প্রশ্ন: ১৬৫ : তিলাওয়াতে সিজদার হুকুম ও নিয়ম।

সুরা আ’রাফ :


﴿إِنَّ الَّذِينَ عِندَ رَبِّكَ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيُسَبِّحُونَهُ وَلَهُ يَسْجُدُونَ ۩﴾
২০৬) তোমার রবের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থানকারী ফেরেশতাগণ কখনো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে তাঁর ইবাদতে বিরত হয় না,১৫৫  বরঞ্চ তারা তাঁরই মহিমা ঘোষণা করে ১৫৬  এবং তাঁর সামনে বিনত থাকে ৷ ১৫৭ 


১৫৭. এ ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান এই যে, যে ব্যক্তি এ আয়াতটি পড়বে বা শুনবে তাকে সিজদা করতে হবে৷ এভাবে তার অবস্থা হয়ে যাবে আল্লাহর নিকটতম ফেরেশতাদের মত৷ এভাবে সারা বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা পরিচালনাকারী কর্মীরা যে মহান আল্লাহর সামনে নত হয়ে আছে তারাও তাদের সাথে তাঁর সামনে নত হয়ে যাবে এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংগে সংগেই একথা প্রমাণ করে দেবে যে, তারা কোন অহমিকায় ভোগে না এবং আল্লাহর বান্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াও তাদের স্বভাব নয়৷
কুরআন মজীদে চৌদ্দটি স্থানে সিজদার আয়াত এসেছে৷ এ আয়াতগুলো পড়লে বা শুনলে সিজদা করতে হবে, এটি ইসলামী শরীয়াতের একটি বিধিবদ্ধ বিষয়,এ ব্যাপারে সবাই একমত৷তবে এ সিজদা ওয়াজিব হবার ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে৷ ইমাম আবু হানীফা, (র) তেলাওয়াতে সিজদাকে ওয়াজিব বলেন৷ অন্যান্য উলামা বলেন এটি সুন্নত৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক সময় একটি বড় সমাবেশ কুরআনে পড়তেন এবং সেখানে সিজদার আয়াত এলে তিনি নিজে তৎক্ষণাৎ সিজদা করতেন এবং সাহাবীগণএর যিনি যেখানে থাকতেন তিনি সেখানেই সিজদানত হতেন৷এমনকি কেউ কেউ সিজদা করার জায়গা না পেয়ে নিজের সামনের ব্যক্তির পিঠের ওপর সিজদা করতেন৷ হাদীসে একথাও এসেছে, মক্কা বিজয়ের সময় তিনি কুরআন পড়েন৷ সেখানে সিজদার আয়াত এলে যারা মাটির ওপর দাঁড়িয়েছিলেন তারা মাটিতে সিজদা করেন এবং যারা ঘোড়ারও উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন তারা নিজেদের বাহনের পিঠেই ঝুঁকে পড়েন৷ কখনো নবী (সা) খুতবার মধ্যে সিজদার আয়াত পড়তেন, তখন মিম্বার থেকে নেমে সিজদা করতেন তারপর আবার মিম্বরের ওপর উঠে খুতবা দিতেন৷
অধিকাংশ আলেমের মতে নামাযের জন্যে যেসব শর্ত নির্ধারিত এ তেলাওয়াতের সিজাদার জন্যও তাই নির্ধারিত ৷ অর্থাৎ অযুসহকারে কিবলার দিকে মুখ করে নামাযের সিজদার মত করে মাটিতে মাথা ঠেকাতে হবে৷কিন্তু তেলাওয়াতের সিজদার অধ্যায়ে আমরা যতগুলো হাদীস পেয়েছি সেখানে কোথাও এ শর্তগুলোর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই৷ সেখান থেকে তো একথাই জানা যায় যে, সিজদার আয়াত শুনে যে ব্যক্তি যেখানে যে অবস্থায় থাকে সে অবস্থায়ই যেন সিজদা করে - তার অযু থাক বা না থাক,কিবলামুখী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হোক বা না হোক, মাটিতে মাথা রাখার সুযোগ পাক বা না পাক তাতে কিছু আসে যায় না৷ প্রথম যুগের আলেমদের মধ্যেও আমরা এমন অনেক লোক দেখি যারা এভাবেই তেলাওয়াতের সিজদা করেছেন৷ ইমাম বুখারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি অযু ছাড়াই তেলাওয়াতের সিজদা করতেন৷কাতহূল বারীতে আবু আবদুর রহমান সুলামী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি পথ চলতে কুরআন মজীদ পড়তেন এবং কোথাও সিজদার আয়াত এলেই মাথা ঝুঁকিয়ে নিতেন৷ অযু সহকারে থাকুন বা থাকুন এবং কিবলার দিকে মুখ ফিরানো থাক বা না থাক, তার পরোয়া করতেন না৷ এসব কারণে আমি মনে করি, যদিও অধিকাংশ আলেমদের মতটিই অধিকতর সতর্কমূলক তবুও কোন ব্যক্তি যদি অধিকাংশ আলেমের মতের বিপরিত আমল করে তাহলে তাকে তিরস্কার করা যেতে পারে না৷ কারণ অধিকাংশ আলেমদের মধ্যে এমনসব লোকও পাওয়া গেছে যাদের রীতি ছিল পরবর্তীকালের অধিকাংশ আলেমদের থেকে ভিন্নতর৷

প্রশ্ন: ১৬৪ : লজ্জা স্থান ধরলে কি ওজু ভেঙ্গে যায় ?

প্রশ্ন
সালাম মুফতী সাহেব!
কিছুদিন পূর্বে আপনাদের ওয়েব সাইটে একটি প্রশ্নের জবাব প্রকাশিত হয়েছে। যাতে আপনি বলেছেন যে, লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে অজু ভঙ্গ হবে না। এ বিষয়ে ফিক্বহের কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। দয়া করে হাদীসের আলোকে বিষয়টি পরিস্কার করার অনুরোধ রইল।
প্রশ্নকর্তা-আলী আহমাদ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়ে থাকে প্রশ্ন অনুপাতে। উক্ত প্রশ্নটি ছিল জবাব জানার জন্য দলীল জানার জন্য নয়। তাই আমরা উত্তরটি প্রদান করে ফিক্বহের কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করেছি। যেহেতু ফিক্বহের কিতাবের মাসআলাগুলো  কুরআন ও হাদীসের আলোকেই বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সংকলন করেছেন। তাই ফিক্বহের কিতাবের রেফারেন্স দেয়ার দ্বারাই দলীল হয়ে গেছে বলে সাব্যস্ত হয়ে যায়।
পৃথকভাবে এ প্রশ্ন করায় আমরা উক্ত মাসআলার প্রমাণবাহী হাদীসও উদ্ধৃত করে দিচ্ছি।
عَنْ قَيْسِ بْنِ طَلْقٍ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: سَأَلَ رَجُلٌ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيَتَوَضَّأُ أَحَدُنَا إِذَا مَسَّ ذَكَرَهُ؟ قَالَ: ” إِنَّمَا هُوَ بَضْعَةٌ مِنْكَ أَوْ جَسَدِكَ
কায়েশ বিন তালক তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাঃ কে জিজ্ঞাসা করে যে, যে ব্যক্তি তার গোপনাঙ্গ স্পর্শ করেছে সে কি অজু করবে? রাসূল সাঃ বললেন, এটিতো তোমার একটি অঙ্গ বা বলেছেন তোমার শরীরের একটি অঙ্গ। [তাই এটি ধরলে অজু ভাঙ্গবে কেন?] {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬২৮৬}
ইবনে হিব্বান, তাবারানী ইবনে হাযম একে সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। আল্লামা আলী বিন মাদিনী রহঃ বলেন, এটি বুসরাহ রাঃ এর [গোপনাঙ্গ স্পর্শ করলে অজু ভেঙ্গে যাবার] হাদীসের তুলনায় এটি উত্তম। {আসারুস সুনান-৪৯}
ইমাম তিরমিজী এ সংক্রান্ত হাদীস আনার পর মন্তব্য করেন
قال الترمذي: وقد روي عن غير واحد من أصحاب النبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وبعض التابعين: أنهم لم يَرَوْا الوضوء من مسِّ الذكر، وهو قول أهل الكوفة وابن المبارك. وهذا الحديث أحسن شيء روي في هذا الباب.
এছাড়া আরো সাহাবায়ে কেরামগণ এবং তাবেয়ীগণ থেকে এরকম বক্তব্য নির্ভর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যারা লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে অজু করার কথা বলতেন না। এটিই আহলে কুফা এবং আব্দুল্লাহ বিন মুবারকের সিদ্ধান্ত। আর এ হাদীস এ বিষয়ে বর্ণিত সবচে’ উত্তম। {তিরমিজী, হাদীস নং-৮৫}
عَنْ أَرْقَمَ بْنِ شُرَحْبِيلَ، قَالَ: ” قُلْتُ لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ: إِنِّي أَحُكُّ جَسَدِي وَأَنَا فِي الصَّلاةِ فَأَمَسُّ ذَكَرِي، فَقَالَ: إِنَّمَا هُوَ بِضْعَةٌ مِنْكَ
হযরত আরকাম বিন শুরাহবিল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদকে বললাম, আমি নামাযরত অবস্থায় আমার শরীর চুলকাচ্ছিলাম। এর মাঝে আমি আমার গোপনাঙ্গ স্পর্শ করে ফেলি।[এ পরিস্থিতে হুকুম কী? অজু কি ভেঙ্গে গেছে?] আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাঃ বললেন, এটিতো তোমার শরীরেরই একটি অংশ। [তাই অজু ভাঙ্গবে কেন? শরীরের অন্য অঙ্গে ধরলে যেমন ভাঙ্গবে না, তো এখানে ধরলে ভাঙ্গবে কেন?] {মুয়াত্তা মুহাম্মদ, হাদীস নং-২১}
এর সনদটি হাসান। {আসারুস সুনান-৪৯}
عَنْ إِبْرَاهِيمَ، ” أَنَّ ابْنَ مَسْعُودٍ سُئِلَ عَنِ الْوُضُوءِ مِنْ مَسِّ الذَّكَرِ؟ فَقَالَ: إِنْ كَانَ نَجِسًا فَاقْطَعْهُ
হযরত ইবরহীম নাখয়ী থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় ইবনে মাসঊদ রাঃ কে লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে অজু ভেঙ্গে যাবে কি না? মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যদি এটি নাপাকই হয়, তাহলে এটি কেটে ফেল। {মুয়াত্তা মুহাম্মদ, হাদীস নং-১৯}
এ সংক্রান্ত আরো অনেক সহীহ হাদীস ও আছারে সাহাবা তাহাবী শরীফ, মুয়াত্তা মুহাম্মদ, মুসনাদে আহমাদ, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, আসারুস সুনানসহ হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে বিদ্যমান। যা পরিস্কার প্রমাণ করে যে লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে অজু ভঙ্গ হবে না। কারণ এটি শরীরের একটি অঙ্গ। নাক স্পর্শ করলে যেমন ভাঙ্গবে না, তেমনি লজ্জাস্থান স্পর্শ করলেও অজু ভাঙ্গবে না। যদি এটি নাপাকই হতো, তাহলে সর্বক্ষণই মানুষের শরীর নাপাক হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু একথা কি কেউ বলেন?
তাহলে বুঝা গেল লজ্জাস্থান স্পর্শ করার সাথে অজু ভঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। যে হাদীসে ভঙ্গের কথা আসছে সেখানে উদ্দেশ্য হল এর দ্বারা যদি ভিতর থেকে মজী বা অদী জাতীয় নাপাক বেরিয়ে আসে, তাহলে অজু ভেঙ্গে যাবার কথা বুঝানো উদ্দেশ্য। এমনিতে ধরলেই অজু ভেঙ্গে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

তবে শাফেয়ী মাজহাব অনুসারে লজ্জাস্‌থান স্পর্শ করলে অজু  ভেঙ্গে যাবে। 

প্রশ্ন: ১৬৩ : গোসল এর বিধান।

গোসলের আভিধানিক অর্থ
কোনো কিছুর ওপর পানি পূর্ণাঙ্গরূপে বাইয়ে দেয়া।
শরয়ী পরিভাষায় গোসলের অর্থ
আল্লাহ তাআলার ইবাদতের উদ্দেশে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গরূপে শরীর ধৌত করা।

গোসল ফরজ হওয়ার কারণসমূহ

১-বীর্যপাত

বীর্য হলো: গাড়-সাদা পানি যা যৌন-উত্তেজনাসহ ঠিকরে বের হয়, যারপর শরীর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বীর্য গন্ধে অনেকটা পঁচা ডিমের মতো। ইরশাদ হয়েছে :
( وَإِن كُنتُمۡ جُنُبٗا فَٱطَّهَّرُواْۚ ) (আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও[ সূরা আল মায়েদা:৬] আলী রাযি. বলেছেন, ‘তুমি যদি সজোরে পানি নির্গত করো, তবে গোসল করো।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)
মাসায়েল
১- যদি কারো স্বপ্নদোষ হয় আর বীর্যপাত না ঘটে, তবে গোসল ফরজ হবে না। যদি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর বীর্যপাত ঘটে তবে গোসল ফরজ হবে।
২- কেউ যদি বীর্য দেখতে পায় আর স্বপ্নদোষের কথা মনে না থাকে, তবে গোসল ফরজ হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘পানি তো পানির জন্য’(বর্ণনায় মুসলিম) অর্থাৎ বীর্যপাত হলে গোসল ফরজ হবে’।
৩- যদি পুরষাঙ্গে বীর্যের স্থানান্তর অনুভূত হয়, আর বীর্য বের না হয় তবে গোসল ফরজ হবে না।
৪- যদি কারো অসুস্থতার কারণে উত্তেজনা ব্যতীত বীর্যপাত ঘটে তবে গোসল ফরজ হবে না।
৫- যদি গোসল ফরজ হওয়ার পর গোসল করে নেয় এবং গোসলের পর বীর্য বের হয়, তাহলে পুনরায় গোসল করতে হবে না। কেননা এ সময় সাধারণত উত্তেজনা ব্যতীত বীর্য নির্গত হয়। এ অবস্থায় সতর্কতার জন্য অজু করে নেয়াই যথেষ্ট হবে।
৬- যদি ঘুম থেকে জাগার পর আদ্রতা দেখা যায়, এবং কারণ মনে না থাকে, তবে এর তিন অবস্থা হতে পারে:
ক - আদ্রতা যে বীর্য থেকে নয় এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হলে গোসল ফরজ হবে না। বরং এ আদ্রতার হুকুম হবে পেশাবের ন্যায়।
খ- বীর্য কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হলে যাচাই করে দেখতে হবে। যদি এমন বিষয় মনে করা সম্ভব হয় যা উক্ত আদ্রতা বীর্য থেকে হওয়ার সম্ভাবনাকে পোক্ত করে দেয়, তবে তা বীর্য বলেই গণ্য হবে। আর যদি এমন বিষয় মনে করা সম্ভব হয় যা উক্ত আদ্রতা যে মযী তার সম্ভাবনাকে পোক্ত করে দেয়, তবে তা মযী বলেই গণ্য হবে।
গ - আর যদি কোনো কিছুই মনে করতে না পারা যায়, তাহলে সতর্কতার জন্য গোসল করা জরুরি।
৭- যদি বীর্য দেখা যায় কিন্তু কখন স্বপ্নদোষ হয়েছে তা মনে না থাকে, তাহলে গোসল করতে হবে এবং সর্বশেষ ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর যত নামাজ আদায় করা হয়েছে তা পুনরায় পড়তে হবে।

২-সঙ্গম ঘটলে

পুরষাঙ্গ ও যোনির সম্মিলনকে সঙ্গম বলে। আর এটা ঘটে পুরষাঙ্গের পুরো অগ্রভাগ যোনির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ফলে। এতটুকু হলেই সঙ্গম বলে ধরা হবে এবং বীর্যপাত না ঘটলেও গোসল ফরজ হয়ে যাবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘নারী ও পুরুষের গুপ্তাঙ্গের সম্মিলন ঘটলেই গোসল ফরজ হয়ে যাবে।’(বর্ণনায় তিরমিযী)

৩ - কাফির ব্যক্তি মুসলমান হলে

এর প্রমাণ কায়েস ইবনে আসেম যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে গোসল করার নির্দেশ দেন।(বর্ণনায় আবু দাউদ)

৪ - হায়েয ও নিফাস বন্ধ হলে

আয়েশা রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতিমা বিনতে আবি হুবাইশ রাযি. কে বলেন, ‘হায়েয এলে নামাজ ছেড়ে দাও, আর হায়েয চলে গেলে গোসল করো ও নামাজ পড়ো।’ নিফাস হলো হায়েয এর মতো, এ ব্যাপারে কারো দ্বীমত নেই।(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৫ - মৃত্যু ঘটলে

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা যায়নাব রাযি. এর মৃত্যুর পর তিনি বলেছেন, ‘তাকে তিনবার গোসল দাও, অথবা পাঁচবার অথবা তারও বেশি যদি তোমরা ভালো মনে করো।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

গোসলের বিবরণ

গোসলের ক্ষেত্রে ফরজ হলো গোসলের নিয়তে সমস্ত শরীর পানি দিয়ে ধোয়া। তা যেভাবেই হোক না কেন। তবে মুস্তাহাব হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোসলের অনুসরণ করা। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রাযি. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাবত থেকে গোসলের জন্য পানি রাখলেন। অতঃপর তিনি ডান হাত দিয়ে বাম হাতে দুই অথবা তিনবার পানি ঢাললেন। এরপর তিনি তাঁর গুপ্তাঙ্গ ধৌত করলেন। এরপর তিনি জমিনে অথবা দেয়ালে দুই অথবা তিনবার হাত মারলেন। অতঃপর তিনি কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। তিনি তাঁর চেহারা ও দুই বাহু ধৌত করলেন। এরপর তিনি মাথায় পানি ঢাললেন। শরীর ধৌত করলেন। তিনি তাঁর জায়গা থেকে সরে গেলেন এবং দু’পা ধৌত করলেন। বর্ণনাকারী বলেন,‘এরপর আমি একটি কাপড়ের টুকরা নিয়ে এলাম। অবশ্য তিনি তা চাইলেন না। তিনি তাঁর হাত দিয়েই পানি ঝেড়ে ফেলতে শুরু করলেন।’(বর্ণনায় বুখারী)
সে হিসেবে গোসল করার পদ্ধতি হলো:
১- দুই অথবা তিনবার কব্জি পর্যন্ত দু’হাত ধোয়া।
২- গুপ্তাঙ্গ ধোয়া।
৩- জমিন অথবা দেয়ালে দুই অথবা তিনবার হাত মারা।
৪- নামাজের অজুর ন্যায় অজু করা, তবে মাথা মাসেহ ও পা ধোয়া ব্যতীত।
৫- মাথায় পানি ঢালা।
৬- সমস্ত শরীর ধোয়া।
৭- যেখানে দাঁড়িয়ে গোসল করা হয়েছে সেখান থেকে সরে গিয়ে পা ধোয়া ।

জুনুবী ব্যক্তির ওপর যা হারাম

১- নামাজ

দলিল, আল-কুরআনের আয়াত:
(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡرَبُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنتُمۡ سُكَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَعۡلَمُواْ مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغۡتَسِلُواْۚ )
{হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।} [আন-নিসা:৪৩]

২- বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বায়তুল্লাহর তাওয়াফ হলো নামাজতুল্য’।(বর্ণনায় নাসায়ী)

৩- কুরআন স্পর্শ করা।

এর দলিল, আল কুরআনের আয়াত,
(لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ) {কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া।}[সূরা আল ওয়াকিয়া:৭৯], হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পবিত্রতা ব্যতীত কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না’।(হাদীসটি ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।)

৪– কুরআন পড়া

আলী রাযি. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইস্তেন্জা সেরে বের হয়ে আসতেন, তিনি আমাদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন, আমাদের সাথে গোশত খেতেন, জানাবত ব্যতীত কোনো কিছু তাঁকে কুরআন থেকে বারণ করত না’।(বর্ণনায় তিরমিযী)

৫- মসজিদে অবস্থান করা, তবে যদি হেঁটে অতিক্রম করে যাওয়া হয় তার কথা ভিন্ন

ইরশাদ হয়েছে:
(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡرَبُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنتُمۡ سُكَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَعۡلَمُواْ مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغۡتَسِلُواْۚ)
{হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর।}
[সূরা আন-নিসা:৪৩]

মুস্তাহাব গোসল

১- জুমার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, {‘যে ব্যক্তি জুমার জন্য অজু করল সে এর দ্বারাই নেয়ামত পেয়ে গেল, আর যে ব্যক্তি গোসল করল, তবে গোসলই উত্তম।’}[বর্ণনায় আবু দাউদ]
২- হজ্ব ও উমরার জন্য গোসল করা। যায়েদ ইবনে ছাবেত রাযি. থেকে বর্ণিত, ‘তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইহরামের উদ্দেশে কাপড় পরিত্যাগ করতে ও গোসল করতে দেখেছেন।’ (বর্ণনায় তিরমিযী)
৩- মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার পর গোসল করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাল সে যেন গোসল করে।’(বর্ণনায় ইবনে মাজাহ)
৪- প্রতিবার সঙ্গমের পর গোসল করা। আবু রাফে রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের কাছে গমন করলেন, এবং প্রত্যেকের কাছেই গোসল করলেন। বর্ণনাকারী বলেন,‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, একবার গোসল করলেই কি হয় না? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এটাই উত্তম, অধিক ভালো ও পবিত্রতা’।(বর্ণনায় আবু দাউদ)
যা উচিত নয়
১- জানাবতের গোসল এতটুকু দেরিতে করা যে নামাজের ওয়াক্ত চলে যায়।
২- নারীর মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার পর পরবর্তী ফরজ নামাজ ছেড়ে দেয়া। যদি কোনো নারী যোহরের নামাজের শেষ ওয়াক্তে পবিত্র হয় এবং এক রাকাত পড়া যাবে এমন সময় বাকী থাকে তবে তার ওপর যোহরের নামাজ ফরজ বলে গণ্য হবে এবং গোসল করে যোহরের নামাজ পড়তে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে এক রাকাত নামাজ পেল সে ফজরের নামাজ পেল। আর যে ব্যক্তি সুর্যাস্তের পূর্বে এক রাকাত আসরের নামাজ পেল সে আসরের নামাজ পেল’।


প্রশ্ন: ফরয গোসলের শুদ্ধ নিয়ম কি? মেয়েদের ফরজ গোসলে আলাদা নিয়ম আছে?*
উত্তর:
*ফরয গোসলের পদ্ধতি:*
১) প্রথমে নিয়ত করবে
২) অতঃপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে দু’হাত কব্জি পর্যন্ত তিন বার ধৌত করবে।
৩) লজ্জাস্থানে পানি ঢেলে তা পরিস্কার করবে।
৪) অতঃপর পূর্ণরূপে ওযু করবে।
৫) মাথায় পানি ঢেলে আঙ্গুল চালিয়ে চুল খিলাল করবে।
৬) যখন বুঝবে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছে গেছে তখন মাথায় তিন বার পানি ঢালবে
৭) এবং সমস্ত শরীরে পানি ঢালবে।
- এ ক্ষেত্রে ডান সাইড থেকে কাজ আরম্ভ করবে।
মা আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর গোসলের বর্ণনা এরূপই এসেছে। (বুখারী ও মুসলিম)
*উল্লেখ্য যে, গোসলের ফরয তিনটি। যথা:*
(ক) নিয়ত করা।
(খ) নাক ও মুখে পানি দেয়া
(গ) সমস্ত শরীরে পানি প্রবাহিত করা।
উপরোক্ত পদ্ধতি হল পরিপূর্ণ ও সুন্নতী পদ্ধতি। তবে কেউ যদি সুন্নতী পদ্ধতি ফলো না করে কেবল ফরজগুলো আদায় করে তাহলে তা পবিত্র হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে সুন্নত অনুসরণ করে গোসল করা উত্তম তাতে কোন সন্দেহ নাই।
 মহিলাদের মাথার চুলে যদি ঝুঁটি বাধা থাকে তাহলে তা খোলা জরুরি নয়। বরং চুলের গোড়ায় গোড়ায় পানি পৌঁছলেই যথেষ্ট ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম।

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।

প্রশ্ন: ১৬২ : হায়েজ সেরে জাওয়ার এক দু দিন পর মাঝে মধ্যে একটুমাত্র হলে নামাজ চলবে কি ?

দেখতে হবে আপনার সর্বোচ্চ মুদ্দত / সময় সীমা কতদিন। মনে করেন দশ দিন। এবং সর্ব নিম্ন সময় সীমা মনে করেন সাত দিন। এখন সাত দিন পর আপনি সেরে উঠলেন এবং নামাজ পড়া শুরু করলেন। কিন্তু ৮ম দিনে আবার দেখা গেল। সেক্ষেত্রে আপনি নামাজ ছেড়ে দিবেন এবং ১০ দিন পূর্ণ করে নামাজ পড়বেন। ১০ দিন পূর্ণ করে নামাজ যখন পড়া শুরু করলেন, এরপর দেখা গেলে আর সমস্যা নেই, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না। গোসল করে নামাজ পড়ে নিবেন।

প্রশ্ন: ১৬০ : আল্লাহ আমাদের সব কিছু জানেন তারপরেও কেন আমাদের বিভিন্ন ধর্মে পাঠিয়েছেন?

আমি এমন অনেক মুসলমান দেখেছি যারা পরকাল বিশ্বাস করেনা। মুসলমান এর ঘরে জন্ম নিয়েও অনেক ব্যক্তি হিদায়াত গ্রহণ করেনি।

আসল কথা হলো এ পৃথিবী একটা পরীক্ষা ক্ষেত্র। এখানে কর্মের ফলাফল আখিরাতে পাবেন। । বিভিন্ন ধর্মও একটা পরীক্ষা। আপনি যে ধর্মেই জন্মগ্রহণ করেন না কেন ইসলামের দাওয়াত ও সত্যতা আপনার কাছে পৌছানো হবে এটা আল্লাহর ওয়াদা। আপনি এরপর কোন পথে চলবেন, ইসলামের পথে নাকি অন্য কোন পথে এটা আপনার ব্যাাপার।

প্রশ্ন:১৬১ : মরণোত্তর চক্ষুদান / দেহদান কি জায়েজ ?

ইসলামের দৃষ্টিতে মরণোত্তর দেহদান 

পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে মর্যাদাবান। তারাভরা আকাশ, জোছনা ভরা রাত বিছিয়ে রাখা বিস্তৃত সবুজ ভূমি সব আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। আল্লাহতায়ালার সব সৃষ্টিই মানুষের কল্যাণে। মানুষের প্রয়োজনে। মানবজাতিকে মর্যাদাবান করার জন্য মহান প্রভু মানুষের অবয়ব ও কাঠামোগত সৌন্দর্য, বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান-গরিমায় উন্নতি দিয়েছেন। দিয়েছেন ভাব-ভাষা ও শৈলীর শক্তি। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি। (সূরা তিন ৪)। মানুষের মন-মনন, চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞানের মর্যাদা প্রদানে কোরআন বলেছে, আল্লাহতায়ালা মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যা সে জানত না। (সূরা আলাক ৫)। আল্লাহ আরও বলেছেন, আমি আদমকে বস্তুজগতের সব জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি। (সূরা বাকারা ৩৩)। সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা কোরআন এভাবে উচ্চারণ করছে, আমি তো মানুষকে মর্যাদা দান করেছি, জলে ও স্থলে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি। সৃষ্টির অনেকের ওপর আমি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। (সূরা বনি ইসরাইল ৭০)। পৃথিবীর ফুল ফল, বৃক্ষ-তরু-লতা, পাখ-পাখালি সব আয়োজনই মানুষের জন্য। মানুষের প্রয়োজনে সমগ্র সৃষ্টি নিবেদিত। সেই মানুষের হাড়, মাংস বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যথেচ্ছ ব্যবহার, মানব অঙ্গ বেচাকেনা, আদান-প্রদান, কাটাছেঁড়া করা আদৌ কি মানুষের মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ? নাকি চিরায়ত ধারায় মর্যাদাবান জাতি মানব সভ্যতার প্রতি অভিশাপ? কোরআনুল কারিমে মানব সৃষ্টির ধারাবাহিকতার কথা এভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষকে কেমন সাধারণ বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন। শুক্রবিন্দু থেকে, তিনি সৃষ্টি করেন, পরে পরিমিত বিকাশ করেন, পরে মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসার পথ সহজ করে দেন, তারপর তাকে মৃত্যু দেন, অতঃপর তাকে কবরে স্থান দেন। (সূরা আবাসা-১৮-২১)। মরণোত্তর মানুষের দেহদান, হাড়, মাংস, চামড়া, চর্বির বাণিজ্যিক ব্যবহার, মানব অঙ্গ বেচাকেনা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে গবেষণা ইত্যাদি মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদার সঙ্গে কতটা যুতসই! মানব জন্ম, যাপিত জীবন ও মরণোত্তর কবরের ধারণা, মানুষের দৈহিক-মানসিক মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি কি কোরআনের ভাষ্য থেকে আমাদের আলোড়িত করে না? আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানুষ আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি নৈপুণ্যের অসাধারণ উপমা। মানুষ সৃষ্টির বিস্ময়। মানুষের আত্মা, বলা-কওয়া, দেখা-শোনা ও ভাব-অনুভাবের শক্তি আল্লাহর বিশেষ করুণা। করুণানির্ভর এ জীবন আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের কাছে আমানত। প্রতিটি মানুষের নিজের এই অঙ্গ বা দেহ ব্যবহারের অনুমতি আছে বটে, তবে সে এ দেহের মালিক নয়। সে এ দেহের মালিক নয় বিধায় সে আত্মহত্যা করতে পারবে না। পারবে না নিজেকে বিকিয়ে দিতে। ধ্বংস করতে। কোনো মানুষের জন্য বৈধ নয় অঙ্গহানি, অঙ্গদান কিংবা দেহদান। আজকের উত্তর আধুনিক পৃথিবীর সব জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি আবদার করে বসে, দয়াময় প্রভুর এ সৃষ্টির মতো মানুষের শরীরে বিদ্যমান একটু লোম বানিয়ে দেখাও! আত্মা, চোখ, নাক, কান সে তো দূরের কথা! হাত উঁচিয়ে হ্যাঁ বলার মতো কাউকে পাওয়া যাবে কি! মৌলিক কথা হল, কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবিত কিংবা মৃত কোনো মানুষের অঙ্গ বা দেহের বেচাকেনা কোনোভাবেই বৈধ নয়। মানব অঙ্গের বেচাকেনা যদি বৈধ না হয় তাহলে দান করার কি অনুমতি আছে? তাও নেই। কারণ দাতার জন্য জরুরি হল নিজে বস্তুর মালিক হওয়া। দেহটি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মানুষের কাছে আমানত। আমানত সূত্রে পাওয়া বস্তুর ব্যবহার বৈধ, বেচাকেনা কিংবা দান বৈধ নয়। তবে অগ্রসর পৃথিবীতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ অনেক দূর এগিয়েছে। ইসলাম-মুসলমান এ অগ্রসরতাকে সাধুবাদ জানাই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূত্র ধরেই রক্তদান, চক্ষুদান, কিডনিদান বা দেহদানের প্রাসঙ্গিকতা এসে যায়। আধুনিক চিকিৎসার স্বার্থে মানুষের অঙ্গ ব্যবহার বা প্রতিস্থাপনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সন্দেহ নেই ইসলাম সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করে। চিকিৎসার সূত্রে মানব অঙ্গের কোনো কোনো ব্যবহার একান্ত প্রয়োজনে ফেকাহবিদরা অনুমতি দিয়েছেন। অবশ্য অঙ্গ ব্যবহারের ধরন অনেক রকম হতে পারে। যেমন- তরল অঙ্গ বা জমাট। তরল বলতে মানবদেহে দুধ আর রক্ত। বাকি পুরোটা জমাট। মা তার দুধ নিজের বাচ্চাকে খাওয়ানো বা অন্যের বাচ্চাকে খাওয়ানো বা চিকিৎসার স্বার্থে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার পুরোটাই বৈধ। দুধের বৈধতার আলোকেই আলেমরা রক্তদানের বিষয়টি অনুমতি দিয়েছেন। যুক্তিকতা হল- দুধ ও রক্ত শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর দ্রুতই অভাব পূরণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি চালু আছে। জমাট অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেমন- চক্ষু, কিডনি, মাংস ইত্যাদির বেচাকেনা, দান কোনোটাই বৈধ নয়। দেশের আইনবিদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও বিষয়টি খুব সহজ মনে করছেন না। সামাজিক শান্তি-শৃংখলার স্বার্থে সরকারও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করছে। বাণিজ্যিক পৃথিবীতে যদি মানবদেহের বেচাকেনা বৈধ হয়! তাহলে সামাজিক শৃংখলা থাকবে না। ছেলেধরা, মানবপাচার, নারী-শিশুপাচার আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাবে। ধনীর দুলালেরা দেশী-বিদেশী হাসপাতালের বেডে শুয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের অর্ডার করবে কিংবা বুড়ো বয়সে নতুন চক্ষুর আবদার করবে, তখন পাড়াগাঁয়ে উধাও হবে গরিবের সন্তান। পণ্য হবে গরিব মানুষের দেহ। ল্যাপটপ-মানিব্যাগ চুরি যাওয়ার মতো পথে-ঘাটে কিডনি চুরির প্রবণতাও দেখা যাবে। যেমন আজকাল কোনো কোনো হাসপাতালে এসব কাণ্ড ঘটছে। লাশ চুরির ঘটনাও তখন সাধারণই মনে হবে। উন্নত পৃথিবীর সভ্যতা তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! কে জানে। মুফতি হুমায়ূন আইয়ূব প্রিন্সিপাল, জামিয়াতুস সালাম মদিনাবাগ মাদ্রাসা, ঢাকা

প্রশ্ন: ১৫৯ : আকিকা ।

আকিকার পরিচয় ও গুরুত্বপূর্ন মাসআলা


একজন মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম সুন্দর সুন্দর বিধান প্রদান করেছে। নবজাতক শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর সন্তানের পিতা-মাতা বা তার অভিবাবকের উপর আকীকার বিধান ইসলামের সৌন্দর্যময় বিধান সমূহের মধ্য হতে অন্যতম একটি বিধান। আকীকার অর্থঃ ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পর আল্লাহর শুকরিয়া ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে পশু জবাই করা হয়, তাকে আকীকা বলা হয়।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘(জন্মের) সপ্তম দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসান ও হুসাইনের আকিকা দিয়েছেন, তাদের নাম রেখেছেন এবং তাদের মাথা থেকে কষ্ট (চুল) দূর করেছেন।’ (বায়হাকি : ১৯০৫৫; সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৩১১)।
আলী বিন আবি তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি ছাগল দিয়ে হাসানের আকিকা দিলেন এবং বললেন, ‘হে ফাতেমা, তার মাথার চুল ফেলে দাও এবং তার চুলের ওজনে রুপা সদকা কর। তিনি বলেন, অতঃপর ফাতেমা তা পরিমাপ করল, এর ওজন হলো এক দিরহাম বা এক দিরহামের কিছু বেশি পরিমাণ।’ (তিরমিজি : ১৬০২; হাকেম, মুস্তাদরাক : ৭৫৮৯)।
আকিকার দিন : সাধারণ সন্তান ভূমিষ্ঠের সপ্তম দিন আকিকা করা উত্তম। তবে যদি কেউ কারণবশত সপ্তম দিন না করতে পারে, তবে পরবর্তী সময়ে যেকোনো দিন আদায় করতে পারবে। সপ্তম দিন মনে রাখার একটি সহজ পদ্ধতি হলো, সপ্তাহের যে দিনটিতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, যেমনশুক্রবার, পরবর্তী সপ্তাহে ঠিক এর আগের দিন, অর্থাত্ বৃহস্পতিবার আকিকা আদায় করলে তা সপ্তম দিনে পড়বে। (আবু দাউদ : ২৮৩৭)
আকিকার জন্তুর ধরন : যেসব জন্তু দিয়ে কোরবানি শুদ্ধ হয় না, সেসব জন্তু দিয়ে আকিকাও শুদ্ধ হয় না। তাই আকিকার ক্ষেত্রে জন্তুর বয়স ও ধরনের দিক থেকে কোরবানির জন্তুর গুণ পাওয়া যায়, এমন জন্তুই নির্বাচন করতে হবে। (তিরমিযি : খ. ৪, পৃ. ১০১)
কোরবানির জন্তুর সঙ্গে আকিকা করা : কোরবানির জন্তুর সঙ্গে আকিকা করা বৈধ। একটি পশুতে তিন শরিক কোরবানি হলে সেখানে আরো দু-এক শরিক আকিকার জন্যও দেওয়া যেতে পারে। তদ্রূপ কোরবানির মতো একই পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরিক হয়ে আকিকা আদায় করতে পারবে। (দুররুল হুক্কাম : ১/২৬৬) বড় পশুঅর্থাত্ গরু, মহিষ, উট ইত্যাদিতে ছেলের জন্য এক শরিক আকিকা দিলেও তা আদায় হয়ে যাবে।
আকীকার গোশত :
আকীকার পশু যবেহ করার পর এর ব্যবহার ঠিক কুরবানীর পশুর মতোই। ফলে তা তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একভাগ পরিবার, একভাগ সাদাকা ও একভাগ হাদিয়ার জন্য। ইমাম নাববী রহ. বলেন : ‘মুস্তাহাব হলো আকীকার গোশত থেকে (নিজেরা) খাওয়া, (গরীবদের মাঝে) সদকা করা এবং (বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে) হাদিয়া পাঠানো। যেমন আমরা বলেছি এসেছি কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে।’ [নাসায়ী : ৪২২৯; শরহু মা‘আনিল আছার : ১০১৫।]
আকিকার চামড়া:
ইবন রুশদ বলেন :‘আকীকার গোশত, চামড়া এবং এর যাবতীয় অংশের বিধান খাওয়া, সদকা করা ও বেচার দিক থেকে কুরবানীর পশুর মতোই।’ [বিদায়াতুল মুজতাহিদ : ১৩৭৭।]
এককথায় আকীকার গোশত ও এর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার তেমনি যেমন কুরবানীর পশুর গোশত ও তার অন্যান্য অংশের ব্যবহার করতে হয়।
# অধিকাংশ আলিমের মতে আকীকা সুন্নত। তবে কেউ কেউ আকীকা ওয়াজিব বলেছেন।
# জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা দেয়াটাই সুন্নতের পূর্ণ আনুগত্যের দাবী। তবে এরপরেও যে কোনো সময় আকীকা দেয়া যাবে। কারণ, হাদীসে সপ্তম দিনের কথা বলা হয়েছে, তবে তা হবে না- এমন কিছু বলা হয়নি।
# ছেলের আকীকা হিসেবে দুটি এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল জবাই করা সুন্নত। তবে কষ্টসাধ্য হলে একটি ছাগল দিয়েও ছেলের আকীকা দেয়া যাবে। কারণ, উভয় ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্বকে তাঁর রাসূলের সুন্নতের রঙ্গে রাঙাবার এবং সকল অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকবার তাওফীক দিন। আমীন।

প্রশ্ন: ১৫৭ : কত বছর বয়সে মেয়েদের জন্য পর্দা করা ফরয হয়।



উত্তরঃ-এর জন্য নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই।
শারীরিক গঠনে পরিবর্তন দেখা দিলে এবং সাবালিকা হ’লে তার উপর পর্দা ফরয হয়ে যায়।
তবে সাবালিকা হওয়ার পূর্ব থেকেই পর্দার অভ্যাস,,
গড়ে তোলা জরুরি।
(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৭/২১৯)

ছাহাবায়ে কেরাম তাদের শিশুদের,,
ছালাত ও ছিয়ামের প্রশিক্ষণ দিতেন।
এমনকি ছিয়ামরত শিশুদের খেলনা দিয়ে খাবারের কথা ভুলিয়ে রাখতেন।
(বুখারী হা/১৯৬০, মুসলিম হা/১১৩৬)

সাধারণতঃ নয় বছর বয়সে মেয়েরা সাবালিকা হয়। যেমন আয়েশা (রা) বলেন, যখন কোন শিশু নয় বছর বয়সে পদার্পণ করে তখন সাবালিকা হয়ে যায়। (তিরমিযী হা/১১০৯)

প্রশ্ন: ১৫৬ : চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার বিধান ।

চেয়ারে বসে নামায আদায়- মূলনীতি ও কিছু বিধান

ইসলাম শাশ্বত, সত্য, স্বভাবজাত ও বাস্তববাদী ধর্ম। ইসলামের প্রতিটি বিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবমুখী। চির সুন্দর,সহজ-সরল ও সর্বোপযোগী।

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে, নামাজ। আল্লাহপাক যা নবীজী (সা.) কে মেরাজের রাতে পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিলেন। নামাজ মহান প্রভুর দরবারে দীনতা, নিয়ামতরাজির প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তাঁর শাহী দরবারে বান্দার নানাবিদ চাহিদা পূরণের মিনতি জানানোর মাধ্যম। ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজ। তাই ঈমানের পরে, সকল ইবাদতের ঊর্ধ্বে তার স্থান। যে নামাজ কায়েম করল, সে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করল। আর যে নামাজ ধ্বংস করল, সে দ্বীন ধ্বংস করল। অর্থাৎ যার নামাজ ঠিক তার দ্বীন ঠিক। আর যার নামাজ বরবাদ তার দ্বীন বরবাদ। অতএব, যে ব্যক্তির নামাজ যত সুন্দর হবে, তার দুনিয়া-আখেরাতের জিন্দেগীও তত সুন্দর ও সফল হবে।

তবে নামাজের এ অসীম গুরুত্বের পাশাপাশি শরীয়তের আরেকটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। আর তা হচ্ছে, সকল ক্ষেত্রে সহজীকরণ। আল্লাহ পাক সাধ্যাতীত নির্দেশ দেন না, বরং যা সহজ তাই আল্লাহর নিকট প্রিয়।

ইরশাদ হয়েছে, لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا অর্থাৎ- “আল্লাহতাআলা সাধ্যের বাহিরে কোন দায়িত্ব কারও উপর চাপিয়ে দেন না”। -সূরা বাকারা : ২৮৬

ইরশাদ হয়েছে,  يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ অর্থাৎ “আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য  কঠিন করতে চান না”। -সূরা বাকারা : ১৮৫

অতএব, অবহেলা প্রদর্শন না করে নামাজের প্রতি পূর্ণ মর্যাদা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যেমন আবশ্যক, তার সাথে নামাজকে সাধ্যাতীত না করে, বরং সহজ করে দেখাও আবশ্যক। এ দুয়ের মাঝেই রয়েছে সীরাতে মুস্তাকীম। এই মৌলিক আলোচনার পর চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ের কয়েকটি বিধান নিচে তুলে ধরা হলো—

১. কিয়াম, রুকু ও সিজদা- নামাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যা নামাজের রুকন বা ফরযের অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি এই রুকনগুলো সঠিকভাবে আদায় করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও অবহেলা করে ছেড়ে দেয় বা চেয়ারে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করে, তার নামাজ আদায় হবে না। আর কেউ যদি কোন রুকন প্রকৃতপক্ষেই আদায় করতে সক্ষম না হয় বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে সে মাযুর (অক্ষম) সাব্যস্ত হয়, তাহলে সে এ রুকনটি ইশারার মাধ্যমে আদায় করে নিবে। এতে তার নামাজ পরিপূর্ণ বলে গণ্য হবে এবং সে পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। -রদ্দুল মুহতার : ১/৪৪২

হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন-

كانت بي بواسير فسألت النبي صلى الله عليه وسلم عن الصلاة فقال صل قائما فإن لم تستطع فقاعدا فإن لم تستطع فعلى جنب -সহিহ বোখারি; হাদিস নং- ১১১৭)

২. সুতরাং কেউ যদি দাঁড়াতে সক্ষম না হয়, কিন্তু মাটিতে বসে সিজদা করতে সক্ষম, তাহলে তাকে মাটিতে বসে সিজদা করে নামাজ আদায় করতে হবে। চেয়ারে বসে ইশারা করে রুকু সিজদা করলে তার নামাজ আদায় হবে না।

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রাহ.) বলেন-

ولايصح الإيماء بهما – ( الركوع والسجود) –  مع القدرة عليهما، بل شرطه تعذرهما۔

-রদ্দুল মুহতার ২/৯৯, এইচ. এম. সাঈদ

 ৩. তবে যে ব্যক্তি দাঁড়াতেও সক্ষম না এবং জায়নামাজে বসে সিজদা করতেও সক্ষম না, চেয়ার বা নীচে বসে ইশারার মাধ্যমে সিজদা করা ছাড়া তার উপায় নেই, এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিধান হল, যথাসম্ভব জায়নামাজে বসেই ইশারা করার চেষ্টা করবে। এটাই উত্তম। কারণ বৈঠকে অধিক বিনয় প্রকাশ পায় এবং বৈঠক সিজদার নিকটবর্তী অবস্থান। তবে কেউ যদি নীচে বসতে সক্ষম না হয়, কিংবা এতে তার অধিক কষ্ট হয়, এমন ব্যক্তির জন্যে চেয়ারে বসে ইশারায় নামায আদায় করতে কোনো বাধা নেই। নিঃসন্দেহে তার নামাজ বিশুদ্ধভাবে আদায় হয়ে যাবে।

ইমাম আল মারগীনানী (রাহ.) বলেন-  والأفضل هو الإيماء قاعدا ، لأنه أشبه بالسجود (আল-হিদায়া- ১/১৬২)।

হযরত ইবনে আবী লায়লা (রাহ.) রর্ণনা করেন- عن عطاء قال في صلاة القاعد يقعد كيف شاء (মুসান্নাফু ইবনি আবী শায়বা ৬/৬৬, হাদীস নং- ৮৮৭৩)।

ইমাম সারাখসী (রাহ.) বলেন-

والمصلى قاعدا تطوعا أو فريضة بعذر يتربع ويقعد كيف شاء من غير كراهة إن شاء محتبيا وإن شاء متربعا لأنه لما جاز له ترك أصلالقيام فترك صفة القعود أولى. (جـ 1 صـ 902)

৪. যে ব্যক্তি দাঁড়াতে এবং বসতে সক্ষম কিন্তু সিজদা করতে সক্ষম না, সিজদা তাকে ইশারায় করতে হয়। এমন ব্যক্তির জন্য কিয়ামের ফরয আদায়ের লক্ষ্যে দাঁড়ানো আবশ্যক, না বসে নামাজ পড়লেও নামায আদায় হবে। এতে দু’টি মত রয়েছে।

আমাদের হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ মত হল, তার জন্য দাঁড়ানো আবশ্যক নয়; বসে পড়লেও তার নামাজ আদায় হয়ে যাবে। তবে অনেকের অভিমত হচ্ছে, যতটুকু সম্ভব দাঁড়িয়ে কিয়ামের ফরয আদায় করতে হবে। তারপর সম্ভব হলে রুকু করবে। তারপর তার জন্য দুটি পন্থা রয়েছে, যে কোন একটি অবলম্বন করতে পারবে-

এক. বসে ইশারার মাধ্যমে সিজদা আদায় করা। এটা উত্তম।
দুই. দাঁড়িয়ে ইশারার মাধ্যমে সিজদা আদায় করা। তখন সিজদার জন্য মাথাকে রুকুর চেয়ে একটু বেশি নিচু করবে।

ইমাম আইনী (রাহ.) উল্লেখ করেন-

وعن أبي جعفر الطحاوي : ولو قدر على بعض القيام ولو قدر آية أو تكبيرة يقوم ذلك القدر وإن عجز عن ذلك قعد، وإن لم يفعل ذلك خفتأن تفسد صلاته، هذا هو المذهب، ولا يروى عن أصحابنا خلافه، وكذا إذا عجز عن القعود وقدر على الاتكاء أو الاستناد إلى إنسان أو حائطأو وسادة لا يجزئه إلا كذلك. ولو استلقى لا يجزئه 

-আল বেনায়া- ২/৬৩৫, মাকতাবা নাঈমিয়া

উভয় মতানুসারে বসার ক্ষেত্রে জায়নামায বা নীচে বসা আবশ্যক, নাকি চেয়ারে বসতে পারবে? এ বিধানটি তিন নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে। -রদ্দুল মুহতার- ২/৯৮, ইলাউস সুনান; ৭/১৯৮ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা

৫. এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কে সক্ষম, কে অক্ষম, কে মাজুর বা কতটুক মাজুর এবং কে মাজুর না, সে বিষয়টি নির্ণয় করা। এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, বয়স্ক এবং প্রকাশ্যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের অপারগতা সম্পর্কে অনেকটা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যদি এ সংক্রান্ত মাসআলা তাদের জানা থাকে। তবে এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তি খুবই কম রয়েছেন। তাই উত্তম পন্থা হচ্ছে, নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ মুফতি সাহেবদের শরণাপন্ন হয়ে জেনে নেয়া।

আর যারা বাহ্যিকভাবে সুস্থ, কিন্তু বিশেষ রোগের কারণে বিশেষজ্ঞ বিশ্বস্ত ডাক্তার তাদেরকে রুকু সিজদা করতে নিষেধ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও মাজুরের হুকুম প্রযোজ্য হবে। তবে তাদের জন্যও উচিত হবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বিজ্ঞ মুফতিদের শরণাপন্ন হওয়া।

৬. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যারা সঠিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার অনুমতি পেয়েছেন বা চেয়ার ব্যতীত যাদের কোনো বিকল্প নেই, তারা মসজিদে গিয়ে চেয়ারে বসে নামায পড়বেন, নাকি মসজিদের শোভা নষ্ট হবে এই অজুহাতে মসজিদ ছেড়ে ঘরে নামায আদায় করবেন?

এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিতে সঠিক মত হলো- তারা মসজিদে গিয়েই জামাতে শরীক হয়ে নামাজ আদায় করবেন, যদিও তারা চেয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য। কারণ, ফরয নামাজ আদায় করার আসল রূপই হচ্ছে, মসজিদে গিয়ে সবাই মিলে জামাত করে নামাজ আদায় করা। সম্মিলিতভাবে বন্দেগি করা ও দাসত্ব প্রকাশ করা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়। তাই মসজিদের জামাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিষয়ে একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদীস রয়েছে। যেমন-  وَارْكَعوا مَعَ الرَّاكِعِينَ (সূরা বাকারা: ৪৩) وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ -সূরা শুআরা- ২১৯

عن أبي هريرة : أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: والذي نفسي بيده لقد هممت أن آمر بحطب، فيحطب، ثم آمر بالصلاة، فيؤذن لها،ثم آمر رجلا فيؤم الناس، ثم أخالف إلى رجال، فأحرق عليهم بيوتهم، والذي نفسي بيده لو يعلم أحدهم، أنه يجد عرقا سمينا، أو مرماتينحسنتين، لشهد العشاء (সহিহ বোখারি : হাদিস নং-৬৪৪

عن أبي هريرة، قال : أتى النبي صلى الله عليه وسلم رجل أعمى، فقال: يا رسول الله، إنه ليس لي قائد يقودني إلى المسجد، فسأل رسول اللهصلى الله عليه وسلم أن يرخص له، فيصلي في بيته، فرخص له، فلما ولى، دعاه، فقال: هل تسمع النداء بالصلاة؟ قال: نعم، قال: فأجب 

সহিহ মুসলিম : হাদিস নং- ৬৫৩

তাই যারা জামাতে উপস্থিত হতে পারে, তাদের জন্য এর বিকল্প নেই। কেননা মসজিদের নামাজে যে প্রাণ থাকে, ঘরের নামাজে সেটা থাকে না। তাছাড়া এ ধরণের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ রোগীর কষ্ট করে জামাতে উপস্থিত হওয়া, অন্যদেরকে মসজিদে গিয়ে জামাতে শরীক হতে উৎসাহী করবে এবং গাফেল লোকদের মসজিদমুখী হতে প্রেরণা যোগাবে। তাই এমন লোকদের মসজিদের জামাতে উপস্থিতি আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা ও সকল সৃষ্টির কাছে পছন্দনীয়।

তবে যারা আন্তরিকতার সাথে এ ধরনের লোকদের মসজিদে গিয়ে চেয়ারে বসে নামায পড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করেন তাদের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তাদের অপছন্দের উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য। যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।

এর উত্তরে বলব, অপারগতা ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য অবৈধতার কারণ নয়। অর্থাৎ- মানুষ যা করতে বাধ্য, যা না হলে মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হবে, এমন বিষয়ে সাদৃশ্যের বিধান প্রযোজ্য নয়। কারণ এ সকল বিষয় কারো সাদৃশ্য গ্রহণের জন্য করা হয় না, বরং প্রয়োজনে করা হয়। তাই এগুলোকে সাদৃশ্যের কারণে হারাম বলা যাবে না। তাছাড়া মূল রহস্য বা কারণ না বুঝে শুধু সাদৃশ্য দেখেই যদি ঢালাওভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়গুলিকে হারাম বলে দেওয়া হয়, তাহলে খাওয়া-দাওয়াসহ জীবন ধারণের অনেক মৌলিক বিষয়ও তার আওতায় চলে আসবে। কারণ, এসব বিষয় মৌলিকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর এ সব হারাম হয়ে গেলে মানব জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই যে সকল বিষয় আবশ্যক, প্রয়োজনীয় ও উপকারী নয় বা যে সকল মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পথ ও পন্থা একাধিক হতে পারে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সাদৃশ্যপূর্ণ রূপরেখা বর্জন করে সাদৃশ্যহীন পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ করা হয়। আল্লামা ইবনে নুজাইম (রাহ.) বলেন-

و(يكفّر) بوضع قلنسوة المجوسي على رأسه على الصحيح إلا لضرورة دفع الحر أو البرد، وبِشدّ الزنار في وسطه إلا إذا فعل ذلك خديعةفي الحرب وطليعة للمسلمين (আল-বাহরুর রায়েক ৫/২০৮)

 হযরত থানভী (রাহ.) বলেন-

كفار كی وضع بلا ضرورت قويہ حسيہ كدفع الحر والبرد يا شرعيہ كخدع اهل الحرب والتجسس للمسلمين افعال كفر سے ہے বাওয়াদিরুন নাওয়াদের- ৪৫৪)।

পূর্বের আলোচনায় এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, নামাজে চেয়ার শুধু প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে পারবে। আর এটি তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে ওজরের অন্তর্ভুক্ত হবে। অতএব, চেয়ারের এই বৈধ ও প্রয়োজনীয় ব্যবহারকে শুধু সাদৃশ্যের অজুহাতে অবৈধ বলা যাবে না।

তবে যারা প্রয়োজন ছাড়া নামাজে চেয়ার ব্যবহার করে জেনে না-জেনে এটাকে ফ্যাশনে পরিনত করতে চলেছেন, তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখার জন্য এ বিষয়ে সঠিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ইমাম ও খতিব সাহেবগণ যদি এ বিষয়ে সঠিক মাসআলা তুলে ধরে সময়ে সময়ে আলোচনা করেন, তাহলে চেয়ারের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার আশা করি, বন্ধ হয়ে যাবে। আর যারা প্রয়োজনে ব্যবহার করেন, তারাও মসজিদে এসে জামাতে শরীক হয়ে আল্লাহর বন্দেগী করার সুযোগ লাভ করবেন।

والله اعلم بالصواب

আল্লাহপাকই সকল বিষয়ে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

ফতোয়া প্রদান, মুফতি কিফায়াতুল্লাহ, সিনিয়র মুফতি ও মুহাদ্দিস, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

তারিখ- ১৮/ ০৮/১৪৩৬ হিজরী-০৬/০৬/২০১৫ ঈসায়ী

বাংলাদেশ সময়: ২১২০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫
এমএ

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...