৯ নং সুরা: আত-তওবা, আয়াত নং: ৬০
আয়াত ক্রম: ১২৯৫, পারা: ১০, পৃষ্ঠা: ১৫, রুকু: ৮
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
এ সাদকা গুলো তো আসলে ফকীর৬১ মিসকীনদের৬২ জন্য। আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত৬৩ এবং যাদের মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য।৬৪ তাছাড়া দাস মুক্ত করার,৬৫ ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার,৬৬ আল্লাহর পথে৬৭ এবং মুসাফিরদের উপকারে৬৮ ব্যয় করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষে থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহ সবকিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ।
The alms are meant only for the poor and the needy and those who are in charge thereof, those whose hearts are to be reconciled; and to free those in bondage, and to help those burdened with debt, and for expenditure in the way of Allah and for the wayfarer. This is an obligation from Allah. Allah is All-Knowing, All-Wise.
টিকা:৬১) ফকির এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে নিজের জীবিকার ব্যাপারে অন্যের মুখাপেক্ষী। কোন শারীরিক ত্রুটি বা বার্ধ্যক্যজনিত করণে কেউ স্থায়ীভাবে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে অথবা কোন সাময়িক কারণে আপাতত কোন ব্যক্তি অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে এবং সাহায্য সহায়তা পেলে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, এ পর্যায়ের সব ধরনের অভাবী লোকের জন্য সাধারণভাবে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এতীম শিশু, বিধবা নারী, উপার্জনহীন বেকার এবং এমন সব লোক যারা সাময়িক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
টিকা:৬২) মিসকীন শব্দের মধ্যে দ্বীনতা, দুর্ভাগ্য পীড়িত অভাব, অসহায়তা ও লাঞ্ছনা অর্থ নিহিত রয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে সাধারণ অভাবীদের চাইতে যাদের অবস্থা বেশী খারাপ তারাই মিসকীন। নবী (সা.) এ শব্দটির ব্যাখ্যা করে বিশেষ করে এমন সব লোকদেরকে সাহায্য লাভের অধিকারী গণ্য করেছেন, যারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপায়-উপকরণ লাভ করতে পারেনি, ফলে অত্যন্ত অভাব ও দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু তাদের পদমর্যাদা সচেতনতা কারোর সামনে তাদের হাত পাতার অনুমতি দেয় না। আবার তাদের বাহ্যিক অবস্থাও এমন নয় যে, কেউ তাদেরকে দেখে অভাবী মনে করবে এবং সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিবে। হাদীসে এভাবে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ
الْمِسْكِينُ الَّذِى لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ ، وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ ، وَلاَ يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ
"যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ পায় না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং যে নিজে দাঁড়িয়ে কারোর কাছে সাহায্যও চায় না, সে-ই মিসকীন” অর্থাৎ সে একজন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র গরীব মানুষ।
টিকা:৬৩) অর্থাৎ যারা সাদকা আদায় করা, আদায় করা ধন-সম্পদ সংরক্ষণ করা, সে সবের হিসেব-নিকেশ করা, খাতাপত্রে লেখা এবং লোকদের মধ্যে বণ্টন করার কাজে সরকারের পক্ষ থেকে নিযুক্ত থাকে। ফকীর বা মিসকীন না হলেও এসব লোকের বেতন সর্বাবস্থায় সাদকার খাত থেকে দেয়া হবে। এখানে উচ্চারিত এ শব্দগুলো এবং এ সুরার ১০৩ আয়াতের শব্দাবলী خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً(তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদাকা উসূল করো) একথাই প্রমাণ করে, যে, যাকাত আদায় ও বণ্টন ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, নবী ﷺ খোদ নিজের ও নিজের বংশের (বনী হাশেম) ওপর যাকাতের মাল হারাম ঘোষণা করেছিলেন। কাজেই তিনি নিজে সবসময় বিনা পারিশ্রমিকে যাকাত আদায় ও বন্টনের কাজ করেন। বনী হাশেমদের অন্য লোকদের জন্যও তিনি এ নীতি নির্ধারণ করে যান। তিনি বলে যান, তারা যদি বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করে তাহলে এটা তাদের জন্য ধৈর্য। আর পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এ বিভাগের কোন কাজ করলে তা তাদের জন্য বৈধ নয়। তার বংশের কোন লোক যদি সাহেব নেসাব (অর্থাৎ কমপক্ষে যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দেয়া ফরয) হয়, তাহলে তার ওপর যাকাত দেয়া ফরয হবে। কিন্তু যদি সে গরীব, অভাবী, ঋণগ্রস্ত ও মুসাফির হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য যাকাত নেয়া হারাম হবে। তবে বনী হাশেমদের নিজেদের যাকাত বনি হাশেমরা নিতে পারবে কিনা এবং ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। ইমাম আবু ইউসুফের মতে, নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ তাও না জায়েজ বলে মত প্রকাশ করেন।
টিকা:৬৪) মন জয় করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করার যে হুকুম এখানে দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা ইসলামের বিরোধীতায় ব্যাপকভাবে তৎপর এবং অর্থ দিয়ে যাদের শত্রুতার তীব্রতা ও উগ্রতা হ্রাস করা যেতে পারে অথবা যারা কাফেরদের শিবিরে অবস্থান করেছে ঠিকই কিন্তু অর্থের সাহায্যে সেখান থেকে ভাগিয়ে এনে মুসলমানদের দলে ভিড়িয়ে দিলে তারা মুসলমানদের সাহায্যকারী হতে পারে কিংবা যারা সবেমাত্র ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং তাদের পূর্বেকার শত্রুতা বা দুর্বলতাগুলো দেখে আশঙ্কা জাগে যে, অর্থ দিয়ে তাদের বশীভূত না করলে তারা আবার কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, এ ধরনের লোকেদেরকে স্থায়ীভাবে বৃত্তি দিয়ে বা সাময়িকভাবে এককালীন দানের মাধ্যমে ইসলামের সমর্থক ও সাহায্যকারী অথবা বাধ্য ও অনুগত কিংবা কমপক্ষে এমন শত্রুতে পরিণত করা যায়, যারা কোন প্রকার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। এ খাতে গণিমতের মাল ও অন্যান্য উপায়ে অর্জিত অর্থ থেকেও ব্যয় করা যেতে পারে এবং প্রয়োজন হলে যাকাতের তহবিল থেকেও ব্যয় করা যায়। এ ধরনের লোকদের জন্য, ফকির, মিসকিন বা মুসাফির হবার শর্ত নেই। বরং ধনী ও বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও তাদের যাকাত দেয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, নবী (সা.) এর আমলে তালীফে কলব, তথা মন জয় করার উদ্দেশ্যে বহু লোককে বৃত্তি দেয়া এবং এককালীন দান করা হতো। কিন্তু তার পরেও এ খাতটি অপরিবর্তিত ও অব্যাহত রয়েছে কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম আবু হানিফা (র) ও তার সহযোগীদের মতে, হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমরের(রা.) আমল থেকে এ খাতটি রহিত হয়ে গেছে। কাজেই এখন তালীফে কলবের জন্য কাউকে কিছু দেয়া জায়েজ নয়। ইমাম শাফেয়ীর (র) মতে তালীফে কলবের উদ্দেশ্যে ফাসেক মুসলমানদেরকে যাকাত তহবিল থেকে দেয়া যেতে পারে কিন্তু কাফেরদের দেয়া যেতে পারে না। অন্যান্য কতিপয় ফকীহের মতে, মুআল্লাফাতুল কুলুব, (যাদের মন জয় করা ইস্পিত হয়) এর খাত আজও অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজন দেখা দিলে এ খাতে ব্যয় করা যেতে পারে।
হানাফীগণ এ প্রসঙ্গে প্রমাণ উপস্থাপন করে বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর উয়ইনা ইবনে হিসন ও আকরা ইবনে হাবেস হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে আসে এবং তাঁর কাছে একটি জমি চায়। তিনি তাদেরকে জমিটির একটি দানপত্র লিখে দেন। তারা এ দানপত্রকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য অন্যান্য প্রধান সাহাবীগণের সাক্ষ্যও এতে সন্নিবেশ করতে চায়। সেমতে অনেক সাক্ষ্য সংগৃহীত হয়ে যায়। কিন্তু তারা যখন হযরত উমরের (রা.) কাছে সাক্ষ্য নিতে যায় তখন তিনি দানপত্রটি পড়ে তাদের সামনেই সেটি ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি তাদেরকে বলেন, অবশ্যই তালীফে কলব করার জন্য নবী (সা.) তোমাদের দান করতেন। কিন্তু তখন ছিল ইসলামের দুর্বলতার যুগ। আর এখন আল্লাহ ইসলামকে তোমাদের মতো, লোকদের প্রতি নির্ভরতা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। এ ঘটনার পর তারা হযরত আবু বকরের (রা.) এর কাছে এসে অভিযোগ করে এবং তাকে টিটকারী দিয়ে বলেঃ খলীফা কি আপনি, না উমর? কিন্তু হযরত আবু বকর নিজেও এর কোন প্রতিবাদ করেননি। কিংবা অন্যান্য সাহাবীদের একজনও হযরত উমরের এ মতের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেননি। এ থেকে হানাফিগণ এ মর্মে প্রমাণ পেশ করেছেন, যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি তারা অর্জন করেছে তখন যে কারণে প্রথম দিকে মুআল্লাফাতুল কুলূবের অংশ রাখা হয় তা আর বর্তমান রইলো না। এ কারণে সাহাবীগণের ইজমার মাধ্যমে এ অংশটি চিরকালের জন্য বাতিল হয়ে গেছে।
ইমাম শাফিয়ী (র) এ প্রসঙ্গে প্রমাণ পেশ করে বলেন, তালীফে কলব, এর জন্য যাকাতের মাল দেবার ব্যাপারটা নবী (সা.) এর কর্মকাণ্ড থেকে প্রমাণিত নয়। হাদীসে আমরা যতগুলো ঘটনা পাই তা থেকে একথাই জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ তালীফে কলবের জন্য কাফেরদেরকে যা কিছু দেবার তা গণিমতের মাল থেকেই দিয়েছেন, যাকাতের মাল থেকে দেননি।
আমাদের মতে প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুআল্লাফাতুল কুলুবের অংশ কিয়ামত পর্যন্ত বাতিল হবার কোন প্রমাণ নেই। হযরত উমর (রা.) যা কিছু বলেছেন তা নিঃসন্দেহে পুরোপুরি সঠিক ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র যদি তালীফে কলবের জন্য অর্থ-ব্যয় করার প্রয়োজন নেই মনে করে, তাহলেও এ খাতে কিছু ব্যয় করতেই হবে এমন কোন ফরয তার ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। কিন্তু কখনো প্রয়োজন দেখা দিলে যাতে ব্যয় করা যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ যে অবকাশ রেখেছেন তা অবশ্যই অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত। হযরত উমর ও সাহাবায়ে কেরামের যে বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল তা ছিল মূলত এই যে, তাদের আমলে যে অবস্থা ছিল তাতে তালীফে কলবের জন্য কাউকে কিছু দেবার প্রয়োজন তারা অনুভব করতেন না। কাজেই কোন গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী স্বার্থ তথা প্রয়োজন ও কল্যাণের খাতিরে কুরআনে যে খাতটি রাখা হয়েছিল, সাহাবীগণের মতৈক্য তাকে খতম করে দিয়েছে বলে সিদ্ধান্তে আসার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
অন্যদিকে ইমাম শাফেয়ীর অভিমতটি অবশ্যই এতটুকু পর্যন্ত তো সঠিক মনে হয় যে, সরকারের কাছে যখন অন্যান্য খাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ-সম্পদ মওজুদ থাকে তখন তালীফে কলবের খাতে তার যাকাতের অর্থ-সম্পদ ব্যয় না করা উচিত। কিন্তু যখন যাকাতের অর্থ-সম্পদ থেকে এ খাতে সাহায্য নেবার প্রয়োজন দেখা দেবে তখন তা ফাসেকদের জন্য ব্যয় করা যাবে, কাফেরদের জন্য ব্যয় করা যাবে না, এ ধরনের পার্থক্য কারার কোন কারণই সেখানে নেই। কারণ কুরআনে মুআল্লাফাতুল কূলুবের যে অংশ রাখা হয়েছে, তা তাদের ঈমানের দাবীর কারণে নয়। বরং এর কারণ হচ্ছে, ইসলাম নিজের প্রয়োজনে তাদের তালীফে কলব তথা মন জয় করতে চায়। আর শুধুমাত্র অর্থের সাহায্যেই এ ধরনের লোকদের মন জয় করা যেতে পারে। এ প্রয়োজন ও এ গুণ-বৈশিষ্ট্য যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই মুসলমানদের সরকার কুরআনের বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার অধিকার রাখে। নবী (সা.) এ খাত থেকে কাফেরদের কিছুই দেননি। এর কারণ তার কাছে অন্য খাতে অর্থ ছিল। নয়তো এ খাত থেকে কাফেরদেরকে দেয়া যদি অবৈধ হতো তাহলে তিনি একথা সুস্পষ্ট করে বলে দিতেন।
টিকা:৬৫) দাসদেরকে দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা দু’ভাবে হতে পারে। এক, যে দাস তার মালিকের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছে যে, সে একটা বিশেষ পরিমাণ অর্থ আদায় করলে মালিক তাকে দাসত্ব মুক্ত করে দেবে। তাকে দাসত্ব মুক্তির এ মূল্য আদায় করতে যাকাত থেকে সাহায্য করা যায়। দুই, যাকাতের অর্থে দাস কিনে তাকে মুক্ত করে দেয়া। এর মধ্যে প্রথমটির ব্যাপারে সকল ফকীহ একমত। কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থাটিকে হযরত আলী(রা.) সাঈদ ইবনে জুবাইর, লাইস, সাওরী, ইবরাহীম নাখয়ী, শাবী, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন, হানাফী ও শাফেয়ীগণ নাজায়েজ গণ্য করেন অন্যদিকে ইবনে আব্বাস (রা.) হাসান বসরী, মালেক, আহমদ ও আবু সাওর একে জায়েয মনে করেন।
টিকা:৬৬) অর্থাৎ এমন ধরনের ঋণগ্রস্ত, যারা নিজেদের সমস্ত ঋণ আদায় করে দিলে তাদের কাছে নেসাবের চাইতে কম পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে। তারা অর্থ উপার্জনকারী হোক বা বেকার, আবার সাধারণ্যে তাদের ফকীর মনে করা হোক বা ধনী। উভয় অবস্থায় যাকাতের খাত থেকে তাদেরকে সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক ফকীহ এ মত পোষণ করেছেন যে, অসৎকাজে ও অমিতব্যয়িতা করে যারা নিজেদের টাকা পয়সা উড়িয়ে দিয়ে ঋণের ভারে ডুবে মরছে, তাওবা না করা পর্যন্ত তাদের সাহায্য করা যাবে না।
টিকা:৬৭) আল্লাহর পথে শব্দ দু’টি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব সৎকাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এমন সমস্ত কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে কেউ কেউ এমত পোষণ করেছেন যে, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে যাকাতের অর্থ যে কোন সৎকাজে ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম যুগের ইমামগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে মত পোষণ করেছে সেটিই যথার্থ সত্য। তাদের মতে এখানে আল্লাহর পথে বলতে আল্লাহর পথে জিহাদ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য কুফরী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। যেসব লোক এ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম রত থাকে, তারা নিজেরা সচ্ছল ও অবস্থা সম্পন্ন হলেও এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন না থাকলেও তাদের সফর খরচ বাবদ এবং বাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। অনুরূপ ভাবে যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সমস্ত সময় ও শ্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়োজিত করে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যও যাকাতের অর্থ এককালীন বা নিয়মিত ব্যয় করা যেতে পারে।
এখানে আর একটি কথা অনুধাবন করতে হবে। প্রথম যুগের ইমামগণের বক্তব্য সাধারণত এক্ষেত্রে গাযওয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি যুদ্ধের সমর্থক। তাই লোকেরা মনে করে যাকাতের ব্যয় খাতে ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর পথের যে খাত রাখা হয়েছে তা শুধু যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু আসলে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ যুদ্ধ বিগ্রহের চাইতে আরো ব্যাপকতর জিনিসের নাম। কুফরের বাণীকে অবদমিত এবং আল্লাহর বাণীকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করা আর আল্লাহর দ্বীনকে একটি জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে কায়েম করার জন্য দাওয়াত ও প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে অথবা যুদ্ধ বিগ্রহের চরম পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা ও কাজ করা হয়, তা সবই এ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর আওতাভুক্ত।
টিকা:৬৮) মুসাফির তার নিজের গৃহে ধনী হলেও সফরের মধ্যে সে যদি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে তাহলে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে। এখানে কোন কোন ফকীহ শর্ত আরোপ করেছেন, অসৎকাজ করা যার সফরের উদ্দেশ্য নয় কেবল মাত্র সেই ব্যক্তিই এ আয়াতের প্রেক্ষিতে সাহায্য লাভের অধিকারী হবে। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের কোথাও এ ধরনের কোন শর্ত নেই। অন্যদিকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি, যে ব্যক্তি অভাবী ও সাহায্য লাভের মুখাপেক্ষী তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে তার পাপাচার বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে গোনাহগার ও অসৎ চরিত্রের লোকদেরকে বিপদে সাহায্য করলে এবং ভাল ও উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের চরিত্র সংশোধন করার প্রচেষ্টা চালালে তা তাদের চরিত্র সংশোধনের সবচেয়ে বড় উপায় হতে পারে।
(তাফহীমুল কুরআন - সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রাহ:)
No comments:
Post a Comment