প্রশ্ন: ৩১৩ : নামাজের মাকরূহ সমূহ ।

যেসব কারনে নামাজ হয়ে যাবে, কিন্তু নামাজ মাকরূহ হবে সে সকল কারন সমূহ নিম্নে উল্লেখ্য করা হল -

১. নামাযের মধ্যে  কোন বিষয় নিয়ে একাধিকবার চিন্তা করলে ।

২. পা কিংবা হাতের আঙ্গুল মটকাইলে ।

৩. নামাযের মধ্যে হেলা-দুলা করলে ।

৪. মাথার মধ্যস্থানের চুল বাঁধিলে ।

৫. নামায পড়ার সময় কোন প্রকার জীবের ছবি কিংবা প্রাণীর মূর্তির উপর নজর পড়লে ।

৬. ভাল পোশাক থাকিতে জীর্ণ ও অপরিষ্কার কাপড় পরিয়া নামায পড়লে ।

৭. নামাযের মধ্যে এদিক-সেদিক তাকাইয়া কিছু দেখা কিংবা অপরকে ইঙ্গিত করে দেখাইলে ।

৮. কেরাত পাঠ করতে অসুবিধা হয় এরূপ কোন দ্রব্য মুখে থাকলে ।

৯. ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে তাহরীমা বাঁধিলে ।

১০. ‘সামিআল্লাহ হুলিমান হামিদাহ’ বলার সময় মোক্তাদি ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ না বললে ।

১১. এক জায়গায় দুই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ফরজ নামায পড়লে ।

১২. জারজ ব্যক্তির পিছনে নামায পড়লে ।

১৩. কসাইখানায় বসিয়া নামায পড়লে ।

১৪. কায়দাতে দুই হাত হাঁটুর উপর না রাখলে ।

১৫. গো-শালা বা আস্তাবলে নামায পড়লে ।

১৬. নামাযের সময় সুগন্ধি ফুলের ঘ্রাণ লইলে ।

১৭. নিদ্রিত লোক সম্মুখে রেখে নামায পড়লে ।

১৮. সিজদার সময় কপালে ধূলা-বালি লাগিলে তা ঝাড়িলে ।

১৯. স্ত্রীলোক পুরুষের মত নাভীর উপর বা নিচে তাহরীমা বাঁধিলে ।

২০. ইমামের আগে রুকু এবং সিজদায় যাওয়া ও মাথা উঠাইলে ।

২১. বিনা ওজরে খেয়া নৌকায় নামায পড়লে ।

২২. জোহর ও আছর নামাযের কেরাত জোরে জোরে পড়লে ।

২৩. পাতলা কাপড় পরিয়া নামায পড়লে ।

২৪. প্রত্যহ নামাযে একই সূরা পাঠ করলে ।

২৫. এছাড়া এমন কোন কাজ করা যাতে নামাজের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, খুশু খুজুতে বাধার সৃষ্টি করে, এবং বাইরে থেকে কেউ দেখলে মনে করে যে এই লোকটি নামাজে নেই। 






প্রশ্ন: ৩১২: কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী।

কোরবানি মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ জাতীয় উৎসব। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয় এ উৎসব। কোরবানি শব্দটি আরবি বা ফারসি। এর আভিধানিক অর্থ ত্যাগ বা নৈকট্য। আত্মত্যাগের দুরূহ ও কঠিন পথ পেরিয়েই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব। এ কোরবানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতি। হজরত ইবরাহিম (আ.) ত্যাগের পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বে নিজের সন্তানের গলায় তীক্ষ খঞ্জর চালিয়েছিলেন। তাঁর কাজ আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে কিয়ামত পর্যন্ত সব সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর সেই ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতির অনুশীলনে কোরবানি করা ওয়াজিব। তাই কোরবানি শুধু মোটাতাজা জন্তু জবাইয়ের মহড়া দেওয়া নয়। কোরবানি শুধু উৎসব-আনন্দে, ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেওয়া নয়। কোরবানি হলো, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিনম্র প্রকাশ।
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব
কোরবানি মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্যতম। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছর কোরবানি করতেন। যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এতে গরিব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়।
কোরবানিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে। এতে আল্লাহর ভালোবাসায় নিজের সব চাহিদা ও যুক্তি কোরবানি (ত্যাগ) করার শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২)
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলিম নর-নারী, যে কোরবানির দিনগুলোতে সাড়ে সাত ভরি সোনা, সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা ওই পরিমাণ রুপার সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও প্রয়োজনাতিরিক্ত অন্য আসবাবপত্রের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৬৫)
আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা—এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। যেমন কারো কাছে কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমান, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৫/২১৯)
কোরবানির নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য জাকাতের মতো সম্পদের বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়, শুধু কোরবানির তিন দিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াই যথেষ্ট। এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলে কোরবানি ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬২)
অনেকের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়, কিন্তু তারা ঋণ করে হলেও কোরবানি করে থাকেন, এমনটি অনুচিত।
এ ধরনের কারো কারো মনের অভিব্যক্তি হলো, ‘কোরবানির দিন আমার সন্তান কার মুখের দিকে চেয়ে থাকবে।’ এমন চিন্তা থেকে কোরবানি করলে কোরবানি হবে না, গোশত খাওয়া হবে।
কোরবানি মূলত ধনীদের ইবাদত, যেভাবে জাকাত ও হজ ধনীদের ইবাদত। ধনীদের মধ্যে পাপাচারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। হতে পারে, এজন্য তাদের বিশেষ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে, যাতে তারাও পাপমুক্ত জীবনে ফিরে আসতে পারে।
একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৭৮)
শরিকে কোরবানি করলে গোশত ওজন করে বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। তবে হাড্ডি-মাথা ইত্যাদি যেসব অংশ সাধারণত সমানভাবে ভাগ করা যায় না, সেগুলো অনুমান করে ভাগ করা যাবে। এতে সামান্য কমবেশি হলে সমস্যা নেই। (ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫১)
কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি
কোরবানি একটি ইবাদত। সুতরাং যেন খাঁটি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশেই হয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন মুখ্য না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে তা আল্লাহর কাছে কোরবানি গৃহীত হবে না। অংশীদারদের কারো নিয়ত যদি পরিশুদ্ধ না থাকে কিংবা তার অর্থ যদি হালাল না হয়, তাহলে বাকিদের কোরবানিও নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যাচাই-বাছাই করে অংশীদার নির্বাচন করতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না যে নিজের ধনাঢ্যতা প্রদর্শন ও বিত্তের মহড়া দেওয়ার জন্য কোরবানি দিলে কোরবানি হবে না।
দ্বিতীয়ত, অর্থকড়ি হালাল হওয়া। হারাম অর্থ দিয়ে ইবাদত শুদ্ধ নয়। হারাম অর্থের দ্বারা সওয়াবের আশা করাও গুনাহর কাজ। হালাল অর্থ দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী ছোটখাটো পশুর ব্যবস্থা করেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর না গোশত পৌঁছে, না রক্ত পৌঁছে; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৭)
কোরবানির পশুর বৈশিষ্ট্য
কোরবানির জন্তু : উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। অন্যান্য জন্তু দ্বারা কোরবানি নাজায়েজ। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছর পূর্ণ হতে হবে, গরু-মহিষ দুই বছর পূর্ণ হতে হবে, উট পাঁচ বছর পূর্ণ হতে হবে। (হিদায়া, খণ্ড-৪, পৃ. ১০৩)
কোরবানির পশু হতে হবে দোষত্রুটিমুক্ত। পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেওয়া যাবে না, সেগুলো হচ্ছে : ১. দৃষ্টিশক্তি না থাকা, ২. শ্রবণশক্তি না থাকা, ৩. অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া, ৪. এই পরিমাণ লেংড়া যে জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম, ৫. লেজের বেশির ভাগ অংশ কাটা, ৬. জন্মগতভাবে কান না থাকা, ৭. কানের বেশির ভাগ কাটা, ৮. গোড়াসহ শিং উপড়ে যাওয়া, ৯. পাগল হওয়ার কারণে ঘাস-পানি ঠিকমতো না খাওয়া, ১০. বেশির ভাগ দাঁত না থাকা, ১১. রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে যাওয়া, ১২. ছাগলের দুটি দুধের যেকোনো একটি কাটা, ১৩. গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোনো দুটি কাটা। মোট কথা, কোরবানির পশু বড় ধরনের দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হবে। যেমন হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। অন্ধ—যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত—যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু—যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত—যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৪৪)
পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলেও কোরবানি দেওয়া যাবে, সেগুলো হচ্ছে : ১. পশু পাগল, তবে ঘাস-পানি ঠিকমতো খায়; ২. লেজ বা কানের কিছু অংশ কাটা, তবে বেশির ভাগ অংশ আছে; ৩. জন্মগতভাবে শিং নেই, ৪. শিং আছে, তবে ভাঙা; ৫. কান আছে, তবে ছোট; ৬. পশুর একটি পা ভাঙা, তবে তিন পা দিয়ে সে চলতে পারে; ৭. পশুর গায়ে চর্মরোগ, ৮. কিছু দাঁত নেই, তবে বেশির ভাগ আছে। স্বভাবগত এক অণ্ডকোষবিশিষ্ট পশু; ৯. পশু বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম, ১০. পুরুষাঙ্গ কেটে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে অক্ষম। তবে উত্তম হচ্ছে ত্রুটিমুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি দেওয়া, ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি দেওয়া অনুচিত।
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হয়। উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু-মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। অবশ্য ছয় মাসের ভেড়া যদি দেখতে মোটাতাজা হয় এবং এক বছর বয়সের মতো মনে হয়, তাহলে তা দিয়েই কোরবানি বৈধ। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির ক্ষেত্রে একটি পশু শুধু এক ব্যক্তিই কোরবানি দিতে পারবে। গরু, মহিষ, উট সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তি মিলে কোরবানি দিতে পারবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরিক হতে পারে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৩১৮)
মহানবী (সা.)-এর কোরবানি
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর কোরবানির হুকুম অবতীর্ণ হয়। হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি প্রথাটা কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের কী লাভ?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে।’ সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সওফ তথা দুম্বা, ভেড়া ও উটের পশমের বিনিময়ে কি এ পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেওয়া হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই কোরবানি করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার ১০ বছর জীবনের প্রতিবছরই কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
কাজেই সামর্থ্য থাকলে কোরবানি করা থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, দান করা পৃথক একটি ইবাদত। অন্যদিকে কোরবানি করা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। উভয় ইবাদতের একটি অন্যটির পরিপূরক নয়। তাই কোরবানির অর্থ দান করলে কোরবানির সওয়াব পাওয়া যাবে না। এর মাধ্যমে কোরবানি আদায় হবে না। তবে দানের সওয়াব পাওয়া যাবে।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুল মদিনা, নবাবপুর, ঢাকা।

প্রশ্ন: ৩১২: কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী।

কোরবানি মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ জাতীয় উৎসব। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয় এ উৎসব। কোরবানি শব্দটি আরবি বা ফারসি। এর আভিধানিক অর্থ ত্যাগ বা নৈকট্য। আত্মত্যাগের দুরূহ ও কঠিন পথ পেরিয়েই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব। এ কোরবানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতি। হজরত ইবরাহিম (আ.) ত্যাগের পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বে নিজের সন্তানের গলায় তীক্ষ খঞ্জর চালিয়েছিলেন। তাঁর কাজ আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে কিয়ামত পর্যন্ত সব সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর সেই ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতির অনুশীলনে কোরবানি করা ওয়াজিব। তাই কোরবানি শুধু মোটাতাজা জন্তু জবাইয়ের মহড়া দেওয়া নয়। কোরবানি শুধু উৎসব-আনন্দে, ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেওয়া নয়। কোরবানি হলো, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিনম্র প্রকাশ।
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব
কোরবানি মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্যতম। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছর কোরবানি করতেন। যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এতে গরিব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়।
কোরবানিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে। এতে আল্লাহর ভালোবাসায় নিজের সব চাহিদা ও যুক্তি কোরবানি (ত্যাগ) করার শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২)
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলিম নর-নারী, যে কোরবানির দিনগুলোতে সাড়ে সাত ভরি সোনা, সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা ওই পরিমাণ রুপার সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও প্রয়োজনাতিরিক্ত অন্য আসবাবপত্রের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৬৫)
আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা—এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। যেমন কারো কাছে কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমান, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৫/২১৯)
কোরবানির নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য জাকাতের মতো সম্পদের বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়, শুধু কোরবানির তিন দিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াই যথেষ্ট। এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলে কোরবানি ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬২)
অনেকের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়, কিন্তু তারা ঋণ করে হলেও কোরবানি করে থাকেন, এমনটি অনুচিত।
এ ধরনের কারো কারো মনের অভিব্যক্তি হলো, ‘কোরবানির দিন আমার সন্তান কার মুখের দিকে চেয়ে থাকবে।’ এমন চিন্তা থেকে কোরবানি করলে কোরবানি হবে না, গোশত খাওয়া হবে।
কোরবানি মূলত ধনীদের ইবাদত, যেভাবে জাকাত ও হজ ধনীদের ইবাদত। ধনীদের মধ্যে পাপাচারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। হতে পারে, এজন্য তাদের বিশেষ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে, যাতে তারাও পাপমুক্ত জীবনে ফিরে আসতে পারে।
একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৭৮)
শরিকে কোরবানি করলে গোশত ওজন করে বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। তবে হাড্ডি-মাথা ইত্যাদি যেসব অংশ সাধারণত সমানভাবে ভাগ করা যায় না, সেগুলো অনুমান করে ভাগ করা যাবে। এতে সামান্য কমবেশি হলে সমস্যা নেই। (ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫১)
কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি
কোরবানি একটি ইবাদত। সুতরাং যেন খাঁটি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশেই হয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন মুখ্য না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে তা আল্লাহর কাছে কোরবানি গৃহীত হবে না। অংশীদারদের কারো নিয়ত যদি পরিশুদ্ধ না থাকে কিংবা তার অর্থ যদি হালাল না হয়, তাহলে বাকিদের কোরবানিও নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যাচাই-বাছাই করে অংশীদার নির্বাচন করতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না যে নিজের ধনাঢ্যতা প্রদর্শন ও বিত্তের মহড়া দেওয়ার জন্য কোরবানি দিলে কোরবানি হবে না।
দ্বিতীয়ত, অর্থকড়ি হালাল হওয়া। হারাম অর্থ দিয়ে ইবাদত শুদ্ধ নয়। হারাম অর্থের দ্বারা সওয়াবের আশা করাও গুনাহর কাজ। হালাল অর্থ দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী ছোটখাটো পশুর ব্যবস্থা করেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর না গোশত পৌঁছে, না রক্ত পৌঁছে; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৭)
কোরবানির পশুর বৈশিষ্ট্য
কোরবানির জন্তু : উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। অন্যান্য জন্তু দ্বারা কোরবানি নাজায়েজ। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছর পূর্ণ হতে হবে, গরু-মহিষ দুই বছর পূর্ণ হতে হবে, উট পাঁচ বছর পূর্ণ হতে হবে। (হিদায়া, খণ্ড-৪, পৃ. ১০৩)
কোরবানির পশু হতে হবে দোষত্রুটিমুক্ত। পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেওয়া যাবে না, সেগুলো হচ্ছে : ১. দৃষ্টিশক্তি না থাকা, ২. শ্রবণশক্তি না থাকা, ৩. অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া, ৪. এই পরিমাণ লেংড়া যে জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম, ৫. লেজের বেশির ভাগ অংশ কাটা, ৬. জন্মগতভাবে কান না থাকা, ৭. কানের বেশির ভাগ কাটা, ৮. গোড়াসহ শিং উপড়ে যাওয়া, ৯. পাগল হওয়ার কারণে ঘাস-পানি ঠিকমতো না খাওয়া, ১০. বেশির ভাগ দাঁত না থাকা, ১১. রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে যাওয়া, ১২. ছাগলের দুটি দুধের যেকোনো একটি কাটা, ১৩. গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোনো দুটি কাটা। মোট কথা, কোরবানির পশু বড় ধরনের দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হবে। যেমন হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। অন্ধ—যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত—যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু—যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত—যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৪৪)
পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলেও কোরবানি দেওয়া যাবে, সেগুলো হচ্ছে : ১. পশু পাগল, তবে ঘাস-পানি ঠিকমতো খায়; ২. লেজ বা কানের কিছু অংশ কাটা, তবে বেশির ভাগ অংশ আছে; ৩. জন্মগতভাবে শিং নেই, ৪. শিং আছে, তবে ভাঙা; ৫. কান আছে, তবে ছোট; ৬. পশুর একটি পা ভাঙা, তবে তিন পা দিয়ে সে চলতে পারে; ৭. পশুর গায়ে চর্মরোগ, ৮. কিছু দাঁত নেই, তবে বেশির ভাগ আছে। স্বভাবগত এক অণ্ডকোষবিশিষ্ট পশু; ৯. পশু বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম, ১০. পুরুষাঙ্গ কেটে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে অক্ষম। তবে উত্তম হচ্ছে ত্রুটিমুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি দেওয়া, ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি দেওয়া অনুচিত।
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হয়। উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু-মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। অবশ্য ছয় মাসের ভেড়া যদি দেখতে মোটাতাজা হয় এবং এক বছর বয়সের মতো মনে হয়, তাহলে তা দিয়েই কোরবানি বৈধ। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির ক্ষেত্রে একটি পশু শুধু এক ব্যক্তিই কোরবানি দিতে পারবে। গরু, মহিষ, উট সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তি মিলে কোরবানি দিতে পারবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরিক হতে পারে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৩১৮)
মহানবী (সা.)-এর কোরবানি
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর কোরবানির হুকুম অবতীর্ণ হয়। হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি প্রথাটা কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের কী লাভ?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে।’ সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সওফ তথা দুম্বা, ভেড়া ও উটের পশমের বিনিময়ে কি এ পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেওয়া হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই কোরবানি করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার ১০ বছর জীবনের প্রতিবছরই কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
কাজেই সামর্থ্য থাকলে কোরবানি করা থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, দান করা পৃথক একটি ইবাদত। অন্যদিকে কোরবানি করা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। উভয় ইবাদতের একটি অন্যটির পরিপূরক নয়। তাই কোরবানির অর্থ দান করলে কোরবানির সওয়াব পাওয়া যাবে না। এর মাধ্যমে কোরবানি আদায় হবে না। তবে দানের সওয়াব পাওয়া যাবে।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুল মদিনা, নবাবপুর, ঢাকা।

প্রশ্ন : ৩১১ : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্পর্কে কুরআন হাদীসের বানী।

আত্মীয় বলতে আমরা বুঝি আপন লোকজনকে। এক বংশ ও রক্ত যার শরীরে বহমান তিনিই রক্ত সম্পর্কের আপনজন। আবার কুটুম্বিতার দরুনও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক কাছের ও দূরের বিভাজনে বিভক্ত।
আত্মীয় বলতে আমরা বুঝি আপন লোকজনকে। এক বংশ ও রক্ত যার শরীরে বহমান তিনিই রক্ত সম্পর্কের আপনজন। আবার কুটুম্বিতার দরুনও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক কাছের ও দূরের বিভাজনে বিভক্ত। তবে, আত্মীয়স্বজন বলতে আমরা বুঝি আত্মিক সম্পর্ক, যিনি আমার সুখে সুখী, আমার দুঃখে দুঃখী, তিনিই আমার আত্মীয়। আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় বিধান। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গোনাহ। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীর জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যেমন রয়েছে পুরস্কার, তেমনই এ সম্পর্ক ছিন্নকারীর জন্য রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি।
ইসলাম আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর প্রতি কঠিন শাস্তি ও আজাবের কথা ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের বিষয়ে বলা হয়েছে-
আল্লাহর অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হবে
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের নিন্দা করেছেন এবং তারা মহান রবের অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হবে বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর (ইবাদত করার) দেওয়া প্রতিশ্রুতির পর তা লঙ্ঘন করে, আর (আত্মীয়তার) সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।’ -সূরা আর রাদ: ২৫
তার নেক আমলসমূহ কবুল হবে না
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর নেক আমল আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। আদম সন্তানের আমল সপ্তাহে একদিন আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আল্লাহতায়ালা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর আমলগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের আমল (সপ্তাহের) প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুমার রাতে আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কোনো আমল কবুল করা হয় না।’ -আহমাদ: ২/৪৮৪

জান্নাতে প্রবেশ করবে না
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কঠোর শাস্তি সম্পর্কে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিসে বর্ণনা এসেছে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে মহানবী ঘোষণা দিয়েছেন। হজরত যুবাইর ইবনে মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি পাবে
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর শাস্তি শুধু আখেরাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জগতেই শাস্তি পেতে হবে। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়াতে যে (দুই) অপরাধের শাস্তি আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত দ্রুত কার্যকর করে থাকেন এবং আখেরাতেও এর শাস্তি অব্যাহত থাকবে, সে দু’টি অপরাধ হলো- ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। -জামে তিরমিজি 
আল্লাহতায়ালা সম্পর্ক ছিন্ন করবেন
কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে আল্লাহতায়ালাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি রহমান। আমি আত্মীয়তার জন্য আমার নাম থেকে একটি নাম বাছাই করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’ –সুনানে আবু দাউদ

প্রশ্ন: ৩১০: কিয়াামতের দিন কুরআন ও রোজা মুমিন ব্যাক্তিদের জন্য সুপারিশকারী হওয়ার দলিল ।

★৬৫.আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ
يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَىْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِى فِيهِ. وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِى فِيهِ. قَالَ فَيُشَفَّعَانِ
”রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে।রোযা বলবে, হে প্রভু, আমি তাকে দিনের বেলায় খাদ্য ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে বাধা দিয়েছিলাম।
অতএব: আঁপনি তার ব্যাপারে আমার শাফায়ত কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম থেকে বাধা দিয়েছিলাম। অতএব,তার ব্যাপারে আমার শাফায়ত কবুল করুন। অত:পর তাদের শাফায়াত কবুল করা হবে।”
[মুসনাদ আহমদ, মুসনাদে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর হাদীস নং ৬৭৮৫, শামেলা, সনদ সহীহ আল-মুস্তাদরাক, হাদীস নং ২০৩৬ তাবরানী শরীফ, সুনানুল কুবরা, ইবনে আবিদ্দুনইয়া]

প্রশ্ন: ৩০৯ : পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত নবীগণের নাম।

হজরত আবু জর গিফারি রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীদের সংখ্যা কত? তিনি জবাব দিলেন, ১ লাখ ২৪ হাজার। তাদের মধ্যে ৩১৫ জন হচ্ছেন রাসূল।

তবে কোরআনে কারিমে মাত্র ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের কারও কারও আলোচনা বিভিন্ন সূরায় একাধিক জায়গায় স্থান পেয়েছে। আবার কারও কারও নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এর সংখ্যা মাত্র ৫টি।

কোরআনে কারিম যেহেতু হেদায়েতের বাণী ও উপদেশগ্রন্থ, তাই অতীতকালের জাতি ও সম্প্রদায়ের ঘটনাবলি, তাদের ভালো-মন্দ আমল ও তার পরিণতি বর্ণনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ধারা বর্ণনাপদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। বরং সত্য প্রচারের লক্ষ্যে দাওয়াত প্রদানের মুখ্যতম পন্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে প্রাচীনকালের সম্প্রদায় ও তাদের প্রতি প্রেরিত পয়গম্বরদের আলোচনা বারবার শ্রবণ করার ফলে শ্রোতাদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যেতে পারে এবং তা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ উপযোগীও বটে। কোরআনে কারিমে বর্ণিত ২৫ জন নবীর নাম হলো-

১. হজরত আদম আলাইহিস সালাম। মোট ৯টি সূরার ২৫ জায়গায় তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সর্বপ্রথম মানুষ ও নবী ছিলেন।

২. হজরত ইদরিস আলাইহিস সালাম। কোরআনের দু’টি সূরায় দু’বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তিনি সর্বপ্রথম কলম দ্বারা লিখেছেন। আল্লাহতায়ালা তাকে সিদ্দিক হিসেবে কোরআনে আখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি সর্বপ্রথম কাপড় সেলাই করে পরিধান করা শুরু করেন।

৩. হজরত নুহ আলাইহিস সালাম। ২৮টি সূরায় ৪৩ বার উল্লেখ করা হয়েছে এই নবীর নাম। তিনি নিজ জাতিকে সাড়ে ৯শ’ বছর দাওয়াত দিয়েছেন। তার ছেলে কেনানকে কুফরির কারণে আল্লাহতায়ালা মহাপ্লাবনে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।

৪. হজরত হুদ আলাইহিস সালামের নাম তিনটি সূরায় সাতবার উল্লেখিত হয়েছে। তাকে আদ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল। নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়কে প্লাবন দ্বারা ধ্বংস করার পর সর্বপ্রথম তার সম্প্রদায়ের লোকেরা মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ তাদেরকে প্রচন্ড ঝড় দ্বারা ধ্বংস করে দেন।


৫. হজরত সালেহ আলাইহিস সালামের নাম চারটি সূরায় ৯ স্থানে উল্লেখ আছে। তাকে ছামূদ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়। সালেহ (আ.)-এর মুজেযা ছিল উটনি।
 
৬. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নাম ২৫ সূরায় ৬৯ বার উল্লেখ হয়েছে। তিনি ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন ও ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেন। পরে আল্লাহতায়ালার হুকুমে স্ত্রী ও শিশু সন্তান ইসমাঈলকে জনমানবহীন মক্কায় রেখে আসেন।

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আবুল আম্বিয়া বা নবীদের পিতা বলা হয়। তিনি ছেলে ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে কাবা ঘর নির্মাণ করেন ও সর্বপ্রথম মানুষকে বায়তুল্লাহর হজ করার জন্য আহবান করেন।

৭. হজরত লুত আলাইহিস সালাম। চৌদ্দটি সূরায় ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম। তার স্ত্রী কাফের ছিল। তার সম্প্রদায়ের লোকেরা সমকামিতার মতো পাপে লিপ্ত ছিলো। ফলে আল্লাহতায়ালা তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন।

৮. হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। আট সূরায় ১২ জায়গায় উল্লেখ হয়েছে এই নবীর নাম। জন্মের পূর্বেই তাকে বিজ্ঞ বলে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল।

৯. হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম। কোরআনের ১২টি সূরায় মোট ১৭ বার আলোচিত হয়েছে তার নাম। তিনি ও ইসমাঈল (আ.) সম্পর্কে ভাই ছিলেন।

১০. হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। ১০টি সূরায় ১৬ বার আলোচিত হয়েছে তার নাম। তার আরেক নাম হলো- ইসরাইল। তার নামানুসারে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে।

১১. হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম। তিনটি সূরায় ২৭ বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। এ ছাড়া সূরা ইউসুফ নামে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা সম্বলিত একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে কোরআনে। তিনি নিজে নবী ছিলেন এবং তার পিতা ইয়াকুব (আ.), তার দাদা ইসহাক (আ.)  ও পরদাদা ইবরাহীম (আ) নবী ছিলেন।

১২. হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম। চার সূরায় ১১ বার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম। তার সম্প্রদায়ের লোকেরা মাপে বা ওজনে কম দেওয়ার প্রেক্ষিতে আজাবপ্রাপ্ত হয়েছিল।

১৩. হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম। চারটি সূরার চার জায়গায় আলোচিত হয়েছে তার নাম। আল্লাহতায়ালা তাকে দীর্ঘকাল কঠিন অসুখ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ধৈর্যধারণ করে ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

১৪. হজরত যুলকিফল আলাইহিস সালাম। দু‍’টি সূরায় দু’বার আলোচিত হয়েছে তার নাম।

১৫. হজরত মুসা আলাইহিস সালাম। পবিত্র কোরআনে সবচেয়ে বেশি বার তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৪টি সূরায় ১৩৭ বার আলোচিত হয়েছেন তিনি। বনী ইসরাঈলের প্রথম নবী ছিলেন তিনি। জন্মের পর মুসা আলাইহিস সালামকে তার মা বাক্সে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহর কুদরত হিসেবে পরে তিনি জালেম বাদশা ফেরাউনের বাড়ীতে লালিত-পালিত হন। নবী মূসাকে আল্লাহতায়ালা অনেকগুলো মুজেযা দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে একটি হলো- মূসা (আ.) তার হাতের লাঠি মাটিতে রেখে দিলে তা বিশাল বড় সাপে পরিণত হতো। পরে তিনি সেটা হাতে নিলে আবার লাঠি হয়ে যেত।

১৬. হজরত হারুন আলাইহিস সালাম। ১৩টি সূরায় ২০ বার আলোচিত হয়েছেন তিনি। তিনি নবী মূসা (আ.)-এর ভাই ছিলেন। বাগ্মীতার পারদর্শী ছিলেন তিনি।

১৭. হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। ৯টি সূরায় ১৬ বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তিনি নিজে রোজগার করে সংসার চালাতেন। তাকে যাবুর কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, আরেকদিন রাখতেন না।

১৮. হজরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম। সাতটি সূরায় ১৭ বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তিনি সারা পৃথিবীর বাদশাহ ছিলেন। পশু-পাখীদের ভাষা বুঝাসহ মুজেযাস্বরূপ বাতাস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন তিনি।

১৯. হজরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম। দু’টি সূরায় তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম।

২০. হজরত ইয়াসা আলাইহিস সালাম। কোরআনে কারিমের দু’টি সূরায় দু’বার অালোচনা করা হয়েছে তার প্রসঙ্গ।

২১. হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম। দু’টি সূরায় দু’বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তাকে মাছে গিলে ফেলেছিল। পরে তিনি দোয়া করার পর আল্লাহতায়ালা তাকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি নিনুওয়া এলাকার লোকদের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন। পূর্ববর্তী সমস্ত নবীর অধিকাংশ উম্মত তাদের সঙ্গে কুফরি করলেও ইউনুস (আ.)-এর সম্প্রদায়ের সবাই তার প্রতি ঈমান এনেছিলেন।

২২. হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম। চারটি সূরায় সাতবার উল্লেখ হয়েছে পেশায় কাঠুরে এই নবীর নাম।

২৩. হজরত ইয়াইয়া আলাইহিম সালাম। চারটি সূরায় পাঁচবার উল্লেখ হয়েছে তার প্রসঙ্গ। তাকে কিশোর অবস্থাতেই আল্লাহ জ্ঞানী করেছিলেন এবং তাকে তাওরাতের শিক্ষা দিয়েছিলেন।

২৪. হজরত ঈসা আলাইহি সালাম। ১১টি সূরায় ২৫ বার উল্লেখ হয়েছে তার প্রসঙ্গে। তিনি বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের সর্বশেষ নবী। তার আরেক নাম মাসিহ।

২৫. হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। চারটি সূরায় মাত্র চার জায়গায় তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য স্থানে তার গুণবাচক নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অথবা আইয়ুহান নবী কিংবা আইয়ুহার রাসূল বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এটা বিশ্বনবীর সম্মান ও মর্যাদার পরিচয় বহন করে।

প্রশ্ন: ৩০৮ : নামাজে পঠিত আত্তাহিয়াতু, দুরুদ,দোয়া মাসূরা,রুকু, সিজদাহ্ দোয়ার হাদিস ও অর্থ।

উত্তরটি মাওলানা মওদূদী রাহ: এর রচিত  “নামাজ রোজার হাকীকত” বই থেকে দেওয়া হলো। বইটির ডাউনলোড লিংক:    ডাউনলোড করুন। 

নামাযে কি পড়েন

নামায মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত, দাসত্ব ও আনুগ্যত স্বীকার করে চলার জন্য কিভাবে প্রস্তুত করে, তা পূর্বে বিস্তারিতরূপে আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে যা কিছু লেখা হয়েছে তা পাঠ করে আপনি পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, একজন মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম এবং ফরয মনে করে রীতিমতো নামায আদায় করে, তবে সে নামাযে দোআ ও সুরাগুলের কোন অর্থ বুঝতে না পারলেও এ নামাজ তার মনে আল্লাহর ভয়, আল্লাহর হাযের-নাযের হওয়ার কথা এবং তাঁর আদালতে একদিন উপস্থিত হওয়ার বিশ্বাস নিসন্দেহে সবসময়ই জাগরুক রাখবে। সবসময় সে মনে করবে যে, সে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো দাস নয়- আল্লাহই তার প্রকৃত বাদশাহ এবং প্রভু। এরই ফলে তার মধ্যে কর্তব্য পালনের অভ্যাস হবে এবং সকল অবস্থায়ই সে আল্লাহর বিধান পালন করে চলার জন্য প্রস্তুত থাকবে। মানুষের সমগ্র জীবনকে আল্লাহর বন্দেগীর অধীনে যাপন করতে এবং গোটা জীবনকে এবাদাতে পরিনত করতে হলে যে সব গুন -সিফাত অবশ্য প্রয়োজনীয় তাও এ নামাযের সাহায্যে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়। নামায দ্বারা এ উপকার কিরূপে লাভ করা যায় তাও আপনারা পূর্বের প্রবন্ধে ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন আশা করি।
এখন বুঝে দেখতে হবে যে, নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ না বুঝে নামায পড়লে যদি এতবড় উপকার লাভ করা যায়, তাহলে কেউ যদি নামায ভালোভাবে বুঝে-শুনে পড়ে, সে যা পড়ছে তা যদি সে হৃদয়-মন দিয়ে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে তবে তার বিশ্বাস, মতবাদ, চিন্তাধারা এবং অভ্যাস ও স্বভাবের কি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হতে পারে এবং তার গোটা জীবন কিরূপ আদর্শে গঠিত হতে পারে, এখানে আমি এ বিষয়ই পুংখানুপুংখরূপে আলোচনার চেষ্টা করবো।
সর্বপ্রথম আযান সম্পর্কে ভেবে দেখুন। দৈনিক পাঁচবার আপনাকে কি বলে ডাকা হয়? বলা হয়ঃ
ٱللهُ أَكْبَر -‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সকলের বড়।’
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَـٰهَ إِلَّا ٱللهُ -‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন আর কোন মা’বুদ নেই। বন্দেগীর যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।’
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رُسُولُ ٱلله – ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।’
حَيَّ عَلَىٰ ٱلصَّلاة – ‘নামাজের জন্য আস’
حَيَّ عَلَىٰ ٱلْفَلاَح -‘যে কাজে কল্যান ও মঙ্গল সেই কাজের দিকে আস।’
الله أكبر -‘আল্লাহ্‌ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
لا إله إلا الله -‘আল্লাহ্‌ ছাড়া ভিন্ন কোনো মা’বুদ নেই।’
ভেবে দেখুন, এটা কত বড় শক্তিশালী ডাক। এ ডাক প্রত্যেক দিন পাঁচবার আপনাদেরকে একথায়ই স্মরণ করিয়ে দেয়, “পৃথিবীতে যতবড় খোদায়ীর দাবিদার দেখা যাচ্ছে, তারা সকলেই মিথ্যাবাদী, আকাশ ও পৃথিবীতে মাত্র একজনই খোদায়ী ও প্রভুত্বের অধিকারী এবং কেবল তিনি ইবাদাতের যোগ্য। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁরই ইবাদাত করি। ইবাদাতেই আমাদের সকলের জন্য ইহকালের ও পরকালের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।”
এ মর্মস্পর্শী আওয়ায শুনে কে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে? যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান আছে, এতবড় নির্ভীক সাক্ষ্য এবং এত স্পষ্ট আহবান শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয় এবং প্রকৃত প্রভূ-মালিকের দরবারে হাজির হয়ে তার সামনে মাথা নত না করেও সে কিছুতেই থাকতে পারে না।
এ ডাক শুনেই আপনি উঠে পড়েন এবং সর্বপ্রথমেই আপনি চিন্তা করে দেখেন, আমি কি পবিত্র, না অপবিত্র? আমার জামা-কাপড় পাক কিনা? আমার অযু আছে কি নেই? অন্য কথায় আপনার সুস্পষ্ট অনুভূতি থাকে যে, উভয় জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজিরা দেয়ার বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য সকল বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। অন্যান্য কাজ তো সকল অবস্থাতেই করা যায়, কিন্তু এ মহান দরবারে শুধু দেহ ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতাই যথেষ্ট নয় অতিরিক্ত (বিশেষ) পবিত্রতাও (অর্থাৎ অযু) একান্ত অপরিহার্য। এরূপ পবিত্রতা ছাড়া এখানে হাজিরা দেয়া ভীষণ বেয়াদবী। এ অনুভূতির সাথেই আপনি প্রথমে পবিত্র হওয়ার কথা চিন্তা করেন এবং তারপরে অযু করা আরম্ভ করেন। এ অযুর সময়ে যদি আপনি প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ ধোয়ার সময় এবং অযু শেষ করার পর হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো দোআসমূহ পাঠ করেন এবং আল্লাহকে যথাযথরূপে স্মরণ করেন, তাহলে শুধু যে আপনার অংগ-প্রত্যংগই ধোয়া হবে তা নয়, বরং আপনার অন্তরকেও ধৌত (পবিত্র) করা হবে। অযু শেষ করার পর নিম্ন দো’আ পড়তে হবেঃ
اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ” “أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক ও অদ্বিতীয় লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তুর্ভূক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অবলম্বনকারী বানাও।”
এরপর আপনি নামাযের জন্য দাঁড়ান। আপনার মুখ থাকে পবিত্র কেবলার দিকে। আপনি পাক-পবিত্র হয়ে সমগ্র জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজির হন।
সর্বপ্রথমেই আপনার মুখ থেকে বের হয়ঃ ٱللهُ أَكْبَر‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
মনে ও মুখে এ বিরাট অঙ্গীকার উচ্চারণ করে আপনি দুনিয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস হতে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করার প্রতীক হিসেবে কান পর্যন্ত দু’হাত তোলেন এবং আপনার বাদশার সামনে হাত বেঁধে দণ্ডায়মান হন। এরপরে নিরতিশয় বিনয় সহকারে আপনি আরয করেনঃ
 سبحانك اللهم و بحمدك، وتبارك اسمك، و تعالى جدك، ولا إله غيرك
“হে আল্লাহ! আমি তোমারই পবিত্রতা বর্ণনা করছি, তোমার প্রশংসা সহকারে তোমার নামের বরকত ও মাহাত্ন্য সত্যই অতুলনীয়। তুমি সর্বশ্রেষ্ট, তোমার সম্মন সকলের উচ্চে। তুমি ছাড়া কেউ মা’বুদ নেই।”
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
“অভিশপ্ত মরদুদ শয়তানের কবল হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।”
بسم الله الرحمن الرحيم
“মেহেরবান-দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি।”
الحمد لله رب العالمين
-“সারাজাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই সমগ্র ও সর্বপ্রকার তারীফ-প্রশংসা।”
الرحمن الرحيم
-তিনি অত্যন্ত দয়াময় ও মেহেরবান।
مالك يوم الدين
-তিনি বিচার দিনের একমাত্র মালিক। যেদিন মানুষের যাবতীয় কর্মের বিচার করা হবে এবং প্রত্যেককে তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
إياك نعبدوإياك نستعين
-হে মালিক! আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।
اهدنا الصراط المستقيم
-আমাদেরকে সহজ, সোজা, সঠিক পথ দেখাও।
صراط الذين أنعمت عليهم
-তাদের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ ও পুরস্কার প্রাপ্ত।
غير المغضوب عليهم ولأ الضا لين
-আর যারা অভিশপ্ত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত নয়।
-হে আল্লাহ! আমাদের দোআ কবুল কর, মনোবাঞ্চনা পূর্ণ কর।
এরপর কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত পড়তে হয়। কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতই অমৃতে পরিপূর্ণ। তাতে অমূল্য উপদেশ, শিক্ষা এবং সত্য পথের দিকে আহবান রয়েছে। সূরা ফাতেহায় যে সহজ ও সোজা পথের জন্য দোআ করা হয়, তাতে সেই সোজা পথেরই হেদায়াত ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি সূরার উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
وَالعَصرِ إِنَّ الإِنسانَ لَفي خُسرٍ إِلَّا الَّذينَ آمَنوا وَعَمِلُوا الصّالِحاتِ وَتَواصَوا بِالحَقِّ وَتَواصَوا بِالصَّبرِ
“কালের শপথ! সমগ্র মানুষ ধ্বংসের মুখে। কেবল তারা ছাড়া যারা ঈমানদার এবং (ঈমানের দাবি অনুযায়ী) সৎকর্মশীল এবং যারা পরস্পর পরস্পরকে সত্য পথে চলতে উপদেশ ও পরামর্শ দেয় এবং সত্য পথে দৃঢ় ও মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে (কেবল তারাই ধ্বংসের পথ হতে রক্ষা পেতে পারে)।”
এ ছোট সূরাটি হতে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, ধ্বংস ও ব্যর্থতা হতে মানুষ কেবল একটি মাত্র উপায়ে বাঁচতে পারে। তা এই যে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী আমল করাই যথেষ্ঠ নয়, বরং সাথে সাথে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের এমন একটা সুসংগঠিত দলও থাকা আবশ্যক, যে দল পরস্পরকে এবং দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে সত্যের পথে- ন্যায়ের দিকে আহবান জানাবে এবং সর্বপ্রকার দুঃখ-বিপদে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের ওপর সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে।
কিংবা অন্য কোনো সূরা যেমনঃ
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ
فَذَٰلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ
وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ
الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ
وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ
“হিসাব-নিকাশের দিন-কেয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসী ব্যক্তি কি রকম হয়, তা তুমি দেখেছ কি? এ ধরনের মানুষই এতিমকে বিতাড়িত করে এবং গরীব মিসকীনকে নিজেরা তো আহার দান করেই না- এমনকি অন্য লোকদেরকেও এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার করে না। এমন সব নামাযীর জন্য ধ্বংস (পরকালের প্রতি অবিশ্বাস করার কারনে) যারা নামাযে গাফলতি করে, এরা নামায পড়লেও তা কেবল লোক দেখানোর জন্যই পড়ে এবং তাদের মন এত সংকীর্ণ যে, অতি সামান্য ও ছোট-খাটো জিনিসও অভাবীদেরকে দিতে কুন্ঠিত হয়।”
এ সূরাটির মূল শিক্ষা এই যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করা ইসলামের প্রাণ স্বরূপ। (এটা না থাকলে ইসলামের কাজই প্রাণহীন দেহের মতই অর্থহীন)। এছাড়া কোনো মানুষই আল্লাহর দেখানো সহজ সরল পথে চলতে পারে না। আর একটি সূরাঃ
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ
يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ
كَلَّا ۖ لَيُنبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ
نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ
الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ
إِنَّهَا عَلَيْهِم مُّؤْصَدَةٌ
فِي عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ
“অন্যের দোষ অন্বেষণ করা এবং পরকে হীন প্রতিপন্ন করে অপমানসূচক কথা বলা-ই যাদের অভ্যাস তাদের সকলের জন্য আফসোস। তারা কেবল টাকা-পয়সা জমা করে এবং (তা কি রকম বাড়ছে) বার বার গুনে দেখে। তাদের ধারণা এই যে, তাদের ধন-সম্পত্তি তাদের কাছে চিরদিন থাকবে। তা কখনই নয়। একদিন তারা নিশ্চয় মরবে এবং হুতামা নামক জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জান হুতামা কি? তা আল্লাহর জ্বালানো অগ্নিকুণ্ড; তার লেলিহান শিখা কলিজা পর্যন্ত ভষ্ম করে। তা বড় এবং সুউচ্চ স্তম্ভের ন্যায় অগ্নি শিখা যা তাদেরকে ঘিরে ফেলবে।”
এভাবে নামাযে কুরআন শরীফের যেসব সূরা এবং আয়াত পাঠ করা হয় তাদের মধ্যে কোনো না কোনো মূল্যবান শিক্ষা এবং উপদেশ থাকে। তা মানবকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয় যে, মানুষের প্রতি আল্লাহর এ হুকুম অনুসারে দুনিয়াতে কাজ করতে হবে। এসব হেদায়াত ও উপদেশের আয়াত পড়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে রুকূ’তে যান। হাঁটুর ওপর হাত রেখে দুনিয়া জাহানের আল্লাহ তাআলার সামনে মাথা নত করে বারবার বলতে থাকেনঃ

”সুবহানা রাব্বিয়াল আজীম” 
 “অতি পবিত্র আমার মহান পালনকর্তা পরওয়ারদেগার।”

তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে বলেনঃ (”সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ “ ) “যে ব্যাক্তি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলো, তার কথা আল্লাহ্‌ শুনতে পেয়েছেন।”

তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং বলেনঃ (”রাব্বানা লাকাল হামদ”), “হে আমাদের রব, সকল প্রশংসা শুধু তোমার জন্যই” ।

এরপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাটির সাথে মাথা মিশিয়ে সেজদা করেন এবং বলেনঃ (”সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা।” ) “আমি মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”

পরে মাথা উঠান এবং আদবের সাথে বসে (আত্তাহিয়্যাতু)  পাঠ করেনঃ
 التحيات لله والصلوات والطيبات، السلام عليك أيها النبي ورحمة لله
وبركاته، السلام علينا و على عباد الله الصالحين، أشهد أن لا إله إلا الله، وأشهد أن محمدا عبده و رسوله.
“আমাদের সব সালাম-শ্রদ্ধা, আমাদের সব নামায এবং সকল প্রকার পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য।”
-হে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আপনার ওপর আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।
-আমাদের ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ প্রভূ ও মা’বুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্‌ তাআলার বান্দাহ এবং রাসূল।”
এভাবে আপনি যখন সাক্ষ্য দেন তখন আপনাকে শাহাদাত আঙ্গুল ওঠাতে হয়। কেননা এ আঙ্গুলি সংকেত দ্বারা নামাযের মধ্যেই আপনার আকীদা ও বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করা হয় এবং এ সাক্ষ্যের কথাটি মুখে বলার সময় বিশেষভাবে মনোযোগ স্থাপন করতে এবং মন-মগযের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়। এরপর আপনাকে নিম্নের দরূদ পাঠ করতে হয়ঃ

اللهم
 صل على محمد وعلى آل محمد، كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم، وبارك على محمد وعلى آل محمد، كما باركت على إبراهيم
 وعلى آل إبراهيم، في العالمين إنك حميد مجيد.
“হে আল্লাহ! দয়া ও রহমত কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি, যেমন তুমি রহমত করেছো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি অতি উত্তম গুনের আধার এবং মহান। হে আল্লাহ! বরকত নাযিল কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার বংশধরদের ওপর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তার বংশধরদের ওপরে করেছো। নিশ্চয়ই তুমি অতীব সৎগুন বিশিষ্ট ও মহান।”
দরূদ পড়ার পরে আল্লাহর কাছে এভাবে দোআ করেনঃ
اللهم إني أعوذ بك من عذاب جهنم، و من عذاب القبر، و من فتنة المحيا و الممات، و من فتنة المسيح الدجال، رب اغفر لي و لوالدي رب ارحمهما كما ربياني صغيرا.
“হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের আযাব হতে বাঁচার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় চাই। কবরের আযাব থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই। সেই পথভ্রষ্টকারী দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তোমার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর অনিষ্ট থেকে । হে আল্লাহ! অন্যায় কাজ এবং ঋণ থেকেও তোমার কাছে আশ্রয় চাই।”
এ দোআ পাঠ করার পর নামায পূর্ণ হয়ে যায়। রাব্বুল আলামীনের দরবার থেকে বিদায় নিয়ে সর্বপ্রথম ডান ও বাম দিকে ফিরে উপস্থিত সকলের এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য রহমত ও শান্তি প্রার্থনা করে বলেনঃ
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ
 “আপনাদের প্রতি আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।” এটা যেন একটি শুভ সংবাদ; নামাযের পর আল্লাহর দরবার থেকে এটা নিয়েই আপনি ফিরে এসেছেন। এভাবেই নামায আদায় করেন অতি ভোরে উঠে দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম শুরু করার পূর্বেই। তারপর অনেক ঘণ্টা যাবত দুনিয়ার নানা কাজে লিপ্ত থাকেন। দ্বিপ্রহরের একটু পরেই আবার আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে নামায আদায় করেন-তার কয়েক ঘণ্টা পরেই বেলা তৃতীয় প্রহরেও আবার এ নামায আদায় করেন। আবার কয়েক ঘণ্টা কাজ-কর্ম করার পর সূর্যাস্ত হলেই আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে এ নামায আদায় করেন। তারপর দুনিয়ার কাজ-কর্ম শেষ হয়ে গেলে ঘুমাবার পূর্বে শেষবারের মত আল্লাহর সামনে হাজির হন। এ শেষ নামাযের শেষ তিন রাকআতের নাম ‘বেতেরের নামায।’ এর তৃতীয় রাকআতে আল্লাহর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা করেন। এ প্রতিজ্ঞার নাম ‘দোআয়ে কুনুত।’ এ দোআর মরফতে নামাযী আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্রতার সাথে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের শপথ গ্রহন করে। তাঁর অনুগত হয়ে চলার ওয়াদা করে। এ প্রতিজ্ঞায় আপনি কি বলেন মনোযোগ সহকারে শুনুনঃ
اللهم إنا نستعينك ونستغفرك ونؤمن بك ونتوكل عليك ونثني عليك الخير ونشكرك ولا نكفرك ونخلع ونترك من يفجرك
اللهم إياك نعبد ولك نصلي ونسجد وإليك نسعى ونحفد ونرجو رحمتك ونخشى عذابك إن عذابك بالكفار ملحق
“হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই। তোমার কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। তোমার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি। আমরা কেবলমাত্র তোমার ওপরেই ভরসা করি। সর্বপ্রকার কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে তোমার প্রশংসা করি। আমরা তোমার শোকর আদায় করি, তোমার দানকে অস্বীকার করি না। আমরা তোমার কাছে ওয়াদা করছি যে, তোমার অবাধ্য লোকদের সাথে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখবো না-তাদেরকে পরিত্যাগ করবো। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব স্বীকার করি। কেবলমাত্র তোমার জন্যই নামায পড়ি, কেবল তোমাকেই সিজদা করি এবং আমাদের সকল প্রকার চেষ্টা-সাধনা ও সকল কষ্ট স্বীকার কেবল তোমার সন্তুষ্টির জন্যই। কষ্ট আমরা কেবল তোমারই রহমত লাভের আশায় করি, তোমার আযাবকে আমরা ভয় করি। নিশ্চয়ই তোমার আযাবে কেবল কাফেরগণই নিক্ষিপ্ত হবে।”
একটু ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচবার আযানের ধ্বনি শুনে এবং চিন্তা করে দেখে যে, কত বড় কথা সেই আযানেই ঘোষণা করা হচ্ছে এবং তা দ্বারা কত বড় মহান বাদশাহর কাছে হাজির হবার জন্য আহবান হানানো হচ্ছে। প্রতিবার আযান শুনে যে ব্যক্তি তা মনে মনে অনুভব করে নিজের সকল কাজ-কর্ম ছেড়ে সারাজাহানের মালিক ও প্রভুর দরবারে হাজির হয়, প্রতি নামাযের পূর্বে অযু করে নিজের দেহ ও মনকে পবিত্র করে নেয় এবং বারবার নামাযে উল্লেখিত রূপে সূরা ও দোয়া মনোযোগ সহকারে পাঠ করে প্রকৃতপক্ষে তার হৃদয়-মনে আল্লাহর ভয় না জেগে পারে না। আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে তার লজ্জা না হয়ে পারে না। পাপ ও অন্যায় কাজের কালো চিহ্ন নিয়ে আল্লাহর দরবারে বারবার হাজির হতে তার অন্তরাত্না নিশ্চয় কেঁপে ওঠবে। নামাযে আল্লাহর দাসত্ব এবং তাঁর আনুগত্য করে চলার কথা বলা এবং আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক বলে বারবার স্বীকার করার পর কোন মানুষ বাহির দুনিয়ায় নিজের কাজ-কর্মের মধ্যে ফিরে এসে মিথ্যা কথা বলা, বেঈমানী করা, পরের হক আত্নসাৎ করা, ঘুষ খাওয়া ও দেয়া , সুদ খাওয়া ও দেয়া, অন্য মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া, নির্লজ্জতা, ব্যাভিচার ও অন্যায় প্রভৃতি কাজ কিছুই করতে পারে না কিংবা এগুলো করার পর পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে এসব কথা মুখে স্বীকার করার দুঃসাহস করতে পারে না। আপনি জেনে বুঝে দৈনিক অসংখ্যবার আল্লাহর সামনে স্বীকার করেন, “হে আল্লাহ! আমি কেবল তোমার দাসত্ব করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।” এটা স্বীকার করে আপনার পক্ষে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করা এবং অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? একবার এসব স্বীকার করে তার বিরোধিতা করলে পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হতে আপনার মন আপনাকে তিরস্কার করবে, লজ্জায় আপনার মাথা নত হয়ে পড়বে। আবার বিরোধিতা করলে আরো বেশী লজ্জা হবে এবং বিবেক আপনাকে আরো বেশী দংশন করবে। সমস্ত জীবন ভরে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়া সত্ত্বেও আপনার কাজ-কর্ম ও চরিত্র ঠিক না হওয়া এবং আপনার জীবনের আমূল পরিবর্তন সূচিত না হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা নামাযের এ সুফল দান প্রসংগে বলেছেনঃ
إِنَّ الصَّلاةَ تَنهىٰ عَنِ الفَحشاءِ وَالمُنكَرِ
“নিশ্চয়ই নামায মানুষকে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা ও সর্বপ্রকার পাপকার্য হতে বিরত রাখে।”
কিন্তু মানুষের মন ও চরিত্র সংশোধন করার এতবড় উপায় থাকা সত্ত্বেও এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সত্ত্বেও যদি কারো চরিত্র ঠিক না হয়, যদি কেউ পাপ পথ থেকে বিরত না থাকে তবে বুঝতে হবে যে, আসলে তারই স্বভাব খারাপ। সে জন্য নামাযের কোনো ত্রুটি নেই। পানি ও সাবান কাপড়ের ময়লা পরিস্কার করে বটে; কিন্তু তাতে কয়লার ময়লা দূর না হলে সে জন্য পানি ও সাবানের কোনো দোষ দেয়া যায় না-দোষ কয়লারই হবে।
কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, আমরা নামাযে যা কিছু পড়ি তা মোটেই বুঝি না বা বুঝেও পড়ি না। আমাদের নামাযে এটা একটি অতি বড় অভাব। এটা শেখার জন্য কিছু সময় ব্যয় করলেই অভাব পূরন হতে পারে-নিজেদের মাতৃভাষায় নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ ও ভাব অনায়াসেই আপনারা শিখতে পারেন। আমি মনে করি, এতে আপনাদের বড়ই উপকার হবে।

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...