শিশুদের শিক্ষায় করনীয়

 

শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা : কঠোরতা নয়, কোমলতাই আসল পন্থা

মাওলানা মুহাম্মদ আনসারুল্লাহ হাসান

ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শৈশব-কৈশরই হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তিকাল। স্বচ্ছ মেধা, সুস্থ বুদ্ধি, সরল চিন্তা ও স্পষ্ট মনোযোগের কারণে শিশুরা সহজেই সবকিছু আয়ত্ত করতে পারে। সঙ্গত কারণেই তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিও অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।

এখানে মনে রাখা উচিত, শরীয়তের দৃষ্টিতে শিশুদের পরিচয়, তারা গায়রে মুকাল্লাফ তথা দায়ভার ও জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত। তারা শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল তেমনি মানসিকভাবেও  কোমল। তাই তাদের সাথে কোমল ও নরম আচরণ করতে হবে। তাদেরকে শিক্ষাদান করতে হবে মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে। এক্ষেত্রে ডাঁট-ধমক ও কঠোরতা  পরিহার করে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করতে হবে। যে নম্রতা ও কোমলতার আচরণ করতেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার সাথে করতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হঠকারী ও কঠোরতাকারীরূপে প্রেরণ করেননি; বরং সহজ-কোমল আচরণকারী শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৭৮

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীর ভুল-ত্রুটিগুলো যথাসম্ভব কোমলতা ও উদারতার সাথে সংশোধন করতে হবে এবং দয়া ও করুণার পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধমক ও ভৎর্সনা নয়।-আর রাসূলুল মুয়াল্লিম, পৃ. ১১

খতীবে বাগদাদীখ্যাত ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে আলী রাহ. শিক্ষকের আদাব সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, শিক্ষকের উচিত, ভুলকারীর ভুলগুলো কোমলভাবে ও নরম ভাষায় বলে দেওয়া, কঠোর আচরণ ও রুক্ষ ভাষার মাধ্যমে নয়।-আলফকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ ২/২৮৪

তিনি তার এ বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।

১. হযরত মুআবিয়া ইবনে হাকাম রা. বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নামাযরত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি (নামাযের মধ্যে) হাঁচি দিল। প্রতিউত্তরে আমি ইয়ারহামুকাল্লাহ বললাম। লোকজন তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আমি বলে উঠলাম, আপনাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লোকজন তাদের উরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ হতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করলেন। আমার পিতামাতা তার প্রতি উৎসর্গিত হোন, তার মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তার পূর্বেও কাউকে দেখিনি এবং তার পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন; তিনি বললেন, আমাদের এই নামায মানষের কথাবার্তার উপযোগী নয়। (অর্থাৎ নামাযে এ ধরনের কথা বলা যায় না।) বরং এ  তো হল তাসবীহ, তাকবীর ও তেলাওয়াতে কুরআন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৩৭; আবু দাউদ, হাদীস : ৯৩০

২. হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কোমল আচরণকারী, তিনি সর্বক্ষেত্রে কোমলতাকে ভালবাসেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০২৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২১৬৫

মুসলিম শরীফের অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হে আয়েশা! আল্লাহ তাআলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পছন্দ করেন। তিনি নম্রতার জন্য এমন কিছু দান করেন, যা কঠোরতার জন্য দান করেন না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯৩

৩. হযরত জারীর রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে প্রকৃত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮০৭

৪. হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোমলতা যে কোনো বিষয়কে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। আর কোনো বিষয় থেকে কোমলতা দূর হয়ে গেলে তাকে কলুষিত করে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯৪

ইমাম মুহিউদ্দীন নববী রাহ. শিক্ষকের আদাব সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, শিক্ষকের উচিত, তার ছাত্রের সাথে নরম ব্যবহার করা, তার প্রতি সদয় হওয়া। তার কোনো ভুল হলে বা অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রকাশ পেলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। বিশেষত শিশু-কিশোরদের বেলায়।

তিনিও এ বিষয়ে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। একটি হাদীস এই- হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই মানুষ তোমাদের অনুসারী হবে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন দ্বীন শেখার জন্য তোমাদের নিকট আগমন করবে। যখন তারা আগমন করবে, তোমরা তাদের হিতকাঙ্খী হবে এবং তাদেরকে সদুপদেশ দিবে।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৫০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৪৯; (আততিবয়ান পৃ. ৫৬-৫৭)

রাগান্বিত অবস্থায় শিশুদের প্রহার করা অন্যায় স্বভাব-প্রকৃতির কারণেই শিশুরা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। তাই শিশুদের শিক্ষাদান খুবই কঠিন। শান্ত-শিষ্টতার চেয়ে চপলতা ও চঞ্চলতাই তাদের মধ্যে প্রবল। ফলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ কষ্টকর। কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, শিক্ষকের মধ্যে ক্রোধের ভাব সৃষ্টি হয়ে যায় এবং প্রহার করার অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। এ সময় শাস্তি দিবে না; বরং  নীরব-নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ দূর করবে। তারপর করণীয় ঠিক করবে। এটাই ইসলামের শ্বাশ্বত শিক্ষা ও ধর্মীয় নির্দেশনা।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা শিক্ষাদান কর, সহজ ও কোমল আচরণ কর; কঠোর আচরণ করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক (এ কথা তিনবার বললেন)।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫৫৬, ২১৩৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৮৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১৫২, ১৫৩; মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী, হাদীস : ২৬০৮; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস : ২৪৫,

আল-আদাবুল মুফরাদের অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা শিক্ষাদান কর এবং সহজ-কোমল আচরণ কর এ কথা তিনবার বলা হয়েছে।-হাদীস : ১৩২০

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আমাকে আল্লাহর গযব থেকে রক্ষা করবে? তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৬৩৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ২৯৬

রাসূলের জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণিত,  এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তা বলার পর আমি চিন্তা করে দেখলাম, ক্রোধই হল সকল অনিষ্টর মূল।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩১৭১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ২০২৮৬;

শিশুদেরকে বা অন্য  কাউকে প্রহার করা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে কিয়ামতের দিন তার থেকে এর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে।-আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস : ১৮৬, মুসনাদে বাযযার, হাদীস-৩৪৫৪, তাবারানী, হাদীস-১৪৬৮

এ সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন, কখনো রাগান্বিত অবস্থায় শিশুকে প্রহার করবে না। পিতা ও উস্তাদ উভয়ের জন্যই এ কথা। এ সময় চুপ থাকবে। যখন ক্রোধ দূর হয়ে যাবে তখন ভেবেচিন্তে শাস্তি দিবে। এতে শাস্তির মাত্রা ঠিক থাকবে।  সীমালঙ্ঘন হবে না। কিন্তু যদি রাগান্বিত অবস্থায় মারতে আরম্ভ কর, তাহলে এক থাপ্পড়ের জায়গায় দশ থাপ্পড় দিয়ে ফেলবে। এর কারণে একে তো গুনাহ হল। কেননা, প্রয়োজনের অধিক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত এতে শিশুর ক্ষতি হবে। কেননা, সকল বিষয়ই মাত্রা অতিক্রম করলে ক্ষতি হয়ে যায়। তৃতীয়ত এর জন্য পরে অনুতাপ করতে হবে। তাই তিনি বলেছেন, ক্রুব্ধ অবস্থায় শাস্তি দিবে না।

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. বলেছেন, শিশুদেরকে প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। অন্যান্য গুনাহ তো তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের উপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তওবার দ্বারা মাফ হয় না। যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করে। এদিকে যার উপর জুলুম করা হয়েছে সে হচ্ছে নাবালেগ। নাবালেগের ক্ষমা শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য এ অপরাধের মাফ পাওয়া খুবই জটিল। আর তাই শিশুদেরকে প্রহার করা এবং তাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত।-ইসলাহী মাজালিস, মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী। 

আল্লামা ইবনে খালদূন ছাত্রদের প্রহার ও কঠোরতাকে ক্ষতিকর আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, খুব স্মরণ রাখবেন। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে প্রহার করা এবং ডাঁট-ধমক দেওয়া শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা উস্তাদের অযোগ্যতা ও ভুল শিক্ষা পদ্ধতির নমুনা। প্রহার করার ফলে শিশুদের মনে শিক্ষকের কঠোরতার প্রভাব বিরাজ করে। তাদের মন-মানসিকতায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং তারা লেখাপড়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কঠোরতা তাদেরকে অধঃপতনমুখী করে তোলে। অনেক সময় তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি বলেন, প্রহার ও কঠোরতার কারণে শিশুদের মাঝে মিথ্যা বলা ও দুষ্কর্মের মানসিকতা সৃষ্টি হয়। তাদের আত্মমর্যাদাবোধ ও উচ্চ চেতনা দূর হয়ে যায়। শিক্ষকের মারধর থেকে বাঁচার জন্য তারা নানা অপকৌশল, মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এই সকল ত্রুটি তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যায়। উত্তম চরিত্র ও সুন্দর মানসিকতার পরিবর্তে অসৎ চরিত্র ও অনৈতিকতার ভিত রচিত হয়।

এসব ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা ও নীতি নৈতিকতার বিষয়টি বাদ দিলেও শিশুদের প্রহারের অশুভ প্রতিক্রিয়া হয় বহুরূপী ও বহুমুখী। প্রথমত যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সুনামের সাথে তার শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে আসছে মারধরের দু-একটি ঘটনাই তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্য যথেষ্ট।

দ্বিতীয়ত দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি বিরূপ মানসিকতার সৃষ্টি হয়। অনেক দ্বীনদার মুসলিম পরিবারেও এ অভিযোগ শোনা যায় যে, বাচ্চারা মাদরাসায় যেতে চায় না শিক্ষকের মারধর ও কঠোরতার কারণে। তৃতীয়ত, বাইরে মাদরাসার শিক্ষকদের ব্যাপারে দুর্নাম রটে যায় যে, তারা সবাই ছাত্রদের প্রহার করে। দুয়েকজনের অজ্ঞতামূলক আচরণের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজকে দুর্নাম বহন করতে হয়।

একদিকে জাগতিক শিক্ষার জন্য দুনিয়াবী লোকেরা শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন নিয়ে শিশু-কিশোরদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে এবং ইসলামের দেওয়া উন্নত চরিত্র ও মহৎ আচরণ, কোমল ও বিনম্র ভাষায় কথা বলে তাদেরকে জাগতিক শিক্ষার সুফল দেখাচ্ছে, অন্যদিকে দ্বীনী শিক্ষার সঙ্গে জড়িত দু-একজন ব্যক্তি ইসলামী দিক-নির্দেশনা ও শিক্ষার সুন্দর বৈশিষ্ট্য, উলামায়ে কেরামের মহৎ গুণাবলী পরিত্যাগ করে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা অত্যন্ত নাজুক বিষয়। এ জন্য উপযুক্ত শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালু করা এবং তাতে অংশ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের জন্য এ বিষয়ের প্রাচীন ও আধুনিক কিছু বইপত্র অধ্যয়ন করাও জরুরী। ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে আগামীতেও কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। 

মূল লিংক : https://www.alkawsar.com/bn/article/588/


সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করা হয়েছে এটা কি সঠিক

 কলম কি সর্বপ্রথম সৃষ্টি?

আল্লাহ পাক রব্বুল আ’লামীন সর্ব প্রথম কি সৃষ্টি করেছেন এটা আলোচনার মূল বিষয়ঃ

যেমন হযরত উবাদা ইবনে ছামিতرضي الله عنه থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে,

“নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেছেন।অতঃপর কলমকে বললেন,লিখ।কলম বললঃ হে প্রভূ! কি লিখবো? আল্লাহ বললেনঃ লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।“

রেফারেন্সঃ

★মুসনাদে আবু দাউদ তায়লাসীঃ হাদিসঃ ৫৭৮নং

★মুসনাদে ইবনে জা’দঃ হাদিস নংঃ ৩৪৪৪

★মুসনাদে আহমদঃ হাদিস নংঃ ২২৭০৭

★তিরমিযী শরীফঃ হাদিস নংঃ ২১৫৫।সনদ সহীহ।




এই হাদিসের প্রথম অংশটি দ্বারা বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি হচ্ছে ‘কলম’।কিন্তু শেষ অংশটি দ্বারা বুঝা যায় “কলম” প্রথম সৃষ্টি নয়। কারণ হাদিসটির শেষে” আল্লাহ তাআলা বললেন: লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।”

এই এবারত দ্বারা বুঝা যায়, কলম সৃষ্টির পূর্বেও অনেক কিছু ছিল।কারণ এখানে ( ‘মা কানা’ ) দ্বারা অতীতকালের ঘটনা বুঝায়।

এখানে ‘কলম’ প্রথম সৃষ্টি যা কলমের সম্মানার্থে বলা হয়েছে, মূলত প্রথম সৃষ্টি ‘কলম’ নয়।

আর আমাদের দেশের কিছু মানুষ আছে,যারা হাদিসের প্রথম অংশ দিয়ে মানুষকে বোঝায় ,দেখ প্রথম সৃষ্টি কলম।অথচ হাদিসের পরের অংশ পড়লেই বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি কলম নয়।

দরূদ শরীফ পড়লে কি ধরণের গুণাহ মাফ হয়

 প্রশ্ন-বিস্তারিত: একজন গুনাগার পাপি ব্যাক্তি যার দোয়া মন্দ কাজের ফলে কবুল হয়না, এমন ব্যক্তি যদি নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপর দরূদ পাঠ করে তবে কি সে দরূদ পাঠের নিশ্চত ফজিলত লাভ করবে?(যেমন তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষন হওয়া,গুনাহ মিটে যাওয়া ইত্যাদি)


উত্তর : দেখুন মন্দ কাজ, গুনাহ এগুলোর কিছু স্তর আছে, যেমন: নামাজ রোজা হজ্জ ইত্যাদি আল্লাহর হক, আবার অন্য ক্ষেত্রে আছে বান্দার হক্ব। দরূদ যতই পড়ুক, দোয়া যতই করুক, অন্যের সম্পদ আত্মসাতের গুনাহ মাফ হবেনা, বা বান্দার হক্ব মাফ হবেনা। এছাড়া দৈনন্দিন ছগিরা গুনাহ দরুদ শরীফ পড়লে মাফ হবে। কিন্তু ফরজ নামাজ আদায় না করে বা কবীরা গুণাহ করলে, তা মফের জন্য তওবা শর্ত, শুধু দরূদ শরীফ দ্বারা তা মাফ হবেনা। সুতরাং, কবীরা গুনাহ এবং বান্দার হক্ব নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া ছোট খাটো ছগিরা গুণাহ, দরূদ শরীফ পড়লে মাফ হয়ে যাবে।

গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিলে তা কার্যকরী হবে কি ?

 অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে তালাক

অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যায়। তবে গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। এ ক্ষেত্রে ৯০ দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হবে৷
অর্থাৎ স্ত্রী গর্ভবতী হলে, সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। তবে মনে রাখতে হবে এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্ত্রী পূর্ণ ভরণপোষণ পেতে আইনত হকদার।  

সন্তানের দায়ভার 

তালাকের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। এ ক্ষেত্রে ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে৷ তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা বহন করবে৷


এক সাথে তিন তালাক দিলে তা তিন তালাক হবে নাকি এক তালাক হিসেবে গণ্য হবে, এ নিয়ে মতভেদ আছে। বেশীর ভাগ আলেমের মতে এক সাথে তিন তালাক দিলে তা তিন তালাক হিসেবেই কার্যকর হবে, তবে, কোনো কোনো আলেমের মতে এক সাথে তিন তালাক দিলে তা এক তালাক হিসেবেই গন্য হবে, কেননা, এক তুহুরে একটির বেশী তালাক দেওয়া যায়না। 


===========================


প্রশ্ন

জনৈক পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে স্ত্রীকে বলল: 'তোকে তালাক'। তখন স্ত্রী তাকে গালি দিল। গালি খেয়ে স্বামী তার পেটে লাথি মারল ও ধাক্কা দিল। এতে করে স্ত্রী সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল এবং পাঁচ মাসের সন্তান প্রসব করে দিল। পরবর্তীতে স্বামী অনুতপ্ত হল এবং শশুর বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চাইল। ঐ মহিলার বাবা আমার সাথে পরামর্শ করলে আমি তাকে বললাম: আমি আপনার জিজ্ঞাসার ব্যাপারে কোন একজন আলেমকে ফতোয়া জিজ্ঞেস করব। কেননা হতে পারে গর্ভস্থিত সন্তান প্রসব হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে হুকুম কি হবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

আলেমগণের ইজমা (সর্বসম্মত অভিমত) হচ্ছে- গর্ভবতী তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত হচ্ছে­- সন্তান প্রসব। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলছেন: "আর গর্ভবতীদের ইদ্দত হল তাদের সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত।"[সূরা তালাক, আয়াত: ৪]

আলেমগণ এ মর্মেও ইজমা করেছেন যে, যদি কোন নারী এমন কিছু প্রসব করে যার আকৃতি মানুষের আকৃতি বুঝা যায় এর দ্বারাও সে নারীর ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে।[আল-মুগনি (১১/২২৯)] গর্ভস্থিত ভ্রূণের আকৃতি গঠন শুরু হয় ৮০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভ্রূণের বয়স ৯০ দিন পূর্ণ হলে।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যে নারী তার পাঁচ মাসের ভ্রূণ প্রসব করেছেন সকল আলেমের মতানুযায়ী তার ইদ্দত শেষ। সুতরাং ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার স্বামী তাকে আর ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার রাখেন না।

কিন্তু, স্বামী যদি চান তাহলে নতুন একটি আকদ (বিয়ের চুক্তি) করতে পারেন। সেক্ষেত্রে মহিলার সম্মতি, অভিভাবকের উপস্থিতি, দুইজন সাক্ষী ও মোহরানা নির্ধারণ করতে হবে।

আর অপরিপক্ক ভ্রূণ নষ্ট করার কারণ হওয়ার প্রেক্ষিতে এই পুরুষের উপর দুইটি বিষয় আবশ্যক হবে:

এক: ভুলক্রমে হত্যার কাফ্‌ফারা আবশ্যক। আর তা হল- একজন মুমিন দাস আযাদ করা। যদি দাস না পাওয়া যায় তাহলে লাগাতর দুইমাস রোযা রাখা। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: "কেউ যদি কোন ঈমানদার লোককে ভুলক্রমে হত্যা করে তাহলে তাকে একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে এবং নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে, তবে তারা মাফ করে দিলে ভিন্ন কথা"। এরপর তিনি বলেন: "যে তা পাবে না তাকে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পাপমুক্তি কামনায় অবিরাম দুই মাস রোযা রাখতে হবে। আল্লাহ্‌ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।"[সূরা নিসা, আয়াত: ৯২]

দুই: ভ্রূণের রক্তমূল্য (মায়ের রক্তমূল্যের ১০ ভাগের একভাগ। মুসলিম নারীর রক্তমূল্য হচ্ছে ৫০টি উট। বর্তমানে সৌদি রিয়ালে এর মূল ধরা হয় ৬০ হাজার রিয়াল) পরিশোধ করতে হবে। তাই পিতার উপর আবশ্যক হল ৬ হাজার রিয়াল কিংবা এর সমপরিমাণ অন্য মুদ্রা এই ভ্রূণের ওয়ারিসগণকে পরিশোধ করা। ওয়ারিশগণের মাঝে এই অর্থ এমনভাবে বণ্টন করা হবে যেন এই ভ্রূণ তাদেরকে রেখে মারা গেছে। পিতা এই অর্থ থেকে কোন কিছু পাবে না। কেননা কোন হত্যাকারী নিহতের সম্পত্তির ওয়ারিশ হয় না। ইবনে কুদামা বলেন: "যদি ভ্রূণ হত্যাকারী অপরাধীটি পিতা হয় কিংবা ভ্রূণের ওয়ারিশদের মধ্য থেকে অন্য কেউ হয় তাহলে হত্যাকারীর উপর গুর্‌রাহ (একটি দাস কিংবা দাসী আযাদ করা। যার মূল্য হচ্ছে- পাঁচটি উট। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৬ হাজার সৌদি রিয়াল) আবশ্যক হবে। সে ব্যক্তি এই ভ্রূণ থেকে কোন কিছু উত্তরাধিকার হিসেবে পাবে না। এবং একটি গোলাম আযাদ করবে। এটি যুহরি, শাফেয়ি ও অন্যান্য আলেমগণের অভিমত। সমাপ্ত।[আল-মুগনি (১২/৮১)]

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ। আমাদের নবী মুহাম্মদ-এর উপর আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।

ইমাম মুসল্লি থেকে উঁচু স্থানে দাঁড়ালে নামায হবে কি?

 


প্রশ্ন

মুফতী সাহেরেব কাছে আমার জানার বিষয় হল, যদি ইমাম যেখানে দাঁড়িয়েছে সেটি মুক্তাদীদের কাতার থেকে দুই হাত উঁচু হয়, তাহলে এভাবে জামাত করে নামায পড়া যাবে কি?

আমাদের এলাকায় মাহফিলের সময় এমনটি করা হয়ে থাকে। ইমাম সাহেব স্টেজের উপর দাঁড়ান, আর মুক্তাদীগণ নিচে দাঁড়ায়। স্টেজ কয়েক হাত উঁচু হয়ে থাকে।

এভাবে নামায আদায় করা কতটুকু সহীহ?

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

মুক্তাদী থেকে এক হাত উঁচুতে দাড়াতে পারে। এর চেয়ে বেশি উঁচুতে দাঁড়ালে উক্ত নামায মাকরূহে তাহরীমী হবে।

সুতরাং এক হাতের চেয়ে উঁচু স্টেজে ইমাম আর মুক্তাদী সব নিচে দাড়িয়ে নামায পড়লে তা মাকরূহ হবে।

তবে এক্ষেত্রে যদি উপরে ইমামের সাথে কিছু মুসল্লি থাকে, তাহলে নামায মাকরূহ ছাড়াই শুদ্ধ হবে।

عَنْ عَدِيِّ بْنِ ثَابِتٍ الْأَنْصَارِيِّ، حَدَّثَنِي رَجُلٌ، أَنَّهُ كَانَ مَعَ عَمَّارِ بْنِ يَاسِرٍ بِالْمَدَائِنِ فَأُقِيمَتِ الصَّلَاةُ فَتَقَدَّمَ عَمَّارٌ وَقَامَ عَلَى دُكَّانٍ يُصَلِّي وَالنَّاسُ أَسْفَلَ مِنْهُ، فَتَقَدَّمَ حُذَيْفَةُ فَأَخَذَ عَلَى يَدَيْهِ فَاتَّبَعَهُ عَمَّارٌ، حَتَّى أَنْزَلَهُ حُذَيْفَةُ فَلَمَّا فَرَغَ عَمَّارٌ مِنْ صَلَاتِهِ قَالَ لَهُ حُذَيْفَةُ: أَلَمْ تَسْمَعْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِذَا أَمَّ الرَّجُلُ الْقَوْمَ فَلَا يَقُمْ فِي مَكَانٍ أَرْفَعَ مِنْ مَقَامِهِمْ» أَوْ نَحْوَ ذَلِكَ؟، قَالَ عَمَّارٌ: «لِذَلِكَ اتَّبَعْتُكَ حِينَ أَخَذْتَ عَلَى يَدَيَّ

আদী ইবনু ছাবেত (রাঃ) জনৈক ব্যক্তির সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, একদা আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাঃ) -র সাথে মাদায়েনে ছিলেন। নামাযের জন্য ইকামত দেয়া হলে আম্মার (রাঃ) একটি দোকানের উপর (উঁচু স্থানে) দাঁড়িয়ে নামাযে ইমামতি করতে যান, মুকতাদীরা নিচু স্থানে দন্ডায়মান ছিলেন।  হুযায়ফা (রাঃ) অগ্রসর হয়ে আম্মার (রাঃ)-র হাত ধরে তাকে নীচে নামিয়ে আনেন। আম্মার (রাঃ) নামায শেষ করলে হুযায়ফা (রাঃ) তাকে বলেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেননিঃ যখন কোন ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের ইমামতি করবে, সে যেন সমাগত মুসল্লী হতে কোন উঁচু স্থানে দন্ডায়মান না হয়? তখন আম্মার (রাঃ) বলেন, ঐ সময় হাদীছটি আমার স্মরণে আসায় আমি আপনার হস্ত ধারণের অনুসরণ করে নীচে নেমে আসি। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৫৯৮]

وقدر الارتفاع بذراع ولابأس بما دونه، وقيل ما يقع به الإمتياز وهو الأوجه (الدر المختار مع رد المحتار-2/415)

وقيل بمقدار الذراع اعتبارا بالسترة وعليه الاعتماد، كذا فى التبيين وفى غاية البيان هو الصحيح كذا فى البحر الرائق (الفتاوى الهندية-1/108، جديد-1/168)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

নামাজ বসে পড়ার বিধান

প্রশ্ন : বসে বসে নামাজ পড়ার মাসালা একটু আলোচনা করবেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্যগত সমস্যা না থাকলেও অনেকে সুন্নত ও নফল নামাজ বসে পড়ে থাকেন।

উত্তর : ফরজ সালাত ছাড়া যত সুন্নত সালাত আছে সেগুলো বসে আদায় করা জায়েজ। সেখানে বসার অনুমোদন আছে। কিন্তু এ অনুমোদনটুকু এমন যে, সুস্থ থাকলেও পড়তে পারবেন, তবে সওয়াবের ক্ষেত্রে কম-বেশি হয়ে যাবে।

সুতরাং কোনো কাজের অনুমোদন পেলেই সে কাজটা করলে শুদ্ধ নয়। দাঁড়িয়ে পড়লে যে মর্যাদা বা সওয়াব পাওয়া যাবে, বসে পড়লে সে মর্যাদা বা সওয়াব পাওয়া যাবে না। এটিই হলো পার্থক্য।

ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ।


=======================================================


রুকু সেজদা করতে সক্ষম ব্যক্তি ফজরের সুন্নাত বসে আদায় করলে হবে না। দাঁড়িয়েই আদায় করবে। বাকি সুন্নাতে মুআক্কাদাগুলোও দাঁড়িয়ে আদায় করা উচিত। বাকি বসে আদায় করলেও হবে।

কিন্তু এছাড়া বাকি সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদা ও নফল নামায বসে আদায় করতে পারবে। তবে দাঁড়িয়ে রুকু সেজদা করে নামায আদায় করাই উত্তম।


فى الدر المختار: ومنها القيام……. فِي فَرْضٍ) وَمُلْحَقٍ بِهِ كَنَذْرٍ وَسُنَّةِ فَجْرٍ فِي الْأَصَحِّ (لِقَادِرٍ عَلَيْهِ)

وفى رد المحتار: (قَوْلُهُ وَسُنَّةُ فَجْرٍ فِي الْأَصَحِّ) أَمَّا عَنْ الْقَوْلِ بِوُجُوبِهَا فَظَاهِرٌ، وَأَمَّا عَلَى الْقَوْلِ بِسُنِّيَّتِهَا فَمُرَاعَاةً لِلْقَوْلِ بِالْوُجُوبِ. وَنُقِلَ فِي مَرَاقِي الْفَلَاحِ أَنَّ الْأَصَحَّ جَوَازُهَا مِنْ قُعُودٍ ط.

أَقُولُ: لَكِنْ فِي الْحِلْيَةِ عِنْدَ الْكَلَامِ عَلَى صَلَاةِ التَّرَاوِيحِ لَوْ صَلَّى التَّرَاوِيحَ قَاعِدًا بِلَا عُذْرٍ، قِيلَ لَا تَجُوزُ قِيَاسًا عَلَى سُنَّةِ الْفَجْرِ فَإِنَّ كُلًّا مِنْهُمَا سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ وَسُنَّةُ الْفَجْرِ لَا تَجُوزُ قَاعِدًا مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ بِإِجْمَاعِهِمْ كَمَا هُوَ رِوَايَةُ الْحَسَنِ عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ، قَالَ: سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَلاَةِ الرَّجُلِ وَهُوَ قَاعِدٌ، فَقَالَ: «مَنْ صَلَّى قَائِمًا فَهُوَ أَفْضَلُ، وَمَنْ صَلَّى قَاعِدًا فَلَهُ نِصْفُ أَجْرِ القَائِمِ، وَمَنْ صَلَّى نَائِمًا فَلَهُ نِصْفُ أَجْرِ القَاعِدِ (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب صفة الصلاة، مَطْلَبٌ قَدْ يُطْلَقُ الْفَرْضُ عَلَى مَا يُقَابِلُ الرُّكْنَ وَعَلَى مَا لَيْسَ بِرُكْنٍ وَلَا شَرْطٍ، بحث القيام-2/131-132، طحطاوى على مراقى الفلاح، كتاب الصلاة، فصل فى صلاة النفل جالسا-402

হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ব্যক্তির বসে নামায পড়া বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাবে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায পড়ে সে উত্তম। বসে যে নামায পড়ে, সে দাড়িয়ে নামায আদায়কারীর তুলনায় অর্ধেক সওয়াব পায়। আর যে ব্যক্তি শুয়ে নামায পড়ে, সে বসে নামায আদায়কারীর তুলনায় অর্ধেক সওয়াব পায়। [বুখারী, হাদীস নং-১১১৬]

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন :  মাওলানা মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

সূত্র: আহলে হক মিডিয়া



 

ইসলামে রক্ত দানের বিধান

 রক্ত মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু মানুষে মানুষে কতো তফাৎ! কেউ রক্ত দেয়। আবার কেউ রক্ত নেয়। কেউ কেউ তো এমনও আছে, যারা রক্ত বইয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর জিঘাংসায় লিপ্ত হয়। খুন-পিয়াসী ‘খুনিয়া’ হয়ে ওঠে। মানবতার গায়ে এঁকে দেয় কলংক-চিহ্ন। কিন্তু এ রক্তই অন্যজন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার অমর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুমূর্ষ ভাইয়ের জন্য আনন্দচিত্তে ও অকাতরে বিলিয়ে দেয়। শুধু সওয়াব-পুণ্যের আশায়; আর একটুখানি হাসির ঝিলিক দেখতে।

রক্ত সাধারণত শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নাপাক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় (প্রয়োজন ও কারণ ছাড়া) এক জনের রক্ত অন্যের শরীরে স্থানান্তর করা হারাম।

তাই রক্ত গ্রহণের বিকল্প নেই, এমন অসুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নে লিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে-

এক. যখন কোনো অসুস্থ ব্যাক্তির জীবননাশের আশংকা দেখা দেয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে তার শরীরে অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত বাঁচানোর কোনো পন্থা না থাকে, তখন রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং এ ক্ষেত্রে ইসলাম আরো উৎসাহ দিয়েছে।

দুই. রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুর আশংকা নেই বটে, কিন্তু রক্ত দেওয়া ছাড়া তার জীবনের ঝুঁকি বাড়ে অথবা রোগমুক্তি বিলম্বিত হয়; এমন অবস্থায় রক্ত দেওয়া জায়েজ ও জরুরি।

তিন. যখন রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দেয় না, বরং রক্ত না দেওয়ার অবকাশ থাকে; তখন অযথা রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকা চাই।

চার. যখন জীবননাশের এবং অসুস্থতা বিলম্বিত হওয়ার আশংকা থাকে না, বরং শুধুমাত্র শক্তি বৃদ্ধি এবং সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্য হয়; সে অবস্থায় ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক রক্তদান জায়েজ নয়।

রক্ত ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান
রক্ত বিক্রি জায়েজ নয়। কিন্তু যে শর্তের ভিত্তিতে প্রথম সূরতে রক্ত দেয়া জায়েজ সাব্যস্ত হয়েছে, ওই অবস্থায় যদি যথা রক্ত বিনামূল্যে পাওয়া না যায়, তখন তার জন্য মূল্যে দিয়ে রক্ত ক্রয় করা জায়েজ। তবে যে রক্ত দিবে তার জন্য রক্তের মূল্য নেয়া জায়েজ নয়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৮)

অমুসলিমের রক্ত মুসলিমের শরীরে স্থানান্তরের বিধান
অমুসলিমের রক্ত মুসলিমের শরীরে স্থানান্তর জায়েজ। মুসলিম আর অমুসলিমের রক্তে কোনো প্রভেদ নেই। কিন্তু শরিয়তসিদ্ধ কথা হলো, কাফের-ফাসেকের স্বভাবে মন্দ ও নিন্দনীয় প্রভাব রয়েছে। কারণ তারা নাপাক ও হারাম খাদ্য গ্রহণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর এতে করে খাবারের প্রভাব রক্ত-মাংসে পড়ে। তাই সে ক্ষেত্রে অমুসলিমের মন্দ স্বভাব-চরিত্রের প্রভাব মুসলিমের স্বভাব-চরিত্রে রক্তের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হওয়ার বেশ আশংকা থেকে যায়। (এজন্য শিশুর জন্য পাপাচারী মহিলার দুধ পান করা মাকরুহ করা হয়েছে। ) সুতরাং এসব ক্ষতির দিকে লক্ষ্য করে, অমুসলিমের রক্ত নেওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা উচিত। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪০)

স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে রক্তদানের বিধান
স্বামীর রক্ত স্ত্রীর শরীরে, স্ত্রীর রক্ত স্বামীর শরীরে প্রবেশ করানো জায়েজ। তারা একে-অপরের জন্য অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মতো। তারা একে-অন্যকে রক্ত দিলে বিয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। বৈবাহিক সম্পর্কও যথারীতি বহাল থাকে। কেননা ইসলামী শরিয়তের সূত্র মতে, মাহরামের সম্পর্ক দুধ পানের মাধ্যমে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন। আর দুধ পানের দ্বারা মাহরামের সম্পর্ক স্থাপনের বয়স আড়াই বছর। সুতরাং আড়াই বৎসর পর কোনো মহিলার দুধ পান করার দ্বারা যেমন মাহরাম সাব্যস্ত হয় না, তেমনি রক্ত নেওয়া ও দেওয়ার মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর মাঝে মাহরামের সম্পর্ক তৈরি হয় না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪০)


==========================================

ইসলাম একটি জীবন্ত ও সচল ধর্ম। প্রতি যুগে, প্রতিটি প্রশ্নের সমাধানে ইসলাম কথা বলেছে। বিভিন্ন অসুবিধায় মানুষের রক্ত প্রদান-গ্রহণের প্রয়োজন হয়। ইসলামে এ ব্যাপারেও রয়েছে সুন্দর নির্দেশনা। স্বেচ্ছায় নিজের রক্ত অন্য কারও প্রয়োজনে দান করাই রক্তদান। 

রক্ত দানকারীরা খুবই ভাগ্যবান। দুনিয়াতেও তাদের উপকার, আখেরাতেও তাদের উপকার। দুনিয়ার উপকারটা দুই ধরনের। একটি হলো ব্যক্তিগত উপকার আর অন্যটি হলো জনগণের উপকার। ব্যক্তিগত উপকারের কথা বলা হলে বলতে হবে যে, রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। 

রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ‘বোনম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকা জন্ম হয়, ঘাটতি পূরণ হয়। বছরে তিনবার রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলে ও নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়ায়। নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার ভালো থাকে। রক্তদান অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার প্রতিরোধেও সহায়তা করে। স্থূলদেহী মানুষের ওজন কমাতে রক্তদান সহায়ক।

তবে রক্তদাতাকে অবশ্যই পূর্ণবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স হতে হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে রক্তদান করতে পারেন। এতে স্বাস্থ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। তবে রক্তদানের পদ্ধতি ও পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অযথা ভীতির কারণেই মূলত অনেকে রক্ত দিতে 
দ্বিধান্বিত হন।

রক্ত দেওয়া কখন বৈধ : 
রক্ত শরীরের ভেতরে থাকাবস্থায় পবিত্র। আর শরীর থেকে বের হয়ে গেলে অপবিত্র। এর আসল দাবি হলো, অন্যের শরীরে রক্ত দেওয়া হারাম হওয়া। তাই স্বাভাবিক অবস্থায় (প্রয়োজন ও কারণ ছাড়া) একজনের রক্ত অন্যের শরীরে স্থানান্তর করা শরিয়তে নিষেধ। তাই রক্ত গ্রহণের বিকল্প নেই, এমন অসুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।

১. যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে তার শরীরে অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত বাঁচানোর কোনো পন্থা না থাকে, তখন রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং এ ক্ষেত্রে ইসলাম আরও উৎসাহ দিয়েছে। ২. রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা নেই বটে, কিন্তু রক্ত দেওয়া ছাড়া তার জীবনের ঝুঁকি বাড়ে অথবা রোগমুক্তি বিলম্বিত হয়; এমন অবস্থায় রক্ত দেওয়া জায়েজ ও জরুরি। ৩. যখন রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দেয় না, বরং রক্ত না দেওয়ার অবকাশ থাকে; তখন অযথা রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। ৪. যখন জীবননাশের এবং অসুস্থতা বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, বরং শুধু শক্তি বৃদ্ধি এবং সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে হয়; সে অবস্থায় ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক রক্তদান জায়েজ নয়। (ফাতাওয়া আলমগিরি  ৫/৩৫৫; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩৮৯)

ফকিহগণ নারীর দুধের ওপর কিয়াস (তুলনা) করে রক্ত দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ যেভাবে বাচ্চার জন্য দুধ পান করার সময়ে মানুষের অংশ হওয়া সত্ত্বেও নারীর দুধ পান করা বৈধ। ঠিক তেমনিভাবে প্রয়োজনের সময় মানুষের রক্ত অন্য মানুষের মাঝে স্থানান্তর করাও বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস ও যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। অবশ্য যে ব্যক্তি অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানি ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোনো পাপ নেই।’ (সুরা বাকারা : ১৭৩)। বৈধ ক্ষেত্রে রক্তদান অনেক সওয়াবের কাজ। এতে একটি প্রাণকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেকোনো একজন ব্যক্তির জীবন রক্ষা করল সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করল।’ (সুরা মায়িদা : ৩২)

রক্ত বেচাকেনা : 
রক্ত দেওয়া বৈধ তবে এর বিনিময় নেওয়া অবৈধ। কিন্তু যে শর্তের ভিত্তিতে রক্ত দেওয়া জায়েজ, ওই অবস্থায় যদি রক্ত বিনামূল্যে পাওয়া না যায়, তখন তার জন্য মূল্য দিয়ে রক্ত ক্রয় করা জায়েজ। তবে যে রক্ত দেবে তার জন্য রক্তের মূল্য নেওয়া জায়েজ নয়। রক্ত কেনা কিংবা বেচা উভয়ই মানব জীবননাশের আশঙ্কা তৈরি করে। (আল বাহরুর রায়েক : ৬/১১৫; জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৩৮)

অমুসলিমদের রক্ত দেওয়া-নেওয়া : 
অমুসলিম থেকে রক্ত নেওয়া ঠিক নয়। তবে রক্ত নিয়ে নিলে এতে করে মুসলমান রোগী কাফের হয়ে যাবে না। তার সন্তানাদিও কাফের হয়ে জন্ম নেবে না। তবে এ কথা স্পষ্ট যে, কাফের, পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের রক্তে যে খারাপ প্রভাব থাকে এর প্রভাব খোদাভীরু মুসলমানের রক্তে পড়ার শক্তিশালী সম্ভাবনা বিদ্যমান। এ জন্য যথাসম্ভব এদের রক্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকাই উচিত। হ্যাঁ, তাদের রক্ত দিতে কোনো সমস্যা নেই। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৮/৩৩৩; জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৪০)

স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে রক্তদানের বিধান: 
স্বামী স্ত্রীকে রক্ত দেওয়া, স্ত্রী স্বামীকে রক্ত দেওয়া জায়েজ। রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা একে অন্যের জন্য অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মতো। তারা একে অন্যকে রক্ত দিলে বিয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। বৈবাহিক সম্পর্কও যথারীতি বহাল থাকে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৪০)
ওষুধ হিসেবে রক্তের ব্যবহার : মানুষের রক্ত ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা জায়েজ নেই। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৮/৩২৮)

ব্লাড ব্যাংকে রক্তদান : 
রক্তের ব্যাংক যেখানে লোকেরা স্বেচ্ছায় রক্ত দান করে এবং তারা ব্যাংকগুলো অভাবগ্রস্তকে বিনামূল্যে রক্ত সরবরাহ করে সেখানে মুসলমানদের জন্য রক্তদান করা জায়েজ। এটি মানব সেবার অন্তর্ভুক্ত। (কিতাবুন নাওয়াজিল : ১৬/২১৫)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে নিয়মিত রক্তদান করে অসুস্থ মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার তওফিক দান করুন।


==============================================

প্রশ্ন : আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পিং কিংবা কোনো রোগীকে রক্ত দিয়ে থাকি। আমি শুনেছি, এটি নাকি কোনো হাদিসে নেই। তবে বিভিন্ন আলেমদের মতে জায়েজ। আমার প্রশ্ন হলো, রক্তদানের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?

উত্তর : ধন্যবাদ আপনাকে। বিভিন্ন ক্যাম্পিংয়ে যেই রক্ত দেওয়া হয়ে থাকে বা কাউকে রক্ত দেওয়ার ব্যাপারটি হাদিসে নেই। কোরআন ও হাদিসে এসব থাকার তো প্রশ্ন আসে না। এই চিকিৎসাগুলো ছিল না, এত প্রযুক্তি ছিল না। তবে এসব না থাকলেও অনেক মূলনীতি দেওয়া আছে। সেসব মূলনীতি থেকেই আমরা নামাজ পড়ছি বা বিভিন্ন দিকনির্দেশনা মানছি। রক্তদানের ব্যাপারটি অনেক পরে আবিষ্কার হয়েছে। আর রক্তদানের পর রক্তদাতার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাই আলেমরা রক্তদানের ব্যাপারে মত দিয়েছেন। রক্ত দান করা জায়েজ। কিন্তু রক্ত বিক্রি করা বা রক্তের ব্যবসা করা জায়েজ নয়। যেহেতু এটি একটি সহযোগীতামূলক কাজ কিংবা কারো জীবনে সাহায্য হয় তাই রক্তদান জায়েজ। এটি বৈধ, এটিকে আলেমরা জায়েজ বলেছেন। কেউ রক্তদান করলে তার ফজিলত পাবেন। এটি একটি সদকা।

============================================

আবহমানকাল ধরে মানবদেহের জন্য রক্তদান এবং রক্তগ্রহণের ব্যবহার চলছে। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মহামূল্যবান জীবন ও দেহ সুরক্ষায় রক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য তরল উপাদান। যে-কোনো দুর্ঘটনায় শরীর থেকে রক্ত ঝরে গেলে দেহের অভ্যন্তরে অন্ত্র বা অন্য কোনো অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হলে অস্ত্রোপচারের জন্য রক্তের খুব প্রয়োজন। প্রসবজনিত অপারেশনের সময় বা বড় ধরনের দুর্ঘটনার মতো নাজুক অবস্থায় রক্ত দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। মানবদেহে রক্তশূন্যতার জন্য রক্তগ্রহণের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি রক্তের চাহিদা পূরণের জন্য রক্ত বিক্রয় বৈধ নয়। তবে বিনামূল্যে রক্ত না পেলে রোগীর জন্য রক্ত ক্রয় করা বৈধ; কিন্তু এতে বিক্রেতা গুনাহগার হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক রোগের ওষুধ আছে। সুতরাং যখন রোগ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা হয়, তখন আল্লাহর হুকুমে রোগী আরোগ্য লাভ করে।’ (মুসলিম)।

মানবতার কল্যাণে এটি একটি বিশেষ ও উত্তম উদ্যোগ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টি জানা তাই সকল মানুষের জরুরি। বিশেষ করে যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য। এ নিবন্ধে ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। রক্ত মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু মানুষে মানুষে কত তফাত! কেউ রক্ত দেয়, আবার কেউ রক্ত নেয়। কেউ কেউ তো এমনও আছে, যারা রক্ত বইয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর জিঘাংসায় লিপ্ত হয়। খুনপিয়াসী ‘খুনিয়া’ হয়ে ওঠে। মানবতার গায়ে এঁকে দেয় কলঙ্কচিহ্ন। কিন্তু এ রক্তই অন্যজন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার অমর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুমূর্ষু ভাইয়ের জন্য আনন্দচিত্তে ও অকাতরে বিলিয়ে দেয়। শুধু সওয়াব-পুণ্যের আশায়; আর একটুখানি হাসির ঝিলিক দেখতে।

রক্ত সাধারণত শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নাপাক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় (প্রয়োজন ও কারণ ছাড়া) একজনের রক্ত অন্যের শরীরে স্থানান্তর করা হারাম। তাই রক্ত গ্রহণের বিকল্প নেই, এমন অসুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নে লিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।

এক. যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে তার শরীরে অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত বাঁচানোর কোনো পন্থা না থাকে, তখন রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং এ ক্ষেত্রে ইসলাম আরো উৎসাহ দিয়েছে।

দুই. রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা নেই বটে, কিন্তু রক্ত দেওয়া ছাড়া তার জীবনের ঝুঁকি বাড়ে অথবা রোগমুক্তি বিলম্বিত হয়; এমন অবস্থায় রক্ত দেওয়া জায়েজ ও জরুরি।

তিন. যখন রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দেয় না, বরং রক্ত না দেওয়ার অবকাশ থাকে; তখন অযথা রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকা চাই।

চার. যখন জীবননাশের এবং অসুস্থতা বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, বরং শুধু শক্তি বৃদ্ধি এবং সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্য হয়; সে অবস্থায় ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক রক্তদান জায়েজ নয়।

রক্ত ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান : রক্ত বিক্রি জায়েজ নয়। কিন্তু যে শর্তের ভিত্তিতে প্রথম সুরতে রক্ত দেওয়া জায়েজ সাব্যস্ত হয়েছে, ওই অবস্থায় যদি যথা রক্ত বিনামূল্যে পাওয়া না যায়, তখন তার জন্য মূল্যে দিয়ে রক্ত ক্রয় করা জায়েজ। তবে যে রক্ত দেবে তার জন্য রক্তের মূল্য নেওয়া জায়েজ নয়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৩৮)।

অমুসলিমের রক্ত মুসলিমের শরীরে স্থানান্তরের বিধান : অমুসলিমের রক্ত মুসলিমের শরীরে স্থানান্তর জায়েজ। মুসলিম আর অমুসলিমের রক্তে কোনো প্রভেদ নেই। কিন্তু শরিয়তসিদ্ধ কথা হলো, কাফের-ফাসেকের স্বভাবে মন্দ ও নিন্দনীয় প্রভাব রয়েছে। কারণ তারা নাপাক ও হারাম খাদ্য গ্রহণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর এতে করে খাবারের প্রভাব রক্ত-মাংসে পড়ে। তাই সে ক্ষেত্রে অমুসলিমের মন্দ স্বভাব-চরিত্রের প্রভাব মুসলিমের স্বভাব-চরিত্রে রক্তের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হওয়ার বেশ আশঙ্কা থেকে যায়। (এজন্য শিশুর জন্য পাপাচারী মহিলার দুধ পান করা মাকরুহ করা হয়েছে।)। সুতরাং এসব ক্ষতির দিকে লক্ষ করে, অমুসলিমের রক্ত নেওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা উচিত। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৪০)।

স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে রক্তদানের বিধান : স্বামীর রক্ত স্ত্রীর শরীরে, স্ত্রীর রক্ত স্বামীর শরীরে প্রবেশ করানো জায়েজ। তারা একে-অপরের জন্য অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মতো। তারা একে-অন্যকে রক্ত দিলে বিয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। বৈবাহিক সম্পর্কও যথারীতি বহাল থাকে। কেননা ইসলামী শরিয়তের সূত্রমতে, মাহরামের সম্পর্ক দুধ পানের মাধ্যমে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন। আর দুধ পানের দ্বারা মাহরামের সম্পর্ক স্থাপনের বয়স আড়াই বছর। সুতরাং আড়াই বছর পর কোনো মহিলার দুধ পান করার দ্বারা যেমন মাহরাম সাব্যস্ত হয় না, তেমনি রক্ত নেওয়া ও দেওয়ার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মাহরামের সম্পর্ক তৈরি হয় না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৪০)।

রক্তদানের ইতিহাস : ১৪৯২ সালে অষ্টম পোপ যখন স্ট্রোক করেন তখনকার চিকিৎসকরা ধারণা করেছিলেন, পোপের মনে হয় শরীরের কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই ভেবে পোপকে বাঁচানোর জন্য ১০ বছর বয়সের তিনজন ছেলের শরীর থেকে রক্ত বের করে পোপকে পান করানো হয়েছিল। যেহেতু তখন রক্তনালি বলে কিছু আছে, সেটাই জানা ছিল না। তাই সবাই ভাবত রক্ত খেলেই সেটা শরীরে ঢুকে পড়বে। মাত্র একটা স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সেই তিন বাচ্চার রক্ত নেওয়া হয়েছিল। দুঃখজনক হলো, রক্ত নেওয়ার ফলে তিনটা বাচ্চাই মারা যায়। কিন্তু পোপ বেঁচে যায়। সবাই ধারণা করেছিল, সেই রক্তের জন্যই পোপ বেঁচে গেছেন। পরের বছর পোপ সেকেন্ড স্ট্রোক করে মারা যান কোনো ঘোষণা ছাড়াই। তারপর থেকে কেউ আর রক্ত দিতে সাহস করেনি। চলুন ফিরে দেখা যাক কীভাবে রক্তদান মানববিশ্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এলো।

১৬১৬ সালে ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ প্রথম জানতে পারে, মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহিত হয়। ১৬৬৬ সালে ডা. রিচার্ড লোয়ার সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। ১৬৭৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপের নিষেধাজ্ঞা। ১৮১৮ সালে ডা. জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম বলেন, একজন মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেওয়া যাবে।

১৯০১ সালে ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার দেখান, মানুষের রক্তের প্রধানত চারটি গ্রুপ রয়েছে-A, B, AB এবং O. প্রথমবারের মতো মানুষ বুঝল যে, গত ২৭২ বছর ধরে তাদের ভুলটা ঠিক কোথায় হচ্ছিল। তিনি ১৯৪০ সালে আবার Rh group আবিষ্কার করেন, যা আমরা পজিটিভ-নেগেটিভ রক্ত বুঝতে পারি। ১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করানো হয়। এ ধারণা থেকেই ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা ও মেডিকেল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন। ১৯২১ সালে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে ব্রিটিশ রেড ক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেন। সূচিত হয় বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত। পরিশেষে মুমূর্ষু লোকের জীবন রক্ষা ও জনসেবামূলক কাজে যেহেতু ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই, সেহেতু নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য রক্তদান উদ্যাপনের মতো কর্মসূচি ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : এম এম কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা; কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি।


===============================================

রক্তদানের ইসলামী বিধান

 ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

 ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

রক্ত মানবশরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তৈল বা বিদ্যুৎ ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না তেমনি রক্ত ছাড়াও মানুষের জীবন বাঁচে না। রক্তস্বল্পতাও বহু রোগ ও শারীরিক কষ্টের কারণ হয়ে থাকে। অস্ত্রোপচারসহ অন্তত বারোটি রোগের চিকিৎসায় রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের অভাবে অনেক সময় রোগী মারা যায়। বিশেষত ব্লাড ক্যানসার, প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, রক্তশূণ্যতা, ডেঙ্গু, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, একজন সুস্থ মানুষ; যার বয়স আঠারো বছরের নিচে নয় এবং ওজন সাত চল্লিশ কেজি-এর কম নয়, এমন ব্যক্তি বছরে চার বার, আর মহিলা হলে তিন বার রক্ত দিতে পারে। রক্তদানের বহুবিদ উপকার থাকলেও অমূলক ভীতি, ধর্মীয় জ্ঞানের দৈন্যতা, মানবসেবার মনোবৃত্তির অভাব, অসচেতনতা ইত্যাদির কারণে অনেকেই রক্তদানে অনাগ্রহী। অথচ রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগে কষ্ট পাচ্ছে অগণীত মানুষ।


২০০৮ সালের এক জরিপ মতে সারা বিশ্বে বছরে আট কোটি দশ লাখ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয়। শুধু চট্টগ্রামে রক্ত লাগে সত্তর হাজার ব্যাগ। আর জনসংখ্যার শতকরা চারভাগ মানুষ রক্তদান করলে মোট চাহিদার তিনগুণ হবে (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৪ জুন, ২০০৮)। তাই রক্তদান-এর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারীতা সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এ কর্মসূচির প্রতি উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

সন্ধানী, ফাতিমা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট, কল্যাণ, সিটিজি ব্লাড ব্যাংক, কণিকা যাঁরাই স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে কাজ করছেন তাঁদেরকে আপন আপন অবস্থান থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়া দরকার। ধর্মীয়ব্যক্তিগণও এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারেন এ বলে যে, মানুষ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের প্রতি ভালবাসা মানে আল্লাহ তায়ালা প্রতি ভালবাসা।

মানবতার সেবা মানে আল্লাহ তায়ালার সেবা। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু নৈরাকার সেহেতু তাঁর ইন্দ্রিয়সেবা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আর না তিনি কারো সেবার মুখাপেক্ষী। অথচ তাঁর সন্তুষ্টি বিধান করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। সেই সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায় হলো মানুষের সেবা করা। দরিদ্রকে অর্থদান, বুভুক্ষকে খাদ্যদান, তৃষ্ণার্তকে পানিদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, রোগীকে সেবাদান ইত্যাদি আল্লাহ তায়ালার সেবা করার নামান্তর। এগুলো পবিত্র কুরআন-হাদিসের আলোকে প্রমাণিত।

বর্তমান যুগে মানবসেবার অন্যতম কর্মসূচি হলো রক্তমুখাপেক্ষী ব্যক্তিকে রক্তদান করা। তবে রক্তদান ও গ্রহণ একটি আধুনিক বিষয়। এ বিষয়ে ইসলামী বিধান কী- সেটি জানার আগ্রহ আছে অনেকের। আবার এটাকে অঙ্গহানির সাথে তুলনা করা অথবা বৈবাহিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় অথবা ভিন্নধর্মীর রক্তের অনুপ্রবেশ ইত্যাদি প্রশ্নে অনেকেই রক্তদান ও গ্রহণ বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তাই এ বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হানি করা বা বিকৃতি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। নিজের ব্যাপারেও কেউ এমন অধিকার রাখে না যে, সে নিজে নিজের অঙ্গহানি করবে অথবা বিকৃতি করবে। আত্মহত্যা তো ইসলামে মহাপাপ হিসেবে সাব্যস্ত। সুতরাং আল্লাহতে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে, আমি আমার অঙ্গহানি বা বিকৃতি করবো। কারণ, মানুষ রূপক অর্থে সাময়িকভাবে তার শরীর, সম্পদ ইত্যাদির মালিক হলেও প্রকৃত ও স্থায়ী মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি বলেন, “নবম-ল আর ভূ-ম-লের সবকিছু আল্লাহরই মালিকানাধীন” (সূরা বাকারা: ২৫৫)।

অতএব নিজের জান-মাল অনর্থক নষ্ট করা, অঙ্গহানি বা বিকৃতি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “তোমরা স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা” (সূরা বাকারা: ১৯৫)। এ আয়াত এবং অন্যান্য দলিলের আলোকে মরণোত্তর চক্ষুদান বৈধ হওয়া না হওয়া নিয়ে মতানৈক্য আছে। তবে রক্তদান আর মরণোত্তর চক্ষুদান এককথা নয়।

তাই রক্তদান কর্মসূচিকে ইসলামী শরিয়াবিশেষজ্ঞগণ কয়েকটি শর্তে জায়েয ফতোয়া দিয়েছেন। যথা, এক. যদি রক্তের অভাবে রোগী মারা যাওয়ার অথবা রোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে অথবা শারীরিক সুস্থতার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক কাউকে রক্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন তাহলে রক্তদান জায়েয (জাদিদ মাসায়েল, পৃ. ২৯)। দুই. যদি শারীরিক উন্নতি (যা রক্ত গ্রহণ ছাড়া অন্য উপায়ে সম্ভব) বা শারীরিক সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য রক্ত দান ও গ্রহণ জায়েয নয় (প্রাগুক্ত)। তিন. রক্ত বিক্রি বা রক্তব্যবসা জায়েয নয়। তবে বিনামূল্যে যদি রক্ত পাওয়া না যায় তাহলে ক্রয় করা জায়েয (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০। চার. দাতা ও গ্রহীতা ভিন্নধর্মী হওয়ার কারণে রক্তদান ও গ্রহণ নাজায়েয হবে না। তবে রক্তের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আছে বিধায় ভিন্নধর্মী বা পাপাচারী ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ না করতে পারলে ভাল। যেমন, পাপাচারী মহিলার দুগ্ধপান করানোর ব্যাপারে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। পূর্বযুগে দুগ্ধমাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা হতো (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১)। পাঁচ. স্বামী-স্ত্রী বা যাদের মধ্যে বিয়ে হবে তাদের পরস্পরের মধ্যে রক্তের আদান-প্রদান জায়েয। এমন নারী-পুরুষ, যাদের একজন অপরজনকে রক্ত দিয়েছে তাদের মধ্যে বিয়ে হতেও কোন বাধা নেই।

কারণ, বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে যে তিনটি সম্পর্ক প্রতিবন্ধক (বংশীয়, বৈবাহিক এবং দুগ্ধীয় সম্পর্ক) সেগুলোর মধ্যে রক্তদানের বিষয়টি পড়ে না। সুতরাং উক্ত তিনটি সম্পর্কের বাইরে অন্য কোন কারণে বিয়ে অবৈধ হওয়ার ফতোয়া দেয়া মানে শরিয়ত নির্ধারিত বিষয়ের অতিরঞ্জন করা। উল্লেখ্য যে, একই মায়ের দুধ পান করার কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক অবৈধ হওয়ার বিষয়টি আড়াই বছরের বয়সের সাথে শর্তযুক্ত। রক্তদানের ক্ষেত্রে উক্ত বয়স প্রযোজ্য নয় বিধায় দুগ্ধদানের সাথে এর তুলনা করার অবকাশ নেই (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২)।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, রক্তদাতার রক্ত বিশুদ্ধ কিনা তা পরীক্ষা করা আবশ্যক। অন্যথায় লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। এছাড়া গর্ভবতী, স্তন্যদানকারী, হৃদরোগী, উচ্চ বা নিম্ন রক্তচাপের রোগী, ডাযেবেটিকস রোগী, মৃগী রোগী রক্ত দিতে পারবে না। সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি, যার রক্তের কুফল রক্তগ্রহীতার মধ্যে পড়বে- যেমন, হেপাটাইসিস বি, এইচআইভি, মেলিরিয়া, সিফিলিসের রোগীর রক্তও গ্রহণ করা যাবে না।

যারা এমন ওষুধ সেবন করেন, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রক্তগ্রহীতার মধ্যে পড়বে- এমন রোগীর রক্ত গ্রহণ করতেও চিকিৎসকগণ বারণ করেন। তাঁরা রক্তদানের নিম্নোক্ত কয়েকটি উপকারিতা প্রমাণ করেছেন। যেমন, নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া (রক্তদান না করলেও এমনিতেই রক্ত নষ্ট হয়ে নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টি হয়), রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া, হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যাওয়া, নিজের শরীরে কোন মারাত্মক ব্যাধি আছে কিনা- তা চিহ্নিত হওয়া ইত্যাদি। অধুমপায়ীদের রক্তদানের ফলে হার্ট এ্যাটেক, বাইপাস অপরেশন এবং স্টোকের ঝুঁকি কমে যায়। এর মাধ্যমে শরীরের ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৪ জুন-২০০৮)।

এছাড়া রক্তদানের মাধ্যমে আত্মীয়তা সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়, শত্রুতা কমে যায়, অনাত্মীয়কে আপন করে নেয়া যায় এবং তার সাথে স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়। পাশাপাশি নিজের অথবা আপনজনের প্রয়োজনে রক্ত পাওয়া যায়। “ত্যাগেই সুখ” প্রবচনের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে। এতে দারুণ মানসিক প্রশান্তিও লাভ করা যায়। রক্তদানের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় এবং সামাজিক বন্ধনও সুদৃঢ় হয়, যা বর্তমানে দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতেও এর গুরুত্ব অনেক। কারণ, একজনের রক্তদানে আরেকজনের জীবন বেঁচে যায় অথবা রোগী সুস্থ হয়ে যায়, যা একটি উত্তমসেবা।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি কারো জীবন বাঁচাল সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচাল” (সুরা মায়িদা: ৩২)। রোগীর সেবা-শুশ্রুষা করা আল্লাহর নবি (দ.)-এর দায়েমি সুন্নাত। তিনি একাধিক হাদিসে রোগীর সেবার তাগিদ দিয়েছেন; রোগী যে ধর্মেরই হোক না কেন। তিনি বলেন, “তোমরা বন্দীকে মুক্ত করো, বুভুক্ষকে খাবার দাও এবং রোগীর সেবা করো” (ছহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৩০৪৬)।

তিনি এটাকে মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ সুস্থ ও সক্ষম মুসলিমের দায়িত্ব হলো অসুস্থ মুসলিমের সেবা করা আর সেবা পাওয়া অসুস্থ মুসলিমের অধিকার; এটি তাঁর প্রতি করুণা নয়। এমনকি জীব-জন্তুর সেবাও ইসলামে নেক আমল হিসেবে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস হলো, “একদা এক ব্যক্তি পথ চলতে চলতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ল এবং কূপের সন্ধান পেয়ে সেখান থেকে পান করে তৃষ্ণা নিরারণ করল। তৃষ্ণা নিবারণের পর দেখতে পেল, একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর পিপাসায় কাতর হয়ে ভিজাভূমি লেহন করে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করছে। লোকটি চিন্তা করল যে, আমাকে যেমন তৃষ্ণায় পেয়েছিল কুকুরটিও তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছে। সে পুনরায় উক্ত কূপে অবতরণ করে তার মৌজা ভিজিয়ে তা মুখে ধারণ করে কুকুরটিকে পান করাল। ফলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।” হাদিসটি শুনার পর সাহাবিগণ (র.) জিজ্ঞাসা করলেন, জীব-জন্তুর সেবাতেও কি পূণ্য আছে? তিনি বললেন, “সর্বজীবের সেবাতে পূণ্য আছে” (প্রাগুক্ত, হাদিস নং-২৩৬৩)। এ জন্য বলা হয়েছে, “জীবে দয়া করে যেজন, সেজন সেবিছে ইশ্বর”।

রক্তদান একটি মহৎ ও সাওয়াবের কাজ। এই কর্মসূচি পালন করা, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, যোগাযোগ রক্ষা করে রক্তের ব্যবস্থা ও সন্ধান দেয়া ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও সংস্থা আল্লাহ তায়ালার দরবারে মানবতার সেবক হিসেবে বিবেচিত হবেন।

পবিত্র হাদিসের ভাষ্য মতে, তারা আল্লাহ তায়ালার সেবক। পরস্পরের মাঝে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং সহমর্মিতাপূর্ণ সমাজ গড়ার অন্যতম কর্মসূচিও হতে পারে স্বেচ্ছায় রক্তদান। নানাবিধ কুকর্ম থেকে যুবসমাজকে দূরে রাখেতে এ জাতীয় কর্মসূচি খুবই ফলপ্রসূ।


লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।







Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...