প্রশ্ন: ২৪৬ : মুবাহিলার ঘটনা কি ?

মুবাহালা বা মুবাহিলার সোজা অর্থ হলো- কোন বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে, সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করার জন্যে একে অন্যের প্রতি অভিশাপ দিয়ে আল্লাহর গজব বা শাস্তি কামনা করা। অর্থাৎ যার বা যাদের উপর আল্লাহর গজব পড়বে সে বা তারা মিথ্যাবাদী। Cursing and invoking the wrath of God on each other to find the truth. নবম হিজরির জিলহাজ মাসের ২৪ তারিখ, ঐ দিন আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ ও তার পরিবার খোলা ময়দানে ইয়ামন দেশের খৃষ্টানদের সাথে মোবাহিলা করেছিলেন। মোবাহিলায় খৃষ্টানগন মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হন। অত্যাশ্চার্য এই ঘটনার সাক্ষী কোরানের দুটো আয়াত দেখা যাক-
Indeed, the example of Jesus to Allah is like that of Adam. He created Him from dust; then He said to him, “Be,” and he was. (Sura al-Imran 3, verse 59)
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন এবং তারপর তাকে বলেছিলেন হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন। (সুরা আল-ইমরান ৩, আয়াত ৫৯)
Then whoever argues with you about it after [this] knowledge has come to you – say, “Come, let us call our sons and your sons, our women and your women, ourselves and yourselves, then supplicate earnestly and invoke the curse of Allah upon the liars ” (Sura al-Imran 3, verse 61)
অতঃপর তোমার নিকট সত্য সংবাদ এসে যাওয়ার পর যদি এই কাহিনি সম্পর্কে তোমার সাথে কেউ বিবাদ করে, তাহলে বল-এসো, আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আর তারপর চল আমরা প্রার্থনা করি এবং তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি যারা মিথ্যাবাদী। (সুরা আল-ইমরান ৩, আয়াত ৬১)



নবম হিজরির শেষ দিকের ঘটনা। দিকে দিকে তখন ছড়িয়ে পড়েছে ইসলামের দাওয়াত। আরবের সব এলাকার লোক মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। শুধু একটিমাত্র এলাকার জনগণ ছাড়া সবাই মেনে নিয়েছে মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী আদর্শ ও হুকুমাত। সেটি হচ্ছে নাজরান। নাজরান হলো ইয়েমেনের অন্তর্গত এক সমৃদ্ধশালী খ্রিস্টান বসতি। সমসাময়িক খ্রিস্টবিশ্বের মিশনারি সেন্টার হিসেবে বিখ্যাত ছিল এই নাজরান। এখানকার খ্রিস্টান পাদ্রিদের জ্ঞান-গরিমা সারা খ্রিস্ট জগতে ছিল সুপরিচিত। এ নিয়ে নাজরানবাসীদের ছিল অনেক গর্ব। আরব উপদ্বীপের সকল গোত্র উপগোত্র ইসলামের দাওয়াত কবুল করলেও এই নাজরানবাসীরা তা থেকে দূরে সরে থাকে।
নবী করিম (সা.) ইসলামের দাওয়াত দিয়ে নাজরানের প্রধান বিশপ আবু হারিস বিন আলকামার কাছে একটি চিঠি লিখেন। মদীনা থেকে নবী (সা.)-এর প্রতিনিধি যথারীতি ঐ চিঠি নিয়ে নাজরানের বিশপের কাছে পৌঁছে দিলেন।
চিঠি পেয়ে একটু অবাক হলেন বিশপ। তাঁকে এবং তাঁর জনগণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে সুদূর মদীনা থেকে নবী মুহাম্মদ (সা.) চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, হয় শান্তির ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করে আনুগত্য স্বীকার করতে হবে নয়তো কর প্রদান করে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।
বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন বিশপ। একবার ভাবলেন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। তাঁদের মানমর্যাদা তো কম নেই। জ্ঞান-গরিমায় গোটা খ্রিস্ট জগতে নাজরানবাসীরা অতুলনীয়। প্রয়োজন হলে সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু পরক্ষণে আবার ভাবলেন হুট করে বোকার মতো কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। মদীনার শাসনকর্তা সত্যিই যদি আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর আহ্বান অমান্য করার পরিণতি অবশ্যই মারাত্মক হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণীদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করলেন তিনি।
অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো নাজরান থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হবে মদীনায়। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে নবী করিম (সা.) সত্যিই আল্লাহর নবী কিনা।
ষাটজন শিক্ষিত ও জ্ঞানী খ্রিস্টানকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হলো। এদের নেতৃত্ব দানের জন্য নির্বাচিত হলেন তিনজন বিশিষ্ট পাদ্রি। এরা হলেন নাজরানের প্রধান বিশপ আবু হারিস বিন আলকামা, মহাজ্ঞানী আবদুল মসিহ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইহাম।
এই তিনজনের নেতৃত্বে নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মদীনায় পৌঁছেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন জাঁকজমক দেখিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁরা অবাক করে দেবেন। এই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিদল নিজেদের ভ্রমণজনিত মলিন পোশাক পরিধান করলেন। তারপর আঙ্গুলে সোনার আংটি ও গলায় ঝলমলে ক্রুশ ঝুলিয়ে বেশ আড়ম্বরের সাথে মহানবী (সা.)-এর সাথে দেখা করতে চাইলেন। মসজিদে গিয়ে তাঁরা নবী করিম (সা.)-কে অভিবাদন জানালেন।
কিন্তু মহানবী (সা.) তাদেরকে একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কোন কথা বললেন না। এতে প্রতিনিধিদলে নেতৃবৃন্দ দারুণ অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী কিছুই বুঝতে পারলেন না। অপ্রস্তুত অবস্থায় মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন। নবী (সা.) স্বয়ং চিঠি দিয়ে তাঁদেরকে ডেকে এনেছেন আর এখন কী আচরণ করলেন! মনে মনে যেমন ক্ষুব্ধ হলেন তাঁরা তেমনি চিন্তিতও হলেন। নেতৃবৃন্দ অবশেষে তাঁদের পূর্ব পরিচিত হযরত ওসমান এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের সাথে দেখা করলেন। তাঁদের কাছে অভিযোগ করে খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দ বললেন, ‘এ কেমন ব্যবহার হলো। এভাবে অপমান করার জন্যই কি আপনাদের নেতা আমাদেরকে এখানে ডেকে এনেছেন?’
প্রথমে কিছু বুঝতে না পেরে হযরত ওসমান এবং হযরত আবদুর রহমান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। খ্রিস্টানরা ব্যাপারটা খুলে বলতেই তাঁরা দু’জনই বেশ অবাক হয়ে গেলেন। নবী (সা.)-এর এই আচরণের রহস্য তাঁরা বুঝতে পারলেন না।
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এ রকম ব্যবহার করলেন কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না’- এভাবে তাঁরা মন্তব্য করতে লাগলেন।
‘তাহলে এখন কী করব?’ প্রধান বিশপ বললেন, ‘আমরা কি ফিরে যাব?’
হযরত ওসমান বললেন, ‘এক কাজ করুন। আপনারা তাড়াতাড়ি আমাদের ভাই আলী বিন আবি তালিবের কাছে চলুন। তিনি এ ব্যাপারে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।’
কথামতো তাঁরা সবাই হযরত আলী (আ.)-এর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। সব শুনে হযরত আলী বললেন, ‘প্রথমেই তো ভুল করেছেন আপনারা। রেশমি পোশাক আর সোনার আংটি পরে আল্লাহর নবীর কাছে এসেছেন। এ কারণেই তিনি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। এগুলো খুলে ফেলে সাধারণ ভদ্রোচিত পোশাক পরে আপনারা হযরতের সাথে দেখা করুন। তাহলেই তিনি আপনাদের সাদরে গ্রহণ করবেন।’
হযরত আলীর পরামর্শ অনুযায়ী খ্রিস্টান প্রতিনিধিরা নিজেদের বিলাসী বেশভূষা ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরে নবীজীর সাথে দেখা করতে গেলেন। এবার নবী করিম (সা.) তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে নিজের পাশে বসালেন। তারপর সাহাবাদের উদ্দেশে বললেন, ‘যিনি আমাকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন সেই প্রভু আল্লাহর শপথ, প্রথমবার তাঁরা যখন এসেছিলেন তখন তাঁদের সাথে ছিল শয়তান।’
এরপর মহানবী (সা.) প্রতিনিধিদলকে কিছু ধর্মোপদেশ দান করলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানালেন। প্রতিনিধি দল বললেন, ‘মহান এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসই যদি ইসলাম হয় তাহলে আমরাও তো তাঁকে বিশ্বাস করি।’
নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আপনাদের কিছু কার্যকলাপই প্রমাণ করে আপনারা ইসলামে বিশ্বাসী নন। আপনারা ক্রুসের পূজা করেন, শুকরের গোশত খান আর আল্লাহর ছেলে রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। তাহলে কিভাবে তাওহীদী আদর্শে বিশ্বাসী হলেন আপনারা?’
খ্রিস্টানরা বললেন, ‘আমরা হযরত ঈসা (আ.)-কে খোদা বলে বিশ্বাস করি। কারণ, তিনি মৃতকে জীবন দান করেছেন, রোগীকে আরোগ্য দান করেছেন এবং এমনকি কাদামাটির তৈরি পাখির দেহেও জীবন দিয়েছেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয় তিনি খোদা।’
নবী (সা.) বললেন, ‘কখনো নয়। তিনি তো একজন আল্লাহর বান্দা মাত্র। হযরত মারইয়াম (আ.)-এর গর্ভে আল্লাহ তাআলা তাঁকে রেখেছিলেন। আল্লাহই তাঁকে সব ক্ষমতা ও শক্তি দান করেছিলেন।’
প্রতিনিধি দল বলে উঠলেন, ‘অবশ্যই হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র। কারণ, কোন পিতা ছাড়াই কুমারী বিবি মারইয়ামের গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিল।’
ঠিক এই সময় মহানবী (সা.)-এর কাছে আল্লাহর ওহী নাযিল করেন। হযরত (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, ‘হযরত ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারটা হযরত আদম (আ.)-এর মতো। হযরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা কোন পিতামাতা ছাড়াই কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। পিতা ছাড়া জন্ম গ্রহণ করলে যদি আল্লাহর পুত্র হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে হযরত আদমই তো তার অধিক যোগ্য। কারণ, তিনি পিতা এবং মাতা উভয় ছাড়াই জন্ম গ্রহণ করেছেন।’
নবী (সা.)-এর এ রকম অকাট্য যুক্তি শুনে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন তাঁরা। কি জবাব দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। পরক্ষণে পাদ্রিরা চিন্তা করলেন, এভাবে পরাজয় স্বীকার করা চরম লজ্জাকর ব্যাপার। খ্রিস্টসমাজে তাঁরা মুখ দেখাবেন কী করে। তাই নবীজীর যুক্তিকে সরাসরি অস্বীকার করে তাঁরা বললেন, ‘আমরা আপনার যুক্তি মানি না। আপনার ব্যাখ্যা আমাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।’
মহানবী (সা.) খ্রিস্টান পাদ্রিদের কথা শুনে অবাক হলেন। যারা যুক্তি মানতে চায় না তাদেরকে বুঝানো তো খুবই মুশকিল। ঠিক এমনি সময় আল্লাহর প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হলো। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা খ্রিস্টানদের এই ধৃষ্টতার চ্যালেঞ্জ করে বললেন, ‘হে নবী! আপনার কাছে সুস্পষ্ট জ্ঞান আসার পরেও কেউ যদি তর্ক করে তাহলে (তাদেরকে) বলে দিন, এসো একত্র হই আমাদের সন্তানদের আর তোমাদের সন্তানদের নিয়ে, আমাদের নারীদের আর তোমাদের নারীদের নিয়ে আর আমাদের নিজেদের নিয়ে আর তোমাদের নিজেদের নিয়ে। তারপর প্রার্থনা জানাই একান্ত মনে এবং আল্লাহর অভিশাপ কামনা করি তাদের ওপর যারা মিথ্যাবাদী।’ (আলে ইমরান : ৬১)
আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে নবী (সা.) খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা যদি কোন যুক্তিই স্বীকার করতে না চান তাহলে আসুন মোবাহালা (অভিসম্পাত) করি। তাহলেই কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী তার ফয়সালা হয়ে যাবে।’
মোবাহালা হলো দুই পক্ষের মধ্যে কোন সত্য বিষয় নিষ্পন্নের উদ্দেশ্যে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে পরস্পর পরস্পরের জন্য অভিশাপ প্রার্থনা করা। এতে যে পক্ষ মিথ্যাবাদী সেই পক্ষের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়।
নবী করিম (সা.) শেষ পর্যন্ত মোবাহালার আহ্বান জানালে খ্রিস্টানরা ভড়কে গেল। পাদ্রিরা জানতেন যে, হযরত ইবরাহীমের পুত্র হযরত ইসমাইলের বংশে একজন মহানবীর আবির্ভাব ঘটবে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে সেই নবী তারও কিছুটা আভাস তাঁরা পেয়েছিলেন। তবু জিদের বশে তাঁরা নিজেদের আভিজাত্য ও বংশমর্যাদা ছেড়ে অন্য কারো আনুগত্য স্বীকারে রাজি ছিলেন না। এখন মোবাহালায় অংশ না নিলে মান-সম্মান বজায় থাকে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাহালায় অংশগ্রহণ করতে রাজি হলেন। ঠিক হলো পরদিন শহরের বাইরে মরুভূমির এক নির্দিষ্ট স্থানে এই মোবাহালা অনুষ্ঠিত হবে।
মোবাহালার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মদীনার সর্বসাধারণের মাঝে একটা উত্তেজনা জেগে উঠল। খ্রিস্টান জনগণ ভাবল এবার মুসলমানদের দফা রফা হবে। এখন খোদ নাজরানের নেতৃস্থানীয় লোকদের মোকাবেলা করতে হবে নবী করিম (সা.)-কে। মদীনার ইহুদিরা তো বেশ আনন্দিত হলো এই ভেবে যে, এবার মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে লড়াই হবে। মুসলমানরা ভালো করেই জব্দ হবে। মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে খ্রিস্টানরা নাজেহাল হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তবে খ্রিস্টানরা জয়ী হলে তাদের লাভ। সুদী ব্যবসায় কেউ তাদের বাধা দেবে না। অপরদিকে মদীনার মুসলমানদের মাঝে চরম এক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা গুমরে মরছে। না জানি কী হয়। মনে মনে তারা প্রার্থনা করছে- হে আল্লাহ! আমাদের মুখ উজ্জ্বল কর, নাসারাদের হাতে মুসলমানদের অপদস্থ কর না। আমাদের প্রিয় নবীকে তুমি জয়যুক্ত কর। হে প্রভু! দীন ইসলামের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত কর।’
পরদিন যথাসময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) মোবাহালার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী নিজেদের সন্তান হিসাবে ইমাম হাসান (আ.) ও হোসাইন (আ.)-কে, নিজেদের নারী হিসাবে হযরত ফাতেমা (আ.)-কে এবং নিজেদের সত্তা হিসাবে হযরত আলী (আ.)-কে সঙ্গে নিলেন। তারপর দু’হাত তুলে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! এরাই আমার পরিজন, আহলে বাইত, এদেরকে তুমি কবুল কর।’
পরিবারের আর কাউকে তিনি সঙ্গে নিলেন না, শুধু চারজনকে নিয়ে রওয়ানা হলেন মোবাহালার উদ্দেশ্যে। নবী করিম (সা.) ইমাম হাসানকে একহাতে ধরলেন, ইমাম হোসাইনকে বুকে তুলে নিলেন। তাঁর পিছনে নিলেন হযরত ফাতেমা (আ.)-কে। তাঁর পিছনে থাকতে বললেন হযরত আলী (আ.)-কে। সবাইকে বলে দিলেন, “আমি যখন দোয়া শুরু করব তখন তোমরা সবাই ‘আমীন, আমীন’ বলবে।”
এদিকে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মাঝে এক নিদারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতটুকু আত্মবিশ্বাসও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। হুট করে মোবাহালায় রাজি হয়ে যাওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। সত্যিই যদি মুহাম্মাদ (সা.) নবী হয়ে থাকেন তাহলে তো মোবাহালায় খ্রিস্টানদের ধ্বংস অনিবার্য। এই আশঙ্কাজনক অবস্থায় পাদ্রিরা নবী (সা.)-কে তাঁর সাথিদের নিয়ে আসতে দেখলেন। নবী ও তাঁর আহলে বাইতের সদস্যদের চেহারা দেখেই পাদ্রিরা ভড়কে গেলেন। তাঁদের চেহারায় কী যেন এক নূরানী দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্বর্গীয় সুষমায় দীপ্তিমান তাঁদের মুখম-ল। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান আহলে বাইতের অবয়ব জুড়ে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। নবী করিম (সা.)-এর চেহারা মুবারকে অপূর্ব স্বর্গীয় আভা। তাঁর গভীর প্রশান্ত দৃষ্টিপাতে ম্লান হয়ে যায় অন্য সব অভিব্যক্তি।
দৃপ্ত, অকুতোভয় নবী (সা.) ও তাঁর সাথিদের দেখে বাস্তবিকই কম্পন শুরু হয়ে গেল খ্রিস্টান পাদ্রিদের। প্রধান পাদ্রি তাঁর সাথিদের উদ্দেশ্যে বললেন : ‘তাঁদের চেহারা দেখেছ? কেমন নির্ভীক আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান। কেমন যেন স্বর্গীয় দ্যুতি চমকাচ্ছে তাঁদের অবয়ব জুড়ে। আমার তো মনে হয় তাঁরা যদি আল্লাহর কাছে এই বিশাল পর্বতটাও স্থানচ্যুত হয়ে চলে আসতে প্রার্থনা করেন তাহলে তাই কবুল হয়ে যাবে। ইনি সত্যি নবী না হলে এ রকম দৃঢ় আস্থার সাথে অতি আপনজনদের নিয়ে মোবাহালা করার জন্য এগিয়ে আসতেন না। আমাদের উচিত অবিলম্বে মুহাম্মাদের সাথে আপোস করা। অন্যথায় মোবাহালার মাধ্যমে খ্রিস্টান জাতির অস্তিত্বও দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।’

অন্য পাদ্রিরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। উপায়ান্ত না দেখে প্রধান পাদ্রির সাথে একমত হলেন। তাঁরা সকল পাদ্রি একযোগে নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট এসে করজোড়ে বললেন, ‘জনাব! বেয়াদবি হয়ে গেছে, আমাদের মাফ করে দিন। মোবাহালা থেকে আমাদের অব্যাহতি দিন। এর বদলে আপনার দেয়া সকল শর্ত মানতে আমরা রাজি আছি।’

নবী (সা.) মৃদু হেসে বললেন, ‘তাহলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন না কেন?’

পাদ্রিরা বললেন, ‘জানি আপনি সত্যিই নবী। তবে এই মুহূর্তে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে আমাদেরকে রেহাই দিন। অন্য যে কোন শর্ত মানতে আমরা রাজি আছি।’

খ্রিস্টানদের এ রকম হঠাৎ নতি স্বীকারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মুসলমানরা খুশিতে আত্মহারা হলো। আল্লাহ তাআলার দরবারে তারা অশেষ ধন্যবাদ জানাল। দুনিয়ার বুকে মুসলমানদের মুখ আজ উজ্জ্বল হয়েছে। ইসলাম যে একমাত্র আল্লাহর মনোনীত ধর্ম তা আবারো সকলের সামনে প্রমাণিত হয়েছে। অন্য সকল ধর্মের ওপর বিজয় লাভ করেছে ইসলাম। তাই এই দিনটি হয়ে উঠল মুসলমানদের জন্য একটি খুশির দিন।

এ দিন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফির-মুশরিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে ইসলাম ধর্মের সত্যতাকে জগৎবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে এ এক মহা বিজয়ের দিন। তাছাড়া এই ঘটনার মাধ্যমে নবী করিম (সা.)-এর প্রকৃত আপনজন বা আহলে বাইত কারা তাও মুসলমানদের মাঝে চিহ্নিত হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট নির্দেশেই তিনি পবিত্র পাঁচজনকে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন।

যাহোক, শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ জিজিয়া (কর) ধার্যের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের অব্যাহতি দেয়া হয়। নিয়মিত এই কর প্রদানের মাধ্যমে তারা ইসলামী রাষ্ট্রে নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা গ্রহণ করে।

Reference Books :

The Message. JAFAR SUBHAN p. 727-735 (Published by Bathat Foundation I.R. of Iran.)
ALI THE MAGNIFICENT YOSUF LALJEE. p. 71-74 (Safagh Publictions I.R. of Iran)
FATIMA THE GRACIOUS. Odeh A. Muhawesh. Safaqh Publication p. 119-121.
BUKHARI SHaRIF-BENGALI TRANSLTION BY AZIZUL HAQUE. Vol. 4. p. 392-397.

প্রশ্ন: ২৪৫ : চোখ বন্ধ করে নামাজ পড়া যাবে কি ?


নামাজে চোখ বন্ধ করা নবীজি ﷺ এর সুন্নাহয় নেই; বরং তিনি যখন নামাজে দাঁড়াতেন, আল্লাহ্‌র সামনে গভীর বিনয়ে মাথা নিচু রাখতেন আর দৃষ্টি সিজদার স্থানে রাখতেন। ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, যখন কেউ তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করে তখন তার ভালোবাসার একটি বহিঃপ্রকাশ হল সে লজ্জা আর শ্রদ্ধায় মাথা নিচু রাখে এবং আমাদেরও ঠিক এই রকম হতে হবে। রাসূল ﷺ বলেন,

فإذا صليتم فلا تلتفتوا فإن الله ينصب وجهه لوجه عبده في صلاته ما لم يلتفت

যখন কেউ নামাজে দাঁড়াবে, সে যেন এদিক সেদিক না তাকায়, কারণ আল্লাহ তখন তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখেন যতক্ষণ না সে এদিক সেদিক তাকায়। (তিরমিযি)

বাদায়ে’গ্রন্থে এসেছে,

وَيُكْرهُ أَنْ يُغْمِضَ عَيْنَيْهِ فِي الصَّلَاةِ؛ لِمَا رُوِيَ عَنْ النَّبِيِّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – أَنَّهُ نَهَى عَنْ تَغْمِيضِ الْعَيْنِ فِي الصَّلَاةِ؛ وَلِأَنَّ السُّنَّةَ أَنْ يَرْمِيَ بِبَصَرِهِ إلَى مَوْضِعِ سُجُودِهِ وَفِي التَّغْمِيضِ تَرْكُ هَذِهِ السُّنَّةِ؛

চোখ বন্ধ করে নামায পড়া মাকরূহ। কেননা রাসূল ﷺ চোখ বন্ধ করে নামাজ পড়া থেকে নিষেধ করেছেন। আর সুন্নাত হল, সেজদার স্থানের দিকে তাকিয়ে নামায পড়া। চোখ বন্ধ রাখলে এই সুন্নাত তরক হয়ে যায়। (বাদায়ে’ ১/২১৬)

তবে যদি চোখ খোলা রেখে কিছুতেই খুশুখুজু (একাগ্রতা) না আসে তাহলে মাঝে মাঝে চোখ একটু বন্ধ করা যাবে। (রাদদুল মুহতার ১/৬৪৫ আলমুগনী ২/৩০)


والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী

প্রশ্ন: ২৪৪ : জামাতে ১,২,৩বা ৪ রাকাত ছুটে গেলে কী করবেন?

যে মুক্তাদি (মুসল্লি) ইমামের সাথে এক বা একাধিক রাকাত পায়নি তাকে মাসবুক বলে।
মাসবুক ইমামের সাথে শেষ বৈঠকে তাশাহুদ (আত্তাহিয়্যাতু) এমন ধীরে ধীরে পড়বে যেন তার তাশাহুদ শেষ হতে হতে ইমামের দুরূদ ও দোয়ায়ে মাছুরা শেষ হয়ে যায়। মাসবুকের তাশাহুদ যদি আগেই শেষ হয়ে যায় তাহলে সে চুপচাপ বসে থাকতে পারে। (ফতওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ ৩/৩৮২,ফতওয়ায়ে শামী ২/২২০)
ইমাম সেজদায়ে সাহু দিলে মাসবুকও সেজদায়ে সাহু করবে তবে সেজদায়ে সাহুর পর সালাম ফিরাবে না। ভুলে যদি সালাম ফিরিয়ে দেয় তাহলে আবার সেজদায়ে সাহু করতে হবে। (ফতওয়ায়ে আল বাহরুর রায়েক-২/১৭৬,ফতওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ-৩/৩৭৯)

ইমামের উভয় দিকে সালাম ফিরানোর সামান্য পর মাসবুক তার অবশিষ্ট নামাজ পড়ার জন্য আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাঁড়াবে। একদিকে সালাম ফিরানোর সাথে সাথে মাসবুকের উঠে দাঁড়ানো উচিত নয় কারন এতে সে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে । যেমনঃ ইমাম সাহেব নামাজের মধ্যে ভুল বশত কোন ওয়াজিব ত্বরক (ছুটে গেলে) করলে ইমাম সাহেবের ওপর সাহু সেজদা ওয়াজিব এমতাবস্থায় আপনি যদি একদিকে সালাম ফিরানোর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যান তাহলে আপনি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। হয়ত আপনি ইমাম সাহেবের দ্বিতীয় সালাম শুরু করলে তখন উঠে দাড়াতে পারেন। 

মাসবুক অবশিষ্ট নামাজ পড়ার জন্য উঠে প্রথমে ছানা,আউযুবিল্লাহ্ ও বিসমিল্লাহ্ পড়বে। এরপর কেরাত মিলানো রাকাতগুলো পড়বে। পরিশেষে কেরাত বিহীন রাকাত পড়ে নিবে।
মাছবূকের এক রাকাআত ছুটে গেলে তা কিভাবে পড়বে :
ইমাম উভয় সালাম ফিরানোর পর মাছবূক আল্লাহু আকবার বলে উঠবে, ছানা পড়বে, আউযুবিল্লাহ বিসমিল্লাহ সহ সূরা ফাতিহা পড়বে, তারপর বিসমিল্লাহ সহ সূরা মিলাবে এবং রুকু সাজদা ও বৈঠক করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে।
মাছবূক দুই রাকাআত ছুটে গেলে তা কিভাবে পড়বে :
ইমাম উভয় সালাম ফিরানোর পর মাছবূক আল্লাহু আকবার বলে উঠবে এবং পূর্ব বর্ণিত নিয়মে প্রথম রাকাআত আদায় করবে।তিন রাকাত বিশিষ্ট নামাজ হলে বৈঠক করে (বৈঠকে শুধু তাশাহ্হুদ পড়তে হবে) আর চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ হলে বৈঠক না করেই দ্বিতীয় রাকাতের জন্য উঠবে। এ রাকাতে ছানা ব্যতীত এবং শুধু বিসমিল্লাহ সহ সূরা ফাতিহা ও সূরা/কিরাত মিলিয়ে শুধু সাজদা ও বৈঠক কের সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে।
মাসবূক তিন রাকাত ছুটে গেলে কিভাবে পড়বে:
মাছবূক যদি ইমামের সাথে এক রাকাত পায় এবং তিন রাকাত না পায়, অর্থাৎ,শুধুমাত্র চতুর্থ রাকায়াত পায় তাহলে ইমামের উভয় সালাম ফিরানোর পর উঠে পূববর্তী নিয়মে প্রথম রাকাত পড়বে এবং বৈঠক করে দ্বিতীয রাকাতের জন্য উঠবে। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা/কিরাত মিলাতে হবে এবং বৈঠক না করেই তৃতীয় রাকাতের জন্য উঠবে।তৃতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে কোন সূরা/কিরাত মিলাতে হবে না।
মাসবুক কোন রাকাত না পেলে কিভাবে পড়বঃ
মাছবূক যদি কোন রাকাত না পায় শুধু শেষ বেঠকে এসে শরিক হয়, তাহলে ইমামের উভয় সালাম ফিরানোর পর উঠে একাকি যেভাবে নামাজ পড়া হয় সেভাবে পূণ নামাজ আদায় হবে।

প্রশ্ন: ২৪৩ : জুমআর নামাজ কত রাকায়াত ?

 হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার নামাজ আদায় করবে সে যেন এরপর চার রাকাত আদায় করে।’ (মুসলিম : ২০৭৫, তিরমিজি : ৫২৩)
জুমার ফরজ নামাজ : জোহরের ফরজ নামাজ চার রাকাত হলেও জুমার হলো দুই রাকাত। অবশ্য এর আগে দুইটি খুতবা রয়েছে, যা দুই রাকাত নামাজের স্থলাভিষিক্ত। (আল-মুসান্নাফ লি ইবনে আবি শাইবা : ৫৩৬৭, ৫৩৭৪)। এজন্য খুতবার সময় উপস্থিত থাকা এবং তা শোনার প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। জুমার ফরজ নামাজ দুই রাকাত প্রসঙ্গে হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘জুমার নামাজ দুই রাকাত, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা এবং সফরের নামাজ দুই রাকাত। এটাই পূর্ণ সংখ্যা, অসম্পূর্ণ নয়। এ বিধান স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মুখ নিসৃত।’ (নাসাঈ : ১৮৯৪, ইবনে মাজাহ : ১০৬৩)।
জুমার আগে ও পরের সুন্নত নামাজ : জুমার আগে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যা রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তবে জুমার পরের চার রাকাত সুন্নতের সঙ্গে আরও দুই রাকাত নামাজ পড়া উত্তম।
হজরত আলী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে চার রাকাত এবং জুমার নামাজের পর চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন। চার রাকাত শেষে সালাম ফেরাতেন।’ (আল-মুজামুল আওসাত : ১৬১৭)।
এ হাদিসের সনদের সব রাবি পরিচিত, প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আস-সাহমি সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি তুললেও ইমাম ইবনে আদি তার আল-কামিল কিতাবে বলেছেন, ‘এ রাবির ব্যাপারে অসুবিধার কিছু নেই।’ (আল-কামিল : ১৯১-১৯২)। ইমাম ইবনে হিব্বান তাকে নির্ভরযোগ্য রাবির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (কিতাবুস সিকাত : ৭২)। এ বিষয়ে আরও বর্ণনা রয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন।’ (আল-মুজামুল আওসাত : ৩৯৫৯, নাসবুর রায়াহ : ২৪৮)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে একসঙ্গে চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন।’ (সুনানু ইবনে মাজাহ : ১১২৯)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার নামাজ আদায় করবে সে যেন এরপর চার রাকাত আদায় করে।’ (মুসলিম : ২০৭৫, তিরমিজি : ৫২৩)। হজরত সালেম (রা.) তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার পর দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (মুসলিম : ২০৭৮, তিরমিজি : ৫২১)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পর চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (তিরমিজি : ৫২৩, মুসান্নাফু আব্দির রাজ্জাক : ৫৫২৪)।
হজরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পর চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন। আবু ইসহাক বলেন, হজরত আলী (রা.) জুমার পর ছয় রাকাত নামাজ আদায় করতেন। আবদুর রাজ্জাক এটিই গ্রহণ করেছেন। (মুসান্নাফ আব্দির রাজ্জাক : ৫৫২৪)। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জুমার পর ছয় রাকাত নামাজ আদায় করা উচিত।’ (শারহু মায়ানিল আসার : ৯৫)।
জুমার দিনের নফল নামাজ : জুমার দিন আগে আগে মসজিদে যাওয়া উচিত এবং সাধ্যমতো বিভিন্ন নফল নামাজ আদায় করা উচিত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা এসে হাজির হন। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা সর্বাগ্রে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। প্রথম ভাগে যারা মসজিদে প্রবেশ করে তাদের জন্য উট, দ্বিতীয় ভাগে যারা আসে তাদের জন্য গরু, তৃতীয় ভাগে যারা আসে তাদের জন্য ছাগল, চতুর্থ ভাগে যারা আসে তাদের জন্য মুরগি ও সর্বশেষ পঞ্চম ভাগে যারা আসে তাদের জন্য ডিম কোরবানি বা দান করার সমান সওয়াব লেখেন।
আর যখন ইমাম খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে পড়েন তখন ফেরেশতারা তাদের এ খাতা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যান।’ (বোখারি: ৯২৯, মুসলিম : ২০২১)। হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোনো পুরুষ জুমার দিন যদি গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে অথবা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে অতঃপর জুমার নামাজে যায় ও বসার জন্য দুই জনকে আলাদা করে না এরপর যথাসাধ্য নামাজ পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলেন তখন চুপ থাকে, তাহলে তার অন্য জুমা পর্যন্ত গোনাহ মাফ করা হয়।’ (বোখারি : ৮৪৩)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে অতঃপর জুমার নামাজে যায়, এরপর যথাসাধ্য নামাজ পড়ে খুতবা শুনতে চুপ থাকে যতক্ষণ না ইমাম খুতবা শেষ করেন। এরপর তার সঙ্গে নামাজ পড়ে। তার দুই জুমার মধ্যবর্তী সাত দিনের সঙ্গে আরও তিন দিনসহ ১০ দিনের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (মুসলিম : ২০২৪)। এসব হাদিস থেকে বোঝা যায়, জুমার দিন তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়া উচিত এবং শুধু নির্ধারিত চার রাকাত নামাজ আদায় করা নয় বরং তাহিয়াতুল অজু দুই রাকাত ও তাহিয়াতুল মসজিদ দুই রাকাতসহ সাধ্যমতো বিভিন্ন নফল নামাজ আদায় করা উচিত। আরও বোঝা গেল, খুতবার সময় কোনো নামাজ নেই।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রশ্ন:২৪২: বিয়ে করা কি সুন্নাত না ফরজ ।

ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে রয়েছে বিষদ বর্ণনা। সাধারণত বিয়েকে ইসলাম উৎসাহিত করে তথাপি অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতার উপর ভিত্তি করে এটি কোন কোন ব্যক্তির জন্য ফরজ হয়, কারও জন্য মুস্তাহাব, কারও জন্য শুধুই হালাল এমনকি কারও কারও জন্য হারামও হয়ে থাকে।
বিয়ে বা নিকাহ করা সুন্নত। কেহ বলেন মুস্তাহাব। তবে অবস্থা ভেদে বা শ্রেণিভেদে বিবাহ চার প্রকার। যথা- ১. ফরজ বা বাধ্যতামূলক ২. মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় ৩. হালাল বা বৈধ ৪. হারাম বা নিষিদ্ধ।
বিবাহ তখনই ফরজ বা বাধ্যতামূলক হয় যখন একজন ব্যক্তি (নারী ও পুরুষ) তীব্র যৌন চাহিদা অনুভব করে এবং তার দ্বারা ব্যভিচার ঘটে যাবার আশংকা থাকে। যেহেতু ব্যভিচার থেকে দূরে থাকা ফরজ এবং বিবাহই একমাত্র এই চাহিদা পূরণের বৈধ পন্থা, সেহেতু ঐ ব্যক্তির জন্য বিবাহ ফরজ। এক্ষেত্রে ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতিটি হলো, “যদি একটি ফরজ কাজ অন্য একটি কাজ ব্যতীত আদায় সম্ভব না হয় তবে ঐ সহায়ক কাজটিও মূল ফরজের মতোই ফরজ হিসেবে গণ্য হবে।”

যদি কোন ব্যক্তির যৌন চাহিদা খুব তীব্র না হয় এবং তার দ্বারা ব্যভিচার সংঘটিত হবার সম্ভাবনা না থাকে কিন্তু বিবাহ করার সবরকম সামর্থ্য ও সুযোগ তার থাকে এমতাবস্থায় বিবাহ তার জন্য মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় কাজ।
কারণ এটির দ্বারা সে রাসূল (স.) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতকে অনুসরণ করছে। একজন ব্যক্তির বিবাহ করার মতো ন্যূনতম অর্থনৈতিক সামর্থ্য যদি না থাকে (মোহরানা আদায় ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণ স্বামীর জন্য ফরজ) এবং এভাবে সে যদি বিবাহের দায়িত্বসমূহ পালনে অসমর্থ হয় কিন্তু বিবাহের তীব্র প্রয়োজন অনুভব করে, সেক্ষেত্রে বিবাহ করা তার জন্য হালাল (Permitted) এই শর্তে যে- সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী সৎপন্থায় উপার্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং ভাবী স্ত্রীকে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দান করবে।
সত্য গোপন করা প্রতারণার সামিল। আল্লাহ এরূপ অভাবী ব্যক্তিকে সাহায্য করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম সমাজের দায়িত্ব হলো ঐ ব্যক্তিকে আত্মনির্ভরশীল হবার পূর্ব পর্যন্ত সাহায্য করা।
কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে ব্যক্তিটি সৎভাবে উপার্জনের কোন পথই পাচ্ছে না এবং বৈবাহিক দায়িত্ব (অর্থনৈতিক) পালনের কোন উপায়ই তার সম্মুখে খোলা নেই, এমতাবস্থায় ঐ ব্যক্তিকে রোযা ও অন্যান্য সংযম সাধনের (Acts of sublimation) মাধ্যমে নিজেকে দমনের চেষ্টা চালাতে হবে।
যদি কোন ব্যক্তি মনে করে যে তার দ্বারা বিবাহের আবশ্যক (ফরজ) দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা সম্ভবপর নয় এবং তার ব্যভিচারে লিপ্ত হবার সম্ভাবনাও নেই, তখন ঐ ব্যক্তির জন্য বিবাহ হারাম বা নিষিদ্ধ।
শেখ সাদী (রহঃ) বলেছেন, "একজন দ্বীনহীন মহিলা বা পুরুষের সাথে জীবন-যাপন করার চেয়ে, একজন বিষধর সাপের সাথে থাকা উত্তম। তাতে হয়তো সাপ তোমার ইহকালীন জীবন ধ্বংস করে দিবে, কিন্তু দ্বীনহীন মহিলা বা পুরুষ তো তোমার ইহকালীন এবং পরকালীন উভয় জীবনকেই ধ্বংস করে দিবে।"-সময়
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

প্রশ্ন: ২৪১ : নামাজে কুরআন দেখে পড়া যাবে কিনা ?

উত্তর দেওয়া হয়েছে দেখুন। 

প্রশ্ন: ২৪০ : আমার কাপড় টাকনুর উপরে থাকে কিন্তু অপর দিকে নাভির নিচে থকলে কি গোনাহ হবে?

পুরুষের সতর হচ্ছে নাভী হ’তে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত (ছহীহ জামেউছ ছাগীর হা/৫৫৮৩ইরওয়াউল গালীল হা/২৭১)। তাই নাভী ও হাঁটু সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং নাভীর নিচ থেকে হাঁটুর উপর সতর (আলমুগনী /৪১৪নববীআলমাজমূ‘ /১৭৩)। এ অংশ সর্বদা ঢেকে রাখা ওয়াজিব। আর নাভীর নীচে কাপড় পরে অন্য কাপড় দ্বারা ঢেকে দিলেও তা সতর ঢাকা হিসাবেই গণ্য হবে।

প্রশ্ন: ২৩৯ : নামাজরত অবস্থায় হাচি ও হাই আসলে কি করনীয়

প্রশ্ন: নামাজ রত অবস্থায় হাঁচি আসলে 'আলহামদু লিল্লাহ' আর হাই আসলে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বা ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়ত্বানির রাজীম’ পাঠ করা জায়েয কি?
উত্তর:
💠 নামাজ রত অবস্থায় হাঁচি আসলে অধিক বিশুদ্ধ মতে 'আলহামদু লিল্লাহ' পাঠ করা জায়েজ আছে।
এ ব্যাপারে হাদিস হল:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا عَطَسَ أَحَدُكُمْ فَلْيَقُلْ: الحَمْدُ لِلَّهِ
“তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন আলহামদুলিল্লাহ বলে।”
(সহিহুল বুখারী, হাদিস নং-৬২২৪)
এখানে সাধারণভাবে যে কোনো সময় হাঁচি আসলে ‘আল হামদু লিল্লাহ’ পাঠ করার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশেষভাবে সালাত রত অবস্থায় আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করার কথা নিম্নোক্ত হাদিসদ্বারা প্রমাণিত:
রিফাআ ইবনে রাফি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন: আমি একবার রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে সালাত করছিলাম। তখন আমার হাঁচি এলো। আমি বললামঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ مُبَارَكًا عَلَيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى
“আল্লাহর জন্য পবিত্র ও বরকতময় অনেক অনেক প্রশংসা-যেভাবে প্রশংসা করলে আমাদের প্রতিপালক পছন্দ করবেন এবং সন্তুষ্ট হবেন।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষে ফিরে বললেন: সালাতে কে কথা বলছিল?
কিন্তু কেউ উত্তর দিলেন না।
দ্বিতীয়বার তিনি বললেনঃ সালাতে কে কথা বলছিল? কিন্তু কেউ উত্তর দিলেন না।
পরে তৃতীয়বার তিনি বললেনঃ সালাতে কে কথা বলছিল?
তখন রিফাআ ইবনু রাফি ইবনু আফরা বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি কথা বলছিলাম।
তিনি বললেনঃ কী বলছিলে?
তিনি বললেন, আমি বলছিলামঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ مُبَارَكًا عَلَيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ
"সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, ত্রিশেরও অধিক ফেরেশতা দৌড়ে এসেছেন কে আগে এর সওয়াব উঠিয়ে নিতে পারন।" (সহিহ আবু দাউদ ৭৪৭, মিশকাত ৯৯২, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৪০৪ [আল মাদানী প্রকাশনী])
এই বিষয়ে আনাস, ওয়াইল ইবনু হুজর ও আমির ইবনু রাবীআ রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে।
ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ এই হাদীসটি নফল সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
(সূনান তিরমিজী (ইফাঃ) / অধ্যায়ঃ ২/ সালাত (নামায) (كتاب الصلاة) পরিচ্ছদঃ সালাতে হাঁচি আসলে করণীয়)
তবে মুহাক্কিক আলমগণ বলেন, যে কোনো সালাতেই হাঁচি আসলে আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করা যাবে-চাই তা ফরয, সুন্নত বা নফল যাই হোক না কেন। এ পক্ষেই মত ব্যক্ত করেছেন, অধিকাংশ সাহাবী, তাবেঈ এবং ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমদ প্রমুখ ইমামগণ।
তবে তা চুপি স্বরে অথবা এমনভাবে পড়া উচিৎ যে, সে যেন নিজের কানে শুনতে পায়। কিন্তু জামাআতে সালাত পড়ার সময় এতটা উঁচু আওয়াজে বলবে না যে, অন্যান্য মুসল্লিদের সালাতে ব্যাঘাত ঘটে।
🔰 তবে সালাতরত অবস্থায় হাঁচির জবাব দেওয়া জায়েয নেই। এ ব্যাপারে আলেমদের কোনো দ্বিমত নেই।
ইমাম নববী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন:
"সালাত রত অবস্থায় কেউ হাঁচির জবাব দিলে তার সালাত ভঙ্গ হয়ে যাবে।"
💠 হাই উঠলে কি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা...‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম’ পাঠ করা মোস্তাহাব?
হাই উঠলে করণীয় হল, মুখে হাত দিয়ে হাই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা। অন্যথায় মুখগহ্বর দিয়ে শয়তান ভিতরে প্রবেশ করে। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِذَا تَثَاوَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيُمْسِكْ بِيَدِهِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَدْخُلُ ‏"‏ ‏
"যদি তোমাদের কেউ হাই তোলে তবে সে যেন তাঁর মুখের উপর হাত রেখে তাকে প্রতিহত করে। কেননা এ সময় শয়তান (মুখ দিয়ে) প্রবেশ করে।"
(সহীহ মুসলিম হাদিস নম্বরঃ [7222]) অন্য বর্ণনায় এসেছে, হাই প্রতিরোধ না করলে শয়তান হাসে।
কিন্তু এ সময় "লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ" অথবা "আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজিম" পাঠ করা সম্পর্কে কোনো হাদিস আছে বলে জানা নেই-সালাতের মধ্যে হোক অথবা বাইরে হোক।
সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটিকে এ বিষয় জিজ্ঞেস করা হলে তারা উত্তর দেন:
"لا نعلم ما يدل على شرعية الاستعاذة عند التثاؤب لا في الصلاة ولا في خارجها"
“আমরা এমন কিছু জানি না, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাই উঠলে আউযুবিল্লাহ পাঠ করা শরিয়ত সম্মত-সলাতের মধ্যে হোক অথবা সালাতের বাইরে হোক।” (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৬/৩৮৩)
আল্লাহু আলাম।
----------------------
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল মাদানি
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, KSA

প্রশ্ন: ২৩৮: কোথায় কোথায় সালাম দেয়া যায়

উত্তর দেখুন 

প্রশ্ন: ২৩৭ : অজুর দোয়া

অজুর পূর্বে কি দোয়া করতে হয়। বিস্তারিত দেখুন :  এখানে 


আরো দেখুন : এখানে 

প্রশ্ন: ২৩৬ : তালাক প্রদান করার সঠিক পদ্ধতি ।

ইসলামে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ তালাক। বৈবাহিক সম্পর্ক যেন ছিন্ন না হয়, এজন্য সকল প্রকার চেষ্টা চালাতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। 
কিন্তু কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে উভয়ের একত্রে জীবন যাপন অত্যন্ত কষ্টকর ও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই রকম অবস্থায় বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাই উভয়ের জন্য কল্যাণকর মনে হয়। এজন্য ইসলামি শরিয়ত তালাক বৈধ করেছে। 
বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পাদিত চুক্তি ছিন্ন করার নাম তালাক। এর সর্বোত্তম পদ্ধতি এই যে, দু’টি শর্তের ভিত্তিতে কেবলমাত্র একটি তালাক দেবে- (১) নারীর পবিত্রতা অবস্থায় । (২) স্বামী-স্ত্রীকে এমন পবিত্র সময়ে তালাক দেবে যার মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করেনি। শুধুমাত্র এক তালাক দিলে ইদ্দতের সময় কালের ভেতরে রাজআতও করা যাবে। অর্থাৎ কোনো ধরণের বিয়ে ছাড়াই স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক পুনরায় বহাল করা যাবে। আর ইদ্দত শেষ হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে চাইলে বিবাহও করতে পারবে। এছাড়া ইদ্দত শেষ হওয়ার পর নারী অন্য কোনো পুরুষকেও বিবাহ করতে পারবে। মোটকথা হলো, এই জাতীয় তালাক হওয়ার পর বৈবাহিক সম্পর্ক পুনরায় বহাল রাখাও সম্ভব এবং ইদ্দত শেষ হওয়ার পর নারী অন্য যে কোনো পুরুষকে বিবাহ করারও অধিকার থাকবে। সারকথা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে এবং তালাক দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় না থাকলে শুধুমাত্র এক তালাক দেবে। যেন ভুল অনুভব করার পর ইদ্দতের সময়কালে ফিরিয়ে নেয়া এবং ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় বিয়ের রাস্তা খোলা থাকবে। একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া থেকে সম্পূর্ণ বেঁচে থাকতে হবে। কেননা তিন তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া বা পুনরায় বিয়ে করার পথ বাহ্যিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। 
তালাকের অধিকার স্বামীর: 
সৃষ্টিগত ও স্বভাবগত কারণেই পুরুষের মধ্যে নারীর তুলনায় চিন্তা-ভাবনা এবং ধৈর্য-সহনশীলতার শক্তি বেশি থাকে। পাশাপাশি শারীরিক গঠন, স্বভাব, শক্তি ও যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা যে শক্তি ও বড় বড় কাজ করার যোগ্যতা পুরুষকে দিয়েছেন তা নারীকে দেননি। এজন্যই নেতৃত্বের কাজ সঠিকভাবে একজন পুরুষই আঞ্জাম দিতে পারে। এ বিষয়ে নিজের জ্ঞান দ্বারা সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে যিনি এদের দু’জনকেই সৃষ্টি করেছেন, সেই সত্তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন, তিনি কী বলেন। 
কুল কায়েনাতের স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বিষয়টির সমাধান পেশ করেছেন, ‘পুরুষদের জন্য নারীদের ওপর মর্যাদা রয়েছে’ (সূরা বাকারাহ-২২৮)। ‘পুরুষগণ নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল’ (সূরা নিসা-৩৪)। এই আয়াতগুলোর মধ্যে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, যৌথ জীবন পরিচালনায় নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কেবল পুরুষেরই থাকবে। যদিও পুরুষের জন্য উচিৎ যে, নারীকেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে শামিল করবে। এ জন্যই ইসলামি শরিয়ত তালাক প্রদানের অধিকার পুরুষদেরকে দিয়েছে।
খোলা তালাক:
ইসলামি শরিয়ত তালাকের অধিকার পুরুষকে দিলেও নারীদেরকে কেবল বাধ্য ও অপারগ বানিয়ে রাখেনি। কেননা স্বামী যদি স্ত্রীর সকল প্রাপ্য অধিকার যথাযথভাবে আদায় না করে অথবা নারী কোনো কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল রাখতে না চায় তাহলে ইসলামি শরিয়ত নারীকে এই  অধিকার দিয়েছে যে, স্বামীর কাছে তালাক দাবি করবে। নারী যদি বাস্তবেই মজলুম হয়, তাহলে স্বামীর শরয়ি দায়িত্ব হলো তার অধিকার আদায় করবে অথবা নারীর দাবি অনুযায়ী তাকে তালাক দিয়ে দেবে। চাই কোনো কিছুর বিনিময়ে হোক বা বিনিময় ছাড়া। কিন্তু স্বামী যদি তালাক দিতে অস্বীকার করে তাহলে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য নারীর শরয়ি আদালতে যাওয়ার অধিকার আছে। যাতে বিষয়টি সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি ঘটে। অন্যথায় বিচারক স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করবে। এভাবেই আদালতের মাধ্যমে তালাক হয়ে যাবে। এবং নারী ইদ্দত পালনের পর অন্য কাউকে বিবাহ করতে পারবে। ‘খোলা’র এই পদ্ধতিতে তালাকে বায়েনা পতিত হয়। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি পুনরায় এক সঙ্গে থাকার ইচ্ছা করে তাহলে স্বামী বিবাহ ছাড়া পুনরায় ফিরিয়ে নিতে পারবে না। বরং তাদের মাঝে পুনরায় বিবাহ হতে হবে। যার জন্য উভয় পক্ষের অনুমতির প্রয়োজন। 
তালাকের প্রকার সমূহ:
সাধারণভাবে তালাক তিন প্রকার হয়ে থাকে। ১. তালাকে রজয়ি । ২. তালাকে বায়েন। ৩. তালাকে মুগাল্লাজা। 
তালাকে রিজয়ি:
স্পষ্ট শব্দে স্ত্রীকে এক তালাক বা দুই তালাক দেয়ার নাম তালাকে রিজয়ি। উদাহরণ স্বরূপ স্বামী-স্ত্রীকে বলবে, আমি তোমাকে তালাক দিয়েছি। এটা এমন একটি তালাক, যার মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয় না। ইদ্দত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকে। ইদ্দতের সময়কালে স্বামী যদি চায় যে, তালাক থেকে ফিরে আসবে তাহলে এ নারীকে বিবাহ ছাড়াই পুনরায় স্ত্রী বানাতে পারবে। মনে রাখতে হবে যে, তালাক ফিরিয়ে নেয়ার  জন্য শরিয়তে স্ত্রী’র সম্মতি গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। 
তালাকে বায়েন:
তালাকের অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝায় না এমন শব্দে তালাক দেয়ার নাম তালাকে বায়েন। উদাহরণ স্বরূপ, স্বামী তার স্ত্রীকে বলবে, তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও। আমি তোমকে ছেড়ে দিয়েছি। এ জাতীয় শব্দে ওই সময় তালাক হবে, যখন স্বামী এই শব্দ দ্বারা তালাকের নিয়ত করবে, অন্যথায় নয়। এ জাতীয় শব্দ দ্বারা তালাকে বায়েন পতিত হয়। অর্থাৎ বিবাহ বন্ধন তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যায়। এখন কেবল বিবাহের মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রী একজন অপর জনের জন্য হালাল হতে পারে। 
তালাকে মুগাল্লাজা:
একসঙ্গে অথবা পৃথক পৃথক তিন তালাক দেয়ার নাম তালাকে মুগাল্লাজা। চাই একই মজলিসে দিক অথবা একই পবিত্রতায় দিক। এ অবস্থায় স্বামীরও ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার থাকে না। এবং স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিবাহও করতে পারে না। তবে নারী যদি নিজের ইচ্ছায় অপর কোনো পুরুষকে যথা নিয়মে বিয়ে করে এবং দু’জনের সহবাসও হয় অত:পর দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যু হয়ে গেল অথবা দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় তাকে তালাক দিয়ে দিল, এই নারী দ্বিতীয় স্বামীর তালাক বা মৃত্যুর ইদ্দত পালনের পর প্রথম স্বামীকে পুনরায় বিবাহ করতে পারবে। এই বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা তার পবিত্র কালামে সূরায়ে বাকারার ২৩০ নম্বর আয়াতে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ‘অত:পর যদি স্বামী (তৃতীয়) তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে ওই (তালাকপ্রাপ্তা) নারী তার জন্য ওই সময় পর্যন্ত হালাল হবে না যতক্ষণ অন্য কোনো নারীকে বিবাহ না করে। হ্যাঁ, যদি (দ্বিতীয় স্বামীও) তাকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের কোনো অসুবিধা নেই যে, একজন অপর জনের নিকট (নতুনভাবে বিবাহ করে) পুনরায় ফিরে আসবে। এই শর্তে যে, তাদের এই প্রবল ধারণা হবে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখবে।’ এই পদ্ধতিকে হালালাহ বলে। যার উল্লেখ কোরআনে কারিমে রয়েছে। এই পদ্ধতিটি সঠিক হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। (ক) দ্বিতীয় বিবাহটি সঠিক নিয়মে হতে হবে। (খ) দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সহবাস হতে হবে। (গ) দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দিতে হবে অথবা মৃত্যু বরণ করতে হবে। (ঘ) দ্বিতীয় ইদ্দতও সমাপ্ত হতে হবে। এটাও জানা উচিৎ যে, হালালার শর্তে বিয়ে করা হারাম। 
ইসলামি শিক্ষার দাবি এই যে, বিবাহ সারা জীবনের জন্য হয়। তা ছিন্ন করা ও শেষ করার সুযোগই যেন না আসে। কেননা এ সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রভাব কেবল স্বামী-স্ত্রীর ওপরই পড়ে না, বরং সন্তানের জীবন ধ্বংস এবং ক্ষেত্র বিশেষ দুই পরিবার বা দুই বংশের ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর দ্বারা পুরো সমাজ প্রভাবিত হয়। এই জন্য ইসলামি শরিয়ত স্বামী-স্ত্রী উভয়কে এই নির্দেশনা দিয়েছে। যার ওপর আমল করার দ্বারা সম্পর্ক অনেক মজবুত ও সুদৃঢ় হবে। যদি স্বামী-স্ত্রী’র মাঝে মতবিরোধ দেখা যায়, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের দু’জনে মিলে এই বিরোধ দূর করা উচিৎ। যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন কোনো বিষয় সামনে আসে, যা স্বামীর মেজাজ পরিপন্থি, সে ক্ষেত্রে স্বামীকে আদেশ দেয়া হয়েছে, সে যেন বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবং ধমক শাসনের দ্বারা কাজ নেয়। দ্বিতীয়ত স্বামীকে এও বলা হয়েছে যে, স্ত্রীকে কেবল চাকরানি বা খাদেমাও মনে করবে না। বরং স্ত্রী হিসেবে তার বেশ কিছু অধিকারও রয়েছে। যেগুলো আদায় করা শরিয়তের দৃষ্টিতে অধিক জরুরি। এই সকল অধিকারের মধ্যে রয়েছে তাদের খোরপোষ ও বাসস্থানের সুন্দর ব্যবস্থা। তেমনি তাদের নিরাপত্তা, মনোরঞ্জন ও আরাম আয়েশের প্রতি খেয়াল রাখাও জরুরি। এই জন্যই আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন ‘তোমাদের মধ্যে সবচে’ উত্তম মানুষ সেই, যে তার পরিবারের দৃষ্টিতে উত্তম।’ স্পষ্ট কথা তাদের দৃষ্টিতে সেই উত্তম হবে, যে তাদের অধিকার যথাযথ ভাবে আদায় করবে। 

প্রশ্ন: ২৩৫ : একজন নারী কখন তালাক দিতে পারে ।



স্ত্রী কখন তালাক দিতে পারে : 

মুসলিম আইনানুযায়ী বিয়ের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা, অধিকার সংরক্ষিত হয়। মুসলিম আইনে পুরুষের মতো নারীরও রয়েছে সমাজে অধিকার ও মর্যাদা। মুসলিম আইনে বিয়ে এমনই একটি বিষয় যার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের অধিকার রক্ষিত হয়।

একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিয়ে। মুসলিম পারিবারিক আইনে বিয়ে, তালাক, ভরণপোষণ, যৌতুক ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচিত হয়। বিয়ের মাধ্যমেই নারী-পুরষের সম্পর্কের বৈধতা পায়। আইনানুযায়ী বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। বিয়ে যেমন বৈধ। মুসলিম আইন তালাককেও তেমনি বৈধতা দিয়েছে।

স্ত্রী কি তালাক দিতে পারেন?
কাবিন নামায় স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন। এ ক্ষমতা শর্তযুক্তও হতে পারে। স্ত্রী অর্পিত ক্ষমতা বলে স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এছাড়াও বেশ কয়েকটি কারণে স্ত্রী স্বেচ্ছায় স্বামীকে তালাক দিতে পারেন।

আদালতের মাধ্যমে স্ত্রীর তালাক দেওয়া ক্ষমতা:
যদি বিয়ের কাবিননামায় স্ত্রীকে তালাকের কোনো ক্ষমতা অর্পন করা না হয়, তবে স্ত্রী আদালতের অনুমতি নিয়ে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন।

স্ত্রী যেসব কারণে তালাক দেওয়ার অধিকার অর্জন করে:
- স্বামী যদি চার বছর নিরুদ্দেশ থাকেন।
- স্বামী যদি দুই বছর ভরণপোষণ না দেন।
-স্বামী যদি আইনের লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় বিবাহ করেন।
- স্বামী যদি সাত বছর বা এর বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন
- স্বামী যদি যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তিন বছর বৈবাহিক দায়িত্ব পালন না করেন।
- স্বামী যদি পুরুষত্বহীন থাকেন।
- স্বামী যদি দুই বছর অপ্রকৃতিস্থ বা মারাত্মক ব্যাধিতে ভোগেন।
- নাবালিকা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকলে সাবালিকা হওয়ার পর স্ত্রী যদি তা অস্বীকার করেন।
- স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ বা নির্যাতন করলে।

পরকীয়া করলে স্ত্রী কি তার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন?
হ্যা, স্বামী যদি অন্য নারীর সাথে মেলামেশা করেন বা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তবে স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এছাড়াও শারীরকি ও মানসিক নির্যাতন, নৈতিকতাবিরোধী জীবনযাপন, স্ত্রীর সম্পত্তির বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রদান, স্ত্রীর ধর্মীয় চর্চায় বাধা প্রদান ইত্যাদি কারণে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারেন।

তালাক সম্পর্কিত কিছু ভুল ত্রুটি : 


তালাক সম্পর্কিত কিছু ভুলত্রুটি

এ সংখ্যায় শুধু এ বিষয়ে আলোচনা করাই মুনাসিব মনে হল। একটি কথা তো বারবার লেখা হয়েছে, ওলামা-মাশায়েখও আলোচনা করে থাকেন যে, অতীব প্রয়োজন (যা শরীয়তে ওজর বলে গণ্য) ছাড়া স্বামীর জন্য যেমন তালাক দেওয়া জায়েয নয় তেমনি স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া দুরস্ত নয়। তালাকের পথ খোলা রাখা হয়েছে শুধু অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে আমাদের এতদাঞ্চলে কোনো পরিবারে তালাকের ঘটনা যে কত ফাসাদ-বিশৃঙ্খলা, জুলুম-অত্যাচার এবং ঝগড়া-বিবাদের কারণ হয় তা আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। তালাক প্রদানের ক্ষমতাকে শরীয়তের নির্ধারিত নীতিমালার বাইরে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিধানের সাথে বালখিল্যতার শামিল।
এজন্য কেউ দাম্পত্য জীবনে পা রাখার চেষ্টা করলে তার অপরিহার্য কর্তব্য হবে, বিয়ের আগেই দাম্পত্য জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলোর সাথে  তালাকের বিধানসমূহ জেনে নেওয়া।
তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি বিবেচক স্বামীর দায়িত্ব হল, তালাকের শব্দ কিংবা এর সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকা।
অবশ্য অতীব প্রয়োজনে তালাক প্রদানে বাধ্য হলে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থায় শুধু এক তালাক দিয়ে ক্ষান্ত হওয়া উচিত। এভাবে বলবে যে, তোমাকে তালাক দিলাম। তালাকের সাথে বায়েন শব্দ কিংবা ৩ সংখ্যা ব্যবহার করবে না। কেউ বায়েন শব্দ বলে ফেললে (চাই তা এক বা দুই তালাক হোক না কেন) নতুন করে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো ছাড়া স্ত্রীর সাথে পুনরায় মিলনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
অনুরূপভাবে তিন তালাক দিয়ে ফেললে-একই মজলিসে পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া হোক কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হোক- যেমন বলল, তোমাকে তিন তালাক দিলাম। অথবা আগে কখনো দুই তালাক দিয়েছিল আর এখন শুধু এক তালাক দিল। সর্বমোট তিন তালাক দেওয়া হল। যেকোনো উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে বিবাহে ফিরিয়ে আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না।
একসাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা বিভিন্ন সময় তালাক দিতে দিতে তিন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া একটি জঘণ্য অপরাধ ও ঘৃণিত কাজ। আল্লাহ তাআলা এর শাস্তি হিসেবে এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পুনরায় একসাথে বসবাস করতে চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং সে স্বামীর সাথে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর কোনো কারণে সে তালাকপ্রাপ্তা হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর এরা দুজন পরস্পর সম্মত হলে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। 
এজন্য শরীয়ত আগেই সাবধান করে দিয়েছে যে, প্রথমত তালাকের কথা
চিন্তাও করবে না। তবে অতীব প্রয়োজনে কখনো তালাক প্রদানের প্রয়োজন হলে শুধু সাদামাটা তালাক দাও, শুধু এক তালাক। যেন উভয়ের জন্যই নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ থাকে এবং পুনরায় ফিরে আসার পথ খোলা থাকে। এরপর আবারো কোনো সমস্যা দেখা দিলে এভাবেই শুধু এক তালাক দিবে। এখনও ফিরে আসার পথ খোলা থাকবে।
কিন্তু এরপর যদি আবার কখনো শুধু এক তালাকই দেওয়া হয় এবং সব মিলে তিন তালাক হয়ে যায় এ অবস্থায় আর তাকে ফিরিয়ে আনারও সুযোগ থাকবে না, নতুন করে বিয়ে করার বৈধতাও বাকি থাকবে না।
আজকাল স্বামী-স্ত্রী তালাকের বিধান জানা ও সে অনুযায়ী আমল করার পরিবর্তে নিজেদের মনে এমনসব ভুল ও বানোয়াট মাসআলা স্থির করে রাখে যে, আল্লাহ মাফ করুন।
১. তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না
যেমন, কেউ মনে করে যে, শুধু এক বা দুই তালাক দেওয়ার দ্বারা তো তালাকই হয় না। তালাকের জন্য একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে তারা অপরিহার্য মনে করে।
মনে রাখবেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হল, শুধু এক তালাক দেওয়া। পরবর্তীতে আবারও প্রয়োজন হলে শুধু এক তালাকই দিবে। এরচেয়ে বেশি দিবে না। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার সকল পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
একই মজলিসে কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। কিন্তু কেউ এমনটি করলে তালাক কার্যকর হবে এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।
২. তালাকের সাথে কি বায়েন শব্দ ব্যবহার করা জরুরি
অনেকে মনে করে, শুধু তালাক বললে তালাক হয় না; বরং তালাকের সাথে বায়েন শব্দও যোগ করা অত্যাবশ্যক।
এটিও ভুল ধারণা। শুধু তালাক শব্দ দ্বারাই তালাক হয়ে যায়। এর সাথে বায়েন শব্দ যোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। উপরন্তু এ শব্দের সংযোজন নাজায়েয। তবে কেউ যদি এক তালাক বায়েন বা দুই তালাক বায়েন দেয় তবে সে মৌখিকভাবে রুজু করার (পুনরায় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার) পথ বন্ধ করে দিল। এখন শুধু একটি পথই খোলা আছে। আর তা হল, নতুনভাবে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো। অথচ শুধু তালাক বললে এক তালাক বা দুই তালাক পর্যন্ত মৌখিক রুজুর পথ খোলা থাকে। এজন্য স্বামীর উচিত, যত উত্তেজিতই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই যেন তিন তালাক না দেয়। এমনকি তা কখনো মুখেও না আনে। অথচ অনেকে তো তিন তালাক দেওয়ার পরও পৃথকভাবে বায়েন শব্দ যোগ করেন। যেন সব কটি তালাক দেওয়ার পরও তার মন ভরল না। না হলে তিন তালাক দেওয়ার পর আর কী বাকি থাকে যে, বায়েন শব্দ বলতে হবে?!
মনে রাখবেন, তিন তালাক দেওয়াই এক গুনাহ, এরপর বায়েন শব্দ যোগ করে সে আরো বেশি গুনাহগার হল।
৩. একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হয় না
অনেকে এই ভুল ধারণাও প্রচার করে রেখেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া হলে তালাক হয় না কিংবা শুধু এক তালাক হয়।
এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একসাথে তিন তালাক দেওয়া জায়েয না হলেও কেউ যদি এই নাজায়েয কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর উপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এক্ষেত্রে তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি নতুন করে বিবাহ দোহরিয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে অপরের জন্য হালাল হতে পারে না। তাই সকল স্বামীরই কর্তব্য, প্রথম থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। মুখ দিয়ে কখনো তিন তালাক কিংবা তালাক, তালাক, তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর আগেই দুই তালাক দিয়ে থাকলে এখন আর তৃতীয় তালাকের চিন্তাও না করা।
৪. গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক পতিত হয় না
অনেকে এই মাসআলা বানিয়ে রেখেছে যে, গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে তা কার্যকর হয় না। এটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব কথা। গর্ভাবস্থায় হোক বা অন্য যেকোনো অবস্থাই হোক তালাক দেওয়া হলে তা পতিত হয়ে যায়। এজন্য সঠিক মাসআলা শেখা সকলের দায়িত্ব। অজ্ঞতার ধোকায় থাকার কারণে হারাম কখনো হালাল হতে পারে না।
৫. তালাক পতিত হওয়ার জন্য কি সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি
অনেকের ধারণা, স্বামী তালাকের সময় কোনো সাক্ষী না রাখলে তালাক পতিত হয় না। আগেরটার মতো এটাও মানুষের মনগড়া মাসআলা। কোন মূর্খ এই কথা বলেছে জানা নেই। সাক্ষীর প্রয়োজন তো হয় বিবাহের সময়। তালাক পতিত হওয়ার জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই। স্বামী যদি রাতের অন্ধকারে একা একা বসে তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যায়।
৬. রাগের অবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক হয় না
তালাক তো দেওয়াই হয় রাগ হয়ে। কয়জন আছে, শান্তভাবে তালাক দেয়? আসলে তো এমনই হওয়া উচিত ছিল যে, যদি বাস্তবসম্মত ও অনিবার্য প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় তাহলে বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে একে অন্যের কল্যাণকামী হয়ে বুঝে-শুনে, সঠিক মাসআলা জেনে নিয়ে মাসআলা অনুযায়ী তালাক প্রদানের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
 কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মানুষ মাসআলা জানার চেষ্টাও করে না, আর না তাদের মধ্যে এই সুবুদ্ধি আছে যে, বড়দের সাথে পরামর্শ করবে, চিন্তা-ভাবনা করবে। নিজের ইচ্ছাবিরোধী কোনো কিছু পেলেই রাগের বশে তালাক দিয়ে ফেলে। আর তা এক বা দুইটি নয়; এক নিঃশ্বাসে তিন তালাক।
যখন রাগ প্রশমিত হয় তখন অনুতপ্ত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের কথা বানাতে থাকে। বলে, আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, তালাক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এসব লোকের জেনে রাখা উচিত যে, তালাক পতিত হওয়ার জন্য নিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা কোনো ইবাদত নয় যে, এর জন্য নিয়ত করতে হবে। নিয়ত থাক বা না থাক সর্বাবস্থায় তালাক শব্দ বলে ফেললে বা কাগজে লিখে দিলেই তালাক হয়ে যায়। তেমনিভাবে রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়, এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়।
অবশ্য কেউ যদি প্রচন্ড রেগে যায় ও রাগের ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আর এ অবস্থায় সে কী বলেছে তার কিছুই মনে না থাকে তাহলে ঐ অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না।
শেষকথা এই যে, দাম্পত্য জীবন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় ও বিশেষ একটি নেয়ামত। স্বামী-স্ত্রী সকলের কর্তব্য, এই নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং একে অপরের সকল অধিকার আদায় করা। স্ত্রীর জন্য উচিত নয়, কথায় কথায় স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া। আবার স্বামীর জন্যও জায়েয নয় আল্লাহ তাআলার দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করা।
বিয়ে, তালাক ও দাম্পত্য জীবনের সকল বিধান ও মাসআলা শিক্ষা করা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য জরুরি। বিশেষ করে স্বামীর কর্তব্য হল, তালাকের মাসআলা ও এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত না হয়ে মুখে কখনো তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর যদি কোনো কারণে তালাক দেয় এবং এমনভাবে দেয় যে, এখন আর তাদের একসাথে থাকা শরীয়তে বৈধ নয় তাহলে তাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিত। বিভিন্ন টাল-বাহানা, অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে কিংবা ভুল কথার উপর ভিত্তি করে অথবা মূল ঘটনা গোপন রেখে একসাথে বাস না করা উচিত। বিয়ে শুধু একটি সময়ের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়।
বাস্তবেই যদি তালাক হয়ে যায় এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এরপরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসাথে বাস করে তাহলে তা হবে কবীরা গুনাহ এবং উভয়েই যেন ব্যভিচারের গুনাহয় লিপ্ত।
আল্লাহ তাআলা সকলকে হেফাযত করুন এবং তাকওয়া ও পবিত্রতা দান করুন। আমীন। 

তালাক দেওয়ার অধিকার ইসলামে শুধু স্বামীকেই দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর হাতে এ জন্য দেওয়া হয়নি যে নারীদের স্বভাবে সাধারণত তাড়াহুড়া প্রবণতাটা একটু বেশি। তাই তাদের ক্ষমতা দিলে ছোটখাটো বিষয়েও তাড়াহুড়া করে তালাক দেওয়ার আশঙ্কাটা বেশি। তাই বেশি পরিমাণে বিবাহবিচ্ছেদ রোধেই ইসলাম নারীদের তালাকের ক্ষমতা দেয়নি। মনে রাখতে হবে, ইসলাম নারীকে তালাকের অধিকার দেয়নি, কিন্তু তালাকের যে মূল উদ্দেশ্য বিবাহবিচ্ছেদ, তার অধিকার দিয়েছে। অর্থাৎ কোনো কারণে নারী চাইলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। ইসলামে নারীদের আটকে রাখা হয়নি, বরং তারাও প্রয়োজনে যথাবিহিত নিয়মে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারে। যথা :
ক. বিবাহের আগেই স্ত্রী এ শর্ত দিতে পারবে যে আমাকে ‘তালাক’ (বিবাহবিচ্ছেদ) দেওয়ার অধিকার দিতে হবে। তখন স্বামী থেকে প্রাপ্ত অধিকারবলে স্ত্রী প্রয়োজনে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে, যা আমাদের দেশের কাবিননামার ১৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ থাকে। (দেখুন : ফাতহুল কাদির : ৩/৪২৭)
খ. যদি বিবাহের সময় শর্ত না-ও দিয়ে থাকে, তার পরও স্ত্রী স্বামী থেকে আপসের ভিত্তিতে এমনকি প্রয়োজনে বিনিময়ের মাধ্যমেও তালাক নিতে পারবে। এটাকে ‘খোলা তালাক’ বলা হয়। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৭৩)
গ. ওই পদ্ধতিদ্বয় ছাড়াও স্বামী নপুংসক, পাগল, অস্বাভাবিক ক্রোধসম্পন্ন হলে কোনোক্রমেই মনের মিল না হলে বা নিখোঁজ হয়ে গেলে অথবা যেকোনো কঠিন সমস্যায় পতিত হলে স্ত্রী বিচারকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ করিয়ে নিতে পারবে। (শরহুস সগির, দরদির : ২/৭৪৫, কিফায়াতুল মুফতি : ৬/২৫২)

ইসলামে তালাকের অবস্থান
ইসলামী শরিয়তে অতি প্রয়োজনে তালাকের অবকাশ থাকলেও বিষয়টি অপছন্দনীয়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল বস্তু হচ্ছে তালাক।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৭৭)
তাই নারী-পুরুষ উভয়ের কর্তব্য তালাক থেকে দূরে থাকা। তালাক দেওয়ার ক্ষমতা যেহেতু পুরুষের, তাই পুরুষকে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সংযমী হতে হবে। অন্যদিকে নারীর ব্যাপারেও হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে নারী স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৫৫)
সম্প্রতি পরকীয়ার বিস্তারে যেমন পুরুষের অপরাধ আছে, তেমনি আছে নারীরও। দেখা যাচ্ছে, এক নারীর দ্বারাই অন্য নারীর সংসার ভাঙছে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই বাণী খুবই প্রাসঙ্গিক—‘কোনো নারী যেন তার বোনের (অপর নারীর) অংশ নিজের পাত্রে নেওয়ার জন্য তালাকের আবেদন না করে। সে নিজে পছন্দ মোতাবেক বিবাহ করুক, কেননা তার ভাগ্যে যা লেখা আছে সে তা-ই পাবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৬০০)
তাই প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজের পাতে যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। অন্যের পাতের জিনিস নিজের পাতে নিয়ে নেওয়ার মতো লোভী মানসিকতা কোনো ভদ্র মানুষের হতে পারে না। উপরন্তু যখন ওই নারীটিও একজন নারী।

দাম্পত্য সম্পর্কের দৃঢ়তায় ইসলামের দিকনির্দেশনা
যেসব কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়, সেগুলো দূর করার জন্য কোরআন-হাদিসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে।
প্রথমত, বিবাহের আগে একে অন্যকে ভালোভাবে দেখে নেবে, যাতে বুঝে-শুনেই বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং কোনো ধরনের দৈহিক ত্রুটির কারণেই যেন সম্পর্ক ছিন্ন করার উপক্রম না হয়।
দ্বিতীয়ত, শুধু একে অন্যের দোষ-ত্রুটির দিকেই দেখবে না, বরং তার মধ্যে যেসব ভালো গুণ বিদ্যমান সেগুলোর দিকে তাকিয়ে অপছন্দের দিকগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবু তুমি যা অপছন্দ করছ আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৯)
এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ মুমিন নারীর ওপর রুষ্ট হবে না, কেননা যদি তার কোনো কাজ খারাপ মনে হয়, তাহলে তার এমন গুণও থাকবে, যার ওপর সে সন্তুষ্ট হতে পারবে।’ (মুসলিম হাদিস : ১৪৬৯)

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...