Showing posts with label qurbani. Show all posts
Showing posts with label qurbani. Show all posts

প্রশ্ন: ৩৪৭ : হযরত ইবরাহীম আ: এর কুরবানী।

•৷• কুরবানীর ইতিহাস •৷•
.
কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আল্লাহ তায়ালার এ বিধান মানব জাতির সৃষ্টি লগ্ন থেকেই কার্যকর হয়ে আসছে। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোন ভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে। এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব বা ফিতরাত। এ ফিতরাতের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন-
.
وَلِـكُلِّ اُمَّةٍ جَعَـلْـنَا مَنْسَكًا لِّـيَـذْكُرُوْا اسْمَ اللهِ عَلى مَـا رَزَقَـهُمْ مِنْ بَـهِيـْمَةِ الْاَنْـعَـامِ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন”। [সূরা আল হজ্জ-৩৪]
.
● পৃথিবীর প্রথম কুরবানী
.
যখন আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়, তখন হাওয়া (আ.) এর গর্ভ থেকে প্রতিবার (জমজ) অর্থাৎ একসাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ জময সন্তান জন্মগ্রহণ করত। কেবল শীস (আ.) ব্যতিরেকে। তিনি একা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। তখন ভাই-বোন ছাড়া আদম (আ.) এর আর কোন সন্তান ছিল না। অথচ ভাই-বোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.) এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহনকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীনি কন্যা সহোদরা বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। সুতরাং সে সময় আদম (আ.) একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবীলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম ছিল আকলিমা। কিন্তু হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। তার নাম ছিল লিওযা।
.
বিবাহের সময় হলে শরয়ী ‘নিয়মানুযায়ী হাবীলের সহোদরা বোন কাবীলের জন্য নির্ধারিত হল। কিন্তু কাবীল লিওযাকে প্রত্যাখ্যান করে নিজের সহোদরা বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে চাইল। আদম (আ.) তৎকালীন শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবীলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তার নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন। তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিল না।
.
অবশেষে আদম (আ.) তার এ দুই সন্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর, যার কুরবানী গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।’ সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীকে ভষ্মীভূত করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবুল হতো না তারটা পড়ে থকত।
যাহোক, তাদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- কাবীল ছিল চাষী। তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভাল গুলো বের করে নিয়ে খারাপ গুলোর একটি আটি কুরবানীর জন্য পেশ করল। আর হাবীল ছিল পশুপালনকারী। সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে ভাল একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবীলের কুরবানীটি ভষ্মীভুত করে দিল। আর কাবীলের কুরবানী যথাস্থানেই পড়ে থাকল। অর্থাৎ হাবীলেরটি গৃহীত হলো আর কাবীলেরটি হলো না। কিন্তু কাবীল এ আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। এ অকৃতকার্যতায় কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল, এতে কাবীলের প্রতি তার সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। হাবীল বলেছিল, ‘ তিনি মুত্তাক্বীর কর্মই গ্রহণ করেন। সুতরাং তুমি তাক্বওয়ার কর্মই গ্রহণ করো। তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করলে তোমার কুরবানীও গৃহীত হতো। তুমি তা করোনি, তাই তোমার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কোথায়?.....তবুও এক পর্যায়ে কাবীল হাবীল কে হত্যা করে ফেলল। (তাফসীর ইবনু কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩/৪৫ ও ফতহুল ক্বাদীর, ২/২৮-২৯)
.
হাবিল ও কাবিলের অর্থাত সর্ব প্রথম কুরবানীর ঘটনা পবিত্র কুরআনে এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে -
وَاتْلُ عَلَيْـهِمْ نَبَاَ ابْـنَـىْ ادَمَ بِـالْـحَـقِّ- اِذْ قَـرَّبَـا قُـرْبَانًا فَـتُـقُـبِّـلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَلَمْ يُـتَـقَبَّلْ مِنَ الْاخَرِ- قَالَ لَاَقْتُلَـنَّكَ- قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ- لَئِنْ بَسَطْتَّ اِلَىَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِىْ مَا اَنَا بِبَاسِطٍ يَّدِىَ اِلَيْكَ لِاَ قْتُلَكَ- اِنِّىْ اَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعلَمِيْنَ- اِنِّىْ اُرِيْدُ اَنْ تَبُـوْاَ بِـاِثْمِىْ وَاِثْمِكَ فَتَكُـوْنَ مِن اَصْحبِ النَـارِ- وَذلِكَ جَزؤُ الظّلِمِيْنَ- فَطَوَّعَتْ لَـهُ نَـفْسُه قَـتْلَ اَخِـيْـهِ فَقَـتَـلَهُ فَاَصْبَحَ مِنَ الْـخسِرِيْنَ- فَبَـعَـثَ اللهُ غُـرَابًا يَبْحَثُ فِى الْاَرْضِ لِيُرِيَهُ كَـيْـفَ يُـوَارِىْ سَـوْءَةَ اَخِيْهِ- قَالَ يـوَ يْلَتـى اَعَجَزْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِـثْلَ هـذَا الْغُرَابِ فَاُوَارِىَ سَـوْءَةً– فَاَصْبَحَ مِنَ النّدِمِيْنَ “আপনি তাদেরকে আদমের দু’ পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। (তা হচ্ছে এই যে,) যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহীত হল আর অপর জনের কুরবানী গৃহীত হলোনা। তখন সে ভাইকে বলল- অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বলল আল্লাহ তো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। নিশ্চয়ই আমি বিশ্ব জগতের পালন কর্তা আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অত:পর তুমি দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতি গ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সে কিভাবে সমাহিত করবে। সে বললো, আফসোস! আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সমাহিত করি! অত:পর সে অনুতাপ করতে লাগল”। [ সূরা আল মায়িদাহ, ২৭-৩১ আয়াত ]
.
কুরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসে আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানী দাতা ‘হাবীল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কুরবানী হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কুরবানী কবুল হয়। পক্ষান্তরে কাবীল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কুরবানী কবুল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন -
﴿ وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ فَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞ فَلَهُۥٓ أَسۡلِمُواْۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُخۡبِتِينَ ٣٤ ﴾ [الحج: ٣٤]
প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। [সূরা হাজ্জ (২২):৩৪]।
.
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, ‘আদম (আ.) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। (তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯; কাশশাফ, ২/৩৩)।
.
আদম (আ.) এর যুগে তারই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর থেকে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ইতিহাস ততটা প্রাচীন যতটা প্রাচীন দ্বীন-ধর্ম অথবা মানবজাতির ইতিহাস। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানী করার বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। তবে ঐসব কুরবানীর কোন বর্ণনা কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। মূলত সেসব কুরবানীর নিয়ম-কানুন আমাদেরকে জানানো হয়নি।
.
.
● বর্তমান কুরবানীর ইতিহাস
.
পবিত্র কুরআনে এসেছে - ﴿ رَبِّ هَبۡ لِي مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٠٠ فَبَشَّرۡنَٰهُ بِغُلَٰمٍ حَلِيمٖ ١٠١ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡيَ قَالَ يَٰبُنَيَّ إِنِّيٓ أَرَىٰ فِي ٱلۡمَنَامِ أَنِّيٓ أَذۡبَحُكَ فَٱنظُرۡ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَٰٓأَبَتِ ٱفۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُۖ سَتَجِدُنِيٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٠٢ فَلَمَّآ أَسۡلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلۡجَبِينِ ١٠٣ وَنَٰدَيۡنَٰهُ أَن يَٰٓإِبۡرَٰهِيمُ ١٠٤ قَدۡ صَدَّقۡتَ ٱلرُّءۡيَآۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٠٥ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلۡبَلَٰٓؤُاْ ٱلۡمُبِينُ ١٠٦ وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيمٖ ١٠٧ وَتَرَكۡنَا عَلَيۡهِ فِي ٱلۡأٓخِرِينَ ١٠٨ سَلَٰمٌ عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ ١٠٩ كَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١١٠ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١١١ ﴾ [الصافات: ١٠٠، ١١١] [
ইব্রাহীম (আ.) যখন আমার কাছে দু‘আ করল] হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে এক সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক অতি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইবরাহীম বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি, এখন বল, তোমার অভিমত কী? সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন। দু‘জনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহীম তাকে কাত ক‘রে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, ‘হে ইবরাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেই ছাড়লে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবাণীর বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাঁকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! সৎকর্মশীলদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার মু‘মিন বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা আস- সাফফাত:১০০-১১১]।
.
কুরবানী ইবাদত হিসেবে যদিও আদম আ. এর যুগ হতে হয়ে আসছে কিন্তু পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম আ. এর এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে শুরু হয়েছে। আমরা হযরত ইবরাহীম আ. এর মিল্লাতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। এ মিল্লাতের প্রতিষ্ঠাতা ও মুসলিম জাতির পিতা হচ্ছেন হযরত ইবরাহীম আ.। তিনি যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু- পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আয্হার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের প্রিয় জান-মাল আল্লাহর পথে কুরবানী করার সাক্ষ্য প্রদান করেন।
.
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আ. এর সেই মহত্ব ও মাকবুল কুরবানীকে শাশ্বত রূপদানের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা. এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আয্হা উপহার দিয়েছেন এবং এ কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম আ. কর্তৃক স্বীয় পুত্র ইসমাঈলের কুরবানীর জীবন্ত ইতিহাস।
.
আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত ইব্রাহীম আঃ এর স্ত্রী সারা আঃ নিজেকে বন্ধা মনে করতেন৷ উল্লেখ্য যে, ইব্রাহীম আঃ এবং সারা আঃ এর সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে কোন সন্তান ছিল না৷ এমনাবস্থায় সারা আঃ ইব্রাহীম আঃ কে সারা আঃ এর দাসী হাজেরাকে বিয়ে করার পরামর্শ দেন৷ হযরত ইব্রাহীম আঃ হাজেরাকে আজাদ করে দিয়ে তাকে বিয়ে করলেন। হযরত লূত আ. যিনি ইতিপূর্বে তাঁর উপর ঈমান এনেছিলেন তাকে সাথে নিয়ে নিজ জন্মভূমি ইরাক থেকে হিজরত করে ফিলিস্তিনের কেনানে অবস্থান নিলেন। ৮৬ বৎসর বয়সে সেখানে বসে সন্তানের জন্য দোয়া করলেন।
.
رَبِّ هَـبْ لِىْ مِـنَ الـصَّالِـحِيْـنَ
“হে আল্লাহ আমাকে সৎকর্মপরায়ন পুত্র দান করুন”। [সূরা আসসাফ্ফাত-১০০]
.
এর কিছুকাল পরেই হযরত হাজেরা আঃ এর গর্ভ থেকে হযরত ইসমাঈল আঃ জন্মগ্রহণ করেন৷
.
ইব্রাহিম আঃ আল্লাহর নির্দেশে ইসমাঈল আঃ এবং হাজেরা আঃ কে মক্কায় রেখে আসার জন্য রওনা হন৷ পথ চলতে চলতে তারা বাইতুল্লাহ শরীফের নিকট পৌছালে ইব্রাহিম আঃ স্ত্রী, সন্তানকে একটি গাছের নিচে বসিয়ে দেন৷ এরপর হযরত হাজেরা আঃ কে একটি ঝুলি দিলেন, যাতে কিছু খেজুর ও এক মশক পানি ছিল৷ হযরত ইসমাঈল আঃ তখনও দুগ্ধপৌষ্য শিশু ছিলেন৷ জনমানবহীন মরুভুমিতে প্রিয়তমা স্ত্রী এবং প্রাণপ্রিয় একমাত্র সন্তানকে রেখে যখন ইব্রাহিম আঃ ফিরে যাবার জন্য জন্য রওনা হলেন তখন হযরত হাজেরা আঃ প্রশ্ন করলেন, আমাদের এখানে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? . হযরত ইব্রাহীম আঃ কোন জবাব দিলেন না বিধায় হযরত হাজেরা আঃ আবার একই প্রশ্ন করলেন৷ ইব্রাহীম আঃ তবু জবাব দিলেন না৷ হযরত হাজেরা আঃ ইব্রাহীম আঃ এর পিছন পিছন আসছিলেন এবং একই প্রশ্ন বারবার করলেন৷ কিন্তু কোন জবাব না পেয়ে জিগ্যেস করলেন, আমাদের কি আল্লাহর নির্দেশে রেখে যাচ্ছেন?
হযরত ইব্রাহীম আঃ এবার জবাবে হ্যাঁ বললেন৷ তখন হাজেরা আঃ বললেন, তাহলে আমাদের কোন চিন্তা নেই৷ আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।
.
এরপর হযরত হাজেরা আঃ সন্তানের নিকট ফিরে গেলেন এবং স্বামীর পথ পানে অপলক তাকিয়ে রইলেন৷ হযরত ইব্রাহীম আঃ চলতেই থাকলেন৷ একবারও পিছনে তাকালেন না৷ যেন এমন না হয় যে, পিতৃমন উথলিয়ে উঠে এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কোন প্রকার বিচ্যুতি ঘটে যায়। হাজেরা আঃ এর দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবার পর ইব্রাহীম আঃ কিবলামুখী হয়ে দোয়া করলেন:
رَبَّناَ اِنِّىْ اَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِىْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِىْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ- رَبَّنَا لِيُقِيْمُوْا الصَّلوةَ فَا جْعَلْ اَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِىْ اِلَيْهِمْ وَاَرْزُقْهُمْ مِّنَ الثَمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ
“হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক বংশধরকে আপনার পবিত্র ঘরের নিকট অনাবাদ জায়গায় বসবাস করালাম। হে আমাদের পালনকর্তা! যেন তারা নামায কায়েম করে। অত:পর আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদের ফল ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন। সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে”। [সূরা আল ইবরাহীম -৩৭]
.
এদিকে হযরত হাজেরা আঃ মশকের পানি পান করা ও শিশু ইসমাঈল আঃ কে স্তন্য দান করেই দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। এক সময় পানি ফুরিয়ে গেল। তিনি নিজেও পিপাসা অনুভব করছিলেন এবং শিশু ইসমাঈলের পানির পিপাসা দেখে তিনি খুবই পেরেশান হয়ে গেলেন। পানির জন্য ব্যাকুল হয়ে হযরত হাজেরা আঃ শিশু ইব্রাহীম আঃ কে রেখে দৌড়ে সাফা পাহাড়ে ওঠে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর দেখলেন। কিন্তু ধু ধু মরুদ্যানে কোথাও পানি বা কোন কাফেলা দেখতে পারলেন না। এরপর তিনি দৌড়ে সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ের চূড়ায় ওঠেও কোথাও পানি বা কাফেলা দেখতে পেলেন না। এভাবে তিনি সাফা ও মারওয়ায় সাতবার দৌড়া দৌড়ি করলেন।
.
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ নবী করিম সাঃ থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত হাজেরা আঃ একজন ভবিষত নবীকে বাঁচানোর জন্য সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ব্যাকুল হয়ে দৌড়া দৌড়ির করেছন - এ দৃশ্য আল্লাহর নিকট খুব ভাল লেগেছে। তাই এ দৃশ্যটি কিয়ামত পর্যন্ত ধরে রাখার জন্যই আল্লাহ তায়ালা হাজীদের জন্য সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে (হযরত হাজেরা আঃ এর মত সাতবার) দৌড়া দৌড়ির বিধান (ওয়াজিব) করেছেন। শরীয়তের পরিভাষায় যাকে সা'য়ী বলা হয়।
.
হযরত হাজেরা আঃ সপ্তমবার যখন মারওয়া পাহাড়ে পৌছান তখন এক আওয়াজ শুনে চুপ হয়ে গেলেন এবং বললেন, আমি তো আওয়াজ শুনছি কিন্তু তুমি কে? তোমার কাছে পিপাসা নিবারনের কোন উপায় থাকলে বলে দাও। আমার ছেলে পিপাসায় কাতর হয়ে গেছে। এমন সময় হযরত হাজেরা আঃ "যমযম" নামক স্থানে মানুষরুপী এক ফেরেস্তাকে দেখতে পেলেন। সেই ফেরেস্তা পায়ের গোড়ালী দ্বারা যমীনে আঘাত করতেই যমীন ফুড়ে ঝড়নার মতো পানি বের হতে শুরু করল। তখন হযরত হাজেরা আঃ প্রথমে শিশু ইসমাঈল আঃ কে সেই পানি পান করালেন অতঃপর নিজে পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। ফেরেস্তাটি হযরত হাজেরা আঃ কে সান্তনার সুরে বললেন, তোমরা মরে যাবার আশংকা করো না। এখানে আল্লাহর ঘর আছে, যে ঘর এই শিশু এবং তার পিতা একসময় নির্মাণ করবে। আল্লাহ তায়ালা তার ঘরের নির্মাতাদের কখনও ধ্বংস করবেন না। . হযরত ইব্রাহীম আঃ মাঝে মাঝেই শাম (ইরাক) থেকে মক্কায় আসতেন। হযরত ইব্রাহীম আঃ হযরত ইসমাঈল আঃ কে অনেক ভালবাসতেন। ইসমাঈল আঃ কে কাছাকাছি রাখতেন। এভাবেই ইসমাঈল আঃ বড় হতে লাগলেন।
.
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡي َ
‘এবং যখন সে তার সাথে হাটার মত বড় হলো’ - এর অর্থ হচ্ছে, যখন সে বড় হয়েছিল এবং তার বাবার মতই নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে পারত। মুজাহিদ (রাহ.) বলেন, ‘এবং যখন সে তার সাথে হাঁটার মত বড় হলো’ এর অর্থ হচ্ছে, যখন সে বড় হয়ে উঠেছিল এবং বাহনে চড়তে পারত, হাঁটতে পারত এবং তার বাবার সাথে কাজ করতে পারত। যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ০৭ বছর ছিল। ফার্রা বলেন, যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আববাস (রা.) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবলকত্বে উপনীত হয়েছিলেন। (তাফসীর কুরতুবী, ১৫/৯৯) এ রকম একটা অবস্থা যখন আসল, তখন একদিন হযরত ইব্রাহীম আঃ স্বপ্নে দেখলেন, তিনি কুরবানী করার জন্য হযরত ইসমাঈল আঃ এর গলায় ছুরি চালাচ্ছেন৷ সেদিন ছিল যিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখের রাত৷ হযরত ইব্রাহীম আঃ সকালে ঘুম থেকে উঠে সারাদিন চিন্তা করলেন, স্বপ্নটা আল্লাহর পক্ষ থেকে না কি শয়তানের পক্ষ থেকে? এ কারনে যিলহজ্বের ৮ তারিখকে ইয়াওমুত তারবিয়া বা চিন্তা/সংশয়ের দিন বলা হয়৷ পরের রাতেও একই স্বপ্ন দেখায় ইব্রাহীম আঃ নিশ্চিত হলেন এ স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকেই দেখানো হয়েছে৷ এ কারনে যিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখকে ইয়াওমে আরাফা বা সংশয়মুক্ত হওয়ার দিন বলা হয়৷
.
ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, যখন হযরত ইব্রাহীম আঃ প্রতি স্বীয় পূত্র হযরত ইসমাঈল আঃ কে কুরবানি করার নির্দেশ দেয়া হল তখন তিনি পূত্রকে বললেন, রশি ও ছুরি নাও, চলো আমরা ঐ পাহাড় থেকে খড়ি কেটে আনি৷ হযরত ইসমাঈল আঃ রশি ও ছুরি নিয়ে পিতার সাথে রওয়ানা হয়ে গেলেন৷
.
কা'বে আহবাব রহঃ হযরত আবু হুরাইরা রাঃ এবং মুহাম্মদ বিন ইসহাক রহঃ বিভিন্ন রাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ইব্রাহীম আঃ যখন পুত্রকে কুরবানী করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, তখন ইবলিস মনে মনে ভাবল এই মূহুর্তে যদি আমি হাজেরা আঃ কে বিপথে পরিচালিত করতে না পারি, তাহলে আর কখনও তার সন্তানদের প্রতারিত করতে পারবো না৷ . তাই শয়তান এক সাধু পুরুষের ছদ্মবেশে হযরত হাজেরা আঃ এর কাছে এসে বললো, তুমি কি জানো, তোমার স্বামী ইসমাঈলকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
হযরত হাজেরা আঃ বললেন, কেন? তারা তো পাহাড়ে খড়ি কাটতে যাচ্ছে৷
শয়তান বলল, খোদার কসম ঘটনা এমন নয়৷ তোমার স্বামী ইসমাঈলকে কুরবানী করার উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছে৷
হযরত হাজেরা আঃ বললেন, তা হতে পারে না৷ তিনি তো ছেলেকে খুব ভালবাসেন৷ ছেলের মুহাব্বত তার অন্তরে খুব বেশী৷ এত মুহাব্বতের জিনিসকে কেউ জবাই করতে পারে না৷ সুতরাং আমার স্বামী তা কখনই করবে না৷
নিরুপায় শয়তান বলল, হযরত ইব্রাহীম আঃ বলছেন তাকে না কি তার প্রভু তোমার পুত্রকে জবাই করার নির্দেশ দিয়েছেন৷
এ কথা শুনে হযরত হাজেরা আঃ বললেন, যদি তার প্রভুই তাকে এ নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে তো প্রভুর এ নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা উচিত৷ এমন হলো আমিও তাকে সহযোগিতা করব৷
.
হযরত হাজেরা আঃ এর নিকট হতে নিরাশ হয়ে শয়তান ইব্রাহীম আঃ এর পিছন পিছন চলা ইসমাঈল আঃ কে বলল, হে বৎস! তুমি কি জান তোমার পিতা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
হযরত ইসমাঈল আঃ জবাবে বললেন, আমরা খড়ি কাটার জন্য পাহাড়ে যাচ্ছি৷
শয়তান বলল, খোদার কসম তোমার পিতার উদ্দেশ্য কখনও তা নয়৷ বরং তিনি তোমাকে ঐ পাহাড়ের জবাই করে ফেলবে৷
ইসমাঈল আঃ কারন জানতে চেয়ে বললেন, কেন?
শয়তান বলল, তার ধারনা তার প্রভুই নাকি তাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন৷
হযরত ইসমাঈল আঃ বললেন, যদি তাই হয় তাহলে তো তার জন্য তার প্রভুর নির্দেশ মান্য করা অতীব জরুরী৷ আর এ ব্যাপারে আমিও রাজি আছি৷
বালক ইসমাঈল আঃ এর এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেল৷
অনেকক্ষন চিন্তা করে শয়তান ইব্রাহীম আঃ এর নিকট গিয়ে বললো, জনাব! কোথায় যাচ্ছেন?
ইব্রাহীম আঃ জবাবে বললেন, বিশেষ এক উদ্দেশ্যে পাহাড়ে যাচ্ছি।
শয়তান বললো, খোদার কসম! আমি জানি শয়তানই আপনাকে এ স্বপ্ন দেখিয়েছে। এটা কখনও আল্লাহর পক্ষ থেকে না। উক্ত স্বপ্ন অনুযায়ী আপনি কাজ করলে চরম ভুল করবেন। আর ছেলের শোকে আজীবন কাঁদবেন। আমি আল্লাহর এক বান্দা আপনাকে ভুল থেকে ফিরাতে এসেছি।
হযরত ইব্রাহীম আঃ ইলমে নববী দ্বারা বুঝতে পারলেন যে, এ ব্যক্তি শয়তান ছাড়া আর কেউ না। তাই তিনি শয়তানকে বললেন, হে অভিশপ্ত! তুই দূর হয়ে যা। আমি অবশ্যই আমার মাওলার নির্দেশ মোতাবেক কাজ করব।
এতে শয়তান রাগান্বিত হয়ে পিছু হটল।
.
আবু তোফাইল রহঃ হযরত আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ইব্রাহীম আঃ যখন পুত্রকে জবাই করার জন্য সামনে অগ্রসর হতে থাকলো। তখন শয়তান মনে মনে ভাবল, মাশ'আরে হারাম নামক স্থানে বাধা দেবে। কিন্তু শয়তান পৌছার আগেই হযরত ইব্রাহীম আঃ মাশ'আরে হারাম অতিক্রম করার কারনে সেখানে বাধা দিতে পারল না। তাই শয়তান আগেই জমরায়ে উকবাহ নামক স্থানে আগেই গিয়ে অবস্থান নিল। হযরত ইব্রাহীম আঃ সেখানে পৌছার পর শয়তান বাধা দেবার চেষ্টা করলে হযরত ইব্রাহীম আঃ শয়তানকে লক্ষ্য করে সাতটি কংকর ছুড়ে মারলেন। এতে শয়তান পালিয়ে গিয়ে গা বাচাঁল। শয়তান এরপর জমরায়ে উস্তা ও জমরায়ে কুবরা নামক আরও দুইটি স্থানে ইব্রাহীম আঃ কে বাধা দেবার চেষ্টা করলে ইব্রাহীম আঃ আবারও শয়তানকে লক্ষ্য করে সাতটি করে কংকর ছুড়লে শয়তান পরাজয় মেনে নিয়ে পালিয়ে গেল।
.
কুরবানীর পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহীম আ. এর ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাই তিনি মীনা পর্বতের পাদদেশে তার পুত্র ইসমাঈলকে লক্ষ্য করে বললেন -
قَالَ يبُنَىَّ اِنِّىْ اَرى فِى الْمَنَـامِ اَنِّى اَذْ بَـحُـكَ فَـانْـظُـرْ مَـاذَا تَـرى-
“হে প্রাণ প্রিয় পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। সুতরাং তুমি চিন্তা ভাবনা করে দেখ এবং এ স্বপ্নের ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? তা বল”। [ সূরা আস-সাফফাত-১০২]
.
যেমন বাপ, তেমন বেটা। পুত্রও ছিলেন যেন হযরত ইবরাহীম আ. এর ছাঁচে গড়া, কেননা তিনি ও ভাবী নবী। তাই তৎক্ষণাৎ আত্মসর্ম্পনে মস্তক অবনত করে পুত্র জবাবে বললেন :
قَالَ يـاَبَتِ افْـعَـلْ مَا تُـؤْمَرُ- سَـتَـجِـدُ نِىْ اِنْ شَـاءَ اللهُ مِنَ الـصّـبِـرِيْـنَ-
“হে আমার পিতাজী! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন”। [সূরা আস সাফ্ফাত-১০২]
.
পুত্রের সাথে পরামর্শের হিকমত ছিল এই যে -
.
প্রথমত : পুত্রের দৃঢ়তা, হিম্মত এবং আল্লাহর আনুগত্যের জয্বা সৃষ্টি হওয়ার পরীক্ষা স্বরূপ।
.
দ্বিতীয়ত : সে আনুগত্য স্বীকার করলে সওয়াব ও প্রতিদানের অধিকারী হবে। কেননা সওয়াবের জন্য নিয়ত ও আগ্রহ জরুরী।
.
তৃতীয়ত : যবেহের সময় মানুষ হিসেবে এবং স্বভাবজাত পিতৃস্নেহের কারণে কোন ভূল ভ্রান্তি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকার প্রবল আশা সৃষ্টি হবে।[তাফসীরে রুহুল বয়ান]
.
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ইব্রাহীম আঃ স্বপ্নের কথাটি বাড়িতে না বলে নির্জন এলাকায় এসে কেন বললেন?
.
জন মানবহীন এলাকায় স্বপ্নের কথা জানানোর কারন হলো, হযরত ইব্রাহীম আঃ পূর্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি নিজের সন্তানকে অবশ্যই কুরবানীর জন্য জবেহ করবেন৷ পূত্র জবেহ হবার কথা জেনে যদি সম্মতি দেয় তো ভাল৷ অন্যথায় বল প্রয়োগে জোর করেই জবাই করা হবে৷
.
এখানে আরও একটি প্রশ্ন আসতে পারে, হযরত ইব্রাহীম আঃ যেহেতু পুত্রকে জবাই করবেন তবে পুত্রকে কেন বললেন, চলো আমরা ঐ পাহাড় থেকে খড়ি কেটে আনি?
এর জবাব হলো, ইব্রাহীম আঃ প্রায়ই খড়ি কাটতে পাহাড়ে যেতেন৷ সেদিনও ইসমাঈল আঃ কে জবাই করার সাথে সাথে খড়ি কেটে নিয়ে আসারও নিয়াত ছিল৷ পুত্রকে শুধু একটি কাজের কথা বলেছেন, আরেকটি বলেন নাই৷ এটা তো আর মিথ্যাচার হতে পারে না৷ উল্লেখ্য যে, আমাদের মুসলিমদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সকল নবী পাপ থেকে পবিত্র৷ কোন নবীর কোন কাজ বা কথাকে যদি ভুল মনে হয় তবে ভাবতে হবে কোন তথ্য না জানার কারনে আমাদের বোঝার ভুল হচ্ছে৷ তাই কোন নবীর সমালোচনা না করে কারন জানার চেষ্টা করা উচিত৷ মনে রাখতে হবে নবীদের সমালোচনা করলে, নবীদের কোন কিছুর ব্যাপারে সন্দেহ পোষন করলে ঈমান থাকবে না৷ মুসলিমদের মৌলিক বিশ্বাস বা মৌলিক আকিদার একটি হল, সকল নবী পাপ থেকে পবিত্র বলে বিশ্বাস করা৷
.
পরামর্শ শেষে পিতা ও পুত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কুরবানীর নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে গমন করেন। অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন এই মহান কুরবানীর ইবাদত পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানগাহে পৌঁছলেন এবং ইবরাহীম আ. কুরবানী করার জন্য ইসমাঈল আ. কে শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাঈল আ. পিতা ইবরাহীম আ. কে বললেন আব্বাজান! আমার হাত পা খুব শক্ত করে বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা না পড়ে। অন্যথায় এতে আমার ছওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হবেন। আপনার ছুরিটি ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালাম টুকু অনুগ্রহ পূর্বক পৌছে দিবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন।
.
একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কি যে হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আ. দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, হে আমার প্রাণ প্রিয় বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ।
.
অতঃপর হযরত ইব্রাহীম আঃ হযরত ইসমাঈল আঃ কে আদর করলেন এবং বেধে শুইয়ে দিলেন৷ হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, ইসমাঈল আঃ কে কাত করে এমনভাবে শুইয়ে দিলেন, যাতে কপালের এক দিক মাটি স্পর্শ করেছিল৷ আভিধানিক দিক দিয়ে এই অর্থই অগ্রগণ্য৷ কারন আরবী ভাষায় "জাবীন" কপালের দুই পার্শ্বকে বলা হয়৷ কপালের মধ্যভাগকে বলা হয় "জাবহা"৷ এ কারনে হযরত থানবী রহঃ অনুবাদ করেছেন, বালুর উপর শুইয়ে দিলেন৷ তবে কিছু কিছু তাফসীরবিদ অর্থ করেছেন, উপুর করে মাটিতে শুইয়ে দিলেন৷
.
তবে ঐতিহাসিক রেওয়ায়েতে এভাবে শোয়ানোর কারন বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইব্রাহীম আঃ প্রথমে তাকে সোজা করেই শুইয়ে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু বার বার ছুরি চালানো সত্ত্বেও হযরত ইসমাঈল আঃ এর গলা কাটছিল না৷ কেননা আল্লাহ স্বীয় কুদরতে পিতলের একটি টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন৷ তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজী! আমাকে উপুড় করে শুইয়ে নিন। কারণ, আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে উঠে। ফলে গলা কাটা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ছুরি দেখে আমি ঘাবড়ে যাই। সে মতে হযরত ইবরাহীম আ. তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুনরায় সজোরে প্রাণপণে ছুরি চালালেন। কিন্তু তখন ও গলা কাটছিলনা। হযরত ইবরাহীম আ. চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। হযরত ইবরাহীম আ. এর এ প্রাণন্তর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং হযরত ইসমাঈলের বিনা যবেহেই তার কুরবানী কবুল করে নিলেন। এ ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম আ. এর উপর ওহী নাযিল হলো। [তাফসীরে রুহুল মাআ’নী। সূত্র হযরত কাতাদাহ রা. হতে বর্নিত, তাফসিরে ইবনে কাসীর মসনদে আহমদ থেকে নকল করা হয়েছে। সূত্র হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত।]
.
فَلَمَّا اَسْلَمَا وَتَلَّه لِلْجَبِيْنِ- وَنَادَيْنهُ اَنْ يَّا اِبْرَاهِيْمَ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَا- اِنَّا كَذلِكَ نَـجْـزِى الْـمُحْسِنِيْـنَ- اِنَّ هـذَا لَهُـوَ الْـبَلـؤُ الْمُبِيْـنُ- وَقَـدَيْنهُ بِـذِبْحٍ عَـظِـيْمٍ-
“অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের কে সোপর্দ করলো এরং ইবরাহীম আ. পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে), তখন আমি (আল্লাহ) তাকে সম্বোধন করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি সপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমি সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষা। আর আমি (ইসমাঈল আ: এর পরিবর্তে) জবেহ করার জন্য এক মহান জীব এর বিনিময়ে দিলাম”। [সূরা আস-সাফ্ফাত ১২০-১০৭]
.
এখানে আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত উদ্দেশ্য হযরত ইসমাঈল আঃ কে জবেহ করা ছিল না কিংবা হযরত ইব্রাহীম আঃ-কেও এ আদেশ দেয়া উদ্দেশ্য ছিল না যে , প্রাণ প্রতিম পুত্রকেই জবেহ করে ফেল। বরং উদ্দেশ্য ছিল হযরত ইব্রাহীম আঃ কে পরীক্ষা করা। এ কারনেই আল্লাহ তায়ালা এ হুকুমটি সরাসরি কোন ফেরেস্তার মাধ্যমে নাযিল করেননি। যাতে আল্লাহ তায়ালা লক্ষ্য করেন যে, স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত আদেশে ইব্রাহীম আঃ এর আনুগত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ, না কি স্বপ্নকে মানব মনের আবেগে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে আনুগত্যের পথ থেকে সরে দাড়ান? সুবহানাল্লাহ! এটা যে বড়ই কঠিন পরীক্ষা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
.
বস্তুতঃ এ আদেশটি মৌখিক আদেশের মাধ্যমে হলে পরীক্ষাই হত না। কেননা কোন নবীই তো আল্লাহর সরাসরি আদেশ অমান্য করতে পারেন না। তদুপরি আদেশটি পরে রহিত করতে হত। কেননা আল্লাহর উদ্দেশ্য তো পুত্রকে জবাই করানো ছিল না।
.
বর্ণিত আছে যে, হযরত ইব্রাহীম আঃ উপরোক্ত গায়েবী আওয়াজ শুনে উপরের দিকে তাকালে হযরত জিব্রাইল আঃ কে একটি দুম্বা নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখেন এবং হযরত জিব্রাইল আঃ এর নির্দেশনা মোতাবেক দুম্বাটিকে জবেহ করেন। দুম্বাটি স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছিল এবং এই কুরবানী কবুল না হবার কোন সন্দেহ নাই - এ জন্য দুম্বাটি মহান বলা হয়েছে।
.
ফতহুল ক্বাদীরের বর্ননায় পাওয়া যায়, হাবীলের দেয়া কুরবানীর দুম্বাটি আল্লাহ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। ইসমাঈল আঃ এর পরিবর্তে জিব্রাইল আঃ এর মাধ্যমে সেই দুম্বাটিই ইব্রাহীম আঃ কে কুরবানী করার জন্য পাঠিয়ে দেন।
.
ইব্রাহীম আঃ এর এই কুরবানী আল্লাহর নিকট পছন্দ হওয়ায় আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেও কুরবানী করার বিধান দিয়েছেন৷ মহান আল্লাহ বলেছেন -
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى الْا خِرِيْنَ
“আর আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে ইব্রাহীমের এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম”। [সূরা আস আস সাফ্ফাত ১০৮]
.
✔ মাহাদী হাসান
.
● তথ্য সূত্র
• কুরবানীর পাথেয় - মুফতি আব্দুল ওয়াহ্হাব
• অন্তর্জাল
.

প্রশ্ন: ৩১৭ : কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে কুরবানী

কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিশেষ ইবাদত। এটা আদম আ.-এর যুগ থেকে বিদ্যমান ছিল। সূরা মাইদায় (আয়াত ২৭-৩১) আদম আ.-এর দুসন্তানের কুরবানীর কথা এসেছে। তবে প্রত্যেক নবীর শরীয়তে কুরবানীর পন্থা এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে কুরবানীর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূল সূত্র মিল্লাতে ইবরাহীমীতে বিদ্যমান ছিল। কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীস থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। এজন্য কুরবানীকে সুন্নতে ইবরাহীমী নামে অভিহিত করা হয়।
ফার্সী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় কুরবানী শব্দটি আরবী কুরবান শব্দের স্থলে ব্যবহৃত হয়। কুরবান শব্দটি    
মূলধাতু (যার অর্থ হচ্ছে, নৈকট্য) থেকে নির্গত। তাই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়তসম্মত পন্থায় বান্দা যে আমল করে তাকে আভিধানিক দিক থেকে তাকে কুরবান বলা যেতে পারে। তবে শরীয়তের পরিভাষায় কুরবান শব্দের মর্ম তা-ই যা উপরে উল্লেখিত হয়েছে।
ইসলামী শরীয়তে এই পারিভাষিক অর্থে দু ধরনের কুরবানী রয়েছে।
১. যা হজ্বের মওসুমে হজ্ব ও উমরা কারীগণ নির্ধারিত (মক্কা ও মিনায়) স্থানে  আদায় করে থাকেন। এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। যথা-কিরান বা তামাত্তু হজ্ব আদায়কারীর ওয়াজিব কুরবানী, ইফরাদ হজ্বকারীর নফল কুরবানী, সঙ্গে করে নিয়ে আসা হাদি (কুরবানীর পশু) দ্বারা কুরবানী, হজ্ব আদায়ে অক্ষম হওয়ার কারণে বা কোনো নিষিদ্ধ কর্মের জরিমানারূপে অপরিহার্য কুরবানী, মানতের কুরবানী কিংবা দশ যিলহজ্বের সাধারণ কুরবানী।
এ কুরবানীর বিধান মৌলিকভাবে সূরা হজ্ব আয়াত ২৭-৩৭, সূরা বাকারা আয়াত ১৯৬, সূরা মাইদা আয়াত ২, ৯৫-৯৭, সূরা ফাতহ আয়াত ২৫-এ এসেছে। আর হাদীস শরীফে তা উল্লেখিত হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
২. সাধারণ কুরবানী, যা হজ্ব-উমরার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এবং যার স্থানও নির্ধারিত নয়। তবে সময় নির্ধারিত। যে তারিখে হজ্ব আদায়কারীগণ মিনা-মক্কায় কুরবানী করে থাকেন সে তারিখে অর্থাৎ যিলহজ্বের দশ, এগারো, বারো তারিখে এ কুরবানী হয়ে থাকে। পৃথিবীর সকল মুসলিম পরিবারের জন্য; বরং প্রত্যেক আকেল-বালেগ মুসলমানের জন্য এই কুরবানীর বিধান এসেছে। তবে কারো জন্য তা ওয়াজিব, কারো জন্য নফল।
সূরা আনআমের ১৬১-১৬৩ আয়াতে এবং সূরা কাউসারের ২ আয়াতে এই কুরবানী উল্লেখিত হয়েছে। বিস্তারিত বিধি-বিধান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে  রয়েছে।
৪. সূরা আনআমে এসেছে-
قُلْ اِنَّنِیْ هَدٰىنِیْ رَبِّیْۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ ۚ۬ دِیْنًا قِیَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا ۚ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ۝۱۶۱ قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ۝۱۶۲ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ۝۱۶۳
 আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথের দিকে-এক বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে, অর্থাৎ একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের মিল্লাত (তরীকা), আর তিনি মুশরিকদের      অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার সালাত, আমার নুসুক, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই রাববুল আলামীন আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই।  আমাকে এই আদেশই করা হয়েছে, সুতরাং আমি হলাম প্রথম আত্মসমর্পণ কারী।
এ আয়াতে নুসূক শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটি নাসীকাহ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশু। আর কুরবানীর স্থানকে আরবী ভাষায় এবং শরীয়তের পরিভাষায় মানসাক বলা হয়। দুটো শব্দের মূল ধাতু অভিন্ন। আরবী ভাষার যেকোনো অভিধানে এবং লুগাতুল কুরআন, লুগাতুল হাদীস ও লুগাতুল ফিকহের যেকোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে নুসুক শব্দের উপরোক্ত অর্থ পাওয়া যাবে।
(দেখুন : আসসিহাহ খ. ৪ পৃ. ১৬১২; লিসানুল আরব খ. ১৪ পৃ. ১২৭-১২৮; তাজুল আরূস খ. ৭ পৃ. ২৮৭; আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন পৃ. ৮০২; আননিহায়া ফী গারীবিল হাদীসি ওয়াল আছার খ. ৫ পৃ. ৪৮; মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার খ. ৪ পৃ.৭১৪-৭১৫; আলমিসবাহুল মুনীর ফাইয়ুমী পৃ. ৩১১; আলমুগরিব, মুতাররিযী খ. ২ পৃ. ৩০০)
উপরোক্ত আয়াতের অর্থ পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আ.কে যে বিশুদ্ধ তাওহীদ ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছিলেন তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও নাযিল করেছেন এবং আদেশ করেছেন যে, বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সব আল্লাহ তাআলার জন্য।
সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াতেও নুসূক শব্দ এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
উল্লেখ্য আরবী ভাষায় নুসুক ইবাদত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এজন্য ইবাদতকারীকে নাসেক ও ইবাদতের পদ্ধতিকে মানসাক বলা হয়। উল্লেখিত আয়াতে নুসুক শব্দের অর্থ যদি ইবাদতও করা হয়, তবুও তাতে কুরবানী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কেননা কুরবানীও একটি ইবাদত। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার কুরবানীকে একাধিক হাদীসে নুসুক বলেছেন। কুরবানীর পশু যবেহ করার যে দুআ হাদীসে এসেছে তাতেও ওই আয়াত রয়েছে। পূর্ণ হাদীস লক্ষ করুন।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা যবেহ করেছেন। যবেহর সময় সেগুলোকে কিবলামুখী করে বলেছেন-
اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ  اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ  لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ ، بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبرُ، اَللّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَّأُمَّتِهِ.
-সুনানে আবু দাউদ ৩/৯৫, হাদীস : ২৭৯৫; মুসনাদে আহমদ ৩/৩৭৫ হাদীস : ১৫০২২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৮৯৯
কুরবানীর শুরুতে তাঁর এই আয়াত ও দুআ পড়া থেকে যেমন প্রমাণ হয় কুরবানী খালিছ ইবাদত তেমনি একথাও প্রমাণ হয় যে, উল্লেখিত আয়াতে নুসুক শব্দের অর্থ ঈদুল আযহার কুরবানী অথবা কুরবানী তাতে অবশ্যই শামিল রয়েছে।
অন্য আয়াতটি হল সূরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াত। ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَؕ۝۱ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ۝۲ اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ۠۝۳
এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে সালাত (নামায) ও নাহ্র (কুরবানীর) আদেশ দেওয়া হয়েছে। নাহর শব্দের মূল অর্থ উট যবেহ করা, তবে সাধারণ ব্যবহারে যেকোনো পশু যবেহ করাকেই নাহর বলে। আয়াতে এমন যবেহ উদ্দেশ্য, যা  ইবাদত হিসেবে করা হয়। সেটা হচ্ছে হজ্ব ও উমরার কুরবানী এবং ঈদুল আযহার সাধারণ কুরবানী।
এ কুরবানীর সময় তিন দিন : যিলহজ্বের দশ, এগারো ও বারো তারিখ। তবে উত্তম হল দশ তারিখ। সাধারণত এ তারিখেই অধিকাংশ কুরবানী হয়ে থাকে। এজন্য দশ যিলহজ্বের ইসলামী নাম ইয়াওমুন নাহর। -সহীহ বুখারী হাদীস ৫৫৫০
আয়াতে নামাযের যে আদেশ এসেছে তাতে ঈদের নামাযও শামিল রয়েছে। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা যে বিধান দান করেছেন তা পালন করার পদ্ধতি নবীজী  তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। একটি হাদীস লক্ষ করুন।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার দিন নামায পরবর্তী খুতবায় বলেছেন, এই দিনের প্রথম কাজ হল সালাত আদায় করা এরপর নহর (কুরবানী) করা। যে সালাত আদায়ের পর নুসুক (কুরবানী) করল তার নুসুক পূর্ণ হল এবং সে মুসলিমদের পথ অনুসরণ করল। আর যে সালাতের আগে যবেহ করল সেটা তার গোশতের প্রয়োজন পূরণ করবে, কিন্তু নুসুক হিসেবে গণ্য হবে না।
এই হাদীস বহু সহীহ সনদে বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও বিস্তারিতভাবে, কোথাও সংক্ষিপ্তভাবে।
(দেখুন : সহীহ বুখারী, হাদীস, ৯৫১, ৯৫৫, ৯৬৫, ৯৬৮, ৫৫৪৫, ৫৫৪৬; সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯৬১, ৪, ৬, ৭; মুসনাদে আহমদ ৪/২৮১-২৮২, ৩০৩; জামে তিরমিযী হাদীস ১৫০৮, সুনানে নাসায়ী হাদীস ৪৩৯৪-৪৩৯৫; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৯০৭, ৫৯১০, ৫৯১১)
এই হাদীসে সূরাতুল কাউসারের ব্যাখ্যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল থেকে পাওয়া গেল, যার সারমর্ম এই যে, সালাত আদায় করুন শব্দে ঈদের নামায এবং কুরবানী করুন শব্দে ঈদুল আযহার কুরবানীও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঈদুল আযহার কুরবানী হচ্ছে নুসুক, যা সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য গোশত ভক্ষণ করা বা গোশতের প্রয়োজন পূরণ করা নয়। এটা একটা ইবাদত। তবে কুরবানী হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা সে পশুর গোশত কুরবানীদাতার জন্য হালাল করেছেন এবং দশ যিলহজ্ব থেকে মোট চার দিন রোযা রাখতে নিষেধ করে যেন তাঁর মেহমানদারী কবুল করার আদেশ দিয়েছেন।
ঈদুল আযহা মুসলমানদের আনন্দের দিন। আরাফা দিবসের ব্যাপক মাগফিরাত, আল্লাহর দরবারে কুরবানী পেশ করার সৌভাগ্য এবং আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া কুরবানী থেকে মেহমানদারী লাভ ওই আনন্দের কারণ। বলাবাহুল্য, এই তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য অন্তরে প্রয়োজন ঈমানের মিষ্টতা এবং খালিক ও মালিকের মহববত ও ভালোবাসা। বস্ত্তবাদী ও যুক্তিপূজারী হৃদয় দুঃখজনকভাবে এ নিয়ামত থেকে শূন্য।
সুন্নাহর আলোকে কুরবানী
কুরবানী বিষয়ক সহীহ ও হাসান হাদীস একত্র করা হলেও একটি দীর্ঘ কিতাব তৈরি হতে পারে। এখানে আরো কয়েকটি হাদীস পেশ করছি।
১. উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে কুরবানীর ইচ্ছা রাখে সে যেন যিলহজ্বের চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার নখ, চুল ইত্যাদি কর্তন না করে।
-সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯৭৭/৩৯-৪২; তিরমিযী হাদীস ১৫২৩; আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯১; নাসায়ী হাদীস ৪৩৬২-৪৩৬৪, সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৮৯৭, ৫৯১৬, ৫৯১৭
২.আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীন বিষয়ে জানতে এসেছিল। ফিরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকলেন এবং বললেন, আমাকে ইয়াওমুল আযহার আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। লোকটি বলল, আমার কাছে যদি শুধু পুত্রের দেওয়া একটি দুধের পশু থাকে আমি কি তা-ই কুরবানী করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, বরং তুমি সেদিন তোমার মাথার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে) নখ কাটবে, মোচ কাটবে এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।
-মুসনাদে আহমদ ২/১৬৯; হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৭৭৩, ৫৯১৪; আবু দাউদ হাদীস ২৭৮৯; নাসায়ী হাদীস ৪৩৬৫
৩. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যার সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানী করল না (অর্থাৎ কুরবানী করার সংকল্প তার নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। -মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুসতাদরাক হাকিম ৪/২৩১, হাদীস ৭৬৩৯
৪. আলী রা. বলেন, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা যেন (কুরবানী পশুর) চোখ ও কান ভালো করে দেখে নিই এবং কান কাটা বা কান ফাড়া ও কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশুর দ্বারা কুরবানী না করি। -মুসনাদে আহমদ ১/৮০; ১০৮, ১৪৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদীস ২৯১৪-২৯১৫; আবু দাউদ হাদীস ২৮০৪; নাসায়ী হাদীস ৪৩৭৩-৪৩৭৪
৫. বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, চার ধরনের পশুর দ্বারা কুরবানী করা যায় না। যে পশুর চোখের জ্যোতি ক্ষতিগ্রস্ত, যে পশু অতি অসুস্থ, যে পশু খোঁড়া আর যে পশু অতি শীর্ণ। -মুয়াত্তা মালিক ২/৪৮২; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৯১৯; নাসায়ী হাদীস ৪৩৭০-৪৩৭১; তিরমিযী হাদীস ১৪৯৭
৬. আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য একটি দুম্বা আনতে বললেন, যার শিং রয়েছে, যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। এ রকম একটি দুম্বা আনা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আয়েশা, আমাকে ছুরি দাও। আরো বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। তিনি ধারালো করে দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুম্বাটি মাটিতে শায়িত করলেন। এরপর বিসমিল্লাহ বলে যবেহ করলেন এবং বললেন-

ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭, সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৯১৫; আবু দাউদ হাদীস ২৭৯২
অন্য হাদীসে এসেছে যে, কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআ পড়েছেন-
بِسْمِ اللهِ اَللّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ، اَللّهُمَّ عَنْ مُحَمَّدٍ.
আল্লাহর নামে। ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে। ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী হাদীস ১১৩২৯; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২১
নবীজীর কথায়-ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমারই উদ্দেশ্যে চিন্তা-ভাবনা করলে খুব সহজেই বোঝা যায়, কুরবানীর হাকীকত কী। আল্লাহ-প্রদত্ত রিযক এবং আল্লাহর নেয়ামত আমরা লাভ করেছি আর আল্লাহর হুকুমে তা কুরবানী রূপে তাঁর দরবারে পেশ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। আবার তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মেহমানদারী হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশনা পেয়েছি।
অতএব পূর্ণ তাওহীদ ও ইখলাসের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুযায়ী কুরবানী করা কর্তব্য। কুরবানী নামায-রোযার মতো ফরয আমল নয়, তবে অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব আমল। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত কুরবানী করেছেন, কোনো বছর বাদ দেননি
(আল ইসতিযকার, ইবনে আব্দিল বার ১৫/১৬৩-১৬৪) কখনো কখনো কুরবানী করার জন্য সাহাবীদের মধ্যে কুরবানীর পশু বণ্টন করেছেন। -সহীহ বুখারী হাদীস ৫৫৫৫
হযরত আলী রা.কে আদেশ করেছেন যেন (ইন্তেকালের পরেও) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়। হযরত আলী রা. প্রতি বছর নিজের কুরবানীর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী করতেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস ৮৪৩, ১২৭৮, আবু দাউদ হাদীস ২৭৮৭
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এই ইবাদত তাওয়ারুছ ও তাওয়াতুরের সঙ্গে চলমান রয়েছে এবং প্রতিবছর শিয়াররূপে (ইসলামের একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদত হিসেবে) তা আদায় করা হয়েছে। অতএব কেউ যদি মনে করে, কুরবানী ইবাদত নয় এবং ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয় তবে সে শরীয়তকে অস্বীকারকারী।


Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...