প্রশ্ন: ৩৮২ : শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত কবরের আযাব কি বন্ধ থাকে?

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ إِلَّا وَقَاهُ اللهُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ
‘‘যেকোনো মুসলমান জুমুআর দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের ফিৎনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন।’’-মুসনাদে আহমদ: 11/147; তিরমিযি, হাদিস 1074

উপরিউক্ত হাদিসের উপর ভিত্তি করেই এ কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করেছে যে, জুমুআর দিনে মৃত্যু বরণ করলেই কেল্লা ফতেহ। তার কবরের আযাব মাফ হয়ে যাবে। একারণেই যেকোনো ফাসেক-ফাজের, সুদখোর, ঘুষ-খোর মোটকথা যত বড় অপরাধীই হোক-না কেন, শুক্রবার দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ করলে সাধারণ মানুষ দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে যে, মৃত ব্যক্তির কবরে কোনো-ই আযাব হবে না; এমনটি কিয়ামত পর্যন্ত না। এর ব্যতিক্রম হতে পারে এমনটি কেউ ধারণাই করে না।

কিন্তু বাস্তবেই কি তাই? বাস্তবেই কি জুমুআর দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব মাফ হয়ে যায়? উপরিউক্ত হাদিসটি কোন পর্যায়ের? হাদিসটি কি সহিহ? বিষয়টি একটি পর্যালোচনার দাবী রাখে। প্রথমেই আমরা হাদিসটি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো এরপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
হাদিসটি ইমাম তিরমিযি রহ. নিম্নোক্ত সনদে বর্ণনা করেন-
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ، وَأَبُو عَامِرٍ الْعَقَدِيُّ، قَالَا: حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ سَعْدٍ، عَنْ سَعِيدِ بْن أَبِي هِلَالٍ، عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ سَيْفٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍ

ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন-
হাদিসটি গরিব। এটি এমন একটি হাদিস যার সনদ মুত্তাসিল নয়। রাবিয়া ইবনে সাইফ (সরাসরি) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে শুনেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

ইমাম তিরমিযি রহ. এর কথা থেকে বুঝা গেল, হাদিসটি মুত্তাসিল নয় অর্থাৎ এর সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। রাবিয়া এবং আব্দুল্লাহ এর মধ্যে কোনো রাবী বাদ পড়েছে। কিন্তু রাবিয়া এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর মাঝে বাদ পড়া সেই রাবী কে?

বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ শরহু মুশকিলিল আসার (1/250) এ ইমাম তাহাবী রহ. এর একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। তাঁর রেওয়ায়েতে রাবিয়া এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর মধ্যখানে তিনজন রাবির কথার এসেছে। এরা হচ্ছেন, আব্দুর রহমান ইবনে ক্বাহযাম, ইয়ায ইবনে ইকবা, ‘সদফ’ এর এক ব্যক্তি।

ইয়ায ইবনে উকবা একজন্য তাবেয়ী ছিলেন। (রিয়াযুন নুফুস, আবু বকর আব্দুল্লা ইবনে মুহাম্মদ আল মালেকী, পৃষ্ঠা 132) আর ‘ইবনে ক্বাহযাম’ সম্পর্কে শায়েখ শুআইব আল আরনাউত রহ. বলেন, তিনি ‘মাজহুলুল হাল’। ইবনে মাকুলা তার আল ইকমাল: 7/101-102 এর উল্লেখ করেছেন। আর ‘সদফী’ সম্পর্কে বলেন, লোকটি ‘মুবহাম’ (অস্পষ্ট)।-মুসনাদে আহমদ: 11/150

অবশ্য আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদিসটি উপরিউক্ত সনদ ছাড়াও ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।
যেমন মুসনাদেন আহমদে 11/225 নিম্নোক্ত সনদে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে:
حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ أَبِي الْعَبَّاسِ حَدَّثَنَا بَقِيَّةُ حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ سَعِيدٍ التُّجِيبِيُّ سَمِعْتُ أَبَا قَبِيلٍ الْمِصْرِيَّ يَقُولُ سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ مَاتَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ وُقِيَ فِتْنَةَ الْقَبْرِ
সনদের রাবি مُعَاوِيَةُ بْنُ سَعِيدٍ التُّجِيبِيُّ ইবনে হিব্বান ছাড়া কেউ তাঁর তাওসিক করেন নি। أَبو قَبِيلٍ الْمِصْرِيَّ কে হাফেজ ইবেন হাজার রহ. তাঁর তা‘জিলুল মানফাআহ গ্রন্থে দুর্বল বলেছেন।

হাদিসটি ইমাম বাইহাকি রহ. তাঁর ‘ইসবাতু আযাবিল কাবর’ গ্রন্থে (82) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে নিম্নোক্ত সনদে ‘মওকুফান’ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
أَخْبَرَنَا أَبُو عَبْدِ اللَّهِ، وَأَبُو سَعِيدٍ قَالا: ثَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ، نَا مُحَمَّدٌ، نَا عُثْمَانُ بْنُ صَالِحٍ، ثَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي ابْنُ لَهِيعَةَ، عَنْ سِنَانِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الصَّدَفِيِّ، أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، كَانَ يَقُولُ: " مَنْ تُوُفِّيَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ وُقِيَ الْفَتَّانَ ". وَرُوِيَ ذَلِكَ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ مَرْفُوعًا

এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের উপরিউক্ত হাদিসটির ‘শাহিদ’ তথা সমার্থক আরো কয়েকটি হাদিস রয়েছে:
এক.
হযরত আনাস রা. এর হাদিস:
হাদিসটি মুসনাদে আবু ইয়া‘লাতে নিম্নোক্ত সনদে বর্ণিত হয়েছে:
حَدَّثَنَا أَبُو مَعْمَرٍ إِسْمَاعِيلُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ وَاقِدِ بْنِ سَلامَةَ، عَنْ يَزِيدَ الرَّقَاشِيِّ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: " مَنْ مَاتَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وُقِيَ عَذَابَ الْقَبْرِ "
সনদের রাবি ‘ওয়াকিদ ইবনে সালামাহ’ এবং ‘ইয়াযিদ আর রাকাশি’ দু’জনই দুর্বল রাবী।
দুই.
হযরত জাবির রা. এর হাদিস:
হাদিসটি ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে 3/155 নিম্নোক্ত সনদে বর্ণিত হয়েছে।
حدثنا عبد الرحمن بن العباس الوراق ثنا أحمد بن داود السجستاني ثنا الحسن بن سوار أبو العلاء ثنا عمر بن موسى بن الوجيه عن محمد بن المنكدر عن جابر قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من مات يوم الجمعة أو ليلة الجمعة  أجير من عذاب القبر وجاء يوم القيامة عليه طابع الشهداء
হাদিসের সনদে উমর ইবনে মুসা নামক রাবী, হাদিস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত। বিস্তারিত দেখুন, লিসানুল মিযান: 6/148

প্রশ্ন হলো উপরিউক্ত তাখরিজকে সামনে রেখে আমরা কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হবো? হাদিসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে এবং এর কয়েকটি শাওয়াহিদ তথা সমার্থক হাদিস থাকার কারণে এটাকে সহিহ কিংবা হাসান বলবো? নাকি একথা বলবো যে, যদিও অনেক সনদ এবং শাওয়াহিদ রয়েছে কিন্তু এই সকল সনদ এবং শাওয়াহিদগুলো এই পর্যায়ের নয় যে সবগুলো মিলে হাদিসটি হাসান কিংবা সহিহের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে?

এব্যাপারে মুহা্দ্দিসীনে কেরামের মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে এটাকে ‘হাসান’ কিংবা ‘সহিহ’ মনে করেন। যেমন মুনযিরি রহ. তাঁর আততারগী: (পৃ. 1286) গ্রন্থে  সুয়তি রহ. `আল জামিউস সগির’ গ্রন্থে (ফয়জুল কাদির 5/499) হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। এছাড়াও সমসাময়িক আলেমদের মধ্যে শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ. তাঁর ‘আহকামুল জানাইয’ গ্রন্থে পৃ. 50 হাদিসটিকে ‘হাসান’ অথবা ‘সহিহ’ বলেছেন।

এর বিপরিত অনেক মুহাদ্দিস উক্ত হাদিসকে সহিহ মনে করেন না। যেমন:
ক.
ইমাম তাহাবি রহ:
তিনি তাঁর শরহু মুশকিলিল আসার গ্রন্থে (1/250) প্রথমে হযরত আয়েশা রা. থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হাদিস- إنَّ لِلْقَبْرِ لَضَغْطَةً لَوْ كَانَ أَحَدٌ نَاجِيًا مِنْهَا، نَجَا مِنْهَا سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ উল্লেখ করেন। এরপর বলেন, কেউ কেউ বলেন, এই হাদিসটি কি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিস مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ، أَوْ لَيْلَةِ الْجُمُعَةِ إِلا بَرِئَ مِنْ فِتْنَةِ الْقَبْرِ এর বিরোধী হয়ে গেল?
এরপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবন আমরের হাদিসের সনদের দুর্বলতা তুলে ধরে বলেন, এর দ্বারা (এই আলোচনার মাধ্যমে) হাদিসের সনদ যে সঠিক নয়, এসম্পর্কে আমরা অবগতি লাভ করতে পারলাম। আরো জানতে পারলাম যে তাঁর (রাবিয়া, হাদিসের রাবি) জন্য এমন কোনো কিছু রেওয়ায়েত করা বৈধ নয় যার মধ্যে আয়েশার হাদিস অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (অর্থাৎ রাবিয়ার জন্যে এমন কিছু বর্ণনা করা বৈধ নয় যা হযরত আয়েশা রা. এর পূর্বোক্ত হাদিসের বিরোধী হয়।

ইমাম তাহাবি রহ. এর কথার সারাংশ হচ্ছে-জুমুঅা বারে মৃত্যুর ফযিলত সংক্রান্ত হাদিসটি অায়েশা রা. এর হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
খ.
হাফেয যাহাবি রহ:
তিনি তাঁর মিযানুল ই‘তিদাল গ্রন্থে (7/81) এটিকে ‘মুনকার’ তথা আপত্তিজনক (এমন হাদিস যা ফাযায়েলের ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য নয়) বলেছেন।
গ.
আল্লামা কাশমিরি রহ:
তিনি তিরমিযি শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আল আরফুশ শাযী’ 2/351 তে বলেন-
ما صح الحديث في فضل موت يوم الجعة
‘‘জুমুআর দিনে মৃত্য বরণের ফযিলত-সংক্রান্ত হাদিস সঠিক নয়।’’

ঘ.
সমসামিয়ক আলেম শায়খ শুআইব আল আরনাউত রহ. মুসনাদে আহমদ (11/150) এর টিকায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদিসের ‘শাওয়াহিদ’ তথা সমার্থক কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, এসকল ‘শাওয়াহিদ’ হাদিসকে শক্তিশালি করার যোগ্যতা রাখে না। শায়খ আলবানী তাঁর ‘আল জানাইয’ গ্রন্থে (পৃ. 35) মুকারকপুরির ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ এর অনুসরণে হাদিসটিকে ‘হাসান’ কিংবা ‘সহিহ’ বলে ভুল করেছেন।

উপরিউক্ত আলোচনায় দেখা গেলো হাদিসটি সহিহ কি সহিহ নয়, এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কেরাম একমত নয়। তাহলে বিষয়টি সমাধান কীভাবে হবে? যেসকল মুহাদ্দিস হাদিসটিকে হাসান কিংবা সহিহ মনে করেন, তাদের মতানুযায়ী কি একথা বলবো, হাদিসটি যেহেতু সহিহ, সুতরাং একথা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব মাফ হয়ে যাবে। নাকি যে সকল মুহাদ্দিস উক্ত হাদিসটিকে সহিহ এবং গ্রহণযোগ্য মনে করেন না তাদের কথানুযায়ী বলবো যে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়; সুতরাং শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব মাফ হয়ে যায়, এমন কথা ভিত্তিহীন?

কি সিদ্ধান্তে উপনিত হবো? এবিষয়ে সমাধানে পৌঁছার জন্য কয়েকটি বিষয় জানা প্রয়োজন:
ক.
কবরের আযাব সত্য। কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই আযাব থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত ঈমান। দ্বিতীয় শর্ত ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন যাপন, বিশেষত যেসব গুনাহর কারণে কবরে আযাবের কথা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে সর্বোতভাবে বেঁচে থাকা এবং যেসব আমলের দ্বারা কবরের আযাব থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি বর্ণিত হয়েছে সেসব আমল গুরুত্বসহকারে করা। আর কবর ও আখিরাতকে সর্বোচ্চ সুন্দর বানানোর চেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত থাকা উচিত।
খ.
আল্লাহ তাআলা পরকালে নাজাত এবং শাস্তি থেকে মুক্তির বিষয়টি আমলের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। বিশেষ কোনো দিনে বা রাতে মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত করেন নি। তাছাড়া এটি একটি গায়রে এখতিয়ারি ফে‘ল। সুতরাং এর সাথে আযাবে কবর মাফ হওয়ার বিষয়টি বাহ্যত অযৌক্তিক।
গ.
যদি বিশেষ কোনো দিনে মৃত্যু বরণ করা ফযিলতপূর্ণ হয়ে থাকে এবং একারণেই আযাবে কবর মাফ হয়ে থাকে তবে সেই দিনটি সোমবার হওয়াই বেশি যুক্তিসংগত। কেননা সোমবার এমন একটি দিন, সহিহ হাদিসের আলোকে যে দিন আল্লাহ তাআলা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, যেদিন জান্নাতের দরজাসমূহ খোলে দেওয়া হয়।
সহিহ মুসলিমে (2566) হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সোমবার এবং বৃহস্পতিবারে জান্নাতে দরজাসমূহ খোলে দেওয়া হয়, অত:পর মুশরিক ব্যতীত সকল বান্দাকেই ক্ষমা করে দেওয়া হয়। তবে ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয় না যার অপর ভাইয়ের সাথে বিদ্বেষ রয়েছে...

এই সোমবার এমন একটি দিন যেদিন আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহর রাসুলের সাহাবিগণও সোমবারে মৃত্যুর কামনা করতেন। কিন্তু আমরা একটি হাদিস কিংবা আছারেও একথা পাই নি যে আল্লাহর রাসুলের একজন সাহাবিও শুক্রবারে মৃত্যুর কামনা করেছেন; অথচ ঐসকল সাহাবায়ে সব সময় আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকতেন এবং জাহান্নাম এবং কবরের শাস্তি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই চিন্তায় বিভোর থাকতেন। যদি এতো সহজে আযাবে-কবর থেকে মুক্তি পাওয়া যেত, তাহলে সেই কামনা তারা করতেন। কিন্তু কেউ-ই শুক্রবারে মৃত্যুর কামনা করেন নি। বরং এর বিপরিত আমরা দেখি আল্লাহর রাসুলের সবচেয়ে প্রিয় সাহাবি হযরত আবু বকর রা. আল্লাহর রাসুলের মৃত্যুর দিন অর্থাৎ সোমবারে মৃত্যুর কামনা করেছেন। হয়েছেও তাই। দেখুন, সহিহ বুখারি, হাদিস 3/252
ঘ.
ইমাম তাহাবি রহ. জুমুআর দিনে মৃত্যু বরণের ফযিলত-সংক্রান্ত হাদিসটিকে হযতর আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস-
لِلْقَبْرِ ضَغْطَةٌ لَوْ نَجَا مِنْهَا أَحَدٌ، لَنَجَا مِنْهَا سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ
‘‘কবরের একটি চাপ রয়েছে। কারো পক্ষে যদি সেই চাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো, তাহলে অবশ্যই সা‘দ ইবেন মুআয সেই চাঁপ থেকে বাঁচতেন’’
এই হাদিসের বিরোধী মনে করেন। আর এই হাদিসের কারণেই তিনি জুমুআর ফযিলত-সংক্রান্ত হাদিসকে সহিহ মনে করেন না।

‘যাগতা’ হচ্ছে-কবরের দু’পাশ মৃত ব্যক্তির শরিরের সাথে মিলে যাওয়া।

হযরত সা‘দ ইবনে মুআযের আযাবের কারণ কি? এসম্পর্কে হাকিম তিরমিযি রহ. বলেন, প্রত্যেকের কিছু-না কিছু গোনাহ তো আছেই। তাই কবরের এই ‘যাগতা’ তথা চাপের মাধ্যমে সেই অপরাধ মাফ হয়। এটি হবে অপরাধের প্রতিদান হিসেবে। ঠিক তেমনিভাবেই হযরত সা‘দ ইবনে মুআযেরও কবরের চাপ হয়েছে, প্রশ্রাব থেকে বেঁচে থাকার মধ্যে ত্রুটির কারণে। দেখুন, শরহুস সুয়ুতী আলান নাসায়ী, বাব, যাম্মাতুল কাবরি ওয়া আযাবুহু

লক্ষ্য করুন, সা‘দ ইবনে মুআযের মতো সাহাবি, সুনানে নাসায়ি (2055) এর বর্ণনা অনুযায়ী যার মৃত্যুতে আরশ কেঁপেছে, আসমানের দরজাসমূহ খোলে দেওয়া হয়েছে, সত্তর হাজার ফেরেশতা যার জানাযায় শরিক হয়েছেন; সহিহ ইবনে হিব্বানের বর্ণনা অনুযায়ী (3112) যার সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কারো পক্ষে যদি কবরের চাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো, তাহলে অবশ্যই সা‘দ ইবেন মুআয তা থেকে বাঁচতেন; এমন সাহাবিও যখন কবরের আযাব থেকে মুক্তি থেকে পান নি; সুতরাং যে লোকটি সারাটি জীবন সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, এবং নেশার মধ্যে কাটিয়েছে, যেই লোকটি সারাটি জীবন হারামের উপর কাটিয়েছে; শুধু একটি গায়রে এখতিয়ারি (অনিচ্ছাকৃত) আমল অর্থাৎ শুক্রবারে মৃত্যুর কারণে আযাবে কবর থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, বিষয়টি কি যৌক্তিক মনে হয়?
ঘ.
গোনাহগারের জন্য কবরের আযাবের বিষয়টি কুরআন হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এর বিপরিত কারো জন্য যদি আযাবে কবর মাফ হওয়ার দাবী করতে হয় তাহলে এর স্বপক্ষে অকাট্য দলিল থাকতে হবে। এসম্পর্কে মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ফিকহুল আকবারের ব্যাখ্যা গ্রন্থে আবু মুয়িনের রমযান এবং শুক্রবারে কবরের আযাব মাফ সংক্রান্ত আলোচনাটি উল্লেখ করে বলেন-
এটা সুস্পষ্ট বিষয় যে আকিদার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য হল, ইয়াকিনি তথা সুনিশ্চিত দলিল। ‘হাদিসে আহাদ’ (যে হাদিসটি মুতাওয়াতির পর্যায় পৌঁছায়নি) যদি প্রমাণিত হয় তবে তা জন্নি তথা সুনিশ্চিত দলিল নয়। তবে হাদিসটি যদি একাধিক সনদের কারনে মুতাওতিরে মানবি (এমন দলিল যা এত সুত্রে বর্ণিত হয়েছে যে যাকে যৌক্তির নিরিখে মিথ্যা বলা অসম্ভব হয়) হয় তখন সেটা কাতয়ী (সুদৃঢ় দলিল) হয়ে যাবে। ( মিনাহুর রওদিল আযহার ফি শরহে ফিকহুল আকবার-২৯৫-২৯৬)

উপরর্যুক্ত দীর্ঘ অালোচনার ভিত্তিতে বলতে চাই, শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত কবরের অাযাব মাফ হয়ে যাবে (যেমনটি লোকমুখে প্রসিদ্ধ) একথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

হ্যাঁ, শুক্রবারে মৃত্যু বরণের ফযিলত সংক্রান্ত হাদিসটি কে হাসান ধরে নিলে শুধু এতটুকু বলা যেতে পারে যে, শুক্রবারে মৃত্যু হলে শুধু ঐ দিন কবরে আযাব হবে না। (ঐ দিনের বিশেষ ফযিলতের কারণে) কিন্তু এই হাদিসের কোথাও একথা তো বলা হয় নি যে, শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত আযাব মাফ হয়ে যায়! অার অাযাবে কবরের অকাট্য দলিলগুলোর অালোকে একথা বলার সুযোগও নেই। উপরে শেষ দিকে উল্লিখিত লক্ষনীয় বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে পড়লে বিষয়টি অাপনার কাছেও সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা।

মুল্লা আলী কারী রহ. তাঁর ‘মিনাহুর রওদিল আযহার ফি শরহে ফিকহুল আকবার  (পৃ. ২৯৫-২৯৬) এ একথাটিই বলেছেন। তিনি বলেন-
ثبت في الجملة ان من مات يوم الجمعة او ليلة الجمعة يرفع العذاب عنه الا أنه لا يعود اليه الي يوم القيامة فلا اعرف له اصلا
‘‘জুমার দিনে বা জুমার রাতে যে মারা যাবে তার থেকে কবরের আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে, এটা মোটামুটি প্রমাণিত। তবে কিয়ামত পর্যন্ত আর (আজাব) ফিরে আসবে না একথার কোন ভিত্তি আমার জানা নেই।’’

আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনাকে সবাইকে কবরের আযাব থেকে মুক্তি দান করুন, আমিন।


লিংক 

প্রশ্ন: ৩৮১ : একজন মেয়ে একা কতদূরের পথ সফর করতে পারবে ?

 

যদি ৪৮ মাইল (৭৭ কিলোমিটার) বা তার বেশি দূরত্বে সফর হয়, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষদের থেকে নিজের কোনো মাহরাম আত্মীয় ভাই, বাবা বা স্বামী সঙ্গে না থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো নারীর জন্য সফর করা জায়েজ নেই। তা হজের সফর হোক বা উচ্চশিক্ষার জন্য সফর হোক কিংবা দেশ ভ্রমণ হোক। শরীয়তের বিধান হলো মহিলাদের জন্য তার মাহরাম পুরুষ ব্যতীত ৪৮ মাইল বা তদাপেক্ষা বেশী দুরুত্বের সফর করা জায়েয নয়। এর কম হলে জায়েয আছে । তবে সর্বাবস্থায় মাহরাম পুরুষের সাথে সফর করাই উত্তম। আর গাইরে মাহরামদের সাথে সফর করা মারাত্তক গোনাহ।হাদীসে মাহরাম ব্যতীত মহিলাদের সফরের ব্যপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। -বুখারী শরীফ হা: নং১০৮৬,ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৪২।


মহিলাদের ওপর হজ্জ ফরজ হওয়ার জন্য তার স্বামী বা মাহরাম শর্ত। মাহরাম ছাড়া হজ্জ সফর মহিলাদের জন্য জায়েজ নয়। (মাআরেফুল কুরআন)

 তবে সফরের দূরত্ব যদি ৪৮ মাইল বা তার কম হয় তবে ইমাম আবু হানিফাসহ কতিপয় হানাফী ইমামদের মতে মাহরাম প্রয়োজন নেই। (মাযহারী, শরহে বেকায়া ও হেদায়া) 

কিন্তু ইমাম মালিকসহ একদল হানাাফীদের মত হলো, পথ অল্প-বিস্তর যাই হোক, মাহরাম ছাড়া সাধারণ কিংবা হজ্জ; কোনো সফরই জায়েজ নয়। কারণ রাসূল (সা.) বলেছেন, মাহরাম ছাড়া কোনো মহিলা যেন সফর না করে। (বুখারী)

রিয়াদ থেকে প্রকাশিত ফতোয়ায়ে লাজনায় বলা হয়েছে, ‘যে মহিলার মাহরাম নেই সে মহিলার ওপর হজ্জ ফরজ নয়। এটা সুফিয়ান সাওরী, হাসান বসরী, ইবরাহীম নাখয়ী, ইমাম আহমদ, ইসহাক, ইবনে মুনযির ও ইমাম আজম আবু হানীফার মত। আর এটাই সঠিক।’ (ফতোয়ায়ে লাজনা) সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বাযসহ কয়েকজন বিশ্ববরেণ্য মুফতী এ ফতোয়ায় স্বাক্ষর প্রদানের মাধ্যমে তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। (লাজনা)


ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মাহরাম ছাড়া কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করবে না এবং কোনো নারী মাহরাম ব্যতীত সফর করবে না। এক সাহবী বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্ত্রী হজ্জ করতে যাচ্ছে আর আমি অমুক যুদ্ধে নাম লিখিয়েছি। রাসূল (সা.) বললেন, তোমার স্ত্রীর সাথে হজে যাও।’ (বুখারী ও মুসলিম)


রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মহিলার জন্য মাহরাম না পাওয়ার কারণে হজ্জ সফর থেকে বিরত থাকা জায়েজ নয়। তার উচিত কোনো মহিলা দলের সাথে হজ্জ সম্পন্ন করা।’ (সুনানে আবু দাউদ, মুয়াত্তা ইমাম মালিক)

‘মানুষের মধ্য থেকে যারা এই ঘরে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তারা যেন এই ঘরের হজ্জ সম্পন্ন করে। এটি তাদের ওপর আল্লাহর হক। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা আলে ইমরান, ২:৯৭) এ আয়াতে ‘মানুষ’ বলে নারী-পুরুষ উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। ‘পৌঁছার সামর্থ্য রাখা’র ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেছেন, ‘যানবাহন বা যানবাহনের ভাড়া এবং অন্যান্য পাথেয় ও খরচাদি সংগ্রহ করতে সমর্থ হওয়া। (মাযহারী, ইবনে কাসীর, তাবারী)

যেসব হাদীসে মহিলাদের জন্য সফর সঙ্গী হিসেবে মাহরাম বা স্বামী সঙ্গে থাকার কথা বলা হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো, ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়া। কোনো বিশ্বস্ত মহিলা দলের সাথে যাত্রা করলে এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে। বিশ্বস্ত মহিলা দলের ব্যাখ্যা ইমাম শাফেয়ী এভাবে করেছেন, ‘দলের কিছু সংখ্যক মহিলা নির্ভরযোগ্য হতে হবে এবং তাদের সাথে মাহরাম থাকতে হবে। তবেই এ দলের সাথে একজন মাহরামহীন মহিলা হজ্জ সফরে যেতে পারবে।’ (আসান ফেকাহ) তবে এমন কোনো পুরুষ দলের সাথে মহিলারা যেতে পারবেন না, যে দলে কয়েকজন মহিলা নেই বা নিজ মাহরাম পুরুষ নেই। (আল উম্ম)

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মাহরাম ছাড়া কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করবে না এবং কোনো নারী মাহরাম ব্যতীত সফর করবে না। এক সাহবী বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্ত্রী হজ্জ করতে যাচ্ছে আর আমি অমুক যুদ্ধে নাম লিখিয়েছি। রাসূল (সা.) বললেন, তোমার স্ত্রীর সাথে হজে যাও।’ (বুখারী ও মুসলিম)

ইসলামী শরীয়ত যদি কোনো বিষয়কে ফিতনা দূর করার জন্য নিষিদ্ধ করে থাকে তবে পরবর্তীতে ঐ ফিতনা দূর হয়ে গেলে তা বৈধ হয়ে যায়। মহিলাদের জন্য একাকী হজ্জ সফর নিষিদ্ধের কারণ হলো, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মাহরাম ছাড়া সফর করার সময় নিরাপত্তার ব্যাপরে যদি পূর্ণ বিশ্বস্ত মহিলা দল পাওয়া যায় তবে ঐ দলের সাথে সফর করা জায়েজ। (ফতোয়ায়ে কারযাভী।)

যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় তবে গাইরে মাহরাম তো বটেই, মাহরামের সঙ্গেও সফর করাও মাকরুহ। হানফী মাযহাবসহ সব ইমামই এ বিষয়ে একমত। যেমন আবু দাউদ বাযযামিয়্যাহ বর্ণনা করেছেন, আমাদের সময়ে দুধ বোন তার দুধ ভাইয়ের সাথে সফর করতে পারবে না। রদ্দুল মুহতারে বলা হয়েছে, এমনিভাবে যুগের ফাসাদের কারণে যুবতী শাশুড়ি তার মেয়ের জামাইয়ের সাথে সফর করতে পারবে না। (ইলাউস সুনান) অথচ এরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে পরস্পর পরস্পরের মাহরাম। কিন্তু পরবর্তীতে ইমামরা এটাকে অপছন্দ করেছেন এজন্য যে এখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়।

ইমামদের মাঝে যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তার মূল ভিত্তি হলো মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই মহিলাদের হজ্জের জন্য তাদের সার্বিক নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ত দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই কেবল মহিলাদের ওপর হজ্জ ফরজ বা অন্যান্য সফর জায়েজ, অন্যথায় নয়। 


আদী ইবনে হাতেম (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘হে আদী! তোমার জীবনকাল যদি দীর্ঘ হয়, তুমি অবশ্যই দেখতে পাবে, ইরাকের হীরা অঞ্চল থেকে একজন মহিলা একাকী উটের হাওদায় বসে কাবা তাওয়াফ করবে এবং সে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাবে না।’ (বুখারী ও মুসলিম) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘সে মহিলা আল্লাহর ঘর তাওয়াফের নিয়তে/উদ্দেশে একাকী আসবে তার সাথে অন্য কেউ থাকবে না।’ (ফিকহুন্নিসা।) এ হাদীসে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, ইসলামের কল্যাণে মানুষের জান মালের নিরাপত্তা এমন পর্যায়ে পৌঁছবে, মহিলারা একাকী হজের নিয়তে সফর করবে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না।। আর এর বৈধতাও এই হাদীস দ্বারাই প্রমাণীত হয়েছে। কারণ রাসূল (সা.) সতর্কতামূলক নয় বরং প্রশংসামূলকভাবেই এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। (ফতোয়ায়ে কারযাভী) এ হাদীস থেকে আলেমগণ এ যুক্তিও গ্রহণ করেছেন যে, নিরাপত্তার বিঘœ না হলে মহিলারা একাকী হজ্জ সফরে যাত্রা করতে পারবে। (ফিকহুন্নিসা)


শরহে মুসলিমে ইমাম নববী লিখেছেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা, সায়ীদ ইবনুল জুবায়ের, ইবনে সীরীন, মালিক ইবনে আনাস এবং ইমাম আওযায়ীর মতে, মহিলাদের হজ্জ সফরে মাহরাম থাকা শর্ত নয়। বরং শর্ত হলো ঐ মহিলা নিজের ইজ্জত-আবরুর হেফাজত এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। ইমাম ইবনে হাযম এবং ইমাম শাফেয়ীও একই শর্ত দিয়েছেন। (শরহে মুসলিম) হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী কারাবীনীর সূত্রে তার কিতাবে একই কথা লিখেছেন। (ফিকহুস সুন্নাহ) 


মূল লিংক


প্রশ্ন: ৩৮০ : আগের কাতারে জায়গা না পেয়ে নামাজের শেষের কাতারে একা দাড়ানো।


যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তাঁর সাথে কাতার বাধা উচিৎ। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহরাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।

পরন্ত কাতার বাধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদিস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। ১৯৯ তাছাড়াএ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তাঁর নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তাঁর জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাঁদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না। যেমন নাক থেকে রক্ত পড়তে শুরু হলে কিংবা ওযূ ভেঙ্গে গেলে কাতার ছেড়ে আসতে বাধা নেই। যেহেতু নবী (সঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাযে বেওযূ হয়ে যায়, তখন সে যেন নাক ধরে নামায ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।” ২০০ তদনুরূপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরূপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।


ঠিক তদ্রূপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফয়সালা এই যে, সামানে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তাঁর সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। ২০১


প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তার নামায হবে না। ২০২ পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
ফুটনোটঃ১৯৯ (জয়ীফুল জামে ২২৬১ নং), ২০০ (আবূ দাঊদ ১১১৪ নং), ২০১ (লিক্বাউ বাবিল মাফতূহ ২২৭ পৃঃ), ২০২ (মুমতে ৪/৩৮৭)

প্রশ্ন: ৩৭৯ : ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান ।

পবিত্র কোরআন মাজীদে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন যে- 

‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমূখ হয়ো না।’ (সূরা আনফাল, আয়াত:২০)


‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা হাশর, আয়াত:৭)


দাড়ির আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে লিহইয়াহ। এই শব্দটি ‘লাহি’ বা চোয়াল থেকে আগত। চোয়াল তথা গালে গজানো চুলকেই মূলত দাড়ি বলা হয়। নিচের ঠোঁটের নিচে, চিবুকে ও চোয়ালের নিচের অংশে উৎপন্ন চুলও এর অন্তর্ভুক্ত।
 
দাড়ি পুরুষদের মুখমন্ডলের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ। গুরুত্ত্বপূর্ণ বলার কারণ হচ্ছে দাড়ি রাখা বা না রাখার ইসলামিক ও বৈজ্ঞানিক উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় দিক রয়েছে। 


পুরুষদের মুখমন্ডলে দাড়ি রাখা মুসলিমদের এক গুরুত্বপূর্ণ চিন্হ যা তার মুসলমান হওয়ার পরিচয় বহন করে। দাড়ি রাখা ফরজ, ওয়াজিব নাকি সুন্নাত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
 
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তার জীবনে যা করতেন অর্থাৎ তার কর্মপন্থাই মূলত সুন্নাত হিসেবে পরিগণিত। সেই দিক থেকে দাড়ি রাখা অবশ্যই বড় রকমের সুন্নাত এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

পবিত্র কোরআন মাজীদে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন যে-

‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)

হাদীস শরীফে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘দশটি বিষয় সকল নবী-রাসূলগণের সুন্নাত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাড়ি লম্বা করা অন্যতম।’ (সহীহ মুসলিম শরীফ: ১/১২৯)


عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ أَحْفُوا الشَّوَارِبَ وَأَوْفُوا اللِّحَى
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ( রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুশরিকদের বিরোধিতা করো, দাড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর।’ (সহীহ বুখারী শরীফ- ২/৮৭৫, সহীহ মুসলিম: হাদীস নং ৬২৫)


‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা হাশর, আয়াত:৭) 


এসব দৃষ্টিকোণ থেকে দাড়ি রাখাকে অনেক ওলামায়ে কেরামগণ ওয়াজিবও বলেছেন। 


হাদীস শরীফে দাড়ি :


১. হযরত আয়েশা রা. বলেন রাসুল (স:) ইশরাদ করেছেন, দশটি বিষয় সকল নবী রাসুলগণের সুন্নাত তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাড়ি লম্বা করা অন্যতম। (মুসলীম শরীফ, ১/১২৯)


২. হযরত আবুহায়ারা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. ইশরাদ করেছেন, তোমরা গোঁফ কাট এবং দাড়ি লম্বা কর, আর অগ্নি পূজকদের বিরোধিতা কর। (মুসলীম শরীফ, ১/১২৯)


৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল স. ইশরাদ করেন, মুশরিকদের বিরোধিতা কর, দাড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর। (বুখারী শরীফ-২/৮৭৫, মুসলীম)


৪. হুজুর স. বলেছেন যে, তোমরা ভালভাবে গোঁফ কাট এবং দাড়ি বাড়াও। (বুখারী শরীফ)


৫. হুজুরে (স:) এরশাদ করেন যে, গোঁফ কাট এবং দাড়ি ছড়িয়ে রাখ। (কাজী এয়াজ শরহে মুসলিম নববী)


৬. হযরত আবুহুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম স. ইশরাদ করেন, দাড়ি বাড়াও, গোফ কাট এবং এক্ষেত্রে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করোনা। (মাসনাদে আহমদ)


এক নজরে দাড়ি :


১. দাড়িবাড়াও। (বুখারী, মুসলিমশরীফ) 

২.দাড়িপূর্ণ কর। (মুসলিম শরীফ) 

৩.দাড়ি ঝুলন্ত ও লম্বা রাখ। (মুসলিম শরীফ) 

৪. দাড়ি বেশিরাখ। (বুখারীমুসলিম) 

৫. দাড়িকেছাড়, অর্থাৎ কর্তন করোনা। (তাবরানী)।


দাড়ি ও সাহাবায়ে কোরামের আমল :


১. হযরত আব্দুলাহ ইবনে ওমর রা. যখন হজ্জ বা উমরা আদায় করতেন, তখন স্বীয় দাড়ি মুষ্টি করে ধরতেন, অত:পর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন।  ( বুখারী শরীফ-২/৮৭৫)


২. হযরত আবুহুরায়রা রা. স্বীয় দাড়ি ধরতেন, অত:পর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। (মুসান্ন ফলি-ইবনে আবিশাইবা -১৩/১১২)

প্রশ্ন: ৩৭৮ : কাপরে রক্ত / নাপাক লেগে তা শুকিয়ে গেলে পাক হয়ে যাবে কি

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

জামা কাপড়ে নাপাক লাগলে তা দূরিভূত করার দ্বারা উক্ত কাপড় পবিত্র হয়ে যায়। দূরিভূত করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যদি নাপাকটি শুকিয়ে যায়, এবং তা দেখা যায়, তাহলে তা রগরে একদম উঠিয়ে ফেললেই কাপড় পবিত্র হয়ে যাবে। যদি রগরে উঠানো না যায়, তাহলে উক্ত নাপাক দূর করার দ্বারা উক্ত কাপড় পবিত্র হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোন সংখ্যার শর্ত নেই। নাপাকটি দূরিভূত হয়ে যাওয়া শর্ত।

তবে যদি নাপাক দেখা না যায়, বরং তা কাপড়ের সাথে মিশে গিয়ে থাকে, কিংবা কোথায় লেগেছে তা জানা না যায়, তাহলে পুরো কাপড় ভাল করে তিনবার ধৌত করা এবং প্রতিবার ভাল করে নিংড়ানো দ্বারা কাপড়টি পবিত্র হয়ে যাবে।

وَإِزَالَتُهَا إنْ كَانَتْ مَرْئِيَّةً بِإِزَالَةِ عَيْنِهَا وَأَثَرِهَا إنْ كَانَتْ شَيْئًا يَزُولُ أَثَرُهُ وَلَا يُعْتَبَرُ فِيهِ الْعَدَدُ. كَذَا فِي الْمُحِيطِ فَلَوْ زَالَتْ عَيْنُهَا بِمَرَّةٍ اكْتَفَى بِهَا وَلَوْ لَمْتَزُلْ بِثَلَاثَةٍ تُغْسَلُ إلَى أَنْ تَزُولَ، كَذَا فِي السِّرَاجِيَّةِ. . . . . وَإِنْ كَانَتْ غَيْرَ مَرْئِيَّةٍ يَغْسِلُهَا ثَلَاثَ مَرَّاتٍ. كَذَا فِي الْمُحِيطِ وَيُشْتَرَطُ الْعَصْرُ فِي كُلِّ مَرَّةٍ فِيمَا يَنْعَصِرُ وَيُبَالِغُ فِي الْمَرَّةِ الثَّالِثَةِ حَتَّى لَوْ عَصَرَ بَعْدَهُ لَا يَسِيلُ مِنْهُ الْمَاءُ وَيُعْتَبَرُ فِي كُلِّ شَخْصٍ قُوَّتُهُ وَفِي غَيْرِ رِوَايَةِ الْأُصُولِ يَكْتَفِي بِالْعَصْرِ مَرَّةً وَهُوَ أَرْفَقُ. كَذَا فِي الْكَافِي وَفِي النَّوَازِلِ وَعَلَيْهِ الْفَتْوَى. كَذَا فِي التَّتَارْخَانِيَّة وَالْأَوَّلُ أَحْوَطُ. هَكَذَا فِي الْمُحِيطِ. (الفتاوى الهندية، كتاب الطهارة، الْبَابُ السَّابِعُ فِي النَّجَاسَةِ وَأَحْكَامِهَا وَفِيهِ ثَلَاثَةُ فُصُولٍ، الْفَصْلُ الْأَوَّلُ فِي تَطْهِيرِ الْأَنْجَاسِ-1/42

কাপড়ে নাপাক লাগার পর যদি উক্ত নাপাক শুকিয়ে যায়, তাহলে উক্ত স্থানে হাত বা কাপড় লাগলে তা নাপাক হবে না। শুকানোর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নাপাক লেগে শুকিয়ে যাওয়া কাপড় নিংড়ালে কোন কিছু বের হয় না। অর্থাৎ কোন কিছুতে তা লাগলে নাপাকের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। তাহলে যে কাপড় শুকিয়ে যাওয়া নাপাকে লেগেছে সে কাপড় ও স্থান নাপাক হয় না। সুতরাং পেশাব শুকিয়ে গেলে উক্ত স্থানে হাত লাগার দ্বারা হাতে নাপাকীর চিহ্ন না দেখা যায়, তাহলে হাত বা কাপড় নাপাক হবে না।

وَإِذَا جَعَلَ السِّرْقِينَ فِي الطِّينِ فَطَيَّنَ بِهِ السَّقْفَ فَيَبِسَ فَوَضَعَ عَلَيْهِ مِنْدِيلٌ مَبْلُولٌ لَا يَتَنَجَّسُ (الفتاوى الهندية، كتاب الطهارة، الْفَصْلُ الثَّانِي فِي الْأَعْيَانِ النَّجِسَةِ-1/47، وكذا فى حلبى كبير-1/153

যে নাপাক দেখা যায়, সে নাপাক এক দিরহাম পরিমাণ হলে কাপড় পাক থাকে, উক্ত কাপড় পরিধান করে নামায পড়া শুদ্ধ আছে। তবে যদি এক দিরহাম থেকে অধিক হয়, তাহলে উক্ত কাপড়সহ নামায পড়া শুদ্ধ হয় না।

عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : تعاد الصلاة من قدر الدرهم من الدم (سنن الدر قطنى، كتاب الصلاة، باب قدر النجاسة التي تبطل الصلاة، رقم الحديث-1

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-এক দিরহাম পরিণাম রক্তের দরুন নামাযকে পুনরায় আদায় কর। {সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৩৮৯৬, জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-১০৭৮৩, মারেফাতুস সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাকী, হাদীস নং-১৩২৩, আল জামেউল কাবীর, হাদীস নং-২৩৮}

এ হাদীসটি দুর্বল। কিন্তু যেহেতু এ বিষয়ে এ হাদীসটিই পাওয়া যায়, এর বিপরীত কোন হাদীস বর্ণিত নেই। তাই এর উপর আমল করা হয়। সেই সাথে এমন কম নাজাসাত থেকে সাধারণত বেঁচে থাকা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার তাই এ সহ নামায জায়েজ হওয়ার বিষয়টি যুক্তিগ্রাহ্য বিষয়ও। এছাড়া সাহাবাদের থেকে বর্ণিত রয়েছে যে,

فلما ذكره صاحب الأسرار عن علي وبن مسعود أنهما قدرا النجاسة بالدرهم وكفى بهما حجة في الاقتداء وروي عن عمر أيضا أنه قدره بظفره(عمدة القارى شرح صحيح البخارى، كتاب الوضوء،  باب غسل الدم، رقم الحديث-227،3/140

হযরত আলী রাঃ এবং ইবনে মাসউদ রাঃ [কাপড়] নাপাক হওয়ার পরিমাণ নির্দিষ্ট করেছেন এক দিরহাম। আর আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ নির্ধারণ করেছেন  নখ পরিমাণ। {উমদাতুল কারী-৩/১৪০, আদিল্লাতুল হানাফিয়্যাহ-১০১}

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

মূল লিংক

প্রশ্ন: ৩৭৭ : পালক সন্তান বাবা ডাকতে পারবে ?

 রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও জায়েদ নামে এক সাহাবিকে দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হারেসা। তাঁকে সবাই জায়েদ ইবনে মোহাম্মাদ—অর্থাত্ মোহাম্মাদের পুত্র বলে ডাকত। কোরআনে বিষয়টি নিষেধ করে দেওয়া হয়। পরে সবাই তাঁকে জায়েদ ইবনে হারেসা বলেই ডাকা আরম্ভ করে।

কোরআনে কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহ তোমাদের পোষ্যপুত্রদের তোমাদের পুত্র করেননি, এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ সঠিক কথা বলেন এবং সরল পথ প্রদর্শন করেন। তোমরা তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সংগত বিধান। যদি তোমরা তাদের পিতৃপরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে।’ (সুরা আহজাব : ৪-৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে নিজের পিতাকে ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলে দাবি করে, তার জন্য জান্নাত হারাম।’ (বুখারি : ৪৩২৬)

এ জন্যই যুগশ্রেষ্ঠ ফকিহ মুফতি শফি (রহ.) বলেন, ‘লালন-পালনকারীকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মা-বাবা ডাকা বৈধ হলেও অনুত্তম ও অনুচিত। কেননা এতে জাহেলিয়াতের কুসংস্কারের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায়। ইসলাম এ ধরনের সাদৃশ্য পছন্দ করে না।’ (আহকামুল কোরআন : ৩/২৯২)

প্রশ্ন: ৩৭৬ : যখন ফজরের নামাজের জামাত শুরু হয়ে যায়,, তখন কি সুন্নত পড়তে পারবে ?

আসলে এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। সুনানুল কোবরার মধ্যে ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করেছেন, এ ছাড়া আবু দাউদ তাঁর সুনানের মধ্যে উল্লেখ করেছেন এবং সহিহ সনদে বর্ণিত অন্যান্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) স্পষ্ট নিষেধ করেছেন, যখন নামাজের একামত হয়ে যাবে, ফরজ নামাজ ছাড়া আর কোনো নামাজ তখন নেই। (ড. সাইফুল্লাহ) । তবে আলেমদের মতে, শুধুমাত্র ফজরের সুন্নাতের ক্ষেত্রে এটি ব্যাতিক্রম। সাহাবী এবং তাবেয়ীদের আমল থেকে পাওয়া যায় যে, যদি ফজরের সুন্নত পড়ে ফরজ নামাজের জামায়াতের এক রাকাত পাওয়া যাবে বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে ফজরের সুন্নাত পড়ে নেওয়া উচিত। যেমন : আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, (কূফার গভর্নর) সায়ীদ ইবনে আস তাঁকে এবং হুযায়ফা ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে ফজরের নামাযের আগে ডাকলেন। তাঁরা (কাজ শেষে) তার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ইতিমধ্যে মসজিদে ফজরের নামাযের ইকামত শুরু হয়ে গেছে। ইবনে মাসউদ রা. মসজিদের একটি খুঁটির আড়ালে ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -শরহু মাআনিল আসার ১/৬১৯ । আরো বিস্তারিত :


 ফজরের জামাত চলা অবস্থায় সুন্নত পড়া

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান

পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের গুরুত্ব ও ফযীলত অসীম। এই নামাযের একটি বিধান হচ্ছে জামাতের সাথে আদায় করা। এটা ওয়াজিব। হাদীসে জামাতের প্রতি সবিশেষ উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং তাতে অবহেলার ব্যাপারে কঠোর সতর্ক করা হয়েছে।

এক হাদীসে আছে, জামাতের নামায একাকী নামাযের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি মর্যাদা রাখে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫০

অন্য হাদীসে আছে, কোনো এক নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোককে পেলেন না। বললেন, আমার ইচ্ছে হয়, কাউকে কাঠ-খড়ি আনতে বলি। তারপর আযান দিতে বলি। তারপর কাউকে নামায পড়াতে বলি। অতপর যারা জামাতে আসে না আমি তাদের কাছে যাই এবং কাঠ-খড়ি জ্বালিয়ে তাদেরসহ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫১

তার মধ্যে এশা ও ফজরের জামাতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এ দুই সময়ে মানুষ সাধারণত পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায় ও বিশ্রাম করে। ফলে জামাতদুটিতে যথেষ্ট অবহেলা ও গাফিলতি হয়ে থাকে। এজন্য হাদীসে এর প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।

উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ফজরের নামায পড়ালেন। সালাম ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কি আছে? লোকেরা বলল, জী না। তারপর আরেকজনের নাম নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কি আছে? লোকেরা বলল, জী না। তিনি বললেন, এ দুই নামায (এশা ও ফজর)  মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। তোমরা যদি জানতে যে, এই দুই নামাযে কী পরিমাণ সওয়াব নিহিত রয়েছে, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে আসতে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৫৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৪৭৭

এমনিভাবে তাকবীরে উলা ও প্রথম কাতারেরও বেশ ফযীলত রয়েছে। এক হাদীসে আছে, জামাতের প্রথম কাতার (সম্মান ও মর্যাদায়) ফিরিশতাদের কাতারের অনুরূপ। তোমরা যদি জানতে যে, এটা কত মর্যাদাপূর্ণ তাহলে এর জন্য প্রতিযোগিতা করতে।  -প্রাগুক্ত

অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে চল্লিশদিন তাকবীরে উলার সাথে জামাতে নামায আদায় করবে তার জন্য দুটি মুক্তিনামা লেখা হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং নিফাক থেকে মুক্তি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১

সুতরাং নামাযের জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া কর্তব্য। যাতে ধীরস্থিরতার সাথে সুন্নত পড়া যায় এবং তাকবীরে উলার সাথে প্রথম কাতারে জামাতে নামায আদায় করা যায়।

কিন্তু কখনো যদি এমন হয় যে, ইকামত শুরু হয়ে গেছে বা নামায শুরু হয়ে গেছে, তাহলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্য সুন্নত হলে আর সুন্নতের নিয়ত বাঁধবে না; বরং জামাতে শরীক হয়ে যাওয়া জরুরি।

আর যদি ফজরের সুন্নত হয় এবং এ কথা মনে হয় যে, তা পড়ে জামাতের অন্তত এক রাকাত পাওয়া যাবে, তাহলে মসজিদের বাইরে তো তা নিঃসন্দেহে পড়া জায়েয; বরং পড়ে নেওয়াই উত্তম। এমনভিাবে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় অথবা খুঁটির আড়ালে পড়াও জায়েয আছে। কিন্তু জামাতের কাতারে বা তার নিকটে পড়া মাকরূহে তাহরিমী।

সুন্নত নামাযের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত। হাদীসে এর প্রভূত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং এর প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যা অন্যান্য সুন্নতের ক্ষেত্রে হয়নি। এখানে ফজরের সুন্নত সম্বন্ধে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।

(ক) আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

ركعتا الفجر خير من الدنيا وما فيها.

ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৫

(খ) তিনি আরো বর্ণনা করেছেন-

لم يكن النبي صلى الله عليه وسلم على شيء من النوافل أشد منه تعاهدا على ركعتي الفجر.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) নামাযে এত গুরুত্ব দিতেন যা অন্য কোনো নফল (বা সুন্নত) নামাযে দিতেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৪

(গ) তিনি আরো বর্ণনা করেছেন-

صلى النبي صلى الله عليه وسلم العشاء، ثم صلى ثماني ركعات، وركعتين جالسا، وركعتين بين النداءين، ولم يكن يدعهما أبدا.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার নামায পড়লেন। তারপর আট রাকাত নামায পড়লেন। তারপর বসে দুই রাকাত। তারপর আযান ও ইকামতের মধ্যে দুই রাকাত। এই দুই রাকাত তিনি কখনো বাদ দিতেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৫৯

(ঘ) আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لا تدعوهما، وإن طردتكم الخيل.

 তোমরা এই দুই রাকাত কখনো ত্যাগ করো না, শত্রুবাহিনী তোমাদের তাড়া করলেও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১২৫৮

(ঙ) আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। (এরপর তিনি পাঁচটি বিষয় বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে)-

...وركعتا الفجر حافظوا عليهما، فإنهما من الفضائل.

তোমরা ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত)-এর ব্যাপারে পুরোপুরি যতœবান হও। কারণ তা ফযীলতপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৫৪৪

উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট যে, ফজরের দু’রাকাত সুন্নত অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ এবং পারতপক্ষে তা ত্যাগ না করা উচিত।

এ কারণে বহু সংখ্যক সাহাবী-তাবেয়ী এমন ছিলেন, যারা কখনো যদি মসজিদে এসে দেখতেন যে, ফজরের ইকামত বা জামাত শুরু হয়ে গেছে, তাহলে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক প্রান্তে কিংবা খুঁটির আড়ালে ফজরের দু’রাকাত সুন্নত পড়ে নিতেন। তারপর জামাতে শরীক হতেন। আর কিছুসংখ্যক সাহাবী-তাবেয়ী মসজিদের ভেতরে তা পড়তেন না। তবে মসজিদের বাইরে ঘরে বা পথে অথবা মসজিদের দরজায় পড়তেন। তারপর ইমামের সাথে শরীক হতেন। এখানে তাঁদের কিছু আমল ও ফতোয়া উল্লেখ করা হল।

১. আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, (কূফার গভর্নর) সায়ীদ ইবনে আস তাঁকে এবং হুযায়ফা ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে ফজরের নামাযের আগে ডাকলেন। তাঁরা (কাজ শেষে) তার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ইতিমধ্যে মসজিদে ফজরের নামাযের ইকামত শুরু হয়ে গেছে। ইবনে মাসউদ রা. মসজিদের একটি খুঁটির আড়ালে ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -শরহু মাআনিল আসার ১/৬১৯

حدثنا سليمان بن شعيب، قال: ثنا عبد الرحمن بن زياد، قال: ثنا زهير بن معاوية، عن أبي إسحاق، قال: حدثني عبد الله بن أبي موسى، عن أبيه، حين دعاهم سعيد بن العاص، دعا أبا موسى، وحذيفة، وعبد الله بن مسعود رضي الله عنهم، قبل أن يصلي الغداة، ثم خرجوا من عنده وقد أقيمت الصلاة، فجلس عبد الله إلى أسطوانة من المسجد، فصلى الركعتين، ثم دخل في الصلاة.

এ ঘটনাটি আবু ইসহাক সাবেয়ী থেকে কিছু ভিন্নতার সাথে মুতাররিফ ইবনে তরীফ ও সুফিয়ান সাওরী রাহ.ও বর্ণনা করেছেন। মুতাররিফের বর্ণনায় এ কথাও আছে যে, আবু মূসা আশয়ারী রা. জামাতে শরীক হয়ে গেলেন। -দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৪০২১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৬৪৭৬

বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (৮৫৫হি.) বলেন, فأخرجه من ثلاث طرق صحاح  ইমাম তহাবী রাহ. এটি তিনটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮২

২. আবু মিজলায থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ফজরের জামাত চলা অবস্থায় ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমর রা.-এর সঙ্গে মসজিদে প্রবেশ করলাম। ইবনে উমর রা. জামাতের কাতারে প্রবেশ করলেন। আর ইবনে আব্বাস রা. ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -প্রাগুক্ত

حدثنا أحمد بن عبد المؤمن الخراساني، قال: ثنا علي بن الحسن بن شقيق، قال: أنا الحسين بن واقد، قال: ثنا يزيد النحوي، عن أبي مجلز، قال: دخلت المسجد في صلاة الغداة مع ابن عمر وابن عباس رضي الله عنهم، والإمام يصلي، فأما ابن عمر رضي الله عنهما فدخل في الصف، وأما ابن عباس رضي الله عنهما، فصلى ركعتين، ثم دخل مع الإمام.

বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من طريقين صحيحين  ইমাম তহাবী রহ. এটি দুটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৩

৩. যায়েদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত, ইবনে উমর রা. মসজিদে এসে দেখেন, ফজরের জামাত চলছে। কিন্তু তাঁর ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়া হয়নি। তিনি হাফসা রা.-এর কামরায় তা পড়লেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -প্রাগুক্ত  ১/৬২০-৬২১

حدثنا علي بن شيبة، قال: ثنا الحسن بن موسى، قال: ثنا شيبان بن عبد الرحمن، عن يحيى بن أبي كثير، عن زيد بن أسلم، عن ابن عمر رضي الله عنهما أنه جاء والإمام يصلي الصبح، ولم يكن صلى الركعتين قبل صلاة الصبح، فصلاهما في حجرة حفصة رضي الله عنها، ثم إنه صلى مع الإمام.

বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من ثلاث طرق صحاح  ইমাম তহাবী রাহ. এটি তিনটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।’ -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৪

৪. আবু উবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, আবু দারদা রা. কখনো মসজিদে এসে দেখতেন, ফজরের জামাত চলছে। তিনি মসজিদের এক কোণায় (ফজরের) দুই রাকাত (সুন্নত) পড়ে নিতেন। তারপর জামাতে শরীক হতেন। -শরহু মাআনিল আসার ১/৬২১

حدثنا أبو بشر الرقي، قال: ثنا أبو معاوية، عن مسعر، عن عبيد بن الحسن، عن أبي عبيد الله، عن أبي الدرداء أنه كان يدخل المسجد والناس صفوف في صلاة الفجر، فيصلي الركعتين في ناحية المسجد، ثم يدخل مع القوم في الصلاة.

বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه بإسناد صحيح  ইমাম তহাবী রাহ. এটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৪

৫. আবু উসমান নাহদী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা কখনো মসজিদে এসে দেখতাম, উমর রা. (ফজরের) নামায শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়া হয়নি। আমরা মসজিদের শেষ প্রান্তে তা পড়ে নিতাম। তারপর জামাতে শরীক হতাম। -প্রাগুক্ত

حدثنا أبو بكرة، قال: ثنا أبو داود، قال: ثنا هشام بن أبي عبد الله، عن جعفر، عن أبي عثمان النهدي، قال: كنا نأتي عمر بن الخطاب رضي الله عنهما قبل أن نصلي الركعتين قبل الصبح، وهو في الصلاة، فنصلي الركعتين في آخر المسجد، ثم ندخل مع القوم في صلاتهم.

এটি আবু উসমান নাহদী থেকে কিছু ভিন্নতার সাথে উসমান ইবনে গিয়াস ও আসেম ইবনে সুলায়মান আলআহওয়ালও বর্ণনা করেছেন। -দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৬৪৭৫; শরহু মাআনিল আসার ১/৬২১

এ বর্ণনাটি থেকে বোঝা যায় যে, উমর রা.-এর যামানায় তা বেশ প্রচলিত ছিল এবং এ ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন।

ইউসুফ বিন্নুরী রাহ. (১৩৯৭ হি.) বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে লিখেছেন,

وهذا يدل على تعامل عام بينهم ، وأنه على علم من عمر في عهده وعدم إنكاره، وهذا يكون أقوى ما يتمسك به.

এ থেকে বোঝা যায় যে, এটা তাদের মাঝে ব্যাপকভাবে অনুসৃত ছিল এবং উমর রা. তা জানতেন; কিন্তু এর উপর আপত্তি করতেন না। এটা আলোচ্য বিষয়ে শক্তিশালী দলীল। -মাআরিফুস সুনান ৪/৭৬

আরো দ্রষ্টব্য : ইলাউস সুনান ৭/১০৪

৬. ইমাম শা‘বী থেকে বর্ণিত, একদা মাসরূক রাহ. ফজরের জামাত চলাকালে মসজিদে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তাঁর ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়া হয়নি। তিনি মসজিদের এক কোণায় তা পড়ে নিলেন। তারপর জামাতে শরীক হলেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৬৪৭২

حدثنا هشيم، قال: أخبرنا حصين، وابن عون، عن الشعبي، عن مسروق؛ أنه دخل المسجد والقوم في صلاة الغداة، ولم يكن صلى الركعتين، فصلاهما في ناحية، ثم دخل مع القوم في صلاتهم.

এটি ইমাম শা‘বী থেকে আসেম ইবনে সুলায়মান আলআহওয়ালও এবং হুসাইন ইবনে আবদুর রহমান থেকে ইমাম শু‘বা রাহ.ও বর্ণনা করেছেন। -দ্রষ্টব্য : শরহু মাআনিল আসার ১/৬২১-৬২২

বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من ثلاث طرق صحاح  ইমাম তহাবী রাহ. এটি তিনটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৫

৭. কাসেম ইবনে আবী আইয়ুব থেকে বর্ণিত, সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. ফজরের জামাত চলা অবস্থায় মসজিদের দিকে এলেন। মসজিদে প্রবেশের আগে মসজিদের দরজায় (ফজরের) দুই রাকাত (সুন্নত) পড়ে নিলেন। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৭৪

حدثنا عباد بن عوام، عن حصين، عن القاسم بن أبي أيوب، عن سعيد بن جبير؛ أنه جاء إلى المسجد والإمام في صلاة الفجر، فصلى الركعتين قبل أن يلج المسجد، عند باب المسجد.

৮. ইউনুস ইবনে উবায়েদ থেকে বর্ণিত, হাসান বসরী রাহ. বলতেন, তা মসজিদের এক কোণায় পড়ে নিবে। তারপর জামাতে শরীক হবে। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৭৩

حدثنا هشيم، عن يونس، عن الحسن، قال: كان يقول: يصليهما في ناحية، ثم دخل مع القوم في صلاتهم.

হাসান বসরী রাহ. থেকে অনুরূপ ফতোয়া ইয়াযিদ ইবনে ইবরাহীমও বর্ণনা করেছেন। -দেখুন : শরহু মাআনিল আসার ১/৬২২

বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন, فأخرجه من طريقين رجالهما ثقات  ইমাম তহাবী রহ. এটি দুই সূত্রে বর্ণনা করেছেন, উভয় সূত্রের রাবীগণ ছিকা। -নুখাবুল আফকার ৩/৬৮৬

৯. উসমান ইবনে আসওয়াদ থেকে বর্ণিত, মুজাহিদ রাহ. বলেন, যদি কখনো মসজিদে গিয়ে দেখ যে, ফজরের জামাত শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তোমার সুন্নত পড়া হয়নি, তাহলে তা পড়ে নিবে- জামাতের এক রাকাত ছুটে যাবে বলে মনে হলেও। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৭৯

حدثنا عبيد الله بن موسى، عن عثمان بن الأسود، عن مجاهد، قال: إذا دخلت المسجد والناس في صلاة الصبح، ولم تركع ركعتي الفجر فاركعهما، وإن ظننت أن الركعة الأولى تفوتك.

১০. উবায়েদ ইবনে হাসান থেকে বর্ণিত, আমি (আবদুর রহমান) ইবনে মাকিল রাহ.-কে দেখেছি, তিনি (মসজিদের) দরজায় ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পড়েছেন। -প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৬৪৮৭

حدثنا وكيع، عن مسعر، عن عبيد بن الحسن، قال: رأيت ابن معقل صلى الركعتين قبل الفجر في السدة.

এছাড়া ইকরিমা ও ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. থেকেও মসজিদের ভেতরে ফজরের সুন্নত পড়ার কথা প্রমাণিত। ইমাম ইবনে বাত্তাল রাহ. (৪৪৯হি.) তাঁর সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে (২/২৮৬) উমর রা.-এর আমলও অনুরূপ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। আর মসজিদের বাইরে পড়া আরো প্রমাণিত আতা ইবনে আবী রাবাহ ও হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান রাহ. থেকে।

উপরোক্ত আসারসমূহ থেকে একটি বিষয় দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। তা হল, ফজরের সুন্নত অন্যান্য সুন্নতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পারতপক্ষে তা ত্যাগ না করা কর্তব্য। এটা মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে যে তাগিদ দিয়েছেন সেটারই বহিঃপ্রকাশ ও বাস্তব নমুনা।

এখানে পাঠক লক্ষ করেছেন যে, বহুসংখ্যক সাহাবী-তাবেয়ী ইকামত বা জামাত চলা অবস্থায় মসজিদে এলে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় অথবা খুঁটির আড়ালে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত পড়ে নিতেন। তারপর জামাতে শরীক হতেন। আর কতিপয় সাহাবী-তাবেয়ী মসজিদের ভেতরে না পড়লেও বাইরে পড়তেন। তারপর ইমামের সাথে শরীক হতেন।

সুতরাং ফজরের জামাত চলাকালে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় কিংবা খুঁটির আড়ালে ফজরের সুন্নত পড়াকে নাজায়েয বা হারাম কিংবা বিদআত আখ্যা দেওয়া সম্পূর্ণ অনুচিত। একে বিদআত আখ্যা দেওয়া বস্তুত ঐ সকল সাহাবী-তাবেয়ীর আমলকেও বিদআত আখ্যা দেওয়া।

কতিপয় সাহাবী-তাবেয়ী إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة (নামাযের ইকামত শুরু হয়ে গেলে ফরয ছাড়া অন্য নামায পড়া জায়েয নয়)-এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইকামত বা জামাত চলা অবস্থায় ফজরের সুন্নত পড়তেন না। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আবু হুরায়রা রা., আবু মূসা আশয়ারী রা., মুহাম্মদ ইবনে সীরীন, ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীর রাহ.।

কিন্তু তাঁরা কখনো ঐ সকল সাহাবী-তাবেয়ীর উপর আপত্তি করেননি, যারা সুন্নত পড়ে নেওয়াকেই ভালো মনে করতেন। পেছনে আমরা দেখেছি যে, আবু মূসা আশয়ারী ও হুযায়ফা রা.-এর সামনে ইবনে মাসউদ রা. তা পড়েছেন এবং ইবনে উমর রা.-এর সামনে ইবনে আব্বাস রা. পড়েছেন। কিন্তু কেউ কারো উপর আপত্তি করেননি। যদি তা নাজায়েয হত তাহলে তাঁরা অবশ্যই বাধা দিতেন। সাহাবায়ে কেরাম নাজায়েয কাজে কখনো চুপ থাকতেন না।

ইমাম তহাবী রাহ. যথার্থই লিখেছেন,

منهم عبد الله بن مسعود، وبمحضر من حذيفة، ومن أبي موسى لذلك، ولم ينكراه عليه، فدل ذلك على متابعتهما إياه عليه.

অর্থাৎ, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হুযায়ফা ও আবু মূসা আশয়ারী রা.-এর উপস্থিতিতে তা পড়েছেন। কিন্তু তাঁরা কোনোরূপ আপত্তি করেননি। এ থেকে বোঝা যায় যে, উভয়ে এটা সমর্থন করেছেন। -শরহু মুশকিলিল আসার ১০/৩৯৬

যে সকল সাহাবী-তাবেয়ী জামাত চলাকালে ফজরের সুন্নত পড়তেন না তাঁরা إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة-এই হাদীসের বিধানকে সকল নামায এমনকি ফজরের সুন্নতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য মনে করতেন। কিন্তু অন্যান্য সাহাবী-তাবেয়ী ফজরের সুন্নত অধিক গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় এই বিধান থেকে একে ভিন্ন মনে করতেন। হাদীসটিকে তাঁরা ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্যান্য নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করতেন। ফজরের সুন্নতের ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাগিদ এবং আলোচ্য বিষয় সংক্রান্ত বিভিন্ন বর্ণনার পর্যালোচনা থেকেও এটাই প্রতীয়মান হয়। কোনো কোনো সাহাবী নবীজীর সামনে ফজরের ইকামত চলাকালে মসজিদে সুন্নত পড়েছেন। এ ক্ষেত্রে নবীজী তাঁদেরকে সরাসরি নিষেধ করেননি বা এ কথা বলেননি যে, إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة (ফরযের ইকামত শুরু হলে অন্য নামায পড়া নিষেধ)। বরং তিনি বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। যদি ইকামত চলা অবস্থায় ফজরের সুন্নত পড়া সর্বাবস্থায় নাজায়েয হত, তাহলে তিনি স্পষ্ট নিষেধ করতেন বা বলতেন যে, ফরযের ইকামত শুরু হলে অন্য নামায পড়া নিষেধ। এখানে সংক্ষেপে এধরনের কয়েকটি বর্ণনার পর্যালোচনা করা হল।

বর্ণনা নং ১ :

عن عبد الله بن مالك ابن بحينة، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر برجل يصلي، وقد أقيمت صلاة الصبح، فكلمه بشيء، لا ندري ما هو، فلما انصرفنا أحطنا نقول: ماذا قال لك رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ قال: قال لي: يوشك أن يصلي أحدكم الصبح أربعا.

আবদুল্লাহ ইবনে মালেক ইবনে বুহায়না রা. থেকে বর্ণিত, ফজরের ইকামত চলাকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত একলোকের পাশ দিয়ে গেলেন এবং তাকে কিছু বললেন কিন্তু আমরা তা বুঝিনি। নামায শেষে আমরা তাকে ঘিরে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে কী বলেছেন? বলল, বলেছেন, তোমাদের কেউ হয়তো ফজরের নামায চার রাকাত পড়বে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭১১

এ হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, ফজরের ইকামত চলা অবস্থায় অন্য নামায নিষেধের কারণ হচ্ছে, এতে কারো এ কথা মনে হতে পারে যে, ফজরের ফরয নামায চার রাকাত। -দ্রষ্টব্য : ফাতহুল মুলহিম বিশরহি সহীহিল ইমাম মুসলিম ৪/৯৩

স্পষ্ট যে, এ ধারণা জন্মাতে পারে যদি জামাতের কাতারে বা তার নিকটে সুন্নত পড়া হয়। মসজিদের বাইরে পড়লে তো এ সম্ভাবনা মোটেই নেই। এমনিভাবে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা কোণায় পড়লেও তা হবে না।

উপরোক্ত হাদীসের বর্ণনাশৈলী থেকে মনে হয় যে, ঐ সাহাবী জামাতের কাতারে বা তার নিকটে সুন্নত পড়ছিলেন। হাদীসটির পাঠ আবার দেখুন,

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر برجل يصلي، فكلمه بشيء...

(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত একলোকের পাশ দিয়ে গেলেন এবং তাকে কিছু বললেন)।

এটা ফজরের নামাযে মসজিদে প্রবেশকালের ঘটনা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত মসজিদে নববীর পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন, যা মসজিদের মাঝামাঝি বা কিছুটা কিবলার দিকে এগিয়ে অবস্থিত। হাদীসটির উপরোক্ত পাঠ এবং নবীজীর প্রবেশের অবস্থা থেকে মনে হয় হয়, সাহাবী জামাতের কাতারে বা তার নিকটে নামায পড়ছিলেন।

এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনা থেকে। একদা তিনি মসজিদে এসে দেখেন, ফজরের ইকামত শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর সুন্নত পড়া হয়নি। তিনি সুন্নতের নিয়ত বাঁধলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে নিষেধ করলেন এবং তাঁর হাত টেনে ধরে বললেন, তুমি কি ফজরের (ফরয) নামায চার রাকাত পড়তে চাও?

বর্ণনাটির কিছু পাঠ দেখুন-

أقيمت الصلاة ولم أصل الركعتين، فرآني وأنا أصليهما، فنهاني فجذبني وقال: تريد أن تصلي للصبح أربعا؟

-فأخذ بيدي النبي صلى الله عليه و سلم و قال: أتصلي الصبح أربعا؟

-সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১১২৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৪৬৯

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইবনে আব্বাস রা. জামাতের কাতারে বা তার নিকটে সুন্নত পড়ছিলেন। যে কারণে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত টেনে ধরতে পেরেছেন।

বর্ণনা নং ২ :

عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه قال: سمع قوم الإقامة فقاموا يصلون، فخرج عليهم رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال: أصلاتان معا؟ أصلاتان معا؟ وذلك في صلاة الصبح في الركعتين اللتين قبل الصبح.

আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, কিছু সাহাবী ইকামত  শুনে (ফজরের সুন্নত) নামায পড়তে দাঁড়ালেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মধ্যে আগমন করলেন। বললেন, দুই নামায এক সাথে? দুই নামায এক সাথে? -মুয়াত্তা মালেক ১/৯৮

এ হাদীস থেকে ইকামতের পর অন্য নামায নিষেধের দ্বিতীয় আরেকটি কারণ বের হয়। তা হল, এতে একই জায়গায় ফরয ও সুন্নত নামাযের মিশ্রণ হয়ে যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই মিশ্রিতকরণ হবে যদি জামাতের কাতারে বা নিকটে সুন্নত পড়া হয়। মসজিদের বাইরে পড়লে তো এ সম্ভাবনা বিলকুল নেই। একইভাবে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে মসজিদের কোণায় বা বারান্দায় পড়লেও তা হবে না।

ইমাম ইবনে রুশদ রাহ. (৫৯৫হি.) আলোচিত বিষয়ে ইমামদের মতভেদের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন,

والسبب في اختلافهم اختلافهم في مفهوم قوله عليه الصلاة والسلام: إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة...

ومن قصر ذلك على المسجد فالعلة عنده إنما هو أن تكون صلاتان معا في موضع واحد لمكان الاختلاف على الإمام، كما روي عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه قال سمع قوم...

অর্থাৎ, তাঁদের এই মতভেতের কারণ হল إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة -এই হাদীসের ব্যাখ্যায় তাঁদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে। কারো মতে এ বিধানটি মসজিদের সাথে বিশেষ। তাঁদের মতে ইকামত চলাকালে অন্য নামায নিষেধের কারণ হল একই জায়গায় দুই নামায একসাথে হওয়া। এতে ইমামের সাথে বিরোধ দেখা যায়।

এরপর তিনি উপরোক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। -বিদায়াতুল মুজতাহিদ ১/২৫৮

যাকারিয়া কান্ধলবী রাহ. (১৪০২হি.) ইমাম ইবনে রুশদের উপরোক্ত বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, وهذه العلة أولى এ কারণটিই অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। -আওজাযুল মাসালিক ২/৩৮১  

বর্ণনা নং ৩ :

عن عبد الله بن سرجس، قال: دخل رجل المسجد ورسول الله صلى الله عليه وسلم في صلاة الغداة، فصلى ركعتين في جانب المسجد، ثم دخل مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، فلما سلم رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال: يا فلان بأي الصلاتين اعتددت؟ أبصلاتك وحدك، أم بصلاتك معنا؟

আবদুল্লাহ ইবনে সারজিস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একলোক মসজিদে প্রবেশ করে এক কোণায় (ফজরের) দুই রাকাত (সুন্নত) পড়ল। তারপর জামাতে শরীক হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন্ নামাযকে ফরয গণ্য করেছ? একাকী যা পড়েছ তা, না আমাদের সাথে যা আদায় করেছ তা? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭১২

এই হাদীস থেকে তৃতীয় আরেকটি কারণ জানা যায়। তা হল, ইকামতের পর সুন্নত পড়লে ইমামের সাথে বিরোধ দেখা যায়।

বলাবাহুল্য, মসজিদের বাইরে সুন্নত পড়লে এ সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আর ভেতরে জামাতের কাতারে বা নিকটে পড়লে পুরোপুরি থাকে। আর জামাতের কাতার থেকে দূরে পড়লে আংশিক থাকে।

এ পর্যালোচনা থেকে বোঝা গেল যে, ফজরের ইকামত বা জামাত চলাকালে অন্য নামায নিষেধের কারণ হল তিনটি :

১. ফজরের ফরযকে চার রাকাত মনে করার আশংকা।

২. একই জায়গায় ফরজ ও সুন্নতের মিশ্রিতকরণ।

৩. ইমামের সাথে বিরোধ।

এবং এ-ও জানা গেল যে, মসজিদের বাইরে সুন্নত পড়লে এ তিনটি কারণের কোনোটিই পাওয়া যায় না। তাই মসজিদের বাইরে ফজরের সুন্নত পড়তে কোনো অসুবিধা নেই। বরং পড়ে নেওয়াই উচিত। আর জামাতের কাতারের মধ্যে বা কাতারের নিকটে পড়লে সবগুলো কারণ পাওয়া যায়। এজন্য তা মাকরূহে তাহরিমী। আর কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা কোণায় পড়লে প্রথম দুটি কারণ থাকে না, তবে শেষটি আংশিক থাকে। এজন্য বাইরে জাগা থাকা অবস্থায় এমন করবে না। অবশ্য প্রয়োজনে কোনো কোনো ফকীহ এর অবকাশ এজন্য দিয়েছেন যে, অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ী তা করেছেন। যেমন আমরা উদ্ধৃতিসহ তা পড়ে এসেছি।

যাকারিয়া কান্ধলবী রাহ. বলেন,

ولا يذهب عليك أن جملة الروايات الواردة في الباب يوافق العلة التي استنبطها الحنفية والمالكية من الاختلاف على الإمام واختلاط الصلاتين...

এটা ভুলে গেলে হবে না যে, আলোচ্য বিষয়ের সবগুলো বর্ণনা হানাফী ও মালেকী ফকীহগণের আহরণকৃত ইল্লত বা কারণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তা হল, ইমামের সাথে বিরোধ এবং এক জায়গায় দুই নামাযের মিশ্রিতকরণ।

এরপর তিনি উপরোক্ত কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। -দ্রষ্টব্য : আওজাযুল মাসালিক ২/৩৮১

ইউসুফ বিন্নুরী রাহ. আলোচিত বিষয়ে সারগর্ভ আলোচনার পর লিখেছেন,

وبه يجمع بين كل حديث مرفوع في الباب، وكل أثر صحيح في الموضوع، وهي الطريقة المثلى، ولو اكتفينا بذلك المرفوع فقط، أو قلنا: العبرة لما روى لا لما رآى، لزمنا أن نتغامض عن مادة غزيرة في الباب مرفوعة وموقوفة، فلو قلنا: إن الراوي أدرى بما يرويه لكان حجة لنا، حيث صح عن ابن عمر وابن عباس المرفوع، وعلى خلافه في الظاهر صح عملهما، وكذا لو قلنا: عمل الراوي بخلاف روايته دليل النسخ أو التخصيص والتقييد لكان حجة أيضا.

وبالجملة مذهب جمهور الفقهاء ..أقوى أثرا، كما هو أقوى نظرا، ولو قلنا: إنه مذهب جمهرة الصحابة والتابعين لما كان  فيه شطط، وحيث لم يثبت عن الصحابة خلافه إلا قليلا، وتعامل الصحابة أقوى حجة عند معترك الخصام، وهو يجعل المرفوع مقيدا...

এ পদ্ধতিতে আলোচ্য বিষয়ের মারফূ ও মওকূফ সবগুলো বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় হয়ে যায়। আর (বিরোধপূর্ণ বর্ণনাসমূহের মধ্যে সমাধানের জন্য) এটাই উত্তম পন্থা। অন্যথায় আমরা যদি শুধু ঐ মারফূ হাদীস (إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি কিংবা বলি যে, সাহাবী (নবীজী থেকে) যা বর্ণনা করেছেন তা-ই ধর্তব্য, তাঁর মত ধর্তব্য নয়, তাহলে আলোচিত প্রসঙ্গে মারফূ-মওকূফ অনেক বিষয়কে আমাদের উপেক্ষা করতে হবে। আর যদি বলি যে, রাবী তার বর্ণনা সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত, তাহলে এটাও আমাদের পক্ষে। কারণ ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস রা. জামাত চলাকালে অন্য নামায নিষেধ বিষয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন কিন্তু উভয়ের আমল (বাহ্যিক দৃষ্টিতে) এর বিপরীত। এমনিভাবে যদি বলি যে, রাবীর নিজ বর্ণনার বিপরীতে আমল করা বর্ণনাটির বিধান রহিত বা বিশেষ হওয়ার আলামত, তাহলে এটাও আমাদের পক্ষে।

সারকথা, জুমহুরে ফুকাহার মাসলাক বর্ণনাগত দলীলের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী এবং যুক্তিগত দলীলের দিক থেকেও অধিক শক্তিশালী। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এটাই জুমহুরে সাহাবা-তাবেয়ীর মাসলাক। সাহাবায়ে কেরাম থেকে এর বিপরীত বক্তব্য অল্পই প্রমাণিত। মতভেদের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের তাআমুল অতি শক্তিশালী দলীল। এতে মারফূ হাদীসটির বিধান বিশেষ হয়ে যায় (ব্যাপক থাকে না)। -মাআরিফুস সুনান ৪/৮৮

মোদ্দাকথা, ফজরের জামাত চলাকালে মসজিদের বাইরে তো বটেই ভেতরেও জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় ফজরের সুন্নত পড়া জায়েয। আর إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة -এ হাদীসটি ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্যান্য নামাযের জন্য। ফজরের সুন্নত অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ী এই বিধানকে এ থেকে ব্যতিক্রম মনে করেছেন।

এখানে ইবনে আব্বাস রা.-এর আমলটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি জামাত চলা অবস্থায় জামাতের কাতার থেকে দূরে ফজরের সুন্নত পড়তেন। অথচ একদা রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের ভেতরে সুন্নত পড়তে দেখে তাঁকে নিষেধ করেছিলেন। এর অর্থ এটাই যে, ওই নিষেধ ছিল জামাতের কাতারে বা তার নিকটে পড়ার জন্য। দূরে পড়লে নিষেধ নেই।

এ কারণে যদি অন্তত এক রাকাত জামাতের সাথে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় তাহলে (উপরোক্ত পদ্ধতিতে) তা পড়া জায়েয। এতে জামাতের ফযীলতও অর্জিত হয়ে যাবে এবং ফজরের সুন্নতের সওয়াবও হাসিল হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এক রাকাতও পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে জামাতে শরীক হয়ে যাবে। ফজরের সুন্নত মর্যাদাপূর্ণ হলেও জামাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব তার চেয়ে বেশি এবং জামাত পরিত্যাগের ব্যাপারে কঠোর সতর্ক বাণী এসেছে।

 হেদায়া গ্রন্থকার ইমাম মারগিনানী (৫৯৩হি.) রাহ. বলেন,

(ومن انتهى إلى الإمام في صلاة الفجر وهو لم يصل ركعتي الفجر، إن خشي أن تفوته ركعة ويدرك الأخرى، يصلي ركعتي الفجر عند باب المسجد، ثم يدخل)، لأنه أمكنه الجمع بين الفضيلتين، (وإن خشي فوتهما دخل مع الإمام)، لأن ثواب الجماعة أعظم والوعيد بالترك ألزم، ...والتقييد بالأداء عند باب المسجد يدل على الكراهة في المسجد إذا كان الإمام في الصلاة، والأفضل في عامة السنن والنوافل المنزل، هو المروي عن النبي عليه الصلاة والسلام.

অর্থাৎ, যে মসজিদে গিয়ে দেখে, ফজরের জামাত শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তার সুন্নত পড়া হয়নি, যদি তার মনে হয় যে, সুন্নত পড়লে জামাতের এক রাকাত ছুটে গেলেও আরেক রাকাত পাওয়া যাবে, তাহলে মসজিদের দরজায় সুন্নত পড়ে নিবে। তারপর জামাতে শরীক হবে। কারণ এখানে উভয় ফযীলতের (ফজরের সুন্নতের ফযীলত ও জামাতের ফযীলত) মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে। আর যদি মনে হয় যে, উভয় রাকাত ছুটে যাবে তাহলে জামাতে শরীক হয়ে যাবে। কারণ জামাতের মর্যাদা বেশি এবং তা পরিত্যাগ করার ব্যাপারে সতর্কবাণী এসেছে।

(জামিউস সাগীর গ্রন্থে) তা মসজিদের দরজায় আদায়ের শর্তকরণ থেকে বোঝা যায় যে, জামাত চলা অবস্থায় তা মসজিদে ভেতরে পড়া মাকরূহ (অনুত্তম)।  সুন্নত-নফলের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে ঘরে পড়া। এটাই রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। -হেদায়া ১/৩১৫-৩১৬

আল্লামা উমর ইবনে নুজাইম (১০০৫হি.) লেখেন,

ثم إنما يأتي بها بشرط أن يجد مكانًا عند باب المسجد، فإن لم يجد تركها، لأن ترك المكروه مقدم على فعل السنة، غير أن الكراهة تتفاوت، فإن كان الإمام في الصيفي فصلاته إياها في الشتوي أخف من صلاتها في الصيفي، وقلبه، وأشدها كراهة أن يصليها مختلطًا بالصف.

অর্থাৎ, জামাত চলাকালে সুন্নত পড়ার জন্য একটি শর্ত হচ্ছে মসজিদের দরজায় জায়গা থাকা। যদি সেখানে জায়গায় না থাকে তাহলে তা পড়বে না। কারণ সুন্নত আদায়ের চেয়ে মাকরূহ কাজ পরিত্যাগ করা অগ্রগণ্য। তবে মাকরূহের স্তরভেদ আছে। গরমকালের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় জামাত অনুষ্ঠিত হলে শীতকালের জন্য নির্ধারিত জায়গায় সুন্নত পড়া সেখানে পড়ার চেয়ে হালকা। এমনিভাবে এর উল্টো। আর সর্বাধিক মাকরূহ হচ্ছে জামাতের কাতারের সাথে মিলে পড়া। -আননাহরুল ফায়েক ১/৩১০-১১

শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ. (১৩৬৯হি.) লিখেছেন,

فجمع علماؤنا رحمهم الله بين فضل ركعتي الفجر وفضل الجماعة، وفضل الجماعة يحصل بإدراك الركعة مع الإمام، كما تقدم منصوصا في صحيح مسلم، من قوله صلى الله عليه وسلم: من أدرك ركعة من الصلاة مع الإمام، فقد أدرك الصلاة، وإذا لم يمكن الجمع بين الفضيلتين فرجحوا ما هو أشد تأكدا، وهي الجماعة، لورود الوعيد الشديد على تاركها، وركعتا الفجر وإن كانتا متأكدتين تأكدا يقرب من الوجوب فوق سائر النوافل والرواتب، إلا أنهما لم يرد في حق تاركهما ما ورد في تارك الجماعة.

অর্থাৎ, আমাদের আলেমগণ ফজরের সুন্নতের ফযীলত ও জামাতের ফযীলতের মধ্যে সমন্বয় করেছেন। ইমামের সাথে এক রাকাত পাওয়া দ্বারা জামাতের ফযীলত অর্জিত হয়ে যায়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকাত নামায পেল সে পুরো নামাযই (ইমামের সাথে) পেল। আর যেখানে উভয় ফযীলতের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব নয় সেখানে তারা এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথা জামাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ জামাত পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। আর ফজরের সুন্নত যদিও গুরুত্বপূর্ণ-ওয়াজিবের কাছাকাছি এবং সকল সুন্নত-নফলের উপরে কিন্তু তা পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে জামাত পরিত্যাগকারীর মত সতর্কবাণী আসেনি। -ফাতহুল মুলহিম বিশরহি সহীহিল ইমাম মুসলিম ৪/৯১

            মুফতী কিফায়াতুল্লাহ দেহলবী রাহ. (১৩৭২হি.) বলেন,

فجر  کی جماعت شروع  ہوجانے کے بعد کسی عليحدہ  جگہ میں سنتیں ادا کرنے کا موقع مل جائے  کہ سنت ادا کرکے فرض ایک رکعت مل سکے گی تم سنتیں ادا کرکے جماعت  میں شریک ہو، اور اگر کوئی  عليحدہ  جگہ میسرنہ ہو یا ایک رکعت فرض ملنے کی امید نہ ہو تو جماعت میں شریک ہو جائے.

অর্থাৎ, যদি জামাতের জায়গা থেকে পৃথক কোনো জায়গা থাকে এবং সুন্নত পড়ে ফরযের (অন্তত) এক রাকাত পাওয়া যাবে বলে মনে হয়, তাহলে সুন্নত পড়ে জামাতে শরীক হবে। কিন্ত যদি পৃথক কোনো জায়গা না থাকে কিংবা ফরযের এক রাকাতও পাওয়ার আশা নেই, তাহলে জামাতে শরীক হয়ে যাবে। -কিফায়াতুল মুফতী ৪/৫৫১

আরো দেখা যেতে পারে : তুহফাতুল ফুকাহা ১১৯৮; ফাতাওয়া সিরাজিয়া পৃ. ১১৭-১১৮; আলমুহীতুর রাজাবী (মাখতূত) প্রথম খ-, ওয়ারাকা ৪৫; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬৩৯; আততাজনীসু ওয়াল মাযীদ ২/৪৬; শরহুল জামিইস সাগীর, কাজীখান (মাখতূত) প্রথম খ-, ওয়ারাকা ২৭; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/৬১-৬২; আননিহায়া ফী শরহিল হিদায়া (মাখতূত) প্রথম খ-, ওয়ারাকা ৯৬; গায়াতুল বায়ান ওয়ানাদিরাতুল আকরান (মাখতূত) প্রথম খ-, ওয়ারাকা ৯৩; আলবিনায়া ২/৫৬৯-৫৭২; মিনহাতুস সুলূক ফী শরহি তুহফাতিল মুলূক পৃ. ১৯৫-১৯৬; মাজমাউল আনহুর ফী শরহি মুলতাকাল আবহুর ১/২১০-২১১; ফাইযুল বারী ২/১৯৮; কিফায়াতুল মুফতী ৩/২৬২; ফাতাওয়া হাক্কানিয়া ৩/২৮৮; খাইরুল ফাতাওয়া ২/৪৯৩-৪৯৪; ফাতাওয়া কাসিমিয়া (শাব্বীর আহমদ কাসিমী মুরাদাবাদী) ৮/২১২; কিতাবুল ফাতাওয়া ২/৩৪৩-৩৪৫; তালিকুশ শায়েখ খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী আলমুখতারাতিন নাওয়াযিল ১/৩০৬

পুনশ্চ : শুধু তাশাহহুদের মাঝে জামাতে শরীক হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে, এমন হলে ফজরের সুন্নাত পড়বে কি না- কোনো কোনো হানাফী ফকীহ এক্ষেত্রেও পড়ার কথা বলেছেন। (দেখুন, ফাতাওয়া উসমানী, খ. ১,  পৃ. ৪৮৩)

তবে যে বিষয়ে খুব বেশি সতর্কতা দরকার তা হল, ইকামতের পর মজজিদের ভেতরে সুন্নত না পড়া। জামাতের কাতারের সংগে মিশে বা তার কাছাকাছি তো নয়ই।

রমযানুল মুবারকে এ বিষয়ে খুব বেশি অবহেলা দেখা যায়; জামাতের কাতারে যুক্ত হয়ে অনেকে সুন্নত পড়েন। বিষয়টির এসলাহ হওয়া জরুরি।

বাকি থাকল ফজরের সুন্নতের কাযা প্রসঙ্গ। সেটা নিয়ে অন্য কোনো সময় আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। -আবদুল মালেক


মূল লিংক

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...