প্রশ্ন : ৪৯ : হজ্জ্ব ।

প্রশ্নঃ হাজ্জের অভিধানিক অর্থ ও পারিভাষিক সংজ্ঞা দাও।হাজ্জের প্রকারভেদ কি কি?হাজ্জের প্রকারভেদ লিখ।হাজ্জ কাদের উপর ফরয আলোচনা কর। হাজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত নিয়ে আলোচনা কর।


ভূমিকা



আল্লাহ বলেন,
 

কুরআনে এসেছে, এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল­াহর জন্য বায়তুল­াহর হজ্জ করা ফরয। আরযে কুফরী করে, তবে আল­াহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী। ( সূরা আলে ইমরান-৯৭)


ইসলাম ধর্ম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার মধ্যে হজ্ব ইসলামের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। যা সক্ষম ব্যক্তির জীবনে একবারই ফরজ।হাজ্জ অস্বীকারকারী ব্যক্তি ইসলামের ভিতর থাকতে পারে না।যারা তা অস্বীকার করবে তারা ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরুপে খারিজ হয়ে যায়।ইসলামে হাজ্জ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারনা নিম্নে দেওয়া হলঃ

 

হাজ্জ কি


 

 হজ্ব আরবি শব্দ। অর্থ নিয়ত করা, দর্শন করা, সঙ্কল্প করা, এরাদা করা, গমন করা, ইচ্ছা করা, প্রতিজ্ঞা করাসহ , কোনো মহৎ কাজে ইচ্ছা করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনে নিয়তসহ ইহরামরত অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা।

 

আবার কেউ বলেন,  জিলহজ্বের ৯ তারিখ ইহরাম বেঁধে আরাফাতের মাঠে অবস্থানসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত কয়েকটি আমল যথাযথভাবে আদায় করে কাবা গৃহ তাওয়াফ করাকে হজ্ব বলে।

 

আল-ফিকাউল ইসলামী গ্রন্থে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজের মাধ্যমে নির্ধারিত স্থান যিয়ারত করা হল হাজ্জ

 

শরহে বিকায়া গ্রন্থাগার বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে সুনির্দিষ্ট স্থান যিয়ারত করার নাম হল হাজ্জ

 

আল-কামসুল ফিকহ গ্রন্থে আছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় একটা নির্ধারিত সময়ে মক্কা মুয়াযযামার বায়তুল হারামে গমনের নিয়ত পোষণ করাই হল হাজ্জ 

 

হাজ্জ যাদের উপর ফরয


 

(১) মুসলিম হওয়া

 

(২) বালিগ হওয়া

 

(৩) স্বাধীন হওয়া

 

(৪) বিবেকবান হওয়া

 

(৫)নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যে ব্যক্তির এ পরিমাণ ধনসম্পদ আছে যে, সে হজের সফর (পথ খরচ) বহন করতে সক্ষম এবং তার অনুপস্থিতিকালীন তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন মেটানোর মতো খরচও রেখে যেতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ। অথবা এমন ব্যক্তি যে হজের মৌসুমে অর্থাৎ শাওয়াল মাস শুরু হওয়া থেকে সৌদি আরবে অবস্থানরত ছিল এবং জিলহজ মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে অবস্থান করতে থাকে এবং তার ওপর যদি কোনো বিধি-নিষেধ, ওজর ও অসুবিধা না থাকে তাহলে তার ওপরও হজ পালন করা ফরজ  ইত্যাদি।

 

(৬) যাতায়াতে নিরাপত্তা

 

(৭) মহিলাদের সাথে মাহরুম থাকা

 

হজের প্রকারগুলো


 

হজ তিন প্রকার যথা :

 

এক. হজে ইফরাদ : অর্থাৎ হজের সফর শুরু করার সময় মিকাত থেকে যদি শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধে এবং হজের সঙ্গে ওমরাহ আদায় না করে তাহলে এ প্রকার হজকে হজে ইফরাদ বলা হয়। এ প্রকার হজ পালনকারীকে শরিয়তের পরিভাষায় মুফরিদ বলে।

 

দুই. হজে কিরান : যদি একই সঙ্গে হজ এবং ওমরাহর নিয়ত করে উভয়টিই পালন করে এবং হজ ও ওমরাহর জন্য একই ইহরাম বাঁধে, তাহলে এ ধরনের হজকে শরিয়তের পরিভাষায় হজে কিরান বলা হয়। এ প্রকার হজ পালনকারীকে কারিন বলে।

 

তিন. হজে তামাত্তু : অর্থাৎ হজের সঙ্গে ওমরাহকে এভাবে মেলানো যে মিকাত থেকে শুধু ওমরাহর ইহরাম বাঁধা। এই ইহরামে মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ পালনের পর ইহরাম ভেঙে ৭ জিলহজ সেখান থেকেই হজের ইহরাম বেঁধে হজ পালন করাকে শরিয়তের পরিভাষায় হজে তামাত্তু বলে। এ প্রকারের হজ পালনকারীকে মুতামাত্তি বলে।

 

এই তিন প্রকারের হাজ্জের ভিতর কিরান হাজ্জ সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ একটি হাজ্জ। দশম হিজরী সালে মুহাম্মদ (সাঃ) কিরান হাজ্জ সম্পাদন করেছিলেন।

 

হজ্বের ফরজ


 

হজ্বের ফরজ তিনটি-

 

· ইহরাম বাঁধা অর্থাৎ হজ্বের নিয়ত করা। আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা ওয়াল উমরাতা ওয়াজ জিয়ারাতা ফাইয়াস সিরহুলি ওয়াতাক্কাব্বালহু মিন্নি- অর্থ হে আল্লাহ! আমি হজ্ব উমরা এবং কাবাগৃহ তাওয়াফের জন্য নিয়ত করলাম। তুমি তা কবুল কর।

 

ইহরাম বাঁধার নিয়ম : হজ ও ওমরাহর আমলগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম আমল হলো ইহরাম বাঁধা। ইহরাম বাঁধার নিয়ম হলো- হজ অথবা ওমরাহর নিয়তে সেলাইকৃত কাপড় খুলে সেলাইবিহীন দুটি চাদর পরিধান করে তালবিয়াহ্ পাঠ করা, শরিয়তের পরিভাষায় একেই ইহরাম বলা হয়। ইহরাম বাঁধার উত্তম পদ্ধতি হলো-যখন ইহরাম বাঁধার ইচ্ছা করবে তখন প্রথমে গোসল অথবা অজু করবে, নখ কাটবে, বগল ও নাভীর নিচের চুল পরিষ্কার করবে এবং মাথা ও দাড়ি চিরুনি করে সর্ববিষয়ে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করবে। ইহরামের জন্য দুটি নতুন অথবা ধোলাই করা পরিষ্কার চাদর হওয়া সুন্নত। একটি চাদর দিয়ে লুঙ্গি বানাবে অন্যটি দিয়ে চাদর বানাবে। ইহরামের কাপড় পরিধান করার পর নামাজের মাকরুহ সময় না হলে মাথা ঢেকে দুই রাকাআত নফল নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। নামাজ পড়ে মাথার কাপড় খুলে ফেলবে এবং যেই হজের ইচ্ছা করবে মনে মনে সেই হজের নিয়ত করে ইহরামের তালবিয়াহ্ পাঠ করবে।

 

তালবিয়াহ্র উচ্চারণ :

 

লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা, লাকা ওয়াল মুল্‌ক লা-শারীকালাক

 

· জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ ফজরের পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত্ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা।

 

· তাওয়াফে জিয়ারাত অর্থাৎ মক্কা শরীফ পৌঁছার পর সর্বপ্রথম কাজটি হলো চারবার কাবাগৃহটি প্রদক্ষিণ করা আবার হজ্বের কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরার সময় সর্বশেষ কাজ হলো তিনবার কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করে রওনা হওয়া।

 

হজ্বের ওয়াজিব


 

হজ্বের ওয়াজিব কাজ সাতটি-

 

· সাফা ও মারওয়া উভয় পাহাড় সাতবার প্রদড়্গিণ করা।

 

· মুজদালিফায় রাত যাপন করা।

 

· মিনায় তিনটি জামরাতে তিনদিনে প্রত্যেক জামরাতে ৭টি করে ৭*৭=৪৯টি পাথর শয়তানের উদ্দেশে নিক্ষেপ করা,

 

· মিনার ময়দানে কোরবানি করা,

 

· মাথা মুণ্ড করা,

 

· ফরজ তাওয়াফ শেষে ৩ চক্কর দেয়া,

 

· বিদায়ী তাওয়াফ করা

 

হাজ্জের গুরুত্ব এবং ফযীলত


 

১. আল্লাহর নির্দেশ পালন : হাজ্জ একটি অন্যতম ফরজ ইবাদাত। হাজ্জ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ পালন হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা সামর্থবান মুসলিমের উপর হাজ্জ ফরজ করেছেন । কুরআনে এসেছে, এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল­াহর জন্য বায়তুল­াহর হজ্জ করা ফরয। আরযে কুফরী করে, তবে আল­াহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী। ( সূরা আলে ইমরান-৯৭)

 

২. যিকরুল্লাহ প্রতিষ্ঠা : হজ্জ এমন একটি ইবাদাত যার প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহর যিকর করা হয়। তাওয়াফ, সাঈ, রমঈল জিমার (পাথর নিক্ষেপ),মিনা,মুযদালিফাহ, আরাফাহসহ প্রত্যেকটি নির্দেশনায় আল্লাহর যিকরে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল­াহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ। আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিয়ে দিন। বস্ত্তত আখিরাতে তার জন্য কোন অংশ নেই।(সূরা আলবাকারাহ-২০০)।

 

আল্লাহ আরো বলেন, সুতরাং যখন তোমরা আরাফা থেকে বের হয়ে আসবে, তখন মাশআরে হারামের নিকট আল­াহকে স্মরণ কর এবং তাকে স্মরণ কর যেভাবে তিনি তোমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও তোমরা এর পূর্বে অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সূরা আলবাকারাহ-১৯৮)

 

৩. জাহান্নামদের আযাব থেকে মুক্তি দানঃ হজ্জ জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রান দান করে। মহানবী (সঃ) বলেন; মহান আল্লাহ আরাফাতের দিন যত মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন অন্যকোন দিনে এত লোককে মুক্তি দেন না। (মুসলিম)

 

 ৪. হজ্জ পালনকারী সদ্যজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়: হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন; আমি রাসূল (সঃ) কে বলতে শুনেছি; যে ব্যক্তি হজ্জ করে এবং হজ্জকালে যৌন সম্ভোগ ও কোনপাপাচারী কাজে লিপ্ত হয় না। সে ব্যক্তি সদ্য মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ট শিশুরমত নিষ্পাপ হয়েবাড়ি ফিরে যায়। (বুখারী ও মুসলিম)

 

এক হাদীসে এসেছে, তোমরা পর-পর হজ্জ ও উমরা আদায় করো। কেননা তা দারিদ্র ও পাপকে সরিয়ে দেয় যেমন সরিয়ে দেয় কামারের হাপর লোহা-স্বর্ণ-রুপার ময়লাকে। আর হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। (সহিহ নাসায়ী)

 

৫. হজ্জের এক মাত্র প্রতিদান জান্নাত:হাজ্জের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত; মহানবী (সঃ)বলেন;

 

একউমরাহ হতে অন্য উমরাহ অন্তরবর্তী কালীন সময় গুনাহের কাফ্ফারা হয়। আর মাবরূর(গৃহীত ) হজ্জের একমাত্র প্রতিদান হল জান্নাত। (বুখারী ও মুসলিম)

 

৬. বিধর্মী হওয়া থেকে মুক্তিঃ যাদের উপর হাজ্জ ফরয হওয়ার পর হাজ্জ না করে মৃত্যুবরণ করবে তাদের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী দেওয়া হয়েছে। রাসূল(সাঃ) বলেন,

 

যার উপর হাজ্জ ফরয হল অথছ সে যদি হাজ্জ না করে মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে কি ইয়াহূদী হয়ে মরল নাকি খ্রিষ্টান হয়ে মরল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।3

 

৭. উত্তম নেক আমলঃ যারা সঠিকভাবে হাজ্জ সম্পাদন করবে তারা ইসলামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করবে।রাসূল (সাঃ) বলেন,

 

উত্তম আমল কি এই মর্মে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল। উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হল, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। বলা হল তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মাবরুর হজ্জ। (বুখারী) একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রশ্ন করে আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদে ও অভিযানে যাব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য উত্তম ও সুন্দরতম জিহাদ হল হজ্জ, তথা মাবরুর হজ্জ। (বুখারী)

 

৮. আল্লাহর উদ্দেশ্য পূর্ণঃ আল্লাহ পাক মানুষকে এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন যে,তারা কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে। যারা হাজ্জ করবে তাদের সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।তাই আল্লাহ বলেন,

                      [বাকারাঃ২০০]

 

৯. মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ লাভঃ যারা হাজ্জ পালন করবে তারা আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ(সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন করবে। এই ব্যাপারে মুহাম্মদ(সাঃ)  বলেন,

 

আমার মৃত্যর পর যে হাজ্জ করল আর আমার কবর যিয়ারত করল সে যেন আমার সাথে জীবিত অবস্থায় সাক্ষাৎ করল

 

১০. আল্লাহর নৈকট্য লাভঃ হাজ্জব্রত অবস্থায় আল্লাহর একজন প্রিয়বান্দা বিভিন্ন ধরনের আমল পালন করে।আল্লাহর যিকির করে থাকে।কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করে থাকে। এসকল আমলের মধ্য দিয়ে একজন বান্দা অতি সহজে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে।

 

১১. চারিত্রিক বিশুদ্বতাঃ হাজ্জব্রত অবস্থায় মানুষ সহজে তার চারিত্রিক বিশুদ্বতা অর্জন করতে পারে।কারণ হাজ্জ অবস্থায় ঝগড়া করা,হাঙ্গামা সৃষ্টি করা, গীবত করা, হিংসা করা, কৃপনতা প্রদর্শন করা, অপচয় করা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ব।তাই হাজীগণ এই সময় এসকল খারাপ কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করে এবং এর দ্বারা সে তার চরিত্রকে পূত-পবিত্র করতে পারে।

 

১২. সামগ্রিক ইবাদত পালনঃ  নামায এবং সাওম হল কেবল দৈহিক ইবাদত আর যাকাত হল আর্থিক ইবাদত।আর হাজ্জ এমন একটি ইবাদত যা কিনা দৈহিক এবং আর্থিক উভয় ইবাদতের সমন্বয়ে সাধিত হয়।তাই রাসূল(সাঃ) বলেন, উত্তম জিহাদ হল হাজ্জ

 

১৩. আখিরাতের কথা স্মরণঃ হাজ্জের প্রত্যেকটি কাজ মানুষকে আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১. এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজ্জের সফরে রওয়ানা হওয়া কাফন পরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।হজ্জের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনয়ীতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।এহরাম পরিধান করে পুত-পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্য লাব্বাইক বলা সমস্ত গুনাহ-পাপ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় যে এহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে।

 

সামাজিক শিক্ষা


 

১. বিশ্বভাতৃত্ববোধ : হাজ্জের মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের স্বরুপ প্রকাশ পায়।এ মিলন কেন্দ্রে পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমান মিলিত হন।তাই বলা হয় যে হাজ্জ মুসলমানদের বিশ্বসম্মেলন।বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার নানা ভাষা,আকৃতি ও বর্ণের লক্ষ লক্ষ মুসলমান একই পোশাকে একই নিয়মে হাজ্জব্রত উদযাপনে শরীক হন।

 

২. বদ অভ্যস দূরীকরণ : হাজ্জের মাধ্যমে মানুষের মন থেকে কৃপনতা,অপচয় প্রবণতা দূরীভূত হয়।আর মিতব্যয়ী হওয়ার দরুন দারিদ্য দূর হয়।অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকে।

 

৩. সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্বি : আমাদের সমাজে হাজীদের মর্যাদা ও সম্মান অনেক বেশি।আল্লাহর ঘর তওয়াফ করার জন্য সাধারণ মানুষ হাজীদের সম্মান করে থাকে।

 

৪. কলুষমুক্ত সমাজব্যবস্থা গঠনঃ বিশ্বের সকল দেশ থেকে লোক আল্লাহর ঘরের কাছে সমবেত হয় এবং সর্বপ্রকার কলহ দ্বন্দ্ব,বিবাদ,ঝগড়া,ফাসাদ,অনাচার,অবিচার থেকে হাজীগণ পবিত্র থাকেন।কোন জাতির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ বলতে কিছু থাকে না।এর মধ্য দিয়ে একটি কলুষমুক্ত সমাজ গঠনে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

 

৫. শৃংখলা শিক্ষাঃ হাজ্জ পালনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম-শৃংখলার শিক্ষা পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট সময় ঘুম থেকে উঠা, নির্দিষ্ট সময় সালাত আদায় করা, নির্দিষ্ট সময় আরাফার ময়দান,মুযদালিফায় অবস্থান,শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ করা ইত্যাদি যথা সময়ে যথাযথভাবে পালন করার শিক্ষা পাওয়া যায়।

 

৬. আন্তর্জাতিক সম্মেলনঃ এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের নেতৃবর্গ একত্রিত হয় এবং তাদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে যা মুসলিম দেশসমূহের ভিতর সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।

 

৭. ত্যাগের শিক্ষাঃ জাহহের মাধ্যমে ব্যক্তি ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।পশু কুরবানী করে।আর সে হাজীদের সুবিধার জন্য ত্যাগ করে।ইসলামের মৌলিক শীক্ষা অনুযায়ী সর্বদা অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়। এভাবে করে ক্ষুদ্র ত্যাগের শিক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তর প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়।

 

উপসংহার


 

এছাড়াও হাজ্জের রাষ্ট্রীয়,অর্থনৈতিক,নৈতিক,আন্তর্জাতিক এবং বাণিজ্যি গুরুত্ব অপরিসীম।তাই আমরা সকলে হাজ্জ যথাযথভাবে পালন করার জন্য চেষ্টা করব এবং আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করার জন্য চেষ্টা করব।


সূত্র:

প্রশ্ন: ৪৮ : রাসুল সা: এর বক্ষবিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা কতবার সংঘটিত হয়েছিল?

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী: 

 ‘সিনা চাক’ বা বক্ষবিদারণ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের চিন্তা চলে যায় দেড় হাজার বছর আগে ইতিহাসের একটি বাঁকে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরব ভূমিতে জন্ম নিয়েছিলেন সৃষ্টির সেরা আল্লাহর পেয়ারা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কক্ষবিদারণকে আরবিতে বলা হয় ‘শাক্কুস সাদর’, ফার্সি ও উর্দুতে ‘সীনা চাক’। চাক মানে চিরা। ছুরি দিয়ে কোনো জিনিষ চিরা হয় বিধায় ফার্সি ও উর্দুতে বলা হয় চাকু। নবীজির জীবনে বক্ষবিদারণের ঘটনা ঘটেছিল একবার নয়, দুই বা তিন বার। প্রথমবার তার বুক চেরা হয়েছিল শৈশবে চার বছর বয়সে। দ্বিতীয়বার হেরা পর্বতের উপরিস্থ গুহায় ধ্যানমগ্নতায় আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী লাভের সূচনা পর্বে। তৃতীয়বার বক্ষবিদারণ হয়েছিল মে’রাজ উপলক্ষে উর্ধ্বজগত পরিভ্রমণের প্রস্তুতি পর্বে। তখন হযরতের বয়স ৫০ বছরের বেশি।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওপেন হার্ট সার্জারির প্রসার ঘটায় ‘শাক্কে সদর’ এর ব্যাপারটি বুঝা সহজ হয়েছে। তবে নবীজি (সা.) এর বেলায় ব্যাপারটি ছিল অলৌকিক। এর পেছনে আয়োজন ছিল অতি-প্রাকৃতিক। সার্জন ছিলেন আল্লাহর ফেরেশতা। অপারেশনের আগে চেতনা বিলোপের ঔষধ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়নি। ফলে ঘটনার আদ্যোপান্ত হযরতের গোচরেই সম্পন্ন হয়েছে এবং তিনি একটুও অচেতন হননি। আবার অপরেশন-উত্তর তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ, আগের চাইতে প্রাণবন্ত। হযরতের বক্ষ বিদারণের কারণ নিয়ে গবেষকগণ অনেক কথা বলেছেন। মূল কথাটি হলো, হযরতের মানবীয় সত্তায় মন্দ ও দুর্বল কোন কোষ থাকলে, তা অপসারণ করে নবুয়াতের দায়িত্ব পালন বা সাত আসমান পাড়ি দিয়ে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ অতিক্রম করে আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার রূহানী শক্তি ও মনোবল ভরে দেয়া। আমরা প্রথমে হযরতের শৈশবের বক্ষবিদারণের ঘটনার ওপর আলোকপাত করব।
নবীজি (সা.) জন্মেছিলেন মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে। অভিজাত কুরাইশ বংশের অতি সম্মানিত গোত্র হাশেমী শাখার প্রবাদ-প্রতীম পুরুষ আব্দুল মুত্তালিব তখনো জীবিত। তার দশম পুত্র হযরত আব্দুল্লাহর ঘরে মা আমেনার কোলে জন্মেছিলেন সৃষ্টির সেরা সুন্দর ফুল মুহাম্মদ রাসুল (সা.)। আরব ঐতিহ্যের নিয়ম মাফিক প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠার জন্যে শিশু মুহাম্মদকে তুলে দেয়া হয় পেশাদার ধাত্রী হালিমার কাছে। শিশু মুহাম্মদের আগমনে সচ্ছলতার আনন্দে আলোকিত হয় হালিমার জীর্ণ কুঠির। প্রকৃতির কোলে অন্য সাথীদের সাথে বেড়ে উঠলেও মুহাম্মদের চলন বলনের ধরণ ছিল আলাদা। তাই মা হালিমা ও তার স্বামী ‘হারেস’এর সমগ্র মনযোগ নিবদ্ধ ছিল কুরাইশী এই শিশুটির প্রতি। প্রাত্যহিক নিয়মে মুহাম্মদ অন্য ভাইদের সাথে একদিন মেষ চরাতে গেছেন অদূরে চারণভূমিতে। হঠাৎ সাথীরা লক্ষ্য করে শ্বেত-বসন দু’জন লোক ধরে নিয়ে গেছে কুরাইশী ভাইটিকে। দৌঁড়ে ঘরে এসে খবর দেয় তারা মা হালিমা ও তার স্বামীকে। প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দৌঁড় দেয় দু’জনে মুহাম্মদের সন্ধানে। দেখে সুবোধ ছেলেটির চেহারা বিবর্ণ। মুসলিম শরিফের রেওয়ায়তটি এখানে প্রণিধানযোগ্য-
আনাস ইবনে মালিক (রদ.) বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে (নবুয়াতের আগে ফেরেশতা) জিব্রাঈল আগমন করেন, তখন তিনি ছেলপেলেদের সাথে খেলছিলেন। ফেরেশতা তাকে ধরে মাটিতে শুয়ে তার হৃদপিন্ডটি বের করেন। তা থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করে নেন। ফেরেশতা বলেন, এ হচ্ছে তোমার ভেতরকার শয়তানের অংশ। অতপর হৃদপিন্ডটি সোনার তশতরীতে নিয়ে জমজম এর পানি দিয়ে ধৌত করেন। তারপর জোড়া লাগিয়ে আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করেন। এ দৃশ্য দেখে ছেলেরা দৌঁড়ে ধাত্রীমা হালিমার কাছে এসে বলে: মুহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে। তারা দ্রুত গিয়ে দেখে, তার চেহারার রং বিবর্ণ। বর্ণনাকারী আনাস বলেন, হযরতের বক্ষে পরবর্তীতেও সিলাইয়ের চিহ্ন দেখা যেত। (মুসলিম, ২৪০/১৬৪)।। অন্যান্য সূত্রের বর্ণনায় ফেরেশতার সংখ্য্য ছিল দু’জন আর তার হৃদপিন্ড ধোয়া হয়েছিল বরফ দিয়ে। এই অপারেশনের বিবরণ দিয়েছেন স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সা.)। এ ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়ে হালিমা দম্পতি। আতংকিত হয়, না জানি কোন জিন ভুতের আছর হয়েছে কিনা। কিন্তু প্রাণ-উচ্ছল শিশু মুহাম্মদকে দেখে আঁচ করা যায় না এর কোন আলামত। দ্বিধা-থরথর হালিমা সিদ্ধান্ত নেন, কোন দৈব দুর্ঘটনার আগে শিশু মুহাম্মদকে ফিরিয়ে দিতে হবে মক্কায়।

প্রশ্ন: ৪৭ : কোরবানির সাথে কি আকিকা দেওয়া যাবে কিনা ?

প্রশ্ন : জুমআর বয়ানে খতীবসাহেব বললেন, ‘অনেকে কুরবানীর সাথে আকীকার অংশ দিয়ে থাকেন এভাবে করা জায়েয নয়। কুরবানির সাথে আকীকার অংশ দিলে আকিকা আদায় হবে না।’ সঠিক মাসআলাটি জানতে চাই!

  উত্তর : কুরবানি ও আকীকা আলাদাভাবেই করা উচিৎ। তবে একত্রে করলে আদায় হবে না তা নয়। একত্রে করলেও কুরবানী-আকীকা দুটোই আদায় হবে। কারণ আকীকাও এক ধরনের কুরবানী। হাদীস শরীফে আকীকার উপরও ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। আর এখানে ‘নুসুক’ অর্থ কুরবানী। হাদীসের আরবী পাঠ এই- سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا أحب العقوق كأنه كره الاسم، قالوا يا رسول الله! نسألك عن أحدنا يولد له، فقال : من أحب منكم أن ينسك عن ولده فليفعل، على الغلام شاتان مكافأتان، وعلى الجارية شاة. [দ্র. আলমুসান্নাফ, আব্দুর রাযযাক : ৭৯৬১; আলমুসনাদ, আহমদ : ৬৭১৩, ৬৭২২; আসসুনান, আবু দাউদ (আকীকা অধ্যায়)২৮৪২; আস-সুনান, নাসায়ী : ৭/১৬২, ১৬৩; আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৪ হাদীস : ২৪৭২৭; আলমুসতাদরাক,হাকিম, ৫/৩৩৭, হাদীস : ৭৬৬৬] سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا يحب الله العقوق، من ولد له منكم ولد فأحب أن ينسك عنه فليفعل. [দ্র. আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২১, হাদীস : ২৪৭২২; আলমুয়াত্তা, ইমাম মালিক, আকীকা অধ্যায়, হাদীস : ৬৫৮] আকীকাও যখন এক প্রকারের কোরবানী তখন একটি গরু বা উট দ্বারা একাধিক ব্যক্তির (সাত জন পর্যন্ত) আলাদা-আলাদা কুরবানী আদায় হওয়ার হাদীসগুলো থেকে কুরবানী-আকীকা একত্রে আদায়েরঅবকাশও প্রমাণিত হয়। এটা শরীয়তের পক্ষ হতে প্রশস্ততা যে, গরু বা উটের ক্ষেত্রে একটি‘জবাই’ সাত জনের সাতটি জবাইয়ের স্থালাভিষিক্ত গণ্য হয়। একারণে একটি উট বা গরু সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হয়। সহীহ মুসলিমে সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমরা হজ্বের ইহরামবেঁধে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকেআদেশ করলেন যেন প্রত্যেক উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি।’ [সহীহমুসলিম, কিতাবুল হজ্ব, হাদীস : ১৩১৮/৩৫১] خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم مهلين بالحج، فأمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر، كل سبعة منا في بدنة. অন্য বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘(একটি) গরু সাতজনের পক্ষহতে এবং (একটি) উট সাতজনের পক্ষ হতে (কুরবানী করা যাবে)।’ البقرة عن سبعة والجزور عن سبعة. [আস-সুনান, আবু দাউদ, হাদীস : ২৮০১, কিতাবুল আযাহী] সারকথা, ‘নুসুক’ বা কুরবানীর ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি এই যে, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বারক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ (إراقة الدم) দ্বারা একটি কুরবানী আদায় হলেও উট ও গরুর ক্ষেত্রে একটি‘জবাই’ দ্বারা সাতটি কুরবানী আদায় হতে পারে। অর্থাৎ এখানে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়া’ও (সর্বোচ্চসাত জনের) কুরবানী আদায়ের পক্ষে যথেষ্ট। আকীকাও যেহেতু ‘নুসুক’ বা কুরবানী তাই এ মূলনীতিতে আকীকাও শামিল থাকবে। সুতরাং ‘একটি পশু জবাই’ করা দ্বারা যেমন তা আদায় হবে, তেমনি নির্ধারিত নিয়মে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়ার’ (شركة في دم) দ্বারাও তা আদায় হবে। সুতরাং এ প্রশ্নের অবকাশ নেই যে, ‘আকীকায় তো পশু জবাই করতে বলা হয়েছে। অতএব অন্ততএকটি পশু জবাইয়ের দ্বারাই তা আদায় হতে পারে।’ কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে পশু জবাই (إراقة الدم)-এর দায়িত্ব যেমন একটি পশু জবাই করার দ্বারা আদায় হয় তেমনি নির্ধারিত পশুতে ‘শরীকহওয়ার’ দ্বারাও (شركة في دم) আদায় হয়। আকীকার ক্ষেত্রে এই মূলনীতি প্রযোজ্য নয় বলে দাবি করলে ব্যতিক্রমের বিধান সম্বলিত দলীল লাগবে। আমাদের জানামতে এমন কোনো দলীল নেই। 

গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান সৌজন্যে : মাসিক আল-কাউসার 
সূত্র


=======================================



কোরবানি এবং আকিকা সর্ম্পকে জরুরি ৬টি প্রশ্ন-জবাব

বেশ কিছু ভাই প্রশ্নটি করেছেন, এক
গরুতে কোরবানি এবং আকিকা দেওয়া যাবে কিনা?
এ বিষয়ের ওপর বেশ কিছু মাসআলা-ফতোয়ার
কালেকশন তুলে ধরলাম- আল্লাহ আমাদের
সবাইকে সঠিকভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন।
আমিন।
১. কোরবানির পশুতে আকীকার অংশ
মাসআলা : কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকীকার
নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কোরবানি ও
আকীকা দুটোই সহীহ হবে।
[বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০, তাহতাবী আলাদ্দুর
৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২]
২. কোরবানির পশুতে ভিন্ন ইবাদতের নিয়তে শরীক
হওয়া
মাসআলা : এক কোরবানির পশুতে আকীকা, হজ্বের
কোরবানির নিয়ত করা যাবে। এতে প্রত্যেকের
নিয়তকৃত ইবাদত আদায় হয়ে যাবে।
[বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬,
আলমাবসূত সারাখছী ৪/১৪৪, আলইনায়া ৮/৪৩৫-৩৪৬,
আলমুগনী ৫/৪৫৯]
৩. প্রশ্ন: কেউ যদি একটি গরুতে একভাগ আকীকা আর
বাকি অংশ কোরবানির
নিয়তে কোরবানি করে তবে তার আকীকা ও
কোরবানি আদায় হবে কি না?
উত্তর: হ্যাঁ, গরু, উট, মহিষে সাত ভাগের এক ভাগ
আকীকা ও বাকি অংশ কোরবানির নিয়ত
করলে আকীকা ও কোরবানি দু’টোই আদায়
হয়ে যাবে।
[রদ্দুল মুহতার ২/৫৪৩, ৬/৩২৬;
ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০৪;
ইমদাদুল আহকাম ৪/২৮২]
৪. প্রশ্ন: কোরবানির গরুতে আকীকার জন্য অংশ
দেওয়া যাবে কি? আমরা স্বামী-স্ত্রীর পক্ষ
থেকে কোরবানির দুই অংশ, মৃত বাবা-মার দুই অংশ
এবং মেয়ে ও ছেলের আকীকার তিন অংশ-
এভাবে এক গরুতে কোরবানি ও আকীকা করতে চাই।
এটা জায়েয হবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, কোরবানির গরুর সাত ভাগে আকীকার
অংশ দেওয়া জায়েয। এতে কোরবানি ও
আকীকা দু’টোই আদায় হবে।
আপনি প্রশ্নে যেভাবে বলেছেন
সেভাবে কোরবানি ও আকীকা করতে পারবেন।
[ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৫০; বাদায়েউস
সানায়ে ৪/২০৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৮/২৪৪;
মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/৩৩১-৩৩৩; শরহুল মুহাযযাব
৮/৪০৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬]
৫. প্রশ্ন: একই পশুতে কোরবানির সঙ্গে আকিকাও
করা যাবে কিনা?
উত্তর: একই গরু মহিষ ও উটের মধ্যে কোরবানি ও
আকিকা একসঙ্গে করা যাবে। (মাহমুদিয়া, ২৬/৪১৩)
৬. প্রশ্ন: আকীকা কী? আকীকার হুকুম কী? আকীকার
সময় কি নির্ধারিত? কেউ কি নিজের
আকীকা নিজেই করতে পারবে? আকীকা আদায়ের
নিয়ম কী? আকীকার গোশত কি পিতা-মাতা ও
আত্মীয়স্বজনরা খেতে পারবে? জানিয়ে বাধিত
করবেন।
উত্তর: সন্তান জন্মগ্রহণের শুকরিয়াস্বরূপ যে পশু যবাই
করা হয় তাকে আকীকা বলে। আর
আকীকা করা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সন্তানের
জন্য আকীকা করতে হয়। সুতরাং তোমরা তার পক্ষ
থেকে যবাই কর এবং তার ‘জঞ্জাল’ শ দূর কর (অর্থাৎ
চুল চেছে ফেল)। (সহীহ বুখারী ২/৮২২) রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ
করেন, যার সন্তান ভূমিষ্ট হয় সে যদি শিশুটির পক্ষ
থেকে আকীকা করা পছন্দ করে তাহলে যেন তাই
করে। (সুনানে নাসায়ী ২/১৬৭)
জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা করা উত্তম। সপ্তম
দিনে সম্ভব না হলে ১৪ বা ২১ তম
দিনে করা ভালো। কেননা হাদীস শরীফে এই তিন
দিনের উল্লেখ আছে। এ তিন দিনেও
করা না হলে পরে যে কোনো দিন
আকীকা করা যেতে পারে। হযরত আমর ইবনে শুআইব-এর
সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবজাতকের
সপ্তম দিনে আকীকা করা, নাম রাখা ও তার
জঞ্জাল দূর করার (অর্থাৎ মাথার চুল কাটার)
নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসান্নাফ
ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৬) হযরত বুরাইদা রা.
থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আকীকার পশু
সপ্তম বা চৌদ্দতম বা একুশতম দিনে যবাই করা হবে।
(আলমুজামুল আওসাত ৫/৪৫৭)
কারো আকীকা করা না হলে বড় হয়ে নিজের
আকীকা নিজেও করতে পারবে। হযরত আনাস রা.
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পর নিজের
আকীকা নিজে করেছেন। (প্রাগুক্ত ১/৫২৯; মাজমাউয
যাওয়াইদ, হাদীস : ৬২০৩; আলমুফাসসাল
ফী আহকামিল আকীকা, ড. হুসামুদ্দীন ইবনে মূসা,
জামেয়াতুল কূদস, পৃ. ১৪২) হাসান বসরী রাহ. বলেন,
তোমার
যদি আকীকা না করা হয়ে থাকে তাহলে তুমি নিজের
আকীকা করে নাও। যদিও তুমি ইতিমধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক
হয়ে গেছ। (আলমুহাল্লা ৬/২৪০) পুত্র সন্তান
হলে দুটি আর কন্যাসন্তান হলে একটি ছাগল/ভেড়া/
দুম্বা দ্বারা আকীকা করা উত্তম। তবে পুত্রসন্তানের
ক্ষেত্রে একটি যবাই করলেও আকীকার হক আদায়
হয়ে যাবে। এছাড়া উট, মহিষ, গরু
ইত্যাদি দ্বারা আকীকা করা যায়।
হযরত উম্মে কুরয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকীকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,
পুত্রসন্তানের পক্ষ থেকে দুটি ছাগল আর
কন্যাসন্তানের পক্ষ থেকে একটি ছাগল যবাই করবে।
(জামে তিরমিযী ১/১৮৩) হযরত ইবনে আববাস রা.
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান ও
হুসাইন রা-এর পক্ষ
থেকে একটি একটি ভেড়া আকীকা করেছেন। (আবু
দাউদ ২/৩৯২) হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ইরশাদ করেন, যার কোনো সন্তান জন্মলাভ
করে সে যেন উট, গরু অথবা ছাগল
দ্বারা আকীকা করে। (আলমুজামুল আওসাত ২/৩৭১,
হাদীস : ৩৭১) আকীকার গোশত পিতা-মাতা ও
অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ধনী-গরীব
নির্বিশেষে সকলেই
খেতে পারবে। হযরত আয়েশা রা. বলেন, (আকীকার
গোশত) নিজে খাবে, অন্যদের
খাওয়াবে এবং সদকা করবে।
[মুসতাদরাকে হাকেম ৫/৩৩৮; আলমুগনী ১৩/৩৯৩, ৩৯৭,
৪০০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৭, হাদীস :
২৪৭৪৩, ২৪৭৩৭; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/৩২৯, ৩৩০, ৩৩১;
তুহফাতুল মাওদূদ বি আহকামিল মাওলূদ ৭৮]
ibnaltaf

সূত্র 



Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...