১০। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : বদর যুদ্ধের মানচিত্র


 ( বিস্তারিত ০৮  নং সুরা  আনফাল  এর ভূমিকা দ্রষ্টব্য ) : বদর এর যুদ্ধ  :..............মক্কী যুগের শেষ তিন-চার বছরে ইয়াসরেবে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েত থাকে অপ্রতিহত গতিতে। সেখানকার লোকেরা আরবের অন্যান্য এলাকার গোত্রগুলোর তুলনায় অধিকতর সহজে ও নির্দ্বিধায় এ আলো গ্রহণ করতে থাকে। শেষে নবুয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্জের সময় ৭৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল রাতের আঁধারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। তারা কেবল ইসলাম গ্রহণই করেননি বরং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে নিজেদের শহরে স্থান দেয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন। মহান আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে এ দুর্লভ সুযোগটি দিয়েছিলেন এবং নবী (সা.) ও হাত বাড়িয়ে তা লুফে নিয়েছিলেন। ইয়াসরেববাসীরা নবী(সা.) কে শুধুমাত্র একজন শরণার্থী হিসেবে নয় বরং আল্লাহর প্রতিনিধি এবং নেতা ও শাসক হিসেবেও আহবান করেছিলেন। আর তাঁর অনুসারীদেরকে তারা একটি অপরিচিতি দেশে নিছক মুহাজির হিসেবে বসবাস করার জন্য আহবান জানাচ্ছিলেন না। বরং আরবের বিভিন্ন এলাকায় ও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যেসব মুসলমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তাদের সবাইকে ইয়াসরেবে জমা করে ইয়াসরেবী মুসলমানদের সাথে মিলে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এভাবে মূলত ইয়াসরেব নিজেকে “মদীনাতুল ইসলাম” তথা ইসলামের নগর হিসেবে উপস্থাপিত করলো। নবী(সা.) তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে আরবের প্রথম দারুল ইসলাম গড়ে তুললেন। 


। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের অর্থ কি হতে পারে সে সম্পর্কে মদীনাবাসীরা অনবহিত ছিল না। এর পরিষ্কার অর্থ ছিল, একটি ছোট্ট শহর সারাদেশের উদ্যত তরবারি এবং সমগ্র দেশবাসীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক বয়কটের মোকাবিলায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কাজেই আকাবার বাইআত গ্রহণ করার সময় সেদিনের সেই রাত্রীকালীন মজলিসে ইসলামের প্রাথমিক সাহায্যকারী (আনসারগণ) এ পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে বুঝেই নবী (সা.) এর হাতে নিজেদের হাত রেখেছিলেন। যখন এ বাইআত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ঠিক তখনই ইয়াসরেবী প্রতিনিধি দলের সর্বকনিষ্ঠ যুব সদস্য আস’আদ ইবনে যুরারাহ (রা.) উঠে বললেনঃ


رُوَيْداً يَا أَهْلَ يَثْرِبَ! أنَّا لَمْ نَضْرِبْ اليه أَكْبَادَ الإِبِلِ إِلاَّ وَنَحْنُ نَعْلَمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ , وَإِنَّ إِخْرَاجَهُ الْيَوْمَ مُنَاواةُ للْعَرَبِ كَافَّةً وَقَتْلُ خِيَارِكُمْ وتَعَضَّكُمُ السُّيُوفُ- فَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَصْبِرُونَ عَلَى ذَلِكَ فخذوه واجره عَلَى اللَّهِ وَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَخَافُونَ مِنْ أَنْفُسِكُمْ خيفة فَذروه فَبَيِّنُوا ذَلِكَ فَهُوَ أَعْذَرُ لَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ- “থামো, হে ইয়াসরেব বাসীরা! আমরা একথা জেনে বুঝেই এঁর কাছে এসেছি যে, ইনি আল্লাহর রসূল এবং আজ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে সমগ্র আরববাসীর শত্রুতার ঝুঁকি নেয়া। এর ফলে তোমাদের শিশু সন্তানদেরকে হত্যার করা হবে এবং তোমাদের ওপর তরবারি বর্ষিত হবে। কাজেই যদি তোমাদের এ আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা থাকে তাহলে এঁর দায়িত্ব গ্রহণ করো। আল্লাহ এর প্রতিদান দেবেন। আর যদি তোমরা নিজেদের প্রাণকে প্রিয়তর মনে করে থাকো তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দাও এবং পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের অক্ষমতা জানিয়ে দাও। কারণ এ সময় অক্ষমতা প্রকাশ করা আল্লাহর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য হতে পারে”।প্রতিনিধি দলের আর একজন সদস্য আব্বাস ইবনে উবাদাহ ইবনে নাদলাহ (রা.) একথারই পুনরাবৃত্তি করেন এভাবেঃ


اتعلمون علام تبايعون هذا الرجل ؟ (قالوا نعم ، قال) إنكم تبايعونه على حرب الأحمر والأسود من الناس - فإن كنتم ترون أنكم إذا نهكت أموالكم مصيبة - وأشرافكم قتلا أسلمتموه فمن الآن عدعوه فهو والله إن فعلتم خزي الدنيا والآخرة وإن كنتم ترون أنكم وافون له بما دعوتموه إليه على نهكة الأموال وقتل الأشراف فخذوه ، فهو والله خير الدنيا والآخرة- 


“তোমরা কি জানো, এ ব্যক্তির হাতে কিসের বাইআত করছো? (ধ্বনিঃ হাঁ আমরা জানি) তোমরা এঁর হাতে বাইআত করে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নিচ্ছো।কাজেই যদি তোমরা মনে করে থাকো, যখন তোমাদের ধন-সম্পদ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হবার আশংকা দেখা দেবে তখন তোমরা এঁকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে দেবে, তাহলে আজই বরং এঁকে ত্যাগ করাই ভাল। কারণ আল্লাহর কসম, এটা দুনিয়ায় ও আখেরাতের সবখানেই লাঞ্চনার কারণ হবে। আর যদি তোমরা মনে করে থাকো, এ ব্যক্তিকে তোমরা যে, আহবান জানাচ্ছো, নিজেদের ধন-সম্পদ ধ্বংস ও নেতৃস্থানীয় লোকেদের জীবন নাশ সত্ত্বেও তোমরা তা পালন করতে প্রস্তুত থাকবে, তাহলে অবশ্যি তাঁর হাতে আঁকড়ে ধরো। কারণ আল্লাহর কসম, এরই মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ”।এ


..............সেখানে হারম শরীফের দরজার ওপর আবু জেহেল তার সমালোচনা করে বললোঃ


।الأموال وقتل الأشراف أَلَا أَرَاكَ تَطُوفُ بِمَكَّةَ آمِنًا وَقَدْ أَوَيْتُمْ الصُّبَاةَ وَزَعَمْتُمْ أَنَّكُمْ تَنْصُرُونَهُمْ وَتُعِينُونَهُمْ؟ لَوْلَا أَنَّكَ مَعَ أَبِي صَفْوَانَ مَا رَجَعْتَ إِلَى أَهْلِكَ سَالِمًا- 


“তোমরা আমাদের ধর্মত্যাগীদের আশ্রয় দেবে এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগীতা দান করবে আর আমরা তোমাদেরকে অবাধে মক্কায় তাওয়াফ করতে দেবো ভেবেছ? যদি তুমি আবু সফওয়ান তথা উমাইয়া ইবনে খলফের মেহমান না হতে তাহলে তোমাকে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে দিতাম না”।সাদ জবাবে বললেনঃ


وَاللَّهِ لَئِنْ مَنَعْتَنِي هَذَا لَأَمْنَعَنَّكَ مَا هُوَ أَشَدُّ عَلَيْكَ مِنْهُ طَرِيقَكَ عَلَى الْمَدِينَةِ 


“আল্লাহর কসম, যদি তুমি আমাকে এ কাজে বাধা দাও তাহলে আমি তোমাকে এমন জিনিস থেকে রুখে দেবো, যা তোমার জন্য এর চাইতে অনেক বেশী মারাত্মক। অর্থাৎ মদীনা দিয়ে তোমাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেবো”।অর্থাৎ এভাবে মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে যেন একথা ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করার পথ মুসলমানদের জন্য বন্ধ। আর এর জবাবে মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে বলা হলো, সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য করার পথ ইসলাম বিরোধীদের জন্য বিপদসংকুল।


...............মক্কাবাসীদের যে ব্যবসায় চলতো তার পরিমাণ ছিল বছরে আড়াই লাখ আশরাফী।..........কুরাইশদের একটি বিরাট বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে অগ্রসর হচ্ছিল । ................এ চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার সংকল্প করেই তিনি আনসার ও মোহাজিরদের একত্র করলেন। তাদের সামনে পরিস্থিতি পরিষ্কার তুলে ধরলেন। একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা এবং অন্যদিকে দক্ষিণে এগিয়ে আসছে কুরাইশদের সেনাদল। আল্লাহর ওয়াদা, এ দুটির মধ্য থেকে কোন একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, এর মধ্য থেকে কার মোকাবিলায় তোমরা এগিয়ে যেতে চাও? জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবী মত প্রকাশ করলেন, কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানো হোক। কিন্তু নবী (সা.) এর সামনে ছিল অন্য কিছু অভিপ্রায়। তাই তিনি নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় মোহাজিরদের মধ্য থেকে মিকদাদ ইবনে আমর (রা.) উঠে বললেনঃ,


 لاَ نَقُولُ لك كَمَا قَالَ بَنُو إِسْرَائِيلَ لمُوسَى اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَا هُنَا قَاعِدُونَ, وَلَكِنِ اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا مَعَكُمَا مُقَاتِلِون مادامت عين مناتطرف- 


“হে আল্লাহর রসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যাবার হুকুম দিচ্ছেন সেদিকে চলুন। আপনি যেদিকে যাবেন আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মত একথা বলবো নাঃ যাও, তুমি ও তোমার আল্লাহ দুজনে লড়াই করো, আমরা তো এখানেই বসে রইলাম। বরং আমরা বলছিঃ চলুন আপনি ও আপনার আল্লাহ দুজনে লড়ুন আর আমরাও আপনাদের সাথে জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করবো। যতক্ষণ আমাদের একটি চোখের তারাও নড়াচড়া করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত।”কিন্তু আনসারদের মতামত না জেনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ এ পর্যন্ত যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাতে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রথম দিন তারা ইসলামকে সমর্থন করার যে শপথ নিয়েছিল তাকে কার্যকর করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত তা পরীক্ষা করার এটি ছিল প্রথম সুযোগ। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সা.) সরাসরি তাদেরকে সম্বোধন না করে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় সাদ ইবনে মুআয উঠে বললেন, সম্ভবত আপনি আমাদের সম্বোধন করে বলছেন? জবাব দিলেনঃ হাঁ। একথা শুনে সাদ বললেনঃ


لقد امنا بك وصدقناك وشهدنا ان ماجئت به هوا الحق واعطيناك عهودنا ومواثيقنا على السمع والطاعة- فامض يارسول الله لما اردت فوالذى بعثك بالحق لو استعرضت بنا هذا البحر فخضته لخضناه معك وما تخلف منا رجل واحد- وما نكره ان تلقى بنا عدونا غدا انا لنصبر عند الحرب صدق عند اللقاء ولعل الله يريك منا مانقربه عينك فسربنا على بركة الله- 


“আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনি যা কিছু এনেছেন তাকে সত্য বলে ঘোষণা করেছি। আপনার কথা শুনার ও আপনার আনুগত্য করার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কাজেই হে আল্লাহর রসূল! আপনি যা সংকল্প করেছেন তা করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরাও আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আপনি কালই আমাদের দুশমনের সাথে যুদ্ধ শুরু করুন। এটা আমাদের কাছে মোটেই অপছন্দনীয় নয়। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকবো। মোকাবিলায় আমরা সত্যিকার প্রাণ উৎসর্গীতার প্রমাণ দেবো। সম্ভবত আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু কৃতিত্ব দেখিয়ে দেবেন, যাতে আপনার চোখ শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ভরসায় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন।"এ আলোচনা ও বক্তৃতার পরে সিদ্ধান্ত হলো, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে কুরাইশ সেনা দলের মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এটা কোন যেনতেন সিদ্ধান্ত ছিল না। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল তিনশর কিছু বেশী (৮৬ জন মোহাজির, ৬১ আওস গোত্রের এবং ১৭০ জন খাযরাজ গোত্রের, । এদের মধ্যে মাত্র দুতিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকি লোকদের জন্য ৭০ টির বেশী উট ছিল না। এগুলোর পিঠে তারা তিন চারজন করে পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলেন। যুদ্ধাস্ত্রও ছিল একেবারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে বর্ম ছিল। এ কারণে গুটিকয় উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ ছাড়া এ ভয়ংকর অভিযানে শরীক অধিকাংশ মুজাহিদই হৃদয়ে উৎকণ্ঠা অনুভব করছিলেন। তারা মনে করছিলেন, যেন তারা জেনে বুঝে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সুবিধাবাদী ধরনের লোক ইসলামের পরিসরে প্রবেশ করলেও তারা এমন ইসলামের প্রবক্তা ছিল না যাতে ধন-প্রাণের সংশয় দেখা দেয়। তারা এ অভিযানকে নিছক পাগলামী বলে অভিহিত করছিল। ........


।রমযান মাসের ১৭ তারিখে বদর নামক স্থানে উভয় পক্ষের মোকাবিলা হলো। নবী (সা.) দেখলেন, তিনজন কাফেরের মোকাবিলায় একজন মুসলমান দাঁড়িয়েছে এবং তাও আবার তারা পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত নয়। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহর সামনে দোয়া করার জন্য দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে ও কান্না বিজড়িত স্বরে তিনি দোয়া করতে থাকলেনঃ


اللهم هذه قريش قد اتت بخيلائها تحاول ان تكذب رسولك , اللهم فنصرك الذى وَعَدْتَنِى اللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَاليوم لا تعبد- 


।১) উল্লেখ্য, বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাস ও সীরাত লেখকরা যুদ্ধ কাহিনী সংক্রান্ত হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় উদ্ধৃত বর্ণনাসমূহের ওপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনাগুলোর বিরাট অংশ কুরআন বিরোধী ও অনির্ভরযোগ্য। শুধুমাত্র ঈমানের কারণেই আমরা বদর যুদ্ধ সংক্রান্ত কুরআনী বর্ণনাকে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতে বাধ্য হইনা বরং ঐতিহাসিক দিকে দিয়েও যদি আজ এ যুদ্ধ সংক্রান্ত সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা থেকে থাকে, তাহলে তা হচ্ছে এ সূরা আনফাল। কারণ যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এটি নাযিল হয়েছিল। যুদ্ধে যারা শরীক ছিলেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষের বিপক্ষের সবাই এটি শুনেছিলেন ও পড়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ এর মধ্যে কোন একটি কথাও যদি সত্য ও বাস্তব ঘটনা বিরোধী হতো, তাহলে হাজার হাজার লোক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতো।


।“হে আল্লাহ! এই কুরাইশরা এসেছে, তাদের সকল ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা নিয়ে তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ! এখন তোমার সেই সাহায্য এসে যাওয়া দরকার, যার ওয়াদা তুমি করেছিলে আমার সাথে। হে আল্লাহ! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এ পৃথিবীতে আর কোথাও তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।"


।এ যুদ্ধের ময়দানে মক্কার মোহাজিরদের পরীক্ষা ছিল সবচেয়ে কঠিন। তাদের আপন ভাই-চাচা ইত্যাদি তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারোর বাপ, কারোর ছেলে, কারোর চাচা, কারোর মামা, কারোর ভাই দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিপক্ষে। এ যুদ্ধে নিজের কলিজার টুকরার ওপর তরবারী চালাতে হচ্ছিল তাদের। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র তারাই উত্তীর্ণ হতে পারে, যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে হক ও সত্যের সাথে সম্পর্ক জুড়েছ এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পুরোপুরি উদ্যোগী হয়েছে। ওদিকে আনসারদের পরীক্ষাও কিছু কম ছিল না। এতদিন তারা মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়ে কুরাইশ ও তাদের সহযোগী গোত্রগুলোর শত্রুতার ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু এবার তো তারা ইসলামের সমর্থনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। এর মানে ছিল, কয়েক হাজার লোকের একটি জনবসতি সমগ্র আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে, যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হতে পারে। অবশেষে তাদের অবিচল ঈমান ও সত্যনিষ্ঠা আল্লাহর সাহায্যের পুরষ্কার লাভে সফল হয়ে গেলো। আর নিজেদের সমস্ত অহংকার ও শক্তির অহমিকা সত্ত্বেও কুরাইশরা এ সহায়-সম্বলহীন, জানবাজ সৈনিকদের হাতে পরাজিত হয়ে গেলো। তাদের ৭০ জন নিহত হলো, ৭০ জন বন্দী হলো এবং তাদের সাজ-সরঞ্জামগুলো গনীমতের সামগ্রী হিসেবে মুসলমানদের দখলে এলো। কুরাইশদের যেসব বড় বড় সরদার তাদের মজলিস গুলজার করে বেড়াতো এবং ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে যারা সর্বক্ষণ তৎপর থাকতো, তারা এ যুদ্ধে নিহত হলো। এ চূড়ান্ত বিজয় আরবে ইসলামকে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত করলো। একজন পাশ্চাত্য গবেষক লিখেছেন, “বদর যুদ্ধের আগে ইসলাম ছিল শুধুমাত্র একটি ধর্ম ও রাষ্ট্র। কিন্তু বদর যুদ্ধের পরে তা রাষ্ট্রীয় ধর্মে বরং নিজেই রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেলো।" 


৯। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : মদীনা থেকে বদর পর্যন্ত


 

( বিস্তারিত ০৮  নং সুরা  আনফাল  এর ভূমিকা দ্রষ্টব্য ) : বদর এর যুদ্ধ  :..............মক্কী যুগের শেষ তিন-চার বছরে ইয়াসরেবে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েত থাকে অপ্রতিহত গতিতে। সেখানকার লোকেরা আরবের অন্যান্য এলাকার গোত্রগুলোর তুলনায় অধিকতর সহজে ও নির্দ্বিধায় এ আলো গ্রহণ করতে থাকে। শেষে নবুয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্জের সময় ৭৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল রাতের আঁধারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। তারা কেবল ইসলাম গ্রহণই করেননি বরং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে নিজেদের শহরে স্থান দেয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন। মহান আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে এ দুর্লভ সুযোগটি দিয়েছিলেন এবং নবী (সা.) ও হাত বাড়িয়ে তা লুফে নিয়েছিলেন। ইয়াসরেববাসীরা নবী(সা.) কে শুধুমাত্র একজন শরণার্থী হিসেবে নয় বরং আল্লাহর প্রতিনিধি এবং নেতা ও শাসক হিসেবেও আহবান করেছিলেন। আর তাঁর অনুসারীদেরকে তারা একটি অপরিচিতি দেশে নিছক মুহাজির হিসেবে বসবাস করার জন্য আহবান জানাচ্ছিলেন না। বরং আরবের বিভিন্ন এলাকায় ও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যেসব মুসলমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তাদের সবাইকে ইয়াসরেবে জমা করে ইয়াসরেবী মুসলমানদের সাথে মিলে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এভাবে মূলত ইয়াসরেব নিজেকে “মদীনাতুল ইসলাম” তথা ইসলামের নগর হিসেবে উপস্থাপিত করলো। নবী(সা.) তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে আরবের প্রথম দারুল ইসলাম গড়ে তুললেন। 


। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের অর্থ কি হতে পারে সে সম্পর্কে মদীনাবাসীরা অনবহিত ছিল না। এর পরিষ্কার অর্থ ছিল, একটি ছোট্ট শহর সারাদেশের উদ্যত তরবারি এবং সমগ্র দেশবাসীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক বয়কটের মোকাবিলায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কাজেই আকাবার বাইআত গ্রহণ করার সময় সেদিনের সেই রাত্রীকালীন মজলিসে ইসলামের প্রাথমিক সাহায্যকারী (আনসারগণ) এ পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে বুঝেই নবী (সা.) এর হাতে নিজেদের হাত রেখেছিলেন। যখন এ বাইআত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ঠিক তখনই ইয়াসরেবী প্রতিনিধি দলের সর্বকনিষ্ঠ যুব সদস্য আস’আদ ইবনে যুরারাহ (রা.) উঠে বললেনঃ


رُوَيْداً يَا أَهْلَ يَثْرِبَ! أنَّا لَمْ نَضْرِبْ اليه أَكْبَادَ الإِبِلِ إِلاَّ وَنَحْنُ نَعْلَمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ , وَإِنَّ إِخْرَاجَهُ الْيَوْمَ مُنَاواةُ للْعَرَبِ كَافَّةً وَقَتْلُ خِيَارِكُمْ وتَعَضَّكُمُ السُّيُوفُ- فَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَصْبِرُونَ عَلَى ذَلِكَ فخذوه واجره عَلَى اللَّهِ وَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَخَافُونَ مِنْ أَنْفُسِكُمْ خيفة فَذروه فَبَيِّنُوا ذَلِكَ فَهُوَ أَعْذَرُ لَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ- “থামো, হে ইয়াসরেব বাসীরা! আমরা একথা জেনে বুঝেই এঁর কাছে এসেছি যে, ইনি আল্লাহর রসূল এবং আজ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে সমগ্র আরববাসীর শত্রুতার ঝুঁকি নেয়া। এর ফলে তোমাদের শিশু সন্তানদেরকে হত্যার করা হবে এবং তোমাদের ওপর তরবারি বর্ষিত হবে। কাজেই যদি তোমাদের এ আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা থাকে তাহলে এঁর দায়িত্ব গ্রহণ করো। আল্লাহ এর প্রতিদান দেবেন। আর যদি তোমরা নিজেদের প্রাণকে প্রিয়তর মনে করে থাকো তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দাও এবং পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের অক্ষমতা জানিয়ে দাও। কারণ এ সময় অক্ষমতা প্রকাশ করা আল্লাহর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য হতে পারে”।প্রতিনিধি দলের আর একজন সদস্য আব্বাস ইবনে উবাদাহ ইবনে নাদলাহ (রা.) একথারই পুনরাবৃত্তি করেন এভাবেঃ


اتعلمون علام تبايعون هذا الرجل ؟ (قالوا نعم ، قال) إنكم تبايعونه على حرب الأحمر والأسود من الناس - فإن كنتم ترون أنكم إذا نهكت أموالكم مصيبة - وأشرافكم قتلا أسلمتموه فمن الآن عدعوه فهو والله إن فعلتم خزي الدنيا والآخرة وإن كنتم ترون أنكم وافون له بما دعوتموه إليه على نهكة الأموال وقتل الأشراف فخذوه ، فهو والله خير الدنيا والآخرة- 


“তোমরা কি জানো, এ ব্যক্তির হাতে কিসের বাইআত করছো? (ধ্বনিঃ হাঁ আমরা জানি) তোমরা এঁর হাতে বাইআত করে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নিচ্ছো।কাজেই যদি তোমরা মনে করে থাকো, যখন তোমাদের ধন-সম্পদ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হবার আশংকা দেখা দেবে তখন তোমরা এঁকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে দেবে, তাহলে আজই বরং এঁকে ত্যাগ করাই ভাল। কারণ আল্লাহর কসম, এটা দুনিয়ায় ও আখেরাতের সবখানেই লাঞ্চনার কারণ হবে। আর যদি তোমরা মনে করে থাকো, এ ব্যক্তিকে তোমরা যে, আহবান জানাচ্ছো, নিজেদের ধন-সম্পদ ধ্বংস ও নেতৃস্থানীয় লোকেদের জীবন নাশ সত্ত্বেও তোমরা তা পালন করতে প্রস্তুত থাকবে, তাহলে অবশ্যি তাঁর হাতে আঁকড়ে ধরো। কারণ আল্লাহর কসম, এরই মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ”।এ


..............সেখানে হারম শরীফের দরজার ওপর আবু জেহেল তার সমালোচনা করে বললোঃ


।الأموال وقتل الأشراف أَلَا أَرَاكَ تَطُوفُ بِمَكَّةَ آمِنًا وَقَدْ أَوَيْتُمْ الصُّبَاةَ وَزَعَمْتُمْ أَنَّكُمْ تَنْصُرُونَهُمْ وَتُعِينُونَهُمْ؟ لَوْلَا أَنَّكَ مَعَ أَبِي صَفْوَانَ مَا رَجَعْتَ إِلَى أَهْلِكَ سَالِمًا- 


“তোমরা আমাদের ধর্মত্যাগীদের আশ্রয় দেবে এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগীতা দান করবে আর আমরা তোমাদেরকে অবাধে মক্কায় তাওয়াফ করতে দেবো ভেবেছ? যদি তুমি আবু সফওয়ান তথা উমাইয়া ইবনে খলফের মেহমান না হতে তাহলে তোমাকে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে দিতাম না”।সাদ জবাবে বললেনঃ


وَاللَّهِ لَئِنْ مَنَعْتَنِي هَذَا لَأَمْنَعَنَّكَ مَا هُوَ أَشَدُّ عَلَيْكَ مِنْهُ طَرِيقَكَ عَلَى الْمَدِينَةِ 


“আল্লাহর কসম, যদি তুমি আমাকে এ কাজে বাধা দাও তাহলে আমি তোমাকে এমন জিনিস থেকে রুখে দেবো, যা তোমার জন্য এর চাইতে অনেক বেশী মারাত্মক। অর্থাৎ মদীনা দিয়ে তোমাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেবো”।অর্থাৎ এভাবে মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে যেন একথা ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করার পথ মুসলমানদের জন্য বন্ধ। আর এর জবাবে মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে বলা হলো, সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য করার পথ ইসলাম বিরোধীদের জন্য বিপদসংকুল।


...............মক্কাবাসীদের যে ব্যবসায় চলতো তার পরিমাণ ছিল বছরে আড়াই লাখ আশরাফী।..........কুরাইশদের একটি বিরাট বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে অগ্রসর হচ্ছিল । ................এ চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার সংকল্প করেই তিনি আনসার ও মোহাজিরদের একত্র করলেন। তাদের সামনে পরিস্থিতি পরিষ্কার তুলে ধরলেন। একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা এবং অন্যদিকে দক্ষিণে এগিয়ে আসছে কুরাইশদের সেনাদল। আল্লাহর ওয়াদা, এ দুটির মধ্য থেকে কোন একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, এর মধ্য থেকে কার মোকাবিলায় তোমরা এগিয়ে যেতে চাও? জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবী মত প্রকাশ করলেন, কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানো হোক। কিন্তু নবী (সা.) এর সামনে ছিল অন্য কিছু অভিপ্রায়। তাই তিনি নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় মোহাজিরদের মধ্য থেকে মিকদাদ ইবনে আমর (রা.) উঠে বললেনঃ,


 لاَ نَقُولُ لك كَمَا قَالَ بَنُو إِسْرَائِيلَ لمُوسَى اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَا هُنَا قَاعِدُونَ, وَلَكِنِ اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا مَعَكُمَا مُقَاتِلِون مادامت عين مناتطرف- 


“হে আল্লাহর রসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যাবার হুকুম দিচ্ছেন সেদিকে চলুন। আপনি যেদিকে যাবেন আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মত একথা বলবো নাঃ যাও, তুমি ও তোমার আল্লাহ দুজনে লড়াই করো, আমরা তো এখানেই বসে রইলাম। বরং আমরা বলছিঃ চলুন আপনি ও আপনার আল্লাহ দুজনে লড়ুন আর আমরাও আপনাদের সাথে জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করবো। যতক্ষণ আমাদের একটি চোখের তারাও নড়াচড়া করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত।”কিন্তু আনসারদের মতামত না জেনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ এ পর্যন্ত যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাতে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রথম দিন তারা ইসলামকে সমর্থন করার যে শপথ নিয়েছিল তাকে কার্যকর করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত তা পরীক্ষা করার এটি ছিল প্রথম সুযোগ। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সা.) সরাসরি তাদেরকে সম্বোধন না করে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় সাদ ইবনে মুআয উঠে বললেন, সম্ভবত আপনি আমাদের সম্বোধন করে বলছেন? জবাব দিলেনঃ হাঁ। একথা শুনে সাদ বললেনঃ


لقد امنا بك وصدقناك وشهدنا ان ماجئت به هوا الحق واعطيناك عهودنا ومواثيقنا على السمع والطاعة- فامض يارسول الله لما اردت فوالذى بعثك بالحق لو استعرضت بنا هذا البحر فخضته لخضناه معك وما تخلف منا رجل واحد- وما نكره ان تلقى بنا عدونا غدا انا لنصبر عند الحرب صدق عند اللقاء ولعل الله يريك منا مانقربه عينك فسربنا على بركة الله- 


“আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনি যা কিছু এনেছেন তাকে সত্য বলে ঘোষণা করেছি। আপনার কথা শুনার ও আপনার আনুগত্য করার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কাজেই হে আল্লাহর রসূল! আপনি যা সংকল্প করেছেন তা করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরাও আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আপনি কালই আমাদের দুশমনের সাথে যুদ্ধ শুরু করুন। এটা আমাদের কাছে মোটেই অপছন্দনীয় নয়। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকবো। মোকাবিলায় আমরা সত্যিকার প্রাণ উৎসর্গীতার প্রমাণ দেবো। সম্ভবত আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু কৃতিত্ব দেখিয়ে দেবেন, যাতে আপনার চোখ শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ভরসায় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন।"এ আলোচনা ও বক্তৃতার পরে সিদ্ধান্ত হলো, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে কুরাইশ সেনা দলের মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এটা কোন যেনতেন সিদ্ধান্ত ছিল না। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল তিনশর কিছু বেশী (৮৬ জন মোহাজির, ৬১ আওস গোত্রের এবং ১৭০ জন খাযরাজ গোত্রের, । এদের মধ্যে মাত্র দুতিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকি লোকদের জন্য ৭০ টির বেশী উট ছিল না। এগুলোর পিঠে তারা তিন চারজন করে পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলেন। যুদ্ধাস্ত্রও ছিল একেবারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে বর্ম ছিল। এ কারণে গুটিকয় উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ ছাড়া এ ভয়ংকর অভিযানে শরীক অধিকাংশ মুজাহিদই হৃদয়ে উৎকণ্ঠা অনুভব করছিলেন। তারা মনে করছিলেন, যেন তারা জেনে বুঝে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সুবিধাবাদী ধরনের লোক ইসলামের পরিসরে প্রবেশ করলেও তারা এমন ইসলামের প্রবক্তা ছিল না যাতে ধন-প্রাণের সংশয় দেখা দেয়। তারা এ অভিযানকে নিছক পাগলামী বলে অভিহিত করছিল। ........


।রমযান মাসের ১৭ তারিখে বদর নামক স্থানে উভয় পক্ষের মোকাবিলা হলো। নবী (সা.) দেখলেন, তিনজন কাফেরের মোকাবিলায় একজন মুসলমান দাঁড়িয়েছে এবং তাও আবার তারা পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত নয়। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহর সামনে দোয়া করার জন্য দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে ও কান্না বিজড়িত স্বরে তিনি দোয়া করতে থাকলেনঃ


اللهم هذه قريش قد اتت بخيلائها تحاول ان تكذب رسولك , اللهم فنصرك الذى وَعَدْتَنِى اللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَاليوم لا تعبد- 


।১) উল্লেখ্য, বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাস ও সীরাত লেখকরা যুদ্ধ কাহিনী সংক্রান্ত হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় উদ্ধৃত বর্ণনাসমূহের ওপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনাগুলোর বিরাট অংশ কুরআন বিরোধী ও অনির্ভরযোগ্য। শুধুমাত্র ঈমানের কারণেই আমরা বদর যুদ্ধ সংক্রান্ত কুরআনী বর্ণনাকে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতে বাধ্য হইনা বরং ঐতিহাসিক দিকে দিয়েও যদি আজ এ যুদ্ধ সংক্রান্ত সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা থেকে থাকে, তাহলে তা হচ্ছে এ সূরা আনফাল। কারণ যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এটি নাযিল হয়েছিল। যুদ্ধে যারা শরীক ছিলেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষের বিপক্ষের সবাই এটি শুনেছিলেন ও পড়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ এর মধ্যে কোন একটি কথাও যদি সত্য ও বাস্তব ঘটনা বিরোধী হতো, তাহলে হাজার হাজার লোক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতো।


।“হে আল্লাহ! এই কুরাইশরা এসেছে, তাদের সকল ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা নিয়ে তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ! এখন তোমার সেই সাহায্য এসে যাওয়া দরকার, যার ওয়াদা তুমি করেছিলে আমার সাথে। হে আল্লাহ! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এ পৃথিবীতে আর কোথাও তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।"


।এ যুদ্ধের ময়দানে মক্কার মোহাজিরদের পরীক্ষা ছিল সবচেয়ে কঠিন। তাদের আপন ভাই-চাচা ইত্যাদি তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারোর বাপ, কারোর ছেলে, কারোর চাচা, কারোর মামা, কারোর ভাই দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিপক্ষে। এ যুদ্ধে নিজের কলিজার টুকরার ওপর তরবারী চালাতে হচ্ছিল তাদের। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র তারাই উত্তীর্ণ হতে পারে, যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে হক ও সত্যের সাথে সম্পর্ক জুড়েছ এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পুরোপুরি উদ্যোগী হয়েছে। ওদিকে আনসারদের পরীক্ষাও কিছু কম ছিল না। এতদিন তারা মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়ে কুরাইশ ও তাদের সহযোগী গোত্রগুলোর শত্রুতার ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু এবার তো তারা ইসলামের সমর্থনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। এর মানে ছিল, কয়েক হাজার লোকের একটি জনবসতি সমগ্র আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে, যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হতে পারে। অবশেষে তাদের অবিচল ঈমান ও সত্যনিষ্ঠা আল্লাহর সাহায্যের পুরষ্কার লাভে সফল হয়ে গেলো। আর নিজেদের সমস্ত অহংকার ও শক্তির অহমিকা সত্ত্বেও কুরাইশরা এ সহায়-সম্বলহীন, জানবাজ সৈনিকদের হাতে পরাজিত হয়ে গেলো। তাদের ৭০ জন নিহত হলো, ৭০ জন বন্দী হলো এবং তাদের সাজ-সরঞ্জামগুলো গনীমতের সামগ্রী হিসেবে মুসলমানদের দখলে এলো। কুরাইশদের যেসব বড় বড় সরদার তাদের মজলিস গুলজার করে বেড়াতো এবং ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে যারা সর্বক্ষণ তৎপর থাকতো, তারা এ যুদ্ধে নিহত হলো। এ চূড়ান্ত বিজয় আরবে ইসলামকে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত করলো। একজন পাশ্চাত্য গবেষক লিখেছেন, “বদর যুদ্ধের আগে ইসলাম ছিল শুধুমাত্র একটি ধর্ম ও রাষ্ট্র। কিন্তু বদর যুদ্ধের পরে তা রাষ্ট্রীয় ধর্মে বরং নিজেই রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেলো।" 


৮। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : কুরাইশদের বাণিজ্যিক পথ


 

( বিস্তারিত ০৮  নং সুরা  আনফাল  এর ভূমিকা দ্রষ্টব্য ) : বদর এর যুদ্ধ  :..............মক্কী যুগের শেষ তিন-চার বছরে ইয়াসরেবে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েত থাকে অপ্রতিহত গতিতে। সেখানকার লোকেরা আরবের অন্যান্য এলাকার গোত্রগুলোর তুলনায় অধিকতর সহজে ও নির্দ্বিধায় এ আলো গ্রহণ করতে থাকে। শেষে নবুয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্জের সময় ৭৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল রাতের আঁধারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। তারা কেবল ইসলাম গ্রহণই করেননি বরং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে নিজেদের শহরে স্থান দেয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন। মহান আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে এ দুর্লভ সুযোগটি দিয়েছিলেন এবং নবী (সা.) ও হাত বাড়িয়ে তা লুফে নিয়েছিলেন। ইয়াসরেববাসীরা নবী(সা.) কে শুধুমাত্র একজন শরণার্থী হিসেবে নয় বরং আল্লাহর প্রতিনিধি এবং নেতা ও শাসক হিসেবেও আহবান করেছিলেন। আর তাঁর অনুসারীদেরকে তারা একটি অপরিচিতি দেশে নিছক মুহাজির হিসেবে বসবাস করার জন্য আহবান জানাচ্ছিলেন না। বরং আরবের বিভিন্ন এলাকায় ও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যেসব মুসলমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তাদের সবাইকে ইয়াসরেবে জমা করে ইয়াসরেবী মুসলমানদের সাথে মিলে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এভাবে মূলত ইয়াসরেব নিজেকে “মদীনাতুল ইসলাম” তথা ইসলামের নগর হিসেবে উপস্থাপিত করলো। নবী(সা.) তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে আরবের প্রথম দারুল ইসলাম গড়ে তুললেন। 


। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের অর্থ কি হতে পারে সে সম্পর্কে মদীনাবাসীরা অনবহিত ছিল না। এর পরিষ্কার অর্থ ছিল, একটি ছোট্ট শহর সারাদেশের উদ্যত তরবারি এবং সমগ্র দেশবাসীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক বয়কটের মোকাবিলায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কাজেই আকাবার বাইআত গ্রহণ করার সময় সেদিনের সেই রাত্রীকালীন মজলিসে ইসলামের প্রাথমিক সাহায্যকারী (আনসারগণ) এ পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে বুঝেই নবী (সা.) এর হাতে নিজেদের হাত রেখেছিলেন। যখন এ বাইআত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ঠিক তখনই ইয়াসরেবী প্রতিনিধি দলের সর্বকনিষ্ঠ যুব সদস্য আস’আদ ইবনে যুরারাহ (রা.) উঠে বললেনঃ


رُوَيْداً يَا أَهْلَ يَثْرِبَ! أنَّا لَمْ نَضْرِبْ اليه أَكْبَادَ الإِبِلِ إِلاَّ وَنَحْنُ نَعْلَمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ , وَإِنَّ إِخْرَاجَهُ الْيَوْمَ مُنَاواةُ للْعَرَبِ كَافَّةً وَقَتْلُ خِيَارِكُمْ وتَعَضَّكُمُ السُّيُوفُ- فَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَصْبِرُونَ عَلَى ذَلِكَ فخذوه واجره عَلَى اللَّهِ وَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَخَافُونَ مِنْ أَنْفُسِكُمْ خيفة فَذروه فَبَيِّنُوا ذَلِكَ فَهُوَ أَعْذَرُ لَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ- “থামো, হে ইয়াসরেব বাসীরা! আমরা একথা জেনে বুঝেই এঁর কাছে এসেছি যে, ইনি আল্লাহর রসূল এবং আজ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে সমগ্র আরববাসীর শত্রুতার ঝুঁকি নেয়া। এর ফলে তোমাদের শিশু সন্তানদেরকে হত্যার করা হবে এবং তোমাদের ওপর তরবারি বর্ষিত হবে। কাজেই যদি তোমাদের এ আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা থাকে তাহলে এঁর দায়িত্ব গ্রহণ করো। আল্লাহ এর প্রতিদান দেবেন। আর যদি তোমরা নিজেদের প্রাণকে প্রিয়তর মনে করে থাকো তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দাও এবং পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের অক্ষমতা জানিয়ে দাও। কারণ এ সময় অক্ষমতা প্রকাশ করা আল্লাহর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য হতে পারে”।প্রতিনিধি দলের আর একজন সদস্য আব্বাস ইবনে উবাদাহ ইবনে নাদলাহ (রা.) একথারই পুনরাবৃত্তি করেন এভাবেঃ


اتعلمون علام تبايعون هذا الرجل ؟ (قالوا نعم ، قال) إنكم تبايعونه على حرب الأحمر والأسود من الناس - فإن كنتم ترون أنكم إذا نهكت أموالكم مصيبة - وأشرافكم قتلا أسلمتموه فمن الآن عدعوه فهو والله إن فعلتم خزي الدنيا والآخرة وإن كنتم ترون أنكم وافون له بما دعوتموه إليه على نهكة الأموال وقتل الأشراف فخذوه ، فهو والله خير الدنيا والآخرة- 


“তোমরা কি জানো, এ ব্যক্তির হাতে কিসের বাইআত করছো? (ধ্বনিঃ হাঁ আমরা জানি) তোমরা এঁর হাতে বাইআত করে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নিচ্ছো।কাজেই যদি তোমরা মনে করে থাকো, যখন তোমাদের ধন-সম্পদ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হবার আশংকা দেখা দেবে তখন তোমরা এঁকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে দেবে, তাহলে আজই বরং এঁকে ত্যাগ করাই ভাল। কারণ আল্লাহর কসম, এটা দুনিয়ায় ও আখেরাতের সবখানেই লাঞ্চনার কারণ হবে। আর যদি তোমরা মনে করে থাকো, এ ব্যক্তিকে তোমরা যে, আহবান জানাচ্ছো, নিজেদের ধন-সম্পদ ধ্বংস ও নেতৃস্থানীয় লোকেদের জীবন নাশ সত্ত্বেও তোমরা তা পালন করতে প্রস্তুত থাকবে, তাহলে অবশ্যি তাঁর হাতে আঁকড়ে ধরো। কারণ আল্লাহর কসম, এরই মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ”।এ


..............সেখানে হারম শরীফের দরজার ওপর আবু জেহেল তার সমালোচনা করে বললোঃ


।الأموال وقتل الأشراف أَلَا أَرَاكَ تَطُوفُ بِمَكَّةَ آمِنًا وَقَدْ أَوَيْتُمْ الصُّبَاةَ وَزَعَمْتُمْ أَنَّكُمْ تَنْصُرُونَهُمْ وَتُعِينُونَهُمْ؟ لَوْلَا أَنَّكَ مَعَ أَبِي صَفْوَانَ مَا رَجَعْتَ إِلَى أَهْلِكَ سَالِمًا- 


“তোমরা আমাদের ধর্মত্যাগীদের আশ্রয় দেবে এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগীতা দান করবে আর আমরা তোমাদেরকে অবাধে মক্কায় তাওয়াফ করতে দেবো ভেবেছ? যদি তুমি আবু সফওয়ান তথা উমাইয়া ইবনে খলফের মেহমান না হতে তাহলে তোমাকে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে দিতাম না”।সাদ জবাবে বললেনঃ


وَاللَّهِ لَئِنْ مَنَعْتَنِي هَذَا لَأَمْنَعَنَّكَ مَا هُوَ أَشَدُّ عَلَيْكَ مِنْهُ طَرِيقَكَ عَلَى الْمَدِينَةِ 


“আল্লাহর কসম, যদি তুমি আমাকে এ কাজে বাধা দাও তাহলে আমি তোমাকে এমন জিনিস থেকে রুখে দেবো, যা তোমার জন্য এর চাইতে অনেক বেশী মারাত্মক। অর্থাৎ মদীনা দিয়ে তোমাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেবো”।অর্থাৎ এভাবে মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে যেন একথা ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করার পথ মুসলমানদের জন্য বন্ধ। আর এর জবাবে মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে বলা হলো, সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য করার পথ ইসলাম বিরোধীদের জন্য বিপদসংকুল।


...............মক্কাবাসীদের যে ব্যবসায় চলতো তার পরিমাণ ছিল বছরে আড়াই লাখ আশরাফী।..........কুরাইশদের একটি বিরাট বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে অগ্রসর হচ্ছিল । ................এ চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার সংকল্প করেই তিনি আনসার ও মোহাজিরদের একত্র করলেন। তাদের সামনে পরিস্থিতি পরিষ্কার তুলে ধরলেন। একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা এবং অন্যদিকে দক্ষিণে এগিয়ে আসছে কুরাইশদের সেনাদল। আল্লাহর ওয়াদা, এ দুটির মধ্য থেকে কোন একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, এর মধ্য থেকে কার মোকাবিলায় তোমরা এগিয়ে যেতে চাও? জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবী মত প্রকাশ করলেন, কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানো হোক। কিন্তু নবী (সা.) এর সামনে ছিল অন্য কিছু অভিপ্রায়। তাই তিনি নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় মোহাজিরদের মধ্য থেকে মিকদাদ ইবনে আমর (রা.) উঠে বললেনঃ,


 لاَ نَقُولُ لك كَمَا قَالَ بَنُو إِسْرَائِيلَ لمُوسَى اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَا هُنَا قَاعِدُونَ, وَلَكِنِ اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا مَعَكُمَا مُقَاتِلِون مادامت عين مناتطرف- 


“হে আল্লাহর রসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যাবার হুকুম দিচ্ছেন সেদিকে চলুন। আপনি যেদিকে যাবেন আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মত একথা বলবো নাঃ যাও, তুমি ও তোমার আল্লাহ দুজনে লড়াই করো, আমরা তো এখানেই বসে রইলাম। বরং আমরা বলছিঃ চলুন আপনি ও আপনার আল্লাহ দুজনে লড়ুন আর আমরাও আপনাদের সাথে জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করবো। যতক্ষণ আমাদের একটি চোখের তারাও নড়াচড়া করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত।”কিন্তু আনসারদের মতামত না জেনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ এ পর্যন্ত যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাতে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রথম দিন তারা ইসলামকে সমর্থন করার যে শপথ নিয়েছিল তাকে কার্যকর করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত তা পরীক্ষা করার এটি ছিল প্রথম সুযোগ। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সা.) সরাসরি তাদেরকে সম্বোধন না করে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। একথায় সাদ ইবনে মুআয উঠে বললেন, সম্ভবত আপনি আমাদের সম্বোধন করে বলছেন? জবাব দিলেনঃ হাঁ। একথা শুনে সাদ বললেনঃ


لقد امنا بك وصدقناك وشهدنا ان ماجئت به هوا الحق واعطيناك عهودنا ومواثيقنا على السمع والطاعة- فامض يارسول الله لما اردت فوالذى بعثك بالحق لو استعرضت بنا هذا البحر فخضته لخضناه معك وما تخلف منا رجل واحد- وما نكره ان تلقى بنا عدونا غدا انا لنصبر عند الحرب صدق عند اللقاء ولعل الله يريك منا مانقربه عينك فسربنا على بركة الله- 


“আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনি যা কিছু এনেছেন তাকে সত্য বলে ঘোষণা করেছি। আপনার কথা শুনার ও আপনার আনুগত্য করার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কাজেই হে আল্লাহর রসূল! আপনি যা সংকল্প করেছেন তা করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরাও আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আপনি কালই আমাদের দুশমনের সাথে যুদ্ধ শুরু করুন। এটা আমাদের কাছে মোটেই অপছন্দনীয় নয়। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকবো। মোকাবিলায় আমরা সত্যিকার প্রাণ উৎসর্গীতার প্রমাণ দেবো। সম্ভবত আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু কৃতিত্ব দেখিয়ে দেবেন, যাতে আপনার চোখ শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ভরসায় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন।"এ আলোচনা ও বক্তৃতার পরে সিদ্ধান্ত হলো, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে কুরাইশ সেনা দলের মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এটা কোন যেনতেন সিদ্ধান্ত ছিল না। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল তিনশর কিছু বেশী (৮৬ জন মোহাজির, ৬১ আওস গোত্রের এবং ১৭০ জন খাযরাজ গোত্রের, । এদের মধ্যে মাত্র দুতিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকি লোকদের জন্য ৭০ টির বেশী উট ছিল না। এগুলোর পিঠে তারা তিন চারজন করে পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলেন। যুদ্ধাস্ত্রও ছিল একেবারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে বর্ম ছিল। এ কারণে গুটিকয় উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ ছাড়া এ ভয়ংকর অভিযানে শরীক অধিকাংশ মুজাহিদই হৃদয়ে উৎকণ্ঠা অনুভব করছিলেন। তারা মনে করছিলেন, যেন তারা জেনে বুঝে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সুবিধাবাদী ধরনের লোক ইসলামের পরিসরে প্রবেশ করলেও তারা এমন ইসলামের প্রবক্তা ছিল না যাতে ধন-প্রাণের সংশয় দেখা দেয়। তারা এ অভিযানকে নিছক পাগলামী বলে অভিহিত করছিল। ........


।রমযান মাসের ১৭ তারিখে বদর নামক স্থানে উভয় পক্ষের মোকাবিলা হলো। নবী (সা.) দেখলেন, তিনজন কাফেরের মোকাবিলায় একজন মুসলমান দাঁড়িয়েছে এবং তাও আবার তারা পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত নয়। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহর সামনে দোয়া করার জন্য দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে ও কান্না বিজড়িত স্বরে তিনি দোয়া করতে থাকলেনঃ


اللهم هذه قريش قد اتت بخيلائها تحاول ان تكذب رسولك , اللهم فنصرك الذى وَعَدْتَنِى اللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَاليوم لا تعبد- 


।১) উল্লেখ্য, বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাস ও সীরাত লেখকরা যুদ্ধ কাহিনী সংক্রান্ত হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় উদ্ধৃত বর্ণনাসমূহের ওপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনাগুলোর বিরাট অংশ কুরআন বিরোধী ও অনির্ভরযোগ্য। শুধুমাত্র ঈমানের কারণেই আমরা বদর যুদ্ধ সংক্রান্ত কুরআনী বর্ণনাকে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতে বাধ্য হইনা বরং ঐতিহাসিক দিকে দিয়েও যদি আজ এ যুদ্ধ সংক্রান্ত সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা থেকে থাকে, তাহলে তা হচ্ছে এ সূরা আনফাল। কারণ যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এটি নাযিল হয়েছিল। যুদ্ধে যারা শরীক ছিলেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষের বিপক্ষের সবাই এটি শুনেছিলেন ও পড়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ এর মধ্যে কোন একটি কথাও যদি সত্য ও বাস্তব ঘটনা বিরোধী হতো, তাহলে হাজার হাজার লোক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতো।


।“হে আল্লাহ! এই কুরাইশরা এসেছে, তাদের সকল ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা নিয়ে তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ! এখন তোমার সেই সাহায্য এসে যাওয়া দরকার, যার ওয়াদা তুমি করেছিলে আমার সাথে। হে আল্লাহ! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এ পৃথিবীতে আর কোথাও তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।"


।এ যুদ্ধের ময়দানে মক্কার মোহাজিরদের পরীক্ষা ছিল সবচেয়ে কঠিন। তাদের আপন ভাই-চাচা ইত্যাদি তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারোর বাপ, কারোর ছেলে, কারোর চাচা, কারোর মামা, কারোর ভাই দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিপক্ষে। এ যুদ্ধে নিজের কলিজার টুকরার ওপর তরবারী চালাতে হচ্ছিল তাদের। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র তারাই উত্তীর্ণ হতে পারে, যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে হক ও সত্যের সাথে সম্পর্ক জুড়েছ এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পুরোপুরি উদ্যোগী হয়েছে। ওদিকে আনসারদের পরীক্ষাও কিছু কম ছিল না। এতদিন তারা মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়ে কুরাইশ ও তাদের সহযোগী গোত্রগুলোর শত্রুতার ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু এবার তো তারা ইসলামের সমর্থনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। এর মানে ছিল, কয়েক হাজার লোকের একটি জনবসতি সমগ্র আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে, যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হতে পারে। অবশেষে তাদের অবিচল ঈমান ও সত্যনিষ্ঠা আল্লাহর সাহায্যের পুরষ্কার লাভে সফল হয়ে গেলো। আর নিজেদের সমস্ত অহংকার ও শক্তির অহমিকা সত্ত্বেও কুরাইশরা এ সহায়-সম্বলহীন, জানবাজ সৈনিকদের হাতে পরাজিত হয়ে গেলো। তাদের ৭০ জন নিহত হলো, ৭০ জন বন্দী হলো এবং তাদের সাজ-সরঞ্জামগুলো গনীমতের সামগ্রী হিসেবে মুসলমানদের দখলে এলো। কুরাইশদের যেসব বড় বড় সরদার তাদের মজলিস গুলজার করে বেড়াতো এবং ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে যারা সর্বক্ষণ তৎপর থাকতো, তারা এ যুদ্ধে নিহত হলো। এ চূড়ান্ত বিজয় আরবে ইসলামকে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত করলো। একজন পাশ্চাত্য গবেষক লিখেছেন, “বদর যুদ্ধের আগে ইসলাম ছিল শুধুমাত্র একটি ধর্ম ও রাষ্ট্র। কিন্তু বদর যুদ্ধের পরে তা রাষ্ট্রীয় ধর্মে বরং নিজেই রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেলো।" 


৭। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : বনী ইসরাঈলের নির্গমন পথ

 


وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتَوْا عَلَىٰ قَوْمٍ يَعْكُفُونَ عَلَىٰ أَصْنَامٍ لَّهُمْ ۚ قَالُوا يَا مُوسَى اجْعَل لَّنَا إِلَٰهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ۚ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ 

(৭-আরাফ:১৩৮.)  বনী ইসরাঈলকে আমি সাগর পার করে দিয়েছি। তারপর তারা চলতে চলতে এমন একটি জাতির কাছে উপস্থিত হলো, যারা নিজেদের কতিপয় মূর্তির পূজায় লিপ্ত ছিল। বনী ইসরাঈল বলতে লাগলোঃ “হে মূসা! এদের মাবূদদের মত আমাদের জন্যও একটা মাবূদ বানিয়ে দাও।”৯৮ মূসা বললোঃ “তোমরা বড়ই অজ্ঞের মত কথা বলছো।                    


[[টিকা:৯৮) বনী ইসরাঈল যে স্থান থেকে লোহিত সাগর অতিক্রম করেছিল সেটি ছিল সম্ভবত বর্তমান সুয়েজ ও ইসমাঈলীয়ার মধ্যবর্তী কোন একটি স্থান। এখান থেকে লোহিত সাগর পার হয়ে তারা সিনাই উপদ্বীপের দক্ষিণ অঞ্চলের দিকে উপকূলের কিনারা ঘেঁষে রওয়ানা হয়েছিল। সে সময় সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম ও উত্তরাংশ মিসরের শাসনাধীন ছিল। দক্ষিণের এলাকায় বর্তমান তূর শহর ও আবু যানীমার মধ্যবর্তী স্থানে তামা ও নীলম পাথরের খনি ছিল। এ খনিজ সম্পদ দ্বারা মিসরবাসী প্রচুর লাভবান হতো। এ খনিগুলো সংরক্ষন করার জন্য মিসরীয়রা কয়েক জায়গায় টহলদার চৌকি স্থাপন করেছিল। মাফকাহ নামক স্থানে এ ধরনের একটি চৌকি ছিল। এখানে ছিল মিসরীয়দের একটি বিরাট মন্দির। উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এখনো এর ধ্বংসাবশেষে পাওয়া যায়। এর কাছাকাছি আর একটি স্থানে প্রাচীন সিরীয় জাতিসমূহের চন্দ্রদেবীর মন্দির ছিল। সম্ভবত এরই কোন একটি জায়গা দিয়ে যাবার সময় দীর্ঘকাল মিসরীয়দের গোলামীতে জীবন যাপন করার কারণে মিসরীয় পৌত্তলিক ভাবধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মনে একটি কৃত্রিম খোদার প্রয়োজন অনুভূত হয়ে থাকবে।       

         

    মিসরবাসীদের দাসত্ব বনী ইসরাঈলীদের মনমানসকে কিভাবে বিকৃত করে দিয়েছিল নিম্নোক্ত বিষয়টি থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মিসর থেকে বের হয়ে আসার ৭০ বছর পর হযরত মূসার প্রথম খলীফা হযরত ইউসা ইবনে নূন বনী ইসরাঈলীদের সাধারণ সমাবেশে তাঁর শেষ ভাষণে বলেনঃ                    “তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সৎ সংকল্প ও নিষ্ঠার সাথে তাঁর উপাসনা করো। আর তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা বড় নদীর (ফোরাত) ওপারে ও মিসরে যেসব দেবতার পূজা করতো তাদেরকে বাদ দাও। আর একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত যদি তোমাদের খারাপ লাগে তাহলে তোমরা যার উপাসনা করবে আজই তাকে মনোনীত করে নাও। …..এখন রইলো আমার ও আমার পরিবারবর্গের কথা, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করতে থাকবো।” (যিহোশূয় ২৪: ১৪-১৫)                    


এ থেকে বুঝা যায় যে, ফেরাউন শাসিত মিসরের দাসত্বের যুগে এ জাতির শিরা উপশিরা পৌত্তলিকতার যে প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল, ৪০ বছর পর্যন্ত হযরত মূসার এবং ২৮ বছর পর্যন্ত হযরত ইউশার অধীনে শিক্ষা ও অনুশীলন লাভ এবং তাঁদের নেতৃত্ব জীবন পরিচালনা করার পরও তা দূর করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় তারা নিজেদের সাবেক প্রভুদেরকে এসব মূর্তির পদতলে মাথা ঘষতে দেখেছে, মিসর থেকে বের হবার সাথে সাথেই সেই ধরনের মূর্তি দেখে তার সামনে মাথা নোয়াতে এসব বিকৃতমনা ও পথভ্রষ্ট মুসলমানরা যে উদগ্রীব হয়ে উঠবে না, সেটা কেমন করেই বা সম্ভব।]]


৬। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : সুরা আ’রাফে উল্লেখিত জাতিসমূহের এলাকা


 

فَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ ۖ فَكَيْفَ آسَىٰ عَلَىٰ قَوْمٍ كَافِرِينَ 

(৭-আরাফ:৯৩.)  আর শোআইব একথা বলতে বলতে তাদের জনপদ থেকে বের হয়ে যায়-“হে আমাদের জাতির লোকেরা! আমি আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের কল্যাণ কামনার হক আদায় করেছি। এখন আমি এমন জাতির জন্য দুঃখ করবো কেন, যারা সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করে?”৭৬                    


[[টিকা:৭৬) এখানে যতগুলো কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, সবগুলোতে আসলে একজনের ঘটনা বর্ণনা করে তার মধ্যে অন্যজনের চেহারা দেখানোর রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। এখানকার প্রত্যেকটি কাহিনী সে সময় মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর জাতির মধ্যে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছিল তার সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রত্যেকটি কাহিনী ও ঘটনার এক পক্ষে একজন নবী আছেন। তাঁর শিক্ষা, দাওয়াত, উপদেশ ও কল্যাণকামিতা এবং তাঁর সমস্ত কথাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুরূপ। আর প্রত্যেকটি কাহিনীর দ্বিতীয় পক্ষে আছে সত্য প্রত্যাখানকারী, গোষ্ঠি, সম্প্রদায় ও জাতি। তাদের আকীদাগত বিভ্রান্তি, নৈতিক চরিত্রহীনতা, মূর্খতাজনিত হঠকারিতা, তাদের গোত্র প্রধানদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা এবং সত্য অস্বীকারকারী লোকদের নিজেদের গোমরাহীর ব্যাপারে একগুয়েমী ইত্যাদি সবকিছুই ঠিক তেমনি যেমন কুরাইশদের মধ্যে পাওয়া যেতো। আবার প্রত্যেকটি কাহিনীতে সত্য অস্বীকারকারী জাতিগুলোর যে পরিণাম দেখানো হয়েছে তার মাধ্যমে আসলে কুরাইশদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর পাঠানো নবীদের কথা না মানো এবং চরিত্র সংশোধনের যে সুযোগ তোমাদের দেয়া হচ্ছে অন্ধ জিদ ও গোয়ার্তুমীরবশবর্তী হয়ে তা হেলায় হারিয়ে বসো, তাহলে চিরদিন গোমরাহী ও ফিতনা-ফাসাদের ক্ষেত্রে জিদ ধরে বিভিন্ন জাতি যেমন পতন ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তোমরাও তেমনি ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।]]


فَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ ۖ فَكَيْفَ آسَىٰ عَلَىٰ قَوْمٍ كَافِرِينَ 

(৭-আরাফ:৯৩.)  আর শোআইব একথা বলতে বলতে তাদের জনপদ থেকে বের হয়ে যায়-“হে আমাদের জাতির লোকেরা! আমি আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের কল্যাণ কামনার হক আদায় করেছি। এখন আমি এমন জাতির জন্য দুঃখ করবো কেন, যারা সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করে?”৭৬                    


[[টিকা:৭৬) এখানে যতগুলো কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, সবগুলোতে আসলে একজনের ঘটনা বর্ণনা করে তার মধ্যে অন্যজনের চেহারা দেখানোর রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। এখানকার প্রত্যেকটি কাহিনী সে সময় মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর জাতির মধ্যে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছিল তার সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রত্যেকটি কাহিনী ও ঘটনার এক পক্ষে একজন নবী আছেন। তাঁর শিক্ষা, দাওয়াত, উপদেশ ও কল্যাণকামিতা এবং তাঁর সমস্ত কথাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুরূপ। আর প্রত্যেকটি কাহিনীর দ্বিতীয় পক্ষে আছে সত্য প্রত্যাখানকারী, গোষ্ঠি, সম্প্রদায় ও জাতি। তাদের আকীদাগত বিভ্রান্তি, নৈতিক চরিত্রহীনতা, মূর্খতাজনিত হঠকারিতা, তাদের গোত্র প্রধানদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা এবং সত্য অস্বীকারকারী লোকদের নিজেদের গোমরাহীর ব্যাপারে একগুয়েমী ইত্যাদি সবকিছুই ঠিক তেমনি যেমন কুরাইশদের মধ্যে পাওয়া যেতো। আবার প্রত্যেকটি কাহিনীতে সত্য অস্বীকারকারী জাতিগুলোর যে পরিণাম দেখানো হয়েছে তার মাধ্যমে আসলে কুরাইশদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর পাঠানো নবীদের কথা না মানো এবং চরিত্র সংশোধনের যে সুযোগ তোমাদের দেয়া হচ্ছে অন্ধ জিদ ও গোয়ার্তুমীরবশবর্তী হয়ে তা হেলায় হারিয়ে বসো, তাহলে চিরদিন গোমরাহী ও ফিতনা-ফাসাদের ক্ষেত্রে জিদ ধরে বিভিন্ন জাতি যেমন পতন ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তোমরাও তেমনি ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।]]


৫। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : অসংখ্য বক্র পথের মধ্যে একটি মাত্র সরল পথ


 

وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا ۖ وَقَالَ اللَّهُ إِنِّي مَعَكُمْ ۖ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَآمَنتُم بِرُسُلِي وَعَزَّرْتُمُوهُمْ وَأَقْرَضْتُمُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا لَّأُكَفِّرَنَّ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَلَأُدْخِلَنَّكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۚ فَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ مِنكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ 

(৫-মায়েদা:১২.)  আল্লাহ বনী ইসরাঈলদের থেকে পাকাপোক্ত অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে বারো জন ‘নকীব’৩১ নিযুক্ত করেছিলেন। আর তিনি তাদেরকে বলেছিলেনঃ আমি তোমাদের সাথে আছি। যদি তোমরা নামায কায়েম করো, যাকাত দাও, আমার রসূলদেরকে মানো ও তাদেরকে সাহায্য করো৩২ এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে থাকো,৩৩ তাহলে নিশ্চিত বিশ্বাস করো আমি তোমাদের থেকে তোমাদের পাপগুলো মোচন করে দেবো৩৪ এবং তোমাদের এমন সব বাগানের মধ্যে প্রবেশ করাবো যার তলদেশ দিয়ে ঝরণাধারা প্রবাহিত হবে। কিন্তু এরপর তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কুফরী নীতি অবলম্বন করবে, সে আসলে সাওয়া-উস-সাবীল৩৫ তথা সরল সঠিক পথ হারিয়ে ফেলেছে।                    


[[টিকা:৩১) ‘নকীব’ অর্থ পর্যবেক্ষক, রক্ষণাবেক্ষণকারী ও তদন্তকারী। বনী ইসরাঈল ছিল বারোটি গোত্রে বিভক্ত। আল্লাহ প্রত্যেক গোত্র থেকে একজনকে নিয়ে সে গোত্রের ওপরই তাকে নকীব নিযুক্ত করার হুকুম দিয়েছিলেন। নকীবের কাজ ছিল তার গোত্রের লোকদের চালচলন ও অবস্থার প্রতি নজর রাখা এবং তাদেরকে বেদ্বীনী ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। বাইবেলের গণনা পুস্তকে বারো জন ‘সরদার’-এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কুরআনে এ ‘নকীব’ শব্দের মাধ্যমে তাদের যে পদমর্যাদা ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে বাইবেলের বর্ণনা থেকে তা প্রকাশ হয় না। বাইবেল তাদেরকে নিছক সরদার ও প্রধান হিসেবে পেশ করেছে। অন্যদিকে কুরআন তাদেরকে নৈতিক ও ধর্মীয় পর্যবেক্ষক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী বলে গণ্য করেছে।]]                    


[[টিকা:৩২) অর্থাৎ আমার পক্ষ থেকে যে রসূলই আসবে যদি তোমরা তাঁর দাওয়াত কবুল করতে থাকো এবং তাকে সাহায্য করতে থাকো।]]                    


[[টিকা:৩৩) অর্থাৎ আল্লাহর পথে নিজের ধন সম্পদ ব্যয় করতে থাকো। যেহেতু মানুষ আল্লাহর পথে যা ব্যয় করে আল্লাহ তার এক একটি পাইকেও কয়েকগুণ বাড়িয়ে ফেরত দেবার ওয়াদা করেন, তাই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর পথে অর্থ সম্পদ ব্যয় করাকে “ঋণ” হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে, তা অবশ্যি “উত্তম ঋণ” হতে হবে। অর্থাৎ বৈধ উপায়ে সংগৃহীত অর্থ আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে এবং আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও সৎ সংকল্প সহকারে ব্যয় করতে হবে।]]                    


[[টিকা:৩৪) কারোর পাপ মোচন করার দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সত্য ও সঠিক পথ অবলম্বন করার এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চিন্তা ও কর্মের সঠিক পথে চলার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ মানুষের আত্মা বিভিন্ন প্রকার পাপের মলিনতা থেকে এবং তার জীবনধারা বহু প্রকার দোষ ও ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে যেতে থাকবে।                    দুই, এ পরিশুদ্ধি সত্ত্বেও যদি কোন ব্যক্তি সামগ্রিকভাবে পূর্ণতার পর্যায়ে না পৌঁছতে পারে এবং তার মধ্যে কিছু ত্রুটি ও গুনাহ থেকে যায় তাহলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে জবাবদিহির সম্মুখীন করবেন না এবং সে গুনাহগুলো তার হিসেব থেকে বিলুপ্ত করে দেবেন। কারণ যে ব্যক্তি মৌলিক হেদায়াত ও সংশোধন গ্রহণ করে নিয়েছে আল্লাহ তার ছোটখাট ও পরোক্ষ ত্রুটিগুলো পাকড়াও করার মতো কঠোর নীতি অবলম্বন করবেন না।]]                    


[[টিকা:৩৫) অর্থাৎ সে ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ পেয়ে আবার তা হারিয়ে ফেলেছে এবং ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়েছে। ‘সাওয়া-উস-সাবীলের’ অনুবাদ করা যেতে পারে ‘সরল-সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পথ। ’ কিন্তু এরপরও তার পুরোপুরি অর্থ প্রকাশিত হয় না। তাই আয়াতের অনুবাদের সময় হুবুহু মূল শব্দটিই রাখাহয়েছে।                    এ শব্দটির গভীর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য প্রথমেই এ কথাটি হৃদয়ংগম করে নিতে হবে যে, মানুষের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছ একটি ছোটখাটো জগত। এ খুদে জগতটি অসংখ্য শক্তি ও যোগ্যতায় পরিপূর্ণ। ইচ্ছা, আকাংখা, আবেগ, অনুভূতি ও বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা এখানে বাসা বেঁধে আছে। দেহ ও প্রবৃত্তির বিভিন্ন দাবী এবং আত্মা ও মানবিক প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকার চাহিদার ভীড় এখানে সর্বক্ষণ। তারপর ব্যক্তি মানুষেরা একত্র হয়ে যে সমাজ কাঠামো নির্মাণ করে সেখানেও ঘটে অসংখ্য জটিল সম্পর্কের সমন্বয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশের সাথে সাথে এ জটিলতাও বেড়ে যেতে থাকে। এরপর সারা দুনিয়ায় মানুষের চারদিকে জীবন ধারণের যেসব উপকরণ ছড়িয়ে আছে সেগুলো কাজে লাগাবার এবং মানবিক প্রয়োজনে ও মানব সভ্যতার বিনির্মাণে সেগুলো ব্যবহার করার প্রশ্নও ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে অসংখ্য ছোট বড় সমস্যার জন্ম দেয়।                    মানুষ তার সহজাত দুর্বলতার কারণে জীবনের এ সমগ্র কর্মক্ষেত্রটির ওপর একই সময়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টি দিতে পারে না। তাই মানুষ নিজেই নিজের জীবনের জন্য এমন কোন পথ তৈরী করতে পারে না যেখানে তার সমস্ত শক্তির সাথে পুরোপুরি ইনসাফ করা যেতে পারে, যেখানে তার সমস্ত ইচ্ছা ও আশা-আকাংখা যথাযথভাবে পূর্ণ করা যায়, তার সমস্ত আবেগ, অনুভূতি ও প্রবণতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, একটি ন্যায়ানুগ সমতা রক্ষা করে তার ভেতরের ও বাইরের সমস্ত চাহিদা ও দাবী পূরণ করা যায়, তার সমাজ জীবনের সমস্ত সমস্যার প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করে তাদের সুষ্ঠু সমাধান বের করা যায় এবং জড় বস্তুগুলোকেও, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ন্যায়, ইনসাফ, সমতা, ভারসাম্য ও সত্যনিষ্ঠা সহকারে ব্যবহার করা যায়। মানুষ নিজেই যখন নিজের নেতা ও বিধাতায় পরিণত হয় তখন সত্যের বিভিন্ন দিকের মধ্য থেকে কোন একটি দিক, জীবনের প্রয়োজনের মধ্য থেকে কোন একটি প্রয়োজন, সমাধান প্রত্যাশী সমস্যাগুলোর কোন একটি সমস্যা তার মস্তিষ্ক ও চিন্তা জগতকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলোর সাথে সে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বে-ইনসাফী করতে থাকে। তখন তার এ সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত করার ফলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সে ভারসাম্যহীনতার কোন এক প্রান্তের দিকে বাঁকাভাবে চলতে থাকে। তারপর এভাবে চলতে চলতে বক্রতার শেষ প্রান্তে পৌঁছার আগেই তা মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। ফলে যে সমস্ত দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে বে-ইনসাফী করা হয়েছিল তারা বিদ্রোহ শুরু করে দেয় এবং তাদের সাথে ইনসাফ করার জন্য তারা চাপ দিতে থাকে। কিন্তু এরপরও ইনসাফ হয় না। কারণ আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। অর্থাৎ আগের ভারসাম্যহীনতার কারণে যেগুলোকে সবচেয়ে বেশী দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে কোন একটি মানুষের মস্তিষ্ক ও চিন্তা জগতকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং একটি বিশেষ দাবী অনুযায়ী একটি বিশেষ দিকে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখানে আবার অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে বে-ইনসাফী হতে থাকে। এভাবে সরল সোজা পথে চলা মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব হয় না। সবসময়ই সে ঢেউয়ের দোলায় দোদুল্যমান থাকে এবং ধ্বংসের এক কিনার থেকে আর এক কিনারে তাকে ঠেলে দেয়া হয়। মানুষ নিজের জীবন ক্ষেত্রে চলার জন্য যতগুলো পথ তৈরী করেছে সবই বক্র রেখার মতো। একটি ভুল প্রান্তে গিয়ে তার চলা শেষ হয়। আবার সেখান থেকে যখন চলা শুরু করে তখন কোন ভুল দিকেই এগিয়ে চলে।                    এ অসংখ্য বক্র ও ভুল পথের মধ্য দিয়ে এমন একটি পথ চলে গেছে যার অবস্থান ঠিক মধ্যভাগে। এ পথে মানুষের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য, প্রবণতা, আশা-আকাংখা, আবেগ, অনুভূতি, তার দেহ ও আত্মার সমস্ত দাবী ও চাহিদা এবং তার জীবনের যাবতীয় সমস্যার সাথে পূর্ণ ইনসাফ করা হয়েছে। এ পথে কোন প্রকার বক্রতার লেশ মাত্র নেই। কোন দিকের প্রতি অযথা পক্ষপাতিত্ব ও তাকে সুযোগ-সুবিধা দান এবং কোন দিকের সাথে জুলুম ও বেইনসাফী করার প্রশ্নই এখানে নেই। মানুষের জীবনের সঠিক উন্নয়ন, ক্রমবিকাশ এবং তার সাফল্য ও অগ্রগতির জন্য এ ধরনের একটি পথ একান্ত অপরিহার্য। মানুষের মূল প্রকৃতি এ পথেরই সন্ধানে ফিরছে। এ সোজা সরল রাজপথটির অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকার কারণেই তার বিভিন্ন বক্র পথের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু নিজের চেষ্টায় এ রাজপথের সন্ধান লাভ করার ক্ষমতা মানুষের নেই। একমাত্র আল্লাহই তাকে এ পথের সন্ধান দিতে পারেন। মানুষকে এ পথের সন্ধান দেবার জন্যই আল্লাহ তাঁর রসূল পাঠিয়েছেন।                    কুরআন এ পথকেই ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ ও ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ আখ্যা দিয়েছে। দুনিয়ার এ জীবন থেকে নিয়ে আখেরাতের জীবন পর্যন্ত অসংখ্য বক্র পথের মধ্য দিয়ে এ সরল সোজা রাজপথটি চলে গেছে। যে ব্যক্তি এ পথে অগ্রসর হয়েছে সে এ দুনিয়ায়ও সঠিক পথের যাত্রী এবং আখেরাতেও সফলকাম হয়েছে। আর যে ব্যক্তি এ পথ হারিয়ে ফেলেছে সে এখানে বিভ্রান্ত হয়েছে, ভুল পথে চলেছে এবং আখেরাতেও অনিবার্যভাবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কারণ, জীবনের সমস্ত বক্র পথ জাহান্নামের দিকেই চলে গেছে।                    আধুনিক যুগের কতিপয় অজ্ঞ দার্শনিক মানুষকে উপযুর্পরি এক প্রান্তিকতা থেকে আর এক প্রান্তিকতার দিকে ধেয়ে চলতে দেখে এ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া(Dialectic Process) মানব জীবনের উন্নতি, অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক পথ। নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে তারা এ ধারণা করে বসেছেন যে, প্রথমে একটি চরমপন্থী দাবী (Thesis) মানুষকে একদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর এর প্রতিক্রিয়ায় একই পর্যায়ের আরেকটি চরম ভাবাপন্ন দাবী (Antithesis) তাকে আর এক প্রান্তে ঠেলে নিয়ে যায়। আর এরপর তাদের উভয়ের মিশ্রণে (Synthesis) জীবনের অগ্রগতি ও বিকাশের পথ তৈরী হয়। তাদের মতে এটিই হচ্ছে মানব জীবনের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের পথ। অথচ এটি মোটেই ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির পথ নয়। বরং এ হচ্ছে দুর্ভাগ্যের ধাক্কা, যা মানুষের জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত করার এবং তার যথার্থ ক্রমবিকাশের পথে বারবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। প্রত্যেকটি চরমপন্থী ও প্রান্তিকতাবাদী জীবনকে কোন একটি লক্ষ্যের দিকে চালিত করে এবং তাকে টেনে নিয়ে চলে। এভাবে চলতে চলতে যখন সে ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ থেকে অনেক দূরে সরে যায় তখন জীবনেরই অপর কতকগুলো উপেক্ষিত সত্য, যাদের সাথে বেইনসাফী করা হচ্ছিল, তারাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। এ বিদ্রোহ একটি পাল্টা দাবীর আকারে আত্মপ্রকাশ করে তাকে উল্টো দিকে টানতে থাকে। ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ যত কাছে আসতে থাকে ততই এ সংঘর্ষশীল দাবীগুলোর মধ্যে আপোস হতে থাকে এবং তাদের মিশ্রণে এমন কিছু জিনিস অস্তিত্বলাভ করে যা মানুষের জীবনের জন্য উপকারী ও লাভজনক। কিন্তু যখন সেখানে ‘সাওয়া-উস-সাবীলের’ সন্ধান দেয়ার মতো আলো থাকে না এবং তার ওপর অবিচল থাকার মতো ঈমানেরও অস্তিত্ব থাকে না তখন এ পাল্টা দাবী জীবনকে সেই স্থানে টিকে থাকতে দেয় না বরং নিজের শক্তির জোরে তাকে বিপরীত প্রান্তিকতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত জীবনের অন্য কিছু সত্যকে অস্বীকার করার পর্ব শুরু হয়ে যায়। এর ফলে আর একটা বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এসব সংকীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী দার্শনিকদের মধ্যে যদি কুরআনের আলো পৌঁছে গিয়ে থাকতো এবং তারা ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ কি জিনিস তা দেখতে পেতেন। তাহলে তারা জানতে পারতেন, এ ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ই মানুষের জন্য একমাত্র সঠিক ও নির্ভুল পথ। বক্র রেখায় ক্রমাগত এক প্রান্তিকতা থেকে আর এক প্রান্তিকতায় ধাক্কা খেয়ে বেড়ানো মানব জীবনের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের কোন সঠিক ও নির্ভুল পথ নয়।]]


৪। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : বনী ইসরাঈলের মরু পরিক্রমা



 قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ ۛ أَرْبَعِينَ سَنَةً ۛ يَتِيهُونَ فِي الْأَرْضِ ۚ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ 

(৫-মায়েদা:২৬.)  আল্লাহ জবাব দিলেনঃ ঠিক আছে, তাহলে ঐ দেশটি চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য হারাম। তারা পৃথিবীতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াবে,৪৬ এ নাফরমানদের প্রতি কখনো সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করো না।৪৭                    


[[টিকা:৪৬) এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বাইবেলের গণনা পুস্তক, দ্বিতীয় বিবরণ ও যিহোশূয় পুস্তকে পাওয়া যাবে। এর সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ হযরত মূসা ফিলিস্তিনের অবস্থা জানার জন্য ফারান থেকে বনী ইসরাঈলের ১২ জন সরদারকে ফিলিস্তিন সফরে পাঠান। তারা ৪০ দিন সফর করার পর সেখান থেকে ফিরে আসেন। জাতির এক সাধারণ সমাবেশে তারা জানান যে, ফিলিস্তিন তো খাদ্য ও অন্যান্য ভোগ্য সামগ্রীর প্রাচুর্যে ভরা এক সুখী সমৃদ্ধ দেশ, এতে সন্দেহ নেই। “কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা অত্যন্ত শক্তিশালী-----তাদের ওপর আক্রমণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই-----সেখানে আমরা যত লোক দেখেছি তারা সবাই বড়ই দীর্ঘদেহী। সেখানে আমরা বনী ইনাককেও দেখেছি। তারা মহাপরাত্রুমশালী ও দূর্ধর্ষ। তারা বংশ পরস্পরায় পরাক্রমশালী। আর আমরা তো নিজেদের দৃষ্টিতেই ফড়িংয়ের মতো ছিলাম এবং তাদের দৃষ্টিতেও।”----এ বর্ণনা শুনে সবাই সমস্বরে বলে উঠেঃ “হায়, যদি আমরা মিসরেই মরে যেতাম! হায়, যদি এ মরুর বুকেই আমরা মরে যেতাম! আল্লাহ কেন আমাদের ঐ দেশে নিয়ে গিয়ে তরবারির সাহায্যে হত্যা করাতে চায়? এরপর আমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তো লুটের মালে পরিণত হবে। আমাদের জন্য মিসরে ফিরে যাওয়াই কি মঙ্গলজনক হবে না? ” তারপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকে এসো আমরা কাউকে নিজেদের সরদার বানিয়ে নিই এবং মিসরে ফিরে যাই। একথা শুনে ফিলিস্তিনে যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল সেই বারো জন সরদারদের মধ্য থেকে দু’জন-ইউশা ও কালেব উঠে দাঁড়ান। তারা এ ভীরুতা ও কাপুরুষতার জন্য জাতিকে তিরস্কার করেন। কালেব বলেন, “চলো, আমরা অতর্কিতে আক্রমণ করে সে দেশটি দখল করে নিই। কারণ সে দেশটি পরিচালনা করার যোগ্যতা আমাদের আছে। তারপর তারা দু’জন এক বাক্যে বলে ওঠেন, “যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে তিনি অবশ্যি আমাদের সে দেশে পৌঁছাবেন।----তবে তোমরা যেন আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করো এবং সে দেশের লোকদের ভয়ে ভীত না হও।” “আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন, কাজেই ওদের ভয় পেয়ো না।” কিন্তু জাতি তার জবাব দিল একথা বলে, “ওদেরকে পাথর মেরে হত্যা করো।” অবশেষে আল্লাহর ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং তিনি ফয়সালা করলেন, এখন ইউশা ও কালেব ছাড়া এ জাতির বয়স্ক পুরুষদের মধ্য থেকে আর কেউ সে ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারবে না। এ জাতি চল্লিশ বছর পর্যন্ত গৃহহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে থাকবে। অবশেষে যখন এদের মধ্যকার বিশ বছরের থেকে শুরু করে তার ওপরের বয়সের সমস্ত লোক মরে যাবে এবং নবীন বংশধররা যৌবনে প্রবেশ করবে তখনি এদেরকে ফিলিস্তিন জয় করার সুযোগ দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের ফারান মরুভূমি থেকে পূর্ব জর্দানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৩৮ বছর লেগে যায়। যেসব লোক যুব বয়সে মিসর থেকে বের হয়েছিল তারা সবাই এ সময়ের মধ্যে মারা যায়। পূর্ব জর্দান জয় করার পর হযরত মূসারও ইন্তিকাল হয়। এরপর হযরত ইউশা ইবনে নূনের খিলাফত আমলে বনী ইসরাঈল ফিলিস্তিন জয় করতে সমর্থ হয়।]]                    


[[টিকা:৪৭) বর্ণনার ধারাবাহিকতার প্রতি দৃষ্টি রেখে চিন্তা করলে এখানে এ ঘটনার বরাত দেবার উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। গল্পচ্ছলে একথা বর্ণনা করে বনী ইসরাঈলকে আসলে একথা বুঝানো হচ্ছে যে, মূসার সময় অবাধ্যতা, সত্য থেকে বিচ্যুতি ও কাপুরুষতার কাজ করে তোমরা যে শাস্তি পেয়েছিলে এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক নীতি অবলম্বন করলে তার চেয়ে অনেক বেশী শাস্তি ভোগ করবে।]]


৩। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : ওহুদ যুদ্ধক্ষেত্রের নকশা

وَإِذْ غَدَوْتَ مِنْ أَهْلِكَ تُبَوِّئُ الْمُؤْمِنِينَ مَقَاعِدَ لِلْقِتَالِ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ 


(৩-আলে-ইমরান:১২১.)  (হে নবী!৯৪ মুসলমানদের সামনে সে সময়ের কথা বর্ণনা কারো) যখন তুমি অতি প্রত্যুষে নিজের ঘর থেকে বের হয়েছিলে এবং (ওহোদের ময়দানে) মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত করেছিলে। আল্লাহ‌ সমস্ত কথা শুনেন এবং তিনি সবকিছু ভালো করে জানেন।                    


[[টিকা:৯৪) এখান থেকে চতুর্থ ভাষণ শুরু হচ্ছে। ওহোদ যুদ্ধের পর এটি নাযিল হয়। এখানে ওহোদ যুদ্ধের ওপর মন্তব্য করা হয়েছে। আগের ভাষণটি শেষ করার সময় বলা হয়েছিল, ‍‍“যদি তোমরা সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন কৌশল কার্যকর হতে পারবেনা।” এখন যেহেতু ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণই দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে সবরের অভাব ছিল এবং কোন কোন মুসলমানের এমন কিছু ভুলচুক হয়ে গিয়েছিল যা ছিল আল্লাহভীতি বিরোধী, তাই তাদের এই দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্কবাণী সম্বলিত এ ভাষণটি উপরোক্ত ভাষণের শেষ বাক্যটির পরপরই তার সাথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।                   


 এ ভাষণটির বর্ণনাভংগী বড়ই বৈশিষ্ট্যময়। ওহোদ যুদ্ধের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার প্রত্যেকটির ওপর পৃথক পৃথকভাবে কয়েকটি মাপাজোখা শব্দ সমন্বিত ভারসাম্যপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে শিক্ষণীয় মন্তব্য করা হয়েছে। এগুলো বুঝতে হলে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোর পটভূমি জানা একান্ত অপরিহার্য।                    তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের শুরুতে মক্কার কুরাইশরা প্রায় তিন হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। সংখ্যায় বেশী হবার পরও অস্ত্রশস্ত্রও তাদের কাছে ছিল মুসলমানদের চাইতে অনেক বেশী। এর ওপর ছিল তাদের বদর যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার তীব্র আকাংখা। নবী ﷺ ও অভিজ্ঞ সাহাবীগণ মদীনায় অবরুদ্ধ হয়ে প্রতিরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি এমন কতিপয় শাহাদাতের আকাংখায় অধীরভাবে প্রতীক্ষারত তরুণ সাহাবী শহরের বাইরে বের হয়ে যুদ্ধ করার ওপর জোর দিতে থাকেন। অবশেষে তাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে নবী ﷺ বাইরে বের হবার ফয়সালা করেন। এক হাজার লোক তাঁর সাথে বের হন। কিন্তু ‘শওত’ নামক স্থানে পৌঁছে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার তিনশো সঙ্গী নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে তার এহেন আচরণে মুসলিম সেনাদলে বেশ বড় আকারের অস্থিরতা ও হতাশার সঞ্চার হয়। এমন কি বনু সাল্‌মা ও বনু হারেসার লোকরা এত বেশী হতাশ হয়ে পড়ে যে, তারাও ফিরে যাবার সংকল্প করে ফেলেছিল।                    

 

 কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ী সাহাবীগণের প্রচেষ্টায় তাদের মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা দূর হয়ে যায়। এই অবশিষ্ট সাতশো সৈন্য নিয়ে নবী ﷺ সামনের দিকে এগিয়ে যান এবং ওহোদ পর্বতের পাদদেশে (মদীনা থেকে প্রায় চার মাইল দূরে) নিজের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যার ফলে পাহাড় থাকে তাদের পেছন দিকে এবং সামনের দিকে থাকে কুরাইশ সেনাদল। একপাশে এমন একটি গিরিপথ ছিল, যেখান থেকে আকস্মিক হামলা হবার আশঙ্কা ছিল। সেখানে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরের নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী মোতায়েন করেন। তাদেরকে জোর তাগীদ দিয়ে জানিয়ে দেনঃ “কাউকে আমাদের ধারে কাছে ঘেষঁতে দেবে না। কোন অবস্থায় এখান থেকে সরে যাবে না। যদি তোমরা দেখো, পাখিরা আমাদের গোশত ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে, তাহলেও তোমরা নিজেদের জায়গা থেকে সরে যাবে না।” অতঃপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিকে মুসলমানদের পাল্লা ভারী থাকে। এমনকি মুশরিকদের সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তারা বিচ্ছিন্ন –বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু এই প্রাথমিক সাফল্যকে পূর্ণ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দেবার পরিবর্তে গনীমতের মাল আহরণ করার লোভ মুসলমানদের বশীভূত করে ফেলে। তারা শত্রু সেনাদের ধন-সম্পদ লুট করতে শুরু করে।                    ওদিকে যে তীরন্দাজদেরকে পেছন দিকের হেফাজতে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা যখন দেখতে পেলো শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে এবং গনীমতের মাল লুট করা হচ্ছে তখন তারাও নিজেদের জায়গা ছেড়ে গনীমতের মালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কড়া নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বার বার বাঁধা দিতে থাকেন। কিন্তু মাত্র কয়েকজন ছাড়া কাউকে থামানো যায়নি। কাফের সেনাদলের একটি বাহিনীর কমাণ্ডার খালেদ ইবনে অলীদ যথা সময়ে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে পাহাড়ের পেছন দিক থেকে এক পাক ঘুরে এসে গিরিপথে প্রবেশ করে আক্রমণ করে বসেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাঁর মাত্র কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে এই আক্রমণ সামাল দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। গিরিপথের ব্যুহ ভেদ করে খালেদ তার সেনাদল দিয়ে অকস্মাৎ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। খালেদের বাহিনীর এই আক্রমণ পলায়নপর কাফেরবাহিনীর মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। তারাও পেছন ফিরে মুসলমানদের ওপর একযোগে আক্রমণ করে বসে। এভাবে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা বদলে যায়। হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত অবস্থার মুখোমুখি হয়ে মুসলমানরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তাদের একটি বড় অংশ বিক্ষিপ্ত হয়ে পলায়নমুখী হয়। তবুও কয়েক জন সাহসী সৈন্য তখনো যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। এমন সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, নবী ﷺ শহীদ হয়ে গেছেন। এ গুজবটি সাহাবায়ে কেরামের অবশিষ্ট বাহ্যিক জ্ঞানটুকুও বিলুপ্ত করে দেয়। এতক্ষণ যারা ময়দানে লড়ে যাচ্ছিলেন এবার তারাও হিম্মতহারা হয়ে বসে পড়েন। এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারপাশে ছিলেন মাত্র দশ বারো জন উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ। তিনি নিজেও আহত ছিলেন। পরিপূর্ণ পরাজয়ে আর কিছুই বাকি ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে সাহাবীগণ জানতে পারলেন, নবী ﷺ জীবিত আছেন। কাজেই তারা সবদিক থেকে একে একে তাঁর চারদিকে সমবেত হতে থাকে। তারা তাঁকে নিরাপদে পর্বতের ওপরে নিয়ে যান। এ সময়ের এ বিষয়টি আজও দুর্ব্যেধ্য রয়ে গেছে এবং এ প্রশ্নটির জবাব আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি যে, কাফেররা তখন অগ্রবর্তী হয়ে ব্যাপকভাবে আক্রমণ না চালিয়ে কিসের তাড়নায় নিজেরাই মক্কায় ফিরে গিয়েছিল? মুসলমানরা এত বেশী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাদের পক্ষে পুনর্বার এক জায়গায় একত্র হয়ে যথারীতি যুদ্ধ শুরু করা কঠিন ছিল। কাফেররা তাদের বিজয়কে পূর্ণতার প্রান্তসীমায় পৌঁছাতে উদ্যোগী হলে তাদের সাফল্য লাভ অসম্ভব ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারা নিজেরাই বা কেন ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা আজও অজানা রয়ে গেছে।]]


 

২। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : হজ্বের পবিত্র স্থানসমূহের চিত্র

 



 ثُمَّ أَفِيضُوا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ 


(০২-বাক্বারা-১৯৯.)  তারপর যেখান থেকে আর সবাই ফিরে আসে তোমরাও সেখান থেকে ফিরে এসো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।২২০ নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়।                   

 

 [[টিকা-২২০) হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর সময় আরবে হজ্জের সাধারণ প্রচলিত পদ্ধতি ছিল এই যে, ৯ই যিলহজ্জ তারা মিনা থেকে আরাফাত যেতো এবং ১০ তারিখের সকালে সেখান থেকে ফিরে এসে মুযদালিফায় অবস্থান করতো। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন ধীরে ধীরে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের ন্যায় আরবে কুরাইশদের ধর্মীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন তারা বললো, আমরা হারাম শরীফের অধিবাসী, সাধারণ আরবদের সাথে আমরা আরাফাত পর্যন্ত যাবো, এটা আমাদের জন্য মর্যাদাহানিকর। কাজেই তারা নিজেদের জন্য পৃথক মর্যাদাজনক ব্যবস্থার প্রচলন করলো। তারা মুযদালিফা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসতো এবং সাধারণ লোকদের আরাফাত পর্যন্ত যাবার জন্য ছেড়ে দিতো। পরে বনী খুযাআ ও বনী কিনানা গোত্রদ্বয় এবং কুরাইশদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য গোত্রও এই পৃথক অভিজাতমূলক ব্যবস্থার অধিকারী হলো। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, কুরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোর মর্যাদাও সাধারণ আরবদের তুলনায় অনেক উঁচু হলে গেলো। তারাও আরাফাতে যাওয়া বন্ধ করে দিল। এ গর্ব ও অহংকারের পুত্তলিটিকে এ আয়াতে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে কুরাইশ, তাদের আত্মীয় ও চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোকে এবং সাধারণভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এমন সব লোকদেরকে যারা আগামীতে কখনো নিজেদের জন্য এ ধরনের পৃথক ব্যবস্থা প্রচলনের আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ করে। তাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, সবাই যতদূর পর্যন্ত যায় তোমরাও তাদের সাথে ততদূর যাও, তাদের সাথে অবস্থান করো, তাদের সাথে ফিরে এসো এবং এ পর্যন্ত জাহেলী অহংকার ও আত্মম্ভিরতার কারণে, তোমরা সুন্নাতে ইবরাহিমীর যে বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছো সেজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো।


১। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : হযরত ইবরাহীম আ: এর হিজরতের পথ




يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ 
(২-সুরা-বাক্বারা:১২২.)  হে বনী১২৩ ইসরাঈল! তোমাদের আমি যে নিয়ামত দান করেছিলাম এবং বিশ্বের জাতিদের ওপর তোমাদের যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম তার কথা স্মরণ করো।

 [[টিকা-১২৩) এখান থেকে আর একটি ধারাবাহিক ভাষণ শুরু হচ্ছে। এখানে পরিবেশিত বক্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন।

একঃ হযরত নূহ (আ:) এর পরে হযরত ইবরাহীম (আ:) প্রথম বিশ্বজনীন নবী। মহান আল্লাহ‌ তাঁকে ইসলামের বিশ্বজনীন দাওয়াত ছড়াবার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমে তিনি নিজে সশরীরে ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের (অর্থাৎ ইসলাম) দিকে আহবান করতে থাকেন। অতঃপর এই মিশন সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। পূর্ব জর্দানে নিজের ভাতিজা হযরত লূতকে নিযুক্ত করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের ছেলে হযরত ইসহাককে এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় ছেলে হযরত ইসমাঈলকে। তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কা’বাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ মতো এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন।

দুইঃ হযরত ইবরাহীমের বংশধারা দু’টি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয়। একটি শাখা হচ্ছে, হযরত ইসমাঈলের সন্তান-সন্ততিবর্গ। এরা আরবে বসবাস করতো। কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যেসব আরব গোত্র বংশগত দিক দিয়ে হযরত ইসমাঈলের সন্তান ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলেই তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো। দ্বিতীয় শাখাটি ছিল হযরত ইসহাকের সন্তানবর্গের। এই শাখায় হযরত ইয়াকুব, হযরত ইউসূফ, হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান, হযরত ইয়াহ্‌হিয়া, হযরত ঈসা প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন। আর ইতিপূর্বে বলেছি, যেহেতু হযরত ইয়াকুবের আর এক নাম ছিল ইসরাঈল, তাই তাঁর বংশ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত হয়। তাঁর প্রচার অভিযানের ফলে যেসব জাতি তাঁর দ্বীন গ্রহণ করে তারা তার মধ্যে নিজেদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেয় অথবা তারা বংশগতভাবে তাদের থেকে আলাদা থাকলেও ধর্মীয়ভাবে তাদের অনুসারী থাকে। এই শাখায় অবনতি ও অধঃপতন সূচিত হলে প্রথমে ইহুদিবাদ ও পরে খৃস্টবাদের উদ্ভব হয়।

তিনঃ হযরত ইবরাহীমের আসল কাজ ছিল সমগ্র দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান জানানো এবং আল্লাহ‌ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধ ও সংশোধিত করে গড়ে তোলা। তিনি নিজে ছিলেন আল্লাহর অনুগত। আল্লাহ‌ প্রদত্ত জ্ঞান অনুযায়ী নিজের জীবনের সমস্ত কাজ-কারবার পরিচালনা করতেন, সারা দুনিয়ায় এই জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটাতেন এবং চেষ্টা করতেন যাতে সমস্ত মানুষ বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভুর অনুগত হয়ে এ দুনিয়ায় জীবন যাপন করে। এই মহান ও বিরাট কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে তাঁকে বিশ্ব নেতার পদে অভিষিক্ত করা হয়। তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুবের নামে অগ্রসর হয়ে বনী ইসরাঈল নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তার এ নেতৃত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে। এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং এদেরকেই সত্য-সঠিক পথের জ্ঞান দান করা হয়। বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব এদের ওপর সোপর্দ করা হয়। এটি ছিল আল্লাহর মহান অনুগ্রহ ও নিয়ামত। মহান আল্লাহ‌ এ বংশের লোকদেরকে তাই একথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এ শাখাটি হযরত সুলাইমানের আমলে বাইতুল মাকদিসকে নিজেদের কেন্দ্র গণ্য করে। তাই যতদিন পর্যন্ত এ শাখাটি নেতৃত্বের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল ততদিন পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসই ছিল দাওয়াত ইলাল্লাহ---মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।

চারঃ পেছনের দশটি রুকু’তে মহান আল্লাহ‌ বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল তা হুবহু বর্ণনা করেছেন। এ সঙ্গে তাদেরকে একথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা আমার নিয়ামতের চরম অমর্যাদা করেছো। তোমরা কেবল নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকো নি বরং নিজেরাও সত্য ও সততার পথ পরিহার করেছো। আর এখন তোমাদের একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী ছাড়া তোমাদের সমগ্র দলের মধ্যে আর কোন যোগ্যতা অবশিষ্ট নেই।

পাঁচঃ অতঃপর এখন তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব ইবরাহীমের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার নয়। বরং নবী ইবরাহীম নিজে যে নিষ্কলুষ আনুগত্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছিলেন এটি হচ্ছে তারই ফসল। যারা ইবরাহীমের পথে নিজেরা চলে এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকে চালাবার দায়িত্ব পালন করে একমাত্র তারাই এই নেতৃত্বের যোগ্যতা লাভ করতে পারে। যেহেতু তোমরা এ পথ থেকে সরে গেছো এবং এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছো তাই নেতৃত্বের পদ থেকে তোমাদের অপসারিত করা হচ্ছে।

ছয়ঃ সঙ্গে সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিতে একথাও বলে দেয়া হচ্ছে, যেসব অইসরাঈলী জাতি মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে নিজেদের সম্পর্ক জুড়েছিল তারাও ইবরাহীমের পথ থেকে সরে গেছে। এই সঙ্গে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আরবের মুশরিকরাও ইবরাহীম ও ইসমাঈলের সাথে নিজেদের সম্পর্ক রয়েছে বলে গর্ব করে বেড়ায় কিন্তু তারা আসলে নিজেদের বংশ ও গোত্রের অহংকারে মত্ত হয়ে পড়েছে। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের পথের সাথে এখন তাদের দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। কাজেই তাদের কেউই বিশ্ব নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে না।

সাতঃ আবার একথাও বলা হচ্ছে, এখন আমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশের দ্বিতীয় শাখা বনী ইসরাঈলের মধ্যে এমন এক নবীর জন্ম দিয়েছি যার জন্য ইবরাহীম ও ইসমাঈল উভয়েই দোয়া করেছিলেন। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও অন্যান্য সকল নবী যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তিনিও সেই একই পথ অবলম্বন করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় যত নবী ও রসূল এসেছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তাদের সবাইকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন। সকল নবী বিশ্ববাসীকে যে পথের দিকে আহবান জানিয়েছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীগণও মানুষকে সেদিকে আহবান জানান। কাজেই যারা এ নবীর অনুসরণ করে এখন একমাত্র তারাই বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে।

আটঃ নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘোষণার সাথে সাথেই স্বাভাবিকভাবেই কিব্‌লাহ পরিবর্তনের ঘোষণা হওয়াও জরুরি ছিল। যতদিন বনী ইসরাঈলদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠত ছিল ততদিন বাইতুল মাকদিস ছিল ইসলামী দাওয়াতের কেন্দ্র এবং সেটিই ছিল সত্যপন্থীদের কিব্‌লাহ। শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর অনুসারীগণও ততদিন বাইতুল মাকদিসকেই তাঁদের কিব্‌লাহ বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলকে এ পদ থেকে যথারীতি অপসারিত করার পর বাইতুল মাকদিসের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব আপনা-আপনি খতম হয়ে গেল। কাজেই ঘোষণা করে দেয়া হলো, যেখান থেকে এ শেষ নবীর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে সেই স্থানটিই হবে এখন আল্লাহর দ্বীনের কেন্দ্র। আর যেহেতু শুরুতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের কেন্দ্রও এখানে ছিল তাই আহ্‌লি কিতাব ও মুশরিকদের জন্যও এ স্থানটির অর্থাৎ কা’বার কেন্দ্র হবার সর্বাধিক অধিকারের দাবী স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্যি হঠধর্মীদের কথা আলাদা। তারা সত্যকে সত্য জেনেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ আনতে থাকে।

নয়ঃ উম্মাতে মুহাম্মাদীয়ার নেতৃত্ব ও কা’বার কেন্দ্র হবার কথা ঘোষণা করার পরই মহান আল্লাহ‌ ১৯ রুকূ’ থেকে সূরা বাকারার শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ধারাবাহিক হেদায়াতের মাধ্যমে এ উম্মাতের জীবন গঠন ও জীবন পরিচালনার জন্য বিধান দান করেছেন।

প্রশ্ন: ৩৮৮ : শুক্রবারে মৃত্যু হলে কবরের আযাব মাফ হওয়া প্রসঙ্গ।

 প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম। বৃহস্পতিবার আসরের পর মাগরিবের ওয়াক্তের আগে কোন মাইয়েত মৃত‍্যুবরন করলে সেই মাইয়েতকে যদি জুমার নামাজের আগে দাফন সম্পন্ন হয়। তাহলে কি তার কবরের আজাব মাফ হবে



উত্তর : আসলে এসব ব্যাপারে মূল সত্য কথা হচ্ছে, পরকালীন আযাব ও পুরস্কার কোন দিন ক্ষণে মৃত্যুবরণ করার সাথে জড়িত নয়, বরং তা ঈমান ও আমালের সাথে জড়িত। একজন ব্যাক্তির কবরের আজাব বা পরকালীন আজাব হবে কি হবে না, তা মূলত নির্ধারিত হবে তার ঈমান ও আমলনামার উপর ভিত্তি করে। কুরআনের বহু আয়াত এ সত্যটিই দ্বর্থহীন ভাবে তুলে ধরেছে। আর শুক্রবারে মৃত্যুবরণ করলে কবরের আযাব মাফ হয়ে যাবে এ সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাপারে ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন- হাদিসটি গরিব। এটি এমন একটি হাদিস যার সনদ মুত্তাসিল নয়। রাবিয়া ইবনে সাইফ (সরাসরি) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে শুনেছেন বলে আমাদের জানা নেই। আল্লামা কাশমিরি রহ: - তিনি তিরমিযি শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আল আরফুশ শাযী’ 2/351 তে বলেন-ما صح الحديث في فضل موت يوم الجعة‘‘জুমুআর দিনে মৃত্য বরণের ফযিলত-সংক্রান্ত হাদিস সঠিক নয়।’’ মূল হাদীসটি হচ্ছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ إِلَّا وَقَاهُ اللهُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ ‘‘যেকোনো মুসলমান জুমুআর দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের ফিৎনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন।’’-মুসনাদে আহমদ: 11/147; তিরমিযি, হাদিস 1074 কিন্তু, তারপরেও আলেমগণ বলেছেন, এ হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় না যে, এক ব্যাক্তি তার ঈমানের ত্রুটি ও আমলের খিয়ানতের কারণে কবরের আযাবের যোগ্য হয়ে থাকলেও, শুধুমাত্র শুক্রবারে মৃত্যুবরণ করার কারণেই কিয়ামত পর্যন্ত ঐ ব্যাক্তির কবরের আযাাব মাফ হয়ে যাবে। হতে পারে যদি ঐ ব্যাক্তির ঈমান ও আমল গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের থাকে, তথাপি তার কোন ভুল ত্রুটি থেকে থাকে হয়ত সে কবরের প্রাথমিক ফিতনা থেকে বাচতে পারে, শুধু এতটুকুই, এর বেশী কিছু নয়। যদি তাই হতো, তাহলে বহু সংখ্যক সাহাবীদের থেকে শুক্রবারের মৃত্যু কামনা করার হাদীস পাওয়া যেত, অথচ, হযরত আবুবকর সোমবারে মৃত্যু কামনা করতেন এবং সোমবারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। (বুখারি - 3/252) । লিংক: https://alquranindex114.blogspot.com/2020/09/blog-post_51.html

প্রশ্ন: ৩৮৭ : আউয়াল ওয়াক্ত বলতে কি বুঝায়

 প্রশ্ন: 

আওয়াল ওয়াক্ত কি? আউয়াল ওয়াক্ত দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে এর বিস্তারিত ভাবে জানান এবং কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন শুরু হলে আওয়াল ওক্ত ভাববো।


উত্তর : নামাজের প্রতিটি ওয়াক্তের ই একটি ব্যাপ্তি সময় রয়েছে। এই ব্যাপ্তি সময়ের শুরুই হলো আউয়াল ওয়াক্ত । প্রতিটি ওয়াক্ত শুরুর দিকেই ঐ ওয়াক্তের নামাজ পড়ার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় তাহারাত, সুন্নাত আদায় ইত্যাদি করার পরে ফরজ আদায় করে তবে তা-ই আউয়াল ওয়াক্ত হবে। কিন্তু, ফরজ নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব, তাই একটি এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আলেমগণ জামায়াতে নামাজের একটি সময় নির্ধারণ করে দেন। এলাকার মসজিদে সে অনুযায়ীই জামায়াত আদায় করা হয়। তাই, উক্ত জামায়াতে শামিল হয়ে কেউ যদি জামায়াতে নামাজ আদায় করে তবে তাতেই ঐ ব্যাক্তি আউয়াল ওয়াক্তে নামাজ আদায় করেছে। আর, যদি এমন হয় যে ওয়াক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, আপনি অলসতা করে দেরিতে সালাত পড়ছেন, তাহলে আউয়াল ওয়াক্তের সালাত আদায় হবে না। আউয়াল ওয়াক্তের সালাত আদায়ের ফজিলত আপনি পাবেন না, যেহেতু আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেছেন। আর যদি এমন হয় যে, ব্যস্ততার কারণে আপনি ভুলে গিয়েছেন, তাহলে যখনই মনে পরবে তখনই সালাত আদায় করবেন। এতে আউয়াল ওয়াক্তের সালাতের ফজিলত আপনি পাবেন।

প্রশ্ন: ৩৮৬: স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার ।

প্রশ্ন:

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রীর যেকোনো ধরনের ক্রুটিতে স্বামী তালাকের অধিকার রাখে। এমনকি সে রাগ বসত তালাক দিয়ে দিলেও তা‌ স্ত্রীর উপর কার্যকর হয়।অন্যদিকে স্বামীর যে কোনো ক্রুটিতে সামাজিকভাবে স্ত্রীরা ধৈর্য ধারণ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে যদি তার ধৈর্য ধারনের শেষ সীমা অতিক্রম করে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে তখন স্ত্রীর করণীয় কি? শরীয়তে নারীর জন্য তালাক অধিকার রাখা হয়নি। এক্ষেত্রে নারী কি ডিভোর্সের অধিকার রাখে কিনা? ইসলামে‌ এ সম্পর্কে নারী মুক্তির ব্যাপারে কি বলে? ইসলামী শরীয়তের ভিত্তিতে এর মাসালা সম্পর্কে জানতে চাই। 


উত্তর : এ বিষয়টিরও ইসলামী শরীয়ত সুন্দর সমাধান দিয়েছে। ১। কাবিন নামা পড়ে দেখবেন, সেখানে উল্লেখ থাকে কোন কোন কারণে একজন স্ত্রী এই স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারবে, তা সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। অতএব, যদি এরূপ কোন শর্ত স্বামীর দ্বারা ভঙ্গ হয় তবে স্ত্রী আদালতের বা কাজীর দরবারের স্মরণাপন্ন হয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আবেদন করতে পারে। ২। অথবা ধরুণ, স্বামী এমন আচরণ করছে যা কাবিন নামায় উল্লেখ নেই, কিন্তু স্ত্রী স্বামীর আচরণে অতিষ্ঠ অথবা এই স্বামীর সাথে একত্রে বসবাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রেও সে আদালতে বা কাজীর দরবারের স্মরনাপন্ন হয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য আবেদন জানাতে পারে। উপরোক্ত উভয় ক্ষেত্রেই উক্ত বিচারক প্রয়োজন মনে করলে উভয়কে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, ইসলামী শরীয়ত কারো উপরেই জুলুম করে নাই। তাই অনেক গুলো দিকে দৃষ্টি রেখেই তালাকের ক্ষমতাটা স্ত্রীর হাতে অর্পন না করে স্বামীর হাতে অর্পন করেছে। এটা স্ত্রীর জন্যই শেষপর্যন্ত কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে, এর মানে এই না যে, স্ত্রীর নিজের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বুঝি কোন পথ খোলা নেই। না এই ধারনাটা ভুল । স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথ অবশ্যই খোলা আছে, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

প্রশ্ন: ৩৮৫: খুলা তালাকের পরিচয় ও পদ্ধতি

 

প্রশ্ন

প্রশ্ন: খুলা তালাক বলতে কী বুঝায়? খুলা তালাক প্রয়োগ করার পদ্ধতি কী? যদি স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে না চায় তা সত্ত্বেও কী তালাক সংঘটিত হতে পারে? আমেরিকান সোসাইটি সম্পর্কে কি বলবেন? যদি স্ত্রীর কাছে তার স্বামী মনপূত না হয় (কোন কোন ক্ষেত্রে; যেহেতু স্বামী দ্বীনদার)। স্ত্রী ধারণা করে যে, তার তালাক দেয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

খুলা হচ্ছে: কোন কিছুর বিনিময়ে স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে স্বামী সে বিনিময়টি গ্রহণ করে স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে; এ বিনিময়টি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত মোহরানা হোক কিংবা এর চেয়ে বেশি সম্পদ হোক কিংবা এর চেয়ে কম হোক।

এ বিধানের দলিল হচ্ছে, আল্লাহ্‌র বাণী: “আর তাদেরকে যা কিছু দিয়েছো (বিদায় করার সময়) তা থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তবে এটা স্বতন্ত্র, স্বামী-স্ত্রী যদি আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না বলে আশংকা করে, তাহলে এমতাবস্থায় যদি তোমরা আশংকা করো, তারা উভয়ে আল্লাহ্‌ নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করতে পারবে না, তাহলে স্ত্রীর কিছু বিনিময় দিয়ে তার স্বামী থেকে বিচ্ছেদ লাভ করায় উভয়ের কোন গুনাহ নেই।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২৯]

সুন্নাহ্‌ থেকে এর দলিল হচ্ছে, সাবেত বিন ক্বাইস বিন শাম্‌মাস এর স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! আমি সাবেত বিন ক্বাইসের উপর চারিত্রিক বা দ্বীনদারির কোন দোষ দিব না। কিন্তু, আমি মুসলিম হয়ে কুফরিতে লিপ্ত হতে অপছন্দ করি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তুমি কি তার বাগানটি ফিরিয়ে দিবে? সাবেত মোহরানা হিসেবে তাকে বাগান দিয়েছিল। সে বলল: জ্বি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: বাগানটি গ্রহণ করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দাও”[সহিহ বুখারী (৫২৭৩)]

এই ঘটনা থেকে আলেমগণ গ্রহণ করেন যে, কোন নারী যদি তার স্বামীর সাথে অবস্থান করতে না পারে সেক্ষেত্রে বিচারক স্বামীকে বলবেন তাকে তালাক দিয়ে দিতে; বরং স্বামীকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিবেন।

এর পদ্ধতি হচ্ছে- স্বামী বিনিময় গ্রহণ করবেন কিংবা তারা দুইজন এ বিষয়ে একমত হবেন; এরপর স্বামী তার স্ত্রীকে বলবেন: আমি তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম কিংবা আমি তোমাকে খুলা তালাক দিলাম, কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন শব্দ।

তালাক হচ্ছে স্বামীর অধিকার। স্বামী তালাক দিলেই তালাক সংঘটিত হবে। দলিল হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তালাক তারই অধিকার যার রয়েছে সহবাস করার অধিকার” অর্থাৎ স্বামীর। [সুনানে ইবনে মাজাহ (২০৮১), আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (২০৪১) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

এ কারণে আলেমগণ বলেন: যে ব্যক্তিকে তালাক দেয়ার জন্য অন্যায়ভাবে জবরদস্তি করা হয়েছে; সে ব্যক্তি যদি এ জবরদস্তি থেকে বাঁচার জন্য তালাক দেয় তাহলে সে তালাক সংঘটিত হবে না।[দেখুন আল-মুগনী (১০/৩৫২)]

আপনাদের সেখানে মানবরচিত আইনে স্ত্রী নিজেই নিজেকে তালাক দিতে পারার যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন: যদি সেটা এমন কোন কারণে হয় যে কারণে মহিলার জন্য তালাক চাওয়া জায়েয আছে; যেমন- স্ত্রী তার স্বামীকে অপছন্দ করা, স্বামীর সাথে একত্রে থাকতে না পারা, কিংবা স্বামীর দ্বীনদারির ঘাটতি ও হারামে লিপ্ত হওয়ার স্পর্ধাকে অপছন্দ করা ইত্যাদি, তাহলে স্ত্রীর তালাক চাওয়াতে কোন দোষ নেই। তবে, এ অবস্থাতে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে যে মোহরানা গ্রহণ করেছে সেটা ফেরত দিতে হবে।

আর যদি যথাযথ কারণ ছাড়া স্ত্রী তালাক চায় তাহলে সেটা নাজায়েয। এমতাবস্থায় কোর্ট যদি তালাক কার্যকর করে তাহলে সেটা ইসলামি শরিয়তে গ্রাহ্য হবে না। বরং এ মহিলা এ পুরুষের স্ত্রী হিসেবে বলবৎ থাকবে। এখানে হচ্ছে সমস্যা। সমস্যাটা হলো- এ নারী আইনের দৃষ্টিতে তালাকপ্রাপ্তা; ইদ্দত শেষ হলে সে হয়ত অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সে তালাকপ্রাপ্ত নয়; সে অন্য একজনের স্ত্রী।

শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন এ ধরণের মাসয়ালার ক্ষেত্রে বলেন:

আমরা এখন একটা সমস্যা সংকুল মাসয়ালার সামনে আছি। এ নারী তার স্বামীর বিবাহাধীনে থাকায় অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। কিন্তু, বাহ্যতঃ কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে সে তালাকপ্রাপ্তা নারী; যখনি তার ইদ্দত পূর্ণ হবে তার জন্য অন্য স্বামী গ্রহণ করা বৈধ। এ সমস্যা নিরসনে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কিছু দ্বীনদার ও ভাল মানুষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; যাতে করে তারা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমঝোতা করতে পারে। সমঝোতা না হলে, স্ত্রী তার স্বামীকে বিনিময় দিতে হবে; যাতে করে এটি ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে খুলা তালাক হিসেবে গণ্য হয়।

শাইখ উছাইমীনের লিকাউল বাব আল-মাফতুহ; নং ৫৪, (৩/১৭৪) দারুল বাছিরা প্রকাশনী, মিশর

প্রশ্ন: ৩৮৪ : মহিলাদের জন্য জোরে কথা বলার হুকুম কি?

 

মহিলাদের জন্য জোরে কথা বলার হুকুম কি?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ,

মুসলিম উম্মাহর সন্দেহ, সংশয় ও বিভেদ নিরসনে আপনাদের ভুমিকা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় এক নেয়ামত। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাদের মত হাক্কানি আলেমদের দ্বীনের হেফাজতের জন্য কবুল করেছেন। বিশেষ করে আহলে হাদিস ও অন্যান্য বাতিল ফিরকা যেভাবে মানুষদের মধ্যে দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি করছে তার বিরুদ্ধে আপনাদের দলিল ভিত্তিক জবাব সঠিক রাহবারি করছে, উম্মত কে বিপথগামিতা থেকে সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আলাহ তায়ালা আপনাদের ইলম আরও বাড়িয়ে দিন।

আমার একটি প্রশ্ন হলঃ মহিলাদের সব সময় নিচু আওয়াজে কথা বলা ফরজ- কথাটি কি সঠিক? বিস্তারিত আলোচনা করে বাধিত করবেন।

মোঃ ফায়সাল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

যদি পর পুরুষ কথা শুনে ফেলার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে প্রয়োজন ছাড়া জোরে কথা বলা জায়েজ নয়। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে জোরে কথা বলতে সমস্যা নেই।

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ [٢٤:٣٠

وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ ۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ [٢٤:٣١

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।

ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। {সূরা নূর-৩০-৩১}

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا (32) وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى

হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও [ইহুদী খৃষ্টান)। তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় পাও তবে আকর্ষণধর্মী ভঙ্গিতে কথা বলনা, যাতে যাদের মাঝে যৌনলিপ্সা আছে তারা তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বরং তোমরা স্বাভাবিক কথা বল। এবং তোমরা অবস্থান কর স্বীয় বসবাসের গৃহে, জাহেলী যুগের মেয়েদের মত নিজেদের প্রকাশ করো না। {সূরা আহযাব-৩২}

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী


মহিলাদের জন্য আস্তে কথা বলা ফরজ?

প্রশ্ন

মেয়েদের আস্তে কথা বলা ফরজ। এ বিষয়ে কোরআন ও হাদিস কি বলেছে? আর যে সব নারীরা উচ্চ স্বরে কথা বলে কি বলা হয়েছে? হাদিসের আলোকে জানতে চাই।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

আস্তে কথা বলা ফরজ এভাবে বলা উচিত হবে না। বাকি প্রয়োজন ছাড়া জোরে কথা না বলাই উচিত। তবে প্রয়োজনে জোরে কথা বলা জায়েজ আছে। পরপুরুষকে আকৃষ্ট করার মানসে বা আকৃষ্ট হবার শংকা থাকলে জোরে কথা বলা জায়েজ নয়।

إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا (32) وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى

তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় পাও তবে আকর্ষণধর্মী ভঙ্গিতে কথা বলনা, যাতে যাদের মাঝে যৌনলিপ্সা আছে তারা তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বরং তোমরা স্বাভাবিক কথা বল। এবং তোমরা অবস্থান কর স্বীয় বসবাসের গৃহে, জাহেলী যুগের মেয়েদের মত নিজেদের প্রকাশ করো না। {সূরা আহযাব-৩২}

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

প্রশ্ন: ৩৮৩: হায়েজ চলাকালীন সময়ে তালাক দিলে তালাক পতিত হয় কি?

 


প্রশ্ন

আমার স্বামী আমাকে আমার পিরিয়ড চলার সময় তালাক প্রদান করেছে। আমার প্রশ্ন হল, মাসিক চলার সময় তালাক দিলে কি তা পতিত হয়?

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

মাসিকের সময় যদিও তালাক দেয়া নিষেধ। কিন্তু তালাক দিলে তালাক পতিত হয়ে যায়।

ابْنَ عُمَرَ قَالَ طَلَّقَ ابْنُ عُمَرَ امْرَأَتَه“ وَهِيَ حَائِضٌ فَذَكَرَ عُمَرُ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لِيُرَاجِعْهَا قُلْتُ تُحْتَسَبُ قَالَ فَمَهْ

ইবন ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে হায়িয অবস্থায় তালাক দিলেন। ‘উমার (রাঃ) বিষয়টি নাবী এর কাছে ব্যক্ত করলেন। তখন তিনি বললেনঃ সে যেন তাকে ফিরিয়ে আনে। রাবী ইব্ন সীরীন) বলেন, আমি বললাম ,তালাকটি কি গণ্য করা হবে? তিনি (ইবনে ‘উমার) বললেন,তাহলে কী? [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫২৫২]

يقع الطلاق باتفاق المذاهب الأربعة فى حال الحيض او فى حال الطهر الذى جامع الرجل أمرأته فيه، لأن النبى صلى الله عليه وسلم أمر ابن عمر بمراجعة أمرأته التى طلقها، وهى حائض المراجعة لا تكون إلا بعد وقوع الطلاق (الفقه الاسلامى وادلته-7/387-388)

وإذا طلق الرجل امرأته فى حالة الحيض وقع الطلاق، لأن النهى عنه لمعنى فى غيره، وهو ما ذكرنا، فلا ينعدم مشروعيته، ويستحب له أن يراجعها لقوله عليه السلام لعمرمر ابنك فليراجعها، وقد طلقها فى حالة الحيض، وهذا يفيد الوقوع (الهداية-2/357)

ولنا قوله عليه الصلاة والسلام لعمر من ابنك فليراجعها، وكان طلاقها فى حالة الحيض والمراجعة بدون وقوع الطلاق محال (تبيين الحقائق-3/30، زكريا، قديم-2/193

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...