন্ডানো ইসলামের দৃষ্টিতে মাকরূহে তাহরীমী তথা হারামের কাছাকাছি গোনাহ। আহবান ও দাওয়াত দাড়ি রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। দাড়ি ছোট করা এবং মুন্ডানো উভয়টিই মারাত্মক অপরাধ। দাড়ি মুসলিমের পরিচায়ক। সুতরাং যখন একজন পুরুষের মুখে দাড়ি গজানো শুরু হয় তখন থেকেই দাড়িতে কেঁচি বা ব্লেড ব্যবহার না করা। ছোট বা মুন্ডানো থেকে বিরত থাকা জরুরী। সকল নবীদের মুখে দাড়ি ছিল। সকল সাহাবাগণের মুখে দাড়ি ছিল। সকল আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গদের মুখে দাড়ি ছিল। তাই দাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্গ করা, বিরূপ মন্তব্য করা ঈমানের জন্য ক্ষতিকর হবে। নিজে দাড়ি রাখতে হবে, সেই সাথে দাড়িওয়ালা ব্যক্তিদের সম্মান করা, এবং দাড়ি অবমাননা হয এমন কোন কাজ করা যাবে না।
-------------------------
৬।
মানুষের ব্যক্তিত্ব বোঝা যায় তার পোশক-আশাকে। মুসলিমদের অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে আলাদা করতে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা তৈরি করতে আল্লাহ তাদের নির্দিষ্ট একটি ইউনিফর্ম দিয়েছেন। পুরুষের ইউনিফর্ম হলো– ঢিলেঢালা পুরুষালী পোশাক, যা পায়ের গোড়ালির উপর থাকবে। মুখে থাকবে প্রাকৃতিক দাড়ি, গোঁফ ছেটে রাখা হবে। কিন্তু ইসলামি ইউনিফর্মের দাড়ি অংশটাকে সাধারণ মুসলিমরা তো বটেই, অনেক নিষ্ঠাবান মুসল্লি পর্যন্ত অবহেলা করে থাকে । অথচ দাড়ি কেটে একজন মানুষ অনেক ভাবে ইসলাম লঙ্ঘন করে থাকে-
আল্লাহর অবাধ্যতা : আবু হোরায়রা [রা.] থেকে বর্ণিত, পারস্যের সম্রাট কিসরা ইয়েমেনের শাসকের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ [সা.] এর কাছে দু’জন দূত পাঠান। যাদের দাড়ি ছিল না আর গোঁফ ছিল বড়। রাসুলের [সা.] কাছে তাদের এই অবয়ব দেখে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেন। জিজ্ঞেস করেন, কে তোমাদের এমন করতে বলেছে? তারা উত্তর দিল, আমাদের প্রভু কিসরা। তিনি তখন ইরশাদ করেন, আমার রব, যিনি পবিত্র ও সম্মানিত, তিনি আদেশ করেছেন যেন আমি দাড়ি লম্বা রাখি এবং গোঁফ ছোট রাখি। (তাবারি, ফিক্বহুস সিরাহ পৃষ্ঠা-৩৫৯ ) সুতরাং দাড়ি কাটা মানে আল্লাহর নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ।
রসুলের [সা.] আদেশ অমান্যকরণ : ইবন ওমর [রা.] বলেন, রাসুলুল্লাহ [সা.] আমাদের আদেশ করেছেন, ‘গোঁফ ছেটে রাখো, আর দাড়িকে দীর্ঘ হবার সুযোগ দাও । (বুখারি ও মুসলিম) সুতরাং দাড়ি কাটলে আল্লাহর সাথে রাসুলের [সা.] আদেশও অমান্য করা হবে । যার পরিণাম সম্পর্কে কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘আর যে আল্লাহ ও তার রাসুলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। (সুরা জ্বিন, আয়াত ২৩)
সুন্নাত থেকে বিচ্যুতি : আল্লাহর প্রেরিত সব রাসুলদের বর্ণনায় দাড়ির কথা পাওয়া যায়। কোরআনে হজরত হারুন [আ.]-এর দাড়ির বর্ণনা এসেছে। জাবির বিন সামুরাহ [রা.] বলেন,রাসুলের [সা.] দাড়ি ছিল বেশ বড় । সুতরাং দাড়ি কাটা হলে নবি-রসুলগণের স্বভাব ও তাদের রেখে যাওয়া আদর্শের পরিপন্থী কাজ করা হবে।
সাহাবাদের আদর্শের খেলাফ : সাহাবাদের দৈহিক বর্ণনার মধ্যে দাড়ির দৈর্ঘ্যের কথাও এসেছে। হজরত আবু বকরের [রা.] দাড়ি ঘন ছিল, হজরত ওমর, ওসমান ও হজরত আলির [রা.] -এর দাড়ি দীর্ঘ ছিল। খেলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাতকে রাসুল [সা.] আকড়ে থাকতে বলেছেন।
অমুসলিমদের অনুকরণ : আবু হোরায়রা [রা.] বলেন, রাসুল ইরশাদ করেছেন- ‘গোঁফ ছোট কর ও দাড়ি বড় কর, অগ্নি উপাসকদের থেকে ভিন্নবেশী হও।’ অন্য হাদিসে এসছে, দাড়ি বড় রাখার মাধ্যমে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিপরীত করো। মুশরিকদের চেয়ে আলাদা হও।’ (মুসলিম শরিফ)
নারীদের অনুকরণ : দাড়ি না রাখার মাধ্যমে নারীদের মতো মুখাবয়ব বানানো হয়, যাতে প্রকরান্তরে তাদের অনুকরণ করাই হয়। ইবনে আব্বাস [রা.] বলেন, রাসুল [সা.] সে সব পুরুষদের অভিশম্পাত করেছেন যারা নারীদের অনুকরণ করে । (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামকে উপহাস : দাড়ি না রাখতে রাখতে সমাজের অবস্থা এমন হয়েছে যে যদি কোনো মুসলিম দাড়ি রাখে তাহলে তাকে ভিন্নমতাদর্শী বলে কটাক্ষ করা হয়। এছাড়াও অনেকেই আজকাল ভাবতে শুরু করেছে যে, দাড়ি রাখার আসলে তেমন প্রয়োজনই নেই। এটা ইসলামের একটি আবশ্যকীয় বিষয়কে উপহাস করার সুযোগ তৈরি করে দেয় ।
দাড়ি রাখা সুন্নাত নাকি ওয়াজিব : আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটা ভুল ধারণা হলো যে, দাড়ি রাখা সুন্নাত, সুতরাং এটা রাখলেও চলে না রাখলেও চলে। মনে রাখতে হবে রাসুলের [সা.] যে সব সুন্নাত সব মানুষের অনুকরণের জন্য তাকে বলে ‘সুন্নাতে ইবাদাত’। যা আমলের দিক থেকে ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি দাঁড়ি কখনো কাটেননি, কাটার অনুমতি দেননি বরং তা ছেড়ে দিতে বলেছেন। তাই দাড়ি রাখা সুন্নাতে ইবাদাত হিসেবে ওয়াজিব, যা লঙ্ঘনের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহ ও তার রাসুলের অব্যাধ্যতা করে থাকে। তাছাড়া চার মাজহাবের ইমাম, ইবনে তাইমিয়া, ইবন হাজাম, বিন বায, নাসিরুদ্দিন আলবানিসহ ন্যায়পন্থি আলেম দাড়ি কাটাকে হারাম বলেছেন। আমাদের সবার উচিত এর ওপর পরিপূর্ণভাবে আমল করা।
(মাওলানা মনযূরুল হক)
------------------------------------------
৭।
(সংগ্রহ)
প্রশ্নঃ দাড়ি রাখা কি ওয়াজিব? দাড়ি শেভ করা বা কামানো কি পাপ?
উত্তরঃ দাড়ি রাখা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করুনঃ
শুধু আমাদের দেশেই না বেশীরভাগ দেশেই দাড়ি রাখা সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে, সেটা হল ''দাড়ি রাখা সুন্নত; অতএব দাড়ি রাখলে ভাল আর না রাখলে তেমন কোন সমস্যা নেই, একটা সুন্নত পালন করা হল না এই আর কি।'' জেনে রাখুন, এটা সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণা।
দাড়ী আল্লাহর একটি মহান ও বড় নে’য়ামত। দাড়ী দ্বারা তিনি পুরুষকে অনুগৃহীত করেছেন এবং নারী জাতি থেকে তাকে বৈশিষ্ট মন্ডিত করেছেন। দাড়ী শুধুমাত্র মুখমন্ডলের উপর কয়েকটি
কেশগুচ্ছই নয়; বরং ইহা ইসলামের বাহ্যিক বড় একটি নিদর্শন। দাড়ী ছেড়ে রেখে এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। আল্লাহ্ বলেন,
ﺫَﻟِﻚَ ﻭَﻣَﻦْ ﻳُﻌَﻈِّﻢْ ﺷَﻌَﺎﺋِﺮَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﺈِﻧَّﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺗَﻘْﻮَﻯ ﺍﻟْﻘُﻠُﻮﺏِ
“এই কারণে যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শন সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, এটা তো তার হৃদয়ের তাকওয়ারই পরিচয়।” [ সূরা হাজ্জ- ৩২]
দাড়ী মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসৃত নীতির একটি অন্যতম পরিচয়। তিনি দাড়ী ছেড়ে দিতে ও লম্বা করতে আদেশ করেছেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, দাড়ীর প্রতি এত গুরুত্ব ও তার প্রতি সম্মানের নির্দেশ থাকা সত্বেও অধিকাংশ মুসলমান বিষয়টিকে অতি নগন্য ও তুচ্ছ মনে করে। যেন ঘৃণা ভরে প্রতিদিন তা ছেঁচে ফেলতে মহা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যারা মুন্ডন করে না তারা আরেক ষ্টাইলে তার সাথে খেলা-ধুলা করে। কেউ শুধুমাত্র থুতনীর উপর ছোট ছোট করে রাখে আবার কেউ খুবই হালকা করে কাল একটি রেখার মত করে রাখে। কেউ আবার দাড়িকে গোঁফের সাথে মিলিয়ে দিয়ে গোলাকৃতী করে রাখে।
এই চিত্রগুলো দেখলে একদিকে যেমন দুঃখ লাগে অন্য দিকে তা যেন হাস্যেরও পাত্র। যে মুসলমানকে দাড়ী ছেড়ে দিতে আদেশ করা হয়েছে, দাড়ীকে সম্মান করতে বলা হয়েছে সেই মুসলমান তো দূরের কথা কোন বিবেকবানের পক্ষেও এরকম আচরণ করা শোভনীয় নয়।
বড়ই পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলা যে আকৃতিতে দাড়ীকে সৃষ্টি করেছেন সে অবস্থাতেই তা নিজ মুখমন্ডলে অবশিষ্ট রেখে ইসলামী শিষ্টাচারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী এরকম সভ্য মানুষের সংখ্যা আজ খুবই বিরল। (লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্)
দাড়ী মুন্ডন হারাম হওয়ার দলীলঃ
আল্লাহ্ বলেন,
ﻭَﻟَﺂَﻣُﺮَﻧَّﻬُﻢْ ﻓَﻠَﻴُﻐَﻴِّﺮُﻥَّ ﺧَﻠْﻖَ ﺍﻟﻠَّﻪِ
“(শয়তান বলে) আমি অবশ্যই তাদেরকে আদেশ করব, তারা তখন আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দিবে।” [ সূরা নিসাঃ ১১৯]
দাড়ী মুন্ডন করা বা কর্তন করা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার শামিল। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
"দশটি জিনিস স্বভাবজাত। তম্মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেনঃ গোফ কর্তন করা ও দাড়ী ছেড়ে দেয়া।" [ মুসলিম]
অতএব গোঁফ লম্বা করা আর দাড়ী কেটে ফেলা সুস্থ স্বভাব বিরোধী কাজ।
ইবনে ওমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
ﺧَﺎﻟِﻔُﻮﺍ ﺍﻟْﻤُﺸْﺮِﻛِﻴﻦَ ﻭَﻓِّﺮُﻭﺍ ﺍﻟﻠِّﺤَﻰ ﻭَﺃَﺣْﻔُﻮﺍ ﺍﻟﺸَّﻮَﺍﺭِﺏَ
“তোমরা মুশরিকদের বিরোধীতা কর। দাড়ী ছেড়ে দাও এবং গোঁফ ছোট কর।” [বুখারী ও মুসলিম]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
ﺟُﺰُّﻭﺍ ﺍﻟﺸَّﻮَﺍﺭِﺏَ ﻭَﺃَﺭْﺧُﻮﺍ ﺍﻟﻠِّﺤَﻰ ﺧَﺎﻟِﻔُﻮﺍ ﺍﻟْﻤَﺠُﻮﺱَ
“গোঁফ ছেঁটে ফেল এবং দাড়ী লম্বা কর আর এর মাধ্যমে অগ্নী পুজকদের বিরোধীতা কর।” [ মুসলিম]
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যাবতীয় বিষয়ে মুশরিক-হিন্দু, ইহূদী-খৃষ্টান ও অগ্নী পুজকদের বিরোধীতা করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ওয়াজিব।
এ জন্যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“যারা কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে,
সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত হবে।” [ আবু দাউদ, আহমাদ হাদীছ সহীহ ]
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
ﻣَﻦْ ﻟَﻢْ ﻳَﺄْﺧُﺬْ ﻣِﻦْ ﺷَﺎﺭِﺑِﻪِ ﻓَﻠَﻴْﺲَ ﻣِﻨَّﺎ
“যে ব্যক্তি গোঁফ কাটে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়।” [ তিরমিযী, নাসাঈ, হাদীছ সহীহ ]
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নির্দেশ ওয়াজিব বা আবশ্যকতার দাবী রাখে। অন্য দিকে দাড়ী মুন্ডন করার মাধ্যমে নিজেকে নারীদের কাতারে শামিল করা হয়। কেননা নারীরা দাড়ী বিহীন । কোন নারী যদি পুরুষের আকৃতি ধারণ করে এবং কোন পুরুষ যদি নারীর আকৃতি ধারণ করে তবে তারা লা’নতপ্রাপ্ত।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারীর সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষকে এবং পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারীনী নারীকে অভিশাপ করেছেন।” [ছহীহ আবু দাউদ, তিরমিযী]
দাড়ী রাখা ওয়াজিব না সুন্নাত?
এ নিয়ে মানুষ মতোবিরোধ করলেও দাড়ী রাখা যে ওয়াজিব সেটাই প্রনিধাণযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য কথা। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাড়ী রেখেছেন বলেই ইহা নবীজীর সুন্নাত বলে তার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কেননা নবীজী দাড়ী নিজে রেখেছেন এবং তা রাখার জন্যে নির্দেশও দিয়েছেন। আর
আল্লাহ্ তা’আলা যেমন ফরয করেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও তেমনি ফরয বা ওয়াজিব করেন। তার কারণ হচ্ছে নবীজী কখনো নিজের কল্পনা প্রসূত কোন কথা বলতেন না। আল্লাহ্ তাঁর নিকট যা ওহী করতেন তিনি তাই বলতেন। (সূরা নজমঃ ৩,৪)
তাছাড়া নবীজী দাড়ীর বিষয়ে যে সকল আদেশ সূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন তার বিপরীতে এমন কোন হাদীছ খুঁজে পাওয়া যাবে না যা দ্বারা দাড়ীকে সুন্নাত বা মুস্তাহাব সাব্যস্ত যাবে।
তিরমিযীতে একটি হাদীছে বলা হয়েছেঃ
ﻛﺎﻥ ﻳﺄﺧﺬ ﻣﻦ ﻟﺤﻴﺘﻪ ﻣﻦ ﻋﺮﺿﻬﺎ ﻭﻃﻮﻟﻬﺎ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৈর্ঘ ও প্রস্ত দিক থেকে তাঁর দাড়ী কাটতেন।” এ হাদীছটি মওযু বা জাল যার কোন ভিত্তি নেই। ইমাম তিরমিযী
হাদীছটি বর্ণনা করার পর নিজেই একথার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। [ দ্রঃ ছহীহ তিরমিযীঃ হা/২৭৬২]
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, দাড়ী মুন্ডন করা হারাম। ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেন, দাড়ী মুন্ডান, উঠানো বা কর্তন করা কোনটাই জায়েয নয়। শায়খ বিন বায (রঃ) বলেন, দাড়ীকে সংরক্ষণ করা, পরিপূর্ণ রাখা ও তা ছেড়ে দেয়া ফরয। এই ফরযের প্রতি অবহেলা করা জায়েয নয়।
শাইখ ইবনে উসাইমীন (রঃ) বলেন, দাড়ী রাখা ওয়াজিব,
উহা মুন্ডন করা হারাম বা কাবীরা গুনাহ।
প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফিকাহবিদগণও দাড়ী ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব ও কেটে ফেলাকে হারাম বলে মত প্রকাশ করেছেন।
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ র্দুরে মুখতারে (২য় খন্ড/৪৫৯ পৃঃ) বলা হয়েছেঃ পুরুষের জন্য দাড়ী কর্তন করা হারাম। নিহায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দাড়ী এক মুষ্টির বেশী হলে তা কেটে ফেলা ওয়াজিব। কিন্তু এর চাইতে বেশী কর্তন করা যেমনটি পশ্চিমা দেশের লোকেরা এবং খোঁজা পুরুষেরা করে তা কেউ বৈধ বলেননি। আর দাড়ী সম্পূর্ণটাই কেটে চেঁছে ফেলা হিন্দুস্থানের ইহূদী ও কাফের-মুশরেকদের কাজ।”
মালেকী মাযহাব মতে দাড়ী কাটা হারাম। (আল আদাভী আলা শারহে কিফায়াতুত্ তালেব রাব্বানী ৮ম খন্ড ৮৯ পৃঃ)
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘আল উম্ম’ উল্লেখ করেছেন যে, দাড়ী কর্তন করা হারাম।
শাফেঈ মাযহাবের আলেম আযরাঈ বলেনঃ সঠিক কথা হচ্ছে কোন কারণ ছাড়া সম্পূর্ণ দাড়ী মুন্ডন করা হারাম। (হাওয়াশী শারওয়ানী ৯ম খন্ড ৩৭৬ পৃঃ)
হাম্বলী মাযহাবের বিদ্বানগণও দাড়ী মুন্ডনকে হারাম বলেছেন। (ইনসাফ, শরহে মুন্তাহা)
অতএব দাড়ী মুন্ডন করা বড় পাপ। এ থেকে তওবা করা আবশ্যক। অবশ্য দাড়ী মুন্ডন করা ও কেটে ছোট করার পাপ এক সমান নয়। যদিও উভয়টিই পাপের কাজ। অনেক মানুষ দাড়ী মুন্ডন করাটাকে খুবই ছোট ও তুচ্ছ ব্যাপার মনে করে। কিন্তু ইহা মুন্ডন করা কোন সময় সবচেয়ে বড় গুনাহের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। কেননা এটা প্রকাশ্যে পাপের কাজে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম। আর প্রকাশ্যে এভাবে অন্যায়ে লিপ্ত হয়ে তওবা না করলে হতে পারে দাড়ী মুন্ডনকারী আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাবে না। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
ﻛُﻞُّ ﺃُﻣَّﺘِﻲ ﻣُﻌَﺎﻓًﻰ ﺇِﻻ ﺍﻟْﻤُﺠَﺎﻫِﺮِﻳﻦَ
“আমার উম্মতের সবাইকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে পাপের কাজে লিপ্ত হয় তাদেরকে ক্ষমা করা হবে না।” [বুখারী ও মুসলিম ]
তাছাড়া কোন মানুষ যদি দাড়ীকে অপছন্দ করে বা তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে অথবা দাড়ীওয়ালা মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে,
তবে সম্ভাবনা আছে একারণে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে কুফরীতে লিপ্ত হবে এবং মুরতাদ হয়ে যাবে। কেননা নবী (ছাঃ) যা নিয়ে এসেছেন তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা বা ব্যঙ্গ করা বা তা ঘৃণা ও অপছন্দ করা ইসলাম ভঙ্গ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
আল্লাহ্ বলেন,
ﺫَﻟِﻚَ ﺑِﺄَﻧَّﻬُﻢُ ﺍﺗَّﺒَﻌُﻮﺍ ﻣَﺎ ﺃَﺳْﺨَﻂَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛَﺮِﻫُﻮﺍ ﺭِﺿْﻮَﺍﻧَﻪُ ﻓَﺄَﺣْﺒَﻂَ ﺃَﻋْﻤَﺎﻟَﻬُﻢْ
“এই কারণে যে, তারা এমন বস্তুর অনুসরণ করেছে যার প্রতি আল্লাহ্ রাগাম্বিত। আর তারা তাঁর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করেছে। ফলে তিনি তাদের আমলগুলো বরবাদ করে দিয়েছেন।” [ সূরা মুহাম্মাদঃ ২৮]
সাবধান মুসলমান! নিজের আমল বরবাদ করবেন না বা অজ্ঞতা বশতঃ ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন না।
প্রিয় ভাই! সালাত সিয়াম ও অন্যান্য ওয়াজিব বিষয়ে আপনি যেমন আপনার পালনকর্তার আনুগত্য করেছেন।
কেন এই বিষয়টিতে তাঁর নাফরমানী করছেন?
উভয় বিষয়ের আদেশকারী রব কি একজনই নয়?
কোথায় আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন?
কোথায় ঈমানের বলিষ্ঠতা ও সত্যতা?
শরীয়তের বিধান নিয়ে কেন এই ছিনিমিনি খেলা?
পুরুষের সৌন্দর্য দাড়ী মুন্ডানোতে নয়। আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে নারী জাতী থেকে আলাদা ও বৈশিষ্ট মন্ডিত করেছেন। পৌরুষত্বের পরিচয় দাড়ী প্রদান করে তার সৌন্দর্য্যকে প্রস্ফুটিত করেছেন। কিভাবে মানুষ তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তাকে পরিবর্তন করে নিজেকে নারী জাতীর সাথে সাদৃশ্য করতে চায়? ইসলামের শত্র“দের সাথে নিজেকে মিলিত করতে চায়? আর ধারণা করে যে, এতেই রয়েছে অতিরিক্ত সৌন্দর্য্য ও ব্যক্তিত্ব!? দাড়ী মুন্ডন না করলে বা না কাটলে যেন পুরুষের সৌন্দর্যই ফুটে উঠে না। পুরুষকে দাড়ী দিয়ে যেন আল্লাহ ভুল করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ্) তাই সেই ভুল শোধরাতে তারা যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
আল্লাহ্ বলেনঃ
ﺃﺃﻧْﺘُﻢ ﺃﻋْﻠَﻢُ ﺃﻡِ ﺍﻟﻠﻪُ
“তোমরাই কি বেশী জ্ঞান রাখ না আল্লাহ্ অধিক জ্ঞান রাখেন?” [ সূরা বাকারাঃ ১৪০]
দাড়ী বিহীন পুরুষ যদি অধিক সুন্দর হত তবে তা করতে আল্লাহ্ অপারগ ছিলেন না। কিন্তু তিনি এর মাধ্যমে পুরুষকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করতে চেয়েছেন। পার্থক্য করেছেন নারীদের থেকে।
সম্মানিত ভাই!
আপনার এই কাজে কি দুনিয়াবী কোন উপকার আছে কি?
পাবেন কি আখেরাতে কোন ছওয়াব-নেকী?
কেন আপনি নিজেকে আল্লাহর ক্রোধের সম্মুখিন করছেন?
কেন আপনি প্রতিদিন একটি অযথা পরিশ্রমে নিজেকে ক্লান্ত করছেন?
কেন সময় ও অর্থের অপচয় করছেন?
হে আল্লাহ্ তুমি আমাদের সবাইকে তোমার সন্তুষ্টি মূলক কাজ করার তাওফীক দাও এবং যে কাজে তোমার অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ রয়েছে তা থেকে আমাদেরকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান কর৷
আরো কিছু প্রাসাংগিক কথাঃ
* দাড়ি রাখা যাই হোক না কেন প্রকৃত মুসলমান দাড়ি রাখবে, এটাই স্বাভাবিক ।
এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কাটার সুযোগ শরীয়তে রয়েছে। হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. ও হযরত আবু হুরায়রা রা. এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কেটেছেন।
আবু যুরআ রাহ. বলেন, আবু হুরায়রা রা. তাঁর দাড়ি মুঠ করে ধরতেন। এরপর এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩/১১২, হাদীস : ২৫৯৯২; ২৫৯৯৯)
কিন্তু কোনো সহীহ বর্ণনায় এক মুষ্ঠির ভিতরে দাড়ি কাটার কোনো অবকাশ পাওয়া যায় না।
এখন আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, আপনি কি করবেন। আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ মানবেন নাকি সমাজের মানুষের কাছে লজ্জার ভয়ে কিংবা কাফির-মুশরিকদের অন্ধ অনুসরণ করবেন? ৷৷৷ সংগৃহিত।