প্রশ্ন: ৩০৫ : ইসলামে মৃত্যূদন্ডের বিধান ।

হাদিস: ‘তিনটি অপরাধের দরুণ একজন মুসলীমকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায় ।
১. বিবাহিত হয়েও ব্যভিচার করলে ।
২. কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলে ।
৩. নিজ ধর্ম (ইসলাম) ত্যাগ করলে (বা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ঘোষণা করলে)  ।‘… তিরমিজী শরীফ – ১৩৪২

ব্যাখ্যা: 

১. যদি বিবাহিত ব্যাক্তির যিনা করার বিষয়টি চারজন সাক্ষী দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়, তবে তাকে মৃত্যুদন্ড দিতেই হবে, এ ব্যাপারে কারো ক্ষমা করার ইখতিয়ার নেই। (সুরা নূর)। এ ধরণের ব্যাক্তি যদি নিজে তওবাও করে তবুও দুনিয়াবী এই শাস্তি থেকে সে রেহাই পাবেনা, তবে তার এ তওবা পরকালে কার্যকর হবে।  বিবাহিত ব্যাক্তির যিনা শরীয়তের মানদন্ডে প্রমাণিত হবার পর এ ব্যাপারে রাস্ট্র স্বয়ং বাদী হয়ে যাবে, এবং তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবে। 

২. কিন্তু এক ব্যাক্তি অন্য কোন ব্যাক্তিকে হত্যা করে ফেললে হত্যাকারীর ওয়ারিশগণ যদি হাত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয় অথবা, শর্ত সাপেক্ষে অর্থাৎ, রক্তপণ নিয়ে মাফ করে দেয় তবে, হত্যাকারী ক্ষমা পেয়ে যাবে। এখানে রাষ্ট্র বাদী হতে পারবেনা। 

৩. মুরতাদ ব্যাক্তির বিধান : এ ব্যাপারে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর মুরতাদের শাস্তি বইতে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা আছে। সেই বইটি পড়লেই এ ব্যাপারে পরিস্কার হয়ে যাবেন। 

তবুও এখানে সামান্য আলোকপাত করা হলো : 

মুসলমান ইসলামের অনুশাসন মানতে বাধ্য বলেই গুনাহ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে বিভিন্ন শাস্তি তার উপর আপতিত হয়। দুনিয়াতে কোনো গুনাহের শাস্তি বন্দিত্ব, কোনোটার শাস্তি বেত্রাঘাত, হস্তকর্তন ও মৃত্যুদন্ড ইত্যাদি। সবচে বড় গুনাহ হল মুসলিম থেকে অমুসলিম হয়ে যাওয়া। একেই বলে মুরতাদ হওয়া। মুরতাদ শব্দের শাব্দিক অর্থ বিমুখ হয়েছে বা ফিরে গিয়েছে এমন। এর মূল মর্ম  হল, ইসলাম ত্যাগ করা, ইসলামের কোনো মৌলিক আকিদা বা বিধানকে মানতে অস্বীকার করা, কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা অথবা ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের অবমাননা করা, যা অন্তরের ভক্তিশূন্যতা ও শ্রদ্ধাহীনতার আলামত বহন করে। এককথায় ঈমান বিনষ্টকারী যে কোনো কুফরী-শিরকী আকিদা বা বিশ্বাস পোষণ করা, অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়ার নামই হল ইরতিদাদ বা মুরতাদ হওয়া।
যে সকল কারণে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায় এর বিভিন্ন কারণের মধ্য হতে নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।
১. আল্লাহ তাআলার শানে বেয়াদবি করা।
২. ইসলামের শিআর তথা প্রতীকসমূহের অবমাননা করা। এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা কৌতুক করা।
ইসলামের মৌলিক শিআর হল; কুরআন মাজীদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ; বিভিন্ন ইবাদত যথা-নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাত, দোয়া-দরূদ; বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ স্থান যথা-মসজিদে নববী, কাবা শরীফ, মসজিদে আকসা এবং পৃথিবীর সকল মসজিদ ইত্যাদি। এগুলোর অবমাননা যেমন, মসজিদকে গোয়ালঘর বলা, কোরআন মাজীদকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলা, নবীজীকে যুদ্ধবাজ বলা, তাঁর নামের অবমাননা করা ইত্যাদি।
৩. ইসলামের কোনো বিধান, ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ কোনো বিষয়, নবীজীর কোনো সুন্নত, এমনকি প্রমাণিত কোনো মুস্তাহাব আমল ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করা অথবা অবজ্ঞা-প্রকাশক কোনো আচরণ করা। যেমন কুকুরের মাথায় টুপি পরানো, বোরকাকে বেশ্যার পোশাক বলা ইত্যাদি।
৪. জরুরিয়াতে দ্বীন তথা সর্বজনবিদিত অকাট্য দ্বীনী বিষয়সমূহের কোনো একটি অস্বীকার করা, অপছন্দ করা, বা তার অপব্যাখ্যা করা, অথবা তার উপর আপত্তি তোলা কিংবা তা সংস্কারযোগ্য বলে মনে করা। যেমন খতমে নবুওত অস্বীকার করা, চুরির শাস্তির উপর আপত্তি করা ইত্যাদি।
৫. ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা কিংবা কোনো ধর্মই না মানা। যেমন আল্লাহকে বিশ্বাস না করা, প্রকৃতিবাদী হওয়া, খৃস্টান বা তাদের ভাষায় ঈসায়ী মুসলমান হওয়া ইত্যাদি।
৬. এমন কোনো কাজ করা বা বিশ্বাস পোষণ করা, যা আল্লাহ তাআলার তাওহীদ পরিপন্থী। যেমন কোনো প্রতিকৃতির সামনে মাথা নত করা, মাজার তওয়াফ করা, উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে রিযিকদাতা, ফসলদাতা, সন্তানদাতা ইত্যাদি মনে করা।
৭. অন্যদের ধর্মীয় প্রতীক গ্রহণ করা, কথা বা কাজে এর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করা।
৮. ইসলামী শরীয়ত তথা আল্লাহ রববুল আলামীনের হাকিমিয়্যত (শাসকত্ব)-কে অস্বীকার করা। অর্থাৎ জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহ তাআলা হালাল-হারাম, সিদ্ধ-অসিদ্ধ নির্ধারণকারী এবং তিনিই যে একমাত্র বিধানদাতা তা বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।
ইরতিদাদের সকল প্রকার সাধারণ কুফরের চে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর হল সত্যদ্বীন গ্রহণ না করা বা প্রকৃত দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা। কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতা নয়, এ হল বিদ্রোহ, বিরুদ্ধতা! সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ। পাশাপাশি তা ইফসাদ ফিল আরদ তথা পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টিও বটে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ  أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ  خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ  إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ  إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ
আল্লাহ এমন একটা কওমকে কীভাবে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করতে পারেন; যে সমাজ একবার ঈমান আনার পর, রাসূলকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার পর এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ এসে যাওয়ার পর আবার কাফের হয়ে যায়? অবস্থা এই যে, আল্লাহ এমন জালিম সমাজকে কখনো হেদায়েতের পথ দেখান না। এই যে লোকগুলো, এদের কর্মফল হলো, এদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ! তবে এর পরে যারা তওবা করবে আর (নিজেদেরকে) সংশোধন করে নেবে, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। পরন্তু আল্লাহ হচ্ছেন মহাক্ষমাশীল করুণাময়। (কিন্তু) যারা একবার ঈমান আনার পর আবার কাফের হয়ে যায় এবং তাদের কুফরী আচরণ আরও বেড়ে চলে, তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না। (আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৯০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-
وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়। আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হল জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে। (বাকারা ২ : ২১৭)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
(তরজমা) প্রকৃতপক্ষে যারা তাদের সামনে হেদায়েত পরিস্ফুট হওয়ার পরও মুরতাদ হয়ে যায়, (আসলে) শয়তান তাদেরকে ফুসলিয়েছে এবং অমূলক আশা দিয়েছে। এসব এজন্য যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়কে অপছন্দ করে, তাদেরকে (সেই কাফেরদেরকে) তারা (মুরতাদ-মুনাফিকেরা) বলে, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তোমাদের কথাও মানবো। (স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ তাদের গুপ্ত কথা সম্পর্কে অবগত। ফেরেশতারা যখন এদের চেহারায় এবং পিছন দিক থেকে আঘাত করতে করতে এদের জান কবজ করবে, তখন এদের কী দশা হবে! এসব (শাস্তি) এজন্য যে, তারা এমন মতবাদ বেছে নিয়েছে, যা আল্লাহ তাআলাকে নারাজ করে এবং তারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন পছন্দ করে না। তাই আল্লাহ তাদের আমলগুলো বরবাদ করেছেন। (মুহাম্মাদ (৪৭) : ২৫-২৮)
মুরতাদের পরকালীন এ শাস্তিগুলির ফয়সালা হবে হাশরের ময়দানে। যেখানে ফয়সালাকারী হবেন খোদ আল্লাহ রাববুল আলামীন। দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বিষয় সম্পর্কে যিনি অবগত। যিনি আহকামুল হাকিমীন। মানুষের অন্তরের একান্ত গোপন কথাও যার অজানা নয়। তাই দুনিয়াতে যে নিজের ইরতিদাদ ও কুফর লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, কেয়ামতের দিন সেও অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাকেও কঠিন আযাব ভোগ করতে হবে।
কিন্তু এই দুনিয়ার আদালতে মনের অবস্থার উপর বিচার করা যায় না। এখানে কারো মনের খবর নিশ্চিতভাবে জানাও সম্ভব হয় না। তাই দুনিয়াতে বিচার হয় বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। কোনো মুনাফিক নিজের অন্তরে কুফরি আকিদা-বিশ্বাস লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলে বিচারকের সামনে তার ইরতিদাদ প্রমাণিত হবে না। সুতরাং দুনিয়াবী কোনো শাস্তিও তার উপর আপতিত হবে না। দুনিয়াবী শাস্তি প্রয়োগ হবে কেবল ঐ ব্যক্তির উপর-যার ইরতিদাদ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং হাকিমের কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে।
মুরতাদ দুই প্রকারের হয়ে থাকে : এক. যে নিজের ইরতিদাদের ঘোষণা দিয়েছে। দুই. যে ইরতিদাদ-মূলক কোনো আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে অথবা অনুরূপ কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেও নিজেকে কথা বা কাজে মুসলমান বলে দাবী করছে। দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদকে যিন্দীক, মুলহিদ ও মুনাফিক ইত্যাদি বলা হয়।
স্বঘোষিত মুরতাদ হোক আর মুনাফিকজাতীয় মুরতাদ হোক, উভয় প্রকার মুরতাদের ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম হল, যদি আদালতে এদের ইরতিদাদ প্রমাণ হয়ে যায়, তাহলে তার বিষয়ে শরীয়ত মোতাবেক ফয়সলা করা বিচারকের উপর ফরজ। আর প্রশাসনের ফরজ হল ঐ শাস্তি অপরাধীর উপর প্রয়োগ করা।
আল্লাহ পাকের আইনে মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি কী- সেটা ইসলামী শরীয়তের অকাট্য সর্বজনস্বীকৃত ও যুগ পরম্পরায় অনুসৃত শিক্ষাগুলির একটি। এর উপর উম্মতের সকল মাযহাব, সকল গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর ইজমা রয়েছে। এতে কোনো কালেই কোনো আলেমে দ্বীনের দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে থাকলে মুলহিদ-যিন্দীকরাই করেছে। কোনো মুমিন করেনি। একজন মুমিন তো শরীয়তের সকল বিধানের উপর ঈমান রাখে। হদ-কিসাস ও দন্ডবিধি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এগুলিকে হুবহু মেনে নেওয়াই ঈমান। এগুলির একটি হল, মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
বিচারকের জন্য নিয়ম হল, মুরতাদকে প্রথমে তওবা করার সুযোগ দিবে। তওবা করলে তো ভালো। অন্যথায় নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করবে।
মুরতাদের তওবা কবুল করা এবং এ উসিলায় তার শাস্তি মওকুফ করা শরীয়তে মুহাম্মদীর বিধান। নতুবা তাওরাতের শরীয়তে তওবা করলেও এ শাস্তি মাফ হত না। বরং তওবার মাধ্যমে পরকালীন শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দুনিয়াবী শাস্তি গ্রহণ করা অপরিহার্য ছিল।
বনী ইসরাইলের একটি দল যখন গোবৎসের পুজা করে শিরকে লিপ্ত হল, যে কারণে তারা মুরতাদ হয়ে গেল, তখন তাদের ব্যাপারে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হল এবং এটা তাদের তওবারই একটা অংশ ছিলো। ইরশাদ হয়েছে-
(তরজমা) যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়েছে, শীঘ্রই তাদের রবের গজব তাদেরকে পাকড়াও করবে আর দুনিয়ার জীবনেই লাঞ্ছনা আপতিত হবে। যারা মিথ্যা রচনা করে, আমি এভাবেই তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (আরাফ ৭ : ১৫২)
মুরতাদের উপর আপতিত সেই গজব ও লাঞ্ছনা কী ছিল? কোরআনেই ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
তোমরা বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট তওবা কর এবং নিজেরা নিজেদের মাঝে মৃত্যুদন্ড কার্যকর কর। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট এ ব্যবস্থা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাহলে তিনি তোমাদের তওবা কবুল করবেন। তিনি তো তওবা কবুলকারী, পরম করুণাময়। (বাকারা ২ : ৫৪)
দুনিয়াতে এই ক্রোধ ও গজব এবং লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা যারা শিরক করে মুরতাদ হয়ে গেছে শুধু তাদের জন্যই নয়, বরং সব ধরনের মুরতাদের জন্য। ইরশাদ হয়েছে-
(তরজমা) যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর তার কুফরীতে লিপ্ত হয় -অবশ্য সে নয়, যাকে কুফুরীর জন্য বাধ্য করা হয়েছে, কিন্তু তার অন্তর ঈমানের উপর প্রশান্ত রয়েছে, বরং সেই ব্যক্তি, যে সহৃদয়ে কুফুরী মেনে নিয়েছে, এরূপ ব্যক্তির উপর আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (নাহল ১৬ : ১০৬)
সূরা বাকারার ৫৪ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, মুরতাদের উপর আপতিত খোদায়ী গজব হল মৃত্যুদন্ড। ইসলামের প্রতি দুশমনি করা অথবা যে কোনো ধরনের শিরকী-কুফরী কর্ম ও বিশ্বাসের মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি -যদিও সে আচরণে-উচ্চারণে নিজেকে মুসলমান প্রমাণের চেষ্টা করে -তবু সে মুরতাদ। কোরআনের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা হয়। এদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন-
لَئِنْ لَمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا  مَلْعُونِينَ أَيْنَمَا ثُقِفُوا أُخِذُوا وَقُتِّلُوا تَقْتِيلًا  سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা এবং মদীনাতে ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা যদি নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রবল করে দিব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে সেখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না। তাও থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায়, যেখানেই এমন লোককে পাওয়া যাবে, ধরে ধরে একে একে হত্যা করে ফেলা হবে। আল্লাহ তাআলার এ নিয়ম পূর্ববর্তী লোকদের জন্যও বলবৎ ছিল। আল্লাহর নিয়মে কোনো দিন আপনি কোনো ব্যত্যয় খুজে পাবেন না। (আহযাব ৩৩ : ৬০-৬২)
উল্লেখিত আয়াতে মুরতাদ-মুনাফিকের দুটি অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা থেকে বিরত না হলে শাস্তি লাঞ্ছনা এবং মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়াতের শেষ অংশ থেকে এ-কথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তেও মুরতাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। (মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী ৭ : ২৩৪-২৩৫)
বিদ্রোহের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড
এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, মুরতাদ (প্রকাশ্য মুরতাদ অথবা মুনাফেক মুরতাদ দুজনই) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী মুহারিব। ইসলাম ও মুসলমানকে অপমানকারী বিশ্বাসঘাতক। আল্লাহর জমিনে শান্তি বিনষ্টকারী প্রতারক। সকল মুহারিব ও ফেৎনাবাজ দুষ্কৃতিকারীর শাস্তি প্রসঙ্গে কোরআন মাজীদের ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (মায়েদা ৬ : ৩৩)
আয়াতে বিভিন্ন প্রকার ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুহারিবের এবং তাদের অপরাধের ধরন ও মাত্রাভেদে বিভিন্ন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর মুহারিব ও মুফসিদ (বিপর্যয় সৃষ্টিকারী) এর মাঝে সবচে মারাত্মক হল যারা দ্রোহের ঘোষণা দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে, ইসলামের অবমাননা করে মুসলিম পরিচয় দিয়ে মুমিনদেরকে তাদের ঈমানের ব্যাপারে সন্দিহান করে-ফেলার মতো দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়। উল্লিখিত আয়াতে أَنْ يُقَتَّلُوا শব্দে সর্বপ্রথম এ ধরনের মুহারিব এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া উল্লিখিত আয়াত প্রসঙ্গে লিখেছেন, (অর্থ :) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুভাবে হতে পারে। একটা অস্ত্রের মাধ্যমে আরেকটা যবানের মাধ্যমে। আর দ্বীনী বিষয়ে কখনো কখনো অস্ত্রের যুদ্ধের চে যবানের যুদ্ধ মারাত্মক হয়ে থাকে। এই জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্ত্রের যুদ্ধে লিপ্ত অনেককে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতেন, কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যবানি দুশমনিতে লিপ্ত কাউকে ক্ষমা করতেন না। তেমনি পৃথিবীর শান্তি শৃংখলা কখনো অস্ত্র বিস্তারের কারণে বিনষ্ট হয় আর কখনো হয় যবান দরাজির কারণে। আর দ্বীনি বিষয়ে যবান দরাজির মাধ্যমে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়, তা অস্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট বিশৃংখলার চে বহু গুণে মারাত্মক।-আছ ছা-রিমুল মাছলূল পৃ. ৩৯১
হাদীসে নববীতে মুরতাদের শাস্তি-প্রসঙ্গ
হাদীস ইসলামী শরীয়তের স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল এবং কুরআনের তাফসীর। এখন আমরা সহীহ হাদীস ও আছারে সাহাবার আলোকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা তুলে ধরবো। তা থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের দ্বিতীয় দলিলের ফয়সালা সামনে এসে যাবে এবং সুন্নাহর মাধ্যমেও এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, উল্লিখিত আয়াতসমূহের বক্তব্য তা-ই যা উপরে বলা হয়েছে।
عن عكرمة قال : أتي علي رضي الله عنه بزنادقة فأحرقهمفبلغ ذلك ابن عباس فقال : لو كنت أنا لم أحرقهم، لنهي رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا تعذبوا بعذاب الله، ولقتلتهم لقول رسول الله صلى الله عليه وسلم : من بدل دينه فاقتلوه.
১. ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী রা. এর নিকট কয়েকজন মুরতাদ-যিন্দীককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এ-খবর ইবনে আববাস রা এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, আমি হলে পুড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আল্লাহ পাকের শাস্তি দানের বস্ত্ত (আগুন) দ্বারা শাস্তি দিও না। আমি বরং এদেরকে হত্যা করতাম। কেননা আল্লাহর রাসুল বলেছেন, যে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯২২, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৫৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৫১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭১)
প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে-
عن عبد الله قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا يحل دم امرء مسلم يشهد أن لا إله إلا الله، وأني رسول الله، إلا بإحدى ثلاث : النفس بالنفس، والثيب الزاني، والمفارق لدينه، التارك للجماعة.
২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে মুসলমান সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই আর আমি আল্লাহর রাসূল, তিন কারণের কোনো একটি ব্যতীত তার রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয় : অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, বিবাহিত ব্যক্তি যেনা করা, ইসলাম ত্যাগ করে উম্মত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮৭৮, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০২, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৮৭০৪, বায়হাকী ৮:১৯৪ ইত্যাদি)
অন্য একটি হাদীসে এসেছে-
৩. আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, আমি নবীজীর নিকট এলাম। আমার সঙ্গে দুজন আশআরী লোক ছিল। তারা দুজনেই প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল। নবীজী চুপ করে রইলেন। একটু পর আমাকে বললেন, আবু মুসা! তোমার কী মত? আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এরা দুজন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি। আমিও ভাবতে পারিনি যে, তারা পদের আশায় এসেছে। আবু মুসা বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি নবীজীর মেসওয়াক ঠোঁটের তলে উচু হয়ে আছে। হুজুর বললেন, আমরা কোনো উমেদারকে প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করি না। তবে আবু মুসা, তুমি যাও। অতঃপর নবীজী তাকে ইয়ামান পাঠালেন। তার পিছনে পাঠালেন মুআয ইবনে জাবালকে।
বর্ণনাকারী বলেন, মুআয যখন আবু মুসার কাছে পৌঁছলেন, তখন আবু মুসা তাকে স্বাগতম জানালেন এবং বসার জন্য তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আবু মুসার পাশে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এক ব্যক্তি। মুআয বললেন, এর কী হল? তিনি বললেন, এই লোক ইহুদী ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আবার সে তার বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। মুআয বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা বললেন, হাঁ, ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিদের্শ। তিনি এ-কথা তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মূসা লোকটিকে হত্যা করে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাই করা হল। (সুনানে আবু দাউদ : হাদীস ৪৩৫৪)
আরও এক হাদীসে এসেছে-
৪. যখন উমর রা. এর নিকট তুসতার নামক এলাকা বিজয়ের সংবাদ এলো, তখন তিনি সংবাদবাহীদের কাছে কোনো বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এক মুসলমান ব্যক্তি মুশরিক হয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমরা গ্রেফতার করে নিয়েছি। তিনি বললেন, ঐ লোকের সঙ্গে তোমরা কী আচরণ করেছো? তারা বললো, আমরা তাকে হত্যা করে ফেলেছি। হযরত উমর বললেন, যদি তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে। এইভাবে তিনদিন তওবা তলব করতে তাহলে কত ভালো হতো! তখন সে তওবা করলে তো করল, না হয় হত্যা করে ফেলতে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৯৫৮৮)
মুরতাদের শাস্তি প্রসঙ্গে উম্মতের ইজমা
হাদীসে নববী যেমন শরীয়তের স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল, ইজমাও তেমনি পৃথক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল। অর্থাৎ শরীয়তের কোনো বিষয়ে যদি উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে ঐ বিষয়ে সরাসরি কুরআন ও হাদীসের কোনো বক্তব্য না থাকলেও শুধু ইজমার ভিত্তিতে সেটা শরীয়তের অকাট্য বিধানরূপে পরিগণিত হয়।
মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড-এর উপর উম্মতের ইজমা রয়েছে। কোনো দ্বীনী বিষয়ে যুগের মুজতাহিদ আলেমগনের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে ইজমা বলে। এখানে ইজমার কিছু দলিল তুলে ধরা হচ্ছে। এ- থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের তৃতীয় দলিলের ফায়সালা সামনে এসে যাবে এবং এই দলিলের মাধ্যমেও এটা আরেকবার স্পষ্ট হবে যে, উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের বক্তব্য তা-ই, যা উপরে বলা হয়েছে।
ইমাম তিরমিযী (মৃত্যু ২৭৯- হি.) তার জামে তিরমিযীর ১৪৫৮ নম্বর হাদীস-من بدل دينه فاقتلوه  অর্থাৎ যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে-এর অধীনে লিখেছেন,
والعمل على هذا عند أهل العلم في المرتد
অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে ইলমের সকল ধারক-বাহকের নিকট এটাই অনুসৃত বিধান।
ইবনে আরাবী (মৃত্যু ৫৪৩ হি.) ইমাম তিরমিযীর উপরোক্ত বক্তব্যের প্রসঙ্গে লিখেছেন,
لا خلاف في أن المرتد يقتل.
অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড-এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।-আরিযাতুল আহওয়াযী ৬/২৪৩
ইবনু আব্দিল বার (মৃত্যু ৪৬৩ হি.) লিখেছেন,
إن من ارتد عن دينه حل دمه، وضربت عنقه، والأمة مجتمعة على ذلك
অর্থাৎ যে তার দ্বীন ত্যাগ করে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরশ্ছেদ করা হবে। মুরতাদের এ শাস্তির বিষয়ে পুরো উম্মতের সুপ্রতিষ্ঠিত ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। আততামহীদ ৫/৩০৬
ইবনে কুদামা হাম্বলী (মৃত্যু ৬২০ হি.) লিখেছেন,
وأجمع أهل العلم على وجوب قتل المرتدينوروي ذلك عن أبي بكر، وعثمان، وعلي، ومعاذ، وأبي موسى، وابن عباس، وخالد وغيرهم، ولم ينكر على ذلكفكان إجماعا.
অর্থাৎ সব ধরনের মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এ বিষয়ে আলেমগণের ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। হযরত আবু বকর, উসমান, আলী, মুআয, আবু মুসা, ইবনে আববাস এবং খালিদ ইবনে ওয়ালীদ প্রমুখ সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে এ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আর এ শাস্তির উপর কোনো সাহাবী আপত্তি করেননি। অতএব মৃত্যুদন্ডের এ বিধানের উপর সাহাবায়ে কেরামেরও ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।-আলমুগনী ১২ : ২৬৪
এ বিষয়ে আরও যারা ইজমা নকল করেছেন, তাদের কয়েকজন যথাক্রমে,
১. ইবনুল মুনযির (মৃত্যু ৩১৮ হি.)-আলইজমা পৃ. ১২২
২. ইবনে হায্ম যাহেরী (মৃত্যু ৪৫৬ হি.)-মারাতিবুল ইজমা পৃ. ২১০
৩. ইবনে রুশদ আলহাফীদ মালেকী (মৃত্যু ৫৯৫ হি.)-বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২ : ৩৪৩
৪. ইবনে কুদামা মাকদিসী হাম্বলী (মৃত্যু ৬৮২ হি.)-আশশরহুল কাবীর ৫ : ৩৫৫
৫. বুরহানুদ্দীন আলহানাফী (মৃত্যু ৬১৬ হি.)-আলমুহীতুল বুরহানী ৭ : ৪৪৩
৬. ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী শাফেয়ী (মৃত্যু ৯৭৪ হি.)-আলইলাম বি কাওয়াতি-ইল ইসলাম পৃ. ৪০০
৭. মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আসসানআনী (মৃত্যু ১১৮২ হি.)-সুবুহুস সালাম ৩ : ৫৩৪
৮. ইবনে আবেদীন শামী (মৃত্যু ১২৫২ হি.)-রাসায়েল ১ : ৩১৬
৯. যফর আহমদ উসমানী (মৃত্যু ১৩৯৬ হি.)-ইলাউস সুনান ১২ : ৫৯৯
যুক্তির আলোকে মুরতাদের মৃত্যুদন্ড
শরীয়তের সকল বিধানেরই যৌক্তিকতা রয়েছে। যে সকল বিধানের দলিল কুরআন, হাদীস ও ইজমায়ে উম্মতের মাঝে বিদ্যমান, সে সকল বিধানের উপর আমলের জন্য কেয়াস তথা যৌক্তিকতার অপেক্ষায় থাকা চলে না। এজাতীয় বিধানের যৌক্তিকতা বোধগম্য হোক বা না হোক, এর উপর আমল অপরিহার্য। মুতরাদের মৃত্যুদন্ডের বিষয়টিও তেমন একটি বিধান। যদিও এ-বিধানটিও খুবই যুক্তিযুক্ত। আর এখানে এটাও স্মরণ রাখা উচিতৎ যে, শরীয়তের বিধানাবলীর প্রকৃত রহস্য, হেকমত ও যৌক্তিকতা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কারণ তিনিই হলেন সৃষ্টিকর্তা শরীয়তদাতা, বিধানদাতা। তবে মানুষের সাধ্যের ভিতরে যতটুকু আছে, ততটুকু যৌক্তিকতা জানা মানুষের আন্তরিক প্রশান্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
মুরতাদের মৃত্যুদন্ডের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে ইবনুল কায়্যিম আলজাওযিয়্যাহ (মৃত্যু ৭৫১ হি.) লিখেছেন,
فأما القتل فجعله عقوبة أعظم الجنايات، كالجناية على النفس ... وكالجناية على الدين بالطعن فيه والارتداد عنه، وهذه الجناية أولى بالقتل ... إذ بقائه بين أظهر العباد مفسرة لهم، ولا خير يرجى في بقائه ولا مصلحة.
 মৃত্যুদন্ড হলো সর্বোচ্চ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি। সর্বোচ্চ অপরাধ যেমন, মানুষ হত্যা, দ্বীনের বিষয়ে কটূক্তি করা বা দ্বীন ত্যাগ করার মাধ্যমে দ্বীনের উপর আঘাত হানা ইত্যাদি।
ইরতিদাদের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত। কারণ সমাজে মুরতাদের অবস্থান সংঘাত-সহিংসতা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণ হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তির বেঁচে থাকার মাঝে কোনো মঙ্গলের আশা করা যায় না। একে বাঁচিয়ে রাখা বরং অনেক বড় নির্বুদ্ধিতা।-ইলামুল মুওয়াক্যিঈন ২/৮৪
পাঠক! আমরা যদি সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দিকে একটু লক্ষ্য করি, তাহলেই আমাদের সামনে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।





প্রশ্ন: ৩০৪ : মিলাদ কি জায়েজ ?

শরীয়তের আদেশ নিষেধ সাহাবায়ে আজমাঈনগণের মাধ্যমেই আমাদের নিকট পৌছেছে। তারা রাসুল সা: কে আমাদের চাইতেও বেশী ভালোবেসেছেন। সুতরাং, রাসুল সা: এর মৃত্যুর পর সাহবায়ে আজমাঈনগণ কি মিলাদ পড়েছেন ? যদি মিলাদ জায়েজই হতো তাহলে সাহাবায়ে আজমাঈন গণ সবচাইতে বেশী মিলাদ পড়তেন এবং হাদীসের অধ্যয়গুলোতে মিলাদ নামে আলাদা অধ্যায় থাকতো। সুতরাং, মিলাদ জায়েজ নয়, বরং এটি একটি বিদআত কর্ম, কারণ এটি জরুরী নেক কাজ মনে করে করা হয়।

প্রশ্ন: ৩০৩ : ইসলামে হারাম, হালাল, মাকরুহ, মুবাহ ও মুস্তাহাব পরিচিতি।


ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের কাজকর্ম হারাম, হালাল, মাকরুহ, মুবাহ ও মুস্তাহাব-এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। সংক্ষেপে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
হারাম : ইসলামে যে সব কাজকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে তাকে হারাম বলা হয়। এ ধরনের কাজ বর্জন করা বাধ্যতামূলক। হারাম কাজ করলে আল্লাহর শাস্তি পেতে হবে। যেমন: গীবত করা বা অপবিত্র কিছু খাওয়া ইসলামে হারাম। সূর্যদয় এবং সূর্যাস্তের সময় নামাজ আদায় করা। হালাল : হালাল অর্থ বৈধ। ইসলাম যে সব কাজকে বৈধ বা জায়িজ স্বীকৃতি দিয়েছে ইসলামি পরিভাষা অনুযায়ী তাই হালাল। একজন মুসলিমের উচিত সর্ব ব্যাপারে হালাল পন্থা ও পথ-পদ্ধতি অবলম্বন করা।যেমন : ব্যবসা হালাল এবং সুদ হারাম।

মাকরুহ : মাকরুহ এমন আমল যা পালন করার তুলনায় না করা উত্তম। অর্থাৎ যে কাজ করা জায়েজ কিন্তু না করা উত্তম। মাকরুহ কাজ করলে শাস্তি পেতে হবে না, কিন্তু এ ধরনের কাজ এড়িয়ে যেতে বলেছে ইসলাম। যেমন : আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ঐ দিনের আসরের নামাজ ছাড়া অন্য কোনো নামাজ আদায় করা।

 মুস্তাহাব : মুস্তাহাব এমন আমল যা পালন না করলে কোনো শাস্তি পেতে হবে না। কিন্তু পালন করা ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম। মুস্তাহাব কাজ করলে সওয়াব ও আল্লাহর দরবারে পুরস্কার আছে। যেমন: প্রতি আরবি মাসের প্রথম ও শেষ বৃহস্পতিবার রোজা রাখা মুস্তাহাব।

 মুবাহ :  এটি এমন কর্ম যা সম্পাদন বা বর্জন কোনোটিই ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়। আবার একাজ করতে উত্সাহিতও করা হয়নি। যেমন : ক্ষুধা না থাকা অবস্থায় কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা ছাড়া খাবার গ্রহণ করা।
 গ্রন্থনা : মাওলানা মিরাজ রহমান

মূল লিংক 

==============================

মুবাহ হলো ফরজ, ওয়াজিব ও নফলের মতোই আমলের স্তর বোঝাতে ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। মুবাহ হলো, যা সাধারণভাবে হালাল বা জায়েজ। অর্থাৎ, যে জিনিস বা কাজটির সঙ্গে সত্তাগতভাবে ইসলামের কোনো আদেশ বা নিষেধ সম্পৃক্ত নয়।

যেমন পানাহার করা, বেচাকেনা করা, পর্যটনমূলক বা জীবিকার সন্ধানে ভ্রমণ, রমজানের রাতের বেলা স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা।
মুবাহ কাজের উদাহরণ : মুবাহর সংজ্ঞাতে ‘সত্তাগতভাবে’ কথাটি এ জন্য বলা হয়েছে যেহেতু হতে পারে এর সঙ্গে তৃতীয় কোনো একটি বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে সেটাকে নির্দেশিত কিংবা নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত করবে।
উদাহরণ ‘পানি ক্রয় করা’ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, যদি পানি ক্রয় করার ওপর ফরজ নামাজের জন্য ওজু করা আটকে থাকে সেক্ষেত্রে পানি কেনা ওয়াজিব। কেননা যে মাধ্যম ছাড়া কোনো ওয়াজিব কর্ম সম্পাদিত হয় না সে মাধ্যমও ওয়াজিব।

আরেকটি উদাহরণ পর্যটনমূলক ভ্রমণ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, এ ভ্রমণ যদি হয় বিধর্মী কোনো দেশে যেখানে ফিতনা, পাপাচার ও ব্যভিচার ইত্যাদির সয়লাব; এমন ভ্রমণ হারাম। কেননা এ ভ্রমণ হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যম।

মুবাহর সম্বন্ধে : আরও জানতে পড়তে পারেন ইবনে কুদামার লিখিত ‘রওজাতুন নাজের ওয়া জুন্নাতুল মুনাজির’ (১/১৫০-২১০), জারকাশির লিখিত ‘আল-বাহরুল মুহিত’ (১/১৪০-২৪০) এবং ইবনে উছাইমীনের ‘শারহুল উসুল মিন ইলমিল উসুল’ (৪৬-৬৮)।

=================================


প্রশ্ন

ফরয (আবশ্যকীয়), মুস্তাহাব (আবশ্যকীয় নয়), মুবাহ (ঐচ্ছিক), মাকরুহ (অপছন্দনীয়) ও হারাম (নিষিদ্ধ)। আমি আশা করব, আপনারা আমাকে প্রত্যেক শ্রেণীর একটি করে উদাহরণ জানাবেন।

উত্তর

আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
ওয়াজিব: যা পালন করার জন্য শরিয়তপ্রণেতা আবশ্যকীয়ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর উদাহরণ হচ্ছে- পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমযানের রোযা, যাকাত দেয়ার সামর্থ্যবান হলে যাকাত, হজ্জ করার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ।
'ওয়াজিব'-কে فرض (ফরয), فريضة (আবশ্যকীয়), حتم (অপরিহার্য), لازم (অনিবার্য) ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল সম্পাদনকারী সওয়াব পাবেন এবং না করলে শাস্তি পাবে।
দুই:
মানদুব: যা পালন করার জন্য শরিয়তপ্রণেতা নির্দেশ দিয়েছেন; তবে আবশ্যকীয়ভাবে বা অপরিহার্যরূপে নয়।
এর উদাহরণ হচ্ছে- কিয়ামুল লাইল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথের সুন্নত নামাযগুলো ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের অতিরিক্ত নামাযগুলো, প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখা, শাওয়াল মাসে ছয় রোযা রাখা, গরীবদেরকে দান-সদকা করা এবং নিয়মিত যিকির-আযকার ও ওযিফাগুলো পড়া।
'মানদুব'-কে মুস্তাহাব, সুন্নত, মাসনূন, নফল ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল পালনকারী সওয়াব পাবেন; তবে বর্জনকারী শাস্তি পাবে না।
তিন:
হারাম বা নিষিদ্ধ: যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরিয়তপ্রণেতা আবশ্যকীয়ভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন- ব্যভিচার, মদপান, পিতামাতার অবাধ্যতা, দাঁড়ি না রাখা, নারীদের বেপর্দা চলাফেরা করা।
হারাম কাজ বর্জনকারী সওয়াব পাবেন, আর হারামে লিপ্ত ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হবে।
চার:
মাকরুহ: যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরিয়তপ্রণেতা নিষেধ করেছেন; তবে আবশ্যকীয়ভাবে নয়। যেমন- কোন কিছু বাম হাতে গ্রহণ করা ও বাম হাতে প্রদান করা। নারীদের জন্য মৃতব্যক্তির জানাযার সাথে যাওয়া। এশার নামাযের পর আলাপ-আলোচনা করা, কাঁধ খালি রেখে এক কাপড়ে নামায আদায় করা, ফজরের নামাযের পর সূর্যোদয়ের আগে নফল নামায পড়া এবং আছরের নামাযের পর সূর্যাস্তের আগে নফল নামায পড়া।
মাকরুহ আমল বর্জনকারী সওয়াব পাবেন; কিন্তু মাকরুহ আমলে লিপ্ত হলে শাস্তি দেওয়া হবে না।
পাঁচ:
মুবাহ বা হালাল বা জায়েয: যে আমলের সাথে সত্তাগতভাবে কোন আদেশ বা নিষেধ সম্পৃক্ত নয়।
যেমন- পানাহার করা, বেচাকেনা করা, পর্যটনমূলক বা জীবিকার সন্ধানে ভ্রমণ, রযমানের রাতেরবেলা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা।
মুবাহ –এর সংজ্ঞাতে 'সত্তাগতভাবে' কথাটি এ জন্য বলা হয়েছে যেহেতু হতে পারে এর সাথে তৃতীয় কোন একটি বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে সেটাকে নির্দেশিত কিংবা নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত করবে।
উদাহরণত: ‘পানি খরিদ করা’ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, যদি পানি খরিদ করার উপর ফরয নামাযের জন্য ওযু করা আটকে থাকে সেক্ষেত্রে পানি খরিদ করা ওয়াজিব। কেননা যে মাধ্যম ছাড়া কোন ওয়াজিব কর্ম সম্পাদিত হয় না সে মাধ্যমও ওয়াজিব।  
আরেকটি উদাহরণ- পর্যটনমূলক ভ্রমণ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, এ ভ্রমণ যদি হয় বিধর্মী কোন দেশে যেখানে ফিতনা, পাপাচার ও  ব্যভিচার ইত্যাদির সয়লাব; এমন ভ্রমণ হারাম। কেননা এ ভ্রমণ হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যম।
এ বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন: ইবনে কুদামার লিখিত 'রওযাতুন নাযের ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির' (১/১৫০-২১০), যারকাশির লিখিত 'আল-বাহরুল মুহিত' (১/১৪০-২৪০) এবং ইবনে উছাইমীনের 'শারহুল উসুল মিন ইলমিল উসুল' (৪৬-৬৮)।
আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।




প্রশ্ন: ৩০২: ছোট শিশুদের কত বছর পর্যন্ত দুধ খাওয়ানো যাবে।

প্রশ্ন: আমার বাচ্চার বয়স ২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই একজন আলেমকে দুধ পান করানোর সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আড়াই বছর পর্যন্ত পান করানো যাবে। তারপর হারাম হবে। এখন জানতে পারলাম, ২ বছরের পর দুধ পান করানো যাবে না। আমার জানার বিষয় হল, দুই বছরের পর দুধ পান করানোর কোনো সুযোগ আছে কি না? এবং ঐ আলেমের কথা সঠিক কি না? 

উত্তর: বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী সন্তানকে দুধ পান করানোর মেয়াদ চান্দ্র বছর হিসেবে দুই বছর। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) আর মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। (এ বিধান) তার জন্য যে দুধ পানের (মেয়াদ) পূর্ণ করতে চায়। [সূরা বাকারা : ২৩৩] আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আর তার (সন্তান) দুধ ছাড়ানো হয় দু বছরে। [সূরা লুকমান : ১৪] সুতরাং দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর সন্তানকে আর দুধ পান করানো যাবে না। তাই আড়াই বছর পর্যন্ত পান করানো যাবে- এ কথা ঠিক নয়। [সূরা বাকারা : ২৩৩; তাফসীরে তবারী ৪৯৬২; মুখতাসারুত তহাবী ২২০; ফাতহুল কাদীর ৩/৩০৯; গুনইয়াতু যাবীল আহকাম শুরুম্বুলালীয়া ১/৩৫৫, ৩৫৬; আলবাহরুর রায়েক ৩/২২৩] গ্রন্থনা ও সম্পদানা : মাওলানা মিরাজ রহমান সৌজন্যে : মাসিক আল-কাউসার

মূল লিংক

প্রশ্ন: ৩০১: কুরআনের আয়াত ”কোরআন আমি সহজ করিয়া দিয়াছি উপদেশ গ্রহনের জন্য অতএব,উপদেশ গ্রহনকারি কেহ আছে কি? “ - আললাহর এই কথাটা কাদের জন্য বলেছেন,সুধু কি আলেমদের জন্য, নাকি পৃথিবীর সব মানুষের জন্য? কোরআন থেকে জানতে চাই!যারা শিক্ষিত তারা যদি কোরআন পরে, এবং চিন্তা ভাবনা করে, তাহলে তারা বুঝতে পারবে কি পারবেনা,জানাবেন!

প্রথমত দ্বীন ও শরীয়তের পার্থক্য বুঝতে হবে। দ্বীন সব নবীর ক্ষেত্রেই এক ছিল। সকল প্রকার শিরক থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহকে নিজের ইলাহ রব ও বিধানদাতা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া এবং এই জীবনের কার্যাবলীর জন্য অবশ্যই পরকালে হিসাব দিতে হবে এবং পরকাল অবশ্যই সংঘটিত হবে এবং তা দিনের আলোর মতই সত্য - এই ধরণের প্রধান প্রধান নীতি নির্ধারক বিষয়গুলোর সমস্টিই হচ্ছে দ্বীন। কুরআন থেকে এই দ্বীন বুঝা সহজ করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি ব্যাক্তিই খারাপ পথ আর ভালো পথের ব্যাপারে সহজেই কুরআন থেকে জানতে পারবে। কিন্তু ইসলামী জীবন পরিচালনার জন্য সার্বিক নিয়ম কানুনের সমস্টি হচ্ছে শরীয়ত, এই শরীয়ত বিভিন্ন নবীর সময় বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে। তো কুরআন হাদীস থেকে জীবন পরিচালনার জন্য সার্বিক বিধি বিধান চয়ন করার জন্য কুরআন হাদীসে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। এটি সর্ব সাধারণের পক্ষে এই বিধিবিধান চয়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য সর্বসাধারণকে বিশেষজ্ঞ আলেমদের ও ইসলামের বড় বড় ইমামদের দারস্থ হতে হবে। ইমামদের রচিত ইসলামী জীবন পরিচালনার এই বিধিবিধানের সমস্টিই হচ্ছে মাযহাব।

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কোন ব্যাক্তি যদি কুরআন হাদীস ইত্যাদি গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে জীবন চলার বিধি বিধান চয়ন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তবে তার জন্য মাযহাব মানা জরুরী নয়। বরং সে তাকে এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইমামদের মতামত কুরআন হাদীসের আলোকে যাচাই করে এবং গবেষণা করে দেখতে পারে। কিন্তু যে ব্যাক্তি কুরআন হাদীস থেকে ইসলামী জীবন পরিচালনার বিধি বিধান চয়ন করতে সক্ষম নয়, তার জন্য মাযহাব মান জরুরী ।


প্রশ্ন: ৩০০ : ইসলামে হারাম ও হালাল খাবার / খাদ্যদ্রব্যের তালিক।


আসলে ইসলামে হালাল খাদ্যদ্রব্যের কোন তালিকা নেই বরং হারাম খাদ্য দ্রব্যের তালিকা রয়েছে। অর্থাৎ, হারাম খাদ্যদ্রব্য বাদ দিয়ে বাকী সব খাবারই হালাল।

মানুষের জন্য উপকারী ও পবিত্র সবধরনের খাদ্যের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হচ্ছে হালাল ও বৈধতার। প্রমাণ্য ও গ্রহণযোগ্য দলিল ব্যতীত কোন প্রকার খাদ্য হারাম বলা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বল, ‘আমার নিকট যে ওহী পাঠানো হয়, তাতে আমি আহারকারীর উপর কোন হারাম পাই না, যা সে আহার করে। তবে যদি মৃত কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের গোশ্ত হয়- কারণ, নিশ্চয় তা অপবিত্র।’ (আন-আম : ১৪৫) এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যেসব খাদ্যের ব্যাপারে হারামের কোন দলিল নেই, তা হালাল ও বৈধ। আমরা যেসব খাদ্য গ্রহণ করি, তা দু’প্রকার। প্রথম প্রকার : পশু ও পাখপাখালি। দ্বিতীয় প্রকার : উদ্ভিদ ও শাকসবজি।




প্রথম প্রকার : পশু ও পাখপাখালি : পশু ও পাখপাখালির ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম অনেক লেখালেখি করেছেন এবং এর মধ্যে যা যা হারাম তার জন্য কিছু নিদর্শন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করে দিয়েছেন, যে প্রাণীর মধ্যে হারামের কোন আলামত পাওয়া যাবে, তা খাওয়া হারাম। নিম্নে আমরা সেসব বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করছি :




(১) দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করা হারাম। যেমন, বাঘ, চিতা বাঘ, সিংহ ও কুকুর ইত্যাদি।

(২) থাবা বা পাঞ্জাবিশিষ্ট হিংস্র পাখি ভক্ষণ করা হারাম। যেমন, ঈগল, বাজ, শ্যেন, পেঁচা ও শাহীন পাখি ইত্যাদি। দলিল : ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘রাসূল সা. দাঁতবিশিষ্ট প্রত্যেক হিংস্র জন্তু ও থাবাবিশিষ্ট প্রত্যেক হিংস্র পাখি খেতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ১৯৩৪)

(৩) নির্দিষ্টভাবে যেসব পশু খেতে নিষেধ করা হয়েছে, তা খাওয়া হারাম। যেমন, গৃহপালিত গাধা। দলিল : জাবের রা. বলেন, রাসূল সা. খায়বরের দিন গৃহপালিত গাধা খেতে নিষেধ করেছেন এবং ঘোরার গোশত খেতে অনুমতি দিয়েছেন।’ (বুখারি:৪২১৯, মুসলিম:১৯৪১) আরেকটি উদাহরণ, শূকর। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃতপ্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশত ...’ (মায়েদা : ৩)

(৪) আরবরা যেসব প্রাণীকে খবিস ও নাপাক বলত, তা খাওয়াও হারাম। দলিল : আল্লাহ তাআলা বলেন, (রাসূল সা.) ‘তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র (খবিস) বস্তু হারাম করে।’ (আরাফ : ১৫৭) অপবিত্র বস্তু যেমন, পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ ও শকুন। যেহেতু এগুলোর খানাখাদ্য অধিকাংশই নাপাক ও আবর্জনা, তাই এগুলোকে খবিস বা নাপাক বলা হয়। (৫) শরিয়ত যেসব প্রাণী হত্যা করতে নিদের্শ দিয়েছে বা যেসব প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছে, তা খাওয়া হারাম। যেমন, হাদিসে নিষিদ্ধ পাঁচটি প্রাণী। যথা : ইদুর, বিচ্ছু, পাগলা কুকুর, কাক ও চিল ইত্যাদি। উল্লেখিত বিধান ও নিয়মের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, এ ছাড়া যেসব পশু ও পাখপাখালি রয়েছে, তা হালাল ও বৈধ। যেমন, ঘোরা, চতুষ্পদ জন্তু, মুরগি, উটপাখি, খরগোস ও জঙ্গলী গাধা এবং এ জাতীয় অন্যান্য প্রাণী। কারণ, কুরআন হাদিসের দলিল এর বৈধতা ও হালালকেই প্রমাণ করে।




দ্বিতয় প্রকার : উদ্ভিদজাতীয় খাদ্য : উদ্ভিদজাতীয় খাদ্য যেমন, বিভিন্ন উদ্ভিদ, ফল, শষ্য ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য ও তা থেকে তৈরিকৃত পানীয় হালাল। কারণ, খাদ্য ও পানীয়ের মূল প্রকৃতি হচ্ছে বৈধ ও হালাল হওয়া। হ্যাঁ, যেসব খাদ্য নেশার সৃষ্টি করে, তা ব্যতীত। যেমন, গাঁজা, আফিম এবং এ জাতীয় অন্যান্য নেশাদ্রব। অথবা যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর, তা ব্যতীত। যেমন, বিষ, সিগারেট ও এ জাতীয় অন্যান্য খাদ্য, যার ক্ষতি ও অপকারিতা সবার নিকট স্বীকৃত। এসব কিছুই হারাম। কারণ এগুলো হয়তো নেশার সৃষ্টি করে অথবা শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর। সন্দেহ নেই যে, আমাদের কোন না কোন স্বার্থ ও কল্যাণের জন্যই আল্লাহ তাআলা এসব কিছু হারাম করেছেন। কারণ, তিনি হেকমত ছাড়া কোন জিনিসের নির্দেশও দেন না, আবার হেকমত ছাড়া কোন জিনিস নিষেধও করেন না। এসব হেকমত মানুষ কখনো বুঝতে সক্ষম হয় কখনো হয় না। মানুষ কোন জিনিসের হেকমত বুঝতে সক্ষম না হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাতে কোন হেকমত নেই। মানুষের শরীর যেসব খাদ্য গ্রহণ করে, সেসব জিনিসের প্রভাবই তার ওপর পড়ে। যে ভাল খাদ্য গ্রহণ করবে, তার ওপর ভাল প্রভাব পড়বে, আর যে খারাপ খাদ্য গ্রহণ করবে, তার ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা ভাল খাদ্য গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আর খারাপ ও নাপাক খাদ্য খেতে নিষেধ করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান, ইসলামিক চিন্তাবিদ ও ফোকাহায়ে কেরাম নিজ নিজ গবেষণা, বই ও নিবন্ধে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রয়োজনে এগুলো পড়ে দেখার পরামর্শ দিচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।




মূল : আহমদ বিন আব্দুর রহমান আর-রশীদ

অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজরি আহমদ

গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান সৌজন্যে : ইসলামহাউজ
মূল লিংক


Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...