প্রশ্ন: ২২৫ : একজন পুরুষের পোষাাক কেমন হবে ?

একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত- আমরা কী পরব? গোল জুব্বা নাকি কোট-টাই-প্যান্ট? এ বিতর্ক অনেক দিনের। আমাদের দেশে আজকাল প্রত্যেক তরিকাপন্থিদের পোশাক ও লেবাস আলাদা।

সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব। কিন্তু মূলত ইসলামে পোশাক সম্পর্কে কি নির্দেশনা রয়েছে?

একটি কথা প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার, তা হলো ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট পোশাককে কারো ওপর চাপিয়ে দেয়নি। বরং পুরুষ ও নারীদের জন্য শালীনতা ও সৌন্দর্যের সমন্বয়ে কিছু নির্দেশনা ও বিধিমালা দেওয়া হয়েছে-যার আলোকে যে কেউ তার পোশাক বেছে নিতে পারে। তবে অবশ্যই তাতে যেন পর্দা ও পোশাকের পূর্ণ অর্থের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।

এ হচ্ছে সাধারণ মুসলমানদের জন্য। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই যারা রাসুলকে (সা.) ভালোবেসে চলতে চান, ‌Ôতাদের জন্য পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ  বলেছেন, ‘আপনি বলুন (হে মুহাম্মদ!) তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসো তবে আমাকে অনুসরণ করো। এতে আল্লাহ  তোমাদেরও ভালবাসবেন এবং তোমাদের মাফ করে দিবেন।’ আর তাই কোনটি ফরয কোনটি সুন্নাত এসব তর্ক-বিতর্কে না জড়িয়ে আসুন আমরা রাসুল (সা.) এর পোশাক সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনা এবং কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিধিমালাগুলো দেখে নিই।

রাসুল (সা.) কখনো চাদর গায়ে দিতেন এবং লুঙ্গি পরতেন। তাঁর চাদর প্রায় ছয় হাত লম্বা থাকতো। তাঁর ব্যবহৃত পোশাকের মধ্যে আরও ছিল, জামা, জুব্বা, পাগড়ি। তিনি যে কামিজ পড়তেন এর বর্ণনা হচ্ছে- হাতের দিকে কব্জি পর্যন্ত আর লম্বায় টাখনুর উপর পর্যন্ত। তিনি হাঁটুর নিচে আধাআধি পর্যন্ত পোশাক পরার অনুমতিও দিয়েছেন। তবে সর্বোচ্চ সীমায় টাখনু পর্যন্ত লম্বা হলেও তা যেন টাখনুর নিচে না ঝুলে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেছেন।

তিনি কখনো পাগড়ি মাথায় দিতেন এবং পাগড়ির নিচে টুপি পরতেন। তিনি টুপি ছাড়া পাগড়ি এবং পাগড়ি ছাড়া শুধু টুপিও পরতেন। রাসুল (সা.) এর পোশাক ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে শামায়েলে তিরমিযী দেখতে পারেন।

পুরুষদের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব নির্দেশনা দিয়েছে এগুলোর অন্যতম হল- স্বর্ণ কিংবা রেশম সম্বলিত কোনো পোশাক পরা যাবে না। সতর (শরীর) আবৃত হয় না, এমন যে কোনো পোশাক বর্জনীয়। এমন কোনো পোশাক পরা নিষেধ যা শুধুমাত্র কাফের ও বিধর্মীদের জন্য নির্ধারিত কিংবা তাদের কোনো বিশেষ পোশাক হিসেবে পরিচিত। নারীদের পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে এমন পোশাকও ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।

রাসুল (সা.) ওইসব পুরুষদের অভিশম্পাত করেছেন যারা নারীদের বেশ ধারণ করে। (বুখারী-৫৫৪৬)

কাপড় পরার সময় বিসমিল্লাহ বলে ডান দিকের অংশ আগে গায়ে পরিধান করতে হবে। আর খোলার সময় বাম দিকের অংশ আগে খুলতে হবে। যখনই কোনো নতুন পোশাক পরবে তখন আল্লাহ  পাকের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে।

নিজের পরিধেয় কাপড়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। আর ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। পুরুষদের সর্বাবস্থায় নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে।

সাদা রঙের পোশাক পরা মুস্তাহাব। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা সাদা রঙের পোশাক পরিধান করো। কারণ তোমাদের অন্যান্য রঙের কাপড় ও বস্ত্র থেকে এটি উত্তম। এ সাদা কাপড়েই তোমরা মৃতদের কাফন দিও। (তিরমিযী)

কেউ কেউ সবুজ রঙের পোশাক পরাকেও মুস্তাহাব বলেছেন। কারণ পবিত্র কুরআনে জান্নাতী লোকদের পোশাকের বর্ণনায় আল্লাহ এ রঙের কথা উল্লেখ করেছেন। (সুরা: ইনসান, আয়াত-২১)

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসুল (সা.) এর প্রিয় রং হিসেবে সবুজ রঙের কথা এসেছে।

আর গাঢ় লাল রং এবং হলুদ রঙের পোশাক পরতে তিনি নিষেধ করেছেন। মুসলিম শরীফের এক হাদীসে তিনি এক সাহাবীর গায়ে এ রঙের কাপড় দেখে বলেছিলেন, এটি কাফেরদের পোশাক। তোমরা এ রং পরবে না।

রাসুল (সা.) লিনেন, সুতি এবং পশম থেকে উৎপন্ন সব ধরনের পোশাক পরেছেন।

গায়ের যে কোনো পোশাক টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরা হারাম। রাসুল (সা.) ওই অংশকে জাহান্নামের বলে অভিহিত করেছেন। (বুখারী-৫৪৫০)

মুসলিম শরীফের এক হাদীসে এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তাদের (যারা টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পোশাক পরে) সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা।

মানুষকে দেখানোর জন্য এবং নিজের বড়ত্ব ও ভাব দেখিয়ে ‘বাহবা’ পাওয়ার জন্য যে কোনো পোশাক পরিধান করা হারাম। আবু দাঊদ শরীফে ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, যে দুনিয়াতে বাহাদুরির পোশাক পরবে আল্লাহ পাক তাকে কেয়ামতের দিন অপমানের পোশাক পরাবেন।

লেখক-কাতার করেসপন্ডেন্ট,  দোহা

-----------------------------------------------------------


প্রশ্ন : অনেকেই  বলছে, ছেলেদের এক কালালের লাল ও হলুদ জামা পড়তে নাকি রসুল স. নিষেধ করেছেন।

বেশ কয়েকটি হাদিসেই নাকি সরাসরি বলা আছে? এই হাদিসগুলোর অনুবাদ কি সঠিক? আর জামাগুলো পড়া কি হারাম?


উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم  

শরীয়তের বিধান হলো পুরুষদের জন্য নিরেট লাল এবং হলুদ কালারের পোশাক  পরিধান করা মাকরুহ। 
রাসুল সাঃ এমন কাপড় পরিধান করতে নিষেধ করেছেন।   

হাদীস শরীফে এসেছে  
حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ مُوسَى الأَنْصَارِيُّ، حَدَّثَنَا مَعْنٌ، حَدَّثَنَا مَالِكُ بْنُ أَنَسٍ، ح وَحَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، عَنْ مَالِكٍ، عَنْ نَافِعٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ حُنَيْنٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم نَهَى عَنْ لُبْسِ الْقَسِّيِّ وَالْمُعَصْفَرِ وَعَنْ تَخَتُّمِ الذَّهَبِ وَعَنْ قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ فِي الرُّكُوعِ .
ইসহাক ইবনু মূসা আনসারী (রহঃ) ..... আলী ইবনু আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেশম, কুসুম রঙ্গের কাপড় (হলুদ), স্বর্ণের আংটি এবং রুকূতে কুরআন পাঠ করা নিষেধ করেছেন। - মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২৬৪ [আল মাদানী প্রকাশনী]

أَخْبَرَنَا الْحَسَنُ بْنُ دَاوُدَ الْمُنْكَدِرِيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي فُدَيْكٍ، عَنِ الضَّحَّاكِ بْنِ عُثْمَانَ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ حُنَيْنٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ، عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ نَهَانِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ أَقُولُ نَهَاكُمْ عَنْ تَخَتُّمِ الذَّهَبِ وَعَنْ لُبْسِ الْقَسِّيِّ وَعَنْ لُبْسِ الْمُفَدَّمِ وَالْمُعَصْفَرِ وَعَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الرُّكُوعِ . 
হাসান ইবনু দাঊদ মুনকাদিরী (রহঃ) ... আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিষেধ করেছেন, আর আমি বলি না যে, তোমাদের নিষেধ করেছেন- সোনার আংটি রেশম মিশ্রিত কাপড়, গাঢ় লাল রং-এর কাপড় এবং কুসুম রং-এর কাপড় থেকে নিষেধ করেছেন এবং রুকু অবস্থায় কিরাআত থেকে।(নাসাঈ ১১৪৫)

أَخْبَرَنَا أَبُو دَاوُدَ، سُلَيْمَانُ بْنُ سَيْفٍ قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو عَلِيٍّ الْحَنَفِيُّ، وَعُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ، قَالَ أَبُو عَلِيٍّ حَدَّثَنَا وَقَالَ، عُثْمَانُ أَنْبَأَنَا دَاوُدُ بْنُ قَيْسٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ حُنَيْنٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، - رضى الله عنه - قَالَ نَهَانِي حِبِّي صلى الله عليه وسلم عَنْ ثَلاَثٍ - لاَ أَقُولُ نَهَى النَّاسَ - نَهَانِي عَنْ تَخَتُّمِ الذَّهَبِ وَعَنْ لُبْسِ الْقَسِّيِّ وَعَنِ الْمُعَصْفَرِ الْمُفَدَّمَةِ وَلاَ أَقْرَأُ سَاجِدًا وَلاَ رَاكِعًا " . 
আবূ দাঊদ সুলায়মান ইবনু সায়ফ (রহঃ) ... আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার বন্ধুটি আমাকে তিনটি কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। আমি বলি না যে, লোকদের নিষেধ করেছেন। তিনি আমাকে নিষেধ করেছেন সোনার আংটি পরিধান করতে, রেশম মিশ্রিত কাপড়, কুসুম রংয়ের কাপড় এবং গাঢ় লাল রংয়ের কাপড় পরিধান করতে। আর আমি যেন রুকু এবং সিজদা অবস্থায় কুরআন পাঠ না করি।
(নাসায়ী ১১২২)

حَدَّثَنَا سَلَمَةُ بْنُ شَبِيبٍ، وَالْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ، وَغَيْرُ، وَاحِدٍ، قَالُوا حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ حُنَيْنٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ نَهَانِي النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَنِ التَّخَتُّمِ بِالذَّهَبِ وَعَنْ لِبَاسِ الْقَسِّيِّ وَعَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ وَعَنْ لِبَاسِ الْمُعَصْفَرِ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .
আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণের আংটি পরতে, রেশমি পোশাক পরতে, রুকু সিজদায় কুরআনের আয়াত পাঠ করতে এবং হলুদ রং-এর পোশাক পরতে বারণ করেছেন।(তিরমিযি ১৭৩৭)


★তবে এক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে,কিছু উলামায়ে কেরাম এটাকে মাকরুহে তানযিহি (অনুত্তম) বলেছেন। 
(ইমদাদুল ফাতওয়া  ৪/১৪৫)

★কিছু উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে  পুরুষদের জন্য লাল এবং হলুদ রং এর পোশাক পরিধান করা জায়েয আছে,তবে মহিলাদের সাথে যেনো সাদৃশ্যতা না রাখে,সেই দিকে পূর্ণ খেয়াল রাখতে হবে।
(কিতাবুন নাওয়াজেল ১৫/৩০৫)    

 আদ্দুররুল মুখতার গ্রন্থে আছেঃ  
وکرہ لبس المعصفر والمزعفر الأحمر والأصفر للرجال مفادہ أنہ لا یکرہ للنساء - إلی قولہ - ولا بأس بلبس الأثواب الأحمر ومفادہ أن الکراہۃ تنزیہۃ۔ (الدر المختار مع الشامي ۶؍۳۸۵ کراچی، ۹؍۵۱۵ زکریا، الفتاویٰ الہندیۃ ۴؍۱۹۲، فتاویٰ قاضي خان ۳؍۴۱۲) 
যার সারমর্ম হলো এই লাল এবং কাপড় রং এর কাপড় পরিধান করা মাকরুহে তানযিহি। 

★তবে যদি কোন পোশাকে লাল বা হলুদ রং এর পাশাপাশি যদি অন্য রং থাকে,তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে পুরুষদের জন্য এমন কাপড় পরিধান করা জায়েজ  আছে।
,
★★সুতরাং যেহেতু পুরুষদের জন্য নিরেট লাল বা হলুদ কাপড় পরিধান করার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে,তাই এহেন পোশাক পরিধান না করাই উত্তম হবে।   


(আল্লাহ-ই ভালো জানেন)

------------------------
মুফতী ওলি উল্লাহ
ইফতা বিভাগ

প্রশ্ন: ২২৪ : ইমাম আবু হানীফা রাহ: এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইমাম আবু হানিফা (র:) জিবনী

ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ ইংরেজী মোতাবেক ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন।এবং ১৪ জুন ৭৬৭ ইংরেজী ১৫০ হিজরী ইন্তেকাল করেন। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা) এর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ।ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন।
এঁরা হচ্ছেন-
১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী)
২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী)
৩) সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী)
৪) আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী)
৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী)
৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী)
৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)
ইমাম সাহেবের শিক্ষা জীবনঃ
সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্হিতি ইমাম আবু হানীফা রহ. যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন আলমে আসলামের খেলাফতের মনসদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান। ইরাকের শাসন কর্তৃত্ব ছিল হাজ্জান ইবনে ইউসুফের হাতে। সাহাবী এবং যুগশ্রষ্ঠ জ্ঞানীগুনিগণের শহর কুফা ছিল তার রাজধানী। হাজ্জাজকে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে জালেম প্রশাসকরূপে আখ্যায়িত করা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীসহ অগণিত সংখ্যক জ্ঞানী গুনীকে তার জুলুম অত্যাচরের কবলে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলতেন, পূর্ববর্তী উম্মতগণের সকল জালেমকে এক পাল্লায় এবং আমাদের হাজ্জাজকে যদি আর এক পাল্লায় তোলা হয় তবে নিঃসন্দেহে হাজ্জাজের জুলুমের পাল্লা অনেক ভারি হবে।
ইবরাহীম নখয়ীর রহ. ন্যায় সাধক ব্যক্তি হাজ্জাজের মৃত্যুসংবাদ শুনে সেজদায় পড়ে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে আল্লাহর শুকুর আদায় করেছিলেন। জুলুম-অত্যাচরের বিভীষিকাময় পরিস্হিতিতে আলেম-সাধক এবং দীনদার শ্রেণীর লোকেরা অনেকটা নিষ্ক্রীয়তা এবং নির্জনবাস বেছে নিয়েছিলেন। যারাই একটু সাহসের সাথে অগ্রসর হয়েছেন, তাদের কেউ এই জালেমের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাননি।
খলীফা আবদুল মালেকের ইন্তেকাল হয় হিজরী ৮৬ সনে। দুর্দন্তপ্রতাপ এই খলিফার শাসনামলে ইসলামী খেলাফতের সীমান্ত পূর্বে কাবুল-কান্দাহার এবং সিন্ধু-পান্জাব পর্যন্ত এবং পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু এলমে-দীনের বড় বড় কেন্দ্রগুলি ছিল স্তব্ধ। আলেমগণ নিজেদের নির্জন হুজরায় বরে দীনি এলেমের চর্চা নামেমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সত্য, কিন্তু বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এলেমের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
হিজরী ৯৫ সনে হাজ্জাজ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। পরবর্তী বছর আব্দুল মালেকের পুত্র ওলীদেরও মৃত্যু হয়। ওলীদের মৃত্যুর পর সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। ইতিহাসবিদগণের বিবেচনায় সুলায়মান ছিলেন উমাইয়া বংশীয় খলীফাদণের মধ্যে অন্যতম সেরা সৎ শাসক। হিজরী প্রথম শতাব্দির মুজাদ্দেদ রূপে পরিচিত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. নিযুক্ত হন তার প্রধান উপদেস্টারূপে। মত্র পৌনে তিন বৎসর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার পর যখন তার ইন্তেকাল হয়, তখন খলিফার অসিয়্যত অনুযায়ী ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হন। (হিজরী ৯৯ সন)
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. স্বয়ং একজন সাধক প্রকৃতির আলেম ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও যত্নে সে যুগের বিশিষ্ট আলেমগণ হাদিস, তফসীর ও ফেকাহশাস্ত্রের চর্চায় ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম বুখারী লিখেছেন, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. আবু বকর ইবনে হাদম এর বরাবরে লিখিত এক পত্রে এ মর্মে আদেশ প্রদান করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস সুমূহ যত্নের সাথে সংগ্রহ ও তা লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্হা কর। আমার আশঙ্কা হয় (বিরাজমান অবস্হায়) এলেম চর্চা এবং আলেমগণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে না যায়! (সহীহ আল বুখারী)
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী বহ. বলেন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উপরোক্ত মর্মের আদেশনামাটি সে যুগের সব বিশিষ্ট আলেমের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হিজরী ১০০ সন থেকে হাদিস সংকলনের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়। তা না হলে আজ আমাদের নিকট হাদিসের যে বিরাট ভান্ডার মজুদ আছে, তা হয়ত থাকতো না। (ওমদাতুল-ক্বারী, ১ম খন্ড)
ওলীদের যখন মৃত্যু হয় (হিজরী ৯৬) তখন আবু হানীফা রহ. ষোল বছরের তরুণ। এ পর্যন্ত তাঁর লেখাপড়া পারিবারিক পরিবেশেই সীমিত ছিল। সে বছরই পিতার সাথে হজ্বে গমন করে মসজিদুল-হারামের দরছের হালকায় বসে আল্লাহর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীর জবানী হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমে এলমে-হাদিসের সাথে তাঁর সরাসরি পরিচিতি ঘটে। প্রথম যৌবনের সীমিত কিছুদিন ছাড়া ইমাম আবু হানীফার জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্তটি ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে কন্টকিত। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতেই উমাইয়া শাসনের পতন এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের উত্থান ঘটে। আব্বাসীয়দের দাবী ছিল খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন ব্যবস্হা পূনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শাসন ক্ষমতায় আহলে-বাইতের প্রাধান্য স্হাপন। যে কারণে সমসাময়িক বিশিষ্ট আলেম ওলামাগণের পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফাও রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটানোর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শরীক হয়েছিলেন।
সেই বিস্ফোরণমূথী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই ইমাম আবু হনীফা কুরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবীগণের জীবনপদ্ধতি মন্হন করে এলমে-ফেকাহ বা বিধান শাস্ত্র রচনা করে গেছেন। সর্বকালের মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞান সম্মত বিধিবিধান সম্বলিত এগরো লক্ষাধীক মাসআলা সংকলিত করে গেছেন তিনি। তাঁর সংকলিত মৌলিক মাসআলা-মাসায়েলের সুত্রগুলির মধ্যে এমন একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সমর্থনে কুরআন, হাদিস বা সাহাবীগণের আছার এর সমর্থন নাই। এর দ্বারাই অনুমিত হয় যে, তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটুকু বিস্তৃত ছিল।
ইমাম আবু হানীফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় প্রষ্ঠপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। তাঁর অন্যতম বিশিষ্ট সাগরেদ ইমাম মুহম্মদকে তিনি বাল্যকাল থেকেই লালন-পালন করে প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত শিখরে পৌছে দিয়েছিলেন। তাঁর অর্থ সাহায্যে লালিত এবং জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন শাখায় সুপ্রতিষ্ঠিত মনীষীবর্গের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ওবাং বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শা’বীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শা’বী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি! তুমি কোথায় যাওয়া-আসা কর?
ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শা’বী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে?
আবু হানীফা রহ. সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়।
কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শা’বী আবু হানীফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম সাহেব বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু জোহরা)
এ সময় আবু হানীফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর কাল ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন। ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতিঃ
যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করা। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)
ইমাম ইবনে হাযম রঃ বলেন, আবু হানীফার রঃ সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হবে। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার রঃ মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রঃ বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রঃ হারামাইন শরীফে কাশফ যুগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আমাকে অবগত করেছেনযে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার রঃ সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামন্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)
সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা রঃ বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্হান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ
সে জামানার দরসের হালকা বা শিক্ষাঙ্গনের চিত্র ছিল, উস্তাদ কোন একটি উচ্চ আসনে বসে তকরীর করতেন। ছাত্রগণ চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে নিতান্ত নিবিষ্টতার সাথে তকরীর শ্রবণ করতেন। অনেকেই তকরীর শুনে তা আয়ত্ব করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এসব তকরীর উস্তাদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে যিনি তকরীর করতেন তাঁর নামেই সেগুলো গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হতো। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দির সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফার রঃ শিক্ষাদান কার্যক্রমেও সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। কোন কোন মাসআলায় তর্ক শুরু হয়ে যেত। সে তর্ক কয়েকদিন পর্যন্তও চলতো। শেষ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যা সাব্যস্ত হতো সেটাই লিপিবদ্ধ হতো। কোন কোন মাসআলায় উস্তাদ ও সাগরেতের মধ্যকার মতভেদ অমীমাংসিতই থেকে যেত। সেই মত পার্থক্যগুলিও স্ব স্ব যুক্তি সহকারেই কিতাব লিপিবদ্ধ করা হতো। এভাবেই হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্হগুলি সংকলিত হয়েছে।
ইমাম সাহেবের দরছগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্হানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনেরা সমবেত হতেন। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন।
কর্মদিবস গুলিতে তিনি এশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। জোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। ফতোয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিল। তবে অবস্হা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো।
দরসের মজলিসে শিক্ষার্থীগণের সাথে অনেক সাধারণ লোকও শরীক হতেন। তর্কচ্ছলে অনেকে আপত্তিকর মন্তব্যও করত। কিন্তু কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে পরম ধৈর্যের সাথে জবাব দিতেন। চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের মোকাবেলাতেও তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না। প্রায সময়ই তিনি একটা কবিতাংশ আবৃত্তি করতেন। যা অর্থ ছিলো- ইয়া আল্লাহ ! যাদের অন্তর আমাদের দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আছে, আমাদের অন্তর তাদের প্রতি প্রশস্ত করে দাও। (আবু যোহরা)
প্রতিটি তকরীরের শেষে তিনি বলতেন, এটি আমার অভিমত। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, তা আমি বললাম। কেউ যদি আমার চাইতেও মজবুত দলীল ও যুক্তির অবতারনা করতে পারেন, তবে তাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। (আবু যোহরা)
কোন একটি বিষয় আলোচনার সময় একবার একজন ছাত্র বলেছিলেন, আপনার এই অভিমতটি খুবই চমৎকার। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে, এক পর্যায়ে এটি ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)
ইমাম আবু ইউসুফ রঃ তাঁর সব আলোচনারই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতেন। ইমাম সাহেব বলতেন, আমার তকরীর শুনে তা অনুধাবন করতে বেশি যত্নবান হও। এমনও হতে পারে যে, আজকের এই কথাগুলি পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)
যারা বিরূপ মন্তব্য করতো, তাদের সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মন্তব্য ছিল- যদি কেউ আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমার মধ্যে নাই, তবে সে ভুল বলছে। আর আলেমদের কিছু না কিছু দোষ চর্চা তো তাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।
ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফ রঃ এর দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফা রঃ এর নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।
মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রঃ ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।
খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। তিনি উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে খলীফাকে সম্বোধন করে বলেন, ’’ আল্লাহর শপথ , কোন ব্যাপারে আমার ফয়সালা যদি আপনার বিরুদ্ধে যায় এবং আপনি আমাকে হুকুম দেন যে হয়ত সিদ্বান্ত পাল্টাও না হলে তোমাকে ফোরাত নদীদে ডুবিয়ে মারা হবে। তখন আমি ডুবে মরতে প্রস্তুত থাকব তবু নিজের সিদ্বান্ত পাল্টাতে পারবনা। তা ছাড়া আপনার দরবারে এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের মনতুষ্টি করার মত কাজীর প্রয়োজন।’’
ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয় । যারফলে তাঁর সারা শরীর রক্কাক্ত হয়ে পড়ে। তখন খলীফা মানসুরের চাচা আব্দুস সামাদ ইবন আলী তাকে এজন্য খুবই তিরিষ্ড়্গার করে বলেন , ’’ ইনি শুধু ইরাকের ফকীহ নন। সমগ্র প্রাচ্যবাসীর ফকীহ।’’ এতে মনসুর লজ্জিত হয়ে প্রত্যেক চাবুঘাতের বদলে এক হাজার দিরহাম ইমাম আবু হানিফার কাছে পাঠান। কিন্তু ইমাম উক্ত দিরহাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানান। তখন তাকে বলা হয় তিনি এ অর্থ গ্রহন করে নিজের জন্য না রাখলেও দুঃখী-গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এর জবাবে ইমাম বলেণ ’’ তার কাছে কি কোন হালাল অর্থও রয়েছে’’?। মানসুর এরপর আরও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। ইমামকে আরও চাবুকাঘাত করা হয়। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফার মৃত্যূ হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মানুসর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন এন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়।

প্রশ্ন: ২২৩ : মুনাজাত শেষে মুখে হাত মোছা যাবে কি ?

প্রশ্নঃ
আমাদের দেশে মুনাজাতের শেষে মুখমন্ডলে হাত মোছার একটা ব্যাপক প্রচলন আছে। আমি অনেক আরব হাফেজ আলেম শায়েখগণকে দেখি তাঁরা মুনাজাত শেষে সরাসরি হাত ছেড়ে দেন।
আসলে হাত মোছা বা ছেড়ে দেওয়া কোনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
দুআ শেষে হাত চেহারায় মোছা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাই চেহারায় হাত মোছাই হাদীস সম্মত। তবে না মুছলেও সমস্যা নেই।
عن عمر بن الخطاب، رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا رفع يديه في الدعاء لم يحطهما حتى يمسح بهما وجهه
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করার সময় যখন তার উভয় হাত উঠাতেন, তিনি তা দিয়ে তার মুখমণ্ডল মর্দন না করা পর্যন্ত নামাতেন না। [সুনানে তিরমিজী-২/১৭৬, হাদীস নং-৩৩৮৬, মুসনাদে বাজ্জার-১/২৪৩, হাদীস নং-১১২৯, মুসতাদরাকে হাকেম-২/৭৪৮, হাদীস নং-১৯৬৭]
عبد الله بن عباس، ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ‏”‏ لا تستروا الجدر، من نظر في كتاب اخيه بغير اذنه فانما ينظر في النار، سلوا الله ببطون اكفكم ولا تسالوه بظهورها، فاذا فرغتم فامسحوا بها وجوهكم ‏”‏
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের ঘরের দেয়ালগুলো পর্দায় আবৃত করো না। যে ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে তার ভাইয়ের চিঠিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, সে যেন জাহান্নামের আগুনের দিকে তাকালো। তোমরা হাতের পৃষ্ঠের দ্বারা নয় বরং হাতের তালুর দ্বারা আল্লাহর কাছে চাইবে। অতঃপর দু‘আ শেষে তোমাদের হাতের তালু দিয়ে নিজের চেহারা মুছবে। [সুনানে আবু দাউদ-১/২০৯, হাদীস নং-১৪৮৫, মুস্তাদরাকে হাকেম-২/৭৪৯, হাদীস নং-১৯৬৮, মুজামে কাবীর লিততাবারানী-১০/৩১৯, হাদীস নং-১০৭৭৯]
عن الزهرى قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يرفع يديه عند صدره فى الدعاء، ثم يمسح بهما وجهه (مصنف عبد الرزاق-2/247، رقم-3234
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com


বি:দ্র: তবে যেহেতু হাত মুখে মুছার পর হাত চুম্বন করা হাদীসে আসেনি, সেহেতু তা না করাই ভালো। 


প্রশ্ন: ২২২: নবীজী (স.)এর জানাযা কে পড়িয়েছেন?

ইসলাম ডেস্ক: ইবনে মাজাহ শরিফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মঙ্গলবার সাহাবায়ে কেরাম রাসুলে কারিম সা.-এর গোসল ও কাফনের কাজ শেষ করেন। নবীজির দেহ মোবারক রওজার পাশে রাখেন। সাহাবারা দল দলে নবীজির কাছে আসতে থাকেন। কারও ইমামতিতে নয়; সবাই একা একা নামাজ ও দুরুদ শেষে বেরিয়ে যান। (ইবনে মাজাহ) অন্য কিতাবে আছে, রাসুল সা.-এর ইন্তেকাল এর আগে সাহাবিরা নবীজির দরবারে আসলেন। সাহাবাদের দেখে নবীজির চোখে বেদনার জল। নবীজি বললেন, আমি তোমাদের আল্লাহর কাছে সোপর্দ করছি, আল্লাহ তোমাদের সঙ্গী হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! আপনার যাওয়ার সময় খুব নিকটে চলে এসেছে, আপনার ইন্তেকালের পর আপনাকে কে গোসল দিবে? রাসুল সা. বললেন, আমার আহলে বাইত মানে আমার পরিবারের সদস্যরা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবার জানতে চাইলেন, কে আপনাকে কাফন পরাবে? রাসুল সা. বললেন, আমার আহলে বাইত। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবার জানতে চাইলেন কে আপনাকে কবরে নামাবে? রাসুল সা. বললেন, আমার আহলে বাইত। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবার জানতে চাইলেন কে আপনার জানাজা কে পড়াবে? তখন রাসুল সা.-এর চোখ বেয়ে বেদনার জল নেমে এলো। তিনি বললেন, তোমাদের নাবীর জানাজা এমন হবে না, যেমন তোমাদের হয়। যখন আমার গোসল হয়ে যাবে তখন তোমরা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। সবার আগে জিবরাইল আমার জানাজা পড়বে। তারপর মিকাঈল ও ই¯্রাফিল ধারাবাহিকভাবে আরশের অন্যান্য ফেরেশতারা আসবে ও আমার জানাজা পড়বে। তারপরে তোমাদের পুরুষরা, নারীরা এবং শিশুরা আমার জন্য দোয়া ও সালাম পড়বে। অতঃপর তোমরা আমাকে আল্লাহর সোপর্দ করে দিবে। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া-৫/২২২, দালায়েলুন নবুয়্যাহ লিলবায়হাককি) নবীজি সা.-এর জানাজা বিষয়ে আরো দীর্ঘ হাদিস পাওয়া যায় তিরিমিজি শরিফে। সাহাবি হজরত সালেম বিন ওবায়েদ রা. বলেন, আমি প্রথমে হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. কে রাসুলে কারিম সা.-এর ইন্তেকালের সংবাদ দিই । তখন আবু বকর সিদ্দিক রা. আমাকে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে ভেতরে আসো । সাহাবি হজরত সালেম বিন ওবায়েদ রা. বলেন, হজরত আবু বকর রা. যখন রাসুলের নিকট যেতে চাইলেন, তখন চারপাশে মানুষের প্রচন্ড- ভিড় । হজরত আবু বকর রা. লোকদের বললেন, তোমরা আমাকে সামান্য রাস্তা দাও ! লোকেরা ভেতরে যাওয়ার পথ করে দিল ! তিনি ভেতরে গেলেন, মাথা নুইয়ে কাছে গিয়ে নবীজি সা. কে দেখলেন । নবীজির পবিত্র কপালে হজরত আবু বকর রা. চুমু খেলেন । তারপর কোরআনের আয়াত পড়লেন, যার অর্থ হলো, নিশ্চয় তুমিও ইন্তেকাল করবে এবং তারাও ইন্তেকাল করবে । হজরত আবু বকর রা. বেরিয়ে এলে; লোকেরা জানতে চাইলেন, ওগো নবীজির বন্ধু ! নবীজি কি ইন্তেকাল করেছেন ? হজরত আবু বকর রা. বললেন, হ্যা । তখন লোকেরা নবীজির ইন্তেকালের খবর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলো । তারপর সাহাবায়ে কেরাম হজরত আবু বকর রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, ওগো নবীজির বন্ধু ! নবীজির কি জানাজার নামাজ পড়া হবে ? তিনি বললেন, হ্যা । জিজ্ঞাসা করা হল, কিভাবে ? হজরত আবু বকর রা. বললেন, এভাবে যে, এক এক জামাত নবীজির ঘরে প্রবেশ করবে এবং জানাজা পড়ে বেরিয়ে আসবে । তারপর অন্য জামাত প্রবেশ করবে । সাহাবারা হজরত আবু বকর রা. কে জিজ্ঞাসা করলেন, নবীজিকে কি দাফন করা হবে ? তিনি বললেন, জি । জিজ্ঞাসা করা হল, কোথায় ? তিনি বললেন, যেখানে আল্লাহ তায়ালা নবীজির রূহ কবজ করেছেন সেখানেই । কেননা, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় নবীজিকে এমন স্থানে মৃত্যু দান করেছেন যে স্থানটি উত্তম ও পবিত্র । সাহাবারা দৃঢ়ভাবে মেনে নিলেন হজরত আবু বকর রা.-এর কথা । হজরত আবু বকর রা. নিজেই নবীজির আহলে বায়াত তথা রাসুলের পরিবার ও বংশের মানুষদের ডেকে গোসল নির্দেশ দেন । (সূত্র : শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৯, ৩৯৭, শরফুল মুস্তফা, বর্ণনা নং-৮৫০, আল আনওয়ার ফি শামায়িলিন নাবিয়্যিল মুখতার, বর্ণনা নং-১২০৯) ইমাম শাফি রহ. এবং কাজি ইয়াজ রা. বলেন, নবীজি সা.-এর জানাজা পড়া হয়েছে । কিতাবুল উম্মু/ সিরাতে মস্তুফা/৩য় খ-: ২৩৫ পুনশ্চ : নবীজির জানাজা হয়েছে । সাহাবারা একা একা পড়েছেন । কেউ ইমামতি করেননি । তবে তাবাকাতে ইবনে সাদের বরাতে বলা হয়, হজরত আবু বকর ও ওমর রা. এক সঙ্গে নবীজি সা.-এর ঘরে উপস্থিত হন । নবীজির দেহ মোবরক সামনে রেখে নামাজ-সালাম ও দুরুদ পেশ করেন । দীর্ঘ দোয়ার সময় পেছনে সারিবদ্ধ সাহাবিরা আমিন আমিন বলেছেন । (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৫ম খ-: ২৬৫) ৮ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

প্রশ্ন: ২২১ : টয়লেটে কি অযু করা যাবে?

উত্তর: বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে, হবে।

প্রশ্ন: ২২০ : আমরা জানি কুরান আল্লাহর পবিত্র বানী। পবিত্র অবস্থায় পড়তে হয়। কিন্ত কিছু কিছু সময় থাকে ওযু করা একটু কষ্ট হয় যেমন কেউ কোন কর্মক্ষেত্রে আছে বা কেউ ভ্রমণে আছে বা কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে বসে আছে সেই মুহুর্তে কুরান পড়তে চাইলে ওযু ছাড়া পড়া যাবে কি না?

উত্তর : কুরআন পড়ার জন্য অযু শর্ত নয়।

প্রশ্ন: ২১৯ : আমার কয়েক হাজার টাকা ঋণ আছে, আমার যা ইনকাম তা দিয়ে শোধ করতে কয়েক মাস লাগবে কিন্তু পাওনাদারদের আর এক মাসও মানানো যাচ্ছে না, এই মুহূর্তে আমার ব্যাংক থেকে সুদের টাকা তোলার জন্য অনেকেই বলতেছে । এই বিপদের মধ্যে আমার এই কাজটা করা কি ঠিক হবে?

উত্তর : না । আপনার যা সাধ্য আছে সে অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করুন। যারা বেশী চাপাচাপি করছে তারা সুন্নতের খেলাপ করছে।

প্রশ্ন: ২১৮ : সর্বশেষ মৃত্যুবরণ কারী ব্যক্তি কবরে কতদিন থাকবে?

উত্তর : কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী চল্লিশ হাজার বছর। আসলে এতে কবর বাসীদের কিছু আসে যায় না। কারণ কবর থেকে ওঠার পর তাদের মনে হবে তারা কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছিল। এখন ঘুম থেকে জাগলো। (সুরা ইয়াসীন)

প্রশ্ন: ২১৭ : যদি কোন মহিলার স্বামী বিদেশ থাকে এবং বিদেশ থেকে মারা যায় তাহলে কি সেই নারীর ক্ষেত্রে ইদ্দত পালন করা লাগবে কিনা?

উত্তর: জ্বি ইদ্দত পালন করা লাগবে।

প্রশ্ন: ২১৬ : অজুর ফরজ কয়টি ও কি কি চার মাযহাবের ইমামদের মতামত সহ

অজুর ফরজ চারটি।
১. মাথার চুলের গোড়া থেকে থুতনীর নিচ পর্যন্ত এবং এক কানের লতি থেকে অন্য কানের লতি পর্যন্ত সমস্ত মুখ ধৌত করা।
২. উভয় হাত কনুইসহ ধৌত করা।
৩. মাথার চার ভাগের একভাগ মাসেহ করা।
৪. উভয় পা টাখনু -গিরাসহ ধৌত করা।
দাড়ি ঘন হলে তার গোড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছানো জরুরী নয়।
যদি এসব অঙ্গের কোন একটির নখ পরিমাণও শুকনা থাকে,তাহলে অজু শুদ্ধ হবেনা।
ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফেই (রহ.) এর মতে নিয়ত করা এবং অজুর ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও ফরজ।
আর ইমাম মালেক (রহ.) এর মতে একের পর এক অর্থাৎ এক অঙ্গ শুকাতে না শুকাতে আরেক অঙ্গ ধোয়াও ফরজ।
ইমাম আহমদ (রহ.) এর মতে বিসমিল্লাহ বলা,কুলি করা এবং নাকে পানি দেওয়াও ফরজ। ইমাম মালেক ও আহমদ (রহ.) এর মতে সমস্ত মাথা মাসেহ করা ফরজ।

মালাবুদ্দা-মিনহু ৩০

প্রশ্ন: ২১৫ : জামাতে নামাজ না পড়ার শাস্তি কি ?

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ পড়ো নামাজিদের সঙ্গে।’ অর্থাৎ তোমারা জামাতসহকারে  নামাজ পড়ো। (সূরা বাকারা)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
يَوْمَ يُكْشَفُ عَن سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ
خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ
‘পায়ের গোছা পর্যন্ত উন্মুক্ত করার দিনের কথা স্মরন কর, সে দিন তাদেরকে সিজদা করতে বলা হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি অবনত থাকবে, তারা লাঞ্ছনাগ্রস্ত হবে, অথচ যখন তারা সুস্থ অবস্থায় ছিল, তখন তাদেরকে সিজদা করার জন্য আহ্বান জানানো হত। কিন্তু তারা সাড়া দিত না। (সূরা কালাম-৪২-৪৩)।
নবী কারীম সা. ইরশাদ করেন-  ‘জামাতের সঙ্গে নামাজে সাতাশ গুণ বেশি পূণ্য নিহিত রয়েছে।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি)
তিনি আরো ইরশাদ করেন,  ‘একা নামাজ পড়া অপেক্ষা দু’জনে জামাতে নামাজ পড়া উত্তম। দু’জন অপেক্ষা বহুজন মিলে জামাতে নামাজ পড়া আল্লাহর কাছে আরো বেশি পছন্দনীয় এবং উত্তম।’ (আবু দাউদ)।
তিনি আরো ইরশাদ করেন,  ‘যে ব্যক্তি এশার নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়বে, সে অর্ধরাত বন্দেগির সওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়বে, পূর্ণ রাত বন্দেগি করার পূণ্য লাভ করবে।’ (তিরমিযি)।
এজন্য নবীজি (সা.) কখনো জামাত তরক করতেন না। এমনকি অসুস্থ অবস্থায় যখন তিনি হাঁটতে পারতেন না, তখনো দুই সাহাবির কাঁধে ভর করে পা টেনে টেনে নামাজের জামাতে হাজির হয়েছেন। জামাতবিহীন একা একা নামাজ পড়েননি।
এমন কী নবীজি (সা.) তো এতটুকুও বলেছে,  ‘আমার তো মনে চায় মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বলব এবং কাউকে নামাজ পড়াতে বলব আর আমি আগুনের অঙ্গার নিয়ে যাব, যে আজান শুনার পরও মসজিদে জামাতে হাজির হওয়ার জন্য বের হয়নি- তার ঘর জ্বালিয়ে দিই।’ (বুখারি, মুসলিম)।
তিনি আরো বলেন- ‘কোথাও যদি তিনজন মানুষ থাকে, আর তারা যদি জামাতে নামাজ না পড়ে, তাহলে শয়তান তাদের ওপর বিজয়ী হয়ে যাবে। কাজেই তুমি জামাতে নামাজ পড়াকে কর্তব্য মনে করো।’  (নাসায়ি)
তিনি আরো বলেন- ‘সেই ব্যক্তির ওপর আল্লাহর অভিশাপ, যে আজান শুনেও জামাতে উপস্থিত হয় না।’ (মাজমাউজ্জাওয়াইদ)।
চিন্তার বিষয় হলো, নবীজি (সা.) যেখানে জামাতে অনুপস্থিত মুসাল্লির ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেছেন, সেখানে যে বেনামাজি, তার শাস্তি যে  কত ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়।
নবীকরীম (সা.) এর নিকট এক অন্ধ ব্যক্তি এসে বলল,  ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার এমন কেউ নেই, যে আমাকে মসজিদে পৌছে দেবে।
সে নবীজীর কাছে অনুমতি চাইল বাড়িতে নামাজ পড়ার জন্য। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর অন্ধ লোকটি চলে যেতে শুরু করলে রাসূল (সা.) তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী আজান শুনতে পাও?’ সে বলল? জ্বী- হাঁ, শুনতে পাই। তিনি (সা.) বললেন, তাহলে জওয়াব দেবে। অর্থাৎ মসজিদে উপস্থিত হবে। (মুসলিম)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘কোনো মুমিন বান্দার পক্ষে আজান শুনেও জামাতে শামিল না হওয়ার চেয়ে গলিত সীসা কানে ঢেলে দেওয়া উত্তম। (কিতাবুস সালাহ)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেন, আজান শোনার পর বিনা ওযরে যে ব্যক্তি নামাজের জামাতে শরীক হয় না তার একাকী নামাজ পড়া কবুল হবে না। জানতে চাওয়া হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওজর বলতে কী বুঝায়? তিনি বললেন, বিপদ অথবা রোগব্যাধি। (আবু দাউদ, ইবনেমাজাহ)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) আরো বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন (১) যে নেতাকে লোকেরা অপছন্দ করে, (২) যে নারী তার স্বামী অসন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় রাত যাপন করে, (৩) নামাজের আজান শ্রবণ করেও যে জামাতে শরীক হয় না। (হাকেম)।
হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘মসজিদের প্রতিবেশী লোকজনের নামাজ মসজিদ ব্যতিত সঠিক হবে না। জিজ্ঞাসা করা হলো, মসজিদের প্রতিবেশী কারা? ‘যে বাড়ীতে আজান শুনতে পায়।’ (মুসানদে আহমাদ)।
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তি মুসলমান হিসেবে আল্লাহর দীদার লাভ করতে চায় সে যেন প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিক মতো আদায় করে।’ কেননা আল্লাহ তোমাদের নবীর জন্য হিদায়াতের বিধানাবলি প্রবর্তন করে দিয়েছেন। আর এ নামাজগুলো হচ্ছে হিদায়াতের অন্যতম পন্থা। অনেকের মতো তোমরাও যদি নিজ গৃহে নামাজ পড়, তবে যেন নবীর পথ ছেড়ে দিলে। আর তোমরা যদি নবীর পথ ছেড়ে দাও, তাহলে পথভ্রষ্ট হবে। আমার জানা মতে, মুনাফিক বা অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া কেউ জামাতে শামিল হতে অবহেলা করে না। অথচ যে ব্যক্তি দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদ পর্যন্ত আসে, অবশ্যই সে জামাতে নামাজের জন্যই আগমন করে।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, একবার হজরত ওমর (রা.) তার খেজুর বাগান পরিদর্শনে গেলেন। তিনি তখন জামাত ছুটে যাওয়ার কাফফারা স্বরুপ খেজুর বাগানটি সদকা করে দেন।
সংগ্রহে: আব্দুল রাফি আব্দুল্লাহ
ডেইলি বাংলাদেশ/আরএজে

প্রশ্ন: ২১৪ : বিতরের কাযা আদায় করা যাবে কি?

উত্তর:
-----------------------------
বিত্‌র নামায যথা সময়ে না পড়া হলে তা কাযা পড়া বিধেয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি বিত্‌র না পড়ে ঘুমিয়ে যায় অথবা তা পড়তে ভুলে যায় সে ব্যক্তি যেন তা স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌),হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৫৬২নং) তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে থেকে বিত্‌র না পড়তে পারে সে ব্যক্তি যেন ফজরের সময় তা পড়ে নেয়।” (তিরমিযী, সুনান, ইর: ৪২২, জামে ৬৫৬৩নং)
খোদ মহানবী (সাঃ)-এর কোন রাত্রে বিত্‌র না পড়ে ফজর হয়ে গেলে তখনই বিত্‌র পড়ে নিতেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৪৩, বায়হাকী ১/৪৭৯, ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/২৪৬)
একদা এক ব্যক্তি মহানবীর দরবারে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! ফজর হয়ে গেছে অথচ আমি বিত্‌র পড়তে পারিনি।’ তিনি বললেন, “বিত্‌র তো রাত্রেই পড়তে হয়।” লোকটি পুনরায় বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! ফজর হয়ে গেছে অথচ আমি বিত্‌র পড়তে পারিনি।’ এবারে তিনি বললেন, “এখন পড়ে নাও।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৭১২নং)
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, ফজর হয়ে গেলেও বিতর নামায বিতরের মতই কাযা পড়া যাবে। (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৪/২৮৯ দ্র:)
মনে রাখবেন-তবে সেদিন সূর্যোদয়ের পরে বিতির পড়তে হলে চাশতের ওয়াক্তে ১২ রাকাত নামাজ চাশতের নিয়তে আদায় করে নিলেই যথেষ্ট হবে। কারো যদি ৩ রাকাত বিতির পরার অভ্যাস থাকে তবে ৪ রাকাত পরে নিবে জোর করে কারন সূর্যোদয়ের পরে বিতির পড়লে বিজোড় পড়া যাবে না।

প্রশ্ন: ২১৪ : তাশাহুদের বৈঠকে আঙ্গুল কখন কিভাবে উঠাবে?

উত্তর: 
ﺑﺴﻢ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺮﺣﻤﻦ ﺍﻟﺮﺣﻴﻢ
নামাযী নামাযের মধ্যে যখন মৌখিকভাবে তাওহীদের সাক্ষ্য দেয় তখন তার আঙ্গুলও এই সাক্ষ্য দিবে। এজন্য আত্তাহিয়্যাতু পড়তে পড়তে যখন “আশহাদু আল্লা..ইলাহা” পর্যন্ত পৌছবে তখন বৃদ্ধাঙ্গুলি ও মধ্যমা দ্বারা গোলক/বৃত্ত বানাবে, এবং শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করবে। আর কনিষ্ঠা ও অনামিকা হাতের তালুর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। “ইল্লাল্লাহ” বলার পর শাহাদত আঙ্গুলি নিচু করবে। তবে অন্য আঙ্গুলগুলো আপন অবস্থায় নামাযের শেষ পর্যন্ত থাকবে।
উল্লেখ্য যে,বৃদ্ধাঙ্গুলির নিকটতম আঙ্গুলকে শাহাদত আঙ্গুল বলা হয়।
ইশারা শেষ করে আঙ্গুল আর নড়াচড়া করবে না।
ﻓﺎﻟﻤﺮﺍﺩ ﻭﺿﻊ ﺍﻻﻛﻒ ﺛﻢ ﻗﺒﺾ ﺍﻻﺻﺎﺑﻊ ﺑﻌﺪ ﺫﻟﻚ ﻋﻨﺪ ﺍﻻﺷﺎﺭﺓ ﻭﻫﻮ ﺍﻟﻤﺮﻭﻯ ﻋﻦ ﻣﺤﻤﺪ ﻓﻰ ﻛﻴﻔﻴﺔ ﺍﻻﺷﺎﺭﺓ، ﻗﺎﻝ ﻳﻘﺒﺾ ﺧﻨﺼﺮﻩ ﻭﺍﻟﺘﻰ ﺗﻠﻴﻬﺎ ﻭﻳﺤﻠﻖ ﺍﻟﻮﺳﻄﻰ ﻭﺍﻻﺑﻬﺎﻡ ﻭﻳﻘﻴﻢ ﺍﻟﻤﺴﺒﺤﺔ ﻭﻛﺬﺍ ﻋﻦ ﺍﺑﻰ ﻳﻮﺳﻒ ﻓﻰ ﺍﻻﻣﺎﻟﻰ ‏( ﺍﻟﻰ ﺍﻥ ﻗﺎﻝ ‏) ﻭﺻﻔﺔ ﺍﻻﺷﺎﺭﺓ ﻋﻦ ﺍﻟﺤﻠﻮﺍﻧﻰ ﺍﻧﻪ ﻳﺮﻓﻊ ﺍﻻﺻﺒﻊ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻨﻔﻰ ﻭﻳﻀﻌﻬﺎ ﻋﻨﺪ ﺍﻻﺛﺒﺎﺕ ﺍﺷﺎﺭﺓ ﺍﻟﻴﻬﻤﺎ، ‏( ﺣﻠﺒﻰ ﻛﺒﻴﺮ 328-
ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻗُﺘَﻴْﺒَﺔُ ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻟَﻴْﺚٌ ﻋَﻦِ ﺍﺑْﻦِ ﻋَﺠْﻼَﻥَ ﺡ ﻗَﺎﻝَ ﻭَﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺃَﺑُﻮ ﺑَﻜْﺮِ ﺑْﻦُ ﺃَﺑِﻰ ﺷَﻴْﺒَﺔَ - ﻭَﺍﻟﻠَّﻔْﻆُ ﻟَﻪُ - ﻗَﺎﻝَ ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺃَﺑُﻮ ﺧَﺎﻟِﺪٍ ﺍﻷَﺣْﻤَﺮُ ﻋَﻦِ ﺍﺑْﻦِ ﻋَﺠْﻼَﻥَ ﻋَﻦْ ﻋَﺎﻣِﺮِ ﺑْﻦِ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺑْﻦِ ﺍﻟﺰُّﺑَﻴْﺮِ ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻴﻪِ ﻗَﺎﻝَ ﻛَﺎﻥَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ -ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - ﺇِﺫَﺍ ﻗَﻌَﺪَ ﻳَﺪْﻋُﻮ ﻭَﺿَﻊَ ﻳَﺪَﻩُ ﺍﻟْﻴُﻤْﻨَﻰ ﻋَﻠَﻰ ﻓَﺨِﺬِﻩِ ﺍﻟْﻴُﻤْﻨَﻰ ﻭَﻳَﺪَﻩُ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﻋَﻠَﻰ ﻓَﺨِﺬِﻩِ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﻭَﺃَﺷَﺎﺭَ ﺑِﺈِﺻْﺒَﻌِﻪِ ﺍﻟﺴَّﺒَّﺎﺑَﺔِ ﻭَﻭَﺿَﻊَ ﺇِﺑْﻬَﺎﻣَﻪُ ﻋَﻠَﻰ ﺇِﺻْﺒَﻌِﻪِ ﺍﻟْﻮُﺳْﻄَﻰ ﻭَﻳُﻠْﻘِﻢُ ﻛَﻔَّﻪُ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﺭُﻛْﺒَﺘَﻪُ .
হযরত আমের আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূল সাঃ যখন তাশাহুদ পড়ার জন্য বসতেন,তখন ডান হাতখানা ডান উরুর উপর এবং বাঁ হাতখানা বাঁ উরুর উপর রাখতেন। আর শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। এ সময় তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলিকে মধ্যমার সাথে সংযুক্ত করতেন এবং বাঁ হাতের তালু [বাঁ] হাঁটুর উপর রাখতেন। {সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১৩৩৬, কিতাবুল মাসাজিদ, সহীহ ইবনে হিব্বান-৫/২৭০}
ﻭَﺣَﺪَّﺛَﻨِﻰ ﻣُﺤَﻤَّﺪُ ﺑْﻦُ ﺭَﺍﻓِﻊٍ ﻭَﻋَﺒْﺪُ ﺑْﻦُ ﺣُﻤَﻴْﺪٍ ﻗَﺎﻝَ ﻋَﺒْﺪٌ ﺃَﺧْﺒَﺮَﻧَﺎ ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﺑْﻦُ ﺭَﺍﻓِﻊٍ ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻋَﺒْﺪُ ﺍﻟﺮَّﺯَّﺍﻕِ ﺃَﺧْﺒَﺮَﻧَﺎ ﻣَﻌْﻤَﺮٌ ﻋَﻦْ ﻋُﺒَﻴْﺪِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺑْﻦِ ﻋُﻤَﺮَ ﻋَﻦْ ﻧَﺎﻓِﻊٍ ﻋَﻦِ ﺍﺑْﻦِ ﻋُﻤَﺮَ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰَّ - ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - ﻛَﺎﻥَ ﺇِﺫَﺍ ﺟَﻠَﺲَ ﻓِﻰ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓِ ﻭَﺿَﻊَ ﻳَﺪَﻳْﻪِ ﻋَﻠَﻰ ﺭُﻛْﺒَﺘَﻴْﻪِ ﻭَﺭَﻓَﻊَ ﺇِﺻْﺒَﻌَﻪُ ﺍﻟْﻴُﻤْﻨَﻰ ﺍﻟَّﺘِﻰ ﺗَﻠِﻰ ﺍﻹِﺑْﻬَﺎﻡَ ﻓَﺪَﻋَﺎ ﺑِﻬَﺎ ﻭَﻳَﺪَﻩُ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﻋَﻠَﻰ ﺭُﻛْﺒَﺘِﻪِ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﺑَﺎﺳِﻄُﻬَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻬَﺎ
হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ নামায পড়ার সময় যখন বসতেন বৈঠক করতেন] তখন হাত দুইখানা দ্ইু হাঁটুর উপর রাখতেন। আর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির পার্শ্ববতী [শাহাদাত] আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করতেন এবং বাঁ হাত বাঁ হাঁটুর উপর ছড়িয়ে রাখতেন। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৩৩৭}
ﻋَﻦِ ﺍﺑْﻦِ ﻋُﻤَﺮَ ﺃَﻥَّ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ - ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - ﻛَﺎﻥَ ﺇِﺫَﺍ ﻗَﻌَﺪَ ﻓِﻰ ﺍﻟﺘَّﺸَﻬُّﺪِ ﻭَﺿَﻊَ ﻳَﺪَﻩُ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﻋَﻠَﻰ ﺭُﻛْﺒَﺘِﻪِ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَﻯ ﻭَﻭَﺿَﻊَ ﻳَﺪَﻩُ ﺍﻟْﻴُﻤْﻨَﻰ ﻋَﻠَﻰ ﺭُﻛْﺒَﺘِﻪِ ﺍﻟْﻴُﻤْﻨَﻰ ﻭَﻋَﻘَﺪَ ﺛَﻼَﺛَﺔً ﻭَﺧَﻤْﺴِﻴﻦَ ﻭَﺃَﺷَﺎﺭَ ﺑِﺎﻟﺴَّﺒَّﺎﺑَﺔِ
হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, তখন বাম হাতকে রাখতেন বাম হাঁটুর উপর এবং ডান হাতখানা ডান হাঁটুর উপর রাখতেন। আর [হাতের তালু ও আঙ্গুলসমূহ গুটিয়ে আরবী] তিপ্পান্ন সংখ্যার মত করে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। {সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-১৩৩৮}
উল্লেখিত হাদীসমূহে শুধুমাত্র আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করার কথা এসেছে। আঙ্গুল নাড়ানোর কথা আসেনি। কিন্তু আঙ্গুল নাড়বে কি না? এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। অন্য হাদীসে তাও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। যেমন-
ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢُ ﺑْﻦُ ﺍﻟْﺤَﺴَﻦِ ﺍﻟْﻤِﺼِّﻴﺼِﻰُّ ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺣَﺠَّﺎﺝٌ ﻋَﻦِ ﺍﺑْﻦِ ﺟُﺮَﻳْﺞٍ ﻋَﻦْ ﺯِﻳَﺎﺩٍ ﻋَﻦْ ﻣُﺤَﻤَّﺪِ ﺑْﻦِ ﻋَﺠْﻼَﻥَ ﻋَﻦْ ﻋَﺎﻣِﺮِ ﺑْﻦِ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻋَﻦْ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺑْﻦِ ﺍﻟﺰُّﺑَﻴْﺮِ ﺃَﻧَّﻪُ ﺫَﻛَﺮَ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰَّ - ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - ﻛَﺎﻥَ ﻳُﺸِﻴﺮُ ﺑِﺄُﺻْﺒُﻌِﻪِ ﺇِﺫَﺍ ﺩَﻋَﺎ ﻭَﻻَ ﻳُﺤَﺮِّﻛُﻬَﺎ .
হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ যখন তাশাহুদ পড়তেন,তখন আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন, কিন্তু আঙ্গুল নাড়াতে থাকতেন না। {সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-১১৯৩, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৯৯১, মুসনাদে আবী আওয়ানা, হাদীস নং-১৫৯৪}
হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মন্তব্য
১-
ইমাম আব দাউদ উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করার পর কোন মন্তব্য করেননি। আর মুহাদ্দিসদের কাছে এটি প্রসিদ্ধ যে, ইমাম আবু দাউদ কোন হাদীস বর্ণনা করার পর তার ব্যাপারে কোন মন্তব্য না করার মানেই হল, উক্ত হাদীসটি তার কাছে সহীহ।

ইমাম নববী রহঃ বলেন- হাদীসটির সনদ সহীহ। {আলখুলাসা-১/৪২৮, আলমাজমূ-৩/৪৫৪}

মুহাদ্দিস আব্দুল হক শিবলী রহঃ বলেন- হাদীসটির সনদ সহীহ। {আলআহকামুস সুগরা-২৪৯}

ইবনে দাকীকুল ঈদ রহঃ বলেন- কতিপয় মুহাদ্দিসদের বক্তব্য অনুপাতে হাদীসটি সহীহ। {আলইলমাম ফি বিআহাদীসিল আহকাম-১/১৭৫}

আল্লামা ইবনুল মুলাক্কিন রহঃ বলেন- হাদীসটি সহীহ। {খুলাসাতুল বদরুল মুনীর-১/১৩৯, আলবাদরুল মুনীর-৪/১১, তুহফাতুল মুহতাজ-১/৩২৩}

শায়েখ হায়সামী রহঃ বলেন- সনদের রাবীগণ সিক্বা। {মাযমাউজ জাওয়ায়িদ-২/১৪৩}

ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন- হাদীসটি হাসান। {তাখরীজে মিশকাতুল মাসাবীহ-১/৪১১}
ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺍﻋﻠﻢ ﺑﺎﻟﺼﻮﺍﺏ
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

প্রশ্ন: ২১৩ : মাগরিব নামাজ একাকী পড়লে কেরাত চুপিচুপি পড়া যাবে কি?

প্রশ্ন

যোহরের নামায ও আসরের নামাযে ক্বিরাত চুপে চুপে পড়া, আর ফজর, মাগরিব ও এশার নামাযে উচ্চস্বরে পড়ার সপক্ষে কুরআন-সুন্নাহর কী দলিল রয়েছে?
উত্তর
আলহামদু লিল্লাহ।
তোমার এই উচ্চাকাঙ্খার জন্য আমরা তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং এই বয়সে কুরআন-সুন্নাহ্‌র দলিল জানার আগ্রহ দেখে আমরা প্রীত হচ্ছি। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন, তোমাকে কাজে লাগান।
আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণ ও অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: "তোমাদের জন্য তথা যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহ্‌কে বেশি বেশি স্মরণ করে তার জন্য রাসূলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ।[সূরা আহযাব, আয়াত: ২১]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ সেভাবে নামায পড়"। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে, মাগরিব ও এশার নামাযের প্রথম দুই রাকাতে শব্দ করে তেলাওয়াত করতেন। আর বাকী নামাযে চুপে চুপে তেলাওয়াত করতেন।
উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করার দলিলসমূহের মধ্যে রয়েছে:
জুবাইর বিন মুতয়িম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মাগরিবের নামাযে (সূরা) "তূর" তেলাওয়াত করতে শুনেছি।"[সহিহ বুখারী (৭৩৫) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৩)]
আল-বারা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এশার নামাযে "ওয়াত ত্বীনি ওয়ায যাইতূন" পড়তে শুনেছি। আমি তাঁর চেয়ে সুন্দর কণ্ঠের তেলাওয়াত শুনিনি।"[সহিহ বুখারী (৭৩৩) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৪)]
জ্বিনদের উপস্থিত হওয়া ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কুরআন শুনা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস। সে হাদিসে রয়েছে: "তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। যখন তাদের কানে কুরআন পৌঁছল তখন তারা মনোযোগ দিয়ে কুরআন শুনল।"[সহিহ বুখারী (৭৩৯) ও সহিহ মুসলিম (৪৪৯)]
এ হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করতেন যাতে করে উপস্থিত লোকেরা শুনতে পায়।
আর যোহর ও আসরের নামাযে চুপে চুপে তেলাওয়াত করার সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে:
খাব্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করল: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি যোহর ও আসরের নামাযে ক্বিরাত পড়তেন? তিনি বলেন: হ্যাঁ। আমরা বললাম: আপনারা সেটা কিভাবে জানতেন? তিনি বললেন: তাঁর দাঁড়ির নড়াচড়া দেখে।"[সহিহ বুখারী (৭১৩)]
সুতরাং এর মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে গেল যে, উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করার নামাযগুলোতে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করা এবং চুপেচুপে তেলাওয়াত করার নামাযগুলোতে চুপেচুপে তেলাওয়াত করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ্‌ (আদর্শ) এবং গোটা মুসলিম উম্মাহ্‌ এ ব্যাপারে একমত।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: "তিনি প্রত্যেক নামাযে তেলাওয়াত করতেন। তিনি যে নামাযগুলোতে আমাদেরকে শুনিয়ে তেলাওয়াত করতেন সে সব নামাযে আমরাও তোমাদেরকে শুনিয়ে তেলাওয়াত করি। আর তিনি যে সব নামাযে আমাদেরকে না শুনিয়ে তেলাওয়াত করতেন সে সব নামাযে আমরাও তোমাদেরকে না শুনিয়ে তেলাওয়াত করি।"[সহিহ বুখারী (৭৩৮) ও সহিহ মুসলিম (৩৯৬)]
ইমাম নববী বলেন: “সুন্নাহ্‌ হচ্ছে—ফজর, মাগরিব ও এশার দুই রাকাতে এবং জুমার নামাযে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করা। আর যোহর ও আসরের নামাযে এবং মাগরিবের তৃতীয় রাকাতে এবং এশার তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে চুপেচুপে তেলাওয়াত করা। সুস্পষ্ট সহিহ হাদিসের সাথে মুসলিম উম্মাহর ইজমার ভিত্তিতে এসব বিধান সাব্যস্ত।”[আল-মাজমু (৩/৩৮৯) থেকে সমাপ্ত]
ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন:  
“যোহর ও আসরের নামাযে চুপেচুপে তেলাওয়াত করবে। মাগরিব ও এশার নামাযের প্রথম দুই রাকাতে এবং ফজরের নামাযের সব রাকাতে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করবে...। এর দলিল হচ্ছে—নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল। এটি পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে পরবর্তীদের প্রচারের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে। অতএব, কেউ যদি চুপেচুপে পড়ার নামাযে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করে কিংবা উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করার নামাযে চুপেচুপে পড়ে তাহলে সে সুন্নাহ্‌র খিলাফ করল। কিন্তু তার নামায শুদ্ধ হবে।”[আল-মুগনি (২/২৭০) থেকে সমাপ্ত]

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

প্রশ্ন: ২১২ : সুরা তওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া যাবে কি ?

সূরা আত-তাওবাহ: অনুশোচনা
সূরা আত-তওবাহ পবিত্র কুরআন শরীফের ৯ম সূরা। এই সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ১২৯টি। আরবি তওবা অর্থ ক্ষমা। একে সূরা তওবা বলা হয়, কারণ এতে মুসলমানদের তওবা কবুল হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। সূরাটির অন্য নাম হলো বারা'আত - একে বারা'আত বলা হয় কারণ, এতে কাফিরদের তথা অবিশ্বাসীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্ব-মুক্তির উল্লেখ আছে।
পবিত্র কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা রয়েছে। তার মধ্যে সূরা তাওবাহ ছাড়া বাকি ১১৩টি সূরার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ রয়েছে। কিন্তু সূরা তাওবাহ’র শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ নেই।
সূরা আত-তাওবাহ -তে ‘বিসমিল্লাহ’ না থাকার কারণ:
পবিত্র কুরআন শরীফের বিভিন্ন অংশ ২৩ বছরের দীর্ঘ পরিসরে অবতীর্ণ হয়েছিল। কখনও একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাও ভেঙে ভেঙে অবতীর্ণ হতো। হযরত জিব্রাইল (আ:) তা কোথায় বসাতে হবে, তা বলে দিতেন। একটি সূরা সমাপ্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় সূরা শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ নাযিল হতো। এর থেকে বুঝা যেত যে, একটি সূরা শেষ হলো, অতঃপর অপর সূরা শুরু হলো। কুরআন মাজীদের সকল সূরার বেলায় এ নীতি-বলবৎ থাকে।
কিন্তু সাধারণ নিয়ম মতে তাওবাহ’র শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ নাযিল হয়নি, আর রসূলুল্লাহ (স.) তা লিখে নেয়ার জন্য ওহী লেখকদের নির্দেশও দেন-নি এবং এই সূরা কোন সূরার অংশ তাও বলেননি। এই অবস্থায় রসূলুল্লাহ (স:) ইন্তেকাল করেন।
তাই মাসহাফ-ই ওসমানীতেও (তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা.) কর্তৃক প্রকাশিত কুরআন) সূরা তাওবাহ’র শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা হয়নি। সূরা আনফাল এই সূরার পূর্বে অবতীর্ণ হওয়ায় সূরা তাওবাহকে সূরা আনফলের পরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এবং আয়াত সংখ্যা বেশি হওয়ায় আনফলের সাথে অন্তর্ভুক্ত না করে তওবাকে আলাদা করে স্থান দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞ 'আলেমদের বক্তব্য হলো, যেহেতু অবতরণের সময় সূরা তাওবাহ’র শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ ছিল না, তাই সূরা তাওবাহ আনফালের সাথে পড়লে এর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তে হবে না, অন্যথায় পড়তে হবে।

(উত্তর দানে : আবদুল বাতেন) 

প্রশ্ন: ২১১: নামাজে সতর কতটুকু ঢাকতে হবে?হাতের কুনুই খোলা রাখলে কি নামাজ হবে?আমি টিসার্ট পরে নামাজ পড়ি এতে হাতের কুনুই খোলা থাকে, এতে কি নামাজ যথাযথ হবে?

নামাজে সতর ঢাকা প্রসঙ্গে:
মুফতি মাহমুদ হাসান
==================

নামাজ বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হলো সতর ঢেকে রাখা। নামাজে পুরুষের নাভির নিচ থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে রাখা ফরজ। মহিলাদের মুখমণ্ডল, দুই হাত কবজি পর্যন্ত ও টাখনুর নিচে পায়ের পাতা ছাড়া সব অঙ্গ ঢেকে রাখা ফরজ। তবে বিনা ওজরে পুরুষের মাথা, পেট-পিঠ, হাতের কনুই খোলা রেখে নামাজ পড়লে তা আদায় হয়ে গেলেও মাকরূহ হবে-
(ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১০৬)। ঢেকে রাখা অঙ্গগুলোর কোনো একটির এক-চতুর্থাংশ বা এর অধিক ইচ্ছাকৃত এক মুহূর্তের জন্য খুললেও নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি অনিচ্ছাকৃত এক-চতুর্থাংশ বা ততোধিক খুলে যায়, তাহলে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় খোলা থাকলে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। এক-চতুর্থাংশের কম হলে চাই ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় নামাজ নষ্ট হবে না।
যদি একাধিক জায়গায় সামান্য করে খোলা থাকে, তাহলে এর সমষ্টি ছোট একটি অঙ্গের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ হলেও নামাজ হবে না- (রদ্দুল মুহতার ১/৩৭৯, তাবয়ীনুল হাক্বায়েক্ব ১/৯৭)।
মহিলাদের চুলও সতরের অন্তর্ভুক্ত, একটি চুলের এক-চতুর্থাংশ বা ততোধিক খুলে গেলেও নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে- (তাবয়ীনুল হাক্বায়েক্ব ১/৯৭)।
অনুরূপ এত পাতলা পোশাক, যাতে বাইরে থেকে ভেতরের অঙ্গগুলোর রং দেখা যায় তা দিয়েও নামাজ শুদ্ধ হবে না- (রদ্দুল মুহতার ১/৩৮১)।
জীবজন্তুর স্পষ্ট ছবিবিশিষ্ট কাপড়ে নামাজ পড়া মাকরূহ। (হেদায়া ১/১২২)
অনেক পুরুষ নামাজের আগের তাঁদের টাখনুর কাপড় ওপরে উঠিয়ে নেন, এটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। একটি হাদিসে এসেছে, 'টাখনুর নিচের কাপড় পরিধানকারীর নামাজ কবুল হয় না।' তবে তা শুধু নামাজের সময়ের আমল নয়, যদিও নামাজের সময় এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়।
বরং পুরুষের লুঙ্গি-পায়জামা ইত্যাদি নামাজের ভেতরে-বাইরে সর্বদা টাখনুর উপর কাপড় পরিধান অপরিহার্য। হাদিস শরিফে এর প্রতি ভীষণ ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে- (সুনানে আবী দাউদ হাঃ ৬৩৮, বোখারি হাঃ ৫৭৮৭)। কেউ কেউ প্যান্ট এত নিচে পরিধান করেন যে সতরের অংশবিশেষ খুলে যায়, তাতে নিজের নামাজের তো ক্ষতি হচ্ছেই, অন্যদেরও অসুবিধা হয়।
লেখক : ফতোয়া সংকলন প্রকল্পের গবেষক
============================

প্রশ্ন : নামাজের সময় মেয়েদের সতর কী হবে?

উত্তর : মেয়েরা টাখনুর নিচ পর্যন্ত কাপড় পরবেন। কিন্তু পায়ের পাতা ঢাকতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। পায়ের পাতা ঢাকতে হলে তো মোজা পরতে হবে, আর মোজা পরে নামাজ পড়তে হবে, এ ধরনের কোনো সহিহ বর্ণনা রাসুল (সা.) দেননি।

তবে কেউ চাইলে মোজা পরতে পারেন। এককথায়, শাড়ি হোক বা কামিজ, মেয়েরা টাখনুর নিচ পর্যন্ত ঢাকবেন; কিন্তু পায়ের পাতা ঢাকার আবশ্যক নেই।

- ড. মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম।


প্রশ্ন: ২১০: নামাজে খুশু খুযু সৃষ্টির উপায়।

১। নামাজ রত অবস্থায় আল্লাহর ধ্যানে থাকবেন ।

২। পরকালকে স্মরণ করবেন। হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে দাড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে এই দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করবেন।

৩। নামাজে যা পড়ছেন, তার অর্থ শিখে নেবেন, এবং নামাজ পড়ার সময় অর্থের দিকে খেয়াল রাখবেন।

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...