প্রশ্ন: ৪২১ : আয়াতুল কুরসী।

 সুরা বাক্বারা এর  ২৫৫ নং আয়াতকেই আয়াতুল কুরসী নামে অভিহিত করা হয়। 

﴿اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ﴾

২৫৫) আল্লাহ এমন এক চিরঞ্জীব ও চিরন্তন সত্তা যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের দায়িত্বভার বহন করছেন , তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই ৷২৭৮  তিনি ঘুমান না এবং তন্দ্রাও তাঁকে স্পর্শ করে না ৷২৭৯  পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে সবই তাঁর ৷২৮০  কে আছে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে ?২৮১  যা কিছু মানুষের সামনে আছে তা তিনি জানেন এবং যা কিছু তাদের অগোচরে আছে সে সম্পর্কে তিনি অবগত ৷ তিনি নিজে যে জিনিসের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান সেটুকু ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ব করতে পারে না ৷২৮২  তাঁর কর্তৃত্ব ২৮৩  আকাশ ও পৃথিবী ব্যাপী ৷ এগুলোর রক্ষণাবেক্ষন তাঁকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত করে না ৷ মূলত তিনিই এক মহান ও শ্রেষ্ঠ সত্তা ৷২৮৪  

২৭৮ . অর্থাৎ মূর্খতা নিজেদের কল্পনা ও ভাববাদিতার জগতে বসে যত অসংখ্য উপাস্য, ইলাহ ও মাবুদ তৈরী করুক না কেন আসলে কিন্তু সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিপত্তি ও শাসন কর্তৃত্ব নিরংকুশভাবে একমাত্র সেই অবিনশ্বর সত্তার অংশীভূত, যাঁর জীবন কারো দান নয় বরং নিজস্ব জীবনী শক্তিকে যিনি স্বয়ং জীবিত এবং যাঁর শক্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এই বিশ্ব-জাহানের সমগ্র ব্যবস্থাপনা৷ নিজের এই বিশাল সীমাহীন রাজ্যের যাবতীয় শাসন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক তিনি একাই৷ তাঁর গুণাবলীতে দ্বিতীয় কোন সত্তার অংশীদারীত্ব নেই৷ তাঁর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও অধিকারেও নেই দ্বিতীয় কোন শরীক৷ কাজেই তাঁকে বাদ দিয়ে বা তার সাথে শরীক করে পৃথিবীতে বা আকাশে কোথাও আর কাউকে মাবুদ ইলাহ ও প্রভু বানানো হলে তা একটি নিরেট মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই হয় না৷ এভাবে আসলে সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷
২৭৯ . মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সত্তাকে যারা নিজেদের দুর্বল অস্তিত্বের সদৃশ মনে করে এবং যাবতীয় মানবিক দুর্বলতাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করে, এখানে তাদের চিন্তা ও ধারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে ৷ যেমন বাইবেলের বিবৃতি মতে, আল্লাহ ছয় দিনে পৃথিবী ও আকাশ তৈরী করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন ৷
২৮০ . অর্থাৎ তিনি পৃথিবী ও আকাশের এবং এ দু'য়ের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক৷ তাঁর মালিকানা, কর্তৃত্ব ও শাসন পরিচালনায় কারো এক বিন্দু পরিমাণও অংশ নেই৷ তাঁর পরে এই বিশ্ব-জাহানের অন্য যে কোন সত্তার কথাই চিন্তা করা হবে সে অবশ্যই হবে এই বিশ্ব-জগতের একটি সৃষ্টি ৷ আর বিশ্ব-জগতের সৃষ্টি অবশ্যি হবে আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তাঁর দাস ৷ তাঁর অংশীদর ও সমকক্ষ হবার কোন প্রশ্নই এখানে ওঠে না ৷
২৮১ . এখানে এক শ্রেণীর মুশরীকদের চিন্তার প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বযর্গ ব্যক্তিবর্গ, ফেরেশস্তা বা অন্যান্য সত্তা সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করে যে, আল্লাহর ওখানে তাদের বিরাট প্রতিপত্তি ৷ তারা যে কথার ওপর অটল থাকে, তা তারা আদায় করেই ছাড়ে৷ আর আল্লাহর কাছ থেকে তারা যে কোন কার্যোদ্ধার করতে সক্ষম৷ এখানে তাদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহর কাছ থেকে তারা যে কোন কার্যোদ্ধার করতে সক্ষম৷ এখানে তাদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহর ওখানে প্রতিপত্তির তো কোন প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি কোন শ্রেষ্ঠতম পয়গম্বর এবং কোন নিকটতম ফেরেশতাও এই পৃথিবী ও আকাশের মালিকের দরবারে বিনা অনুমতিতে একটি শব্দও উচ্চারণ করার সাহস রাখে না৷
২৮২ . এই সত্যটি প্রকাশের পর শিরকের ভিত্তির ওপর আর একটি আঘাত পড়লো৷ ওপরের বাক্যগুলোয় আল্লাহর অসীম কর্তৃত্ব ও তার সাথে সম্পর্কিত ক্ষমতাবলী সম্পর্কে একটা ধারণা পেশ করে বলা হয়েছিল, তাঁর কর্তৃত্বর স্বতন্ত্রভাবে কেউ শরীক নেই এবং কেউ নিজের সুপারিশের জোরে তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতাও রাখে না৷ অতপর এখানে অন্যভাবে বলা হচ্ছে, অন্য কেউ তাঁর কাজে কিভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে যখন তার কাছে এই বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা এবং এর অন্তর্নিহিত কার্যকারণ ও ফলাফল বুঝার মতো কোন জ্ঞানই নেই? মানুষ, জিন ফেরেশতা বা অন্য কোন সৃষ্টিই হোক না কেন সবার জ্ঞান অপূর্ণ ও সীমিত৷ বিশ্ব-জাহানের সমগ্র সত্য ও রহস্য কারো দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই৷ তারপর কোন একটি ক্ষুদ্রতর অংশেও যদি কোন মানুষের স্বাধীন হস্তক্ষেপ অথবা অনড় সুপারিশ কার্যকর হয় তাহলে তো বিশ্ব-জগতের সমগ্র ব্যবস্থাপনাই ওলট-পালট হয়ে যাবে৷ বিশ্ব-জগতের ব্যবস্থাপনা তো দূরের কথা মানুষ নিজের ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বুঝারও ক্ষমতা রাখে না৷ বিশ্ব-জাহানের প্রভু ও পরিচালক মহান আল্লাহই এই ভালোমন্দের পুরোপুরি জ্ঞান রাখেন৷ কাজেই এ ক্ষেত্রে জ্ঞানের মূল উৎস মহান আল্লাহর হিদায়াত ও পথনির্দেশনার ওপর আস্থা স্থাপন করা ছাড়া মানুষের জন্য দ্বিতীয় আর কোন পথ নেই৷
২৮৩ . কুরআনে উল্লেখিত মূল শব্দ হচ্ছে 'কুরসী'৷ সাধারণ এ শব্দটি কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রশক্তি অর্থে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ (বাঙলা ভাষায় এরি সমজাতীয় শব্দ হচ্ছে 'গদি'৷ গদির লড়াই বললে ক্ষমতা কর্তৃত্বের লগাই বুঝায়) ৷
২৮৪ . এই আয়াতটি আয়াতুল কুরসী নামে খ্যাত৷ এখানে মহান আল্লাহর এমন পূর্ণাংগ পরিচিতি পেশ করার হয়েছে, যার নজীর আর কোথাও নেই৷ তার হাদীসে একে কুরআনের শ্রেষ্ঠ আয়াত বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷

প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানে কোন্ প্রসংগে বিশ্ব-জাহানের মালিক মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী আলোচনা করা হয়েছে? এ বিষয়টি বুঝতে হলে ৩২ রুকু' থেকে যে আলোচনাটি চলছে তার ওপর আর এবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিতে হবে৷ প্রথমে মুসলমানদের ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ধন-প্রাণ উৎসর্গ করে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়৷ বনী ইসরাঈলরা যেসব দুর্বলতার শিকার হয়েছিল তা থেকে দূরে থাকার জন্য তাদের জোর তাগিদ দেয়া হয়৷ তারপর তাদেরকে এ সত্যটি বুঝানো হয় যে, বিজয় ও সাফল্য সংখ্যা ও যুদ্ধাস্ত্রের আধিক্যের ওপর নির্ভর করে না বরং ঈমান, সবর, সংযম, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও সংকল্পের দৃঢ়তার ওপর নির্ভর করে৷ অতপর যুদ্ধের সাথে আল্লাহর যে কর্মনীতি সম্পর্কিত রয়েছে সেদিকে ইংগিত করা হয়৷ অর্থাৎ দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা অক্ষুন্ন রাখার জন্য তিনি সবসময় মানুষদের একটি দলের সাহায্যে আর একটি দলকে দমন করে থাকেন৷ নয়তো যদি শুধুমাত্র একটি দল স্থায়ীভাবে বিজয় লাভ করে কর্তৃত্ব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতো তাহলে দুনিয়ায় অন্যদের জীবন ধারা কঠিন হয়ে পড়তো৷

আবার এ প্রসংগে অজ্ঞ লোকদের মনে আরো যে একটি প্রশ্ন প্রায়ই জাগে তারও জবার দেয়া হয়েছে৷ সে প্রশ্নটি হচ্ছে, আল্লাহ যদি তাঁর নবীদেরকে মতবিরোধ খতম করার ও ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য পাঠিয়ে থাকেন এবং তাদের আগমনের পরও মতবিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ খতম না হয়ে থাকে তাহলে কি আল্লাহ এতই দুর্বল যে, এই গলদগুলো দূর করতে চাইলেও তিনি দূর করতে পারেননি? এর জবাবে বলা হয়েছে, বলপূর্বক মতবিরোধ বন্ধ করা এবং মানব জাতিকে জোর করে একটি বিশেষ পথে পরিচালনা করা আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না৷ যদি এটা আল্লাহর ইচ্ছা হতো তাহলে তার বিরুদ্ধাচরণ করার কোন ক্ষমতাই মানুষের থাকতো না৷ আবার যে মূল বিষয়বস্তুর মাধ্যমে আলোচনার সূচনা করা হয়েছিল একটি বাক্যের মধ্যে সেটিকেও ইংগিত করা হয়েছে৷ এরপর এখন বলা হচ্ছে, মানুষের আকীদা-বিশ্বাস-আদর্শ-মতবাদ ও ধর্ম যতই বিভিন্ন হোক না কেন আসলে ওপ্রকৃত সত্য যার ওপর আকারশ ও পৃথিবীর সমগ্র ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত, এই আয়াতেই বিবৃত হয়েছে৷ মানুষ এ সম্পর্ক ভুল ধারণা করলেই বা কি, এ জন্য মূল সত্যের তো কোন চেহারা বদল হবে না৷ কিন্তু লোকদেরকে এটা মানতে বাধ্য করানো আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়৷. …………..যে ব্যক্তি এটা মেনে নেবে সে নিজেই লাভবান হবে৷ আর যে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷

প্রশ্ন: ৪২০ : নারীর প্রতিষ্ঠা বলতে কি বুঝায় ? ইসলাম নারীকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ?

 উত্তর :

নারীর প্রতিষ্ঠা বলতে নারী নেতৃত্ব, ক্ষমতা বা তারা বাইরে গিয়ে কাজ করে নিজেদের ভরণ পোষণ করবে - এটা নয়। বরং, নারীর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, তারা তাদের যথাযথ অধিকার পাবে, মায়ের কথা শোনা এবং তাদের সেবা প্রয়োজনীয় বিষয় সরবরাহ করা সন্তানদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাবাদের জন্যও একই নিয়ম, তবে মায়ের জন্য তিনগুণ বেশী গুরুত্ব। এছাড়াও প্রত্যেক স্বামীর উপর বাধ্যতামূলক, তার স্ত্রীর ভরণ পোষণ করা। প্রত্যেক পিতার উপর বাধ্যতামূলক - তার কন্যাকে যথাযথ ভরণ - পোষণ ও পর্দার মধ্যে রেখে এরপর তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

অর্থাৎ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন মেয়ের দায়িত্ব, হয় তার পিতার উপর, অথবা বড় ভাইয়ের উপর, অথবা, স্বামীর উপর, অথবা, ছেলের উপর, অথবা, যথাযথ ভাবে অভিভাবকের উপর বাধ্যতামূলক ।

একজন নারীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে অন্য সংসারে চলে যায়, তখন তার বাবা মাকে আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করার কোন দায়িত্ব তার উপরে থাকেনা, অথচ, তারপরেও সে পিতা মাতার মৃত্যুর পর তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির অংশীদার হয়, একজন ভাইয়ের অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তি সে পায়।

বিয়ে হওয়ার পর সংসারের কোন খরচ তার নাই, কোন রকম আর্থিক দায় দায়িত্বও তার উপরে নাই, কিন্তু তারপরেও, এ বিয়ে হওয়ার জন্য তার স্বামীকে তাকে একটা মোহরানা দিতে হয়।


এভাবে একজন নারীর উপর কোনো ধরণের সামাজিক বা আর্থিক দায়িত্ব পালন করার কোন বাধ্য বাধকতা তার নেই, বরং, উল্টো তার যাবতীয় দায় দায়িত্ব, ভরণ পোষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরও, তাকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার দায়িত্বও বাধ্যতামূলক ভাবে পুরুষকেই দেওয়া হয়েছে, বরং, মোহরানা, স্বামীর পরিত্যাক্ত সম্পত্তির অংশ পাওয়া, পিতার সম্পত্তির অংশ পাওয়ার পরও বিনিময়ে তার কোন রকম আর্থিক দায় দায়িত্ব ইসলাম তার জন্য আরোপ করেনি। তার নিজের সম্পত্তি খরচ করার ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। অথচ, এ বিষয়টি একজন পুরুষের জন্য চিন্তাই করা যায়না।


আবার অন্যদিকে, নৈতিক দিক থেকে বলা হয়েছে, নারীর পায়ের নিচে তার সন্তানের বেহেশত, আর একজন পুরুষের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সেই ব্যাক্তি ভালো যার ব্যাপারে তার স্ত্রী সাক্ষ্য দিবে যে, সে ভালো।


অতএব, সামাজিক, আর্থিক, নৈতিক, সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে যা দিয়েছে, এর চেয়ে বেশী কিছু কল্পনাতীত এবং অন্য কোন ধর্ম, বিধান বা মতবাদে এমনটি আর কোথাও দেওয়া হয়নি। সম্ভবও নয়।

প্রশ্ন: ৪১৯ : ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম ।

 ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম:

মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪১পৃ:)
৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিত নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিত।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিত, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)
৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।
এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিত। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্‌রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।
পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।
তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।
ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)
একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্‌ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)
পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)
১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)
একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্‌মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)
১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)
১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)
১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)
ফুটনোটঃ
স্বালাতে মুবাশ্‌শির
ইমামতি এবং মুক্তাদি সম্পর্কিত
আবদুল হামীদ ফাইযী

প্রশ্ন: ৪১৮ : স্বামী এবং স্ত্রী মিলে জামায়েতের সাথে সালাত আদায় করা যাবে কী?

 প্রশ্ন : আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এশার ও তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করেছি। আমাদের এই নামাজ কি হয়েছে?   

উত্তর : আমরা ধরেই নিলাম, আপনি হয়তো বিশেষ কোনো কারণে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই আপনি মসজিদে না গিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় নামাজ পড়বেন, এই কাজটি সঠিক নয়।

যদি বিশেষ কোনো কারণে এশার নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায় করতে না পারেন, তাহলে আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। তবে স্ত্রীকে দাঁড়াতে হবে আপনার পেছনে, সে আপনার পাশে দাঁড়াতে পারবে না। আর যদি ধরুন আপনার দুই ছেলে আছে এবং তারাও জামাতে দাঁড়িয়েছে, তাহলে আপনার ছেলেরা পেছনে দাঁড়াবে, তারপর আপনার স্ত্রী দাঁড়াবে। এ ক্ষেত্রে আপনার মেয়েও আপনার স্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারবে। 

(ড. মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম।)



প্রশ্ন : স্বামী এবং স্ত্রী মিলে জামায়েতের সাথে সালাত আদায় করা যাবে কী?

মতলবী মল্লিক
মতলব (দঃ), চাঁদপুর।

প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:১০ এএম

উত্তর : মসজিদের জামাতের বিকল্প হিসাবে এ জামাত চলবে না। যদি কোনো কারণে ঘরেই নামাজ পড়তে হয়, আর তা জামাতে পড়ে সেটা গ্রহণযোগ্য। ফরজ নামাজ ছাড়া তো আর কোনো নামাজে জামাত নেই। ফরজ নামাজ যখন ঘরে পড়ার মত কারণ ঘটে তখন স্বামী স্ত্রী মিলেও জামাত পড়া যায়। তবে, ইমাম অবশ্যই স্বামীকে হতে হবে। দুই ব্যক্তি জামাত করলে যেভাবে একই কাতারে দাঁড়ায়, স্ত্রী এভাবে দাঁড়াবে না। স্ত্রী জামাতের সময় বরাবর না দাঁড়িয়ে পেছনে দাঁড়াবে।

সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।
উত্তর দিয়েছেন : আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী



স্বামী ও স্ত্রী একসাথে নামাজ আদায় করতে পারবে কি?
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন।
(ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪)।
অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’
(বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ,
আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান,
মিশকাত :১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০)।
নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং)।
অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)।
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)।
(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
No photo description available.

প্রশ্ন: ৪১৭ : দোয়া কবুল হওয়ার শর্তগুলো কি কি ।


আসলে প্রথম কথা হচ্ছে, দোয়া কবুল হবার অনেক গুলো শর্ত আলেমগণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারপরও লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, উক্ত শর্তগুলো মেনে দোয়া করার পরও এটা ১০০% নিশ্চয়তা দেওয়া যাবেনা যে, আপনার দোয়া কবুল হবেই।  কারণ প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি জানেন না, উক্ত দোয়া কবুল হওয়ার দ্বারা আসলে আপনার কল্যাণ হবে কিনা ?  যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দেখেন উক্ত দোয়া কবুল হলে বরং আপনার অকল্যাণ হবে, তাহলে হয়তো তিনি আপনার কল্যাণের কথা চিন্তা করেই উক্ত দোয়া অনুযায়ী আপনার প্রার্থিত বস্ত আপনাকে নাও দিতে পারেন। এতেই আপনার কল্যাণ। কিন্তু দোয়া বিফলে যায় না। আপনার প্রার্থিত বস্ত হুবহু না পেলেও আপনার দোয়ার কারণে ইহকালে পরকালে অন্য কল্যাণ আপনাকে আল্লাহ দান করবেন। 


তাই দোয়া করতে থাকতেই হবে। 

 

প্রশ্ন

দোয়া কবুল হওয়ার শর্তগুলো কি কি; যাতে দোয়াটি আল্লাহ্‌র কাছে কবুল হয়?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

দোয়া কবুল হওয়ার বেশকিছু শর্ত রয়েছে। যেমন:

১. আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকে না ডাকা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন: “যখন প্রার্থনা করবে তখন শুধু আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করবে এবং যখন সাহায্য চাইবে তখন শুধু আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাইবে।”[সুনানে তিরমিযি (২৫১৬), আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

এটাই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণীর মর্মার্থ “আর নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহ্‌রই জন্য। কাজেই তোমরা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।”[সূরা জিন্‌, আয়াত: ১৮] দোয়ার শর্তগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ শর্ত পূরণ না হলে কোন দোয়া কবুল হবে না, কোন আমল গৃহীত হবে না। অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের মাঝে ও আল্লাহ্‌র মাঝে মৃতব্যক্তিদেরকে মাধ্যম বানিয়ে তাদেরকে ডাকে। তাদের ধারণা যেহেতু তারা পাপী ও গুনাহগার, আল্লাহ্‌র কাছে তাদের কোন মর্যাদা নেই; তাই এসব নেককার লোকেরা তাদেরকে আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিল করিয়ে দিবে এবং তাদের মাঝে ও আল্লাহ্‌র মাঝে মধ্যস্থতা করবে। এ বিশ্বাসের কারণে তারা এদের মধ্যস্থতা ধরে এবং আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এ মৃতব্যক্তিদেরকে ডাকে। অথচ আল্লাহ্‌ বলেছেন: “আর আমার বান্দারা যখন আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (তখন আপনি বলে দিন) নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী। দোয়াকারী যখন আমাকে ডাকে তখন আমি ডাকে সাড়া দিই।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬]

২. শরিয়ত অনুমোদিত কোন একটি মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে ওসিলা দেয়া।

৩. দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করা। তাড়াহুড়া করা দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে বড় বাধা। হাদিসে এসেছে, “তোমাদের কারো দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাড়াহুড়া করে বলে যে: ‘আমি দোয়া করেছি; কিন্তু, আমার দোয়া কবুল হয়নি”[সহিহ বুখারী (৬৩৪০) ও সহিহ মুসলিম (২৭৩৫)]

সহিহ মুসলিমে (২৭৩৬) আরও এসেছে- “বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে। বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়।”

৪. দোয়ার মধ্যে পাপের কিছু না থাকা। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া না  হওয়া; যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদিসে এসেছে- “বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে।”

৫. আল্লাহ্‌র প্রতি ভাল ধারণা নিয়ে দোয়া করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন।”[সহিহ বুখারী (৭৪০৫) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৭৫)] আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে, “তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া কর।”[সুনানে তিরমিযি, আলাবানী সহিহুল জামে গ্রন্থে (২৪৫) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করে আল্লাহ্‌ তার উপর প্রভুত কল্যাণ ঢেলে দেন, তাকে উত্তম অনুগ্রহে ভূষিত করেন, উত্তম অনুকম্পা ও দান তার উপর ছড়িয়ে দেন।

৬. দোয়াতে মনোযোগ থাকা। দোয়াকালে দোয়াকারীর মনোযোগ থাকবে এবং যাঁর কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে তাঁর মহত্ত্ব ও বড়ত্ব অন্তরে জাগ্রত রাখবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ্‌ কোন উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।”[সুনানে তিরমিযি (৩৪৭৯), সহিহুল জামে (২৪৫) গ্রন্থে শাইখ আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

৭. খাদ্য পবিত্র (হালাল) হওয়া। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “আল্লাহ্‌ তো কেবল মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ২৭] এ কারণে যে ব্যক্তির পানাহার ও পরিধেয় হারাম সে ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদূরপরাহত বিবেচনা করেছেন। হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যিনি দীর্ঘ সফর করেছেন, মাথার চুল উস্কুখুস্ক হয়ে আছে; তিনি আসমানের দিকে হাত তুলে বলেন: ইয়া রব্ব, ইয়া রব্ব! কিন্তু, তার খাবার-খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিধেয় হারাম, সে হারাম খেয়ে পরিপুষ্ট হয়েছে তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হবে?[সহিহ মুসলিম, (১০১৫)]

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন, হারাম ভক্ষণ করা দোয়ার শক্তিকে নষ্ট করে দেয় ও দুর্বল করে দেয়।

৮. দোয়ার ক্ষেত্রে কোন সীমালঙ্ঘন না করা। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা দোয়ার মধ্যে সীমালঙ্ঘন করাটা অপছন্দ করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক; নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” [সূরা আরাফ, আয়াত: ৫৫] আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন 41017 নং প্রশ্নোত্তর।

৯. ফরয আমল বাদ দিয়ে দোয়াতে মশগুল না হওয়া। যেমন, ফরয নামাযের ওয়াক্তে ফরয নামায বাদ দিয়ে দোয়া করা কিংবা দোয়া করতে গিয়ে মাতাপিতার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা। খুব সম্ভব বিশিষ্ট ইবাদতগুজার জুরাইজ (রহঃ) এর কাহিনী থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ জুরাইজ (রহঃ) তার মায়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে ইবাদতে মশগুল থেকেছেন। ফলে মা তাকে বদদোয়া করেন; এতে করে জুরাইজ (রহঃ) আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, আলেমগণ বলেছেন: এতে প্রমাণ রয়েছে যে, জুরাইজের জন্য সঠিক ছিল মায়ের ডাকে সাড়া দেয়া। কেননা তিনি নফল নামায আদায় করছিলেন। নফল নামায চালিয়ে যাওয়াটা হচ্ছে- নফল কাজ; ফরয নয়। আর মায়ের ডাকে সাড়া দেয়া ওয়াজিব এবং মায়ের অবাধ্য হওয়া হারাম....”[শারহু সহিহু মুসলিম (১৬/৮২)]

আরও অধিক জানতে মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আল-হামাদ রচিত ‘আল-দুআ’ নামক বইটি দেখুন।



=====================


মুসলমান হিসেবে আমরা কমেবেশি সবাই দোয়া করি। এটা অনেকটা স্বভাবজাত বিষয়।

তবে দোয়া করার সময় বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে খেয়াল রাখা দরকার। আলেমরা এগুলোকে দোয়া কবুলের শর্ত ও আদব বলে অভিহিত করেছেন।

পবিত্রতা অর্জন: পবিত্রতা অর্জনের পর দোয়া করলে আল্লাহতায়ালা সেই দোয়া কবুল করবেন।

বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা: বিনয়ের সঙ্গে দু’হাত তুলে দোয়া করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার নিকট হাত তুলে হাতের তালু সামনে রেখে দোয়া কর। হাত উল্টো করো না। দোয়ার শেষে উত্তোলিত হাত মুখমন্ডলে বুলিয়ে নাও। ’ -আবু দাউদ

মিনতিভরা কন্ঠে দোয়া করা: মিনতি ও নম্রতার সঙ্গে দোয়া করলে তা ইবাদত হিসেবে গন্য হয়। রাসূলে মকবুল (সা.) বলেছেন, ‘দোয়া সব ইবাদতের মজ্জা ও সারাংশ। ’ দাসত্বের পরিচয় প্রদানই ইবাদতের উদ্দেশ্য। বান্দার নিজের দীনতা ও অক্ষমতা বুঝতে পারা এবং আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও অপার মহিমা উপলব্দি করার মধ্যেই দাসত্বের প্রকাশ ঘটে। দোয়ার মাধ্যমে এ দু’টি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ নিজের অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব এবং আল্লাহর অপ্রতিহত ক্ষমতা, অপার মহিমা ও প্রতাপ অন্তরে স্থান পাওয়া আবশ্যক। দীনতা ও নম্রতা দোয়ার মধ্যে যত অধিক হবে ততই মঙ্গল।

দু’হাত তুলে দোয়া করা: বিনয়, নম্রতা ও দাসত্ব প্রকাশ করার জন্য দোয়ার সময় দু’হাতের তালু আসমানের দিকে রাখতে হবে এবং হাত সম্পূর্ণ সম্প্রসারিত করে দু’হাতের মধ্যে ২/১ আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখতে হবে। হাত কচলানো, রশি পাকানোর মতো হাতের তালু ঘষাঘষি করা দোয়ার আদবের খেলাপ। মনে রাখবেন, আপনি শাহানশাহেরর দরবারে হাত তুলেছেন, তাই এখানে কোনো ধরনের অমনোযোগিতা কাম্য নয়। এছাড়া দোয়া শেষে দু’হাত তুলে দোয়া করে দোয়া শেষে হাত দু’টি মুখমন্ডলে মুছে নিবে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, ‘যে হাত আল্লাহর দরবারে উত্তোলিত হয়, তা একেবারে শূণ্য অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন। ’

আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফসহ দোয়া করা : আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফসহ দোয়া করা। আল্লাহর প্রশংসা যেমন, ‘আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন’ দোয়ার শুরুতে বলা। এছাড়া ইসমে আজমের সহিত দোয়া করা উত্তম। হজরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইসমে আজম এই আয়াতদ্বয়ে রয়েছে-
১. ‘ওয়া ইলাহুকুম ইলাহু ওয়াহিদুন লা ইলাহা ইল্লা হুয়ার রাহমানুর রাহিম। ’ -সূরা বাক্বারা : ১৬৩
২. ‘আলীফ লাম মীম। আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম। ’ -সূরা আল ইমরান : ১

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন রাসূলে কারিম (সা.)-এর নিকট বসেছিলাম। একজন লোক সেখানে নামাজ পড়ছিল। সে তার দোয়ার মধ্যে আরজ করল, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আমার প্রয়োজন প্রার্থনা করছি এই ওসিলায় যে, প্রশংসা ও গুনকীর্তণ আপনার জন্যই উপযুক্ত। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি পরম দয়ালু ও অসীম অনুগ্রহদাতা এবং পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলীর স্রষ্টা। আমি আপনার কাছেই আপনার অনুগ্রহ চাই। ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যু! ইয়া জালজালালী ওয়াল ইকরাম! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ বান্দা আল্লাহর ইসমে আজমের ওসিলায় দোয়া করেছে। এ ওসিলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয় এবং আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাইলে, আল্লাহ তা দান করেন। -তিরমিজি

হজরত ফুজালা ইবনে উবায়দা (রা.) বর্ননা করেন, রাসূলে কারিম (সা.) এক ব্যক্তিকে দোয়া করতে শুনলেন। সে দোয়ায় আল্লাহপাকের প্রশংসা করল না এবং রাসূল (সা.)-এর ওপর দরুদও পাঠ করল না। এতে রাসূলে আকরাম (সা.) বললেন, লোকটি তড়িঘড়ি করে দোয়া করেছে। তিনি লোকটিকে ডেকে আনলেন এবং তাকে অথবা উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ পড়ে তখন দোয়া করার পূর্বে তার উচিত আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করে নেয়া ও রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠ করা। এরপর যা ইচ্ছা তা চাওয়া। -তিরমিজি ও আবু দাউদ

এক হাদিসে এসেছে হজরত রাসূলে মাকবুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দোয়া করার পূর্বে দরুদ শরীফ পড়ে, তার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। মহান আল্লাহতায়ালা অসীম দয়ালু; দোয়ার কিয়দাংশ কবুল করে অপর অংশ কবুল না করা তার স্বভাব নয়। এই হাদিসের সারমর্ম এই যে, দরুদ তিনি অবশ্যই কবুল করে থাকেন, সুতরাং তিনি দরুদ কবুল করে দোয়ার অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ প্রার্থনীয় বিষয় অগ্রাহ্য করেন না। শেষ পর্যন্ত উভয় অংশই কবুল করেন।

হজরত আবু সোলায়মান দারানী (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো দোয়া করে, তার উচিত, প্রথমে দরুদ পড়া এবং দরুদ পড়ে দোয়া শেষ করা। কেননা আল্লাহ উভয় দরুদ কবুল করেন। -কিমিয়ায়ে সাআদাত

** দোয়া শুধু প্রয়োজনে নয়, এটা ইবাদতও

প্রশ্ন: ৪১৬ : ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম ।


মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪১পৃ:)
৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিত নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিত।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিত, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)
৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।
এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিত। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্‌রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।
পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।
তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।
ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)
একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্‌ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)
পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)
১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)
একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্‌মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)
১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)
১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)
১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)
ফুটনোটঃ
স্বালাতে মুবাশ্‌শির
ইমামতি এবং মুক্তাদি সম্পর্কিত
আবদুল হামীদ ফাইযী

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...