ইসলামী নেতৃত্ব - এ কে এম নাজির আহমদ

in
ইসলামী নেতৃত্ব
এ কে এম নাজির আহমদ

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

ইসলামী নেতৃত্ব

আল ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত দীন বা জীবন বিধান। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে বলে ইকামাতে দীন। কোন একটি ভূ-খন্ডে সমাজের সকল স্তরে, সকল দিকে ও বিভাগে ইসলামী বিধান পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলেই বলতে হবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কায়েমের প্রচেষ্টা চালিয়ে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনই হচ্ছে মুমিন জীবনের আসল লক্ষ্য। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কখনো আপনা আপনি কায়েম হয়ে যায় না। এর জন্য প্রয়োজন আন্দোলন। আর আন্দোলন মানে হচ্ছে লক্ষ্য হাসিলের জন্য একদল মানুষের সমন্বিত প্রয়াস।
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কায়েমের আন্দোলনকে বলা হয় আল্লাহর পথে জিহাদ। বাংলা ভাষায় ‘ইসলামী আন্দোলন’ পরিভাষা আল্লাহর পথে জিহাদকেই বুঝায়। আন্দোলনের জন্য চাই সংগঠন। নেতৃত্ব এবং একদল কর্মী না হলে সংগঠন হয় না। সংগঠনে বহু সংখ্যক কর্মী থাকে। নেতার সংখ্যা থাকে কম। কম সংখ্যক হলেও নেতৃত্বকেই সংগঠনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়।
ইসলামী নেতৃত্ব ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নবীদের উত্তরসূরী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দূর অতীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার জন্য নবী রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। আদম আ. থেকে শুরু করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. পর্যন্ত বহু সংখ্যক নবী রাসূল পৃথিবীর বিভিন্ন ভূ-খণ্ডে আবির্ভূত হয়ে আল্লাহ-প্রদত্ত জীবন বিধান আল ইসলামকে মানব সমাজে কায়েম করার আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই প্রসংগে মহান আল্লাহ বলেন,
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا
‘‘আমি তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম (যাতে) আমার নির্দেশে তারা লোকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়।’’ (সূরা আল আম্বিয়াঃ ৭৩)
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। কিন্তু তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আল-কুরআন এবং সেই আল-কুরআনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাহ অবিকৃতভাবে বিদ্যমান। আল্লাহর রাসূলের সা. ইন্তিকালের পর যুগে যুগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতৃত্ব আল ইসলামকে আল্লাহর যমীনে কায়েম করার জন্য বিভিন্ন ভূ-খণ্ডে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আজো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। যেইসব মহান ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের সা. দেখানো পদ্ধতিতে আল ইসলামকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নবী রাসূলদের উত্তরসূরীর ভূমিকাই পালন করছেন।
এই নিরিখে বিচার করলে ইসলামী নেতৃত্বের রয়েছে একটি বড়ো মর্যাদা। সেই কারণে তাঁদের দায়িত্ব বড়ো। তাঁদের সব সময় সজাগ থাকা উচিত যাতে তাঁদের কথা, কাজ এবং আচরণে এমন কিছু প্রকাশ না পায় যা নবীর উত্তরসূরীর জন্য শোভনীয় নয়।
কথার অনুরূপ কাজ ইসলামী নেতৃত্বের প্রধান ভূষণ
অনুগামী ও কর্ম এলাকার লোকদের মাঝে আল ইসলামের জ্ঞান বিতরণ ইসলামী নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু অনুগামীগণ কিংবা কর্ম এলাকার লোকেরা যদি নেতৃত্বের বাস্তব জীবনে আল ইসলামের অনুশীলন দেখতে না পায়, শুধু মুখের কথা শুনেই তারা অনুপ্রাণিত হয় না। যেইসব নেতা মুখে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন অথচ তাঁদের জীবনে সেইসব সুন্দর কথার প্রতিফলন থাকে না, লোকেরা তাঁদেরকে কপট নেতা গণ্য করে। এই ধরণের নেতৃবৃন্দ কখনো লোকদের শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন না। কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য লোকেরা কখনো কখনো তাঁদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হলেও তাদের অন্তরে এইসব নেতার প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ, কোন ভালোবাসা থাকে না।
লোকেরা যখন দেখতে পায় যে নেতাগণ যেইসব কাজ করার জন্য লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন, তাঁরা নিজেরাও সেইসব কাজ করে থাকেন, তখন তারা নেতাদেরকে নীতিবান নেতা বলে স্বীকার করে, তখন তারা তাঁদের কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। নীতিবান নেতৃত্বের নিরাপোষ ভূমিকাই সাধারণ লোকদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। এমন নেতৃত্বের নির্দেশ মতো কাজ করতে তারা উৎসাহ বোধ করে।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. আল-কুরআনের শিক্ষা লোকদের সামনে পেশ করতেন। লোকেরা দেখতে পেতো যে তিনি যেই শিক্ষার কথা মুখে উচ্চারণ করছেন সেই শিক্ষা অনুযায়ীই তাঁর জীবন পরিচালনা করছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর জীবন ছিলো আল-কুরআনেরই জীবন্ত রূপ। বৈসাদৃশ্যহীন, বৈপরীত্যহীন পরিচ্ছন্ন জীবন তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছিলো, তাঁকে অনুকরণীয় অনুসরণীয় করে তুলেছিলো।
‘কথার অনুরূপ কাজ’ না করা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত। এমন চরিত্রের লোকদের সমালোচনা করেই তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ – كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, যেই কাজ তোমরা নিজেরা কর না তা বল কেন? আল্লাহর নিকট এটি গর্হিত কাজ যে তোমরা এমন কথা বল যা তোমরা কর না।’ (সূরা আস সাফঃ ,)
ইসলামী নেতৃত্বকে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে হবে। তাঁদের কথা ও কাজের মাঝে যাতে কোন বৈপরীত্য না থাকে সেই ব্যাপারে তাঁদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। ‘কথার অনুরূপ কাজ’ই তাঁদেরকে লোকদের নিকট শ্রদ্ধাস্পদ করে তুলবে। নেতৃত্ব যদি লোকদের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা কুড়াতে না পারেন তবে তো তাঁদেরকে ব্যর্থ নেতৃত্বই বলতে হবে।
মানুষের কল্যাণ কামনা ইসলামী নেতৃত্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
ইসলামী নেতৃ্ত্ব মানুষের সুখ, শান্তি এবং কল্যাণের কথা ভেবে থাকেন। তাঁরা নিশ্চিত যে মানব রচিত মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করে মানুষের সুখ, শান্তি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মানুষের দুনিয়ার জীবনের কল্যাণ এবং আখিরাতের জীবনের নাজাতের কথা ভেবেই তাঁরা পেরেশান। কল্যাণ এবং মুক্তির পথে মানুষেকে নিয়ে আসার জন্যই তাঁরা তৎপর।
প্রাচীন ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিলেন নূহ (আ)। তিনি লোকদেরকে বলেন,
أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
‘আমি তোমাদের নিকট আমার রবের পয়গাম পৌঁছাই। আমি তোমাদের কল্যাণ কামনা করি। আমি আল্লাহর নিকট থেকে এমন সব বিষয় জানি যা তোমরা জান না।’ (সূরা আল আরাফঃ ৬২)
প্রাচীন আরবের আদ জাতির নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন হূদ (আ)। তিনি লোকদেরকে বলেন,
أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ
‘আমি তোমাদের নিকট আমার রবের পয়গাম পৌঁছাই। আমি তোমাদের নির্ভরযোগ্য কল্যাণকামী।’ (সূরা আল আরাফঃ ৬৮)
প্রাচীন আরবের আরেক জাতি ছিলো ছামূদ জাতি। এই জাতির নিকট প্রেরিত হন ছালিহ (আ)। লোকদেরকে সম্বোধন করে তিনি বলেন,
يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَٰكِن لَّا تُحِبُّونَ النَّاصِحِينَ
‘ওহে আমার কাউম, আমি তোমাদের নিকট আমার রবের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের কল্যাণই চেয়েছি। কিন্তু তোমরা তো কল্যাণকামীদেরকে পছন্দ কর না।’ (সূরা আল আরাফঃ ৭৯)
প্রাচীন আরবের উত্তরাঞ্চলে বাস করতো মাদইয়ান জাতি। এদের নিকট প্রেরিত হন শুয়াইব (আ)। তিনি লোকদেরকে ডেকে বলেন,
يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ ۖ فَكَيْفَ آسَىٰ عَلَىٰ قَوْمٍ كَافِرِينَ
‘ওহে আমার কাউম, আমি আমার রবের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের কল্যাণ চেয়েছি।’ (সূরা আল আরাফঃ ৯৩)
তাঁদের মতো সকল নবীই মানুষের কল্যাণকামী ছিলেন। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা. নবুওয়াত লাভের পূর্বেও ছিলেন একজন অসাধারণ মানবদরদী মানুষ। মানুষের কল্যাণকামী ছিলেন বলেই তিনি সতর বছর বয়সে ‘হিলফুল ফুদুল’ নামক সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
চল্লিশ বছর বয়সে জাবালে নূরের হিরা গুহায় অবস্থানকালে জিবরীলকে (আ) দেখে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। বাড়িতে ছুটে এসে স্ত্রী খাদীজাহ বিনতু খুয়াইলিদকে বলেন তাঁর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিতে। কিছুক্ষণ পর তাঁর গায়ের কম্পন দূর হয়। তিনি স্ত্রীকে বলেন, ‘আমার তো জীবনের ভয় ধরে গেছে।’ খাদীজাহ রা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘‘আপনি আশ্বস্ত হোন, আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করে থাকেন। সর্বদা সত্য কথা বলেন। অসহায় লোকদের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। নিজের উপার্জিত অর্থ দরিদ্রদেরকে দান করেন। ভালো কাজে লোকদের সহযোগিতা করেন।’’
খাদীজাহ বিনতু খুয়াইলিদের (রা) বক্তব্যে মানব দরদী, মানুষের কল্যাণকামী মুহাম্মাদের সা. পরিচয় ফুটে উঠেছে। শুধু দুনিয়ার জীবন নয় মৃত্যুর পরবর্তী অনন্ত জীবনেও মানুষ যাতে সুখী হতে পারে সেই জন্য তিনি লোকদেরকে আল্লাহর পথে এগিয়ে আসার আহ্‌বান জানাতে থাকেন।
আল্লাহর পথ পরিহার করে মানুষ যখন ইবলীসের পথে চলে তখন তাদের জীবনে সৃষ্টি হয় অসংখ্য জটিলতা। সমস্যার আবর্তে তারা ঘুরপাক খেতে থাকে। অশান্তির আগুনে তারা পুড়তে থাকে। তদুপরি আখিরাতের কঠিন আযাব তো তাদের জন্য অপেক্ষমান।
এই অবস্থা দেখে ইসলামী নেতৃত্ব কখনো উল্লসিত হন না। মনের গভীরে তাঁরা দারুণ ব্যথা অনুভব করেন। দুঃখী মানুষের দুঃখ বেদনা লাঘবের জন্য তাঁরা এগিয়ে আসেন। মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য মানুষের চিন্তা-চেতনা থেকে জাহিলিয়াতের মূলোৎপাটন করে তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে কল্যাণময় সমাজ গঠনের উপাদানে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
ইসলামী নেতৃত্ব জানেন যে মানুষের মন্দ আচরণের মূলে রয়েছে মন্দ চিন্তা-চেতনা। এই মন্দ আচরণ দেখে মানুষকে ঘৃণা না করে মানুষের মন্দ চিন্তা-চেতনা দূর করার দিকেই তাঁরা নজর দেন। কারণ মন্দ চিন্তা-চেতনা দূর হলেই মানুষের জীবন থেকে মন্দ আচরণ বিদূরিত হয়।
ইসলামী নেতৃত্বই মানুষের প্রকৃত কল্যাণকামী। দুর্ভাগা মানুষেরা এই মহা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে তারা তাদের কল্যাণকামীদেরকেই তাদের দুশমন মনে করে এবং তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করে থাকে। ইসলামী নেতৃত্ব এই দুর্ভাগাদের প্রতি দরদী এবং ক্ষমাশীল মন নিয়ে তাকান। দিনরাত তাদের কল্যাণের কথাই ভাবেন। যাঁদের অন্তরে মানব প্রেমের ফল্গুধারা নেই ইসলামী নেতা হওয়ার যোগ্যতা তাঁদের নেই। ‘রাহমাতুললিল্‌ আলামীনের’ উত্তরসূরী হওয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁদের মাঝে নেই।
ইসলামী নেতৃত্বের বুনিয়াদী কাজ ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন
ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য চাই ইসলামী ব্যক্তিত্ব। যাদের জীবনে ইসলাম নেই। তারা সমাজে ইসলাম কায়েম করবেন কিভাবে? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যেই পর্যন্ত না তারা তাদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে।’’ (সূরা আর রাদঃ ১১)
এই আয়াতটিকে রয়েছে সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ইসলামী কনসেপ্ট। এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে একটি জাতির ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনধারা যেইভাবে গড়ে তোলে, সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনে সেই ধারাই বিকশিত হয়। অর্থাৎ কোন জাতিকে যদি সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন করতে হয় তাহলে প্রথমে জাতির লোকদের চরিত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। আবার এটাও সত্য যে চিন্তাধারায় পরিবর্তন সাধন না করে কারো চরিত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষের প্রকৃতি। মানুষের জীবনে পরিবর্তন সাধনের প্রক্রিয়া একমাত্র তাঁরই জানা।
মেহেরবান আল্লাহ যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত তাঁর জীবন দর্শন মানুষের সামনে উপস্থাপন করার দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদেরকে। নবী রাসূলগণ প্রথমে মানুষের চিন্তা-চেতনাকে আলোড়িত করতে চেয়েছেন। মানুষের চিন্তাজগতে ইসলামী জীবন দর্শনের বীজ বপন করার চেষ্টা করেছেন। যাদের চিন্তাজগত ইসলামী জীবন দর্শন ধারণ করেছে তাদের কর্ম জগতে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মেই।
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা. একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘তিনিই সেই সত্তা যিনি উম্মীদের জন্য তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূলের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত পড়ে শুনায়, তাদের তাযকিয়া করে এবং তাদেরক আল কিতাব ও আল হিকমাহ শিক্ষা দেয়।’’ (সূরা আল জুমুআঃ )
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
‘‘যেমন আমি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছি যাতে সে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে, তোমাদেরকে আল কিতাব ও আল হিকমাহ শিক্ষা দেয় এবং যেইসব কথা তোমাদের জানা ছিলো না তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়।’’ (সূরা আল বাকারাঃ ১৫১)
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি এই অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল বানিয়েছেন, যে তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে আল কিতাব ও আল হিকমাহ শিক্ষা দেয়।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৬৪)
মুহাম্মাদ সা. সর্বশেষ নবী। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল-কুরআন সর্বশেষ আসমানী কিতাব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামাত পর্যন্ত আল-কুরআনকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। মহানবীর সা. দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী যিন্দেগীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিবরণও অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বের কর্তব্য হচ্ছে মহানবীর সা. অনুকরণে আল-কুরআনকে মানুষের সামনে পেশ করা, আল-কুরআনে উপস্থাপিত জীবন দর্শনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করার জন্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা এবং আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে জীবনকে ঢেলে সাজানোর জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। যারা আল-কুরআনের জীবন দর্শনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে তারাই খাঁটি মুমিন। আর এই মুমিনগণ যাবতীয় গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং যাবতীয় নেক আমল অনুশীলন করে তাদের জীবনকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে নিক, এটাই আল্লাহর অভিপ্রায়।
কোন ভূ-খণ্ডের বিপুল সংখ্যক লোক যখন এইভাবে গড়ে ওঠে তখনই তৈরী হয় ইসলামী গণভিত্তি। আর এই গণভিত্তি ইসলামী সমাজ নির্মাণের বুনিয়াদ। ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের জন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন হচ্ছে ইসলামী নেতৃত্বের বুনিয়াদী কাজ।
কঠোরতা নয় কোমলতা অবলম্বনই ইসলামী নেতৃত্বের প্রধান সাংগঠনিক নীতি
ইসলামী আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব অর্থাৎ আম্বিয়ায়ে কিরাম তাঁদের অনুগামীদের প্রতি খুবই কোমল ছিলেন। তাঁরা অনুসারীদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন না। তাদের সাথে কর্কশভাবে কথা বলতেন না। তাদেরকে তিরস্কার করতেন না। তাদেরকে গালমন্দ করতেন না।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের সা. জীবন চরিত বিস্তারিতভাবে লিখিত রয়েছে। তাঁর জীবনে মন্দ আচরণের কোন উদাহরণ নেই। তিনি অনুগামীদেরকে তাদের আগেই সালাম দিতেন। হাসিমুখে তাদের সাথে কথা বলতেন। কখনো রাগান্বিত হলে তিনি তা কাউকে বুঝতে দিতেন না। তিনি যখন রাগতেন চেহারায় রক্তিমাভা ফুটে ওঠতো। চেহারায় ঘাম দেখা দিতো। এ থেকে লোকেরা আন্দাজ করতো যে রাসূলুল্লাহ সা. রাগান্বিত হয়েছেন। রাগান্বিত অবস্থায় তিনি কাউকে বকাঝকা করতেন না। কটুকথা বলতেন না।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সা. সম্বোধন করে বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ
‘‘ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন কর।’’ (সূরা আল আরাফঃ ১৯৯)
অনুগামীদের প্রতি তিনি সব সময়ই ছিলেন সহনশীল ও ক্ষমাশীল। তিনি ছিলেন بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ‘‘মুমিনদের প্রতি দরদী ও করুণাসিক্ত।’’ (সূরা আত তাওবাঃ ১২৮)
আল্লাহর রাসূলের সা. অনুগামীগণই মানুষই ছিলেন। ফলে তাঁদের ভুলভ্রান্তি হতো। কিন্তু তাঁদের ভুলভ্রান্তি দেখে তিনি ক্ষেপে ওঠতেন না। সংশোধনের লক্ষ্যে বিনম্র ভাষায় তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।
তাঁর কথা ও কাজে ছিলো মাধুর্য। তাঁর অমায়িক ব্যবহার তাঁকে এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলো। তাঁর মুখে মধুর বাণী শুনার জন্য, তাঁর সান্নিধ্যে থেকে প্রাণ জুড়াবার জন্য যখনই সুযোগ পেতো তাঁর অনুগামীগণ তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তারা সহজে তাঁর সান্নিধ্য ত্যাগ করতে চাইতো না। মহানবীর সা. আচরণ সম্পর্কে মহান আল্লাহ নিজেই বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
‘‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যে তুমি তাদের প্রতি নম্র স্বভাবের হয়েছো। যদি তুমি কঠোর ভাষা ও কঠোর চিত্তের লোক হতে লোকেরা তোমার চারদিক থেকে ভেগে চলে যেতো।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯)
مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথীগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর, কিন্তু পরস্পর রহম দিল।’’ (সূরা আল ফাতহঃ ২৯)
কাফিরদের প্রতি কঠোর মানে এই নয় যে, তাঁরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো। বরং কাফিরদের অনুসৃত মত ও পথের প্রতি তাঁদের ভূমিকা ছিলো নিরাপোষ। আবার কাফিরগণ যখন তাঁদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতো তখন ইস্পাতের দৃঢ়তা নিয়ে তাঁরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতো। কিন্তু এই ইস্পাত কঠিন মানুষগুলো যখন একের সাথে অপরজন মেলামেশা করতো, আলাপ করতো, তখন একটি মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। তাঁদের আচরণে সহমর্মিতা ও প্রীতি সম্প্রীতির উষ্ণতা প্রকাশ পেতো।
পরবর্তীকালে ইসলামী নেতৃত্ব যাতে অনুগমীদের প্রতি কোমল আচরণ করে সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. বলেছেন, ‘‘নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ওই ব্যক্তি, যে অধীন ব্যক্তিদের প্রতি কঠোর। সাবধান থাকবে যাতে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পড়।’’ (সহীহ আলবুখারীসহীহ মুসলিম)
আয়িশা রা. বলেন যে নবী সা. বলেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি কোমলতা ভালোবাসেন। তিনি কোমলতা দ্বারা ওই জিনিস দান করেন যা কঠোরতা দ্বারা দান করেন না।’’ (সহীহ মুসলিম)
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বকেও আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে উদারতা-ক্ষমাশীলতা-কোমলতাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের অনুগামীদের সাথে আচরণ করা উচিত। ইসলামী শারীয়ার বিধান লঙ্ঘন করার কারণে আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর কোন কোন অনুগামীকে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিদেরকেও তিনি গালমন্দ করেননি। তাদের সাথে অশোভন আচরণ করেননি।
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বকেও তাদের অনুগামীদের কারো কারো বিরুদ্ধে বিশেষ কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এতদসত্ত্বেও তাঁদের ব্যক্তিগত আচরণ বিন্দুমাত্র অভদ্রজনোচিত হবে না।
সংগঠনের সকল কর্মী একই মানের থাকে না। তাই সকলের কাজও একই মানের হয় না। মেধার পার্থক্য, বয়সের পার্থক্য, সুস্থতা-অসুস্থতা, সমস্যার স্বল্পতা কিংবা আধিক্য ইত্যাদি কারণে সকলের কাজের মান এক হবে না, হতে পারে না।
বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বকে অনুগামীদের ওপর বিশেষ বিশেষ কাজ চাপাতে হয়। কাজ চাপানোর আগে উপরোক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনা করে সঠিক ব্যক্তির ওপর সঠিক কাজ চাপানো উচিত। কাজ চাপানোর আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয় ভালোভাবে অবহিত হয়ে তবেই কাজ চাপানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
শূরা ইসলামী নেতৃত্বের নিরাপত্তা বেষ্টনী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নেতৃত্বকে নির্দেশ প্রদানের অধিকার দান করেছেন। নেতৃত্বের নির্দেশ পালন অনুগামীদের ওপর ফারয করেছেন। নেতৃত্ব কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যই অনুগামীদেরকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন। যদিও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ প্রদানের অধিকার নেতৃত্বকে দেয়া হয়েছে কিন্তু এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেতৃত্বকে দেয়া হয়নি। মহাবিজ্ঞ আল্লাহ বলেন,
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
‘‘তাদের কার্যাবলী পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়।’’ (সূরা আশ শূরাঃ ৩৮)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. ব্যক্তিগতভাবে খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। নবী হওয়ার পূর্বেই কা’বা সংস্কারের পর হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে সংস্থাপনের জন্য বিবাদমান গোত্রগুলোর বিবাদ তিনি যেইভাবে মীমাংসা করেছিলেন তাতে তাঁর অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে। কিন্তু এই বিচক্ষণ ব্যক্তিটির প্রতিও আল্লহর নির্দেশ ছিলো,
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
‘‘সামষ্টিক বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯)
যেই বিষয়ে আল্লাহ ওহী পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহকে সা. নির্দেশ দিতেন না, সেইসব বিষয়ে তিনি বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। বদর প্রান্তরে পৌঁছে একটি স্থান দেখিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর সাহাবীদেরকে তাঁবু স্থাপন করতে বলেন। যুদ্ধ বিশারদ সাহাবীগণ জানতে চান যে ওই স্থানে তাঁবু স্থাপনের জন্য তিনি কি আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট। রাসূলুল্লাহ সা. না সূচক জবাব দিলে তাঁরা অপর একটি স্থানের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলেন যে তাঁদের মতে যুদ্ধ কৌশলের দৃষ্টিতে ওই স্থানটিতে তাঁবু স্থাপন করলে ভালো হয়। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় স্থানটিতে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দেন।
উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে মাসজিদে নববীতে সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতে বসলেন আল্লাহর রাসূল সা.। বিবেচ্য বিষয় ছিলোঃ শহরে অবস্থান করে যুদ্ধ করা, না শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ সাহাবী শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করে আল্লাহর রাসূল সা. যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে উহুদ প্রান্তরে গিয়ে সৈন্য সমাবেশ করেন।
যেইসব সিদ্ধান্তের সাথে বহু সংখ্যক লোকের ভাগ্য জড়িত সেইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তাদের সকলের অথবা তাদের প্রতিনিধিদের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। আন্দোলনের জীবনে এমন সময়ও আসে যখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এমন সিদ্ধান্ত নেতৃত্ব যদি একা একা গ্রহণ করেন এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি জান ও মালের বিপুল ক্ষতি হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। ব্যর্থতার সব গ্লানি তাঁদের ঘাড়ে চাপানো চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যদি সকলের সাথে কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে গ্রহণ করা হয় তখন নেতৃত্বের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে না কেউ।
তাছাড়া এটা অনস্বীকার্য যে বহু সংখ্যক লোক বিভিন্ন দিক দেখে শুনে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলে সঠিক সিদ্ধানেরত উপনীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন মাত্র ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিলে তাঁর দ্বারা একটি বেঠিক সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার ডিকটেটরদের ইতিহাস তার সাক্ষী। দুনিয়াতে যেইসব ডিকটেটারের আবির্ভাব ঘটেছে তারা কিন্তু বোকা লোক ছিলো না। তাদের বহু সিদ্ধান্তই সঠিক ছিলো। কিন্তু একা একা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তারা কখনো কখনো এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যা একদিকে তাদের নিজের জন্য, অপরদিকে তাদের জাতির জন্য বড়ো রকমের অকল্যাণ ডেকে এনেছে। তারা ধিকৃত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। তাদের কারো কারো অপমৃত্যু ঘটেছে।
মহান আল্লাহর নির্দেশে ইসলামী নেতৃত্বকে শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই তাদেরকে ডিকটেটারদের করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয় না। সেই জন্যই বলছিলাম, শূরা ইসলামী নেতৃত্বের নিরাপত্তা বেষ্টনী।
বাগ্মিতা ইসলামী নেতৃত্বের শানিত হাতিয়ার
বক্তৃতা-ভাষণের যোগ্যতাই বাগ্মিতা। বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমেই নবী রাসূলগণ তাঁদের কাউমের নিকট ইসলামী জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পর্কিত বিভিন্ন কনসেপ্ট তুলে ধরেন। সকল নবীই ছিলেন সুবক্তা।
মূসা আ. ভালো বক্তা ছিলেন। কিন্তু তাঁর বড়ো ভাই হারুন আ. ছিলেন আরো বেশি ভালো বক্তা। আদদাওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ করার জন্য বক্তৃতা-ভাষণের পারদর্শিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর হারুণ আ. যেহেতু এই ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন সেহেতু মূসা আ. আল্লাহর নিকট আবেদন রাখেন যাতে হারুনকে আ. তাঁর সহযোগী বানিয়ে দেন।
وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي ۖ إِنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ
‘‘আর আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে বেশি বাগ্মিতা সম্পন্ন, তাকে আমার সাহায্যকারী হিসেবে পাঠান যাতে সে আমার সত্যতা প্রমাণ করতে পারে।’’ (সূরা আল কাছাছঃ ৩৪)
দাউদ আ. এর বাগ্মিতা সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেন,
‘‘আমি তার রাজত্বকে সুদৃঢ় করেছি, তাকে আল হিকমাহ দান করেছি। আর দিয়েছি চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করার যোগ্যতা।’’ (সূরা ছোয়াদঃ ২০)
অর্থাৎ দাউদের আ. কথা পেঁচানো ও অস্পষ্ট হতো না। তিনি কি বুঝাতে চান তা বুঝতে কারো কষ্ট হতো না। তিনি যেই বিষয়ে কথা বলতেন তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠতো। আর শ্রোতাদের অন্তর বলে ওঠতো এই বিষয়ে এটাই তো প্রকৃত কথা, এটাই তো চূড়ান্ত কথা।
এই গুণটি কেবল দাউদকে আ. দেয়া হয়েছিলো তা নয়, অন্যান্য নবী-রাসূলও এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহও সা. একজন সুবক্তা ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা দীর্ঘ হতো না। কিন্তু তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার মাঝেই ভাব ও তত্ত্বজ্ঞান থাকতো অনেক বেশি। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আমি সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক ভাব প্রকাশক বক্তৃতা ভাষণের যোগ্যতাসহ আবির্ভূত হয়েছি।’’
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. বিদায় হাজ্জে যেই ভাষণ দেন তা খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এই ভাষণের প্রতিটি বাক্যে যেই তাৎপর্য লুকিয়ে আছে তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বড়ো বড়ো গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সা. বক্তৃতার ভাষা ছিলো প্রাঞ্জল। শব্দগুলো ছিলো সহজ। ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি পুনরাবৃত্তি করতেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে বক্তব্য রাখতেন। তাঁর বক্তৃতা-ভাষণে আল-কুরআনের উদ্ধৃতি প্রাধান্য পেতো।
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বকেও বক্তৃতা-ভাষণে পারদর্শী হতে হবে। তাঁদেরকে আল-কুরআন এবং আল-হাদীসের জ্ঞান বক্তৃতা ভাষণের মাধ্যমেই অপরাপর মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। কিছু লোক বক্তৃতা-ভাষণের পারদর্শিতা সহজেই আয়ত্ত করতে পারেন। আবার কিছু লোককে তা আয়ত্ত করতে হয় খেটে খুটে। অর্থাৎ বক্তৃতা-ভাষণের প্রশিক্ষণ নিতে হয় তাদেরকে। দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছুকাল প্র্যাকটিস করলেই ভালো বক্তা হওয়া যায়।
আমানাতদারী ইসলামী নেতৃত্বের মর্যাদার গ্যারান্টি
আবদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস রা. বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের ওপর যা কিছু ফারয করেছেন তাই আমানাত। আর আল্লাহর আদেশ কিংবা নিষেধ অমান্য করাই আমানাতের খিয়ানত।’ আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, ‘ছালাত, অযু, গোসল, ক্রয়-বিক্রয়, দাঁড়িপাল্লা সবই আমানাত। আর গচ্ছিত সম্পদ হচ্ছে সবচে’ বড়ো আমানাত।’
নেতা নির্বাচন কালে যোগ্যতম ব্যক্তির পক্ষে নিজের ভোট প্রদান করা আমানাতদারীর দাবি।
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানাতের হকদারের হাতে তা সোফর্দ করতে।’’ (সূরা আন্‌ নিসাঃ ৫৮)
কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে নিঃসংকোচে নিজের অভিমত ব্যক্ত করা আমানাতদারীর দাবি। সঠিক ব্যক্তিদেরকে তালাশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা আমানাতদারীর দাবি। যেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুগামীগণ নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে সেই লক্ষ্যাভিসারী কর্মকাণ্ডে তাদেরকে নিয়োজিত রাখা আমানাতদারীর দাবি।
সংগঠনের টাকা-পয়সা, ফাইলপত্র, আসবাব ইত্যাদি ছোট বড়ো সকল সম্পদ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা এবং সংগঠনের লক্ষ্য হাসিলের জন্য ব্যয়-ব্যবহার করা আমানাতদারীর দাবি।
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘মুনাফিকের আলামত তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে কিছু আমানাত রাখলে তার খিয়ানত করে।’’ (সহীহুল বুখারীসহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যাঁর আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। যার ওয়াদা পালনে নেই তার দীনদারী নেই।’’ (আহমাদসহীহুল বুখারীআত্তাবারানী)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘মানুষের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যেই সদগুণটি তিরোহিত হবে তা হচ্ছে আমানতদারী।’’ ইসলামী নেতৃত্বকে আমানাতদারীর পূর্ণাঙ্গ কনসেপ্ট-এর সাথে পরিচিত হতে হবে। তাঁদেরকে সর্ববস্থায় আমানাতের হিফাযতের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আমানাতের খিয়ানতকারীকে কেউ পছন্দ করে না। তাকে কেউ শ্রদ্ধা করে না। তার কথায় কেউ আস্থা স্থাপন করে না। তাকে কেউ নির্ভরযোগ্য মনে করে না। তাকে কেউ মর্যাদাবান লোক গণ্য করে না।
পক্ষান্তরে আমানাতদার লোককে লোকেরা ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। তাকে নির্ভরযোগ্য গণ্য করে। তাকে মর্যাদাবান লোক বলে স্বীকার করে। এ থেকে প্রমানিত হয় যে আমানাতদারী গুণটি একজন ব্যক্তির মর্যাদার হিফাযতকারী হয়ে থাকে। তাই ইসলামী নেতৃত্বকে অবশ্যই সকল বিষয়ে আমানাতদার হতে হবে।
যোগ্য উত্তরসূরী সৃষ্টি ইসলামী নেতৃত্বের বড়ো সফলতা
কোন মানুষই দুনিয়ায় অমর নয়। আজ যাঁরা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরাও অমর নন। তাই আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য নেতৃত্ব তৈরী করে যাওয়া তাদের কর্তব্য। ইবরাহীম আ. দুনিয়ার বিশাল এলাকায় আল ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবার, আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবার জন্য তিনি ইসমাইল আ., ইসলাম আ. এবং লূতকে আ. তৈরী করে গেছেন।
মূসা আ. বানু ইসরাইলকে নিয়ে ট্রান্স জর্ডনের বিশাল এলাকায় ইসলামের প্রাধান্য পতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পরবর্তী মানযিল ছিলো ফিলিস্তিন। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর হাতে গড়া ইউশা বিন নূন এবং কালিব বানু ইসরাইলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফিলিস্তিনে এনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. ২৩ বছরের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মাদীনাকে কেন্দ্র করে গোটা জাযিরাতুল আরবে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার সাথে সাথে তিনি একদল লোকও গঠন করে যান। তাঁর ইন্তিকালের পর আবু বাকর আছ ছিদ্দিক রা., উমার ইবনুল খাত্তাব রা., উসমান ইবনু আফফান রা. এবং আলী ইবনু আবি তালিব রা. একে একে আমীরুল মুমিনীন হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
বর্তমানে যাঁরা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরকে এই বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বিষয়ের তালিকায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সংগঠনের জনশক্তিকে স্টাডি করে মৌলিক মানবীয় গুণসম্পন্ন লোক বাছাই করতে হবে।
সাধারণত পরিশ্রমপ্রিয়তা, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি, সূক্ষ্ণদৃষ্টি, প্রখর স্মৃতি শক্তি, প্রশস্তচিত্ততা, স্থির চিত্ততা, ভারসাম্যপূর্ণ মিজাজ, উদ্ভাবন শক্তি, বাগ্মিতা, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা প্রভৃতি গুণকে মৌলিক মানবীয় গুণ বলা হয়। ইসলামী আন্দোলনের জন্য শুধু মৌলিক মানবীয় গুণ যথেষ্ট নয়। এর সাথে সমন্বিত থাকতে হবে চিন্তার বিশুদ্ধতা এবং উন্নত নৈতিকতা। নেতৃত্বকে বাছাই করতে হবে মৌলিক মানবীয় গুণ, চিন্তার বিশুদ্ধতা এবং উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন ভারসাম্যপূর্ণভাবে অগ্রসরমান কিছু সংখ্যক কর্মী।
বাছাইকৃত ব্যক্তিদেরকে ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য, প্রকৃতি, নির্বাচন পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি, সংশোধন পদ্ধতি, সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা পদ্ধতি, পরিকল্পনা প্রণয়ন পদ্ধতি, রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ পদ্ধতি, হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদি শেখাতে হবে।
বাছাইকৃত কর্মীদেরকে বিশুদ্ধভাবে আল-কুরআন তিলাওয়াত, উন্নত মানের দারসুল কুরআন প্রদান এবং আকর্ষণীয় বক্তৃতা-ভাষণ প্রদানের পদ্ধতি শেখাতে হবে। তাদের জন্য বিভিন্নমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে তাদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপ করা এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেয়াও জরুরী। যতো বেশি সম্ভব তাদেরকে সাহচর্য দান করা উচিত।
এইভাবে যাদের পেছনে শ্রম দেয়া হবে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব তাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে।

যোগ্য সংগঠকের পরিচয়

কারো পক্ষে সংগঠন বনে যাওয়া কঠিন কিছু নয়, কিন্তু যোগ্য সংগঠক হওয়া সত্যি কঠিন। সংগঠনের কিছু রুটিন ওয়ার্ক সম্পন্ন করা খুবই সহজ, কিন্তু সংগঠনে প্রাণ-বন্যা সৃষ্টি করা মোটেই সহজ নয়।
সংগঠনের প্রাণ-বন্যা সৃষ্টি করা এবং তা অব্যাহত রাখা একজন যোগ্য সংগঠনের পক্ষেই সম্ভব। বহুমুখী কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে একজন যোগ্য সংগঠন তাঁর যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে যান। সংগঠনের সর্বত্র প্রাণচাঞ্চল্য এবং গতিশীলতা অব্যাহত রেখে সংগঠনটিতে উত্তরোত্তর অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম সংগঠকই যোগ্য সংগঠক।
একজন যোগ্য সংগঠন একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁর প্রতি কর্মী বাহিনী স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রদ্ধাবনত থাকে। আর এই শ্রদ্ধা কর্মীদের মনে বিনা কারণেই উৎসারিত হয় না। সংগঠকের উন্নত মানের সততা ও যোগ্যতাই তাঁকে কর্মীদের শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। কর্মীরা যদি সংগঠককে প্রাণভরে ভালোবাসতে পারে তাহলে তাঁর নির্দেশ পালনে তাদের মনে কোনরূপ দ্বিধা বা কুণ্ঠা থাকে না।
শ্রদ্ধাভাজন সংগঠককে কড়া নির্দেশ দিয়ে কর্মীদেরকে কাজে নামাবার প্রয়াস চালাতে হয় না। তাঁর ইঙ্গিত বা অনুরোধই কর্মীদেরকে কর্মচঞ্চল করার জন্য যথেষ্ট। একজন সংগঠক বিভিন্নমুখী যোগ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে যোগ্য সংগঠকের স্তরে উন্নীত হন। এখানে আমরা অতি সংক্ষেপে কিছু যোগ্যতার কথা আলোচনা করবো।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব
একজন সংগঠককে অবশ্যই জ্ঞানী ব্যক্তি হওয়া প্রয়োজন। আদর্শ, আন্দোলন ও সংগঠন সংক্রান্ত যেই কোন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেবার মতো জ্ঞানের ব্যপ্তি ও গভীরতা তাঁর থাকা চাই। বিরোধী মতবাদগুলোর বক্তব্য সম্পর্কেও তাঁকে থাকতে হবে ওয়াকিফহাল। সেইগুলোর ভ্রান্তি ও পূর্ণাঙ্গতা সম্পর্কেও তাঁর অবগতি থাকা প্রয়োজন।
উন্নত আমল
একজন আদর্শ সংগঠককে অবশ্যই আদর্শের মূর্ত প্রতীক হতে হবে। আদর্শের দৃষ্টিতে পালনীয় বিষয়গুলোর অনুশীলনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাই হবে তাঁর জীবনের প্রকৃত ভূষণ। তাঁর আমল হতে হবে অন্যদের জন্য অনুকরণযোগ্য।
সুন্দর ব্যবহার
একজন যোগ্য সংগঠকের ব্যবহার অবশ্যই সুন্দর হতে হবে। তিনি কখনো রুক্ষভাষী হবেন না। তাঁর আচরণ রূঢ় হবে না। বরং তাঁর আচরণ কর্মীদেরকে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিয়ে আসার মতো মধুর হওয়া চাই।
অগ্রণী ভূমিকা পালন
সংগঠনের কাজ আগ বাড়িয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অথবা কোন সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের ক্ষেত্রে সংগঠকেরেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। এইসব বিষয় নিয়ে তিনিই বেশি বেশি ভাববেন, তিনিই নতুন নতুন চিন্তা পেশ করবেন, নতুন নতুন কর্মকৌশল তিনিই উদ্ভাবন করবেন। এইভাবে চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্ব দেবেন। আবার বহির্মুখী কর্মকাণ্ডেও তিনিই ইনিশিয়েটিভ গ্রহণ করবেন। মোটকথা, চিন্তা ও কাজ উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর ভূমিকা হবে অগ্রণী ভূমিকা।
সাহসী ভূমিকা পালন
যেই সংগঠন সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী সেই সংগঠনকে প্রতিষ্ঠিত সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ভালো চোখে দেখবে- এটা স্বাভাবিক নয়। প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে যারা যুলুম ও শোষণ চালায় তারা যে এই সংগঠনের অগ্রগতি দেখে আঁতকে ওঠে শুধু তাই নয়, বরং এই সংগঠনের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেবার জন্য নানা ধরণের সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সওয়ার হয়ে বহুবিধ নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায়। ফলে সংগঠন নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এই ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতে সংগঠককে শক্তভাবে সংগঠনের হাল ধরে থাকতে হয়। একজন যোগ্য সংগঠকের চেহারা ও কর্মকাণ্ডে এমন পরিস্থিতিতেও ভীতির চিহ্ন ফুটে ওঠবে না। তাঁর এই সাহসী ভূমিকাই কর্মীদেরকে সাহসী করে তুলবে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মুকাবিলা করে সামনে এগুবার হিম্মত যোগাবে।
সঠিক মানের কর্মী গঠন
সংগঠনের সঠিক মানের কর্মী তো তারাই যারা এর আদর্শ ও আন্দোলনকে সঠিকভাবে বুঝেছে, সংগঠনের লক্ষ্য ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে, এর কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি বুঝে শুনে গ্রহণ করেছে, এর নির্বাচন পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি, সমালোচনা পদ্ধতি, কর্মী গঠন পদ্ধতি ইত্যাদি ভালোভাবে বুঝেছে এবং শুধু জানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থেকে তারা তাদের জ্ঞান অনুযায়ী বাস্তব ময়দানে ভূমিকাও পালন করে চলছে।
এই মানে কর্মীদের গড়ে তোলার জন্য সংগঠক সাংগঠনিক প্রক্রিয়াগুলোর ওপর তো নির্ভর করবেনই, তদুপরি তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই বিষয়ের দিকে কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।
ব্যক্তিগত সাক্ষাত ও আলাপের মাধ্যমে জ্ঞানের মান ও কর্মতৎপরতার মান ভালোভাবে আঁচ করে পরামর্শ দেবেন। এইভাবে কর্মীদের সঠিক মানে উন্নীত করার নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হয় সংগঠককে।
সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ
কোন সংগঠনের পরিকল্পনা তৈরী হয় সেই সংগঠনের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য। অর্থাৎ পরিকল্পনার ভিত্তি হচ্ছে সংগঠনের স্থায়ী কর্মসূচী। বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব সংগঠককেই পালন করতে হয়। তার পর সেটি সংশ্লিষ্ট ফোরামে পেশ করতে হয় অনুমোদনের জন্য।
পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় কর্মী সংখ্যা, কর্মীদের মান, সংগঠনের আর্থিক সংগতি, শুভাকাঙ্ক্ষীদের আর্থিক সহযোগিতার সম্ভাবনা, সংগঠনের প্রভাব বলয়, পরিবেশ-পরিস্থিতি, বৈরী শক্তিগুলোর শক্তি ও কর্মকৌশল, সামগ্রিকভাবে সমাজ পরিবেশ, সংগঠনের তৎপরতার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া, সংগঠনের কর্মধারা নির্ধারণে বর্তমান সময়ের দাবি ইত্যাদি সামনে রাখতে হয়। পরিকল্পনা প্রণয়ন কালে এই বিষয়গুলো সামনে না রাখলে পরিকল্পনা একপেশে হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। আর সবগুলো দিক বিবেচনা করে পরিকল্পনা রচিত হলে তা বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। একটি বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়নের যোগ্যতা একজন সংগঠনের খুবই বড়ো একটি যোগ্যতা।
জরুরী পরিস্থিতিতে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ
সংগঠনের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় অশান্ত ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি সংগঠনের স্বাভাবিক গতিধারা দারুণভাবে প্রভাবিত করে। আবার এমন পরিস্থিতিরও উদ্ভব হতে পারে যা সংগঠনের জন্য বিপজ্জনক। এই ধরণের পরিস্থিতি স্থায়ী কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা দ্বারা মুকাবিলা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এই ধরণের পরিস্থিতির উদ্ভব হলেই সংগঠনকে জরুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে সংগঠকের কর্তব্য হচ্ছে, উদ্ভূত পরিস্থিতির ত্বরিত মূল্যায়নের পর ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জনশক্তিকে তা যথাশীঘ্র জানিয়ে দেয়। জরুরী পরিস্থিতিতে অবিলম্বে করণীয় নির্ধারণ করার যোগ্যতাও সংগঠকের অতি বড়ো একটি যোগ্যতা।
পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
কোন বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক বিজ্ঞ লোক ব্যাপক আলোচনার পর কোন সিদ্ধান্ত নিলে এতে ভুলের আশংকা কম থাকে। তাই একজন বিজ্ঞ সংগঠক কখনো একা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না।
যতো বেশী সম্ভব লোকদের মতামত যাচাই করে তিনি করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংগঠকের জন্য একটি রক্ষাকবচ। একজন যোগ্য সংগঠন তা কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না।
১০পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মী পরিচালনা
সংগঠক কেবল পরিকল্পনা গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হবেন না। তিনি গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গোটা কর্মী বাহিনীকে কাজে লাগাবেন। এই জন্য তিনি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত কাজগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে কর্মীদেরকে ওয়াকিফহাল করে তুলবেন, প্রত্যেকের করণীয় বিষয়গুলো চিহ্নিত করে দেবেন এবং তা আঞ্জাব দেয়ার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবেন। কর্মীদেরকে ভালোভাবে পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া এবং পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য তাদেরকে পাগলপারা করে তুলতে পারা সংগঠকের একটি বড়ো কৃতিত্ব।
১১সঠিক ব্যক্তিদের বাছাই করে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক ধরণের কাজ রয়েছে। সেইগুলো এক ব্যক্তির পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই সংগঠককে একটি টিম গড়ে তুলতে হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর অর্পণ করতে হয় বিভিন্ন বিভাগের কাজ। বিভিন্ন কাজের জন্য লোক বাছাই করার ক্ষেত্রে সংগঠককে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। সঠিক মিজাজ ও সঠিক মানের লোক বাছাই না হলে ম্যাল এডজাস্টমেন্ট সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। অথচ কাউকে কোন পদে নিযুক্ত করা যতো সহজ, পদচ্যুত করা ততোখানি সহজ নয়। অপসারণকে সহজে মেনে নেয়ার মতো বাহাদুর ব্যক্তি কমই দেখা যায়। ফলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাই নিযুক্তির আগেই সংগঠককে বারবার ভাবতে হবে, ব্যক্তি চয়নের যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হতে হবে। ভেবে চিন্তে, জেনে শুনে এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য রেখে লোক নিয়োগ করা একজন বিচক্ষণ সংগঠকের একটি বিশেষ যোগ্যতা।
১২সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ
সংগঠনের সুগঠিত কার্যক্রম ক্রমশঃ শিকড় পর্যায়ে (গ্রাসরুট লেভেল) নিয়ে যাবার অবিরাম প্রচেষ্টা চালাবেন সংগঠক। অধস্তন স্তরে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা সম্পন্ন লোক হলেই তিনি সেই স্তরে সংগঠন সম্প্রসারিত করে নেবেন। এইভাবে একটি নেটওয়ার্ক নিম্নতম পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। সঠিকমান সংরক্ষণ করে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে শিকড় পর্যায়ে সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটানো যোগ্য সংগঠকের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব।
১৩কাজের তত্ত্বাবধান
কাজের পরিকল্পনা তৈরী করে তা কর্মীদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার পর একজন যোগ্য সংগঠন নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকবেন না। তিনি নানাভাবে জনশক্তির কর্মতৎপরতার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। বিশেষভাবে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজের খোঁজ খবর নেবেন। কাজের ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সেইদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। এইভাবে কাজের তত্ত্বাবধান করাকে একজন যোগ্য সংগঠক তাঁর নিত্যকর্মের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করবেন।
১৪প্রেরণাদায়ক বক্তৃতাভাষণ
একজন যোগ্য সংগঠককে অবশ্যই সুবক্তা হতে হবে। বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমেই তিনি আদর্শের বিভিন্ন দিক, আন্দোলনের গুরুত্ব এবং সংগঠনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য জনসমষ্টির সামনে তুলে ধরবেন। তাঁর বক্তৃতার ভাষা হতে হবে সহজবোধ্য। এতে থাকতে হবে বলিষ্ঠতা এবং কর্মীদের উদ্দীপিত করার ক্ষমতা। আকর্ষণীয় ও প্রেরণাদায়ক বক্তৃতা দানের যোগ্যতাও একটি বড়ো রকমের যোগ্যতা।
১৫স্থানকালপাত্র বিবেচনা করে বক্তব্য পেশ
একজন যোগ্য সংগঠক বক্তব্য পেশ করার আগে ভালোভাবে ভেবে দেখবেন যে যেইস্থানে তিনি কথা বলছেন সেইস্থানে কোন্‌ কথাগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত, তিনি যেই কথাগুলো বলছেন সেইগুলো সময়োপযোগী কিনা এবং তিনি যাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলছেন তাদের সমঝ শক্তি, ধারণ শক্তি কতখানি। শোতাদের বয়স, শিক্ষার মান, সাংগঠনিক জীবনের বয়স ইত্যাদি বিষয়ের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। একজন বিচক্ষণ সংগঠক কখনো স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করে বক্তব্য রাখেন না।
১৬সাংগঠনিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ
প্রত্যেকটি সংগঠনেরই নিজস্ব কিছু আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম থাকে। সংগঠনের স্বকীয়তা সংরক্ষণের প্রয়োজনেই এইসব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন। যেমন ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা, সাংগঠনিক মিটিং করা এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী অনুষ্ঠান। আবার প্রত্যেকটি সংগঠনেরই নিজস্ব কর্মনীতি, কর্মসূচী, কর্মপদ্ধতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি ইত্যাদি থাকে। সংগঠনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের তাকিদেই এইগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে সবসময় সজাগ থাকা সংগঠকের কাজ। নতুনভাবে যারা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তাদের সামনেও এই বৈশিষ্ট্যগুলোর গুরুত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরা এবং তাদেরকে এইগুলোর নিশানবরদাররূপে গড়ে তোলা সংগঠকের অন্যতম কর্তব্য।
১৭আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
একটি সংগঠনের থাকে নানামুখী কাজ। এইসব কাজ সুসম্পন্ন করতে হলে অনেক অর্থের প্রয়োজন। সংগঠনের জনশক্তিকে অধিক পরিমাণে আর্থিক কুরবানী করতে উদ্বুদ্ধ করবেন সংগঠক। শুধু সংগঠনের কর্মীদের অর্থদানের ওপর নির্ভর না করে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে বিভিন্ন কাজের প্রকল্প পেশ করে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সংগঠকেরই কাজ। সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিদের সাথে সংগঠকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। সংগঠনের আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে একজন আদর্শ সংগঠক ব্যক্তিগতভাবেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
১৮শৃঙ্খলা সংরক্ষণ
শক্তিশালী সংগঠন মানেই সুশৃঙ্খল সংগঠন। আর শৃঙ্খলার মূল উৎপাদন হচ্ছে আনুগত্য। আনুগত্য সম্পর্কে আল-কুরআন এবং আল-হাদীস যেইসব পথ নির্দেশ পেশ করেছে সেইগুলো সম্পর্কে কর্মী বাহিনীকে ওয়াকিফহাল করে তোলা এবং এই বিষয়ে কর্মীদেরকে সদাজাগ্রত রাখা সংগঠকেরই কাজ।
আনুগত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্যই সংগঠনে থাকে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান। গঠনতন্ত্র সঠিকভাবে মেনে চলার ক্ষেত্রে কোন কর্মীর শৈথিল্য প্রকাশ পেলে অবিলম্বে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে এবং তাকে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পর্যাপ্ত প্রচেষ্টার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংশোধিত না হলে তার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।
গঠনতন্ত্রের আনুগত্য করে না এমন ব্যক্তির প্রতি নমনীয় আচরণ করা হলে আনুগত্যহীনতাকেই উৎসাহিত করা হবে। এতে করে আনুগত্যহীনতার ব্যাধি সংক্রমিত হয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করার আশংকা রয়েছে। তাতে সংগঠনের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে বাধ্য। তাই সংশোধনের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালানোর পর সংগঠনের স্বার্থেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে একজন যোগ্য সংগঠক কুণ্ঠিত হবেন না।
১৯কর্মীদের বিভিন্নমুখী প্রতিভা বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ
সংগঠনের কর্মীরা এক ধরণের কাঁচামাল। এদের মাঝে সুপ্ত থাকে অনেক সম্ভাবনা। কর্মীদেরকে ভালো সংগঠক, ভালো লেখক, ভালো বক্তা, ভালো সমাজকর্মী এবং ভালো জননেতারূপে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। তাছাড়া বিভিন্ন টেকনিকেল প্রশিক্ষণও যেমন, কম্পিউটার পরিচালনা, মোটর ড্রাইভিং ইত্যাদি তাদেরকে দেবার সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। আধুনিক সমাজের এই ধরণের টেকনিকেল প্রশিক্ষণ কর্মীদেরকে ব্যাপকতর দক্ষতার অধিকারী করে তোলে। কর্মীদের নানামুখী প্রতিভা বিকাশের কর্মকৌশল উদ্ভাবন করা সংগঠকেরই কাজ।
২০সুদূর প্রসারী চিন্তা নিয়ে প্রতিভাবান কর্মীদের ব্যবহার
প্রতিভাবান কর্মীরা সংগঠনের নিকট আল্লাহর এক অতি মূল্যবান আমানাত। এদের সঠিক ব্যবহার আমানাতদারীরই দাবি। এদের সঠিক ব্যবহার না হওয়া আমানতদারীর খেলাফ কাজ।
সংগঠক ভালোভাবে কর্মীদের স্টাডি করবেন। কারা ময়দানের কাজে বেশি উপযুক্ত হবে তা বুঝে তাদেরকে চিহ্নিত করবেন। একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার জন্য উন্নত মানের রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, আইনবিদ, সাহিত্যিক, কূটনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ইত্যাদি প্রয়োজন। একজন সংগঠককে বুঝতে হবে তাঁর কর্মী বাহিনীর প্রতিভাবান ব্যক্তিদের কে কোন্‌ ময়দানের জন্য বেশি উপযুক্ত। যারা যেই ময়দানের উপযুক্ত তাদেরকে সেই ময়দানে বিশেষজ্ঞ হবার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। একজন বিজ্ঞ সংগঠকই কেবল এই লক্ষ্যে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেন।
২১কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করে দ্রুত অগ্রসরমান কর্মীদের বাছাইকরণ
আপন দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে পরিকল্পনার আলোকে ময়দানে কাজ করতে থাকলেও কর্মীদের সকলের কাজের মান এক হয় না। দেখা যাবে কোন কোন কর্মী যেনযেতনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। আবার কোন কোন কর্মী কাজ করছে খুবই সুন্দরভাবে।
সুন্দরভাবে যারা কাজ করছে তাদের মাঝেও দু’ধরণের কর্মী দেখা যায়। এদের একাংশ কাজটা তো সুন্দরভাবে করছে, তবে সময় নিচ্ছে বেশী। অপরাংশ কাজটা সুন্দরভাবে করতে গিয়েও বেশি সময় নিচ্ছে না। বুঝতে হবে, এরা অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি। এদের দ্বারা বেশি পরিমাণে কাজ করিয়ে নেয়া সম্ভব।
কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করলে আরো দেখা যাবে যে কর্মীদের অনেকেই ভালো কর্মী বটে, তবে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা তাদের নেই। আবার অনেকের এমন আছে যারা নিজেও ভালোভাবে কাজ সম্পাদন করে, তদুপরি অন্যকে দিয়েও কাজ করিয়ে নেয়ার যোগ্যতা রাখে। বুঝতে হবে, নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা এদের মাঝে রয়েছে।
যোগ্য সংগঠকের কাজ হচ্ছে কর্মীদের মধ্য থেকে যাদের সমঝ শক্তি ও কর্মশক্তি বেশি তাদেরকে আলাদা তালিকাভুক্ত করে নেয়া।
২২বাছাই করা কর্মীদের ব্যাপকতর প্রশিক্ষণ
সম্ভাবনাময় কর্মীদের তালিকা তৈরী করাই যথেষ্ট নয়। এদের জন্য ব্যাপকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আদর্শ, আন্দোলন ও সংগঠনের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কেও তাদেরকে ওয়াকিফহাল করে তুলতে হবে। আদর্শ, আন্দোলন ও সংগঠনের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করার যেগ্যতা তাদের মাঝে বিকশিত করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দিতে পারেন একজন দূর দৃষ্টি সম্পন্ন সংগঠক।
২৩পারস্পরিক সুসম্পর্ক সৃষ্টি
কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে না উঠলে কোন সংগঠনকে শক্তিধর সংগঠন বলা চলে না। ইসলামী সংগঠনের কর্মীদেরকে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো মজবুত হতে হবে, এটাই আল্লাহর দাবি। এর অর্থ হচ্ছে, এই সংগঠনের কর্মীগণ একে অপরের প্রতি গভীর মমত্তবোধ অনুভব করবে, একে অপরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিপক্ষের মুকাবিলা করবে।
এই ধরণের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কর্মীদের মাঝে এক বিশেষ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ হওয়া প্রয়োজন। একে অপরের ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা, একে অপরের দোষের চেয়ে গুণের দিকে বেশি তাকানো, কোন অবস্থাতেই একে অপরের প্রতি রুষ্ট না হওয়া এবং একে অপরের গীবাত না করা- পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বুনিয়াদ। এই বুনিয়াদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয় সংগঠককেই।
২৪নিষ্ক্রিয়তার প্রতিকার
কোন কারণে মনে খটকা সৃষ্টি হওয়া, কারো আচরণে রুষ্ট হওয়া, কোন প্রপাগাণ্ডায় প্রভাবিত হওয়া, পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ভীত হওয়া, কোন অবাঞ্ছিত ঘটনায় ব্যথিত হওয়া, নিজের জীবনে কোন অপরাধ ঘটে যাওয়া, ব্যক্তিগত জীবনে কোন বড়ো রকমের সমস্যা সৃষ্টি হওয়া- এই ধরণের কোন কারণে একজন কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। সংগঠক কোন কর্মীর এমন অবস্থার কথা জানতে পেলেই শিগগির তার সাথে দেখা ও আলাপ করে আসল কারণটি চিহ্নিত করবেন এবং আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে বক্তব্য রেখে তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাবেন।
২৫স্থবিরতার প্রতিরোধ
সংগঠনের কোন স্তরে স্থবিরতা আসতে পারে নানা কারণে।
সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে সংগঠকের অপরাগতা, কর্মী সভাগুলোতে প্রাণবন্ত ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পরিবেশিত না হওয়া, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের রূঢ় আচরণ, দুশমনদের পরিচালিত উৎপীড়নে ধৈর্যচ্যুতি- এই ধরণের নানা কারণে একই সময় বেশি সংখ্যক কর্মী কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেললে সংগঠন বা সংগঠনের অংশ বিশেষ স্থবিরতার শিকার হয়। এতে করে সংগঠন বেঁচে থাকলেও অগ্রগতি থেমে যায়।
সংগঠনে এমন কোন অবস্থার সূত্রপাত হচ্ছে কিনা যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্থবিরতা, সেই সম্পর্কে সংগঠককে সদা সচেতন থাকতে হবে। এই ধরণের কোন কিছুর লক্ষণ প্রকাশ পেলেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। সংগঠনের যাবতীয় অনুষ্ঠান এবং বক্তব্য যাতে আকর্ষণীয় হয় তা নিশ্চিত করা যোগ্য সংগঠকেরই কাজ।
২৬বিভিন্ন কাজের ভারসাম্য সংরক্ষণ
সংগঠনের আদর্শিক কনসেপ্টগুলো সাধারণের কাছে ছড়িয়ে দেবার কাজ, সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটানোর কাজ, জনশক্তির মানোন্নয়নের কাজ, সমাজ সেবা ও সংস্কারমূলক কাজ, সংগঠনের গণ ভিত্তি রচনার কাজ, জনগণের নেতৃত্ব দানের কাজ- এই ধরণের বহুমুখী কাজ একটি সংগঠনকে আঞ্জাম দিতে হয়। এই কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য পুরো জনশক্তিকে মাঠে ময়দানে নিয়োজিত করতে হয়। সংগঠক লক্ষ্য রাখবেন যাতে এক প্রকারের কাজের আধিক্য অপরাপর কাজগুলোকে গুরুত্বহীন না করে ফেলে। কোন এক সময় কোন এক ধরণের কাজ বেশি গুরুত্ব পেয়ে যাওয়াতে অপর কোন একটি কাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে দেখলে পরবর্তী সময়ে সেই কাজটির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সামগ্রিকভাবে কাজের ভারসাম্য রক্ষা করা একজন সুযোগ্য সংগঠকের পক্ষেই সম্ভব।
২৭আমানাত সংরক্ষণ
একটি সংগঠনের থাকে তহবিল। থাকে অনেক আসবাব-পত্র, অফিস ভবন ইত্যাদি। এইগুলো সংগঠনের পক্ষ থেকে সংগঠকের কাছে গচ্ছিত থাকে। এইগুলো সংগঠনের পক্ষ থেকে সংগঠকের কাছে গচ্ছিত থাকে। এইগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষন এবং সঠিক ব্যয়-ব্যবহারেরই নাম আমানাতদারী। সংগঠক কোন অবস্থাতেই সংগঠনের অর্থ ও সম্পদ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খরচ করে ফেলবেন না। সংগঠনের অর্থ বা সম্পদ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয়-ব্যবহার করলে একজন সংগঠক কিছুতেই কর্মীদের শ্রদ্ধাভাজন থাকতে পারেন না। একজন যোগ্য সংগঠক আমানাত সংরক্ষণে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করে থাকেন।
২৮সঠিকভাবে রেকর্ড পত্র সংরক্ষণ
একটি সংগঠনের অনেক জরুরী কাগজপত্র, ফাইল ও রেজিষ্টার থাকে। এইগুলোকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরী। প্রত্যেকটি বিষয় সংক্রান্ত স্বতন্ত্র ফাইল, প্রত্যেকটি ফাইলে নির্দিষ্ট নাম্বার এবং ফাইলগুলোর একটি ইনডেক্‌স থাকা প্রয়োজন।
ফাইলগুলো নির্দিষ্ট এবং নিরাপদ স্থানে সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ এইগুলো নাড়াচাড়া না করতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রতিটি কাগজ সঠিক ফাইলে যায়, অন্য ফাইলে নয়।
এইভাবে ফাইল মেনটেইন করা হলে কাগজপত্র সঠিকভাবে হিফাযত হয়। আর প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বিনা মেহনতে এবং সময় খরচ না করে বের করা সম্ভব হয়। সুবিন্যস্তভাবে রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ করাটাও একজন সুযোগ্য সংগঠকের অন্যতম বিশেষ গুণ।
২৯সঠিকভাবে হিসাব সংরক্ষণ
সংগঠনের প্রয়োজনে সংগঠকই প্রধানতঃ অর্থ ব্যয় করে থাকনে। ক্যাশিয়ার বা বাইতুলমাল বিভাগের সচিব তহবিল সংরক্ষণ করে। সে নিজের সিদ্ধান্তে তহবিলের অর্থ ব্যয় করার অধিকারী নয়। অর্থ ব্যয়ের নির্দেশ আসবে সংগঠকের কাছ থেকে। সেই নির্দেশ লিখিতভাবে আসাই উত্তম। সেই নির্দেশ মুতাবিক ক্যশিয়ার তার কাস্টোডি থেকে অর্থ হস্তান্তর করবে লিখিত ভাউচারের বিনিময়ে। সংগঠনের তহবিলে কোন অর্থ আসবে না রসিদে এন্ট্রি না হয়ে। তেমনি ভাউচার ছাড়া কোন অর্থ ব্যয় হবে না। ক্যাশিয়ার অর্থ ব্যয়ের একটি টালি সংরক্ষণ করবে। আর একাউনট্যান্ট ক্যাশ বই, লেজার বই এবং ষ্টেটমেন্ট অব একাউন্টস ক্রমাগতভাবে লিখে যেতে থাকবে আধুনিক হিসাব রক্ষণ পদ্ধতির চাহিদা পূরণ করে। একই ব্যক্তি অর্থ আদায় করা, অর্থ ব্যয় করা এবং আয় ব্যয়ের হিসাব রাখা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে হিসাব সংরক্ষণে গোলমাল দেখা দিতে বাধ্য।
একজন বিজ্ঞ সংগঠক কিছুতেই এই গোলমালে পড়ে নিজের ইমেজ বিনষ্ট করতে তৈরী হতে পারেন না। তাই তাঁকে দেখা যাবে এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন।
৩০বৈরী শক্তিগুলোর মুকাবিলার জন্য বিজ্ঞানসম্মত পন্থা উদ্ভাবন
বৈরী সংগঠনগুলো ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের চরিত্র হনন এবং সংগঠন সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে থাকে।
এই প্রচার যে মিথ্যাশ্রয়ী তা সঠিকভাবে জনগণকে জানিয়ে দেয়ার পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে সংগঠককে। ইতিহাস সাক্ষী, বৈরী শক্তিগুলো যখন দেখে যে তাদের মিথ্যা প্রচারণাও শেষ রক্ষা করতে পারছে না তখন তারা ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের ওপর দৈহিক হামলা চালাতে শুরু করে।
এমতাবস্থায় সঠিক কর্ম কৌশল উদ্ভাবন করা সংগঠকেরই দায়িত্ব।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সাধারণতঃ যুলম বিরোধী। সেই কারণে মাযলুমের প্রতি তাঁরা থাকে সহানুভূতিশীল। যালিমদেরকে চিহ্নিত করে তাদের ঘৃণ্য তৎপরতা উন্মুক্ত করে পেশ করতে হবে জনগণের কাছে। যালিমদের যুলমের কাহিনী বা বিবরণ সঠিকভাবে জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারলে বিবেকবান জনগণ তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হবে। এইভাবে যালিমগণ হবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। মনে রাখা দরকার যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন যালিমদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না। জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে শেষাবধি তা ভণ্ডুল হয়ে যায়।
কি কি পন্থায় যালিমদেরকে এক্সপোজ করে জনগণের সহানুভূতি ও সহযোগিতা অর্জন করা যায় তা নির্ণয় করে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করা একজন যোগ্য সংগঠকের কাজ।
৩১গণভিত্তি রচনা
যেহেতু এই যুগে দুনিয়ায় সামগ্রিকভাবে ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারাই প্রায় সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত, সেহেতু দুনিয়ার কোন অঞ্চলে ইসলামী বিপ্লব ঘটাতে হলে, সেই ভূ-খণ্ডের জনগণের নীরব সমর্থন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন তাদের সক্রিয় সমর্থনের।
কোন ভূ-খণ্ডের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তখনই ইসলামী সংগঠনের সক্রিয় সমর্থকে পরিণত হতে পারে যখন তারা উপলব্ধি করবে যে এই সংগঠন যা বলছে তা তাদের মনেরই কথা, এই সংগঠন যা করতে চায় তা করা গেলে তাদেরই কল্যাণ হবে এবং এই সংগঠনের দেখানো পথই সমস্যা সমাধানের একমাত্র নির্ভুল পথ।
এই উপলব্ধির পরও জনগণ সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য এগিয়ে আসবে না, এটা স্বাভাবিক নয়। নিজেদের মঙ্গলের পথ নির্ভুলভাবে চিনতে পারার পরও তারা এই পথের পথিকদেরকে আপন ভাববে না বা তাদের সাথে একাত্ম হবে না, এটা হতে পারে না। এমতাবস্থায় তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই সংগঠনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াবে।
এমন একটি অবস্থা সৃষ্টির নামই গণ ভিত্তি রচনা। কিভাবে এই অবস্থা সৃষ্টি করা যায় তা নির্ণয় ও কার্যকর করা যোগ্য সংগঠকেরই কাজ।
৩২অধঃস্তন ব্যক্তি  অধঃস্তন সংগঠন থেকে কাজের রিপোর্ট আদায়
অধঃস্তন ব্যক্তি ও অধঃস্তন সংগঠনের ওপর অর্পিত স্থায়ী বা কোন সাময়িক কাজের রিপোর্ট আদায় করবেন সংগঠক। তাঁকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনের কাজের রিপোর্ট তাঁর হাতে এলো কিনা। যদি কোথাও থেকে সঠিক সময়ে রিপোর্ট এসে পৌঁছে না থাকে তাহলে সংগে সংগে রিমাইন্ডার দিতে হবে। প্রথম রিমাইন্ডারের পর পর রিপোর্ট না এলে আবারো রিমাইন্ডার দিতে হবে। অর্থাৎ রিপোর্ট তাঁকে আদায় করতেই হবে।
৩৩রিপোর্টের আলোকে কাজের পর্যালোচনা
অধঃস্তন সংগঠন থেকে রিপোর্ট আদায় তখনই অর্থবহ হতে পারে যখন সংগঠক আদায়কৃত রিপোর্ট পড়বেন, কাজের অগ্রগতি বা অধোগতি নির্ণয় করবেন এবং সেই মুতাবিক অধঃস্তন সংগঠনকে লিখিত পর্যালেচনা ও পরামর্শ পাঠাবোন।
নিয়মিতভাবে কাজের এরূপ মূল্যায়ন হতে থাকলে অধঃস্তন সংগঠন উপকৃত হয় এবং সহজেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ এইভাবে রিপোর্ট পর্যালোচনার মাধ্যমে সংগঠক অধঃস্তন ব্যক্তি বা সংগঠনের কাজ উন্নততর করার ক্ষেত্রে বিশেষ সহযোগিতা প্রদান করতে পারেন।
৩৪কুণ্ঠাহীন জবাবদিহি
জবাবদিহি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যিনি কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য নিযুক্ত হন, তাঁকে নিয়োগকারী ব্যক্তিদের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। দুনিয়ার সর্বত্রই এই নিয়ম প্রচলিত রয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে এই পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কতিপয় কর্তব্য পালনের জন্য প্রেরণ করেছেন। এই কর্তব্য পালন সম্পর্কে তিনি এক নির্দিষ্ট দিনে সকল মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলেও জানিয়েছেন। অর্থাৎ সেইদিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কৃত কর্মের জন্য আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে।
কোন সংগঠনের সংগঠক নিরংকুশ স্বাধীন কোন ব্যক্তিত্ব নন। যারা তাঁকে নির্বাচিত বা নিযুক্ত করেছে তিনি তাদের প্রশ্নের জবাব দান এবং তাঁর দায়িত্ব পালন ও অর্থ-সম্পদ ব্যয়-ব্যবহার সম্পর্কে তাঁদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য। একজন আদর্শ সংগঠক কুণ্ঠাহীনতাকেই এই জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত থাকেন।
আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান সংগঠক। কিন্তু কোন সংগঠকই অমর নন। তদুপরি জীবদ্দশাতেও একজন সংগঠকের স্থানান্তরিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তাঁর স্থানান্তরিত হওয়া অথবা ইনতিকালের পর যদি শূণ্য স্থান পূর্ণ করার মতো যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া না যায় তা সংগঠনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনে। সংগঠন যাতে এই ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন না হয় তার জন্য সংগঠককে পূর্বাহ্নেই পরিকল্পিতভঅবে বিকল্প নেতৃত্বের একটি গ্রুপ তৈরী করতে হয়। এই ক্ষেত্রে বিশ্ব নবী মুহাম্মাদ সা. তো অনন্য উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন। তিনি নেতৃত্ব দেবার মতো যোগ্য বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গড়ে তুলেছিলেন যাঁরা তাঁর ইনতিকালের পর একের পর এক সফলভাবে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।
নিঃসন্দেহে যোগ্য উত্তরসূরী সৃষ্টি একজন সংগঠকের অতি বড়ো একটি কৃতিত্ব।

কর্মীদের প্রতি নেতৃত্বের আচরণ

নেতৃত্ব এবং কর্মীদের মিলিত প্রয়াসের ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলনের কাজ সামনে এগুতে থাকে। নেতৃত্ব এবং কর্মীদের মাঝে সুসম্পর্ক থাকলে কাজ স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে অগ্রসর হয়। এই সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত মানে না থাকলে কাজের গতি স্বচ্ছন্দ থাকে না বরং মাঝে মধ্যেই এর গতি ব্যাহত হয়। এইভাবে হোঁচট খেতে খেতে এক পর্যায়ে এসে কাজের গতি একেবারে মণ্থর হয়ে পড়ে।
কাজের সুন্দর ও স্বাভাবিক অগ্রগতির জন্য নেতৃত্ব এবং কর্মীদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর এই সুসম্পর্ক নির্ভর করে একের প্রতি অপরের বাঞ্ছিত আচরণের ওপর। এই নিবন্ধে আমরা কর্মীদের প্রতি নেতৃত্বের কাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
নেতৃত্ব হবেন কর্মীদের জন্য প্রেরণোর উৎস
একটি আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদেরকে নানামুখী কাজ-কর্ম করতে হয়। এইসব কাজ যেমনি দাবি করে সময়, তেমনি পরিশ্রম।
আবার আদর্শিক আন্দোলনের পথ মোটেই ফুলবিছানো নয়। এই পথে আছে নানা বাধা-বিপত্তি। তদুপরি কর্মীদের অনেকেরই বড়ো বড়ো ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে যা তাদেরকে হতোদ্যম করে ফেলতে পারে।
যাবতীয় কাঠিন্য বরদাশত এবং সমস্যা ও বাধা উপেক্ষা করে আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাবার মন-মানসিকতা সজীব রাখার জন্য নেতৃত্বকে ভূমিকা পালন করতে হয়। আদর্শিক জ্ঞান বিতরণ, সদালাপ, অমায়িক ব্যবহার এবং উন্নত চরিত্রের প্রভাব দ্বারাই কেবল নেতৃত্ব এই ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারেন।
নেতৃত্ব বিনম্র ভাষায় নির্দেশ দেবেন
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই ইসলামী সংগঠনের কর্মীদের ওপর নেতৃত্বের নির্দেশ পালনকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। আল্লাহর এই বিধান সম্পর্কে অবহিত প্রত্যেক কর্মী স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নেতৃত্বের নির্দেশ পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
নেতৃত্ব কর্মীদেরকে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ অবশ্যই দেবেন। তবে নির্দেশ প্রদানের ভাব-ভঙ্গি ও ভাষা মোটেই রুক্ষ হওয়া উচিত নয়। কোন অবস্থাতেই ভদ্রতার সীমারেখা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। নেতৃত্ব কোন একটি কাজ সম্পন্ন হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরবেন। প্রয়োজনে নেতৃত্ব বার বার কাজ বা বিষয়টির দিকে কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। তিনি বা তাঁরা বলিষ্ঠভাবে তাঁর বা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরবেন। কিন্তু নেতৃত্বকে সজাগ থাকতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই মেজাজ উগ্র না হয়ে পড়ে।
নেতৃত্ব কর্মীদের সমস্যা সম্পর্কে ওাকিফহাল থাকবেন
একটি সংগঠনের কর্মীগণ মেশিন নয়, মানুষ। তাদের রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। পরিবার, প্রতিবেশ ও সমাজ পরিমণ্ডলে তাদের সমস্যা থাকতে পারে। কেউ কেউ মারাত্মক ব্যাধিগ্রস্থ থাকতে পারে। কেউ কেউ চরম দারিদ্র্যের শিকার হতে পারে।
এইসব সমস্যা কর্মীদেরকে অহর্নিশ যাতনা দিয়ে থাকে। পীড়ন করতে থাকে তাদেরকে নিদারুণভাবে ফলে তাদের মানসিক সুস্থিরতা বিনষ্ট হয়। ব্যাহত হয় মনোযোগ। নষ্ট হয় কর্মস্পৃহা। কর্মীদের অবস্থা সম্পর্কে নেতৃবৃন্দের অবগতি থাকা চাই। এক স্তরের নেতৃত্ব সকল স্তরের কর্মীদের সমস্যা সমানভাবে অবহিত থাকবেন, এটা স্বাভাবিক নয়। তবে সামগ্রিকভাবে সংগঠনের সকল কর্মীই যাতে সংগঠনের কোন না কোন পর্যায়ের নেতৃত্বের কাছে তাদের সমস্যাদি ব্যক্ত করতে পারে এবং সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরামর্শ লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থা থাকা চাই।
কর্মীদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না থাকলে নেতৃত্ব কর্ম বণ্টনের সময় ভুল করে ফেলতে পারেন। তিনি কঠিন সমস্যাপীড়িত কোন ব্যক্তির ওপর তার সাধ্যাতীত কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন। যা কিছুতেই হওয়া উচিত নয়।
নেতৃত্ব বয়সসাংগঠনিক অভিজ্ঞতাস্বাস্থ্যশিক্ষার মান ইত্যাদি বিচার করে কর্মীদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করবেন
একটি সংগঠনে থাকে নানা কাজ। কোন কাজ উচ্চ শিক্ষা দাবি করে, কোনটি তা করে না। কোন কাজ খুব দৈহিক শ্রম দাবি করে, কোনটি তা করে না। কোন কাজ দীর্ঘ সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা দাবি করে, কোনটি তা করে না।
তাই কর্ম বণ্টনের সময় কর্মীদের বয়স, সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মান ইত্যাদি বিচার করে যেই ব্যক্তি যেই কাজের উপযুক্ত তার ওপর সেই কাজ অর্পণ করতে হবে। এইভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে কর্ম বণ্টন করতে দেখা যাবে সঠিক ব্যক্তির ওপর সঠিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।
নেতৃত্ব কর্মীদের কার্য সম্পাদনে সহযোগিতা করবেন
কোন কর্মীর ওপর একটি দায়িত্ব অর্পণ করেই নেতৃত্ব নির্লিপ্ত থাকবেন না। নেতৃত্ব কর্মীকে কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে যথসম্ভব সহযোগিতা প্রদান করবেন।
প্রথমেই কর্মীর ওপর অর্পিত দায়িত্বের দাবিটা কি তা তাকে বুঝিয়ে দেয়া দরকার। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সেই সম্পর্কে তাকে পরামর্শ দেয়া যায়। আপন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন কর্মী কোন জটিলতার সম্মুখীন হলে তা অতিক্রম করার উপায় বলে দিয়েও তাকে সাহায্য করা যেতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে সাময়িকভাবে কোন কর্মীকে প্রথমোক্ত কোন কর্মীর সহযোগিতার জন্য নিয়োজিত করা যেতে পারে।
নেতৃত্ব কর্মীদের অনানুষ্ঠানিক আলাপ করবেন
একটি সংগঠনের থাকে নানা ধরণের ফর্মাল মিটিং। এই মিটিংগুলোকে কর্মীদের সাথে নেতৃত্বের সাক্ষাত হয় বটে, কিন্তু অন্তরঙ্গ আলাপের কোন সুযোগ থাকে না। এই মিটিংগুলোর সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকে। এর ভিত্তিতেই মিটিং শুরু হয়, কার্যক্রম সামনে অগ্রসর হয় এবং এক পর্যায়ে এসে মিটিং সমাপ্ত হয়। এমতাবস্থায় মিটিংয়ে কর্মীদের সাথে নেতৃত্বের সাক্ষাত ঘটলেও তাদের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার সুযোগ মেলে না। অথচ কর্মীদের মান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ, তাদের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং তাদের মানোন্নয়নের জন্য তাদের সাথে নেতৃত্বের ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা খুবই জরুরী। তাই নেতৃত্বকে অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করতে হবে।
নেতৃত্ব কর্মীদের প্রতি কোমলতাউদারতাক্ষমাশীলতা অবলম্বন করবেন
কর্মীগণ সংগঠনের লক্ষ্য হাসিলের জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। অবশ্য কারো মনে যদি কোন কারণে বক্রতা সৃষ্টি হয়ে থাকে ভিন্ন কথা। কর্তব্য পালনের মান সকলের একই রকম হয় না। যোগ্যতা অনুসারে এর তারতম্য হবেই। তাছাড়া কার্য সম্পাদনকালে কারো কারো ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যাবেই। নেতৃত্বের কর্তব্য হচ্ছে কর্মীদের সেইসব ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। ভুল মুক্ত হয়ে কাজ করার জন্য তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কাজের মান উন্নত করার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা।
আচরণের ক্ষেত্রেও সকল কর্মী একই মানের হবার কথা নয়। কারো আচরণ খুবই সুন্দর। আবার কারো আচরণে অনাকাংখিত কিছু প্রকাশ পেতে পারে। অনাকাংখিত কিছু ঘটলে তা শুধরাবার প্রয়াস চালাতে হবে। বার বার সেইদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
কোন কোন কর্মী কোন এক সময় শৃংখলা বিরোধী আচরণও করে ফেলতে পারে। সেই ক্ষেত্রে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। তারা যদি ভুল স্বীকার করে এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এমন অবাঞ্ছিত আচরণ করবে না বলে অঙ্গীকার করে তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে হবে। অবশ্য ভুল স্বীকারের পরিবর্তে তারা যদি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে তাহলে নেতৃত্বকে শৃংখলার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংগঠনের সুস্থতার জন্য এই ধরণের পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই পদক্ষেপকে অবশ্যই ব্যতিক্রম গণ্য করতে হবে। সামগ্রিকভাবে নেতৃত্ব কর্মীদের প্রতি কোমল আচরণ করবে, তাদের প্রতি উদার হবেন এবং যত বেশি সম্ভব তাদেরকে ক্ষমাশীলতার দৃষ্টিতে দেখবেন, এটাই ইসলামের দাবি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই ইসলামী আন্দোলনের মূল নেতা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে সা. নির্দেশ নিয়ে বলেন,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
‘‘তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি নম্র ব্যবহার কর।’’ (সূরা আশ্‌ শূয়ারাঃ ২১৫)
মহান আল্লাহ বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ
‘‘নম্রতা ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন কর, মা’রুফ কাজের উপদেশ দিতে থাক এবং মূর্খ লোকদের সাথে জড়িয়ে পড়ো না।’’ (সূরা আল রাফঃ ১৯৯)
وَلَمَن صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَٰلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
‘‘যেই ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করলো এবং ক্ষমা করলো- নিশ্চয়ই তা উচ্চ মানের সাহসী কাজের অন্যতম। (সূরা আশ শূরাঃ ৪৩)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার ওপর ওহী পাঠিয়েছেন। তোমরা পরস্পর বিনয়-নম্রতার আচরণ কর যেই পর্যন্ত না কেউ কারো ওপর গৌরব করে ও অপরের ওপর বাড়াবাড়ি করে।’’ (সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসূল সা. অন্যত্র বলেন, ‘‘দান দ্বারা সম্পদ কমে না। ক্ষমার দ্বারা আল্লাহ সম্মান বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। আর যেই ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় ও নম্রতার নীতি অবলম্বন করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’’ (সহীহ মুসলিম)
এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘আল্লাহ কোমল। তিনি কোমলতা ভালোবাসে। তিনি কোমলতা দ্বারা ঐ জিনিস দান করেন যা কঠোরতা দ্বারা দেন না। কোমলতা ছাড়া অন্য কিছু দ্বারাই তিনি তা দেন না।’’ (সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘‘যেই জিনিসে কোমলতা থাকে কোমলতা সেটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর যেই জিনিস থেকে কোমলতা ছিনিয়ে নেয়া হয় সেটা ত্রুটিযুক্ত হয়ে যায়।’’ (সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসুল সা. অন্যত্র বলেছেন, ‘‘যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে সব রকমের কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত করা হয়েছে।’’ (সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসূল সা. আরো বলেন, ‘‘জাহান্নামের আগুন এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য হারাম যে লোকদের সাথে থাকে, যে কোমল মন, নরম মিজাজ ও বিনম্র স্বভাব বিশিষ্ট।’’ (জামিউত তিরমিযী)
ক্ষমাশীলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
‘‘তাদের বৈশিষ্ট্যঃ তারা রাগ হজমকারী এবং লোকদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বনকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালোবাসেন।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৩৪)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘‘নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ঐ ব্যক্তি যে অধীন লোকদের প্রতি কঠোর। সতর্ক থেকো যাতে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পড়।’’ (সহীহ মুসলিমসহীহুল বুখারী)
ইসলামী আন্দোলনের মূল নেতা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন কোমলতা, উদারতা ও ক্ষমাশলতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর এই গুণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন তিনি, ‘‘…মুমিনদের প্রতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’ (সূরা আত্‌ তাওবা)
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
‘‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের জন্য নম্র স্বভাবের লোক হয়েছো। তুমি যদি উগ্র-স্বভাব (কটুভাষী) ও কঠোর চিত্ত হতে তাহলে এসব লোক তোমার চারদিক থেকে দূরে সরে যেতো।’’ (সূরা আলো ইমরানঃ ১৫৯)
আল-কুরআনের এইসব আয়াত এবং আল্লাহর রাসূলের সা. এইসব উক্তি থেকে অতি সহজেই উপলব্ধি করা যায় আল ইসলাম কোমলতা-উদারতা-ক্ষমাশীলতার ওপর কতোখানি গুরুত্ব আরোপ করেছে।
আল-কুরআন এবং আল-হাদীসের শিক্ষাকে সামনে রেখেই নেতৃত্বকে কর্মীদের সাথে বিনম্র আচরণ করতে হবে।

একটি মজবুত সংগঠনের পরিচয়

আদর্শিক ভিত্তিতে কোন ভূ-খণ্ডের সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হলে একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। বলিষ্ঠ সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়া কায়েমী স্বার্থবাদের অকটোপাস থেকে সমাজকে মুক্ত করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই জন্যই আদর্শিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে দীর্ঘ সময় ধরে একটি শক্তিশালী বা মজবুত সংগঠন গড়ে তোলার জন্য অহর্নিশ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কোন সংগঠন ক্রমশঃ শক্তি অর্জন করে গণ মানুষের সংগঠনে পরিণত হলেই কাংখিত পরিবর্তনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এখানে আমরা সংক্ষেপে একটি মজবুত সংগঠনের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
সুযোগ্য নেতৃত্বের সমাবেশ
একটি সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে শিকড় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দানের জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিত্বের সমাবেশ প্রয়োজন। যেহেতু সংগঠনের কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব এই সকল ব্যক্তিই পালন করে থাকেন সেহেতু তাঁদের যোগ্যতার মান অনুযায়ীই সংগঠনের পরিকল্পনা প্রণীত হয় এবং তাঁদের যোগ্যতার মান অনুযায়ীই তা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
সংগঠনের যেই স্তরে বা যেই অঞ্চলে সুযোগ্য ব্যক্তিবর্গ থাকেন সেই স্তরে সেই স্তরে বা সেই অঞ্চলে কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়, পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জিত হয় এবং কর্ম এলাকায় তাঁদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সংগঠনের কোন স্তরে বা কোন কর্ম এলাকায় নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দুর্বল হলে সেখানে কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়তে বাধ্য। শুধু তাই নয় সেখানে কাজ থমকেও দাঁড়াতে পারে। ফলে পরবর্তী স্তরে কাজ সম্প্রসারিত হওয়া অথবা সাংগঠনিক তৎপরতার প্রাণবন্যা নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছানো দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়।
অতএব সংগঠনের অগ্রগতির স্বার্থে এর সকল স্তরে সুযোগ্য নেতৃবর্গের সমাবেশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রকৃতপক্ষে এটিই হচ্ছে সাংগঠনিক মজবুতির প্রথম ও সর্ব প্রধান শর্ত।
নবীনদেরকে সম্পৃক্ত করার সক্ষমতা
এটা সত্য যে, প্রবীণের অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। তেমনিভাবে এটাও সত্য যে, নবীনদের কর্মোদ্দীপনার কোন বিকল্প নেই। কাজেই একটি সংগঠনে প্রবীণ ও নবীনের সম্মিলন প্রয়োজন। যেই সংগঠন ক্রমান্বয়ে তরুণ তাজাদেরকে সংগঠনের সর্বস্তরে সম্পৃক্ত করে নিতে পারে না তা এক পর্যায়ে এসে গতিশীলতা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য।
যোগ্যতাসম্পন্ন নবীন কর্মীগণ যাতে সংগঠনে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেইদিকে নজর রাখা সংগঠনের সকল স্তরের নেতৃবর্গের একটি বিশেষ কর্তব্য। বস্তুতঃ কোন সংগঠনে নবীনদের বিপুল সমাবেশ ঘটলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে সেই সংগঠন সাংগঠনিক মজবুতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করলো।
ব্যবস্থাপনার যোগ্য ব্যক্তিদের সমাবেশ
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে মূল নেতৃত্ব ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় দায়িত্ব পালনের জন্য অনেক লোক নিয়োগ করতে হয়। অফিস পরিচালনা, গ্রন্থাগার পরিচালনা, হিসাব রক্ষণ ইত্যাদি কাজের জন্যও বেশ কিছু লোকের প্রয়োজন। এইসব কাজের পদগুলো বাহ্যতঃ ছোট বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এইগুলোও খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ। এইসব পদে যাঁরা থাকেন তাঁরাই মূল নেতৃত্বকে ব্যাকআপ সার্ভিস দিয়ে থাকেন। তাঁরা যদি সঠিক সময়ে এবং সঠিক মানে ব্যাকআপ সার্ভিস দিতে না পারেন তাহলে মূল নেতৃত্ব সঠিক সময়ে এবং সঠিক মানে তাঁদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ার আশংকা রয়েছে। সেই জন্য এই পদগুলোতেও যাতে দক্ষ ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটতে পারে সেইদিকে মূল নেতৃত্বকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
‘একজন কর্মী বেকার। কোথাও কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে না। কাজেই সংগঠনের অফিসে ঢুকিয়ে দাও’- এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন ব্যক্তিকে ব্যবস্থাপনার কোন দায়িত্ব দেয়া সমীচীন নয়। বেকার কর্মীর জন্য প্রয়োজনবোধে কল্যাণ ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তাই বলে অযোগ্য বা কমযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ব্যাকআপ সার্ভিস দেবার মতো কোন পদে কিছুতেই নিয়োগ করা উচিত নয়। সঠিক পদে সঠিক ব্যক্তির নিয়োগও একটি মজবুত সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রয়োজনীয়  উন্নততর উপকরণের সমাবেশ
দিনের পর দিন মানুষের বস্তু জ্ঞান বিস্তৃতি লাভ করছে। মানুষ জীবনকে সহজ ও গতিশীল করার জন্য নিত্য নতুন উপকরণ আবিষ্কার করছে। এইগেুলোর ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে দূরতম অঞ্চলের সাথে যোগাযোগসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা মানুষ লাভ করছে। দুনিয়ার অপরাপর সংগঠন সেইগুলো ব্যবহার করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে আর একটি ইসলামী সংগঠন সেইগুলো ব্যবহার না করে পিছিয়ে থাকবে এটা মোটেই অভিপ্রেত নয়। টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেট, টেলেক্স, অডিও ভিডিও ইকুইপমেন্টস, ফটোষ্ট্যাট মেশিন, কম্পিউটার মেশিন, মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ী ইত্যাদি বর্তমান কালে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় উপকরণ। প্রয়োজনের তীব্রতা সামনে রেখে সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে এইগুলের সমাবেশ ঘটাতে হবে ক্রমান্বয়ে। এইগুলোর সমাবেশ নিঃসন্দেহে একটি গতিশীল সংগঠনের পরিচয় বহন করে।
শিকড় পর্যায় পর্যন্ত সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ
একটি ভূ-খণ্ডের প্রতিটি এলাকা সংগঠনের আওতাভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। সংগঠনের আদর্শিক ধ্যান-ধারণা, এর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বক্তব্য গণ-মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছতে হলে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত এর প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। শিকড় পর্যায় পর্যন্ত সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটানো ছাড়া এটি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তদুপরি একটি সংগঠন তো শেষাবধি গণ-মানুষের সংগঠন হতে চায়। তাই গণমানুষ যতো জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সংগঠনের শাখা সেখান পর্যন্ত বিস্তৃত হতে হবে। সংগঠন গণ-মানুষের বহুমুখী সমস্যা সমধানের দায়িত্ব পালন করবে, জনগণকে সাথে নিয়েই কায়েমী স্বার্থবাদের ভিত কাঁপিয়ে তুলবে। আর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগঠন গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত থাকতে হবে।
রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র সংগঠনের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলে ধরে নিতে হবে সংগঠন সাংগঠনিক মজবুতির আরেকটি জরুরী শর্ত পূরণ করতে পেরেছে।
নেতৃত্ব  কর্মীদের সুসম্পর্ক
কোন সংগঠনে নেতৃবৃন্দ যদি বস্‌ সেজে যান এবং কর্মীগণকে ভৃত্য মনে করেন তাহলে সেই সংগঠন বেশি দিন বেঁচে থাকার কথা নয়। এই ধরণের কোন সংগঠনের একজন কর্মী দুনিয়াবী কোন স্বার্থে হয়তোবা বাহ্যিকভাবে নেতৃত্বের আনুগত্য করতে পারে, কিন্তু তার অন্তরে নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা নয় এবং তার অন্তরে নেতৃত্বের প্রতি সীমাহীন ঘৃণাই বাসা বেঁধে থাকার কথা। যেই সংগঠনের নেতৃত্ব এবং কর্মীদের মধ্যকার সম্পর্কের ধরণ এই, সেই সংগঠনকে মজবুত সংগঠন বলার কোন উপায় নেই।
যেই সংগঠনের নেতৃত্ব কর্মীদেরকে আন্তরিকভাবেই ভাই মনে করেন, তাদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন এবং সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়ান সেই সংগঠনের কর্মীবৃন্দ স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, অকাতরে তাঁর বা তাঁদের নির্দেশ মেনে নেবে এবং নেতৃত্বের নির্দেশে যেই কোন ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে এই কর্মীদের ভূমিকা ভাড়াটে কর্মীদের ভূমিকার মতো হবে না। এমতাবস্থায় সংগঠনের কাজকে তারা নিজেদেরই কাজ মনে করবে এবং সর্বোত্তমভাবে সেই কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে।
তাই নেতৃত্ব ও কর্মীদের সুসম্পর্ক সাংগঠনিক মজবুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
কর্মীদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক
কোন সংগঠনে বহুসংখ্যক কর্মীর সমাবেশ ঘটলেই তাকে মজবুত সংগঠন বলা যায় না যদি না সেই সংগঠনের কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বিরাজ করে। পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকলেই এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির সুখ-দুঃখের সাথী হতে পারে, নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অপরের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে পারে।
যেই সংগঠনের কর্মীগণ নিজের প্রয়োজনের ওপর অপরের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে পারে সেই সংগঠনের শক্তি অনেক।
সেই সংগঠনের কর্মীদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ থাকে না। সেই কারণেই থাকে না পরনিন্দা। আর হিংসা-বিদ্বেষ এবং পরনিন্দার অনুপস্থিতি সঠিক অর্থেই একটি সংগঠনের পরিপূর্ণ সুস্থতার লক্ষ্যণ। কাজেই কোন সংগঠনের কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বিরাজ করলে সেই সংগঠন সাংগঠনিক মজবুতি অত্যাবশ্যকীয় একটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছে, এই কথা জোর দিয়েই বলা যায়।
ভারসাম্যপূর্ণ বহুমুখী তৎপরতা
একটি সংগঠনের থাকে নানামুখী কাজ। বিশেষ করে একটি আদর্শিক সংগঠন বহু ব্যাপক কর্মসূচী নিয়ে কাজ করে থাকে। আদর্শিক কনসেপ্টগুলোর উপস্থাপনার মাধ্যমে চিন্তা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি, ব্যক্তির স্বকীয়তায় আমূল পরিবর্তন সাধন, সামাজিক ব্যধি ও সমস্যাগুলো নিরসনকল্পে পরিচালিত সংস্কারধর্মী কমকাণ্ড এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সৎ ব্যক্তিদের উত্থান প্রয়াস একটি বাস্তবধর্মী সংগঠনের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই কর্মসূচীর বাস্তবায়নের জন্য পরিচালিত হয় বিভিন্ন ধরণের কর্মকাণ্ড। এইসব কর্মকাণ্ডের কোন একটি দিকও না বাহুল্য, না অপ্রয়োজনীয়। এইগুলোকে সামনে রেখেই সংগঠন কর্ম এলাকায় কর্ম তৎপরতা চালায়, সংগঠনের মাঠকর্মীরা মাঠ চষে বেড়ায়। কিন্তু এই মাঠ চষে বেড়ানোর কাজটা একপেশে হয়ে গেলেই সমস্যা। সবগুলো কাজই যদি যুগপৎভাবে সম্পাদিত হয় তাবেই সোনায় সোহাগা। সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে যাতে পরিপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা পায় সেইদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন সংগঠনের পরিচালকবৃন্দ। কোন একটি দিককেও উপেক্ষা বা অবহেলা না করে ভারসাম্য রক্ষা করে যদি সংগঠন কর্মতৎপরতা চালাতে পারে তাহলে এই সংগঠন মজবুত সংগঠন নামে আখ্যায়িত হওয়ার দাবি করতে পারে সংগতভাবেই।
আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা
একটি সংগঠনের বিভিন্নমুখী তৎপরতা পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। অর্থাভাবে যদি কোন সাংগঠনিক কাজ ব্যাহত হয় এটা নিঃসন্দেহেই দুর্ভাগ্যজনক। তদুপরি এটা সাংগঠনিক দুর্বলতার পরিচায়কও বটে।
একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এর গোটা কর্মী বাহিনীকেই দিতে হবে। এর জন্য কর্মী বাহিনীর মধ্যে অব্যাহতভাবে মটিভেশন প্রদানের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তবে কর্মী বাহিনীর বাইরেও সংগঠনের প্রভাব বলয়ের অন্তভুক্ত ধনী ব্যক্তিদেরকে এই সংগঠনে অর্থ দানের মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে বুঝাতে হবে। তাহলে তাঁরাও এই সংগঠনের তহবিলে অকাতরে দান করতে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করা যায়।
মোটকথা, অর্থাভাবে সংগঠনকে পঙ্গু করে রাখার কোন উপায় নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে কোন অর্থ পাওয়া না গেলেও সংগঠনের প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় করতে হবে এবং তা করতে হবে সংগঠনের কর্মীদের কাছ থেকেই। কোন সংগঠন যখন এর কর্ম এলাকায় বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান নিজেই দিতে পারে তখন একে শক্তিশালী সংগঠন গণ্য করার একটি মজবুত ভিত্তি পাওয়া যায়।
১০কর্ম এলাকায় নেতা  কর্মীদের ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি
সংগঠন যেই ভূ-খণ্ডে বা যেই অঞ্চলে কাজ করে থাকে সেই ভূ-খণ্ড বা অঞ্চলে এর নেতৃবৃন্দ এবং কর্মী বাহিনীর ব্যাপক প্রভাব থাকা প্রয়োজন। অবশ্য এই প্রভাব এমনিতেই সৃষ্টি হয় না। সংগঠন যখন বহুমুখী তৎপরতা চালিয়ে জনগণের আস্থাভাজন হতে পারে তখনই এই প্রভাবের বিস্তৃতি ঘটে। আসলে সমাজের প্রতিটি মানুষই কল্যাণের কাঙ্গাল। তারা যখন নিশ্চিত হতে পারে যে এই সংগঠন এবং এর নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী সত্যিকার অর্থেই তাদের কল্যাণকামী, তখন তারা এই সংগঠনের দিকে মানসিকভাবে ঝুঁকে পড়ে।
তখন তারা তাদের দুঃখ-দুর্দশা জানাবার জন্য এদের কাছেই ছুটে আসেন। তাদের নানাবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য এদেরই সহযোগিতা কামনা করে। এই অবস্থাতে সংগঠন যদি তাদের প্রতি অর্থবহ কোন সহযোগিতা দিতে পারে তাহলে তারা কাগজ কলমে না হলেও আন্তরিকভাবেই এই সংগঠনেরই লোক হয়ে যায়।
কর্ম এালাকায় এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলে নির্দ্বিধায় বলা চলে যে সংগঠন একটি মজবুত সংগঠন হওয়ার অতীত গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
১১বৈরী শক্তিগুলোর চক্রান্ত নস্যাৎ করার ক্ষমতা
বৈরী শক্তিগুলোর ইসলামী সংগঠনের উপস্থাপিত আদর্শের বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। কেন না যেই কোন যুক্তি-তর্কে এটাই প্রমাণিত হয় যে ইসলামই সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ। যারা এর কল্যাণকারিতা এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে না তারা অন্যায়ভাবে কোমর বেঁধে এর বিরোধিতায় নেমে পড়ে। যেহেতু তারা আদর্শিকভাবে একে মুকাবিলা করতে পারে না সেহেতু তারা একটি ভয়াল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এই সংগঠনের কর্মী বাহিনী এবং জনগণের মাঝে একটা ব্যবধান সৃষ্টি করতে চায়। তদুপরি মিথ্যা প্রচারণার ঝড় তুলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালায়।
বৈরী শক্তিগুলোর এই চক্রান্তজাল ছিন্ন করেই ইসলামী সংগঠনকে সামনে এগুতে হবে। একে অবশ্যই জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে। জনগণ যাতে বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচারে প্রভাবিত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেই জন্য ব্যাপক গণ-সংযোগ, বিপুল সংখ্যক প্রচার পত্র বিতরণ, পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মোটকথা বৈরী শক্তিগুলোর যাবতীয় অপকৌশল ভণ্ডুল করে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্তি মুক্ত রেখে জনগণ এবং সংগঠনের মধ্যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সংগঠন যদি এটি নিশ্চিত করতে পারে তাহলে বুলন্দ কণ্ঠেই বলা যাবে যে সংগঠন মজবুতির আরেকটি প্রধান শর্ত পূরণ করতে পেরেছে।
…….. সমাপ্ত ……..

ইসলামী আন্দোলন সমস্যা ও সম্ভাবনা - মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

ইসলামী আন্দোলন সমস্যা ও সম্ভাবনা - মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

বইটি ডাউনলোড করুন। 


লটারী-জুয়া বনাম নির্বাচনী লটারী - প্রশ্ন: ১৯৪

 লটারি ও নির্বাচনী লটারি


প্রশ্ন : আমাদের অফিসের একটা পুরানো রীতি হলো, যে কর্মচারী এই অফিস থেকে এক মাইল দূরত্বে অবস্থান করে তাকে যাতায়াতের জন্য  অফিসের  সাইকেল দেয়া হয়। অফিসের সাইকেল একটাই। ঘটনাক্রমে বর্তমানে এক মাইল দূরে অবস্থানকারী কর্মচারীদের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচজন। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ধারণা, লটারির মাধ্যমে একজনকে নির্বাচিত করতে হবে। কেননা এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, লটারি জুয়ারই শামিল এবং নাজায়েয। আপনি বলুন এটা করা জায়েয কিনা?

জবাব : আপনি যে লটারির কথা বলেছেন তাকে জুয়া বলা চলেনা। নির্বাচনী লটারি আর জুয়ার লটারি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বেশিরভাগ লটারির  জুয়ার আওতাভুক্ত এবং অবৈধ। কিন্তু নির্বাচনী লটারি শরিয়তে আপত্তিকর নয়। নিছক নির্বাচনের জন্য গৃহীত লটারি জুয়ার লটারি থেকে একেবারেই আলাদা জিনিস। অনিবার্য ক্ষেত্রে নির্বাচনী লটারি গৃহিত হয়ে  থাকে। উভয়ের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক পার্থক্য এই যে, জুয়ার লটারিতে সত্যিকার বা স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি কোনো সমস্যা দেখা দেয়না এবং তা সমাধানের কোনো অভিপ্রায়ও থাকেনা। এতে আগে থেকে তৈরি করা একটা পরিকল্পনা বা সমঝোতার অধীনে অংশীদার ও উদ্যোক্তরা নিজ নিজ কাংখিত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পুঁজি  খাটায়। অত:পর তা বন্টনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পন্থা অবলম্বন করা হয় যা সাধারণত অনেকাশেই ভাগ্যনির্ভর অন্য কথায় এটা ভাগ্যের খেলা Game of Chance। এর ফলে কিছু লোক কোনা কারণ ও প্রয়োজন ছাড়াই এবং নিজের শ্রম মেধা অনুপাতে বেশি অর্থ লাভ করে। অথচ প্রলুব্ধ হয়ে অংশগ্রহণকারী অনেকে বঞ্চিত থেকে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ধরণের জুয়ার উদ্যোক্তা ও সংগঠকরা নিজের পকেট থেকে কাউকে কিছু দেয়না, আর এমন কোনো সম্পদও বন্টন করেনা যা স্বাভাবিকভাবে সংগৃহীত হয়েছে, কেবল তার বন্টনই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বরঞ্চ তারা অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। অত:পর অবৈধভাবে নিজেরা কিছু নেয় এবং অন্যদেরকেও কিছু দেয়।

পক্ষান্তরে নির্বাচনী লটারি সেই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যেখানে একটি বিশেষ সংখ্যার সমান সমান অংশ বিদ্যমান এবং তা ঠিক সেই সংখ্যক হকদারের মধ্যে বন্টন করা কাম্য হয় এমতাবস্থায় অংশীদার বা বন্টনকারী নিজের ইচ্ছেমত বন্টনের পরিবর্তে লটারির সাহায্যে প্রত্যেক অংশীদারকে একটা বিশেষ অংশ দিয়ে দেয়। এতে অবিচার বা পক্ষপাতিত্বের কোনো অবকাশ থাকেনা। এ ধরনের নির্বাচনী লটারির প্রয়োজন আরো একটা ক্ষেত্রে দেখা দেয়। সেটি হলো, যদি দেয় জিনিসকে একক ও অবিভাজ্য  হয় এবং তার একাধিক হকদার থাকে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে বঞ্চিত করলে সবার প্রতি অবিচার করা হবে। আর যদি দাতা নিজের ইচ্ছেমত কাউকে বাছাই করতে চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তার কাছে কাউকে অগ্রগণ্য মনে করার কোনো মানদণ্ড থাকেনা। এতে একজন বাদে আর সকলের মনেও আঘাত  লাগে। এই সংকটের  সমাধানের জন্য নির্বাচনী লটারি করে কোনো একজনের নাম নির্বাচন করা ও জিনিসটা তাকে দিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা। এমন বলাবাহুল্য যে এই দুই ধরণের নির্বাচনী লটারির সাথে অন্যান্য লটারির আকাশ পাতাল পার্থক্য। উভয় ক্ষেত্রের  জন্য শরিয়তের একই বিধান হতে পারেনা। জুয়ামূলক লটারিতে ইচ্ছেকৃতভাবে পুঁজি এমনভাবে সংগ্রহ ও বন্টন করা হয় যে, কারে হক নষ্ট হয় এবং কেউ অবৈধভাবে লাভবান হয়। পক্ষান্তরে নির্বাচনী লটারিতে একটা বাস্তব সংকটের এমন সমাধান করা হয়, যার কোনো বিকল্প নেই।

কুরআন ও হাদিসে যতো ধরণের জুয়াকে হারাম বা মাকরূহ ঘোষণা করা হয়েছে, তার কোনোটাই নির্বাচনী লটারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বরঞ্চ বহু হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল সা. এবং সাহাবিগণ বিভিন্ন সময়ে উপরোক্ত নির্বাচনী লটারি প্রয়োগ করেছেন। নির্ভরযোগ্য হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল  সা. মদিনায় অবস্থানকালে কবে কোন স্ত্রীর  কাছে থাকতেন, সেটা পালাক্রমে স্থির করতেন। কিন্তু সফরে যাওয়ার সময় তিনি লটারির মাধ্যমে উম্মুল মুমিনীনদের কোনো একজনকে নির্বাচন করতেন এবং তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন।

একথা সত্য, যেসব খেলাধুলা ও কায়কারবারে জুয়ার মিশ্রণ ঘটে, তাতেও বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনী লটারি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সবাই জানে, তা স্বাভাবিক নির্বাচনী লটারির থেকে ভিন্ন রকমের। সেটা  জুয়াবাজিরই একটা অংশ এবং গোটা কারবার জুয়াভিত্তিক হওয়ায় এই অংশটিও নাজায়েয ও হারাম। [তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৩]


(রাসায়েল মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী) 

সুরা ফাতিহা : প্রশ্ন: ১৯৩

সূরা আল ফাতিহা – অর্থ, নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু।

সূরাতুল ফাতিহাহ’ অর্থ মুখবন্ধ বা ভূমিকার সূরা। ইমাম কুরতুবী বলেন, একে ‘ফাতিহাহ’ এজন্য বলা হয় যে, এই সূরার মাধ্যমে কুরআন পাঠ শুরু করা হয়। এই সূরার মাধ্যমে কুরআনের সংকলন কাজ শুরু হয়েছে এবং এই সূরার মাধ্যমে ছালাত শুরু করা হয়’। এটি মক্কায় অবতীর্ণ ১ম ও পূর্ণাঙ্গ সূরা। এতে ৭টি আয়াত, ২৫টি কালেমা বা শব্দ এবং ১১৩টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে। সূরাটি কুরআনের মূল, কুরআনের ভূমিকা ও ছালাতের প্রতি রাক‘আতে পঠিতব্য সাতটি আয়াতের সমষ্টি ‘আস-সাব‘উল মাছানী’ নামে ছহীহ হাদীছে ও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহপাক এরশাদ করেন, وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعاً مِّنَ الْمَثَانِيْ وَالْقُرْآنَ الْعَظِيْمَ ‘আমি আপনাকে সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কোরআন দিয়েছি।’ (হিজর ১৫/৮৭)।

নামকরণ

এ সূরার বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এর এই নামকরণ করা হয়েছে । যার সাহায্যে কোন বিষয়, গ্রন্থ বা জিনিসের উদ্বোধন করা হয় তাকে ‘ফাতিহা’ বলা হয় । অন্য কথায় বলা যায় , এ শব্দটি ভূমিকা এবং বক্তব্য শুরু করার অর্থ প্রকাশ করে ।ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, সূরাটির নাম ‘উম্মুল কিতাব’ এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সূরার মাধ্যমেই পবিত্র কুরআনের সংকলন কার্য শুরু করা হয়েছে এবং এই সূরা পাঠের মাধ্যমে ছালাত শুরু করা হয়ে থাকে।আরবরা প্রত্যেক বস্ত্তর উৎস, সারগর্ভ বস্ত্ত বা কোন কাজের অগ্রভাগ, যার অনুগামী শাখা-প্রশাখা সমূহ রয়েছে, তাকে ‘উম্ম’ (أُمٌّ) বলে। যেমন মক্কাকে উম্মুল ক্বোরা (أم القرى) বলা হয়, পৃথিবীর প্রথম ও শীর্ষ মর্যাদাবান নগরী হওয়ার কারণে এবং এটাই পৃথিবীর নাভিমূল ও এখান থেকেই পৃথিবী বিস্তৃতি লাভ করেছে’ (ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। অতএব সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন (أم القرأن) এজন্য বলা হয়েছে যে, এটা দিয়েই কুরআন শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যে কুরআনের সমস্ত ইল্ম শামিল রয়েছে’ (কুরতুবী)।

সূরা ফাতিহার নাম সমূহ :

বিভিন্ন হাদীছ, আছার ও বিদ্বানগণের নামকরণের মাধ্যমে অন্যূন ৩০টি নাম বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে ছহীহ হাদীছসমূহে এসেছে ৮টি।
যেমন : (১) উম্মুল কুরআন (কুরআনের মূল)।
(২) উম্মুল কিতাব (কিতাবের মূল)।
(৩) আস-সাব‘উল মাছানী (সাতটি বারবার পঠিতব্য আয়াত)।
(৪) আল-কুরআনুল ‘আযীম (মহান কুরআন)।
(৫) আল-হামদু (যাবতীয় প্রশংসা)।
(৬) ছালাত।
(৭) রুক্বিয়াহ (ফুঁকদান)।
(৮) ফাতিহাতুল কিতাব (কুরআনের মুখবন্ধ)।
এ নামে সকল বিদ্বান একমত। কারণ এ সূরা দিয়েই কুরআন পাঠ শুরু হয়। কুরআনুল কারীম লেখা শুরু হয় এবং এটা দিয়েই ছালাত শুরু হয় (কুরতুবী)।
এতদ্ব্যতীত অন্য নামগুলি যেমন : (৯) শিফা (আরোগ্য),
(১০) আসাসুল কুরআন (কুরআনের ভিত্তি)। ইবনু আববাস (রাঃ) এ নামকরণ করেছেন (ইবনু কাছীর)।
(১১) কাফিয়াহ (যথেষ্ট)। ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর এ নামকরণ করেছেন। কারণ এটুকুতেই ছালাত যথেষ্ট এবং এটি ব্যতীত ছালাত হয় না (কুরতুবী)।
(১২) ওয়াফিয়াহ (পূর্ণ)। সুফিয়ান বিন উয়ায়না এ নামকরণ করেছেন। কারণ এ সূরাটি সর্বদা পূর্ণভাবে পড়তে হয়। আধাআধি করে দু’রাক‘আতে পড়া যায় না (কুরতুবী)।
(১৩) ওয়াক্বিয়াহ (হেফাযতকারী)।
(১৪) কান্য (খনি)। এছাড়াও ফাতিহাতুল কুরআন, সূরাতুল হাম্দ, শুক্র, ফাতিহাহ, মিন্নাহ, দো‘আ, সওয়াল, মুনাজাত, তাফভীয, মাসআলাহ, রা-ক্বিয়াহ, নূর, আল-হাম্দুলিল্লাহ, ইল্মুল ইয়াক্বীন, সূরাতুল হাম্দিল ঊলা, সূরাতুল হাম্দিল কুছরা’। এইভাবে নাম বৃদ্ধির ফলে সূরা ফাতিহার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, পবিত্র কুরআনের সূরা সমূহের এক বা একাধিক নামকরণ, মাক্কী ও মাদানী সূরার আগে-পিছে সংযোজন ও আয়াত সমূহের বিন্যস্তকরণ সবকিছু ‘তাওক্বীফী’ অর্থাৎ আল্লাহর ‘অহি’ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট ও রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সন্নিবেশিত, যা অপরিবর্তনীয়।এর মধ্যে গূঢ় তত্ত্বসমূহ নিহিত রয়েছে।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল

এটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের একেবারেই প্রথম যুগের সূরা । বরং হাদীসের নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, এটিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা। এর আগে মাত্র বিছিন্ন কিছু আয়াত নাযিল হয়েছিল । সেগুলো সূরা ‘আলাক’, সূরা ‘মুয্‌যাম্‌মিল’ ও সূরা ‘মুদ্‌দাস্‌সির’ ইত্যাদিতে সন্নিবেশিত হয়েছে ।

বিষয়বস্তু

আসলে এ সূরাটি হচ্ছে একটি দোয়া । যে কোন ব্যক্তি এ গ্রন্থটি পড়তে শুরু করলে আল্লাহ প্রথমে তাকে এ দোয়াটি শিখিয়ে দেন । গ্রন্থের শুরুতে এর স্থান দেয়ার অর্থই হচ্ছে এই যে, যদি যথার্থই এ গ্রন্থ থেকে তুমি লাভবান হতে চাও, তাহলে নিখিল বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহর কাছে দোয়া এবং সাহায্য প্রার্থনা করো ।মানুষের মনে যে বস্তুটির আকাংখা ও চাহিদা থাকে স্বভাবত মানুষ সেটিই চায় এবং সে জন্য দোয়া করে । আবার এমন অবস্থায় সে এই দোয়া করে যখন অনুভব করে যে, যে সত্তার কাছে সে দোয়া করছে তার আকাংখিত বস্তুটি তারই কাছে আছে । কাজেই কুরআনের শুরুতে এই দোয়ার শিক্ষা দিয়ে যেন মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সত্য পথের সন্ধান লাভের জন্য এ গ্রন্থটি পড়, সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে এর পাতা ওলটাও এবং নিখিল বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহ হচ্ছেন জ্ঞানের একমাত্র উৎস— একথা জেনে নিয়ে একমাত্র তাঁর কাছেই পথনির্দেশনার আর্জি পেশ করেই এ গ্রন্থটি পাঠের সূচনা কর ।
এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন ও সূরা ফাতিহার মধ্যকার আসল সম্পর্ক কোন বই ও তার ভূমিকার সম্পর্কের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং এ মধ্যকার আসল সম্পর্কটি দোয়া ও দোয়ার জবাবের পর্যায়ভুক্ত । সূরা ফাতিহা বান্দার পক্ষ থেকে একটি দোয়া । আর কুরআন তার জবাব আল্লাহর পক্ষ থেকে । বান্দা দোয়া করে, হে মহান প্রভু! আমাকে পথ দেখাও । জবাবে মহান প্রভু এই বলে সমগ্র কুরআন তার সামনে রেখে দেন ____ এই নাও সেই হিদায়াত ও পথের দিশা যে জন্য তুমি আমার কাছে আবেদন জানিয়েছ ।

﴿الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
১) প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি নিখল বিশ্ব –জাহানের রব,
﴿الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ﴾
২) যিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়
﴿مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ﴾
৩) প্রতিদান দিবসের মালিক ৷
﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ﴾
৪) আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই
﴿اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ﴾
৫) তুমি আমাদের সোজা পথ দেখাও,
﴿صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ﴾
৬) তাদের পথ যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ,
﴿غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ﴾
৭) যাদের ওপর গযব পড়েনি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি ৷
(১) অনন্ত করুণাময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে (আরম্ভ করছি)।
‘বিসমিল্লাহ’র পূর্বে ‘আক্বরাউ’ ‘আবদাউ’ অথবা ‘আতলু’ ফে’ল (ক্রিয়া) উহ্য আছে। অর্থাৎ, আল্লাহর নাম নিয়ে পড়ছি অথবা শুরু করছি কিংবা তেলাঅত আরম্ভ করছি। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আরম্ভ করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে। সুতরাং নির্দেশ করা হয়েছে যে, খাওয়া, যবেহ করা, ওযু করা এবং সহবাস করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়। অবশ্য ক্বুরআনে করীম তেলাঅত করার সময় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পড়ার পূর্বে ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ্শায়ত্বানির রাজীম’ পড়াও অত্যাবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘অতএব যখন তুমি ক্বুরআন পাঠ করবে, তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর।’’ (সূরা নাহল ৯৮ আয়াত)।
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
(২) সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।
الحَمد এর মধ্যে যে ال রয়েছে, তা استغراق (সমূদয়) অথবা اختصاص (নির্দিষ্টীকরণ)এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যই বা তাঁর জন্য নির্দিষ্ট; কেননা প্রশংসার প্রকৃত অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহই। কারো মধ্যে যদি কোন গুণ, সৌন্দর্য এবং কৃতিত্ব থাকে, তবে তাও মহান আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট। অতএব প্রশংসার অধিকারী তিনিই। ‘আল্লাহ’ শব্দটি মহান আল্লাহর সত্তার এমন এক সতন্ত্র নাম যার ব্যবহার অন্য কারো জন্য করা বৈধ নয়। ‘আলহামদু লিল্লাহ’ কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপক বাক্য। এর বহু ফযীলতের কথা হাদীসসমূহে এসেছে। একটি হাদীসে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হ’কে উত্তম জিকির বলা হয়েছে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’কে উত্তম দুআ বলা হয়েছে। (তিরমিযী, নাসায়ী ইত্যাদি) সহীহ মুসলিম এবং নাসায়ীর বর্ণনায় এসেছে, ‘আলহামদু লিল্লাহ’ দাঁড়িপাল্লা ভর্তি করে দেয়। এ জন্যই অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহ এটা পছন্দ করেন যে, প্রত্যেক পানাহারের পর বান্দা তাঁর প্রশংসা করুক। (সহীহ মুসলিম)
رَبّ মহান আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের অন্যতম। যার অর্থ হল, প্রত্যেক জিনিসকে সৃষ্টি ক’রে তার প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা ক’রে তাকে পরিপূর্ণতা দানকারী। কোন জিনিসের প্রতি সম্বন্ধ (ইযাফত) না করে এর ব্যবহার অন্য কারো জন্য বৈধ নয়। عَالَمِيْن عَالَم (বিশ্ব-জাহান) শব্দের বহুবচন। তবে সকল সৃষ্টির সমষ্টিকে عَالَم বলা হয়। এই জন্যেই এর বহুবচন ব্যবহার হয় না। কিন্তু এখানে তাঁর (আল্লাহর) পূর্ণ প্রতিপালকত্ব প্রকাশের জন্য এরও বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে উদ্দেশ্য হল, সৃষ্টির ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়। যেমন, জ্বিন সম্প্রদায়, মানব সম্প্রদায়, ফিরিশ্তাকুল এবং জীব-জন্তু ও পশু-পক্ষীকুল ইত্যাদি। এই সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজনসমূহও একে অপর থেকে অবশ্যই ভিন্নতর। কিন্তু বিশ্ব-প্রতিপালক প্রত্যেকের অবস্থা, পরিস্থিতি এবং প্রকৃতি ও দেহ অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে থাকেন।
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
(৩) যিনি অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু।
رَحما শব্দটি فَعلان এর ওজনে। আর رَحِيم শব্দটি فَعِيل এর ওজনে। দু’টোই মুবালাগার স্বীগা (অতিরিক্ততাবোধক বাচ্য)। যার মধ্যে আধিক্য ও স্থায়িত্বের অর্থ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, মহান আল্লাহ অতীব দয়াময় এবং তাঁর এ গুণ অন্যান্য গুণসমূহের মত চিরন্তন। কোন কোন আলেমগণ বলেছেন ‘রাহীম’-এর তুলনায় ‘রাহমান’-এর মধ্যে মুবালাগা (অতিরিক্ততাঃ রহমত বা দয়ার ভাগ) বেশী আছে। আর এই জন্যই বলা হয়, ‘রাহমানাদ্দুনিয়া অল-আখিরাহ’ (দুনিয়া ও আখেরাতে রহমকারী)। দুনিয়াতে তাঁর রহমত ব্যাপক; বিনা পার্থক্যে কাফের ও মু’মিন সকলেই তা দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। তবে আখেরাতে তিনি কেবল ‘রাহীম’ হবেন। অর্থাৎ, তাঁর রহমত কেবল মু’মিনদের জন্য নির্দিষ্ট হবে। اللَّهُمَّ! اجْعَلْنَا مِنْهُمْ (আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদেরই অন্তর্ভুক্ত কর!) (আ-মীন)
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
(৪) (যিনি) বিচার দিনের মালিক।
যদিও দুনিয়াতে কর্মের প্রতিদান দেওয়ার নীতি কোন না কোনভাবে চালু আছে, তবুও এর পূর্ণ বিকাশ ঘটবে আখেরাতে। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে তার ভাল ও মন্দ কর্ম অনুযায়ী পরিপূর্ণ প্রতিদান শান্তি ও শাস্তি প্রদান করবেন। অনুরূপ দুনিয়াতে অনেক মানুষ ক্ষণস্থায়ীভাবে কারণ-ঘটিত ক্ষমতা ও শক্তির মালিক হয়। কিন্তু আখেরাতে সমস্ত এখতিয়ার ও ক্ষমতার মালিক হবেন একমাত্র মহান আল্লাহ। সেদিন তিনি বলবেন, ‘‘আজ রাজত্ব কার?’’ অতঃপর তিনিই উত্তর দিয়ে বলবেন, ‘‘পরাক্রমশালী একক আল্লাহর জন্য।’’
يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالأَمْرُ يَوْمَئِذٍ للهِ (যেদিন কেউ কারও কোন উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সকল কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।) এটা হবে বিচার ও প্রতিদান দিবস।
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
(৫) আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
ইবাদতের অর্থ হল, কারো সন্তুষ্টি লাভের জন্য অত্যধিক কাকুতি-মিনতি এবং পূর্ণ নম্রতা প্রকাশ করা। আর ইবনে কাসীর (রঃ) এর উক্তি অনুযায়ী ‘শরীয়তে পূর্ণ ভালবাসা, বিনয় এবং ভয়-ভীতির সমষ্টির নাম হল ইবাদত।’ অর্থাৎ, যে সত্তার সাথে ভালবাসা থাকবে তাঁর অতিপ্রাকৃত মহাক্ষমতার কাছে অসামর্থ্য ও অক্ষমতার প্রকাশও হবে এবং প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তি দ্বারা তাঁর পাকড়াও ও শাস্তির ভয়ও থাকবে। এই আয়াতে সরল বাক্য হল, [نَعْبُدُكَ وَنَسْتَعِيْنُكَ] (আমরা তোমার ইবাদত করি এবং তোমার কাছে সাহায্য চাই।) কিন্তু মহান আল্লাহ এখানে مفعول (কর্মপদকে) فعل (ক্রিয়াপদ)-এর আগে এনে [إيَاكَ نَعْبُدَ وَإيَاكَ نَسْتَعِيْنُ] বলেছেন। আর এর উদ্দেশ্য বিশেষত্ব সৃষ্টি করা। (যেহেতু আরবী ব্যকরণে যে পদ সাধারণতঃ পরে ব্যবহার হয় তা পূর্বে প্রয়োগ করা হলে বিশেষত্বের অর্থ দিয়ে থাকে।) সুতরাং এর অর্থ হবে, ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’ এখানে স্পষ্ট যে, ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য জায়েয নয়, যেমন সাহায্য কামনা করাও তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছে বৈধ নয়। এই বাক্য দ্বারা শির্কের পথ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যাদের অন্তরে শির্কের ব্যাধি সংক্রমণ করেছে, তারা লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা ও অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনার মধ্যে পার্থক্যকে দৃষ্টিচ্যুত ক’রে সাধারণ মানুষদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। তারা বলে, দেখুন! যখন আমরা অসুস্থ হই, তখন সুস্থতার জন্য ডাক্তারের নিকট সাহায্য চাই। অনুরূপ বহু কাজে স্ত্রী, চাকর, ড্রাইভার এবং অন্যান্য মানুষের কাছেও সাহায্য কামনা করি। এইভাবে তারা বুঝাতে চায় যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছেও সাহায্য কামনা করা জায়েয। অথচ প্রাকৃত বা লৌকিক সাহায্য একে অপরের নিকট চাওয়া ও করা সবই বৈধ; এটা শির্ক নয়। এটা তো মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এমন এক নিয়ম-নীতি, যাতে সমস্ত লৌকিক কার্য-কলাপ বাহ্যিক হেতুর ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এমন কি নবীরাও (সাধারণ) মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। ঈসা (আঃ) বলেছিলেন, [مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللهِ] অর্থাৎ, কারা আছে যারা আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্য করবে? (সূরা আলে ইমরান ৫২ আয়াত) আর আল্লাহ তা’য়ালা মু’মিনদেরকে বলেন, [وَتَعَاوَنُوا عَلَى البِرِّ وَالتَّقْوَى] অর্থাৎ, তোমরা নেকী এবং আল্লাহভীতির কাজে একে অন্যের সাহায্য কর। (সূরা মাইদাহ ২ আয়াত) বুঝা গেল যে, এ রকম সাহায্য (চাওয়া ও করা) নিষেধও নয় এবং শির্কও নয়। বরং তা বাঞ্ছনীয় ও প্রশংনীয় কাজ। পারিভাষিক শির্কের সাথে এর কি সম্পর্ক? শির্ক তো এই যে, এমন মানুষের কাছে সাহায্য কামনা করা যে বাহ্যিক হেতুর ভিত্তিতে কোন সাহায্য করতে পারবে না। যেমন, কোন মৃত ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করা, তাকে বিপদ থেকে মুক্তিদাতা এবং প্রয়োজন পূরণকারী মনে করা, তাকে ভাল-মন্দের মালিক ভাবা এবং বিশ্বাস করা যে, সে দূর এবং নিকট থেকে সকলের ফরিয়াদ শোনার ক্ষমতা রাখে। এর নাম হল, অলৌকিক পন্থায় সাহায্য চাওয়া এবং তাকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা। আর এরই নাম হল সেই শির্ক, যা দুর্ভাগ্যক্রমে অলী-আওলিয়াদের মহববতের নামে মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। أعاذنا الله منه
তাওহীদ তিন প্রকারের। এখানে মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর তাওহীদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তাই তাওহীদের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রকারের কথা উল্লেখ করে দেওয়া সঙ্গত মনে হয়। এই প্রকারগুলো হলঃ তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ (প্রতিপালকত্বের একত্ববাদ), তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (উপাস্যত্বের একত্ববাদ) এবং তাওহীদুল আসমা অসসিফাত (নাম ও গুণাবলীর একত্ববাদ)।
১। তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহর অর্থ হল, এই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা, মালিক, রুযীদাতা, নিয়ন্তা ও পরিচালক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। নাস্তিক ও জড়বাদীরা ব্যতীত সকল মানুষই এই তাওহীদকে স্বীকার করে। এমনকি মুশরিক (অংশীবাদী)রাও এটা বিশ্বাস করতো এবং আজও করে। যেমন ক্বুরআন কারীমে মুশরিকদের এ তাওহীদকে স্বীকার করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘‘তুমি জিজ্ঞেস কর, কে রুযী দান করে তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? কে জীবিতকে মৃতের ভিতর থেকে বের করেন এবং কেই বা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তারা বলবে, আল্লাহ।’’ (অর্থাৎ, সমস্ত কর্ম সম্পাদনকারী হলেন আল্লাহ।) (সূরা ইউনুসঃ ৩১) অন্যত্র বলেছেন, ‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ।’’ (সূরা যুমার ৩৮) তিনি আরো বলেছেন, ‘‘জিজ্ঞেস কর, এই পৃথিবী এবং এতে যা আছে তা কার, যদি তোমরা জানো ? তারা ত্বরিৎ বলবে, আল্লাহর; বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না ? জিজ্ঞেস কর, কে সপ্তাকাশ ও মহা আরশের অধিপতি ? তারা বলবে, আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না । জিজ্ঞেস কর, সব কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে; যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যাঁর উপর আশ্রয়দাতা নেই, যদি তোমরা জানো ? তারা বলবে, আল্লাহর। (সূরা মু’মিনুন ৮৪-৮৯) এ ছাড়াও আরো অনেক আয়াত আছে।
২। তাওহীদুল উলূহিয়্যাহর অর্থ হল, সর্ব প্রকার ইবাদতের যোগ্য একমাত্র আল্লাহকে মনে করা। আর ইবাদত সেই সব কাজকে বলা হয়, যা কোন নির্দিষ্ট সত্তার সন্তুষ্টি লাভের আশায় অথবা তাঁর অসন্তুষ্টির ভয়ে করা হয়। (অন্য কথায়ঃ ইবাদত প্রত্যেক সেই গুপ্ত বা প্রকাশ্য কথা বা কাজের নাম, যা আল্লাহ পছন্দ করেন ও যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন।) সুতরাং কেবল নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জই ইবাদত নয়, বরং কোন সত্তার নিকট দুআ ও আবেদন করা তার নামে মানত করা, তার সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা, তার তাওয়াফ করা এবং তার কাছে আশা রাখা ও তাকে ভয় করা ইত্যাদিও ইবাদত। তাওহীদে উলূহিয়্যাহ হল (উল্লিখিত) সমস্ত কাজ কেবল মহান আল্লাহর জন্য সম্পাদিত হওয়া। কবরপূজার ব্যাধিতে আক্রান্ত আম-খাস বহু মানুষ তাওহীদে উলূহিয়্যাতে শির্ক করছে। উল্লিখিত ইবাদতসমূহের অনেক প্রকারই তারা কবরে সমাধিস্থ ব্যক্তিদের এবং মৃত বুযুর্গদের জন্য ক’রে থাকে যা সুস্পষ্ট শির্ক।
৩। তাওহীদুল আসমা অসসিফাত হল, মহান আল্লাহর যে গুণাবলী ক্বুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলিকে কোন রকমের অপব্যাখ্যা এবং বিকৃত করা ছাড়াই বিশ্বাস করা। আর এই গুণাবলীর অনুরূপ অধিকারী (আল্লাহ ছাড়া) অন্য কাউকে মনে না করা। যেমন, অদৃশ্য জগতের জ্ঞান (গায়বী খবর) রাখা তাঁর গুণ, দূর ও নিকট থেকে সকলের ফরিয়াদ শোনার শক্তি তিনি রাখেন, বিশ্বজাহানের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার সব রকমের এখতিয়ার তাঁরই; এই ধরনের আরো যত ইলাহী গুণাবলী আছে আল্লাহ ব্যতীত কোন নবী, ওলী এবং অন্য কাউকেও এই গুণের অধিকারী মনে না করা। করলে তা শির্ক হয়ে যাবে। বড় দুঃখের বিষয় যে, কবরপূজারীদের মধ্যে এই প্রকারের শির্ক ব্যাপক। তারা আল্লাহর উল্লিখিত গুণে অনেক বুযুর্গদেরকে অংশীদার বানিয়ে রেখেছে। أَعَاذَنَا اللهُ مِنْهُ
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
(৬) আমাদেরকে সরল পথ দেখাও
اهدِنَا (হিদায়াত) শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন, পথের দিক নির্দেশ করা, পথে পরিচালনা করা এবং গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়ে দেওয়া। আরবীতে এটাকে ‘ইরশাদ’, ‘তাওফীক্ব’, ‘ইলহাম’ এবং ‘দালালাহ’ ইত্যাদি শব্দে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থ হল, আমাদেরকে সঠিক পথের দিকে দিক নির্দেশ কর, এ পথে চলার তাওফীক্ব দাও এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ, যাতে আমরা (আমাদের অভীষ্ট) তোমার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি। পক্ষান্তরে সরল-সঠিক পথ কেবল জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা অর্জিত হয় না। এই সরল-সঠিক পথ হল সেই ‘ইসলাম’ যা নবী করীম (সাঃ) বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেছেন এবং যা বর্তমানে ক্বুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যে সুরক্ষিত।
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
(৭) তাদের পথ — যাদেরকে তুমি নিয়ামত দান করেছ;[1] তাদের পথ — যারা ক্রোধভাজন (ইয়াহুদী) নয় এবং যারা পথভ্রষ্টও (খ্রিষ্টান) নয়। [2] (আমীন)
এ হল ‘স্বিরাত্বে মুস্তাক্বীম’ তথা সরল পথের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ, সেই সরল পথ হল ঐ পথ, যে পথে চলেছেন এমন লোকেরা যাঁদেরকে তুমি নিয়ামত, অনুগ্রহ ও পুরস্কার দান করেছ। আর নিয়ামত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত দলটি হল নবী, শহীদ, চরম সত্যবাদী (নবীর সহচর) এবং নেক লোকদের দল। যেমন আল্লাহ সূরা নিসার মধ্যে বলেছেন, ‘‘আর যে কেউ আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য করবে (শেষ বিচারের দিন) সে তাদের সঙ্গী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; অর্থাৎ নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ। আর সঙ্গী হিসাবে এরা অতি উত্তম।।’’ (সূরা নিসা ৬৯) এই আয়াতে এ কথাও পরিষ্কার ক’রে বলে দেওয়া হয়েছে যে, পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লোকদের পথ হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের পথ, অন্য কোন পথ নয়।
কোন কোন বর্ণনা দ্বারা সুসাব্যস্ত যে, مَغْضُوْبٌ عَلَيْهِمْ (ক্রোধভাজনঃ যাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়েছে তারা) হল ইয়াহুদী। আর ضَالِّيْنَ (পথভ্রষ্ট) বলতে খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। ইবনে আবী হাতেম বলেন, মুফাসসিরীনদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, {المَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ} হল ইয়াহুদীরা এবং {الضَّالِّينَ} হল খ্রিষ্টানরা। (ফাতহুল ক্বাদীর) তাই সঠিক পথে চলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য অত্যাবশ্যক হল যে, তারা ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টান উভয় জাতিরই ভ্রষ্টতা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে। ইয়াহুদীদের সব থেকে বড় ভ্রষ্টতা এই ছিল যে, তারা জেনে-শুনেও সঠিক পথ অবলম্বন করেনি। তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা করতে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করতো না। তারা উযাইর (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলতো। তাদের পন্ডিত ও সাধু-সন্নাসীদের হালাল ও হারাম করার অধিকার আছে বলে মনে করতো। আর খ্রিষ্টানদের সব থেকে বড় ত্রুটি এই ছিল যে, তারা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ক’রে তাঁকে আল্লাহর পুত্র এবং তিনের এক সাব্যস্ত করেছে। দুঃখের বিষয় যে, উম্মাতে মুহাম্মাদিয়ার মধ্যেও এই ভ্রষ্টতা ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। যার কারণে তারা দুনিয়াতে লাঞ্ছিত এবং ঘৃণিত হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ভ্রষ্টতার গহ্বর থেকে বের করুন; যাতে তারা অবনতি ও দুর্দশার বর্ধমান অগ্নিগ্রাস থেকে সুরক্ষিত থাকে।
সূরা ফাতিহার শেষে ‘আ-মীন’ বলার ব্যাপারে নবী করীম (সাঃ) খুব তাকীদ করেছেন এবং তার ফযীলতও উল্লেখ করেছেন। কাজেই ইমাম এবং মুক্তাদী সকলের ‘আ-মীন’ বলা উচিত। নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ জেহরী (সশব্দে পঠনীয়) নামাযগুলোতে উচ্চস্বরে এমন ভাবে ‘আ-মীন’ বলতেন যে, মসজিদ গমগম করে উঠত। (ইবনে মাজা-ইবনে কাসীর) বলাই বাহুল্য যে, উঁচু শব্দে ‘আ-মীন’ বলা নবী করীম (সাঃ)-এর সুন্নত এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের কৃত আমল।
আ-মীনের কয়েকটি অর্থ বলা হয়েছে। যেমনঃ (كَذَلِكَ فَلْيَكُنْ) এই রকমই হোক। (لاَ تُخَيِّبْ رَجَآءَنَا) আমাদের আশা ব্যর্থ করো না। (اللَّهُمَّ اسْتَجِبْ لَنَا) হে আল্লাহ! আমাদের দুআ কবুল কর।
ফজীলত
সূরা ফাতিহাকে হাদীছ শরীফে “সূরায়ে শিফা” বলা হয়েছে। সূরা ফাতিহা হলো সকল রুগের প্রতিষেধক (কুরতুবী)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমার জীবনাধিপতি ওঁই সত্ত্বার শপথ, সূরা ফাতিহার মতো কোন সূরা তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল অথবা কোন আসমানি কিতাবে নেই। এটা সেই অনুপম ও অনন্য বাণী সপ্তক যা আল্লাহ পাক আমাকেই দান করেছেন। হযরত জাবের (রাঃ) থেকেবর্ণিত , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, হে জাবের! আমি কি বলবো কোরআনের সর্বোত্তম সূরা কোনটি ? হযরত জাবের বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরশাদ করুন,হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ”সূরা ফাতিহা”। ইমাম বুখারী (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বলেছেন, সূরা ফাতিহা কোরআনের দুই তৃতিয়াংশ।
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহার সাতটি আয়াত আমল করবে তাঁর জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ থাকবে। শয়তান চারবার চীৎকার করে কেঁদেছিলো।
১) আদম (আঃ) কে সিজদা না দেয়ায় আল্লাহ তাকে লা’নত দেন তখন
২) জান্নাত থেকে আজাজীলকে বের করে দেয়ার সময়
৩) ঈদ-ই মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিন ও
৪) সূরা ফাতিহা নাযীলের দিন। (বেদায়া ওয়ান নেহায়া)

মাহাত্ত্ব

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হয়, পাঠ করা ওয়াজিব। আল্লাহ পাক ছালাত বা নামাজ ফরজ করেছেন, কোরআন শরীফে ৮২বার নামাজের কথা বলেছেন, কিন্তু একবারও সূরা ফাতিহা পড়ার কথা বলেন নি, বরং বলেছেন, “ফা আকরাউ মা তাইয়াস সারা মিনাল কোরআন” নামাজে কোরআনের যে কোন যায়গা হতে পাঠ কর। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لا صلوة الا بفتحة الكتاب “লা ছালাতা ইল্লা বে ফাতিহাতিল কিতাব” অর্থাৎ সূরা ফাতিহা পাঠ না করা ব্যতীত নামাজ নাই। নামাজ হলো আল্লাহ্’র ইবাদত আর নামাজের নিয়ম কানুন শিখায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবীজি বলেন, “ছাল্লু কামা রায়াইতুমুনি উছাল্লি” অর্থাৎ তুমরা ছালাত আদায় করো যেমনি ভাবে আমাকে আদায় করতে দেখো। কয় ওয়াক্ত নামাজে কয় রাকাত নামাজ, প্রতি রাকাতে কয় রুকু, কয় সিজদা তা আল্লাহ পাক কোরআনে বলেননি, বলেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আসসালাতু মিফতাহুল জান্নাহ” অর্থাৎ জান্নাতের চাবি হলো নামাজ। আর আল্লাহ পাক নামাজের চাবি দান করেছেন নবীজির হাতে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাকাত নামাজে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
(তাফসীরে জালালাইন, মাযহারী, নঈমী, বেদায়া ওয়ান নেহায়া ইত্যাদি)।

মাসআলাঃ-

প্রতি ওয়াক্ত প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব। ইমাম ও একাকী নামাজ আদায় কারীর জন্য নিজ মূখে উচ্চারণ করে এবং মুক্তাদীর জন্য হুকুমী (পরোক্ষ ভাবে) বা ইমামের সাথে মনে মনে শ্রবণ বা পাঠ করা। সহহী হাদীছ শরীফে আছে- قرأة امام له قرأة (ক্বিরআতুল ইমামে লাহু ক্বিরআতুন) অর্থাৎ ইমামের পাঠ করাই মুক্তাদীর পাঠ করা। কোরআন শরীফে মুক্তাদীকে নীরব থাকার এবং ইমামের ক্বিরাত শ্রবণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-
ازا قرىء القران فاستمعوا له وانصتوا (ইজা ক্বুরেয়াল কোরআনু ফাসতামে’উ লাহু ওয়ান চিতু) অর্থাৎ যখন কোরআন শরীফ তালাওয়াত করা হয় তখন তোমরা তা মনযোগ সহকারে শ্রবন করো এবং নিশ্চুপ থাকো। মুসলীম শরীফের হাদীছে আছে- ازا قرأ فانصتوا (ইজা ক্বারাআ ফানচিতু) অর্থাৎ ইমাম যখন ক্বিরাত পাঠ করেন তখন তোমরা চুপ থাকো। এটাই হানাফী মাযহাবের অভিমত।
জানাজার নামাজে দো’আ স্মরণ না থাকলে ‘সূরা ফাতিহা’ দো’আর নিয়তে পাঠ করা জায়েয; কিন্তু ক্বিরাতের নিয়তে জায়েয নয়। (কানযুল ঈমান,আলমগীরী ইত্যাদি)
সূরা ফাতিহা ‘কোরআনের মা’ প্রতি রাকাত নামাজে পাঠ করা ওয়াজিব করা হয়েছে, এই সাত আয়াতের সূরা ফাতিহা’র মধ্যে কি রয়েছে? সূরা ফাতিহা নামাজে আমরা পড়ি ঠিক কিন্তু এর হাকীকত অর্থ আমরা বুঝিনা, বুঝতে চাইনা বা একদল ভূল বুঝাচ্ছেন। বিভিন্ন তাফসীরের আলোকে সূরা ফাতিহার ৭টি আয়াতের এক একটি আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইনশা’আল্লাহ। যদিও হযরত আলী (রাঃ) বলেন, সূরা ফাতিহার ৭টি আয়াতের ব্যাখ্যা যদি করি ৭০টি উঠ লাগবে তা বহন করতে। সূবাহান আল্লাহ!
জ্ঞাতব্য
এ সূরাটি মক্কা ও মদীনা দুই পূণ্যময় স্থানে অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশের মতে মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা ফাতিহায় ৭টি আয়াত, ২৭টি পদ ও ১৪০টি বর্ণ রয়েছে। কোন আয়াত ‘নাসেখ’ (রহিতকারী) ওমানসূখ ( রহিতকৃত) নয়।
ইসতি’আযাহ বা তাআব্বুজঃ- اعوز بالله من الشيطان الرجيم (আ’উজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম) অর্থঃ আল্লাহ’র নিকট পানাহ চাই বিতাড়িত শয়তান হতে।
মাসআলাঃ- কোরআন তেলওয়াতের পূর্বে ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’
পাঠ করা সূন্নত। (তাফসীরে খাযেন)
২য়তঃ কোরআন শরীফ পাঠের পূর্বে ‘আউজুবিল্লাহ’ পাঠ করা ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুন্নাত বলে স্বীকৃত হয়েছে।
মাসআলা
নামজের মধ্যে ইমাম কিংবা একাকী নামাজ আদায় কারীর জন্য ‘সানা’ (সূবহানাকা—-) পাঠ করার পর নীরবে ‘আউজুবিল্লাহ’ পাঠ করা সুন্নাত। (শামী)
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- فازا قرأت القران فاسعز بالله من الشيطان الرجيم
(ফাইজা ক্বারাআতাল কোরআনা ফাসতাইজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম) অর্থাৎ যখন কোরআন পাঠ শুরু করো তখন আল্লাহ’র নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে পানাহ চাও। অতএব প্রমাণীত হলো কোরআন তেলওয়াতের সময় ‘আউজুবিল্লাহ পাঠ করা আল্লাহ’র হুকুম। কোরআন পাঠ ব্যতীত অন্যান্য কাজে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করা সুন্নাত, ‘আ’উজুবিল্লাহ’ নয়। কোরআন তেলওয়াত কালে উভয়টি পাঠ করা সুন্নাত। (আলমগীরি)
তাসমীয়াহঃ- بسم الله الرحمن الرحيم (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম) পাঠ করা।
অর্থঃ- আল্লাহ’র নামে শুরু যিনি পরম দয়ালু করুণাময়।
জ্ঞাতব্য
প্রকাশ থাকে যে, بسم الله الرحمن الرحيم কোরআনের আয়াতের আংশ। সূরায়ে নমলের একটি আয়াত বা অংশ। সূরা ‘তাওবা’ ব্যতীত প্রত্যেক সূরার প্রারম্ভেبسم الله الرحمن الرحيم লিখা বা পাঠ করা হয়। তাসমীয়াহ সূরা ফাতিহার অংশ, না অন্যান্য সকল সূরারই অংশ এতে ইমাম, মোজতাহিদ ও তাফসীরবিদগণের মতানৈক্য রয়েছে। ইমামে আ’জম আবু হানীফা (রাঃ) বলেছেন, بسم الله الرحمن الرحيم সূরা নমল ব্যতীত অন্য কোন সূরার অংশ নয়। তবে এটি এমন একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ আয়াত যা প্রতিটি সূরার প্রথমে লিখা এবং দু’টি সূরার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম হাকেম, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রাঃ) এর নীতিমালা অনুস্মরণে বিশুদ্ধ হাদীছ রুপে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম প্রথম দু’টি সূরার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ণে অসুবিধার সম্মূখীন হতেন, তখন ‘বিসমিল্লাহ’ অবতীর্ণ হয়। (মাযহারী)
মাসাআলা
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” কোরআন শরীফেরই আয়াত, তবে সুরা ফাতিহার অংশ নয়। এ জন্য তেলয়াতের সময় উচ্চরবে তা পাঠ করা হয়না। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীছে বর্ণিত আছে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আবু বকর সিদ্দীক ও হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা ‘আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন’ থেকেই নামাজে ক্বিরাত পড়া শুরু করতেন। অর্থাৎ সূরা ফাতিহার সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উচ্চ রবে পাঠ করতেন না (মনে মনে পড়তেন)।
কোরআন তেলওয়াত ও প্রত্যেক নেক কাজ বিসমিল্লাহ’র সাথে আরম্ভ করার আদেশঃ-
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে লোকদের প্রথা ছিল, তারা তাদের প্রত্যেক কাজ দেব-দেবীদের নামে শুরু করতো। এ প্রথা রহিত করার জন্য হযরত জিব্রাঈল (আঃ) পবিত্র কোরআনের সর্ব প্রথম যে আয়াত নিয়ে এসেছিলেন , তাতে আল্লাহ’র নামে আরম্ভ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ’র প্রেরিত প্রথম ওহী- اقرأ باسم ربك (ইকরা বিসমে রাব্বিকা) অর্থাৎ পাঠ করুন আপনার প্রভূ’র নামে।
কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রথমে কোন কাজ আরম্ভ করতে বলতেন- باسمك اللهم (বিসমিকা আল্লাহুম্মা) এবং কোন কিছু লিখতে হলেও একথা লিখতেন। কিন্তু بسم الله الرحمن الرحيم অবতীর্ণ হওয়ার পর সর্বকালের জন্য ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে সকল নেক কাজ আরম্ভ করার নিয়ম প্রবর্তিত হয়। (কুরতুবী, রুহুল মা’আনী)
মাসআলা
১) কোরআন শরীফের ‘সূরা তাওবা’ ব্যতীত প্রত্যেক সূরা ‘বিসমিল্লাহ’ এর সাথে আরম্ভ করতে হয়। ২) ‘খতম তারাবীহ’র নামাজে’ একবার উচ্চ রবে ‘বিসমিল্লাহ’ অবশ্যই পড়তে হবে। যাতে একটা আয়াত বাদ না পরে। ৩) প্রত্যেক ‘মুবাহ’ বা বৈধ কাজ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আরম্ভ করা মুস্তাহাব। ‘নাজায়েয’ বা অবৈধ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া নিষেধ। ৪) কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ রয়েছে, প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লাহ বলে আরম্ভ করা। ৫) হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়য়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে কাজ বিসমিল্লাহ ব্যতীত আরম্ভ করা হয়, তাতে কোন বরকত থাকেনা। ৬) অন্য হাদীছে এরশাদ হয়েছে, ঘরের দরজা বন্ধ করতে, বাতি নেভাতে ও পাত্র আবৃত করতে বিসমিল্লাহ বলবে। কোন কিছু খেতে, পান করতে, অজু করতে, সওয়ারীতে আরোহণ করতে এবং তা থেকে অবতরণ কালেও বিসমিল্লাহ বলার নির্দেশ কোরআন-হাদীছে বার বার এসেছে। (কুরতুবী)
বিসমিল্লাহ’র তাফসীর
‘বিসমিল্লাহ’ অর্থ আমি আল্লাহ’র নামে আরম্ভ করছি। ‘বিসমি’ শব্ধটি গঠিত হয়েছে ‘বা’ এবং ‘ইসিম’ শব্দ দু’টি দিয়ে। অতি ব্যবহারের ফলে ইসিমের ‘আলিফ’ অক্ষরটি লুপ্ত হয়েছে। ‘ইসিম’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে ‘সামু’ থেকে। ‘বা’ অক্ষরটি সঙ্গী ও সাহায্য কামনা অথবা বরকত অর্জনের জন্য ব্যবহ্রত হয়েছে। আল্লাহ পাকের জিকির দ্বারা সাহায্য কামনা করা হয়ে থাকে। ‘বা’ অব্যয়টি ‘আররাহীম’ শব্দের পরে লুপ্ত একটি ক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ ‘আকরাউ’ বা আমি পড়ি। যেমন ‘বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসাহা’ বাক্যটিতে দেখা যায়। বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে-প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহ’ উল্লেখ থাকাই বাঞ্ছনীয়। আব্দুল কাদীর (রঃ) তাঁর ‘হাবী আরবাইন’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- যে কাজ বিসমিল্লাহ’র সাথে শুরু না হয় সে কাজ অসমাপ্ত থাকে। অর্থাৎ সহজ কথায় এ রকম বলা কর্তব্য যে, আল্লাহ’র নামে আমি পাঠ আরম্ভ করলাম।
আল্লাহঃ- একক ও অবিনশ্বর মহান সৃষ্টিকর্তার জাতি নাম ‘আল্লাহ’। কেহ কেহ আল্লাহ নামটি ‘ইসমে আজম’ বলেছেন। কারো কারো অভিমত হচ্ছে ‘আল্লাহ’ শব্ধটি একটি মৌল শব্দ। কিন্তু প্রকৃত কথা হচ্ছে ‘আল্লাহ’ শব্ধটির উৎপত্তি ঘটেছে ‘ইলাহ’ (উপাস্য) শব্ধটি থেকে। ইলাহ শব্দের ‘হামজা’র স্থলে ‘আলিফ’ ও ‘লাম’ যুক্ত করা হয়েছে। আর এমন সংযুক্ত করা হয়েছে জরুরী ভিত্তিতে, যার দারুন ‘আল্লাহ’ শব্দটি সিদ্ধ। পরিশেষে বলা যায় ‘আল্লাহ’ শব্দটি ঐ চিরস্থায়ী সত্তার মহিমান্বিত নাম, যা সকল প্রকার অপরিচ্ছন্নতা ও অপূর্ণতা থেকে পবিত্র। এজন্যই নামটি স্বমহিমায় ভাস্বর। তাই একত্ব প্রকাশের পবিত্র বাক্যটি হচ্ছে- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।
আর রাহমানির রাহীমঃ- ‘রহমান’ ও ‘রাহীম’ শব্দ দু’টির অর্থ- দাতা ও দয়ালু। দু’টি শব্ধই উৎপন্ন হয়েছে ‘রহমত’ শব্দটি থেকে। রহমত অর্থ আন্তরিক নম্রতা। যার পরিণতি হচ্ছে কল্যাণ ও অনুগ্রহ।
কোন কোন তাফসীর কারকের মতে- ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ শব্দ দু’টি সম অর্থ জ্ঞাপক। বিশেষণের আধিক্য বুঝাতে শব্দ দু’টি একত্রে ব্যবহ্রত হয়েছে। প্রকৃত কথা হলো- ‘রহীম’ শব্দটির তুলনায় ‘রহমান’ শব্দটি ব্যপক আর্থ বোধক। সহজ ভাবে বলতে গেলে এ দুনিয়াতে আল্লাহ ‘রহমান’ অর্থাৎ তাঁর দয়া-দান ব্যপক- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রসারিত। কিন্তু আখেরাতে তিনি ‘রহীম’ অর্থাৎ পরকালে তাঁর দয়া-দান শুধু পূণ্যবানদের জন্য।
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বাক্যটিতে ১৯টি আক্ষর রয়েছে। প্রতি অক্ষরে ১০টি নেকী তাই একবার ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ পাঠ করলে একশত নব্বই নেকী আমল নামায় যোগ হবে।
(তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে রুহুল মা’আনী, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে নঈমি, খাজাইনুল ইরফান, বুখারী, মুসলিম, কুরতুবী ইত্যাদি)
তাফসীরঃ- – الحمد لله رب ٍالعلمين
আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন।
অর্থঃ- সকল প্রশংসা আল্লাহ’র প্রতি, যিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক।
ব্যাখ্যাঃ- “ আলহামদুলিল্লাহ”এখানে তিনটি শব্দ, ‘আল’ ‘হামদু’ লিল্লাহ’।আল- আলীফ+ লাম, আলীফ-লাম এখানে দুই অর্থে ব্যবহ্রত হতে পারে, ১) আলীফ লামে ‘এস্তেগরাকী ২) আলীফ লমে ‘অহুদী। (তাফসীরে রুহুল বয়ান) হামদ এর পূর্বে ‘আলীফ-লামেএস্তেগরাকী’ হলে অর্থ হবে, সব সময়-সর্বাবস্থায় যাবতীয় প্রসংসা বা গুণকীর্তন আল্লাহ’র জন্য। পার্থিব সৌন্দয্যের মৌখিক প্রকাশের নাম ‘হামদ’। সে সৌন্দয্যের সাথে নে’য়ামত বা অনুগ্রহ রাজী সম্পৃক্ত থাকুক বা না থাকুক। ‘হামদ’ শব্দটি ‘মাদাহ’ শব্দটির সঙ্গে সাধারণভাবে তুলনা মূলক সম্পরক ধারী। পার্থিব কিংবা অপার্থিব সৌন্দরয্য প্রশংসিত হলে, ঐ প্রশংসাকে ‘মাদহা’ বলে। ‘হামদ’ এর সাথে ‘আল’ যুক্ত হয়ে সুনির্দিষ্ট শব্দটি গঠিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে- এই সুনির্দিষ্ট অবস্থাটি কি? একটিতো জাতি বাচক বিশেষণ যা সর্ব জন বিদিত। আর অপরটি হচ্ছে সামষ্টিক প্রকাশ। সমষ্টি গত ভাবে সকল প্রশংসাইতো আল্লাহ পাকের জন্যে। তিনি তাঁর বন্দাগণের কারয্য সমূহের স্রষ্ঠা। আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা যা কিছু নে’য়ামত পেয়েছো, সে সমস্ত আল্লাহ’র দিক থেকেই এসেছে’। এতে এরকম ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ পাক জীবিত, ক্ষমতাশালী, অভিপ্রায়কারী ও শক্তির মালিক। এ কারণে তিনি সকল প্রশংসার অধিকারী।
এরপরের শব্দটি হলো- ‘লিল্লাহ’। ‘লিল্লাহ’ শব্দের অর্থ শুধু আল্লাহ’র জন্য। ‘লি’ আল্লাহ শব্দটি কে সুনির্দিষ্ট করেছে। আরবী ভাষারীতি অনুযায়ী ‘আলহামদুলিল্লাহ’ একটি পূর্ণ বাক্য- যার অর্থ হলো, সমস্ত প্রশংসা কেবলই আল্লাহ’র। এ বাক্যটির মাধ্যমে বান্দাদেরকে প্রশস্তি প্রকাশের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। আর বাক্যের উহ্য অংশটিসহ পূর্ণ বাক্যটি হবে এ রকম- ‘কুল আলহামদুলিল্লাহ’ অর্থাৎ হে মানব মন্ডলী! বলো, সকল প্রশংসা শুধু আল্লাহ’র জন্যে। (তাফসীরে মাযহারী)
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ পাক কোরআন শরীফের শুরুতে নিজের প্রশংশা দিয়ে শুরু করেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আল্লাহ এমনই এক পবিত্র স্বত্তা যার কোন আ’য়িব নেই বা অপ্রশংসা নেই। যাবতীয় দুষ-ত্রুটি থেকে তিনি মুক্ত। অতএব দেওবন্দী-কওমীদের কথা, ‘আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন, তবে বলেন না’ (নাউজুবিল্লাহ) একটি কুফুরী মতবাদ। একথাটি আল্লাহ পাকের শানের খেলাফ। নাস্তিক- মুরতাদরাই একথা বলতে পারে।
মাসাআলা
প্রতিটি কাজে ‘বিসমিল্লাহ’র’ মতো ‘হামদ’ বা আল্লাহ’র প্রশংসার মাধ্যমে আরম্ভ করা।
‘হামদ’ কখনো ওয়াজিব; যেমন জুম’আর খোতবায়। কখনো মুস্তাহাব; যেমন বিবাহের খোতবায়, দোয়ায়, প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রারম্ভে এবং প্রত্যেক পানাহারের পর। কখনো সূন্নাতে মুয়াক্কাদাহ; যেমন হাঁচি আসার পর।(তাহতাবী শরিফ)
জ্ঞাতব্য
‘আলহামদুলিল্লাহ’ কোরআনের শুরুতে বলারকারণএওহতেপারেযে, হযরতআদম (আঃ) প্রথমসৃষ্টিহওয়ারপরহাঁচিআসে, তখনতিনিবলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এ কারণে আল্লাহ পাক কোরআনের শুরুতে এবাক্যটি এনেছেন। কারণ এটি আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম জিকির বা কথা বা আল্লাহ’র প্রশংসা। আর একারণে আমাদের উপরও এ হুকুম হাঁচি আসলে ‘ আলহামদুলিল্লাহ’ বলা, আর শ্রবনকারী উত্তরে বলবে ‘ইয়ারহামু কুমুল্লাহ’। তাছাড়া ‘ আলহামদুলিল্লাহ’ এর মধ্যে ৮টি অক্ষর এবং জান্নাত ও ৮টি। বিশুদ্ধ অন্তরে যে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়বে জান্নাতের ৮টি দরজা তার জন্য খোলা থাকবে। এটাও বুঝানো হয়েছে পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠকারী শুরুতেই জান্নাতের খোশ খবরী নিয়ে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত আরম্ভ করবে।
(তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে নঈমী, খাজাইনুল ইরফান, তাহতাবী শরিফ ইত্যাদি)
رب العلمن “রাব্বিল আ’লামীন”ঃ- “আলহামদুলিল্লাহ” এর পরেই আল্লাহ পাকের গুন বাচক নাম ‘রাব্বুল আ’লামীন’ উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় ‘রাব্বুন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘মালিক, সর্দার ও পালন কর্তা’। এ তিনটি অর্থই এখানে প্রযোজ্য।
লালন-পালন বলতে বুঝায়, কোন জীবকে তার সমস্ত মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধীরে ধীরে বা পর্যায় ক্রমে সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়।
‘রব’ শব্দের আরেকটি অর্থ ‘স্বত্বাধিকারী’। যেমন বলা হয়, রব্বিদ দার’-গৃহের স্বত্বাধিকারী। ‘রব’ শব্দটি ‘তরবিয়ত’ অর্থেও ব্যবহ্রত হতে পারে। কোন কিছুকে ক্রম-পরিণতির দিকে পৌছানোর নাম ‘তরবিয়ত’। ‘রব’ শব্দটি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে না। আর বিশ্ব জগত সমূহের উন্মেষ, স্থিতি ও স্থায়িত্ব রবের মূকাপেক্ষী। প্রাকাশ থাকে যে, কোরাআনের শুরুতে আল্লাহ’র গুণ বাচক নামের মধ্যে ‘রব’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। কারণ আখিরাতের প্রথম মঞ্জিল ‘কবরে’ প্রথম প্রশ্ন করা হবে, ‘মার রাব্বুকা’ বা তুমার রব বা প্রভূকে? উত্তরে বলতে হবে ‘ রাব্বি আল্লাহ’ বা আমার প্রভূ বা প্রতিপালক আল্লাহ। এ শিক্ষাটুকু কোরআনের শুরুতে আল্লহপাক দিচ্ছেন।
আ’লামীনঃ- আরবী ‘আলম’ শব্দের বহু বচন ‘আলামীন’। যার অর্থ সমস্ত মাখলুকাত বা সৃষ্টি জগত। আল্লাহ পাক নিজের শানে বলেছেন ‘রাব্বিল আ’লামীন’ বা সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রভূ, আর ছাহেবে কোরআন আল্লাহ’র হাবীবের (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে বলেছেন, ‘রাহমাতাল্লীল আ’লামীন’ অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টি জগতের ‘রহমত’। আল্লাহ- রব আর নবী-রাহমত। জগতের রয়েছে বহু স্তর বিন্যাস। তাই এখানে ‘আলামীন’ বহু বচনের ব্যবহারই সঙ্গত হয়েছে। তন্মধ্যে পৃথিবী ১টি আলম। বিশ্ব সমূহের তুলনায় পৃথিবী যেন সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে একটি তস্তুরী বা প্লেইট। হযরত কা’ব আহরার (রাঃ) বলেছেন, আলম সমূহের সংখ্যা এবং আল্লাহ পাকের সৈন্য সংখ্যা আল্লাহ পাক ছাড়া অন্য কারো জানা নাই। কেহ কেহ বলেছেন, জ্ঞান সম্পন্ন সৃষ্টি কুলের নাম ‘আলম’। যেমন মানুষ, ফেরেশতা ও জ্বীন। অন্যান্য সৃষ্টি এদের অধীন।
– الرحمن الرحيم
(আর রাহমানির রাহিম)
(তিনি) পরম দাতা ও দয়ালু
‘রাব্বুল আ’লামীনের’ কারণ স্বরূপ ‘আর রাহমানির রাহীম’ উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ কেন তিনি বিশ্ব সমূহের প্রভূ? উত্তর হলো- এ কারণে যে, তিনি রহমান ও রহীম। রাহমান ও রাহীম শব্দ দু’টি সমার্থবোধক হলেও গুনগত দিক থেকে পার্থক্য বিদ্যমান, যেমন এ দুনিয়াতে আল্লাহ পাক ‘রহমান’, এর ব্যপকতা রয়েছে। অর্থাৎ পাপি-তাপী, ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সবার প্রাতি তিনি দয়ালু, তাই তিনি এ দুনিয়ার জন্য ‘রাহমান’। কিন্তু পরকালে তিনি ‘রহীম’, অর্থাৎ শুধু নেককারদের দয়া করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, মহান রাব্বুল আ’লামীনের জাতী নাম দু’টি ‘ আল্লাহ’ ও ‘রহমান’। যেমন সূরায়ে বণী-ইসরাঈলের ১১০নং আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ”কুল উদওল্লাহা আওয়িদউর রহমান” অর্থাৎ (হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) আপনি বলুন! তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাকো অথবা ‘রাহমান’ নামে ডাকো।
তাছারা এও হতে পারে যে, ‘হামদ’ বা প্রশংসা এর সাথে রহমত জড়িত। যে আল্লাহ’র প্রশংসা করবে সে অবশ্যই আল্লাহ’র রহমত লাভ করবে। হযরতআদম (আঃ) পয়দা হওয়ার পর পরই হাঁচি দিয়ে বলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ সাথে সাথে ফিরিশতারা জবাবে বলেন ‘ইয়ার হামু কাল্লাহ’।
ملك يوم الدين
মালিকি ইয়াউ মিদ্দিন
বিচার বা প্রতিফল দিবসের মালিক
মালিকঃ- এ শব্দটি দু’ রকম ক্বিরাতে পড়া যায়। মালিক ও মা-লিক। ‘মালিক’ ও ‘মা-লিক’ এর অর্থ একই। যেমন, ‘ফারিহীন’ ও ‘ফা-রিহীন’, ‘হাজিরীন’ ও ‘হা-জিরীন’। প্রকৃত কথা হচ্ছে, সত্ত্বাধিকারী হিসেবে ব্যবহ্রত ‘মা-লিক’ শব্দটি ‘মালিক’ শব্দ থেকে গঠিত হয়েছে। আরবী ভাষায় প্রবাদ রয়েছে ‘মা-লিকুদ্দার’ অর্থ ‘রাব্বুদ্দার’ অর্থাৎ ঘরের সত্ত্বাধিকারী। ‘মালিক’ শব্দের অর্থ রাজা বা সম্রাট- যা গঠিত হয়েছে ‘মূলুক’ শব্দটি থেকে। ‘মালিক’ ও ‘মা-লিক’ এ দু’ রকম উচ্চারণই আল্লাহ পাকের বিশেষণ রূপে সুবিদিত। কেউ বলেছেন, মালিক অথবা মা-লিক তিনিই, যিনি অনস্তিত্বকে অস্তিত্ব দান করতে সক্ষম। তাই এ শব্দ দু’টিকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা বৈধ নয়।
ইয়াউ মিদ্দিনঃ- অর্থ প্রতিফল দিবস। ঐ দিবসকে প্রতিফল দিবস বলে, যে দিন পুরুস্কার ও তিরস্কার কার্যকর হবে। ‘কামাতুদিনু তুদান’ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘দ্বীন’ শব্দ হতে। এর অর্থ হচ্ছে, যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থই সলাম ও আনুগত্যও হতে পারে। কেননা ঐ সময় ইসলাম ও আনুগত্য ব্যতীত অন্য কিছুই ফলদায়ক হবে না।
প্রতিফল দিবসের স্বরূপ ও তার প্রয়োজনীয়তাঃ-
প্রথমতঃ প্রতিদান দিবস কাকে বলে এবং এর স্বরূপ কি? দ্বিতীয়তঃ সমগ্র সৃষ্টির উপর প্রতিদান দিবসে যেমনি ভাবে আল্লাহ তা’য়ালার একক অধিকার থাকবে, অনুরূপ ভাবে আজও সকল কিছুর উপর তাঁরইতো একক অধিকার রয়েছে; সুতরাং প্রতিফল দিবসের বৈশিষ্ট্য কোথায়?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, প্রতিদান-দিবস ঐদিনকেই বলা হয়, যে দিন আল্লাহ তা’আলা ভাল-মন্দ সকল কাজ-কর্মের প্রতিদান দিবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। রোজে- জাযা শব্দ দ্বারা বোঝানু হয়েছে যে, এ দুনিয়া ভাল-মন্দ কাজ-কর্মের প্রকৃত ফলাফল পাওয়ার স্থান নয়; বরং এটি হলো কর্মস্থল; কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জায়গা। যথার্থ প্রতিদান ও পুরুস্কার গ্রহণের স্থান এটি নয়। এতে একথাও বুঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে কারও অর্থ- সম্পদের আধিক্য ও সূখ-শান্তির ব্যপকতা দেখে বলা যাবেনা যে, এ ব্যক্তি আল্লাহ’র দরবারে মাকবুল।
এ জন্যই নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এ দুনিয়ার জীবনে সর্বাপেক্ষা বেশী বিপদাপদে পতিত হয়েছেন এবং তারপর আউলিয়াগণ অধিক বিপদে পতিত হন। কিন্তু দেখা গেছে বিপদের তীব্রতা যতই কঠিন হউক না কেন, দৃঢ় পদে তাঁরা তা সহ্য করেছেন। এমনকি আনন্দ চিত্তে তাঁরা তা মাথা পেতে নিয়েছেন। মোটকথা, দুনিয়ার আরাম আয়াশকে সত্যবাদিতা ও সঠিকতা এবং বিপদাপদকে খারাপ কাজের নিদর্শন বলা যায় না।
অবশ্য কখনো কোন কোন কর্মের সামান্য ফলা ফল দুনিয়াতে ও প্রকাশ করা হয় বটে, তবে তা সে কাজের পূর্ণ বদলা হতে পারে না। এগুলো সাময়িক ভাবে সতর্ক করার জন্য একটু নিদর্শন মাত্র।
اياك نعبد و اياك نستعين
ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন
(হে করুণা নিধান দয়াময়)
আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি
রাব্বিল আ’লামীন, আর রাহমানির রাহীম, মালিকি ইয়াউ মিদ্দিন এ সকল বর্ণনার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, আল্লাহ পাক সমস্ত স্তব-স্তুতির অধিকারী। তাই তিনি ব্যতীত উপাসনা লাভের যোগ্য কে?
ইয়্যাকা না’বুদু (আমরা তোমারই ইবাদত করি)- এ বাক্যটির ভূমিকা স্বরূপ প্রথমেই আল্লাহ তা’আলার গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমাণ করা হয়েছে আল্লাহ তা’আলার একত্ব, পরাক্রম এবং দয়া দাক্ষিণ্যকে। এভাবেই প্রমাণিত হয়েছে সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার পার্থক্য। অর্থাৎ সৃষ্টি মাত্রই স্রষ্টার উপাসনা-বন্দেগী করবে। বান্দা এবার উচ্চারণ করুক ‘ ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন’ অর্থাৎ (হে দয়াময়) আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
আরবী ভাষায় বাক ভঙ্গির বিভিন্ন রূপান্তর রীতি সিদ্ধ। ‘প্রথম’ থেকে ‘মধ্যম’ পুরুষ এর কম বাক ভঙ্গি আরবী ভাষায় সুপ্রচল। এ রকম রূপান্তরশীল বাক ভঙ্গির উদ্দ্যশ্য হচ্ছে, শ্রোতার অন্তরে উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করা। ইবাদত বা উপাসনা হচ্ছে চরম অসহায়ত্ব ও চুড়ান্ত পর্যায়ে বিনয়-নম্রতার নাম।
‘ন’বুদু’ ও ‘নাসতাঈন’ শব্দ দু’টিতে উত্তম পুরুষের বহুবচন ‘আমরা’ ব্যবহ্রত হয়েছে। এতে করে পাঠকের সঙ্গে তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ সম অংশীদার হন। এ বর্ণনা ভঙ্গিটি হচ্ছে দলবদ্ধ উপাসনার প্রতি ইঙ্গিত।আরবী ব্যকরণ অনুযায়ী ‘ইয়্যাকা’ শব্দটি ক্রিয়া ও কতৃপদের পরে আসার কথা। কিন্তু এখানে পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ পাকের মহিমা, উপাস্য হওয়া এবং সাহায্য দাতা হওয়ার বিষয়টিকে সুনির্দিষ্ট করা।
মাসা’আলাঃ- ‘না’বুদু’ বহু বচন ক্রিয়া পদ ইবাদতকে জামা’আত সহকারে বা দল বদ্ধ ভাবে আদায় করার বৈধতাও প্রমাণিত হয়। একথাও বুঝা যায় যে, সাধারণ মুসলমানের ইবাদত আল্লাহ’র প্রিয় বান্দাদের ইবাদতের সাথে মিলে কবূলিয়াতের মর্যাদা লাভ করে। আর এতে শিরক বাতিল হয়েছে। কারণ আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কারোর জন্য ইবাদত হতে পারে না।
প্রকাশ থাকে যে, ওহাবী পন্থীরা এ আয়াতে কারীমা দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া ‘শিরক’ বলে থাকে। যেহেতু এখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি’।
এর জবাব হচ্ছে, এখানে সাহায্য বলতে যথার্থ বা প্রকৃত সাহায্যের কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মূলতঃ তোমাকেই প্রকৃত সাহায্যকারী হিসেবে বিশ্বাস করি। এখন রইলো বান্দার কাছ হতে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারটি। বান্দার কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া হয় তাদেরকে ফয়জে ইলাহী লাভের মাধ্যম রূপে বিশ্বাস করে। যেমন কোরআনে আছে, ‘ইনিলহুকমু ইল্লা লিল্লাহি’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম করার অধিকার নাই। অন্যত্র আছে- ‘লাহু মা ফিস সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ’ অর্থাৎ আসমান-জমিনে যা কিছু আছে সব কিছু আল্লাহ’রই। তারপরও আমরা সরকার বা শাসক বর্গের হুকুম মান্য করি। নিজেদের জিনিসের উপর মালিকানা দাবী করি। অতএব বুঝা যায় যে, উপরোক্ত আয়াত দ্বয়ে হুকুম ও মালিকানা বলতে, প্রকৃত হুকুম ও মালিকানাকে বুঝানো হয়েছে। বান্দাদের বেলায় কিন্তু হুকুম ও মালিকানা আল্লাহ প্রদত্ত।
তাছাড়া উক্ত আয়াতে যে ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে, এ দু’য়ের মধ্যে সম্পর্ক কি তা নির্ণয় করতে হবে। এ দু’টি বিষয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে তাহলো, আল্লাহকে প্রকৃত সাহায্যের উৎস মনে করে সাহায্য প্রার্থনা করা ও ইবাদতের একটি অংশ। পুজারীগণ মূর্তি-পূজার সময় সাহায্যের আবেদন সম্বলিত শব্দাবলী উচ্চারন করে থাকে। যেমন, ‘মা-কালী’ তোমার দোহাই ইত্যাদি। এ উদ্দেশ্যেই ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনা কথা দু’টির একত্রে সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। আয়াতের লক্ষ যদি এই হয়ে থাকে যে, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো কাছ থেকে যেকোন ধরনের সাহায্য প্রার্থনাই ‘শিরক’ তাহলে পৃথিবীর বুকে কেহ মুসলমান থাকতে পারেনা। কারণ এখনো মসজিদ-মাদ্রাসার চাঁদার জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তি বর্গের সাহায্য ভিক্ষা চাওয়া হয়। মানুষ তার জন্ম লগ্ন থেকে কবরস্থ হওয়া পর্যন্ত, এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত বান্দাদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। ধাত্রির সাহায্যে জন্ম গ্রহণ করা, পিতা-মাতার মাধ্যমে লালিত-পালিত হওয়া, শিক্ষকের সাহায্যে জ্ঞান অর্জন করা, মৃত্যুর পর আত্মীয় স্বজন দ্বারা কবর খনন, কাফন-দাফন হওয়া ইত্যাদি কাজ গুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। তাহলে আমরা কোন মুখে বলতে পারি যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো মুখাপেক্ষী নই? তাহলে বুঝা গেলো প্রকৃত সাহায্য আল্লাহ’রই কিন্তু অন্যের সাহায্য হলো উসীলা।
اهدنا الصراط المستقيم
ইহদিনাস সিরা-তালমুস্তাকীম
অর্থাৎ (হেআল্লাহ্!) আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।
সোজা রাস্তা, যাতে কোন আঁকা-বাকা নেই। এ সরল পথই মানুষের চরম আর্তি এবং প্রাপ্তি। তাই পৃথক বাক্যের মাধ্যমে এ প্রার্থনাটি পেশ করা হয়েছে। হেদায়েতের প্রকৃত অর্থ হলো- বিনম্র পথ প্রদর্শন। কেবল কল্যাণ ও পূণ্য বুঝাতেই ‘হেদায়েত’ শব্দটি ব্যবহ্রত হয়। ‘আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করো’ এ প্রার্থনাটি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে উচ্চারিত তাঁর সকল উম্মতের প্রার্থনা। তাঁর হেদায়েত প্রাপ্তিতো পূর্বেই সুনিশ্চিত ছিলো। এ প্রার্থনাটি উচ্চারনের মাধ্যমে তিনি তাঁর উম্মতকে হেদায়েত প্রাপ্তির নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। অবশ্য হেদায়েত প্রাপ্তদের জন্যও এ প্রার্থনাটি জরুরী। প্রকৃত বিশ্বাসীদের অন্তরে অধিকতর হেদায়েত প্রাপ্তির কামনা চির বহ্নি মান। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এটাই মতাদর্শ যে, আল্লাহ পাকের করুণা ও হেদায়েত অন্তহীন। (তাফসীরে মাযহারি)
‘আমাদেরকে সরল পথ দেখাও’- আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা ও গুণাবলীর পরিচয়ের পর ইবাদত, তারপর প্রার্থনা শিক্ষা দিচ্ছেন। এ থেকে এ মাস’আলা জানা যায় যে, বান্দাদের ইবাদতের পর দোয়ায় মগ্ন হওয়া উচিৎ। হাদিছ শরীফেও নামাজের পর দোয়া বা প্রার্থনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। (তাবরানী ফিল কবীর ও বায়হাকী)
‘সিরাতাল মুস্তাকীম’ দ্বারা ‘ইসলাম’ বা ‘কোরআন শরীফ’ কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূত-পবিত্র চরিত্র, অথবা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরিবার-পরিজন (আহলে বায়ত) ও সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম এর কথাই বুঝানো হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, ‘সিরাতুল মূস্তাকীম’ হলো, আহলে সুন্নাতেরই অনুসৃত পথ; যারা আহলে বায়ত, সাহাবা-ই কিরাম, কোরআন ও সুন্নাহ এবং ‘বৃহত্তমজামাত’ সবাইকে মান্য করে। (খাজাইনুল ইরফান)
‘মুস্তাকীম’ অর্থ সমতল বা সরল। প্রকৃত অর্থ হলো সত্য পথ। কেউ কেউ অর্থ করেছেন ‘ইসলাম’। হজরত আবুল আলিয়া এবং ইমাম হাসান (রাঃ) বলেছেন, সিরাতুল মুস্তাকীম হচ্ছে হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর প্রধান সহচর হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা এর পথ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার পরে আমার আদর্শ এবং খোলফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধর। তিনি আরো নির্দেশ করেছেন, আমার পরে আবু বকর ও ওমরের (রাঃ) অনুসারী হইও। (তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে নঈমী,খাজাইনুল ইরফান ইত্যাদি)
صراط الذين انعمت عليهم
সিরা-তাল্লাযীনা আন’আমতা আ’লাইহীম-
অর্থাৎ তাঁদের পথ যারা আপনার নে’আমত বা অনুগ্রহ লাভ করেছে।
এ আয়াতে কারীমা ‘সিরাতাল মুস্তাকীমের’ ব্যাখ্যা। যারা আপনার অনুগ্রহ বা দয়া পেয়েছে তাঁদের পথই সোজা-সরল রাস্তা। এতে করে এ কথাটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, ঐ সমস্ত প্রিয়জন লোকের পথ যাদের মুস্তাকীম হওয়ার বিষয়টি সুস্বীকৃত। এর অর্থ দাঁড়াবে এরকম- হে আল্লাহ্! আমাদেরকে ঐ সমস্ত লোকের পথানুগামী করো, যাঁদের কে তুমি করুণা সিক্ত করেছো। ঐ করুণা সিক্ত লোকেরাই ঈমান ও আনুগত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আর করুণা সিক্ত বা অনুগ্রহ প্রাপ্ত প্রিয় ভাজন কারা আল্লাহ পাকই সূরা নিসা’র ৬৯নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন- “আল্লাজিনা আন’আমাল্লাহু আলাইহিম মিনা ন্নাবীয়্যিনা ওয়াস সিদ্দীকিনা ওয়াশ শোহাদায়ে ওয়াস সালেহীন” অর্থাৎ নে’আমত প্রাপ্তরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালেহীনগণ। আল্লাহ’র দরবারে মকবুল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নবীগণের। অতঃপর নবীগণের উম্মতের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী, তাঁরা হলেন ‘সিদ্দীক’ যাদের মধ্যে রূহানী কামালিয়াত ও পরিপূর্ণতা রয়েছে, সাধারন ভাষায় তাঁদেরকে ‘আউলিয়া’ বলা হয়। আর যারা দ্বীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় শহীদ। আর সালেহীন হলো সৎকর্ম পরায়নশীল তাঁরাও আউলিয়া শ্রেনী ভূক্ত।
অতএব, বুজুরগানে দ্বীন বা আউলিয়ায়ে কিরাম যে সকল আমল করেছেন বা যে পথে চলেছেন তা-ই ‘সিরাতাল মুস্তাকীম’।এছাড়াএটাওপ্রমাণিতহলোহযরতআবুবকরসিদ্দীক (রাঃ) এর খেলাফত হক্ব বা সঠিক। কেননা সিদ্দীকিনদের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। ( দৈনিক নামাজের প্রতি রাকা’আতে আমরা সূরা ফাতিহা ওয়াজিব হিসেবে পাঠ করি, আর নবী-অলী’র পথ অনুস্মরণ করার জন্য ফরিয়াদ করি, কিন্তু বাস্তবে তা কয়জনে মানি?)
তাফসীরে জালালাইন, মাযহারী, কবীর, নঈমী, খাজাইনুল ইরফান, মা’আরেফুল কোরআন ইত্যাদি।
غير المغضوب عليهيم ولا الضالين
গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বাল্লিন (আমিন)-
অর্থাৎ যারা আপনার অভিসম্পাত গ্রস্ত বা গজব গ্রস্ত তাঁদের পথে নয়, তাদের পথেও নয় যারা পথহারা হয়েছে।
এ বাক্যটি ‘আন’আমতা আলাইহিম’ বাক্যের ব্যাখ্যা বোধক। এ বাক্যে ও হেদায়েত রয়েছে। অর্থাৎ যাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর করুণা দানে ধন্য করেছেন, তারাই আল্লাহ’র গজব ও পথভ্রষ্ঠতা থেকে মুক্ত বা সুরক্ষিত।
প্রতি শোধ স্পৃহার উল্লাস ও উদ্দীপনার নাম গজব। কিন্তু এর সম্পর্ক যখন আল্লাহ’র সঙ্গে করা হয়, তখন তাঁর মর্ম হবে গজবের পরিণাম বা পরিসমাপ্তি। ‘আযাব’ এবং ‘দালালাহ’ শব্দ দু’টি হেদায়েতের পথের বিপরীত অর্থ বোধক শব্দ অর্থাৎ যে পথ আল্লাহ পর্যন্ত পৌছায়, ঐ পথের প্রতি বিমূখতাই দালালাহ বা পথভ্রষ্ঠতা। হযরত আদি বিন হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যাদের প্রতি গজব অবতীর্ণ হয়েছে তারা ‘ইহুদী’, আর যারা পথভ্রষ্ঠ তারা ‘খৃষ্টান’। এ হাদীছটি ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে হাব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে লিপি বদ্ধ করেছেন। তিরমীজি স্বীকার করেছেন হাদিছটি হাসান।
তাফসীরে মাযহারী লেখক বলেন, ‘গাইরীল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বাল্লিন’ অর্থাৎ গজব গ্রস্ত ও পথভ্রষ্ঠ- এ শব্দ দু’টিতে সাধারন ভাবে সকল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, অবাধ্য এবং বেদাতী সম্প্রদায় শামীল রায়েছে।
মাস’আলা- সত্য-সন্ধানীদের জন্য, আল্লাহ’র দুশমন থেকে দূরে থাকা এবং রীতি-নীতি থেকে বিরত থাকা একান্ত আবশ্যক। তিরমীজি শরীফের হাদিছ দ্বারা জানা যায়, ‘মাগদুবি আলাইহিম’ যারা ‘ইহুদী’ এবং ‘দোয়াল্লিন’ দ্বারা ‘খ্রিষ্টানদের’ কথা বুঝানো হয়েছে।
মাস’আলা- ‘দোয়াদ’ ও ‘যোয়া’ এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন বৈশিষ্ঠ্যে অক্ষর দু’টির মিল থাকা, উভয়কে এক করতে পারে না।কাজেই ‘মাগদুবি’ এর মধ্যে ‘যোয়া’ সহকারে পাঠ করা যদি ইচ্ছা কৃত হয়, তাহলে তা হবে কোরআন শরীফের বিকৃতি সাধন ও কুফর নতুবা নাজায়েয।
মাস’আলা- যে ব্যক্তি ‘দোয়াদের’ স্থলে ‘যোয়া’ পড়ে সে ব্যাক্তির ইমামত জায়েয নয়।
আমিন- এর অর্থ হলো ‘এরূপকরো’ অথবা ‘কবুল করো’।
মাস’আলা- ‘আমিন’ এটা কোরআনের শব্দ নয়। সূরা ফাতিহা পাঠান্তে নামজে ও নামাজের বাইরে ‘আমীন’ বলা সূন্নাত। আমাদের হানাফী মাযহাবে নামাজে নীরবে আমিন বলতে হয়।
‘সূরা আল ফাতিহার’ আয়াত সাতটির তাফসীর শেষহয়েছে। এখন সমগ্র সূরার সার মর্ম হচ্ছে এ দোয়া- ‘হে আল্লাহ্! আমাদিগকে সরল পথ দান করুন। কেননা সরল পথের সন্ধান লাভ করাই সবচাইতে বড় জ্ঞান ও সর্বাপেক্ষা বড় কামিয়াবী। বস্তুতঃ সরল পথের সন্ধানে ব্যর্থ হয়েই দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হয়েছে। অন্যথায় অ-মুসলমানদের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুস্মরন করার আগ্রহ-আকুতির অভাব নেই। এ জন্যই কোরআন শরীফে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় পদ্ধতিতেই সিরাতে মুস্তাকীমের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আর সূরায়ে ফাতিহাতে নবী-অলী’র পথকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলা হয়েছে। সূরা ফতিহাকে ‘উম্মূল কোরআন’ বলা হয়। যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা বুঝতে পারলো সে গোটা কোরআন শরীফ ও ইসলামকে বুঝতে পারলো। সমাপ্ত।
( তাফহীমুল কুরআন,   তাফসীরে রুহুল বয়ান, মাযহারী, জালালাইন, কবীর, খাজাইনুল ইরফান, মা’রেফুল কোরআন, তিরমীজি শরিফ ইত্যাদি)

হিন্দুকে সালাম দেয়া যাবে কি? - প্রশ্ন: ১৯৫


হিন্দুকে সালাম দেয়া যাবে কি?



জিজ্ঞাসা–২৭৯: আসছালামুআলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহ। আশা করি, আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন। আমি একটা কম্পানিতে চাকরি করি। এখানে অধিকাংশ দোকানপাট হিন্দুদের। তাদের সাথে সৌজন্যমূলক ‘আসছালামুআলাইকুম’ বলা যাবে কি?–Md Rabiul islam : Trrabiul@gmail.com
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, সালাম ইসলামের সৌন্দর্য, একজন মুসলিম ভাইয়ের উপর অপর মুসলিম ভাইয়ের হক ও অধিকার। সুতরাং সালাম শুধু এক মুসলিম ভাই আরেক মুসলিম ভাইকেই দিতে পারবে। কোনো অমুসলিমকে সালাম দেওয়া যাবে না। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ  স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,لا تبدءوا اليهود ولا النصارى بالسلام ‘তোমরা ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের প্রথমে সালাম দেবে না।’ (মুসলিম ২১৬৭)
তবে কোনো অমুসলিম আগে সালাম দিয়ে ফেললে উত্তরে ‘অয়া আলাইকুম’ বলবে। কেননা, রাসূলুল্লাহ  বলেন, ﺇﺫﺍ ﺳﻠﻢ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏﻓﻘﻮﻟﻮﺍ ﻭﻋﻠﻴﻜﻢ ‘আহলে কিতাবগণ তোমাদের সালাম দিলে, তার উত্তরে তোমরা শুধু ‘অয়া আলাইকুম’ বলবে।’  (বুখারি ৬২৫৮ মুসলিম ২১৬৭)
উল্লেখ্য, কোনো অমুসলিমের সাথে সাক্ষাৎ হলে সৌজন্য প্রদর্শনস্বরূপ তার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বা অন্য কোনভাবে যেমন, হাতের দ্বারা ইশারা করে কুশল বিনিময় করার অবকাশ রয়েছে। তাকে ‘আদাব’ও বলা যেতে পারে। তবে কোনভাবেই তাকে ‘নমস্কার’ বা ‘নমস্তে’ বলা যাবে না। (রহীমীয়া ৬/১২৬ কিফায়াতুলমুফতী ৯/১০৬) কেননা, নমস্কার’ বা ‘নমস্তে’ শব্দটি হিন্দুদের বিশেষ সম্ভাষণবাচক শব্দ। সুতরাং এ শব্দ বলে কোনো হিন্দুকে সম্ভাষণ করা যাবে না। (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল ১/৫৪)
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী

কোলাকুলির সময় যে দোয়া পাঠ করতে হয় - প্রশ্ন: ১৯৬

 ইনশাআল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ দুজনের মাঝে মহব্বত তৈরী করে দিবেন।
------------------------------------------------------
اَللّهُمَّ زِدْ مَحَبَّتِيْ لِلّهِ وَرَسُوْلِه
উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা যিদ মুহাব্বাতী লিল্লাহি ওয়া রাসূলিহী।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমার মহব্বত বৃদ্ধি কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের খাতিরে।
বিঃদ্রঃ জ্ঞান কখনো নিজের কাছে জমা রাখতে নেই, আপনি কল্যাণকর যাহাই যানুন, অন্যের মাঝে তা বিলি করুন। এতে আপনার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পাবে। কল্যাণকর কোন বিষয় অন্যর নিকট পৌছে দেওয়া আমাদের সকলের ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকে সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং আমাদের উপর আপনার পবিত্র রহমত বর্ষণ করুন, আমিন।

বাড়ী নির্মাণে টাকা ঋণ দেওয়া এবং সেখান থেকে ভাড়া গ্রহণ করা কি সুদ ? - প্রশ্ন: ১৯৭


প্রশ্ন: আমি কোন এক ব্যক্তিকে টাকা দিব তার বাড়ি নির্মাণ করার জন্য। টাকা দেওয়ার শর্ত হচ্ছে ঐ বাড়ি হতে ভাড়া বাবদ যে অর্থ আয় হবে তার থেকে প্রতি মাসে আমাকে কিছু টাকা দিবে যতদিন আমার দেওয়াকৃত টাকা ফেরত না দিবে। এইভাবে টাকা দিলে লেনদেন কি সুদ হবে।

উত্তর: জ্বী, ১০০% সুদ হবে।

তবে এভাবে সুদ হবেনা যেমনঃ

বাড়ি আপনি নির্মাণ করে দেবেন ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে, তারপর তার নিকট সেটা বিক্রয় করবেন ১১ লাখ টাকায়, এরপর প্রতি মাসের ভাড়া থেকে/ অথবা অন্য যে কোন মাধ্যম থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আপনাকে দেবে এবং এই টাকা ঐ ১১ লাখ থেকে কর্তন হতে থাকবে এবং একসময় পরিশোধ হয়ে যাবে।

এমনকি আপনি তার নিয়োগকৃত ঠিকাদারের মাধ্যমে তার পছন্দমত বাড়ি বানিয়ে দিতে পারবেন তাতে কোন সমস্যা নাই।

তবে টাকা আপনি ঠিকাদারের হাতে টাকা পরিশোধ করবেন।

ইসলামী আন্দোলনের পথ ও পাথেয় - লেখকঃ মোস্তফা মাশহুর





বইটি ডাউনলোড করুন। 

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ - মতিউর রহমান নিজামী




ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ - মতিউর রহমান নিজামী
বইটি ডাউনলোড করুন।

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...