লটারী-জুয়া বনাম নির্বাচনী লটারী - প্রশ্ন: ১৯৪

 লটারি ও নির্বাচনী লটারি


প্রশ্ন : আমাদের অফিসের একটা পুরানো রীতি হলো, যে কর্মচারী এই অফিস থেকে এক মাইল দূরত্বে অবস্থান করে তাকে যাতায়াতের জন্য  অফিসের  সাইকেল দেয়া হয়। অফিসের সাইকেল একটাই। ঘটনাক্রমে বর্তমানে এক মাইল দূরে অবস্থানকারী কর্মচারীদের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচজন। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ধারণা, লটারির মাধ্যমে একজনকে নির্বাচিত করতে হবে। কেননা এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, লটারি জুয়ারই শামিল এবং নাজায়েয। আপনি বলুন এটা করা জায়েয কিনা?

জবাব : আপনি যে লটারির কথা বলেছেন তাকে জুয়া বলা চলেনা। নির্বাচনী লটারি আর জুয়ার লটারি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বেশিরভাগ লটারির  জুয়ার আওতাভুক্ত এবং অবৈধ। কিন্তু নির্বাচনী লটারি শরিয়তে আপত্তিকর নয়। নিছক নির্বাচনের জন্য গৃহীত লটারি জুয়ার লটারি থেকে একেবারেই আলাদা জিনিস। অনিবার্য ক্ষেত্রে নির্বাচনী লটারি গৃহিত হয়ে  থাকে। উভয়ের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক পার্থক্য এই যে, জুয়ার লটারিতে সত্যিকার বা স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি কোনো সমস্যা দেখা দেয়না এবং তা সমাধানের কোনো অভিপ্রায়ও থাকেনা। এতে আগে থেকে তৈরি করা একটা পরিকল্পনা বা সমঝোতার অধীনে অংশীদার ও উদ্যোক্তরা নিজ নিজ কাংখিত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পুঁজি  খাটায়। অত:পর তা বন্টনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পন্থা অবলম্বন করা হয় যা সাধারণত অনেকাশেই ভাগ্যনির্ভর অন্য কথায় এটা ভাগ্যের খেলা Game of Chance। এর ফলে কিছু লোক কোনা কারণ ও প্রয়োজন ছাড়াই এবং নিজের শ্রম মেধা অনুপাতে বেশি অর্থ লাভ করে। অথচ প্রলুব্ধ হয়ে অংশগ্রহণকারী অনেকে বঞ্চিত থেকে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ধরণের জুয়ার উদ্যোক্তা ও সংগঠকরা নিজের পকেট থেকে কাউকে কিছু দেয়না, আর এমন কোনো সম্পদও বন্টন করেনা যা স্বাভাবিকভাবে সংগৃহীত হয়েছে, কেবল তার বন্টনই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বরঞ্চ তারা অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। অত:পর অবৈধভাবে নিজেরা কিছু নেয় এবং অন্যদেরকেও কিছু দেয়।

পক্ষান্তরে নির্বাচনী লটারি সেই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যেখানে একটি বিশেষ সংখ্যার সমান সমান অংশ বিদ্যমান এবং তা ঠিক সেই সংখ্যক হকদারের মধ্যে বন্টন করা কাম্য হয় এমতাবস্থায় অংশীদার বা বন্টনকারী নিজের ইচ্ছেমত বন্টনের পরিবর্তে লটারির সাহায্যে প্রত্যেক অংশীদারকে একটা বিশেষ অংশ দিয়ে দেয়। এতে অবিচার বা পক্ষপাতিত্বের কোনো অবকাশ থাকেনা। এ ধরনের নির্বাচনী লটারির প্রয়োজন আরো একটা ক্ষেত্রে দেখা দেয়। সেটি হলো, যদি দেয় জিনিসকে একক ও অবিভাজ্য  হয় এবং তার একাধিক হকদার থাকে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে বঞ্চিত করলে সবার প্রতি অবিচার করা হবে। আর যদি দাতা নিজের ইচ্ছেমত কাউকে বাছাই করতে চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তার কাছে কাউকে অগ্রগণ্য মনে করার কোনো মানদণ্ড থাকেনা। এতে একজন বাদে আর সকলের মনেও আঘাত  লাগে। এই সংকটের  সমাধানের জন্য নির্বাচনী লটারি করে কোনো একজনের নাম নির্বাচন করা ও জিনিসটা তাকে দিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা। এমন বলাবাহুল্য যে এই দুই ধরণের নির্বাচনী লটারির সাথে অন্যান্য লটারির আকাশ পাতাল পার্থক্য। উভয় ক্ষেত্রের  জন্য শরিয়তের একই বিধান হতে পারেনা। জুয়ামূলক লটারিতে ইচ্ছেকৃতভাবে পুঁজি এমনভাবে সংগ্রহ ও বন্টন করা হয় যে, কারে হক নষ্ট হয় এবং কেউ অবৈধভাবে লাভবান হয়। পক্ষান্তরে নির্বাচনী লটারিতে একটা বাস্তব সংকটের এমন সমাধান করা হয়, যার কোনো বিকল্প নেই।

কুরআন ও হাদিসে যতো ধরণের জুয়াকে হারাম বা মাকরূহ ঘোষণা করা হয়েছে, তার কোনোটাই নির্বাচনী লটারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বরঞ্চ বহু হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল সা. এবং সাহাবিগণ বিভিন্ন সময়ে উপরোক্ত নির্বাচনী লটারি প্রয়োগ করেছেন। নির্ভরযোগ্য হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল  সা. মদিনায় অবস্থানকালে কবে কোন স্ত্রীর  কাছে থাকতেন, সেটা পালাক্রমে স্থির করতেন। কিন্তু সফরে যাওয়ার সময় তিনি লটারির মাধ্যমে উম্মুল মুমিনীনদের কোনো একজনকে নির্বাচন করতেন এবং তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন।

একথা সত্য, যেসব খেলাধুলা ও কায়কারবারে জুয়ার মিশ্রণ ঘটে, তাতেও বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনী লটারি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সবাই জানে, তা স্বাভাবিক নির্বাচনী লটারির থেকে ভিন্ন রকমের। সেটা  জুয়াবাজিরই একটা অংশ এবং গোটা কারবার জুয়াভিত্তিক হওয়ায় এই অংশটিও নাজায়েয ও হারাম। [তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৩]


(রাসায়েল মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী) 

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...