প্রশ্ন: ১২৮ : সুদের বিরুদ্ধে কুরআন ও হাদীস ।

===================================================

====================================================

======================================================

সুদের বিরুদ্ধে কোরআনের আয়াত ও হাদীস


যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে৷ তাদের এইঅবস্থায় উপনীত হবার কারণ হচ্ছে এই যেতারা বলেঃ “ ব্যবসা তো সুদেরই মতো ” অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালালকরে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম  কাজেই যে ব্যক্তির কাছে তার রবের পক্ষ থেকে এই নসীহত পৌছে যায় এবংভবিষ্যতে সুদখোরী থেকে সে বিরত হয়সে ক্ষেত্রে যা কিছু সে খেয়েছে তাতো খেয়ে ফেলেছেই এবং  ব্যাপারটি আল্লাহরকাছে সোপর্দ হয়ে গেছে  আর এই নির্দেশের পরও যে ব্যক্তি আবার এই কাজ করে , সে জাহান্নামের অধিবাসী  সেখানে সেথাকবে চিরকাল (আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৫)

আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত  বিকশিত করেন  আর আল্লাহ অকৃতজ্ঞ দুষ্কৃতকারীকে পছন্দকরেন না (আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৬)

হে ঈমানদারগণ ! আল্লাহকে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও , যদিযথার্থই তোমরা ঈমান এনে থাকো(আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৮)

কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না করো তাহলে জেনে রাখোএটা আল্লাহ  তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা  এখনো তাওবা করে নাও ( এবং সুদ ছেড়ে দাও ) তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে  তোমরাজুলুম করবে না এবং তোমাদের ওপর জুলুম করাও হবে না (আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৯)

হে ঈমানদারগণ ! চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া বন্ধ করো এবং আল্লাহকে ভয় করোআশা করা যায় তোমরা সফলকামহবে (আলে ইমরান,আয়াতঃ ১৩০)

সুদ গ্রহণ করার জন্য যা গ্রহণ করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাসকরার জন্যআমি এমন অনেক পাক-পবিত্র জিনিস তাদের জন্য হারাম করে দিয়েছিযা পূর্বে তাদের জন্য হালাল ছিল৷আর তাদের মধ্য থেকে যারা কাফের তাদের জন্য কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তৈরী করে রেখেছি৷ (আন নেসা,আয়াতঃ ১৬১)

যে সূদ তোমরা দিয়ে থাকোযাতে মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না   আরযে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকোতা প্রদানকারী আসলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করে৷(আররূম,আয়াতঃ ৩৯)

সুদের বিরুদ্ধে হাদীসঃ

হযরত মূসা ইবনে ইসমাঈল (রঃ)......সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট এসে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌছলাম। নদীর মাঝখানে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানের লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায়, তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খন্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে সে যতবার বেরিয়ে আসতে চায়,ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি রক্তের নদীতে দেখছেন, সে হল সূদখোর। (বুখারীঃঅধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়ঃ ১৯৫৫)

হযরত  আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী জিনিস থেকে বিরত থাক। জিজ্ঞেস করা হল,হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), সে গুলো কি কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, যাদু টোনা করা, আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন এমন প্রাণীকে অকারণে হত্যা করা, এতীমের মাল আত্মসাত করা,সুদ খাওয়া,জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং সতী সাধ্বী নিষ্কলুষ মুমিন মহিলার উপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। (মুসলিম, কিতাবুল ইমানঃ১৭০)

হযরত  আহমদ ইবনে ইউনুস(রঃ).....আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) সূদখোর, সূদ দাতা,এর সাক্ষী এবং সুদের হিসাব/দলীল লেখক—সকল কে অভিশাপ দিয়েছেন। আর তিনি এদের সবাই কে সমান অপরাধী বলেছেন।(আবু দাউদ,অধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়ঃ ৩৩০০)

হযরত  আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ (রঃ).....আবু হুরাইরাহ (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, সুদের সত্তরটি স্তর রয়েছে। সবচেয়ে নিম্নটি হল-নিজ মায়ের সাথে ব্যভিচার করা (ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ ব্যবসাঃসুদঃ ২২৭৪)

হযরত  আবু হুরাইরাহ (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, মিরাজের রাতে আমি এমন এক গোত্রের পাশ দিয়ে গমন করি,যাদের পেট ছিল ঘরের মত বড়, যার মধ্যে বিভিন্ন রকম সাপ বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিবরাঈলকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হল সুদখোর।(ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ ব্যবসাঃসুদঃ ২২৭৩)

হযরত  আব্বাস ইবনে জাফর(রঃ).....ইবনে মাসউদ (রাঃ) সুত্রে রাসূল (সাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে বেশী সুদ খাবে, পরিনামে তার সম্পদ কম হয়ে যাবে। (ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ ব্যবসাঃসুদঃ ২২৭৯)

হযরত  আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালাহ(রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, জেনেশুনে এক দিরহাম পরিমান সুদ খাওয়া আল্লাহর নিকট ছত্রিশ বার ব্যভিচারের চাইতেও অধিক গুনাহের কাজ। (মুসনাদে আহমদঃ১০৩৩)
===================================================

====================================================

======================================================

প্রশ্ন: ১২৭ : কসর নামায।

﴿وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ أَن يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُّبِينًا﴾
(নিসা: ১০১) আর যখন তোমরা সফরে বের হও তখন নামায সংক্ষেপ করে নিলে কোন ক্ষতি নেই৷ ১৩২ (বিশেষ করে) যখন তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফেররা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে৷ ১৩৩ কারণ তারা প্রকাশ্য তোমাদের শত্রুতা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে৷  


১৩২. যেসব ওয়াক্তে চার রাকআত নামায ফরয সেসব ওয়াক্তে ফরয নামায দুই রাকআত পড়াই হচ্ছে শান্তির সময়ের সফরের কসর৷ আর যুদ্ধের সময়ে কসর করার ব্যাপারে কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই৷ যুদ্ধের অবস্থায় যেভাবে সম্ভব নামায পড়ে নিতে হবে৷ জামায়াতে পড়ার সুযোগ থাকলে জামায়াতে পড়ে নিতে হবে৷ অন্যথায় ব্যক্তিগতভাবে একা একা পড়ে নিতে হবে৷ কিবলার দিকে মুখ করে পড়া সম্ভব না হলে যে দিকে মুখ করে পড়া সম্ভব সেদিকে মুখ করে পড়তে হবে৷ সাওয়ারীর পিঠে বসে চলন্ত অবস্থায়ও পড়া যেতে পারে৷ রুকূ' ও সিজদা করা সম্ভব না হলে ইশারায় পড়তে হবে৷ প্রয়োজন হলে নামায পড়া অবস্থায় হাঁটতেও পারে৷ কাপড়ে রক্ত লেগে থাকলেও কোন ক্ষতি নেই৷ এতো সব সহজ ব্যবস্থার পরও যদি অবস্থা এতই বিপদজ্জনক হয়, যার ফলে নামায পড়া সম্ভবপর না হয়ে থাকে, তাহলে বাধ্য হয়ে নামায পিছিয়ে দিতে হবে৷ যেমন খন্দকের যুদ্ধের সময় হয়েছিল৷
সফরে কি কেবল ফরয পড়া হবে, না সুন্নতও পড়া হবে- এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যা কিছু প্রমানিত তা হচ্ছে এই যে, তিনি সফরে ফজরেরর সুন্নাত ও এশার বেতের নিয়মিত পড়তেন কিন্তু অন্যনান ওয়াক্তে কেবল ফরয পড়তেন৷ নিয়মিত সুন্নাত পড়া তাঁর থেকে প্রমাণিত হয়নি৷ তবে নফল নামাযের যখনই সুযোগ পেতেন পড়ে নিতেন৷ এমনকি সাওয়ারীর পিঠে বসেও নফল নামায পড়তেন৷ এজন্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) লোকদের সফরে ফজর ছাড়া অন্য ওয়াক্তে সুন্নাতগুলো জায়েয গণ্য করেছেন এবং অধিকাংশ উলামা সুন্নত ও নফল পড়া বা না পড়া উভয়টি জায়েয গন্য করেছেন এবং ব্যক্তি ইচ্ছার ওপর তা ছেড়ে দিয়েছেন৷ হানাফী মাযহাবের সর্বজন গৃহীত মতটি হচ্ছে, মুসাফির যখন পথে চলমান অবস্থায় থাকে তখন তার সুন্নাত না পড়াই উত্তম আর যখন কোন স্থানে অবস্থান করতে থাকে এবং সেখানে নিশ্চিন্ত পরিবেশ বিরাজ করে, সে ক্ষেত্রে সুন্নাত পড়াই উত্তম৷
যে সফরে কসর করা যেতে পারে সে সম্পর্কে কোন কোন ইমাম শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা হতে হবে ফী সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে৷ যেমন জিহাদ, হজ্জ, উমরাই ইসলামী জ্ঞান আহরণ ইত্যাদি৷ ইবনে উমর, ইবনে মাসউদ ও আতা এরি ওপর ফতোয়া দিয়েছেন৷ ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ বলেন, সফল এমন কোন উদ্দেশ্যে হতে হবে যা শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয৷ হারাম ও নাজায়েয উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে সফর করা হয় তাতে কসরের অনুমতির সুবিধা ভোগ করার অধিকার কারোর নেই৷ হানাফীদের মতে যে কোন সফরে কসর করা যেতে পারে৷ এক্ষেত্রে সফরের ধরণ সম্পর্কে বলা যায়, তা নিজেই সওয়াব বা আযাবের অধিকারী হতে পারে৷ কিন্তু কসরের অনুমতির ওপর তার কোন প্রভাব পড়ে না৷
কোন কোন ইমাম ''কোন ক্ষতি নেই" (---------------------------) বাক্যটি থেকে এ অর্থ নিয়েছেন যে, সফরে কসর করা জরুরী নয়৷ বরং সফরে কসরের নিছক অনুমতিই দেয়া হয়েছে৷ ব্যক্তি চাইলে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে আবার চাইলে পুরো নামায পড়তে পারে৷ ইমাম শাফেঈ এ মতটি গ্রহণ করেছেন, যদিও তিনি কসর করাকে উত্তম এবং কসর না আসে উত্তম কাজ ত্যাগ করার অন্তরভুক্ত করেছেন৷ ইমাম আহমাদের মতে কসর করা ওয়াজিব৷ একটি বর্ণনা মতে ইমাম মালিকেরও এই একই মত উদ্ধৃত হয়েছে৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হামেশা সফরে কসর করেছেন, এটা হাদীস থেকে প্রমাণিত৷ কোন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয়নি যে, তিনি সফরে কখনো চার রাকাআত ফরয পড়েছেন৷ ইবনে উমর বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর, উমর, ওসমান রাদিআল্ল্লাহু আনহুমের সাথে সফর করেছি৷ আমি কখনো তাদের সফরে কসর না করতে দেখিনি৷ এরি সমর্থনে ইবনে আব্বাস এবং আরো অসংখ্য সাহাবীর নির্ভরযোগ রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে৷ হযরত উসমান যখন হজ্জের সময় মীনায় চার রাকাআত পড়ালেন তখন সাহাবীগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন৷ হযরত উসমান তখণ এই জবাব দিয়ে লোকদের নিশ্চিন্ত করলেন: আমি মক্কায় বিয়ে করেছি আর যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন শহরে পারিবারিক জীবন শুরু করে সে যেন সেই শহরের অধিবাসী৷ তাই আমি এখানে কসর করিনি এই রেওয়ায়াতগুলোর বিরুদ্ধে হযরত আয়েশা থেকে এমন দু'টি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে যা থেকে জানা যায় যে, কসর করা বা পূর্ণ নামায পড়া উভয়টিই ঠিক কিন্তু এই রেওয়ায়াতগুলো সনদের দিক দিয়ে দুর্বল হবার সাথে সাথে হযরত আয়েশার (রা) নিজের থেকে প্রমাণিত মতেরও বিরোধী ৷ তবে একথা সত্য যে, সফরে ও অ-সফরের মাঝামাঝি একটি অবস্থা রয়েছে৷ সে অবস্থায় একই অস্থায়ী নিবাসে সুবিধা মতো কখনো কসর করা যেতে পারে আবার কখনো পুরো নামায পড়ে নেয়া যেতে পারে৷ সম্ভবত হযরত আয়েশা (রা) এই অবস্থাটি সম্পর্কে বলেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরে কসর করেছেন আবার পুরো নামাযও পড়েছেন৷ আর কুরআনের এই ''সফরে কসর করলে ক্ষতি নেই" বাক্যটি এ ক্ষেত্রে কোন নতুন কথা নয়৷ ইতিপূর্বে সূরা বাকারার ১৯ রুকু'তেও সাফা ও মারাওয়া পাহাড় দু'টির মাঝখানে 'সাঈ' করার নির্দেশও এই একই ভাষায় দেয়া হয়েছে অথচ এই 'সাঈ' 'মানাসিকে হজ্জ' অর্থাৎ হজ্জএর গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীর অন্তরভূক্ত এবং ওয়াজিব৷ আসলে এই উভয় স্থানেই লোকদের মনের একটা আশংকা দূর করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য৷ সেই আশংকাটি ছিল এই যে, এ ধরনের কাজে কোন গোনাহ হবে নাতো বা এতে সওয়াবে কোন কমতি দেখা দেবে না তো! এ ধরনের আশংকা দূর করার উদ্দেশ্যই এ স্থানে এ বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে৷
কি পরিমাণ দূরত্বের সফল হলে তাতে কসর করা যেতে পারে? এ ব্যাপারে ' যাহেরী ফিকাহ'-এর মত হচ্ছে এর কোন পরিমাণ নেই৷ কম বা বেশী যে কোন দূরত্বের সফল হোক না কেন তাতে কসর করা যেতে পারে৷ ইমাম মালিকের মতে ৪৮ মাইল বা এক দিন রাতের কম সময়ের সফরে কসর নেই৷ ইমাম আহমাদও একই মত পোষন করেন৷ ইবনে আব্বাসও (রা) এই মত পোষণ করতেন৷ ইমাম শাফেঈর একটি বিবৃতিতে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়৷ হরত আনাস (রা) ১৫ মাইলের সফরে কসর কায়েয মনে করেন৷ ''একদিনের সফর কসর করার জন্য যথেষ্ট" হযরত উমরের (রা)) এই মত ইমাম আওয়াযী ও ইমাম যুহ্‌রী গ্রহণ করেছেন৷ হাসান বসরী দুই দিন এবং ইমাম আবু ইউসুফ দুই দিনের বেশী দুরত্বের সফরে কসর জায়েয মনে করেন৷ ইমাম আবু হানীফার মতে পায়ে হেঁটে বা উটের পিঠে চড়ে তিন দিন সফল করে যে দুরত্ব অতিক্রম করা যা( অর্থাৎ প্রায় ১৮ ফরসঙ্গ বা ৫৪ মাইল) তাতে কসর করা যেতে পারে৷ ইবনে উমর, ইবনে মাসউদ ও হযরত উসমান রাদি আল্লাহু আনহুম এই মত পোষণ করেন৷
সফরের মাঝখানে কোথাও অবস্থান করলে কতদিন পর্যন্ত কসর করা যেতে পারে-এ ব্যাপারেও ইমামগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন৷ ইমাম আহমাদের মতে যেখানে ৪ দিন অবস্থান করার ইচ্ছা থাকে সেখানে পুরা নামায পড়তে হবে৷ ইমাম মালেক ও ইমাম সাফেঈর মতে যেখানে ৪ দিনের বেশী সময় অবস্থানের নিয়ত করলে পুরা নামায পড়ার হুকুম দিয়েছেন৷ এ অধ্যায়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সুস্পষ্ট বিধান বর্ণিত হয়নি৷ আর যদি কোন স্থানে এক ব্যক্তি বাধ্য হয়ে আটকে পড়ে এবং সবসময় তার খেয়াল থাকে যে, বাধা দূর হলেই সে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হবে, তাহলে এমন স্থানে সে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কসর করতে থাকবে৷ এ ব্যাপারে সমস্ত উলামায়ে কেরাম একমত৷ সাহাবায়ে কেরামদের থেকে এমন অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যা থেকে জানা যায়, তাঁরা এ ধরনের অবস্থায় দুই দুই বছর পর্যন্ত অনবরত কসর করেছেন৷ এরি ওপর কিয়াস করে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল কয়েদীকেও তার সমগ্র ব্যাপী কসর করার অনুমতি দিয়েছেন৷

প্রশ্ন: ১২৬ : গাদীরে খাম এর ঘটনা ।

“গাদীরে খাম-এর ঘটনা”

আসলে এ হাদীসের মূল তাৎপর্য তো বুঝা যায় হযরত আলীর সঙ্গে দন্দ্বে ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন মুয়াবিয়া এবং মুআবিয়া খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস করে  রাজতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেছেন। অতএব, গাদীরে খাম এর ঘটনা এ সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত আলী রা: হক্ব এর উপর ছিলেন। 

ইমাম আহমাদ বলেনঃ হুসাইন ইবন মুহাম্মদ ও আবু নুআইম আল মুআন্না উভয়ে কাতার থেকে, তিনি আবুত-তুফাইল থেকে বর্ণনা করেন। আবুত-তুফাইল বলেন, আলী- কূফার উন্মুক্ত স্থান রাহ্বায় লোকজন সমবেত করেন, এরপর তাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলেন, গাদীরে খাম দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যা বলেছিলেন তা তাোমাদের মধ্যে যে সব মুসলমান শুনেছিল তারা দাঁড়িয়ে বলুক।
এ কথার পর উপস্থিত লোকদের অনেকেই দাঁড়িয়ে যায়। আবু নুআইম বলেন, অনেক লোক দণ্ডায়মান হয়। তারা সাক্ষ্য দেয় যে, সে দিন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আলীর হাত ধারণ করে জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা কি জান যে, আমি মুমিনগণের জন্যে তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক আপন ? তারা জওয়াবে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ কথা যথার্থ। তখন তিনি বলেন, আমি যার অভিভাবক এও তার অভিভাবক। হে আল্লাহ! এর সাথে যে বন্ধুত্ব রাখবে তাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন; আর এর সাথে যে শত্রুতা পোষণ করবে আপনি তার সাথে শত্রুতার সম্পর্ক করুন। রাবী আবু নুআইম বলেন, আমার মনে এ বিষয়ে সন্দেহ জাগায় আমি বেরিয়ে যাইদ ইবন আরকামের কাছে গিয়ে বললাম, আমি আলীকে এই এই কথা বলতে শুনলাম। যাইদ ইবন আরকাম বললেন, তুমি এতে সন্দেহ কর কেন? আমিই তো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনেছি। ইমাম নাসাঈ এ ঘটনা হাবীব ইবন আবু ছাবিতের সূত্রে আবু-তুফাইল থেকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
আবু বকর আশ-শাফিঈ বলেনঃ মুহাম্মদ ইবন সুলাইমান ..... যাইদ ইবন আরকাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী লোকদেরকে শপথ দিয়ে বলেন, তোমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ কথা বলতে কে শুনেছে যে, আমি যার অভিভাবক আলীও তার অভিভাবক। হে আল্লাহ! তাকে যে বন্ধু জানে আপনি তাকে বন্ধু বানান এবং তাকে যে শত্রু জানে আপনিও তাকে শত্রু জানুন। তখন ষোল ব্যক্তি দাঁড়িয়ে এ কথার সাক্ষ্য দেয়। আমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম।
আবূ ইয়া'লা ও আবদুল্লাহ ইবন আহমদ তার পিতার মুসনাদ গ্রন্থে বলেনঃ কাওয়ারীরী ..... আবদুর রহমান ইবন আবু লায়লা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাহবাতে আলী যখন লোকদের কাছে কসম দিয়ে কথা বলেছিলেন তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, গাদীরে খামে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যা বলেছিলেন তা তোমাদের মধ্যে কে কে শুনেছে? আলী তথায় দাঁড়িয়েছিলেন আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, আমি যার অভিভাবক আলীও তার অভিভাবক। এ কথা যারা শুনেছিলে তারা সাক্ষ্য দাও।'
আবদুর রহমান বলেন, এরপর বারজন বদরী সাহাবী দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি যেন এখনও দেখতে পাচ্ছি তাদের একজনের পরিধানে ছিল পাজামা। তারা বললো, আমরা গাদীরে খাম দিবসে রাসূলুল্লহ্ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আমি কি মুমিনগণের জন্যে তাদের নিজেদের চেয়ে ও তাদের মায়েদের স্বামীদের চেয়ে অধিক আপন নই ? আমরা বললাম, হ্যা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ! আপনি তাকে বন্ধু বানান যে আলীকে বন্ধু বানায় এবং আপনি তার সাথে শত্রুতা করেন যে আলীর সাথে শত্রুতা করে।
আবদুল্লাহ ইবন আহমদ ..... আবদুর রহমান ইবন আবু লাইলা থেকে এ হাদীস অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তারপর বারজন লোক দাঁড়িয়ে বললো, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে দেখেছি এবং তাঁর কথা শুনেছি যখন তিনি আপনার হাত ধরে বলেছিলেন : হে আল্লাহ! আপনি তাকে বন্ধু বানান যে আলীকে বন্ধু বানায় এবং তার সাথে শত্রুতা করেন যে আলীর সাথে শত্রুতা করে। আপনি তাকে সাহায্য করুন যে আলীকে সাহায্য করেন এবং তাকে পরিত্যাগ করুন যে আলীকে পরিত্যাগ করে। এ হাদীস অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ আত-তাহবী যার নাম ঈসা ইবন মুসলিম ..... আবদুর রহমান ইবন আবূ লাইলা থেকে। দার কুতনী এ বর্ণনাকে গরীব বলেছেন।
তিবরানী বলেনঃ আহমদ ইবন ইবরাহীম ইবন আবদুল্লাহ ইবন কাইসান মাদীনী ..... ইমাইরাহ ইবন সা'দ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখেছি- আলী (রা) মিম্বরের উপর বসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণকে কসম দিয়ে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গাদীরে খাম দিবসে যা কিছু বলেছিলেন তোমাদের মধ্যে সে কথ্য শ্রবণকারী কেউ আছে কি ? তখন বারজন লোক দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মধ্যে আবূ হুরায়রা (রা), আবু সাঈদ ও আনাস ইবন মালিকও ছিলেন। তারা সাক্ষ্য দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তারা বলতে শুনেছেন যে, আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক। হে আল্লাহ! আপনি তাকে বন্ধু বানান, যে আলীকে বন্ধু বানায়। আপনি তাকে শত্রু বানান, যে আলীকে শত্রু বানায় ।
আবুল আব্বাস ইবন উকদাতাল হাফিজ আশ-শীঈ .... আমর ইবন মুররাহ্ সাঈদ ইবন ওহাব ও যাইদ ইবন নাকী থেকে বর্ণিত। তারা বলেন, আমরা রাহবাহ্ নামক জায়গায় আলী (রা)-কে বলতে শুনেছি। এরপর সে কথার উল্লেখ করেন। তখন তেরজন লোক দাড়িয়ে সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছিলেন, আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু। হে আল্লাহ! যারা আলীর সাথে বন্ধুত্ব রাখে আপনিও তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখুন। আর যারা তার সাথে শত্রুতা রাখে তাদের সাথে আপনিও শত্রুতা রাখুন। যারা তার সাথে মহব্বত রাখে, আপনি তাদেরকে মহব্বত করুন। আর যারা তার সাথে বিদ্বেষ রাখে আপনিও তাদের সাথে বিদ্বেষ রাখুন। যারা তাকে সাহায্য করে, আপনি তাদেরকে সাহায্য করুন। আর যারা তাকে বর্জন করে, আপনি তাদেরকে বর্জন করুন। আবু ইসহাক বলেন, তিনি এ হাদীস বর্ণনা শেষে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু বকর! এ সনদের শাইখ কারা ? আবদুল্লাহ ইবন আহমদ ..... আবু ইসহাক থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ।
আবদুর রাযযাক বলেন, ইসরাঈল, আবু ইসহাক সনদে সাঈদ ইবন ওহাব ও আবদে খাইর থেকে বর্ণনা করেন। তারা উভয়ে বলেন, আমরা কূফার রাহবাতে আলীকে বলতে শুনেছি যে,
তিনি আল্লাহর শপথ করে জিজ্ঞেস করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে এ কথা বলতে কে শুনেছে যে, আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক। তখন কয়েকজন সাহাবী দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন যে, তারা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনেছে।
ইমাম আহমাদ বলেনঃ মুহাম্মদ ইবন জাফর ..... সাঈদ ইব্‌ন ওহাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী লোকদের শপথ দিয়ে জিজ্ঞেস করলে পাঁচজন বা ছয়জন সাহাবী দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক।
ইমাম আহমদ বলেনঃ ইয়াহইয়া ইবন আদম ..... রাবাহ ইবন হারিছ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদল লোক রাহবাতে আলীর সামনে হাযির হয়ে বললো, সালাম আপনার উপর, হে আমাদের অভিভাবক! আলী বললেন, আমি কিভাবে তোমাদের অভিভাবক। তোমরা তো আরব জনগোষ্ঠী ? তারা বললো, আমরা গাদীরে খাম দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি- তিনি বলেছেন : আমি যার অভিভাবক, এই আলীও তার অভিভাবক। রাবাহ বলেন, ঐ লোকগুলো চলে গেলে আমি তাদের অনুসরণ করলাম এবং কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা? তারা বললেন, এরা সবাই আনসার। আবু আইয়ুব আনসারীও তাদের মধ্যে ছিলেন।
আবু বকর ইবন আবূ শাইবাহু বলেনঃ শারীক, হানাশ সূত্রে রাবাহ ইবন হারিছ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আলীর সাথে রাহ্বাতে বসেছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তথায় উপস্থিত হয়। সফরের আলামত তার উপর স্পষ্ট। ঐ লোকটি এসে বললো- আপনার উপর সালাম হে আমার মাওলা! উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ইনি কে ? তখন আবু আইয়ুব বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা।
আহমাদ বলেনঃ মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ..... যিয়াদ ইবন আবু যিয়াদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আলী ইবন আবু তালিবকে লোকের সামনে কসম করতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি এমন কোন মুসলমান আছে কি, যে গাদীরে খামে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বক্তব্য শুনেছে? তখন বারজন বদরী সাহাবী দাঁড়িয়ে সে কথার সাক্ষ্য দেয়। আহমাদ বলেন, ইন নুমাইর ..... ইবন উমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাহবাতে আলীকে বলতে শুনেছি। তিনি লোকদের কসম করে বলেন, গাদীরে খাম দিবসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা বলেছিলেন, তা শুনেছে এমন কেউ আছে কি? তখন তেরজন লোক দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, আমি যার অভিভাবক আলীও তার অভিভাবক।
আহমাদ বলেনঃ হাজ্জাজ ইন-শাইর ...... আলী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) গাদীরে খামে বলেছিলেন, আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক। রাবী বলেন, পরবর্তীতে লোকে এর সাথে আরও কিছু কথা জুড়ে দিয়েছে। যেমন হে আল্লাহ! যে আলীকে বন্ধু বানায় তাকে আপনি বন্ধু করে নিন, আর যে তাকে শত্রু জানে তার সাথে আপনি শত্রুতার ব্যবহার করুন। এ হাদীস আলী (রা) থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। যাইদ ইন আরকাম থেকেও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।
গুনদুর বলেন, শু'বাহ ...... আবূ মারইয়াম অথবা যাইদ ইবন আরকাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক। সাঈদ ইবন জুবাইর বলেন, ইতিপূর্বে আমি এ হাদীস ইবন আব্বাস থেকে শুনেছি। তিরমিযী এ হাদীস বিনদারের সূত্রে গুনদুর থেকে বর্ণনা করে বলেছেন তা হাসান, গরীব। ইমাম আহমাদ বলেনঃ আফফান .... যাইদ ইবন আরকাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাথে এক উপত্যকায় অবতরণ করি। উপত্যকাটির নাম খাম। তিনি আমাদেরকে সালাতের প্রস্তুতি নিতে বললেন। এরপর যোহরের সালাত আদায় করলেন। সালাত শেষে তিনি কিছু বক্তব্য রাখেন। তখন বাবলা বৃক্ষের উপর কাপড় রেখে রৌদ্র থেকে ছায়া দেওয়া হয়। তিনি বললেন, তোমরা কি জাননা, অথবা বলেছেন, তোমরা কি সাক্ষ্য দিবে না যে, প্রত্যেক মু'মিনের জন্যে আমি তার নিজের চেয়ে অধিক আপন ? উপস্থিত সবাই বললো, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তা হলে আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক। হে আল্লাহ! আপনি তাকে শত্রু বানান যে আলীকে শত্রু বানায়। আর তাকে বন্ধু বানান যে আলীকে বন্ধু বানায়। আহমদ অনুরূপ বর্ণনা গুনদুরের সূত্রে ভিন্ন সনদে যাইদ ইবন আরকাম থেকে বলেছেন। যাইদ ইন আরকাম থেকে বেশ কিছু রাবী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমন- আবু ইসহাক সাবীঈ, হাবীব আসাফ, আতিয়্যাহ আওফী, আবু আবদুল্লাহ শামী ও আবুত-তুফাইল আমির ইবন ওয়াছিলা।
মা'রূফ ইবন হারবুয আবুত-তুফাইলের সূত্রে হুযাইফা ইবন উসাইদ থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে বাতহার বৃক্ষাদির কাছে থামার নির্দেশ দেন। বৃক্ষাদির কাছেই সবাইকে নিয়ে সালাত আদায় করেন । সালাত শেষে তিনি দাঁড়িয়ে বলেনঃ লোক সকল! লাতীফুল খাবীর আল্লাহ্ আমাকে জানিয়েছেন যে, যে কোন নবীকে তার পূর্ববর্তী নবীর অর্ধেক বয়স দান করা হয়। আমার ধারণা খুব শিগগিরই আমার ডাক এসে যাবে, আর আমি সে ডাকে সাড়া দিব। আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে এবং তোমরাও জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা তখন কি জওয়াব দিবে ? তারা বললো, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি আপনার দায়িত্ব পৌছে দিয়েছেন, উপদেশ দান করেছেন এবং অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ফলে মহান আল্লাহ আপনাকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করবেন। তিনি বললেন, তোমরা কি এ কথার সাক্ষ্য দাও না যে, আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, মৃত্যু সত্য, কিয়ামত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই এবং কবরে যারা আছে তাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে? সাহাবাগণ বললেন, হ্যা, অমরা ও সবের সাক্ষ্য দিই।
তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। এরপর তিনি বললেন, লোক সকল! আল্লাহ্ আমার অভিভাবক আর আমি মু'মিনদের অভিভাবক। আর আমি তাদের ব্যাপারে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক কল্যাণকামী। আমি যার অভিভাবক এও তার অভিভাবক। হে আল্লাহ! আপনি তাকে বন্ধু করুন যে একে বন্ধু বানায় এবং তাকে আপনার শত্রু করুন যে একে শত্রু বানায়। এরপর তিনি বলেনঃ লোক সকল! আমি তোমাদের আগে বিদায় নিব। হাউযে কাউসারে আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হবে। সে হাউযের দীর্ঘতা হবে আমার চোখ হতে সানআ পর্যন্ত দূরত্বের সমান। তার পানপাত্রের সংখ্যা হবে নক্ষত্রের সংখ্যার সমান। পান পাত্রগুলো রৌপ্য নির্মিত। তোমরা যখন আমার সাথে মিলিত হবে তখন আমি তোমাদের নিকট এ দুটি ভার বস্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবো। কাজেই ভেবে দেখ এ দুটির সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে। এরমধ্যে বড় ভার বস্তুটি হলো আল্লাহর কিতাব। এর একটা দিক রয়েছে আল্লাহর হাতে আর একটি দিক আছে তোমাদের হাতে। কাজেই একে শক্তভাবে ধারণ করবে। একে ত্যাগ করবে না, পরিবর্তন করবে না। আর একটি হলো আমার পরিবার– আহলে বাইত। কেননা, আল্লাহ্ লাতীফুল খাবীর আমাকে জানিয়েছেন যে, এ দুটির একটি থেকে আরেকটি কখনও পৃথক হবে না, হাওযে আমার কাছে না আসা পর্যন্ত। এ হাদীস ইবন আসাকির মা’রূফের সূত্রে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
আবদুর রাযযাক বলেনঃ মা'মার ...... বারা ইবন আযিব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাথে বের হই। চলতে চলতে গাদীরে খাম-এ অবতরণ করি। সেখানে সকলকে একত্র করার জন্যে তিনি ঘোষক পাঠান। একত্রিত হওয়ার পর তিনি বলেন : আমি কি তোমাদের কাছে তোমাদের নিজেদের চেয়ে আপন নই? আমরা বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের কাছে তোমাদের মায়েদের চেয়ে আপন নই? আমরা বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের কাছে তোমাদের পিতাদের চেয়ে আপন নই? আমরা বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমি কি নই, আমি কি নই, আমি কি নই ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমি যার অভিভাবক, আলীও তার অভিভাবক। হে আল্লাহ! আপনি অভিভাবক হন তার যে তাকে অভিভাবক মানে এবং আপনি বিরোধিতা করেন তার যে তার বিরোধিতা করে। তখন উমর ইবন খাত্তাব আলী (রা)-কে বললেন, সৌভাগ্য তোমার হে আবু তালিবের নন্দন! আজ হতে তুমি সমস্ত মু'মিনের অভিভাবক হয়ে গেলে। ইবন মাজাহ্ এ হাদীস হাম্মাদ ইবন সালমার সূত্রে ...... বারা ইব্‌ন আযিব থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। মূসা ইবন উসমান হারামী আবূ ইসহাকের সূত্রে বারা থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীস আরও বর্ণিত হয়েছে সা'দ, তালহা ইবন উবাইদুল্লাহ, জাবির ইবন আবদুল্লাহ (তার থেকে বিভিন্ন সূত্রে), আবু সাঈদ খুদরী, হাবাশী ইব্‌ন জুনাদাহ্, জারীর ইবন আবদুল্লাহ্, উমর ইব্‌ন খাত্তাব ও আবূ হুরায়রা থেকে। আবু হুরায়রা থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ সবের মধ্যে হাফিজ আবু বকর খাতীব বাগদাদী আবদুল্লাহ ইবন আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন বুশরান সূত্রে ..... আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদীস সবচেয়ে গরীব। এ হাদীসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের আঠারো তারিখে সাওম পালন করবে সে ব্যক্তি ষাট মাস সাওম পালন করার সওয়াব পাবে। এ আঠারো যিলহজ্জ তারিখ ছিল গাদীরে খাম দিবস। সে দিন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আলী ইবন আবু তালিবের হাত ধারণ করে লোকদের বলেছিলেন, আমি কি মু'মিনগণের অভিভাবক নই! সাহাবাগণ বললেন হ্যাঁ ইয়া রাসূলুল্লাহ ! তিনি তখন বললেন, আমি যার অভিভাবক আলীও তার অভিভাবক। তখন উমর ইবন খাত্তাব আলীকে বললেন, বাহঃ বাহুঃ হে আবু তালিবের নন্দন! তুমি তো আমার অভিভাবক ও সকল মুসলমানের অভিভাবক হয়ে গেলে। তখন আল্লাহ্ পাক এ আয়াত নাযিল করেন الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দীন পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর যে ব্যক্তি রজব মাসের সাতাইশ তারিখে সাওম পালন করবে সে ব্যক্তিকে ষাট মাস সাওম পালন করার সওয়াব দেওয়া হবে। এই দিনে জিবরাঈল ফেরেশতা সর্ব প্রথম রিসালাতের কাজ নিয়ে অবতরণ করেন।
খাতীবে বাগদাদী বলেন, এ হাদীস হাবশূনের বর্ণনা বলে প্রসিদ্ধ। তিনি একাই তা বর্ণনা করেছেন। তার অনুসরণ করেছেন আহমদ ইবন উবাইদুল্লাহ ইবন আব্বাস ইবন সালিম ইবন মাহরান- যিনি ইবুন নাবারী নামে খ্যাত। তিনি আলী ইবন সাঈদ শামী থেকে বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থকার বলেন, এ হাদীস কয়েকটি কারণে মুনকার হওয়ার যোগ্য। একটি হলো গাদীরে খাম দিবসে الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ আয়াত নাযিল হওয়ার কথা। ইন হারুন আবাদী সূত্রে আবু সাঈদ খুদরী থেকেও অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এ বর্ণনাও সহীহ নয়। বস্তুত এ আয়াত নাযিল হয়েছিল আরাফাত দিবসে। বুখারী ও মুসলিম উমর ইবন খাত্তাব থেকে এ প্রসঙ্গে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। বহু সংখ্যক সাহাবী থেকে এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ঐ সব সাহসী ব্যতীত যাদের নাম “আমি যার অভিভাবক” বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, তাদের থেকে যে সনদে বর্ণিত হয়েছে সে সব সনদ দুর্বল।
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, সপ্তম খণ্ড হুবহু লিখা।

প্রশ্ন: ১২৫ : সুরা ইখলাস নাযিল হওয়া সংক্রান্ত।

নামকরণ :

ইখলাস শুধু এ সূরাটির নামই নয় ,এখানে আলোচ্য বিষয়বস্তুর শিরোনামও । কারণ , এখানে খালেস তথা নির্ভেজাল তাওহীদের আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন মজীদের অন্যান্য সূরার ক্ষেত্রে সাধারণত সেখানে ব্যবহৃত কোন শব্দের মাধ্যমে তার নামকরণ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এ সূরাটিতে ইখলাস শব্দ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কাজেই এর এ নামকরণ করা হয়েছে এর অর্থের ভিত্তিতে। যে ব্যক্তি এ সূরাটির বক্তব্য অনুধাবন করে এর শিক্ষার প্রতি ঈমান আনবে , সে শিরক থেকে মুক্তি লাভ করে খালেস তাওহীদের আলোকে নিজেকে উদ্ভাসিত করবে।

নাযিলের সময়- কাল

এর মক্কী ও মাদানী হবার ব্যাপারে মতভেদ আছে। এ সূরাটি নাযিল হবার কারণ হিসেবে যেসব হাদীস উল্লেখিত হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতেই এ মতভেদ দেখা দিয়েছে। নীচে পর্যায়ক্রমে সেগুলো উল্লেখ করছি :
(১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন , কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে , আপনার রবের বংশ পরিচয় * আমাদের জানান। একথায় এ সূরাটি নাযিল হয়। ( তাবারানী) ।
(২) আবুল আলীয়াহ হযরত উবাই ইবনে কাবের (রা) বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন , মুশরিকরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে , আপনার রবের বংশ পরিচয় আমাদের জানান। এর জবাবে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন । ( মুসনাদে আহমাদ , ইবনে আবী হাতেম , ইবনে জারীর , তিরমিযী , বুখারী ফিত তারীখ , ইবনুল মুনযির , হাকেম ও বায়হাকী ) এ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস আবুল আলীয়ার মাধ্যমে ইমাম তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে হযরত উবাই ইবনে কা'বের বরাত নেই। ইমাম তিরমিযী একে অপেক্ষকৃত বেশী নির্ভুল বলেছেন।
* আরববাসীদের নিয়ম ছিল , কোন অপরিচিত ব্যক্তির পরিচয় লাভ করতে হলে তারা বলতো , ( আরবী -------) ( এর বংশধারা আমাদের জানাও ) কারণ তাদের কাছে পরিচিতির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হতো বংশধারার। সে কোন বংশের লোক ? কোন গোত্রের সাথে সম্পর্কিত ? একথা জানার প্রয়োজন হতো । কাজেই তারা যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাঁর রব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলো তিনি কে এবং কেমন , তখন তারা তাঁকে একই প্রশ্ন করলো। তারা প্রশ্ন করলো , ( আরবী ------------) অর্থাৎ আপনার রবের নসবনামা ( বংশধারা ) আমাদের জানান।
(৩) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন , এক গ্রামীণ আরব ( কোন কোন হাদীস অনুযায়ী লোকেরা ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে , আপনার রবের বংশধারা আমাদের জানান। এর জবাবে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন ( আবু ইয়ালা , ইবনে জারীর , ইবনুল মুনযির , তাবারানী ফিল আওসাত , বায়হাকী ও আবু নু’আইম ফিল হিলইয়া )
(৪) ইকরামা হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে রেওয়ায়াত করেন , ইহুদীদের একটি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়। তাদের মধ্যে ছিল কা’ব ইবনে আশরাফ ও হুই ইবনে আখতাব প্রমুখ লোকেরা । তারা বলে , “ হে মুহাম্মাদ ! ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) আপনার যে রব আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি কেমন সে সম্পর্কে আমাদের জানান। ” এর জবাবে মহান আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন। ( ইবনে আবী হতেম , ইবনে আদী , বায়হাকী ফিল আসমায়ে ওয়াস সিফাত )
এ ছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়া কয়েকটি হাদীস তাঁর সূরা ইখলাসের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :
(৫) হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন , খয়বারের কয়েকজন ইহুদী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলে , “ হে আবুল কাসেম ! আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নূরের পরদা থেকে , আদমকে পচাগলা মাটির পিণ্ড থেকে , ইবলিসকে আগুনের শিখা থেকে , আসমানকে ধোঁয়া থেকে এবং পৃথিবীকে পানির ফেনা থেকে তৈরি করেছেন । এখন আপনার রব সম্বন্ধে আমাদের জানান ( অর্থাৎ তিনি কোন বস্তু থেকে সৃষ্ট ? ) ” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথার কোন জবাব দেননি। তারপর জিব্রীল ( আ) আসেন। তিনি বলেন , হে মুহাম্মাদ ! ওদেরকে বলে দাও , “ হুওয়াল্লাহু আহাদ ” ( তিনি আল্লাহ এক ও একক ) --------------------
(৬) আমের ইবনুত তোফায়েল রসূলুল্লাহকে (সা) বলেন : হে মুহাম্মাদ ! আপনি আমাদের কোন জিনিসের দিকে আহবান জানাচ্ছেন ? তিনি জবাব দেন , “ আল্লাহর দিকে ।” আমের বলে : “ ভালো , তাহলে তার অবস্থা আমাকে জানান। তিনি সোনার তৈরি , না রূপার অথবা লোহার? ” একথার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়।
(৭) যাহহাক , কাতাদাহ ও মুকাতেল বলেন , ইহুদীদের কিছু আলেম রসূলুল্লাহ (সা) কাছে আসে। তারা বলে : “ হে মুহাম্মাদ ! আপনার রবের অবস্থা আমাদের জানান। হয়তো আমরা আপনার ওপর ঈমান আনতে পারবো। আল্লাহ তাঁর গুণাবলী তাওরাতে নাযিল করেছেন। আপনি বলুন , তিনি কোন বস্তু দিয়ে তৈরি ? কোন গোত্রভুক্ত ? সোনা , তামা পিতল , লোহা , রূপা , কিসের তৈরি ? তিনি পানাহর করেন কি না ? তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে কার কাছ থেকে পৃথিবীর মালিকানা লাভ করেছেন ? এবং তারপর কে এর উত্তরাধিকারী হবে ? এর জবাবে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন ।
(৮) ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন , নাজরানের খৃষ্টানদের সাতজন পাদরী সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রদিনিধি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে ।তারা তাঁকে বলে : “ আমাদের বলুন , আপনার রব কেমন ? তিনি কিসের তৈরি ? ” তিনি বলেন , “ আমার রব কোন জিনিসের তৈরি নন। তিনি সব বস্তু থেকে আলাদা ।” এ ব্যাপারে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন।
এ সমস্ত হাদীস থেকে জানা যায় , রসূলুল্লাহ (সা) যে মাবুদের ইবাদাত ও বন্দেগী করার প্রতি লোকদের আহবান জানাচ্ছিলেন তার মৌলিক সত্তা ও অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক প্রশ্ন করেছিল। এ ধরনের প্রশ্ন যখনই এসেছে তখনই তিনিই জবাবে আল্লাহর হুকুমে লোকদেরকে এ সূরাটিই পড়ে শুনিয়েছেন। সর্বপ্রথম মক্কায় কুরাইশ বংশীয় মুশরিকরা তাঁকে এ প্রশ্ন করে । তাদের এ প্রশ্নের জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। এরপর মদীনা তাইয়েবায় কখনো ইহুদী , কখনো খৃষ্টান আবার কখনো আরবের অন্যান্য লোকেরাও রসূলুল্লাহকে (সা) এই ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। প্রত্যেকবারই আল্লাহর পক্ষ থেকে ইশারা হয় জবাবে এ সূরাটি তাদের শুনিয়ে দেবার । ওপরে উল্লেখিত হাদীসগুলোর প্রত্যেকটিতে একথা বলা হয় যে , এর জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। এর থেকে এ হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী একথা মনে করার কোন সংগত কারণ নেই । আসলে হচ্ছে কোন বিষয় সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবতীর্ণ কোন আয়াত বা সূরা থাকতো তাহলে পরে রসূলুল্লাহ (সা) সামনে যখনই সেই বিষয় আবার উত্থাপিত হতো তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত আসতো , এর জবাব উমুক আয়াত বা সূরায় রয়েছে অথবা এর জবাবে লোকদেরকে উমুক আয়াত বা সূরা পড়ে শুনিয়ে দাও। হাদীসসমূহের রাবীগণ এ জিনিসটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন , যখন উমুক সমস্যা দেখা দেয় বা উমুক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন এ আয়াত বা সূরাটি নাযিল হয়। একে বারংবার অবতীর্ণ হওয়া অর্থাৎ একটি আয়াত বা সূরার বারবার নাযিল হওয়াও বলা হয়।
কাজেই সঠিক কথা হচ্ছে , এ সূরাটি আসলে মক্কী । বরং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে একে মক্কায় একেবারে প্রথম যুগে অবতীর্ণ সূলাগুলোর অন্তরভুক্ত করা যায়। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনের কোন বিস্তারিত আয়াত তখনো পর্যন্ত নাযিল হয়নি। তখনো লোকেরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহর দিকে দাওয়াতের বার্তা শুনে জানতে চাইতো : তাঁর এ রব কেমন , যাঁর ইবাদাত - বন্দেগী কারার দিকে তাদেরকে আহবান জানানো হচ্ছে। এর একেবারে প্রাথমিক যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তরভুক্ত হবার আর একটি প্রমাণ হচ্ছে , মক্কায় হযরত বেলালকে (রা) তার প্রভু উমাইয়া ইবনে খালাফ যখন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকার ওপর চিৎ করে শুইয়ে তার বুকের ওপর একটা বড় পাথর চাপিয়ে দিতো তখন তিনি “ আহাদ ” “ আহাদ ” বলে চিৎকার করতেন। এ আহাদ শব্দটি এ সূরা ইখলাস থেকেই গৃহীত হয়েছিল।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

নাযিল হওয়ার উপলক্ষ সম্পর্কিত যেসব হাদীস ওপরে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ওপর এক নজর বুলালে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তখন দুনিয়ার মানুষের ধর্মীয় চিন্তা - ভাবনা ও ধ্যান - ধারণা কি ছিল তা জানা যায়। মূর্তি পূজারী মুশরিকরা কাঠ , পাথর সোনা, রূপা ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসের তৈরি খোদার কাল্পনিক মূর্তিসমূহের পূজা করতো । সেই মূর্তিগুলোর আকার , আকৃতি ও দেহাবয়ব ছিল। এ দেবদেবীদের রীতিমত বংশধারাও ছিল। কোন দেবী এমন ছিল না যার স্বামী ছিল না। আবার কোন দেবতা এমন ছিল না যার স্ত্রী ছিল না। তাদের খাবার দাবারেরও প্রয়োজন দেখা দিতো । তাদের পূজারীরা তাদের জন্য এসবের ব্যবস্থা করতো। মুশরিকদের একটি বিরাট দল খোদার মানুষের রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করায় বিশ্বাস করতো এবং তারা মনে করতো কিছু মানুষ খোদার অবতার হয়ে থাকে । খৃষ্টানরা এক খোদায় বিশ্বাসী হলেও তাদের খোদার কমপক্ষে একটি পুত্র তো ছিলই এবং পিতা পুত্রের সাথে খোদায়ী সাম্রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে রুহুল কুদুসও ( জিব্রীল) অংশীদার ছিলেন । এমন কি খোদার মাও ছিল এবং শাশুড়ীও । ইহুদীরাও এক খোদাকে মেনে চলার দাবীদার ছিল কিন্তু তাদের খোদাও বস্তুসত্তা ও মরদেহ এবং অন্যান্য মানবিক গুণাবলীর উর্ধে ছিল না। তাদের এ খোদা টহল দিতো , মানুষের আকার ধারণ করে আত্ম প্রকাশ করতো। নিজের কোন বান্দার সাথে কুশতিও লড়তো । তার একটি পুত্রও ( উযাইর ) ছিল। এ ধর্মীয় দলগুলো ছাড়া আরো ছিল মাজূসী - অগ্নি উপাসক ও সাবী -তারকা পূজারী দল। এ অবস্থায় যখন লোকদেরকে এক ও লা- শারীক আল্লাহর আনুগত্য করার দাওয়াত দেয়া হয় তখন তাদের মনে এ প্রশ্ন জাগা নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে , সেই রবটি কেমন , সমস্ত রব ও মাবুদদেরকে বাদ দিয়ে যাকে একমাত্র রব ও মাবুদ হিসেবে মেনে নেবার দাওয়াত দেয়া হচ্ছে ? এটা কুরআনের অলৌকিক প্রকাশভংগীরই কৃতিত্ব। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে কুরআন মূলত আল্লাহ অস্তিত্বের এমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা পেশ করে দিয়েছে , যা সব ধরনের মুশরিকী চিন্তা ও ধ্যান -ধারণার মূলোৎপাটন করে এবং আল্লাহর সত্তার সাথে সৃষ্টির গুণাবলীর মধ্য থেকে কোন একটি গুণকেও সংযুক্ত করার কোন অবকাশই রাখেনি।

শ্রেষ্টত্ব ও গুরুত্ব

এ কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে এ সূরাটি ছিল বিপুল মহত্বের অধিকারী । বিভিন্নভাবে তিনি মুসলমানদেরকে এ গুরুত্ব অনুভব করাতেন । তারা যাতে এ সূরাটি বেশী করে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে একে বেশী করে ছড়িয়ে দেয় এ জন্য ছিল তাঁর এ প্রচেষ্টা। কারণ এখানে ইসলামের প্রাথমিক ও মৌলিক আকীদাকে ( তাওহীদ ) এমন ছোট ছোট চারটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে , যা শুনার সাথে সাথেই মানুষের মনে গেঁথে যায় এবং তারা সহজেই মুখে মুখে সেগুলো আওড়াতে পারে। রসূলুল্লাহ (সা) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতিতে লোকদের বলেছেন , এ সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান --- এ মর্মে হাদীসের কিতাবগুলোতে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বুখারী , তিরমিযী , মুসলিম , আবু দাউদ , নাসাঈ , ইবনে মাজাহ , মুসনাদে আহামাদ , তাবারানী ইত্যাদি কিতাবগুলোতে বহু হাদীস আবু সাঈদ , খুদরী , আবু হুরাইরা , আবু আইয়ুব আনসারী , কুলসুম বিনতে উকবাহ ইবনে আবী মু’আইত , ইবনে উমর , ইবনে মাস্থউদ , কাতাদাহ ইবনুন নূ’মান , আনাস ইবনে মালেক ও আবু মাস’উদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত হয়েছে। মুফাসসিরগণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তির বহু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তবে আমাদের মতে সহজ , সরল , ও পরিস্কার কথা হচ্ছে , কুরআন মজীদ যে দীন ও জীবন ব্যবস্থা পেশ করে তার ভিত্তি রাখা হয়েছে তিনটি বুনিয়াদী আকীদার ওপর। এক, তাওহীদ। দুই , রিসালাত । তিন , আখেরাত । এ সূরাটি যেহেতু নির্ভেজাল তাওহীদ তত্ব বর্ণনা করেছেন তাই রসূলুল্লাহ ( সা) একে কুরআনের এক - তৃতীয়াংশের সমান গণ্য করেছেন।
হযরত আয়েশার (রা) একটি রেওয়ায়াত বুখারী ও মুসলিম এবং হাদীসের অন্যান্য কিতাবগুলোতে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক অভিযানে এক সাহাবীকে সরদারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। তিনি সমগ্র সফলকালে প্রত্যেক নামাযে “ কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ ” পড়ে কিরআত শেস করতেন। এটা যেন তার স্থায়ী রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফিরে আসার পর তার সাথীরা রসূলুল্লাহ (সা) কাছে একথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন , তাকে জিজ্ঞেস করো , সে কেন এমনটি করেছিল? তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন : এতে রহমানের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এর পাঠ আমার অত্যন্ত প্রিয়। রসূলুল্লাহ (সা) একথা শুনে লোকদের বলেন : আরবী -------------------------------------------------- “তাকে জানিয়ে দাও , আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন ।”
প্রায় এ একই ঘটনা বুখারী শরীফে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বললেন , জনৈক আনসারী কুবার মসজিদে নামায পড়াতেন। তাঁর নিয়ম ছিল , তিনি প্রত্যেক রাকাআতে ( আরবী --------------) পড়তেন। তারপর অন্য কোন সূরা পড়তেন। লোকেরা এ ব্যাপারে আপত্তি উঠায় । তারা বলেন , তুমি এ কেমন কাজ করছো , প্রথমে ( আরবী ------------) পড়ো তারপর তাকে যথেষ্ট মনে না করে আবার তার সাথে আর একটি সূরা পড়ো ? এটা ঠিক নয়। শুধূমাত্র “ কুল হুওয়াল্লাহ” পড়ো অথবা একে বাদ দিয়ে অন্য একটি সূরা পড়ো। তিনি জবাব দেন , আমি এটা ছড়াতে পারবো না। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নামায পড়াবো অথবা ইমামতি ছেড়ে দেবো। কিন্তু লোকেরা তাঁর জায়গায় আর কাউকে ইমাম বানানোও পছন্দ করতো না। অবশেষে ব্যাপারটি রসূলুল্লাহর (সা) সামনে আসে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন , তোমার সাথীরা যা চায় তা করতে তোমার বাধা কোথায় ? কোন জিনিসটি তোমাকে প্রত্যেক রাকআতে এ সূরাটি পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে ? তিনি বলেন : এ সূরাটিকে আমি খুব ভালোবাসি । রসূলুল্লাহ (সা) জবাবে বলেন : আরবী ---------------------------------- অর্থাৎ “ এ সূরার প্রতি তোমার ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। ”

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...