প্রশ্ন: ৪২০ : নারীর প্রতিষ্ঠা বলতে কি বুঝায় ? ইসলাম নারীকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ?

 উত্তর :

নারীর প্রতিষ্ঠা বলতে নারী নেতৃত্ব, ক্ষমতা বা তারা বাইরে গিয়ে কাজ করে নিজেদের ভরণ পোষণ করবে - এটা নয়। বরং, নারীর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, তারা তাদের যথাযথ অধিকার পাবে, মায়ের কথা শোনা এবং তাদের সেবা প্রয়োজনীয় বিষয় সরবরাহ করা সন্তানদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাবাদের জন্যও একই নিয়ম, তবে মায়ের জন্য তিনগুণ বেশী গুরুত্ব। এছাড়াও প্রত্যেক স্বামীর উপর বাধ্যতামূলক, তার স্ত্রীর ভরণ পোষণ করা। প্রত্যেক পিতার উপর বাধ্যতামূলক - তার কন্যাকে যথাযথ ভরণ - পোষণ ও পর্দার মধ্যে রেখে এরপর তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

অর্থাৎ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন মেয়ের দায়িত্ব, হয় তার পিতার উপর, অথবা বড় ভাইয়ের উপর, অথবা, স্বামীর উপর, অথবা, ছেলের উপর, অথবা, যথাযথ ভাবে অভিভাবকের উপর বাধ্যতামূলক ।

একজন নারীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে অন্য সংসারে চলে যায়, তখন তার বাবা মাকে আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করার কোন দায়িত্ব তার উপরে থাকেনা, অথচ, তারপরেও সে পিতা মাতার মৃত্যুর পর তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির অংশীদার হয়, একজন ভাইয়ের অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তি সে পায়।

বিয়ে হওয়ার পর সংসারের কোন খরচ তার নাই, কোন রকম আর্থিক দায় দায়িত্বও তার উপরে নাই, কিন্তু তারপরেও, এ বিয়ে হওয়ার জন্য তার স্বামীকে তাকে একটা মোহরানা দিতে হয়।


এভাবে একজন নারীর উপর কোনো ধরণের সামাজিক বা আর্থিক দায়িত্ব পালন করার কোন বাধ্য বাধকতা তার নেই, বরং, উল্টো তার যাবতীয় দায় দায়িত্ব, ভরণ পোষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরও, তাকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার দায়িত্বও বাধ্যতামূলক ভাবে পুরুষকেই দেওয়া হয়েছে, বরং, মোহরানা, স্বামীর পরিত্যাক্ত সম্পত্তির অংশ পাওয়া, পিতার সম্পত্তির অংশ পাওয়ার পরও বিনিময়ে তার কোন রকম আর্থিক দায় দায়িত্ব ইসলাম তার জন্য আরোপ করেনি। তার নিজের সম্পত্তি খরচ করার ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। অথচ, এ বিষয়টি একজন পুরুষের জন্য চিন্তাই করা যায়না।


আবার অন্যদিকে, নৈতিক দিক থেকে বলা হয়েছে, নারীর পায়ের নিচে তার সন্তানের বেহেশত, আর একজন পুরুষের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সেই ব্যাক্তি ভালো যার ব্যাপারে তার স্ত্রী সাক্ষ্য দিবে যে, সে ভালো।


অতএব, সামাজিক, আর্থিক, নৈতিক, সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে যা দিয়েছে, এর চেয়ে বেশী কিছু কল্পনাতীত এবং অন্য কোন ধর্ম, বিধান বা মতবাদে এমনটি আর কোথাও দেওয়া হয়নি। সম্ভবও নয়।

প্রশ্ন: ৪১৯ : ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম ।

 ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম:

মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪১পৃ:)
৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিত নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিত।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিত, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)
৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।
এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিত। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্‌রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।
পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।
তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।
ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)
একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্‌ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)
পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)
১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)
একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্‌মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)
১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)
১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)
১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)
ফুটনোটঃ
স্বালাতে মুবাশ্‌শির
ইমামতি এবং মুক্তাদি সম্পর্কিত
আবদুল হামীদ ফাইযী

প্রশ্ন: ৪১৮ : স্বামী এবং স্ত্রী মিলে জামায়েতের সাথে সালাত আদায় করা যাবে কী?

 প্রশ্ন : আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এশার ও তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করেছি। আমাদের এই নামাজ কি হয়েছে?   

উত্তর : আমরা ধরেই নিলাম, আপনি হয়তো বিশেষ কোনো কারণে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই আপনি মসজিদে না গিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় নামাজ পড়বেন, এই কাজটি সঠিক নয়।

যদি বিশেষ কোনো কারণে এশার নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায় করতে না পারেন, তাহলে আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। তবে স্ত্রীকে দাঁড়াতে হবে আপনার পেছনে, সে আপনার পাশে দাঁড়াতে পারবে না। আর যদি ধরুন আপনার দুই ছেলে আছে এবং তারাও জামাতে দাঁড়িয়েছে, তাহলে আপনার ছেলেরা পেছনে দাঁড়াবে, তারপর আপনার স্ত্রী দাঁড়াবে। এ ক্ষেত্রে আপনার মেয়েও আপনার স্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারবে। 

(ড. মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম।)



প্রশ্ন : স্বামী এবং স্ত্রী মিলে জামায়েতের সাথে সালাত আদায় করা যাবে কী?

মতলবী মল্লিক
মতলব (দঃ), চাঁদপুর।

প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:১০ এএম

উত্তর : মসজিদের জামাতের বিকল্প হিসাবে এ জামাত চলবে না। যদি কোনো কারণে ঘরেই নামাজ পড়তে হয়, আর তা জামাতে পড়ে সেটা গ্রহণযোগ্য। ফরজ নামাজ ছাড়া তো আর কোনো নামাজে জামাত নেই। ফরজ নামাজ যখন ঘরে পড়ার মত কারণ ঘটে তখন স্বামী স্ত্রী মিলেও জামাত পড়া যায়। তবে, ইমাম অবশ্যই স্বামীকে হতে হবে। দুই ব্যক্তি জামাত করলে যেভাবে একই কাতারে দাঁড়ায়, স্ত্রী এভাবে দাঁড়াবে না। স্ত্রী জামাতের সময় বরাবর না দাঁড়িয়ে পেছনে দাঁড়াবে।

সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।
উত্তর দিয়েছেন : আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী



স্বামী ও স্ত্রী একসাথে নামাজ আদায় করতে পারবে কি?
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন।
(ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪)।
অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’
(বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ,
আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান,
মিশকাত :১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০)।
নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং)।
অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)।
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)।
(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
No photo description available.

প্রশ্ন: ৪১৭ : দোয়া কবুল হওয়ার শর্তগুলো কি কি ।


আসলে প্রথম কথা হচ্ছে, দোয়া কবুল হবার অনেক গুলো শর্ত আলেমগণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারপরও লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, উক্ত শর্তগুলো মেনে দোয়া করার পরও এটা ১০০% নিশ্চয়তা দেওয়া যাবেনা যে, আপনার দোয়া কবুল হবেই।  কারণ প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি জানেন না, উক্ত দোয়া কবুল হওয়ার দ্বারা আসলে আপনার কল্যাণ হবে কিনা ?  যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দেখেন উক্ত দোয়া কবুল হলে বরং আপনার অকল্যাণ হবে, তাহলে হয়তো তিনি আপনার কল্যাণের কথা চিন্তা করেই উক্ত দোয়া অনুযায়ী আপনার প্রার্থিত বস্ত আপনাকে নাও দিতে পারেন। এতেই আপনার কল্যাণ। কিন্তু দোয়া বিফলে যায় না। আপনার প্রার্থিত বস্ত হুবহু না পেলেও আপনার দোয়ার কারণে ইহকালে পরকালে অন্য কল্যাণ আপনাকে আল্লাহ দান করবেন। 


তাই দোয়া করতে থাকতেই হবে। 

 

প্রশ্ন

দোয়া কবুল হওয়ার শর্তগুলো কি কি; যাতে দোয়াটি আল্লাহ্‌র কাছে কবুল হয়?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

দোয়া কবুল হওয়ার বেশকিছু শর্ত রয়েছে। যেমন:

১. আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকে না ডাকা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন: “যখন প্রার্থনা করবে তখন শুধু আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করবে এবং যখন সাহায্য চাইবে তখন শুধু আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাইবে।”[সুনানে তিরমিযি (২৫১৬), আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

এটাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণীর মর্মার্থ “আর নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহ্‌রই জন্য। কাজেই তোমরা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।”[সূরা জিন্‌, আয়াত: ১৮] দোয়ার শর্তগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ শর্ত পূরণ না হলে কোন দোয়া কবুল হবে না, কোন আমল গৃহীত হবে না। অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের মাঝে ও আল্লাহ্‌র মাঝে মৃতব্যক্তিদেরকে মাধ্যম বানিয়ে তাদেরকে ডাকে। তাদের ধারণা যেহেতু তারা পাপী ও গুনাহগার, আল্লাহ্‌র কাছে তাদের কোন মর্যাদা নেই; তাই এসব নেককার লোকেরা তাদেরকে আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিল করিয়ে দিবে এবং তাদের মাঝে ও আল্লাহ্‌র মাঝে মধ্যস্থতা করবে। এ বিশ্বাসের কারণে তারা এদের মধ্যস্থতা ধরে এবং আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এ মৃতব্যক্তিদেরকে ডাকে। অথচ আল্লাহ্‌ বলেছেন: “আর আমার বান্দারা যখন আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (তখন আপনি বলে দিন) নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী। দোয়াকারী যখন আমাকে ডাকে তখন আমি ডাকে সাড়া দিই।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬]

২. শরিয়ত অনুমোদিত কোন একটি মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে ওসিলা দেয়া।

৩. দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করা। তাড়াহুড়া করা দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে বড় বাধা। হাদিসে এসেছে, “তোমাদের কারো দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাড়াহুড়া করে বলে যে: ‘আমি দোয়া করেছি; কিন্তু, আমার দোয়া কবুল হয়নি”[সহিহ বুখারী (৬৩৪০) ও সহিহ মুসলিম (২৭৩৫)]

সহিহ মুসলিমে (২৭৩৬) আরও এসেছে- “বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে। বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়।”

৪. দোয়ার মধ্যে পাপের কিছু না থাকা। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া না  হওয়া; যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদিসে এসেছে- “বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে।”

৫. আল্লাহ্‌র প্রতি ভাল ধারণা নিয়ে দোয়া করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন।”[সহিহ বুখারী (৭৪০৫) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৭৫)] আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে, “তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া কর।”[সুনানে তিরমিযি, আলাবানী সহিহুল জামে গ্রন্থে (২৪৫) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করে আল্লাহ্‌ তার উপর প্রভুত কল্যাণ ঢেলে দেন, তাকে উত্তম অনুগ্রহে ভূষিত করেন, উত্তম অনুকম্পা ও দান তার উপর ছড়িয়ে দেন।

৬. দোয়াতে মনোযোগ থাকা। দোয়াকালে দোয়াকারীর মনোযোগ থাকবে এবং যাঁর কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে তাঁর মহত্ত্ব ও বড়ত্ব অন্তরে জাগ্রত রাখবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ্‌ কোন উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।”[সুনানে তিরমিযি (৩৪৭৯), সহিহুল জামে (২৪৫) গ্রন্থে শাইখ আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

৭. খাদ্য পবিত্র (হালাল) হওয়া। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “আল্লাহ্‌ তো কেবল মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ২৭] এ কারণে যে ব্যক্তির পানাহার ও পরিধেয় হারাম সে ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদূরপরাহত বিবেচনা করেছেন। হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যিনি দীর্ঘ সফর করেছেন, মাথার চুল উস্কুখুস্ক হয়ে আছে; তিনি আসমানের দিকে হাত তুলে বলেন: ইয়া রব্ব, ইয়া রব্ব! কিন্তু, তার খাবার-খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিধেয় হারাম, সে হারাম খেয়ে পরিপুষ্ট হয়েছে তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হবে?[সহিহ মুসলিম, (১০১৫)]

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন, হারাম ভক্ষণ করা দোয়ার শক্তিকে নষ্ট করে দেয় ও দুর্বল করে দেয়।

৮. দোয়ার ক্ষেত্রে কোন সীমালঙ্ঘন না করা। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা দোয়ার মধ্যে সীমালঙ্ঘন করাটা অপছন্দ করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক; নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” [সূরা আরাফ, আয়াত: ৫৫] আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন 41017 নং প্রশ্নোত্তর।

৯. ফরয আমল বাদ দিয়ে দোয়াতে মশগুল না হওয়া। যেমন, ফরয নামাযের ওয়াক্তে ফরয নামায বাদ দিয়ে দোয়া করা কিংবা দোয়া করতে গিয়ে মাতাপিতার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা। খুব সম্ভব বিশিষ্ট ইবাদতগুজার জুরাইজ (রহঃ) এর কাহিনী থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ জুরাইজ (রহঃ) তার মায়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে ইবাদতে মশগুল থেকেছেন। ফলে মা তাকে বদদোয়া করেন; এতে করে জুরাইজ (রহঃ) আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, আলেমগণ বলেছেন: এতে প্রমাণ রয়েছে যে, জুরাইজের জন্য সঠিক ছিল মায়ের ডাকে সাড়া দেয়া। কেননা তিনি নফল নামায আদায় করছিলেন। নফল নামায চালিয়ে যাওয়াটা হচ্ছে- নফল কাজ; ফরয নয়। আর মায়ের ডাকে সাড়া দেয়া ওয়াজিব এবং মায়ের অবাধ্য হওয়া হারাম....”[শারহু সহিহু মুসলিম (১৬/৮২)]

আরও অধিক জানতে মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আল-হামাদ রচিত ‘আল-দুআ’ নামক বইটি দেখুন।



=====================


মুসলমান হিসেবে আমরা কমেবেশি সবাই দোয়া করি। এটা অনেকটা স্বভাবজাত বিষয়।

তবে দোয়া করার সময় বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে খেয়াল রাখা দরকার। আলেমরা এগুলোকে দোয়া কবুলের শর্ত ও আদব বলে অভিহিত করেছেন।

পবিত্রতা অর্জন: পবিত্রতা অর্জনের পর দোয়া করলে আল্লাহতায়ালা সেই দোয়া কবুল করবেন।

বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা: বিনয়ের সঙ্গে দু’হাত তুলে দোয়া করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার নিকট হাত তুলে হাতের তালু সামনে রেখে দোয়া কর। হাত উল্টো করো না। দোয়ার শেষে উত্তোলিত হাত মুখমন্ডলে বুলিয়ে নাও। ’ -আবু দাউদ

মিনতিভরা কন্ঠে দোয়া করা: মিনতি ও নম্রতার সঙ্গে দোয়া করলে তা ইবাদত হিসেবে গন্য হয়। রাসূলে মকবুল (সা.) বলেছেন, ‘দোয়া সব ইবাদতের মজ্জা ও সারাংশ। ’ দাসত্বের পরিচয় প্রদানই ইবাদতের উদ্দেশ্য। বান্দার নিজের দীনতা ও অক্ষমতা বুঝতে পারা এবং আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও অপার মহিমা উপলব্দি করার মধ্যেই দাসত্বের প্রকাশ ঘটে। দোয়ার মাধ্যমে এ দু’টি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ নিজের অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব এবং আল্লাহর অপ্রতিহত ক্ষমতা, অপার মহিমা ও প্রতাপ অন্তরে স্থান পাওয়া আবশ্যক। দীনতা ও নম্রতা দোয়ার মধ্যে যত অধিক হবে ততই মঙ্গল।

দু’হাত তুলে দোয়া করা: বিনয়, নম্রতা ও দাসত্ব প্রকাশ করার জন্য দোয়ার সময় দু’হাতের তালু আসমানের দিকে রাখতে হবে এবং হাত সম্পূর্ণ সম্প্রসারিত করে দু’হাতের মধ্যে ২/১ আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখতে হবে। হাত কচলানো, রশি পাকানোর মতো হাতের তালু ঘষাঘষি করা দোয়ার আদবের খেলাপ। মনে রাখবেন, আপনি শাহানশাহেরর দরবারে হাত তুলেছেন, তাই এখানে কোনো ধরনের অমনোযোগিতা কাম্য নয়। এছাড়া দোয়া শেষে দু’হাত তুলে দোয়া করে দোয়া শেষে হাত দু’টি মুখমন্ডলে মুছে নিবে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, ‘যে হাত আল্লাহর দরবারে উত্তোলিত হয়, তা একেবারে শূণ্য অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন। ’

আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফসহ দোয়া করা : আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফসহ দোয়া করা। আল্লাহর প্রশংসা যেমন, ‘আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন’ দোয়ার শুরুতে বলা। এছাড়া ইসমে আজমের সহিত দোয়া করা উত্তম। হজরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইসমে আজম এই আয়াতদ্বয়ে রয়েছে-
১. ‘ওয়া ইলাহুকুম ইলাহু ওয়াহিদুন লা ইলাহা ইল্লা হুয়ার রাহমানুর রাহিম। ’ -সূরা বাক্বারা : ১৬৩
২. ‘আলীফ লাম মীম। আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম। ’ -সূরা আল ইমরান : ১

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন রাসূলে কারিম (সা.)-এর নিকট বসেছিলাম। একজন লোক সেখানে নামাজ পড়ছিল। সে তার দোয়ার মধ্যে আরজ করল, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আমার প্রয়োজন প্রার্থনা করছি এই ওসিলায় যে, প্রশংসা ও গুনকীর্তণ আপনার জন্যই উপযুক্ত। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি পরম দয়ালু ও অসীম অনুগ্রহদাতা এবং পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলীর স্রষ্টা। আমি আপনার কাছেই আপনার অনুগ্রহ চাই। ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যু! ইয়া জালজালালী ওয়াল ইকরাম! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ বান্দা আল্লাহর ইসমে আজমের ওসিলায় দোয়া করেছে। এ ওসিলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয় এবং আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাইলে, আল্লাহ তা দান করেন। -তিরমিজি

হজরত ফুজালা ইবনে উবায়দা (রা.) বর্ননা করেন, রাসূলে কারিম (সা.) এক ব্যক্তিকে দোয়া করতে শুনলেন। সে দোয়ায় আল্লাহপাকের প্রশংসা করল না এবং রাসূল (সা.)-এর ওপর দরুদও পাঠ করল না। এতে রাসূলে আকরাম (সা.) বললেন, লোকটি তড়িঘড়ি করে দোয়া করেছে। তিনি লোকটিকে ডেকে আনলেন এবং তাকে অথবা উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ পড়ে তখন দোয়া করার পূর্বে তার উচিত আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করে নেয়া ও রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠ করা। এরপর যা ইচ্ছা তা চাওয়া। -তিরমিজি ও আবু দাউদ

এক হাদিসে এসেছে হজরত রাসূলে মাকবুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দোয়া করার পূর্বে দরুদ শরীফ পড়ে, তার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। মহান আল্লাহতায়ালা অসীম দয়ালু; দোয়ার কিয়দাংশ কবুল করে অপর অংশ কবুল না করা তার স্বভাব নয়। এই হাদিসের সারমর্ম এই যে, দরুদ তিনি অবশ্যই কবুল করে থাকেন, সুতরাং তিনি দরুদ কবুল করে দোয়ার অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ প্রার্থনীয় বিষয় অগ্রাহ্য করেন না। শেষ পর্যন্ত উভয় অংশই কবুল করেন।

হজরত আবু সোলায়মান দারানী (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো দোয়া করে, তার উচিত, প্রথমে দরুদ পড়া এবং দরুদ পড়ে দোয়া শেষ করা। কেননা আল্লাহ উভয় দরুদ কবুল করেন। -কিমিয়ায়ে সাআদাত

** দোয়া শুধু প্রয়োজনে নয়, এটা ইবাদতও

প্রশ্ন: ৪১৬ : ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম ।


মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪১পৃ:)
৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিত নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিত।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিত, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)
৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।
এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিত। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্‌রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।
পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।
তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।
ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)
একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্‌ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)
পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)
১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)
একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্‌মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)
১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)
১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)
১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)
ফুটনোটঃ
স্বালাতে মুবাশ্‌শির
ইমামতি এবং মুক্তাদি সম্পর্কিত
আবদুল হামীদ ফাইযী

প্রশ্ন: ৪১৫ : জামায়াতের কাতার সম্পর্কিত ।

 জামা‘আতে নামাযে দাঁড়ানোর পদ্ধতি, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সালাত হলো দ্বীনে ইছলামের দ্বিতীয় রুক্‌ন। ইছলাম ও কুফ্‌রের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী যেসব বিষয় রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো সালাত। আল্লাহ্‌র (7) আদেশকৃত প্রতিটি বিধি-বিধানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে অসংখ্য হিকমাত। এসবের বেশিরভাগই মানবজাতি তার স্বল্প ও সীমিত জ্ঞান দ্বারা বুঝতে অক্ষম-অপারগ।

তবে সর্বাবস্থায় তা পালনের মধ্যেই রয়েছে মানুষের ইহ-পরকালের মুক্তি ও কল্যাণ। প্রত্যেক মুছলমান পুরুষের জন্য পাঁচ ওয়াক্ব্‌ত ফার্‌য সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করা ইছলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। ইছলামের এই বিধানটির মূলেও অসংখ্য হিকমাত নিহিত রয়েছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে মুছলমানদের পারস্পরিক ভেদাভেদ, অনৈক্য ও হিংসা-বিদ্ধেষ দূর করার এবং তাদের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, ভালোবাসা, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির এক অনন্য প্রশিক্ষণ, তেমনি এটি হলো মুছলমানদের ঐক্যের প্রতীক। “মুছলমানদের মধ্যে সাদা-কালো, ধনী-গরীব, বাদশাহ-ফক্বীর, আশরাফ-আত্বরাফ বা জাত-বংশের কোন তারতম্য ও ভেদাভেদ নেই। তারা সকলেই আল্লাহ্‌র বান্দাহ এবং পরস্পর ভাই ভাই। আল্লাহ্‌র পথে তারা সকলেই ঐক্যবদ্ধ”। গোঁটা বিশ্বকে এই নিরব বার্তা পৌঁছে দেয়ার এবং এর বাস্তব চিত্র প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম হলো পাঁচ ওয়াক্ব্‌ত জামা‘আতে সালাত। আর এই জামা‘আতে সালাত ক্বায়িমের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম একটি বিষয় হলো সফ (ক্বাতার) ঠিক করা।

ক্বাতার (সফ) ঠিক করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা-

সফ সোজা-সঠিক করা হলো জামা‘আতে সালাতের প্রথম কাজ। মুছলমানদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্ধেষ ও পারস্পরিক মতানৈক্য দূর করা, তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ঐক্য সৃষ্টি করা এবং তা অটল ও অটুট রাখা, নামাযে বিনয় ও একাগ্রতা লাভ, শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে আত্মরক্ষা, নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র (7) রাহ্‌মাত ও নৈকট্য লাভ ইত্যাদির অনেকটাই নির্ভর করে নামাজে সঠিকভাবে সফবন্দি হওয়ার উপর। সঠিকভাবে সফবন্দি হওয়া ছাড়া নামায পরিপূর্ণ হয় না, এবং সেই নামায সঠিকভাবে ক্বায়িম হয়েছে বলেও গণ্য হয় না। এর প্রমাণ হলো-
আনাছ ইবনু মালিক e থেকে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে যে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

سَوُّوا صُفُوفَكُمْ؛ فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصُّفُوفِ مِنْ إِقَامَةِ الصَّلَاةِ.

অর্থ- তোমরা তোমাদের সফগুলো সোজা করো, কেননা সফ সোজা করা নামায ক্বায়িমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
আনাছ ইবনু মালিক e হতে বর্ণিত অন্য বর্ণনায় রয়েছে রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

سَوُّوا صُفُوفَكُمْ فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصَّفِّ مِنْ تَمَامِ الصَّلَاةِ.

অর্থ- তোমরা তোমাদের সফগুলো সোজা; ঠিকঠাক করো, কেননা সফ সোজা করা নামাযের পরিপূর্ণতার অন্তর্ভুক্ত।
আর অসম্পূর্ণ সালাত কিংবা সঠিকভাবে ক্বায়িম করা হয়নি এমন সালাত আল্লাহ্‌র কাছে মাক্ববূল হওয়ার আশা করা যায় না। একারণেই রাছূলুল্লাহ 1 এবং সাহাবায়ে কিরাম 4 জামা‘আতে সালাত আদায়কালীন সফ ঠিক করার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সফ সোজা ও ঠিকঠাক না হতো ততক্ষণ তারা নামাযই শুরু করতেন না।
রাছূলুল্লাহ 1 জামা‘আতে নামায শুরু করার আগে একাধিকবার সাহাবায়ে কিরামকে (4) শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে ক্বাতার সোজা করে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিতেন। ক্বাতার সোজা করার জন্য প্রয়োজনে তিনি লাঠিও ব্যবহার করতেন।
নু‘মান ইবনু বাশীর e হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُسَوِّي صُفُوفَنَا إِذَا قُمْنَا إِلَى الصَّلَاةِ ، فَإِذَا اسَتْوَيْنَا كَبَّرَ.

অর্থ- আমরা যখন নামাযে (জামা‘আতে) দাঁড়াতাম তখন রাছূলুল্লাহ 1 আমাদের সফগুলো ঠিক করাতেন। আমরা যখন ঠিকঠাক হয়ে যেতাম (সফগুলো যখন সোজা ও ঠিকঠাক করে নিতাম) তখন তিনি তাকবীর (তাকবীরে তাহ্‌রীমাহ) বলতেন।
এ সম্পর্কে আনাছ e হতে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, তিনি বলেছেন যে, রাছূলুল্লাহ 1 বলতেন:-

اسْتَوُوا، اسْتَوُوا، اسْتَوُوا، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنِّي لَأَرَاكُمْ مِنْ خَلْفِي كَمَا أَرَاكُمْ مِنْ بَيْنِ يَدَيَّ.

অর্থ- ঠিকভাবে সোজা সমান্তরাল হয়ে দাঁড়াও! ঠিকভাবে সোজা সমান্তরাল হয়ে দাঁড়াও! ঠিকভাবে সোজা সমান্তরাল হয়ে দাঁড়াও! কেননা যার হতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে আমার পশ্চাৎ থেকে তেমনি দেখতে পাই যেমনি আমি তোমাদেরকে সম্মুখ থেকে দেখে থাকি।
নাফি‘ o হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে,

كَانَ عُمَرُ يَبْعَثُ رَجُلًا يُقَوِّمُ الصُّفُوفَ، ثُمَّ لَا يُكَبِّرُ حَتَّى يَأْتِيَهُ ، فَيُخْبِرَهُ أَنَّ الصُّفُوفَ قَدِ اعْتَدَلَتْ.

অর্থ- উমার e নামাযের সফ সোজা ও ঠিকঠাক করার জন্য একজন লোক পাঠাতেন। ঐ লোক এসে যে পর্যন্ত না তাকে অবগত করত যে, সারিগুলো (নামাযের সফগুলো) সোজা-সঠিক হয়ে গেছে ততক্ষণ তিনি তাকবীর (তাকবীরে তাহ্‌রীমা) বলতেন না।১০
তিরমিযীর অন্য বর্ণনায় ‘উমার e সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে,

أَنَّهُ كَانَ يُوَكِّلُ رِجَالًا بِإِقَامَةِ الصُّفُوفِ فَلَا يُكَبِّرُ حَتَّى يُخْبَرَ أَنَّ الصُّفُوفَ قَدْ اسْتَوَتْ.১১

তিনি (উমার e) নামাযের সফগুলো সোজা ও ঠিকঠাক করার জন্য কিছু লোককে দায়িত্ব দিয়ে রাখতেন, যতক্ষণ না তারা সফ পুরোপুরি সোজা-সঠিক হয়েছে বলে তাকে অবগত করতেন, ততক্ষণ তিনি তাকবীর বলতেন না।১২
মুসান্নফু ‘আব্দির্‌ রায্‌যাক্ব গ্রন্থে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার h হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: كَانَ عُمَرُ لَا يُكَبِّرُ حَتَّى تَعْتَدِلَ الصُّفُوفُ ، يُوَكِّلُ بِذَلِكَ رِجَالًا.১৩

অর্থ- ‘উমার e নামাযে সফ সোজা; ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত তাকবীর (তাকবীরে তাহ্‌রীমাহ) বলতেন না এবং সফ ঠিক করে দেয়ার জন্য কিছু লোককে তিনি দায়িত্ব দিয়ে রাখতেন।১৪

وَرُوِيَ عَنْ عَلِيٍّ، وَعُثْمَانَ، أَنَّهُمَا كَانَا يَتَعَاهَدَانِ ذَلِكَ، وَيَقُولاَنِ: اسْتَوُوا.১৫

অর্থ- ‘আলী এবং ‘উছমান h হতে বর্ণিত যে, তারা উভয়েও তদ্রুপ করতেন। তাঁরা উভয়েই মুসাল্লীদের উদ্দেশ্য করে বলতেন:- তোমরা সফ ঠিক করো।১৬
কোন কোন সাহাবী কাতার সোজা-সঠিক করার জন্য প্রয়োজনে পায়ে বেত্রাঘাতও করতেন।
‘উমার e সফ সোজা করতে যেয়ে আবূ ‘উছমান আন নাহ্‌দী-র পায়ে বেত্রাঘাত করেছেন।১৭
ছুওয়াইদ ইবনু গাফালাহ e হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

كَانَ بِلالٌ يَضْرِبُ أَقْدَامَنَا فِي الصَّلاةِ , وَيُسَوِّي مَنَاكِبَنَا.১৮

অর্থ- বিলাল e নামাযের সময় (সফ সোজা করার জন্য) আমাদের পায়ে বেত্রাঘাত করতেন এবং আমাদের কাঁধসমূহ সমান্তরাল করে দিতেন।১৯
উপরোক্ত বর্ণনা সমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নামাযে ক্বাতার সোজা-সঠিক করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাছূলুল্লাহ 1 এবং সাহাবায়ে কিরাম 4 এ বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন। একারণেই অনেক ‘উলামায়ে কিরাম নামাযে ক্বাতার সোজা করা ওয়াজিব বলে অভিমত দিয়েছেন।

কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে প্রায় সকল মাছজিদেই সম্মানিত ইমাম সাহেবগণও বেশি থেকে বেশি “কাতার সোজা করুন, মোবাইল ফোন বন্ধ করুন” বলেই নিজ দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করেন। ইমাম সাহেবগণ ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকেন, ক্বাতার ঠিক হোক বা না হোক সময় হওয়ার সাথে সাথেই তারা তাকবীরে তাহ্‌রীমা বলে নামায শুরু করে দেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, মাছজিদের নির্দিষ্ট সময়ে কেবল নামায শুরু করে দেয়াটাই তাদের উপর ওয়াজিব। জুমু‘আর সালাত এবং ‘ঈদের সালাতেও সেই একই অবস্থা। ইমাম সাহেব দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রথমে বাংলা খুৎবা দিতে থাকেন, অন্যদিকে জুমু‘আ পূর্ববর্তী ছুন্নাত সালাতের জন্য এতই সংক্ষিপ্ত সময় দেয়া হয় যে, ধীরে-স্থিরে চার রাকা‘আত সালাত আদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ইমাম সাহেব ‘আরাবী খুতবা দিতে শুরু করে দেন। ‘ঈদের সালাতেও যেখানে খুতবা সালাতের পরে দেয়া ওয়াজিব, সেখানে দেখা যায় যে, ইমাম সাহেব সালাতের আগেই বাংলায় খুতবা (ভাষণ) দিতে থাকেন। সালাত শুরু হওয়ার এক মিনিট পূর্ব পর্যন্ত তার ভাষণ চলতে থাকে। হঠাৎ করে “নামায শুরু হচ্ছে, সফ সোজা করুন” বলে মানুষের বিরাট ক্বাফিলাহ্‌ (দল) কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকবীর বলে নামায শুরু করে দেন। এদিকে দেখা যায় যে, সফ সোজা হওয়া তো দূরের কথা অসংখ্য লোক সফের বাইরে এলোমেলোভাবে যে যেভাবে পারেন নামাযে অংশগ্রহণের চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে অনেকের হয়ত দু’তিনটি তাকবীরই বাদ পড়ে গেছে। ওদিকে ইমাম সাহেব যথাসময়ে সালাত শুরু করতে পেরে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ মুক্বতাদী কিংবা মাছজিদ পরিচালনা কমিটির কথা না হয় বাদই দিলাম, ইমাম সাহেবগণ কি জানেন না যে, জামা‘আতের অর্থ ও তাৎপর্য কী? সফ সোজা করার অর্থ কী? জামা‘আতে সালাত আদায় করার পিছনে কী হিকমাত বা প্রজ্ঞা নিহিত রয়েছে? জামা‘আতে সালাত আদায়কালীন তাদের করণীয় কী? হাদীছে এসময় কী করার নির্দেশ রয়েছে? রাছূলুল্লাহ 1 ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম 4 তখন কী করতেন? তারা কি নির্দিষ্ট সময় হলেই আল্লাহু আকবার বলে নামায শুরু করে দিতেন, নাকি সর্বাগ্রে তারা সফ সোজা করতেন? যদি এসব মৌলিক বিষয় কারো জানা না থাকে, কিংবা জানা থাকলেও তা পালন ও বাস্তবায়নের মত সৎসাহস না থাকে, তাহলে আমরা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি যে, সে লোক কোনভাবেই ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
অজ্ঞতার কারণে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মুক্ব্‌তাদীগণও উপরোক্ত বিষয়ে চরম উদাসীন। প্রায় প্রতিটি মাছজিদে জামা‘আতকালীন ক্বাতারের (সফ বা লাইনের) অবস্থা দেখলে সহজেই বুঝা যায় যে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক হৃদ্যতা, আন্তরিকতা ও ঐক্যের কতো অভাব। তারা কতই না বিশৃঙ্খল। তাদের অনেকের দাঁড়ানোর অবস্থা দেখলে বুঝার উপায় নেই যে, তারা কি নামাযের জন্য দাঁড়িয়েছেন না অন্য কোন কাজের জন্য। পায়ের অবস্থান- সে তো এক পা আগে, আরেক পা পিছে। যেখানে নামাযে দাঁড়ানো কিংবা বসা সর্বাবস্থায় উভয় পায়ের অগ্রভাগ ক্বিবলামুখী থাকা আবশ্যক, সেখানে দেখা যায় যে, অধিকাংশেরই ডান পা উত্তরমুখী আর বাম পা দক্ষিণমুখী হয়ে আছে। এই যদি হয় প্রত্যেক মুক্ব্‌তাদীর দাঁড়ানোর অবস্থা, তাহলে সমবেত নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের সফ বা লাইনের চিত্র কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
মুক্ব্‌তাদীগণের জানা উচিত যে, জামা‘আতে সালাত আদায়কালীন পরস্পর কাঁধ সমান্তরাল রেখে এবং একে অপরের পায়ের গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলিয়ে মধ্যবর্তী ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে সোজা-সঠিকভাবে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো, এটা মূলত মুক্ব্‌তাদীগণেরই কাজ। ইমাম সাহেবের দায়িত্ব হলো- বিষয়টি নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে কঠোরতা আরোপ করা এবং সফ সোজা ও পুরোপুরি ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত সালাত শুরু না করা। শুধু তাই নয় বরং সালাত শুরুর পূর্বে, জুমু‘আর খুতবায় কিংবা ধর্মীয় বিভিন্ন আলোচনা সভায় এতদ্বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ক্বোরআন-ছুন্নাহ্‌র বিশুদ্ধ দালীল-প্রমাণসহ সাধারণ মুছলমানকে অবহিত করা।
সফ ঠিক বা সোজা করা বলতে কি বুঝায়? রাছূলুল্লাহ 1 ও সাহাবাবায়ে কিরাম g কিভাবে সফ ঠিক করতেন?
বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, সফ ঠিক করার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো নিম্নরূপ; রাছূলুল্লাহ 1 এবং সাহাবায়ে কিরাম g “সফ সোজা করো” বলতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে বুঝতেন এবং বুঝাতেন-
(এক) সমান্তরাল হওয়া। আর এই সমান্তরাল দুই দিক থেকে হতে হবে। (ক) উপরের দিকে- কাঁধে কাঁধে। (খ) নিচের দিকে- পায়ে পায়ে। এর প্রমাণ হলো-

(১) আবূ মাছ‘উদ e হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

كَانَ رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَمْسَحُ مَنَاكِبَنَا فِي الصَّلَاةِ، وَيَقُولُ اسْتَوُوا، وَلَا تَخْتَلِفُوا؛ فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ .——-২০

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 সালাতের সময় আমাদের কাঁধ ছুঁয়ে দেখতেন আর বলতেন: সমান্তরাল হও, পরস্পর ভিন্নতা অবলম্বন করো না, নতুবা তোমাদের অন্তরও পরস্পর বিভক্ত-বিভেদপূর্ণ হয়ে যাবে ————–।২১
(২) নু‘মান ইবনু বাশীর e হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

كَانَ رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُسَوِّي صُفُوفَنَا، حَتَّى كَأَنَّمَا يُسَوِّي بِهَا الْقِدَاحَ، حَتَّى رَأَى أَنَّا قَدْ عَقَلْنَا عَنْهُ ، ثُمَّ خَرَجَ يَوْمًا فَقَامَ حَتَّى كَادَ يُكَبِّرُ، فَرَأَى رَجُلًا بَادِيًا صَدْرُهُ مِنْ الصَّفِّ ؛ فَقَالَ : عِبَادَ الله ! لَتُسَوُّنَّ صُفُوفَكُمْ، أَوْ لَيُخَالِفَنَّ الله بَيْنَ وُجُوهِكُمْ.২২

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 (সালাতে) আমাদের সফগুলো এমনভাবে সোজা করাতেন যেন তিনি এর দ্বারা কামানের কাঠ সোজা করছেন, যতক্ষণ না তিনি উপলব্ধি করলেন যে, আমরা তার থেকে (বিষয়টি) পুরোপুরি বুঝে গেছি। অতঃপর একদিন তিনি বেরিয়ে এসে সালাতে দাঁড়িয়ে তাকবীর দিতে যাবেন (তাকবীরে তাহ্‌রীমাহ বলে নামায শুরু করতে যাবেন) এমন সময় দেখলেন যে, এক ব্যক্তির বক্ষ সফ থেকে এগিয়ে আছে। তখন তিনি বললেন:- “আল্লাহ্‌র বান্দাহগণ! অবশ্যই তোমরা তোমাদের সফগুলো সোজা-সঠিক করে নেবে, অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের চেহারায় (পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারার মধ্যে) বিভেদ-মতানৈক্য সৃষ্টি করে দেবেন”।২৩
(৩) বারা ইবনু ‘আযিব e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَخَلَّلُ الصَّفَّ مِنْ نَاحِيَةٍ إِلَى نَاحِيَةٍ يَمْسَحُ صُدُورَنَا وَمَنَاكِبَنَا ، وَيَقُولُ : لَا تَخْتَلِفُوا فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ ، وَكَانَ يَقُولُ : إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الصُّفُوفِ الْأُوَلِ.২৪

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 আমাদের বক্ষ ও কাঁধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে সফের একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত অতিক্রম করতেন আর বলতেন:- পরস্পর ভিন্নতা অবলম্বন করো না, নতুবা তোমাদের অন্তরও পরস্পর বিভক্ত-বিরোধপূর্ণ হয়ে যাবে। তিনি (রাছূলুল্লাহ) আরও বলতেন:- নিশ্চয় আল্লাহ প্রথম ক্বাতার সমূহের (মুসাল্লীদের) উপর রাহ্‌মাত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশতাগণ তাদের জন্য রাহ্‌মাত প্রার্থনা করেন।২৫
মুছলিম উম্মাহ আজ শতধা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন। তাদের পরস্পরের মধ্যে মতভেদ আর মতানৈক্যের কোন ইয়ত্তা নেই। এমনকি নামাযের রূপরেখা আর পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে তাদের মধ্যে অনেক মতবিরোধ। মুছলিম উম্মাহ্‌র এই বিভক্তি, ‍বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের পিছনে যেসব কারণ রয়েছে, তন্মধ্যে উপরোক্ত হাদীছে বর্ণিত কারণটি হলো অন্যতম। তারা যদি রাছূলুল্লাহ এর নির্দেশমত একে অন্যের কাঁধে কাঁধ সমান্তরাল রেখে পায়ের গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলিয়ে ক্বাতারগুলো সোজা-সঠিক করে ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মিলিত হয়ে দাঁড়াত, তাহলে তাদের মধ্যে এতো অনৈক্য, বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হত না এবং তারা আল্লাহ্‌র (7) রাহ্‌মত থেকেও বিচ্ছিন্ন হত না।
(৪) ‘আব্দুল্লাহ্‌ ইবনু ‘উমার h হতে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, তিনি বলেন-

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَقِيمُوا الصُّفُوفَ، وَحَاذُوا بَيْنَ الْمنَاكِبِ، وَسُدُّوا الْخلَلَ، وَلِينُوا بِأَيْدِي إِخْوَانِكُمْ، وَلا تَذَرُوا فُرُجَاتٍ لِلشَّيْطَانِ، وَمَنْ وَصلَ صَفّاً وَصَلَهُ الله، وَمَنْ قَطَعَ صَفّاً قَطَعَهُ الله.২৬

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- তোমরা সফগুলো সোজা-সঠিক করো, পরস্পরের কাঁধ সমান্তরাল রেখো, ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করো, তোমাদের ভাইদের জন্য হাত নরম করো (কেউ যদি ক্বাতারে প্রবেশ করতে চায় তাহলে হাত শক্ত করে রেখোনা যাতে সে ঢুকতে না পারে বরং হাত নরম করে তাকে সফের ফাঁকে প্রবেশের সুযোগ দাও) এবং শয়তানের জন্য ছোট ছোট ফাঁকা জায়গা ছেড়ে দিও না। যে ব্যক্তি (নামাযে) ক্বাতার মিলিয়ে রাখে (ক্বাতারের ফাঁকা জায়গায় প্রবেশ করে ফাঁক বন্ধ করে ক্বাতার মিলিয়ে রাখে) আল্লাহ 0 তাকে তাঁর (রাহ্‌মাতের) সাথে মিলিয়ে রাখেন, আর যে ব্যক্তি ক্বাতার বিচ্ছিন্ন করে (সফের মধ্যে ফাঁকা জায়গা রেখে দেয়, যদ্দরুন দু’জন মুসাল্লী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তদ্বারা সফও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়) আল্লাহ 7 তাকে তাঁর (রাহ্‌মাত) থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন।২৭
(৫) ‘আলী ইবনু আবী ত্বালিব e হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

اسْتَوَوْا تَسْتَوِي قُلُوبُكُمْ ، وَتَمَاسُّوا تَرَاحَمُوا.২৮

অর্থ- তোমরা (সালাতে) ঠিকভাবে সোজা-সমান্তরাল হয়ে দাঁড়াও তাহলে তোমাদের অন্তরও সোজা-সঠিক থাকবে এবং তোমরা গাদাগাদি করে মিলিত হয়ে দাঁড়াও তাহলে তোমাদের প্রতি রাহম করা হবে।২৯
এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, তা হলো- প্রত্যেক মুসাল্লীকে সালাতে (একাকী হোক বা জামা‘আতে) নিজের দু’পায়ের মাঝখানে এই পরিমাণ ফাঁক রেখে দাঁড়ানো উচিত, যাতে বসতে গিয়ে তাকে অতিরিক্ত জায়গা দখল করতে না হয় কিংবা অতিরিক্ত সংকুচিত হয়ে বসতে না হয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ শরীরের মাপ অনুযায়ী দু’পায়ের মাঝখানে স্বাভাবিক ফাঁক রেখে দাঁড়াবেন, যাতে বসার সময় ঐ জায়গাটুকুতে স্বাচ্ছন্দে বসতে পারেন। আমাদের দেশের মাছজিদগুলোতে দেখা যায়- কোন কোন মুসাল্লী নিজের দু’পায়ের মাঝখানে মাত্র আট-দশ আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রেখে খুব এঁটে সেঁটে নামাযে দাঁড়ান, আবার কেউ কেউ নিজের ডান ও বাম পার্শ্বের মুসাল্লীর পায়ের সাথে পা মিলানোর জন্য তথা ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করার জন্য কিংবা এমনিতেই (এমনকি একাকী সালাতেও) নিজের পা দুটিকে অস্বাভাবিকভাবে (অনেক বেশি) প্রশস্থ করে দাঁড়ান। প্রকৃতপক্ষে দাঁড়ানোর এই উভয় পদ্ধতিই ছুন্নাহ্‌সম্মত নয়। এভাবে দাঁড়ালে ছাজদাহ করার সময় এবং বসার সময় অন্যের জায়গা হয় দখল করতে হয়, নতুবা দু’জনের মাঝখানে অনেক জায়গা খালি পড়ে থাকে। অথচ এর কোনটাই কাম্য নয়।

(দুই) একজনের পায়ের গোড়ালির সাথে অপরজনের পায়ের গোড়ালি লাগিয়ে দুইজনের মধ্যকার ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ক্বাতারবন্দি হওয়া। এর প্রমাণ হলো-

(১) আবূ হুরাইরাহ e হতে বর্ণিত-

قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:.سُدُّوا الْخلَلَ.৩০

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- তোমরা (সালাতে) ফাক-ফোঁকর বন্ধ করো।৩১

(২) সাহীহ্‌ বুখারীতে আনাছ ইবনু মালিক e হতে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে যে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي وَكَانَ أَحَدُنَا يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَقَدَمَهُ بِقَدَمِهِ.৩২

অর্থ- তোমরা তোমাদের সফগুলো ঠিকঠাক ও সোজা করে নাও, কেননা আমি তোমাদেরকে আমার পিছন দিক থেকেও দেখতে পাই। আনাছ e বলেন- (একথা শুনার সাথে সাথে) আমাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ পার্শ্ববর্তী লোকের কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা খুব ভালো করে লাগিয়ে নিতাম।৩৩
(৩) আনাছ e হতে অন্য বর্ণনায় বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেছেন-

أُقِيمَتْ الصَّلَاةُ ، فَأَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِوَجْهِهِ ، فَقَالَ : أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ ، وَتَرَاصُّوا ، فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي.৩৪

অর্থ- একদা নামাযের ইক্বামাত হয়ে যাওয়ার পর রাছূলুল্লাহ 1 আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন:- তোমরা তোমাদের সফগুলো ঠিক করো এবং শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করো। আমি তোমাদেরকে আমার পিছন থেকেও দেখতে পাই।৩৫
(৪) নু‘মান ইবনু বাশীর e হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

أَقْبَلَ رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى النَّاسِ بِوَجْهِهِ ، فَقَال: أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ، أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ، أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ، وَالله لَتُقِيمُنَّ صُفُوفَكُمْ، أَوْ لَيُخَالِفَنَّ الله بَيْنَ قُلُوبِكُمْ.৩৬

অর্থ- একদা রাছূলুল্লাহ 1 মানুষের (নামাযের জন্য উপস্থিত লোকদের) প্রতি মুখ ফিরিয়ে (তাকিয়ে) বললেন:- তোমরা সফ ঠিক করো, তোমরা সফ ঠিক করো, তোমরা সফ ঠিক করো। আল্লাহ্‌র শপথ! তোমরা অবশ্যই সফ ঠিক করবে অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের অন্তরকে বিভক্ত করে দিবেন।৩৭
(৫) আবূ ছা‘ঈদ আল খুদরী e হতে বর্ণিত-

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رضي الله عنه، أَنَّ رَسُولَ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ –: فإِذَا قُمْتُمْ إِلى الصَّلَاةِ، فَاعْدِلُوا صُفُوفَكُمْ، وَأَقِيمُوهَا، وَسُدُّوا الْفُرَجَ ؛ فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي.৩৮

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-  — অতঃপর যখন তোমরা সালাতে দাঁড়াবে, তখন তোমরা তোমাদের সফগুলো সোজা-সুদৃঢ় করো এবং ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করো, কেননা আমি তোমাদেরকে আমার পিছন থেকেও দেখতে পাই।৩৯

এই ছিল সাহাবায়ে কিরামের (4) সালাতে দাড়ানোর নমূনা। আর আমাদের মাছজিদগুলোতে দেখা যায় এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। মুসাল্লীগণ তাদের পরস্পরের মধ্যে এত বিস্তর ফাঁক রেখে দাঁড়ান, দেখে মনে হয় যেন কেউ তাদের নির্দেশ দিচ্ছে যে, তোমরা পরস্পর নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখো, একজনের ছোঁয়া যেন অপরজনের গায়ে না লাগে কিংবা শয়তান তাদেরকে বলছে যে, আমি আসছি আমার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রেখো। তাছাড়া এই ফাঁকা জায়গায় কেউ প্রবশ করতে চাইলে তারা প্রচন্ড বিরক্তি বোধ করেন এবং হাত শক্ত করে যথাসম্ভব তাকে বাঁধা দানের চেষ্টা করেন। নামাযে পায়ের সাথে পা এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলানোকে তারা রীতিমত দৃষ্টতা ও বে-আদবী বলে মনে করেন।

(তিন) একের পর এক সামনের সফগুলো পূরণ করে পর্যায়ক্রমে পিছনের সফগুলোতে আসা। এর প্রমাণ হলো-

(১) জাবির ইবনু ছামুরাহ h হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَقَالَ : أَلَا تَصُفُّونَ كَمَا تَصُفُّ الْملَائِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا ؟ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ الله، وَكَيْفَ تَصُفُّ الْمَلَائِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا ؟ قَالَ: يُتِمُّونَ الصُّفُوفَ الْأُوَلَ، ويَتَرَاصّونَ في الصَّفِّ.৪০

অর্থ- একদিন রাছূলুল্লাহ 1 বেরিয়ে এসে আমাদেরকে বললেন:- ফিরিশতারা যেভাবে তাদের পালনকর্তার সামনে সারিবদ্ধ (সফবন্দি) হন তোমরা কেন সেভাবে সারিবদ্ধ (সফবদ্ধ) হও না? আমরা বললাম- হে আল্লাহ্‌র রাছূল! ফিরিশতারা কিভাবে তাদের পালনকর্তার সামনে সফবদ্ধ হন? রাছূলুল্লাহ 1 বললেন:- তারা (প্রথমে) সামনের সফগুলো পূরণ করেন এবং শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে ক্বাতারে দাঁড়ান।৪১

(২) আনাছ ইবনু মালিক e হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

أَنَّ رَسُولَ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ: أَتِمُّوا الصَّفَّ الْمُقَدَّمَ، ثُمَّ الَّذِي يَلِيهِ، فَمَا كَانَ مِنْ نَقْصٍ فَلْيَكُنْ فِي الصَّفِّ الْمؤَخَّرِ.৪২

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- তোমরা সামনের সফ আগে সম্পূর্ণরূপে পূরণ করো, তারপর এর পিছনের সফ (এভাবে পর্যায়ক্রমে সফগুলো) পূরণ করো। যাতে করে অপূর্ণতা যদি থাকে, সেটা যেন সর্বশেষ সফেই থাকে।৪৩
সামনের সফের জায়গা খালি রেখে কেউ যদি পিছনের সফে দাঁড়ায়, তাহলে প্রয়োজনে তার ঘাড় ডিঙ্গিয়ে হলেও সামনের খালি জায়গা পূরণের অনুমতি হাদীছে রয়েছে।
(৩) ইবনু ‘আব্বাছ e হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

مَنْ نَظَرَ إِلَى فُرْجَةٍ فِي صَفٍّ فَلْيَسُدَّها بِنَفْسِهِ، فَإِنْ لَمْ يَفْعَلْ فَمَرَّ مَارٌّ فَلْيَتَخَطَّ عَلَى رَقَبَتِهِ، فَإِنَّهُ لَا حُرْمَةَ لَهُ.৪৪

অর্থ- যদি কেউ ক্বাতারে কোন খালি জায়গা দেখে তাহলে সে নিজে থেকেই যেন তা পূরণ করে নেয়। যদি সে ব্যক্তি তা না করে, তাহলে (প্রয়োজনে) তার ঘাড়ে পা দিয়ে (হলেও) কেউ যেন ঐ খালি জায়গাটুকু পূরণ করতে যায়। কেননা তার কোন সম্মান নেই।৪৫
(৪) আবূ হুরাইরাহ e হতে বর্ণিত অন্য হাদীছে রয়েছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

وْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا فِي النِّدَاءِ وَالصَّفِّ الْأَوَّلِ ثُمَّ لَمْ يَجِدُوا إِلَّا أَنْ يَسْتَهِمُوا عَلَيْهِ لَاسْتَهَمُوا.৪৬

অর্থ- মানুষ যদি জানত আযানে এবং প্রথম ক্বাতারে কী ফাযীলাত রয়েছে, অতঃপর তা অর্জনের জন্য যদি লটারীর প্রয়োজন হত তাহলে তারা তা-ই করত।৪৭
কিন্ত আফছোছ! আমাদের সমাজে মুসাল্লীগণ; নামায শেষে যাতে দ্রুত মাছজিদ থেকে বেরিয়ে আসা যায় তজ্জন্য তারা শেষ ক্বাতারে দাঁড়াতে এতই সচেষ্ট থাকেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন প্রয়োজনে তারা এজন্য লটারী করতেও প্রস্তুত আছেন।

(চার) দুই সফের মধ্যে অযথা বেশি দূরত্ব না রাখা বরং এক সফ থেকে অন্য সফকে যতটুকু সম্ভব কাছাকাছি রাখা। এর প্রমাণ হলো-

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضي الله عنه، عَنْ رَسُولِ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : رُصُّوا صُفُوفَكُمْ، وَقَارِبُوا بَيْنَهَا، وَحَاذُوا بِالْأَعْنَاقِ، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنِّي لأَرَى الشَّيَاطِينَ يدْخُلُ مِنْ خَلَلِ الصَّفِّ ،كَأَنَّهَا الْحذَفُ.৪৮

অর্থ- আনাছ ইবনু মালিক e হতে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- তোমরা তোমাদের সফগুলোর ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করো এবং সফগুলো কাছাকাছি রেখো, কাঁধগুলো সমান্তরাল রেখো (এক বরাবর রেখো, কেউ আগে কেউ পিছে এমন হয়ো না)। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! নিশ্চয়ই আমি কালো রংয়ের লেজ ও কানবিহীন ছোট মেষ শাবকের ন্যায় শয়তানকে ক্বাতারের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে প্রবেশ করতে দেখি।৪৯

মূলত ইমাম ও মুক্ব্‌তাদী মিলে যে সালাত আদায় করা হয়, সেটাকে বলা হয় জামা‘আত। ইজতিমা‘ শব্দ থেকে জামা‘আত শব্দের অর্থ হলো- সমবেত, একত্রিত, সম্মিলিত, ঐক্যবদ্ধ ইত্যাদি। সুতরাং জামা‘আতে নামাযের দাবি হলো- ইমাম-মুক্ব্‌তাদী পরস্পর কাছাকাছি থাকা, মিলেমিশে থাকা, সম্মিলিত থাকা এবং বিচ্ছিন্ন না হওয়া। এ কারণে রাছূলুল্লাহ 1 জামা‘আতে সালাতের সফগুলো একদম কাছাকাছি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অকারণে-অপ্রয়োজনে জামা‘আতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকা বা দূরত্ব বজায় রাখা- এটা জামা‘আতের অর্থ, তাৎপর্য ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থি কাজ। তাই ইমাম থেকে প্রথম ক্বাতার এবং পরবর্তী এক ক্বাতার থেকে অন্য ক্বাতারকে যতটুকু সম্ভব কাছাকাছি রাখা এবং দুই ক্বাতারের মধ্যখানে অনর্থক দূরত্ব বর্জন করা, এটাই হলো রাছূলুল্লাহ 1 এর ছুন্নাহ।

(পাঁচ) প্রাপ্ত বয়স্ক, ‘আলিম ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিগণ যথাসম্ভব ইমামের কাছা্কাছি অবস্থান করা। এর প্রমাণ হলো-

عَنْ عَبْدِ الله بْنِ مَسْعُودٍ الْهُذَلِي رضي الله عنه، قَالَ :قال صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لِيَلِنِي مِنْكُمْ أُولُو الْأَحْلَامِ، وَالنُّهَى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ (ثَلَاثاً)، وَإِيَّاكُمْ وَهَيْشَاتِ الْأَسْوَاقِ.৫০

 অর্থ- ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাছ‘ঊদ আল হুযালী e হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- তোমাদের মধ্য হতে জ্ঞানী-প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ-বুদ্ধিমান লোকেরা আমার কাছাকাছি দাঁড়াবে। অতঃপর যারা (জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার দিক দিয়ে যত বেশি) এদের কাছাকাছি তারা দাঁড়াবে, (“অতঃপর যারা এদের কাছাকাছি তারা দাঁড়াবে” এভাবে এ কথাটি রাছূলুল্লাহ 1 তিনবার বললেন)। এবং তোমরা সাবধান! (মাছজিদে) বাজারের মত শোরগোল করবে না।৫১

কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে প্রায় মাছজিদেই দেখা যায় এমন সব লোকেরা ইমামের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করেন, যারা ইমামের কোন সমস্যা হলে সে সমস্যা মোক্বাবিলা করার জ্ঞান রাখা তো দূরের কথা,‍ অযূ বা সালাতের ফার্‌য-ওয়াজিব বিষয়েরও জ্ঞান রাখেন না, কিংবা যারা সাহীহ-শুদ্ধভাবে ছূরায়ে ফাতিহাও তিলাওয়াত করতে পারেন না। মাছজিদ পরিচালনার দায়ভারও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এধরনের লোকের উপরই ন্যস্ত থাকে। অবশ্য এটা তাদের দোষ নয় বরং এজন্য অনেক ক্ষেত্রেই তারা প্রশংসার দাবিদার। কেননা সমাজের ‘উলামায়ে কিরাম- যারা এই মহান দায়িত্ব পালনের কথা, তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাওয়ার কারণেই অন্যরা এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে বাধ্য হন।
অধিকাংশ ‘আলিম ও ইমামগণ নিজেদের আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা বেমালুম ভুলে যাওয়ার কারণে এবং ইমামতির ন্যায় একটি সুমহান ব্রতের মর্যাদা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি না করার কারণেই সমাজে তারা আজ উপেক্ষিত, যথাযথ মূল্যায়ন ও মর্যাদা প্রাপ্তি থেকে চরমভাবে বঞ্চিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশিরভাগ মাছজিদেই দেখা যায় যে, ইমাম সাহেব চাকরী হারানোর ভয়ে মাছজিদ পরিচালনা কমিটির কিংবা মুতাওয়াল্লী সাহেবের হুক্‌ম আর মর্জিমত ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে অনেক সময় জেনে-শুনে বিদ‘আতী কাজ-কর্ম করতেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না। এতদসত্ত্বেও তাদের অধিকাংশের ভাগ্যে একজন সাধারণ পিয়ন বা চৌকিদারের সমান বেতন জোটে না।
‘আলিমগণ যদি সত্যিকার অর্থেই ‘আলিম হতেন, তারা যদি কেবল আল্লাহ্‌কে (0) ভয় করে এবং একমাত্র তাঁর উপরই পূর্ণ আশা ও ভরসা রেখে চলতেন, তারা যদি নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতেন, তাহলে অবশ্যই তাদের এ করুণ দশা হত না। অপরদিকে সাধারণ মুছলমান এবং বিশেষ করে মাছজিদ পরিচালনার সাথে জড়িত লোকেরা যদি এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতেন যে, হাক্ব্যানী ‘আলিমগণ হলেন নাবীগণের (m) উত্তরসূরী, তারা হলেন জাতির পরিচালক-কর্ণধার এবং মুক্তির দিশারী, তাহলে সমাজে ‘উলামায়ে কিরাম বিদ্যমান থাকাবস্থায় দ্বীনী বিষয়ে অন্য কেউ নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব দেখাতে যেত না। ইমামের নিকটবর্তী স্থানটুকু জ্ঞানী-গুণী আহ্‌লে ‘ইল্‌মদের জন্যই বরাদ্দ থাকত। সাধারণ মানুষ যদি একথা জানত যে, ইমামতি- এটা সাধারণ কোন দায়িত্ব বা পেশা নয়, এটা হলো নাবাওয়ী পেশা, এটা হলো এমন এক সুমহান ব্রত, যে ব্রতে রাছূলুল্লাহ 1 দুন্‌ইয়া থেকে বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, তাহলে তারা ইমামের পরামর্শ অনুযায়ী মাছজিদ পরিচালনা করত। তারা ‘আলিম ও ইমামগণকে সমাজে সবচেয়ে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করত।
(ছয়) প্রথমে ডান দিক হতে সফ পূর্ণ করা। এর প্রমাণ হলো-

(১) বারা ইবনু ‘আযিব e হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

كُنَّا إِذَا صَلَّيْنَا خَلْفَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – أَحْبَبْنَا أَنْ نَكُونَ عَنْ يَمِينِهِ ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ حِينَ انْصَرَفَ: “رَبِّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ”.৫২

অর্থ- আমরা যখন রাছূলুল্লাহ 1 এর পিছনে সালাত আদায় করতাম, তখন আমরা তাঁর ডানদিকে দাঁড়াতে পছন্দ করতাম। ছালাম ফিরানোর পর আমি তাঁকে বলতে শুনেছি “রাব্বী ক্বীনী ‘আযাবাকা ইয়াওমা তাব‘আছু ‘ইবাদাকা” (অর্থ- হে আমার প্রতিপালক! যে দিন তুমি তোমার বান্দাহ্‌দেরকে বিচারের জন্য উঠাবে, সেদিন আমাকে তোমার ‘আযাব হতে রক্ষা করো)।৫৩

(২) ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাছ h হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

بِتُّ عِنْدَ خَالَتِي، فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ ، فَقُمْتُ أُصَلِّي مَعَهُ ، فَقُمْتُ عَنْ يَسَارِهِ ، فَأَخَذَ بِرَأْسِي فَأَقَامَنِي عَنْ يَمِينِهِ.৫৪

অর্থ- একদা আমি আমার খালার (উম্মুল মু’মিনীন মাইমূনাহ f এর) নিকট রাত্রি যাপন করি। রাছূলুল্লাহ 1 উঠে রাতের সালাত পড়তে লাগলেন, আমিও উঠে গেলাম তাঁর সাথে নামায পড়তে এবং গিয়ে তাঁর বাম পাশে দাঁড়ালাম। তিনি আমার মাথায় ধরে (আমাকে তাঁর পিছন দিকে ঘুরিয়ে) ডান পাশে এনে দাঁড় করালেন।৫৫

এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমামের সাথে দাঁড়ানো মুক্ব্‌তাদীর জন্য উত্তম স্থান হলো ইমামের ডান পার্শ্ব। নতুবা রাছূলুল্লাহ 1 ইবনু ‘আব্বাছ-কে (h) তাঁর বাম পার্শ্ব হতে ডান পার্শ্বে নিয়ে আসতেন না।

(৩) ‘আয়িশাহ f হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى مَيَامِنِ الصُّفُوفِ.৫৬

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- নিশ্চয়ই আল্লাহ (নামাযে) সফসমূহের ডান দিকে অবস্থানকারীদের উপর রাহ্‌মাত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশতাগণও তাদের জন্য (আল্লাহ্‌র কাছে) মাগফিরাত (ক্ষমা) প্রার্থনা করেন।৫৭
ডান দিক হতে সফ পূর্ণ করার অর্থ এই নয় যে, ইমামের ঠিক পিছনের জায়গাটুকু সহ ইমামের ডান-বাম খালি রেখে মাছজিদের একদম ডান প্রান্ত থেকে সফ শুরু করা। বরং এর অর্থ হলো ইমামকে মধ্যখানে রেখে প্রথমে তাঁর ডানপার্শ্বে তারপর বামপার্শ্বে দাঁড়াতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ- যদি ইমামের ডানে ও বামে পাঁচজন পাঁচজন করে মোট ১০ জন মোক্ব্‌তাদী হয়ে যান, তাহলে ১১ নং মোক্ব্‌তাদীর জন্য উচিত হলো ইমামের ডান পার্শ্বে দন্ডায়মান পূর্ববর্তী ৫ জনের ডান পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ানো। আর মোক্ব্‌তাদী যদি মাত্র ১জন হন তাহলে অবশ্যই তাকে ইমামের ডান পার্শ্বে ইমামের সাথে একই বরাবরে দাঁড়াতে হবে।
(সাত) মহিলাদেরকে পুরুষদের একদম পিছনে পৃথকভাবে পৃথক সারিতে রাখা। কোনভাবেই যেন সালাতে পুরুষ ও মহিলার সংমিশ্রণ না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। এর প্রমাণ হলো-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرُ صُفُوفِ الرِّجَالِ أَوَّلُهَا وَشَرُّهَا آخِرُهَا وَخَيْرُ صُفُوفِ النِّسَاءِ آخِرُهَا وَشَرُّهَا أَوَّلُهَا.৫৮

অর্থ- আবূ হুরাইরাহ e হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- পুরুষদের জন্য (সালাতে) উত্তম সফ হলো প্রথম সফ (সারি), আর তাদের জন্য মন্দ সফ হলো একদম পিছনের সফ। আর মহিলাদের জন্য উত্তম সফ হলো সর্বশেষ সফ (সারি), আর তাদের জন্য মন্দ সফ হলো প্রথম সফ।৫৯
মহিলা যদি মাত্র একজনও হয় তবুও তাকে পুরুষের সারিতে নিয়ে আসা যাবে না বরং তাকে পিছনে এবং পৃথক সারিতে দাঁড়াতে হবে।
আমাদের দেশের বর্তমান যে সমাজ ব্যবস্থা এবং আমাদের সামাজের যে বেহাল দশা, এতে মহিলাদের মাছজিদে না যেয়ে বরং নিজ নিজ গৃহে সালাত আদায় করা আবশ্যক। তাছাড়া এমনিতেই তো মহিলাদের জন্য মাছজিদের পরিবর্তে নিজ নিজ ঘরে সালাত আদায় করা উত্তম। যেমন-

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: خَيْرُ مَسَاجِدِ النِّسَاءِ قَعْرُ بُيُوتِهِنَّ.৬০

অর্থ- উম্মু ছালামাহ f হতে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে যে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- মহিলাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম মাছজিদ হলো তাদের গৃহাভ্যন্তর।৬১
তবে হ্যাঁ, যদি পূর্ণ পর্দার সাথে মহিলাদের মাছজিদে আসা-যাওয়া, তাদের নিরাপত্তা এবং পুরুষ-মহিলার সংমিশ্রণ না হওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে মহিলাদেরকে জামা‘আতে সালাত আদায়ের জন্য মাছজিদে আসা থেকে বারণ করা যাবে না।
যাই হোক, সালাতে সফ ঠিক বা সোজা করা বলতে উপরোক্ত ৭টি বিষয়কে একত্রে-একসাথে নিশ্চিত করা বুঝায়। যদি এ সাতটি বিষয়ের মধ্য হতে কোন একটি বিষয়ও নামাযের জামা‘আতে বাদ পড়ে, তাহলে সেই সালাত তথা নামায সঠিকভাবে ও পরিপূর্ণরূপে আদায় হয়েছে বলে গণ্য হবে না এবং এর দ্বারা জামা‘আতে সালাতের কাঙ্ক্ষিত ফাযীলাত লাভেরও আশা করা যাবে না। তাই ইমাম এবং মুক্ব্‌তাদী; প্রত্যেকেরই সালাতে সফ তথা ক্বাতারবন্দী হওয়ার বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ও যত্নবান হওয়া একান্ত আবশ্যক।

সংকলক: আবূ ছা‘আদা মুহাম্মাদ হাম্‌মাদ বিল্লাহ c

সূত্রাবলী:
১) আর্‌ রিছালাতুছ্‌ ছানিইয়্যা ফিস্‌ সালাত ওয়ামা ইয়ালযামু ফীহা- লিল ইমাম আহ্‌মাদ ইবনু হাম্বাল o
২) ইহ্‌কামুল আহ্‌কাম শারহু ‘উমদাতিল আহ্‌কাম- লিল ‘আল্লামা ইবনু দাক্বীক্বিল ‘ঈদ o
৩) মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়াল মুক্বালাত আল মুতানাওয়ি‘আহ- লিশ্‌শাইখ ‘আব্দুল ‘আযীয ইবনু বায o
৩) আশ্‌শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুছতাক্বনি‘- লিশ্‌শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ্‌ আল ‘উছাইমীন o
৪) তাছওয়িয়াতুস্‌ সুফূফ – লিশ্‌শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ‘আব্দিল ওয়াহ্‌হাব আল ওসাবী o


১. رواه البخاري 
২. সাহীহ্‌ বুখারী 
৩. رواه مسلم 
৪. সাহীহ্‌ মুছলিম 
৫. رواه أبو داؤود 
৬. ছুনানু আবী দাঊদ 
৭. رواه النسائي 
৮. ছুনানুন্‌ নাছায়ী 
৯. رواه مالك في المؤطأ و عبد الرزاق و الترمذي و البيهقي 
১০. মুআত্তা ইমাম মালিক, মুসান্নাফু ‘আব্দির্‌ রায্‌যাক্ব, জামে‘ তিরমিযী, ছুনানুল বাইহাক্বী 
১১. رواه الترمذي 
১২. জামে‘ তিরমিযী 
১৩. مصنف عبد الرزاق 
১৪. মুসান্নাফু ‘আব্দির্‌ রায্‌যাক্ব 
১৫. رواه الترمذي و مالك في المؤطأ و إبن أبي شيبة 
১৬. জামে‘ তিরমিযী, মুআত্তা ইমাম মালিক, মুসান্নাফু ইবনে আবী শাইবাহ 
১৭. আল মুহাল্লা লি ইবনে হায্‌ম 
১৮. مصنف عبد الرزاق 
১৯. মুসান্নাফু ‘আব্দির্‌ রায্‌যাক্ব 
২০. رواه مسلم وابن حبان 
২১. সাহীহ্‌ মুছলিম, সাহীহ্‌ ইবনু হিব্বান 
২২. رواه البخاري و مسلم 
২৩. সাহীহ্‌ বুখারী, সাহীহ্‌ মুছলিম 
২৪. رواه أبو داؤود 
২৫. আবূ দাঊদ 
২৬. رواه أحمد وأبو داؤود و النسائي 
২৭. মুছনাদে ইমাম ইমাম আহমাদ, ছুনানু আবী দাঊদ, ছুনানুন্‌ নাছায়ী 
২৮. رواه الطبراني في الأوسط 
২৯. তাবারানী-আওছাত্ব 
৩০. رواه أبو داؤود 
৩১. ছুনানু আবী দাঊদ 
৩২. رواه البخاري 
৩৩. সাহীহ্‌ বুখারী 
৩৪. رواه البخاري 
৩৫. সাহীহ্‌ বুখারী 
৩৬. رواه أبو داؤود و ابن حبان و إبن خزيمة 
৩৭. ছুনানু আবী দাঊদ, সাহীহ্‌ ইবনে হিব্বান, সাহীহ্‌ ইবনে ‍খুযাইমাহ 
৩৮. رواه أحمد وإبن خزيمة وإبن حبان 
৩৯. মুছনাদে ইমাম আহ্‌মাদ, সাহীহ্‌ ইবনে খুযাইমাহ, সাহীহ্‌ ইবনে হিব্বান 
৪০. رواه مسلم وابن حبان 
৪১. সাহীহ্‌ মুছলিম, সাহীহ্‌ ইবনে হিব্বান 
৪২. رواه أبو داؤود والنسائي 
৪৩. ছুনানু আবী দাঊদ, ছুনানুন্‌ নাছায়ী 
৪৪. رواه الطبراني في الكبير 
৪৫. মু‘জামুল কাবীর লিত্‌ ত্বাবারানী 
৪৬. متفق عليه 
৪৭. সাহীহ্‌ বুখারী, সাহীহ্‌ মুছলিম 
৪৮. أخرجه أبو داؤود وابن حبان والنسائي 
৪৯. ছুনানু আবী দাঊদ, সাহীহ্‌ ইবনে হিব্বান, ছুনানুন্‌ নাছায়ী 
৫০. رواه مسلم 
৫১. সাহীহ্‌ মুছলিম 
৫২. رواه أبو داؤود و النسائي 
৫৩. ছুনানু আবী দাঊদ, ছুনানুন্‌ নাছায়ী 
৫৪. رواه البخاري و مسلم 
৫৫. সাহীহ্‌ বুখারী ও সাহীহ্‌ মুছলিম 
৫৬. رواه أبو داؤود 
৫৭. ছুনানু আবী দাঊদ 
৫৮. رواه مسلم و أحمد 
৫৯. সাহীহ্‌ মুছলিম, মুছনাদে ইমাম আহ্‌মাদ 
৬০. رواه أحمد و الحاكم 
৬১. মুছনাদে ইমাম আহ্‌মাদ, মুছতাদরাকে হাকিম 

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...