প্রশ্ন: ৩৪৩ : হিজাব ও পর্দা ।

হিজাব ও পর্দা : কিছু সহজ-সরল কথা

আরো বিস্তারিত দেখুন : ইসলামে নারীদের পর্দার বিধান 
পর্দা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কুরআন মজীদের কয়েকটি সূরায় পর্দা-সংক্রান্ত বিধান দেওয়া হয়েছে। পর্দার বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সকল শ্রেণীর ঈমানদার নারী-পুরুষকে সম্বোধন করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন তিনি যেন তাঁর স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের নারীদেরকে চাদর দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত রাখার আদেশ দেন। কিছু আয়াতে উম্মুল মুমিনীনদেরকেও সম্বোধন করেছেন, কোনো কোনো আয়াতে সাহাবায়ে কেরামকেও সম্বোধন করা হয়েছে। মোটকথা, কুরআন মজীদ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য পর্দার বিধান দান করেছে। এটি শরীয়তের একটি ফরয বিধান। এ বিধানের প্রতি সমর্পিত থাকা ঈমানের দাবি। কিন্তু বেদনার বিষয় এই যে, পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের মুসলিম-সমাজ এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে যে, কুরআন ও সুন্নাহর বিধানও তাদের কাছে অপরিচিত ও অপ্রয়োজনীয়! (নাউযুবিল্লাহ) ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান তো-আল্লাহ হেফাযত করুন-মুসলিম পরিচয় বহনকারীদের দ্বারা আক্রমণেরও শিকার। ঐসব বিধানের মধ্যে একটি হচ্ছে পর্দা বিধান। এই সব মুসলমানদের কে বোঝাবে যে, এটা নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল। ইসলামের এই বিধানগুলো শুধু আমাদের আখেরাতে নাজাতেরই উপায় নয়, আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্থি ও পবিত্রতারও রক্ষাকবচ। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অমুসলিমদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আমরা নিজেদের আর্দশ ত্যাগ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। আমাদের পরিবার ও সমাজেও পশ্চিমা সমাজের ভয়াবহ উপসর্গগুলো প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। পশ্চিমা সভ্যতা যেসব মরণব্যাধিতে আক্রান্ত তা থেকে যদি আমরা আমাদের পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করতে চাই তার একমাত্র উপায় ইসলামের বিধান ও আদর্শের সামনে আত্মসমর্পণ। আমরা যদি আমাদের পরিবারিক শান্তি ফিরে পেতে চাই তাহলে নারী-পুরুষ সকলকে পর্দা-বিধানের অনুসারী হতে হবে।

মুসলিম ভাইবোনদের প্রতি কল্যাণকামিতা থেকেই আমরা বিভিন্ন আয়োজন করছি। বর্তমান সংখ্যায় পর্দা সম্পর্কে সহজ-সরল কয়েকটি নিবন্ধ পত্রস্থ হল। সামনে এ বিষয়ে আরো কিছু পেশ করার ইচ্ছা আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাঁর বান্দা হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।-সম্পাদক


পর্দা : বিধান ও কল্যাণ
মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ
পর্দা-বিধান ইসলামী শরীয়তের পক্ষ থেকে সাধারণভাবে সমাজ-ব্যবস্থার এবং বিশেষভাবে উম্মতের মায়েদের জন্য অনেক বড় ইহসান। এই বিধানটি মূলত ইসলামী শরীয়তের যথার্থতা, পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের জন্য অমোঘ বিধান হওয়ার এক প্রচ্ছন্ন দলিল। পর্দা নারীর মর্যাদার প্রতীক এবং ইফফাত ও পবিত্রতার একমাত্র উপায়।
অনেকে মনে করেন, পর্দা-বিধান শুধু নারীর জন্য। এ ধারণা ঠিক নয়। পুরুষের জন্যও পর্দা অপরিহার্য। তবে উভয়ের পর্দার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। যে শ্রেণীর জন্য যে পর্দা উপযোগী তাকে সেভাবে পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যে কোনো ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিই কুরআন-সুন্নাহর পর্দা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে এই বাস্তবতা স্বীকার করবেন যে, ইসলামে পর্দার বিধানটি অন্যান্য হিকমতের পাশাপাশি নারীর সম্মান ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষার জন্যই দেওয়া হয়েছে। এজন্য এই বিধানের কারণে প্রত্যেককে ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। কৃতঘ্ন হয়ে এ বিধান সম্পর্কে অযথা আপত্তি করা উচিত নয়।
আকবর এলাহাবাদী বলেন-
প্রাশ্চাত্যের ও প্রাশ্চাত্য প্রভাবিত পুরুষদের অন্তরে পর্দা পড়ে যাওয়ার কারণে তারা এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে না পারলেও আজকের পশ্চিমা নারীরা এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে। আর এই বিধানটিই তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মাধ্যম হয়েছে।
আমি পূর্বেই বলেছি, নারী-পুরুষ উভয়ের পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায় হল ইসলামের পর্দা বা হিজাব বিধান। এই বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। পর্দার এই সুফল স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
ذلكم اطهر لقلوبكم وقلوبهن
  এই বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৩)
সুতরাং মানবসমাজকে পবিত্র ও পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে পর্দা-বিধানের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমান সমাজের যুবক ও তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা ও নারীজাতির নিরাপত্তার জন্য পর্দা-বিধানের পূর্ণ অনুসরণ এখন সময়ের দাবি।
পর্দা-বিধান কুরআন মজীদে
পর্দার বিধানটি ইসলামের একটি অকাট্য বিধান। কুরআন মজীদের অনেকগুলো আয়াতে এই বিধান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কোনো ঈমানদারের পক্ষে এই বিধানকে হালকা মনে করার সুযোগ নেই। এখানে কয়েকটি আয়াত সংক্ষিপ্ত আলোচনাসহ তুলে ধরা হল।
এক.
يا ايها النبى قل لازواجك وبناتك ونساء المؤمنين ...
  হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : ৫৯)
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে।-ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪
ইবনে সীরিন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) আবীদা (সালমানী রাহ.)কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে।
দুই.
واذا سألتموهن فسئلوهن من وراء حجاب ...
তোমরা তাঁদের (নবী পত্নীদের) নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। তোমাদের কারো জন্য আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া সংগত নয় এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীদেরকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য কখনো বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা ঘোরতর অপরাধ। (সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৩)
এই আয়াত থেকেও বোঝা যায়, নারীর দেহের কোনো অংশই পর্দা-বিধানের বাইরে নয়। উম্মুল মুমিনীনগণের আমলও তা প্রমাণ করে।
এই আয়াতে যখন পর্দার বিধানকে সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মুল মুমিনীনদের জন্যও অধিকতর পবিত্রতার উপায় বলা হয়েছে তখন উম্মতের আর কে আছে যে এই বিধানের বাইরে থাকতে পারে?
তিন.
قل للمؤمنت يغضنن من ابصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن الا ما ظهر منها
তরজমা : (হে নবী!) মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। (সূরা নূর : ৩১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, সাধারণত যা প্রকাশিত অর্থ হচ্ছে কাপড়।-তাফসীরে তাবারী ১৮/১১৯
এই ব্যাখ্যা অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, গায়রে মাহরাম পুরুষের সামনে নারীর মুখমন্ডলসহ পূর্ণ দেহ আবৃত রাখা অপরিহার্য।
চার.
وليضربن بخمرهن على جيوبهن
তরজমা : তারা যেন গ্রীবা ও বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। ... (সূরা নূর : ৩১)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন,
يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله : وليضربن بخمرهن على جيوبهن شققن مورطهن فاختمرن بها.
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন। আল্লাহ তাআলা যখন
وليضربن بخمرهن على جيوبهن
আয়াত নাযিল করলেন তখন তারা নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করেছিলেন।-সহীহ বুখারী ২/৭০০
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন-ফাখতামারনা অর্থ তারা মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।-ফাতহুল বারী ৮/৩৪৭
আল্লামা আইনী রাহ. বলেন-ফাখতামারনা বিহা অর্থাৎ যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তা দিয়ে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী ১৯/৯২)
আল্লামা শানকীতী রাহ. বলেন, এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, উপরোক্ত মহিলা সাহাবীগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুখমন্ডল আবৃত করারও আদেশ করেছেন। তাই তারা আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনার্থে নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।
পাঁচ.
ولا يضربن بارجلهن ليعلم ما يخفين من زينتهن وتوبوا الى الله جميعا ايه المؤمنون لعلهم تفلحون
(তরজমা) তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর :  ৩১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকা ঈমানদার নারীর কর্তব্য। কারণ পরপুরুষকে নুপুরের আওয়াজ শোনানোর উদ্দেশ্যে সজোরে পদবিক্ষেপ যখন নিষেধ করা হয়েছে তখন যে সকল কাজ, ভঙ্গি ও আচরণ এর চেয়েও বেশি আকৃষ্ট করে তা নিষিদ্ধ হওয়া তো সহজেই বোঝা যায়। মুসলিম নারীদের জন্য এটি আল্লাহ রাববুল আলামীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
পর্দার বিধান হাদীস শরীফে
১. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
নারী হল সতর তথা আবৃত থাকার বস্ত্ত। নিশ্চয়ই সে যখন ঘর থেকে  বের হয় তখন শয়তান তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। আর সে যখন গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করে তখন সে আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বেশি নিকটে থাকে।-আলমুজামুল আওসাত, তবারানী
এই হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়।
২. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নেকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে। (সহীহ বুখারী ৪/৬৩, হাদীস : ১৮৩৮)
কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী বলেন, নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজ্বের সময়টুকু এর ব্যতিক্রম। কেননা, এই সময় তারা ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, চেহারার সাথে মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে। (আরিযাতুল আহওয়াযী ৪/৫৬)
৩. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত কাপড় ঝুলিয়ে রাখে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না। তখন উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে মহিলারা তাদের কাপড়ের ঝুল  কীভাবে রাখবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এক বিঘত ঝুলিয়ে রাখবে। উম্মে সালামা বললেন, এতে তো তাদের পা অনাবৃত থাকবে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে এক হাত ঝুলিয়ে রাখবে, এর বেশি নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪১১৭; জামে তিরমিযী ৪/২২৩; সুনানে নাসাঈ ৮/২০৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ১১/৮২
ইমাম তিরমিযী বলেন, এই হাদীসে নারীর জন্য কাপড় ঝুলিয়ে রাখার অবকাশ দেওয়া হয়েছে। কারণ এটিই তাদের জন্য অধিক আবৃতকারী।
৪. ওকবা ইবনে আমের জুহানী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসারী সাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তিনি বললে, সে তো মৃত্যু। -সহীহ বুখারী ৯/২৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২১৭২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৭১; মুসনাদে আহমাদ ৪/১৪৯, ১৫৩
এই হাদীসে বেগানা নারী-পুরুষের একান্ত অবস্থানকে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে স্বামী পক্ষীয় আত্মীয়-স্বজন যেমন দেবর-ভাসুর ইত্যাদির সাথে অধিক সাবধানতা অবলম্বনকে অপরিহার্য করা হয়েছে।
৫. হযরত আয়েশা রা. ইফ্কের দীর্ঘ হাদীসে বলেছেন-আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম একসময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিল বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দা বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত করে ফেলি।
অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমি ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি।-সহীহ বুখারী ৫/৩২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৭৭০; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩১৭৯
৬.  উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছিলাম। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রা.ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হলেন। এটি ছিল পর্দা বিধানের পরের ঘটনা। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তার সামনে থেকে সরে যাও। আমরা বললাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখছেন না?! তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না?-সুনানে আবু দাউদ ৪/৩৬১, হাদীস : ৪১১২; জামে তিরমিযী ৫/১০২, হাদীস : ২৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ ৬/২৯৬; শরহুল মুসলিম, নববী ১০/৯৭; ফাতহুল বারী ৯/২৪৮
৭. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা যখন আমাদের সামনাসামনি চলে আসত তখন আমাদের সকলেই চেহারার ওপর ওড়না টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার তা সরিয়ে নিতাম।-মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০; ইবনে মাজাহ,
হাদীস: ২৯৩৫
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা আবশ্যক।
৮. আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম। ...-মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, সাহাবা-যুগের সাধারণ মহিলারাও গায়র মাহরাম পুরুষ থেকে নিজেদের চেহারা আবৃত করতেন। কারণ আসমা বিনতে আবি বকর রা. এখানে বহুবচন ব্যবহার করেছেন। যা প্রমাণ করে উম্মুল মুমিনগণ ছাড়া অন্য নারীরাও তাদের মুখমন্ডল আবৃত রাখতেন।
৯. ফাতিমা বিনতে মুনযির রাহ. বলেন, আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রা.-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম।-মুয়াত্তা, ইমাম মালেক ১/৩২৮; মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪
হযরত ওমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-যখনই কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে একান্তে সাক্ষাত করে তখন তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।-জামে তিরমিযী
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, একজন মহিলা পর্দার পিছন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে একটি কাগজ দিতে চাইল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাত গুটিয়ে নিলেন (কাগজটি নিলেন না এবং) বললেন, আমি জানি না, এটা কি পুরুষের হাত না নারীর। মহিলা আরজ করলেন, নারীর হাত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যদি নারী হতে তাহলে নিশ্চয়ই নখে মেহেদী থাকত।-সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ী
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, পীর-মুর্শিদ ও উস্তাদের সাথেও পর্দা করা অপরিহার্য।
হযরত উমাইমা বিনতে রুকাইকা রা. থেকে বাইয়াত সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে যে, নারীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের প্রতি আমাদের নিজেদের চেয়েও মেহেরবান। সুতরাং আপনার হাত মোবারক দিন, আমরা বাইয়াত হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি নারীদের সাথে হাত মিলাই না। (যা মুখে বলেছি তা মেনে চলাই তোমাদের জন্য অপরিহার্য)।-মুয়াত্তা মালিক
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, আল্লাহর কসম! বাইয়াতের সময় তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) হাত কখনো কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেনি। তিনি শুধু মুখে বলতেন, তোমাকে বাইয়াত করলাম।-সহীহ বুখারী ২/১০৭১
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
দুই শ্রেণীর দোযখী এখনও আমি দেখিনি। (কারণ তারা এখন নেই, ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবে) এক শ্রেণী হচ্ছে ঐ সকল মানুষ, যাদের হাতে ষাঁড়ের লেজের মতো চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে। (দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে) ঐ সকল নারী, যারা হবে পোশাক পরিহিতা, নগ্ন, আকৃষ্ট ও আকৃষ্টকারী; তাদের মাথা হবে উটের হেলানো কুঁজের ন্যায়। এরা জান্নাতে যাবে না এবং জান্নাতের খুশবুও পাবে না অথচ জান্নাতের খুশবু তো এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে।-মুসলিম ২/২০৫, হাদীস : ২১২৮
এই হাদীসে বেপর্দা নারীদের প্রতি কঠিন হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে। সুতরাং তাদের মৃত্যুর আগেই তাওবা করে পর্দার বিধানের দিকে ফিরে আসা কর্তব্য।
উপরের আলোচনা থেকে জানা গেল যে, কুরআন মজীদে ও হাদীস শরীফে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্দার বিধান দেওয়া হয়েছে। এই বিধান মেনে চলা সকল ঈমানদার নারী-পুরুষের জন্য অপরিহার্য। এবার ঐ সকল নিকটাত্মীয়দের কথা উল্লেখ করছি, যাদের মাঝে পর্দার হুকুম নেই। এরা ছাড়া অন্য সকলের সাথেই পর্দা করতে হবে।
যাদের সাথে পর্দা নেই
মাহরাম পুরুষের সাথে নারীর পর্দা নেই। মাহরাম পুরুষ দ্বারা উদ্দেশ্য হল এমন পুরুষ আত্মীয়, যার সাথে বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে কোনো অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয নয়। যেমন-পিতা, ভাই ইত্যাদি।
আর যে পুরুষের সাথে বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা (যেমন-নারীর বোন বা এমন নারীর বিবাহে থাকা, যাদের দুজনকে বিবাহসূত্রে একত্র করা জায়েয নয়) দূর হওয়ার পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয সে হল গায়র-মাহরাম। তার সাথে পর্দা করা ফরয।
পুরুষের জন্য মাহরাম ও গায়র-মাহরাম নারী
একজন পুরুষের মাহরাম নারী হল এমন নারী, যার সাথে তার বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে কোনো অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয নয়। যেমন-মা, মেয়ে ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে যে নারীর সাথে তার বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা (যেমন-নারীর অন্য পুরুষের বিবাহে থাকা) দূর হওয়ার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয সে হল গায়র-মাহরাম।
মাহরামের প্রকারভেদ
সাধারণত তিন ধরনের সম্পর্ককে শরীয়ত মাহরাম হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছে। যথা : ক) বংশীয়/ঔরসজাত সম্পর্ক। খ) দুধ সম্পর্ক ও গ) বৈবাহিক সম্পর্ক।
বংশগত সম্পর্কের কারণে মাহরাম নারীর বংশ সম্পর্কিত মাহরাম পুরুষগণ হলেন-১. পিতা, দাদা-নানা ও তদোর্ধ্ব পুরুষ। ২. পুত্র, পৌত্র ও তদস্তন পুরুষ। ৩. ভাই-সহোদর, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয়। ৪. ভ্রাতুষ্পুত্র ও তদস্তন পুরুষ। ৫. ভাগ্নে (সহোদর, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় বোনের ছেলে)। ৬. চাচা।
৭. মামা।
আল্লাহ তাআলার বাণী-
ولا يبدين زينتهن الا لبعولتهن او ابآئهن او ابآء بعولتهن او ابنآئهن او ابنآء بعولتهن او اخوانهن او بنى اخوانهن او بنى اخوتهن او نسائهن او ما ملكت ايمانهن او التبعين غير اولى الاربة من الرجال او الطفط الذين لم يظهروا على عورت النساء
(তরজমা) তারা যেন নিজেদের আভরণ প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যারা যৌন কামনা-রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত অন্য কারো নিকট। (সূরা নূর (২৪) : ৩১)
পুরুষের বংশ সম্পর্কিত মাহরাম নারীগণ হলেন-
১. মা ২. কন্যা ৩. ভগ্নী ৪. ফুফু, ৫. খালা ৬. ভ্রাতুষ্পুত্রী ৭. ভাগ্নী।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
حرمت عليكم امهتكم وبنتكم واخوتكم وعمتكم وخلتكم وبنت الاخ وبنت الاخت.
(তরজমা) তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, কন্যা, ভগ্নী, ফুফু, খালা, ভ্রাতুষ্পুত্রী, ভাগ্নী। ... (সূরা নিসা (৪) : ২৩)
দুধ সম্পর্কের কারণে মাহরাম দুগ্ধপানের কারণেও মাহরাম সাব্যস্ত হয়ে থাকে। দুধ মা, দুধ কন্যা, দুধ বোন ইত্যাদি নারীগণ পুরুষের মাহরাম পরিগণিত হবেন। অনুরূপভাবে দুধ পিতা, দাদা ও তদোর্ধ্ব পুরুষ, দুধ পুত্র ও তদস্তন পুরুষ, দুধ ভাই ইত্যাদি পুরুষ নারীর মাহরাম হিসেবে গণ্য হবেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
حرمت عليكم امهتكم ... وامهتكم التى ارضعنكم واخوتكم من الرضاعة
(তরজমা) তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা ... দুধ-মা, দুধ বোন। ... (সূরা নিসা : (৪) : ২৩)
বিখ্যাত মুফাসসির আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ কুরতুবী রাহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-
একজন নারী যদি কোনো শিশুকে দুধ পান করায় তাহলে সে দুগ্ধ পানকারীর জন্য হারাম হয়ে যায়। কারণ সে তার মা। তেমনি দুধমার মেয়ে, বোন হওয়ার কারণে; দুধমার বোন, খালা হওয়ার কারণে; দুধমার মা, নানী হওয়ার কারণে; দুধমার স্বামীর অন্য পক্ষের কন্যা, বোন হওয়ার কারণে; স্বামীর বোন, ফুফু হওয়ার কারণে; স্বামীর মা, দাদী হওয়ার কারণে ঐ শিশুর জন্য হারাম হয়ে যায়। তেমনি দুধমার ছেলে-মেয়ের সন্তানাদিও হারাম হয়ে যায়। কারণ তারা তার ভাই-বোনের
সন্তানাদি। (তাফসীরে কুরতুবী ৫/৭২)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, আবুল কুয়াইসের ভাই আফলাহ (যিনি আয়েশা রা.-এর দুধ চাচা) একবার আমার নিকট আসার অনুমতি চাইলেন। আমি অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালাম। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে আসার পর তাঁকে ঘটনাটি জানালাম। তিনি আমাকে অনুমতি প্রদানের আদেশ করলেন।
মুসলিমের রেওয়ায়েত অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তার সাথে পর্দা করো না। কেননা, বংশীয় সম্পর্কের দ্বারা যা হারাম হয়, দুধ সম্পর্ক দ্বারাও তা হারাম হয়।-সহীহ বুখারী ৮/৩৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৪৭; সুনানে নাসায়ী ৬/৯৯
বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে মাহরাম
মাহরাম সাব্যস্ত হওয়ার তৃতীয় কারণ হল বিবাহ। বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারাও নারী-পুরুষ একে অপরের মাহরাম সাব্যস্ত হয়। নারীর বিবাহ সম্পর্কীয় মাহরাম পুরুষ হল স্বামীর পিতা (শ্বশুর), স্বামীর অন্য পক্ষের পুত্র ইত্যাদি। তেমনিভাবে নিজের শাশুড়ি, স্ত্রীর গর্ভজাত অন্য পক্ষের কন্যা ইত্যাদি নারীও পুরুষের জন্য মাহরাম গণ্য হবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وحرمت عليكم امهتكم ... وامهت نسائكم وربآئبكم التى فى حجوركم من نسائكم التى دخلتم بهن ...
(তরজমা) তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, ... শাশুড়ি ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের সাথে সংগত হয়েছ তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত কন্যা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে।... (সূরা নিসা : ২৩)
ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ কুরতুবী রাহ. বলেন-বিবাহ সম্পর্কীয় মাহরাম নারী চার প্রকার : ১. স্ত্রীর মা (শাশুড়ি) ২. স্ত্রীর কন্যা ৩. পিতার স্ত্রী (সহোদর মা, সৎ মা) ও ৪. পুত্রবধু। (তাফসীরে কুরতুবী ২/৭৪)
উল্লেখ্য, শাশুড়ি বলতে স্ত্রীর মা, দাদী-নানী এভাবে উপরের দিকের সকলকে বোঝাবে। তবে স্ত্রীর খালা, ফুফু অর্থাৎ খালা শাশুড়ি, ফুফু-শাশুড়ি মাহরাম নয়। এঁদের সাথে পর্দা আছে। একই কথা নারীর ক্ষেত্রে। স্বামীর পিতা, দাদা ও নানার সাথে পর্দা নেই। তবে স্বামীর চাচা, মামা অর্থাৎ চাচা-শ্বশুর, মামা-শ্বশুরের সাথে পর্দা আছে।
উপরের আলোচনা থেকে পর্দার বিধান পালন সম্পর্কে আমরা যা পেয়েছি তা হচ্ছে-
এক. পর্দার বিধান পালন করার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ পালন করা, যা মুমিনের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
وما كان لمؤمن ولا مؤمنة اذا قضى الله ورسوله امرا ان يكون لهم الخيرة من امرهم ومن يعص الله ورسوله فقد ضل ضلالا بعيدا.
(তরজমা) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অবকাশ থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট হবে। (সূরা আহযাব (৩৩) : ৩৬)
দুই. পর্দার বিধান মেনে চলা হচ্ছে ঈমানের দাবি। কেননা আল্লাহ তাআলা পর্দা-বিধানের ক্ষেত্রে শুধু ঈমানদার নারীপুরুষকেই সম্বোধন করেছেন।
তামীম গোত্রের কয়েকজন নারী উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নিকট আগমন করল, যাদের পরনে ছিল পাতলা কাপড়। উম্মুল মুমিনীন তাদেরকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমরা যদি মুমিন নারী হও তাহলে এ তো মুমিন নারীর পোশাক নয়। আর যদি মুমিন না হও তাহলে তা ব্যবহার করতে পার। (মাআলিমুস সুনান ৪/৩৭৬)
এক নববধুকে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নিকট আনা হল, যার পরনে ছিল রঙ্গিন কিবতী চাদর। তখন উম্মুল মুমিনীন রা. বললেন, যে নারী এ রকম পোশাক পরিধান করে তার তো সূরা নূরের প্রতি ঈমান নেই। (তাফসীরে কুরতুবী ১৪/২৪৪)
তিন. পর্দাপালন হল সতর।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক লাজুক ও পর্দাশীল। তিনি লজ্জা ও পর্দাকে পছন্দ করেন। (আবু দাউদ, হাদীস : ৪০১২, ৪০১৩; সুনানে নাসাঈ ১/২০০; মুসনাদে আহমদ ৪/২২৪
আল্লাহ তাআলা পিতা আদম ও হওয়া আ.-এর প্রতি পর্দার নেয়ামতকে বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন-
ان لك الا تجوع فيها ولاتعرى
(তরজমা) তোমার জন্য এ-ই রইল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্তও হবে না এবং নগ্নও হবে না।-সূরা ত্বহা (২০) : ১১৮)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন-
يبنى ءادم قد انزلنا عليكم لباسا يورى سوءتكم وريشا ولباس التقوى ذلك خير.
(তরজমা) হে বনী আদম! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশ-ভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে পরিচ্ছদ দিয়েছি এবং তাকওয়ার পরিচ্ছদ এটাই সর্বোৎকৃষ্ট।- সূরা আরাফ (৭) : ২৬)
চার. পর্দা হল নারী-পুরুষ উভয়ের হৃদয়ের পবিত্রতার উপায়। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তা ঘোষণা করেছেন।
পাঁচ. পর্দা হল ইফফাত তথা চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার উপায়। এই ইফফত ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুআর অংশ। তিনি দুআ করতেন-
أسألك الهدى والتقى والعفة
অন্য রেওয়ায়েতে
إني أسألك الهدى والتقى والعفاف
অর্থ : (হে আল্লাহ!) আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি হেদায়েত, তাকওয়া ও ইফফত (চারিত্রিক পবিত্রতা)।-সহীহ মুসলিম (কিতাবুয যিকর; জামে তিরমিযী (দাওয়াত অধ্যায়); ইবনে মাজাহ (দুআ অধ্যায়); মুসনাদে আহমদ ১/৪১১, ৪১৬ ও ৪৩৬
এই পবিত্রতা হচ্ছে জান্নাতী নারীদের একটি গুণ। আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন আয়াতে এর দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
আল্লাহ তাআলা তাদের অসাধারণ রূপের বর্ণনা দেওয়ার সাথে সাথে একথাও বলেছেন যে, তারা নির্ধারিত গৃহে অবস্থান করবে এবং নিজ স্বামী ছাড়া অন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না। তো তাদের সৌন্দর্যের পাশপাশি তাদের পবিত্রতারও প্রশংসা করেছেন। সুতরাং রূপ-সৌন্দর্যের সাথে যদি ইফফাত ও সতীত্ব থাকে তবে এরচেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে?!! আর পর্দাই হল সতীত্ব রক্ষার উপায়।



মুসলমানের  পোশাক : কিছু মূলনীতি
মাওলানা আনসারুল্লাহ হাসান
পোশাক-পরিচ্ছদ মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, পোশাক যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে রাখা ও সৌন্দর্যের উপকরণ, তেমনি শরীয়তের দিক-নির্দেশনা মেনে তা ব্যবহার আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম, কুরআন-হাদীসে অন্যান্য বিষয়াদির মতো লেবাস-পোশাক বিষয়েও হুকুম-আহকাম দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পোশাক সম্পর্কিত দ্বীনী হেদায়াত ও শরীয়তের বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন এবং এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের তরবিয়ত করেছেন। আর
সাহাবায়ে কেরামও নিজ নিজ ঘরে গিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মতো স্ত্রী-কন্যা ও সন্তান-সন্ততির তরবিয়ত করেছেন। কারণ পোশাক-পরিচ্ছদের ভালো মন্দ মানুষের কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, চরিত্র ও নৈতিকতা তথা মানবিক জীবনের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্তর ও মন-মানসিকতায় গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাই পোশাকের বিষয়টি এ রকম সাধারণ কোনো বিষয় নয় যে, একটি কাপড় কিনলাম এবং তা পরে নিলাম। বরং এক্ষেত্রে শরীয়তের দিক-নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি।
পোশাক যে অনেক বড় নেয়ামত তা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
يبنى ءادم قد انزلنا عليكم لباسا يورى سوءتكم وريشا ولباس التقوى ذلك خير.
হে আদমের সন্তান! আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দূষণীয় তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্যেরও উপকরণ। বস্ত্তত তাকওয়ার যে পোশাক সেটাই উত্তম। এসব আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্যতম। এর উদ্দেশ্য মানুষ যাতে উপদেশ গ্রহণ করে।
পোশাকের কিছু মৌলিক নীতিমালা
পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের বিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও উপকারী। শরীয়ত বিশেষ কোনো পোশাক সুনির্দিষ্ট করে দেয়নি এবং কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইন বা আকৃতিও বলে দেয়নি যে, এ ধরনের পোশাকই তোমাদের পরতে হবে; বরং বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল, আবহাওয়া ও মৌসুম ভেদে পোশাক পরিধানের স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে কিছু মৌলিক নীতি ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, এ ধরনের পোশাক গ্রহণীয় ও এ ধরনের পোশাক বর্জনীয়। সুতরাং মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে এসব নীতিমালা ও সীমারেখা মেনে চলা জরুরি। যে পোশাক এই নীতিমালা ও সীমারেখা অনুযায়ী হবে সেটাই শরীয়তসম্মত পোশাক বলে গণ্য হবে।
এক. পোশাক এমন আঁটসাঁট ও ছোট মাপের হতে পারবে না, যা পরলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে এবং দৈহিক গঠন ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।
আবু ইয়াযীদ মুযানী রাহ. বলেন, হযরত ওমর রা. মহিলাদেরকে কাবাতী (মিসরে প্রস্ত্ততকৃত এক ধরনের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫২৮৮
দুই. পোশাক এমন পাতলা ও মিহি হতে পারবে না যাতে শরীর দেখা যায় এবং সতর প্রকাশ পেয়ে যায়। যেমন পাতলা সুতির কাপড়, নেটের কাপড় ইত্যাদি। অবশ্য পাতলা কাপড়ের নিচে সেমিজজাতীয় কিছু ব্যবহার করলে তা জায়েয হবে।
হযরত আলকামা ইবনে আবু আলকামা তার মা থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার হাফসা বিনতে আবদুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নিকটে এল। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন।-মুয়াত্তা মালেক ২/৯১৩, হাদীস : ৬
তিন. পোশাকের ক্ষেত্রে কাফের-মুশরিক ও ফাসেক লোকদের অনুসরণ-অনুকরণ ও সাদৃশ্য অবলম্বন করা যাবে না। বিশেষত সেইসব পোশাকের ক্ষেত্রে যা অমুসলিমদের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উসফুর (ছোট ধরনের লাল বর্ণের ফুল গাছ) দ্বারা রাঙানো দুটি কাপড় পরতে দেখে বললেন, এগুলো হচ্ছে কাফিরদের পোশাক। অতএব তুমি তা পরিধান করো না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৭৭; নাসায়ী, হাদীস : ৫৩১৬
তাছাড়া অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির  সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদেরই দলভুক্ত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০২৭
চার. পোশাকের মাধ্যমে অহংকার ও লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ উদ্দেশ্য হওয়া যাবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সুখ্যাতি ও প্রদর্শনীর পোশাক পরবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬২৪৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০২৫
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি অহংকারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৮৭
পাঁচ. পুরুষদের জন্য মেয়েলী পোশাক এবং নারীদের জন্য পুরুষদের পোশাক পরা এবং একে অন্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করা নিষেধ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব পুরুষের উপর লানত করেছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে (তাদের মতো আকৃতি, তাদের পোশাক ও তাদের চাল-চলন গ্রহণ করে)। আর সেই সব নারীর উপরও লানত করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮৮৫
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নারীর পোশাক পরিধানকারী পুরুষকে এবং পুরুষের পোশাক পরিধানকারিনী নারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৯২
ছয়. পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় করা, বিলাসিতা করার জন্য বা শখের বশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পোশাক ক্রয় করা অথবা মাত্রাতিরিক্ত উচ্চমূল্যের পোশাক ক্রয় করা নিষেধ।
হযরত আমর ইবনে শুআইব তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা খাও, পান কর, অন্যদের দান কর এবং কাপড় পরিধান কর যে পর্যন্ত অপচয় ও অহংকার করা না হয়।-সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৫৫৯; ইবনে মাজাহ,হাদীস : ৩১০৫
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, যা মনে চায় খাও, যা মনে চায় পরিধান কর যে পর্যন্ত দুটি বিষয় না থাকে : অপচয় ও অহংকার।-সহীহ বুখারী ১০/১৫২
সাত. গায়রে মাহরাম ও পর পুরুষের সামনে অলংকার ও পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবে না, যাতে তারা সেদিকে আকৃষ্ট হয়।
ولا يبدين زينتهن الا ما ظهر منها
তারা যেন নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে।
উক্ত আয়াতে নারীদেরকে হুকুম করা হয়েছে তারা যেন গায়রে মাহরাম বা পর পুরুষের সামনে নিজেদের পুরো শরীর বড় চাদর বা বোরকা দ্বারা আবৃত করে রাখে। যাতে তারা সাজ-সজ্জার অঙ্গসমূহ দেখতে না পায়।
ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন, যে সব কর্ম নারীর উপর লানত করে তা হল অলংকার ও আকর্ষণীয় পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশ করা। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার ...। আলকাবায়ের পৃ. ১০২
وقرن فى بيوتكن ولا تبرجن تبرج الجاهلية الاولى
নিজ গৃহে অবস্থান কর সাজ-সজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না। যেমন প্রাচীন জাহেলী যুগে প্রদর্শন করা হত।
প্রাচীন জাহেলী যুগে নারীরা নির্লজ্জ সাজ-সজ্জার সাথে নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াত। আজকের নব্য জাহেলিয়াতের অশ্লীলতা এতটাই উগ্র যে, তার সামনে প্রাচীন জাহেলিয়াত ম্লান হয়ে গেছে।
আট. পুরুষের জন্য টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে কাপড় নিষেধ এবং তা কবীর গুনাহ।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কাপড়ের যে অংশ টাখনুর নীচে যাবে তা (টাখনুর নীচের অংশ) জাহান্নামে জ্বলবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৮৭
হযরত আবু হুবাইব ইবনে মুগাফফাল গিফারী রা. মুহাম্মাদ কুরাশীকে লুঙ্গি টেনে চলতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে অহংকারবশত পায়ের নীচে কাপড় ফেলে চলবে সে জাহান্নামে গিয়ে এভাবে চলবে।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৫৪২
 আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমরা নিজগৃহে অবস্থান কর। এ আয়াতে একটি মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে যে, নারীর আসল জায়গা ও কর্মস্থল তার ঘর। গৃহকর্ম ও খান্দান গড়ে তোলাই তার দায়িত্ব। যে সব তৎপরতা এ দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটায় তা নারীজীবনের মৌলিক উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এর অর্থ এমন নয় যে, ঘর হতে বের হওয়া তার জন্য একদম জায়েয নয়। অতি প্রয়োজনে ঘর হতে বের হওয়া জায়েয। তবে কিছু আদাব ও নিয়মাবলি মেনে চলতে হবে।
১. পুরো শরীর বড় এবং মোটা চাদর দ্বারা অথবা সমগ্র শরীর ঢাকা যায় এমন বোরকা দ্বারা আবৃত করে ফেলবে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের কোনো অংশ খোলা রাখা যাবে না। চেহারা, উভয় হাত কব্জিসহ এবং উভয় পা টাখনুসহ আবৃত করবে। পথ-ঘাট দেখার জন্য শুধু চোখ খোলা রাখা যাবে। প্রয়োজনে হাত ও পায়ের মোজা এবং চেহারার জন্য আলাদা নেকাব ব্যবহার করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন। হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, আপনার কন্যাদের এবং মুমিনদের নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের মুখের উপর তাদের চাদর নামিয়ে দেয়।-সূরা আহযাব : ৫৯
অন্য আয়াতে মুমিন নারীদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন-তোমরা সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না যেমন প্রাচীন জাহেলী যুগে প্রদর্শন করা হত। -সূরা আহযাব : ৩৩
মনে রাখতে হবে, টাখনু পর্যন্ত কদম, কব্জি পর্যন্ত হাতের পাতা এবং চেহারা সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়, ফলে তা নামাযের সময় খোলা রাখা যাবে। কিন্তু এসব অঙ্গ পর্দার হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। ফলে গায়রে মাহরাম ও পরপুরষের সামনে তা খোলা রাখা যাবে না।
২. ঘরের বাইরে যাওয়ার সময়  মেক-আপ, সাজসজ্জা গ্রহণ করবে না এবং কোনো ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করবে না। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. হতে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন কোনো মহিলা সুগন্ধি মেখে ঘর থেকে বের হয় এবং লোকদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাতে তারা তার খুশবু গ্রহণ করে, তবে
সে ব্যভিচারিণী।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৭৮৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪১৭৪-৭৫
৩. স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি গ্রহণ করবে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যে নারী স্বামীর ঘর হতে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত বের হয়ে যায় সে ঘরে ফিরে আসা পর্যন্ত অথবা স্বামী সন্তুষ্ট হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তার উপর অসন্তুষ্ট থাকেন।-কানযুল উম্মাল
৪. দূরের সফর হলে একা যাবে না; বরং কোনো মাহরাম পুরুষের সাথে যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভাষণে বলতে শুনেছি, কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে মাহরাম ব্যক্তি ছাড়া নির্জনে অবস্থান করবে না। এবং কোনো নারী মাহরাম ছাড়া সফর করবে না।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩০২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৪১
৫. এমনভাবে চলবে না যে, অলংকারের শব্দ মাহরাম নয় এমন কেউ শুনতে পায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন-মুসলিম নারীদের উচিত, মাটিতে এমনভাবে পা না ফেলা, যাতে তাদের গুপ্ত সাজ-সজ্জা জানা হয়ে যায়।-সূরা নূর : ৩১
৬. গায়রে মাহরাম তথা বেগানা পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন, হে নবী! মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। ... -সূরা নূর : ৩১
হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে গেলে করণীয় কী-জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে আদেশ করলেন।-সহীহ  মুসলিম, হাদীস : ২১৫৯
৭. মাহরাম নয় এমন পুরুষের সাথে অতি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না। একান্ত যদি বলতেই হয় তবে নরম ও কোমল ভাষায় বলবে না, যাতে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে না পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা কোমল কণ্ঠে কথা বলো না। পাছে অন্তরে ব্যাধি আছে এমন ব্যক্তি লালায়িত হয়ে পড়ে। আর তোমরা বলো সঙ্গত কথা।-সূরা আহযাব : ৩২

ইসলামের পর্দা-বিধান ও আমাদের অসতর্কতা
শামীমা বিনতে নূর
ইসলাম আল্লাহ পাকের মনোনীত দ্বীন। জীবনের এমন কোনো অঙ্গন নেই, যেখানে ইসলামের বিধান ও শিক্ষা নেই। সেই শিক্ষা ও বিধান যখন আমরা ভুলে যাই তখনই আমাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। আখেরাতের ভয়াবহ শাস্তি তো আছেই, দুনিয়ার জীবনও বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
সম্প্রতি নারীনির্যাতন খুব বেড়ে গেছে, বিশেষত উঠতি বয়েসী মেয়েরা চরম নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এটা এ সমাজের চরম ব্যর্থতা যে, নিজেদের মা-বোনকেও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এ অবস্থায় মা-বোনদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন প্রয়োজন অনেক বেশি সতর্কতা ও সচেতনতার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য এই যে, বিপর্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়েই যেন বেড়ে চলেছে আমাদের অবহেলা ও অসচেতনতা। বর্তমান নিবন্ধে চলমান সমাজচিত্রের কিছু অংশ ও আমাদের অবহেলার কিছু দিক পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই।
এক.
আমার প্রতিবেশী একজন শিক্ষক। তাঁর কাছে পড়তে আসে অনেক ছেলেমেয়ে। ছোট ছোট মেয়েরা যেমন আসে তেমনি আসে উঠতি বয়সের কিশোরীরাও। ওদের অনেকেরই পোশাক এমন যে, আমি বিষণ্ণ বোধ করি। আমি ভাবি ওদের মায়েদের কথা। তাঁরা কীভাবে তাদের মেয়েদেরকে পুরুষ শিক্ষকের কাছে পাঠান, উপরন্তু এমন পোশাকে? তাঁদের যদি আখেরাতের ভয় না থাকে, দুর্ঘটনার ভয়ও কি নেই? এই তো কদিন আগে ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলের ঘটনাটি নিয়ে পত্রপত্রিকায় তোলপাড় হল। এর আগেও এরকম ঘটনা পত্রিকার পাতায় এসেছে। অনেক পিতামাতাই হয়তো উদ্বিগ্ন, কিন্তু সম্ভবত তারা ভাবছেন, এছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। তাই সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুখেও মেয়েদেরকে এই শিক্ষাটাই দিচ্ছেন এবং এই পদ্ধতিতেই দিচ্ছেন। কিন্তু সত্যিই কি উপায় নেই? সত্যিই কি এর কোনো বিকল্প নেই? সেই উপায় ও বিকল্প খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।
দুই.
আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে বলেছেন-(তরজমা) ঈমানদাররা! ইসলামে প্রবেশ কর পরিপূর্ণভাবে আর অনুসরণ করো না শয়তানের পদাঙ্ক; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।
কোরআন শরীফের এই আয়াতটি মনে পড়েছে আমার একজন আত্মীয়াকে দেখে। নিজের মহলে তিনি যথেষ্ট দ্বীনদার। নামায-রোযা ও দান-খয়রাতে তাঁর সুনাম আছে। এলাকার অনেক মেয়েকে তিনি বোরকা দিয়েছেন এবং তারা পর্দা মেনে চলতে শুরু করেছে। নিজের মেয়েদেরকেও বোরকায় অভ্যস্ত করেছেন, তবে অনেক ইংরেজি শিক্ষিত দ্বীনদারের মতো তাদের পড়িয়েছেন কলেজ-ভার্সিটিতে। তিনি হয়তো চিন্তাও করেননি যে, মেয়ের কারণে তার নিজের দ্বীনদারীও আক্রান্ত হতে পারে।
সহশিক্ষার উন্মুক্ত পরিবেশে অনেক ক্ষেত্রেই যা হয় তার সন্তানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। একটি দ্বীনহীন পরিবারের ছেলের সাথে মেয়েটির সম্পর্ক হয়েছে। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের অবস্থা যা শুনেছি তা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলি, ঐ অনুষ্ঠানেই তাঁকে শুনতে হয়েছে পর্দা ও বোরকা সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইনের অনেক বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা।
এখানে সম্ভবত পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করার একটি দিক স্পষ্ট হয়েছে। আমি নামায পড়ি, রোযা রাখি, কিন্তু জাহেলিয়াতের মোহ ত্যাগ করতে পারি না, সন্তান-সন্ততিকে বানাতে চাই প্রগতিশীল মুসলিম তাহলে আমি পরিপূর্ণভাবে ইসলামে ঢুকিনি। আমি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম তখনই হতে পারব যখন বিশ্বাস করব ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বলে এবং শিক্ষা-দীক্ষায়, রুচি ও জীবনাচারে ইসলাম যা দিয়েছে তাকেই গ্রহণ করতে পারব সর্বোত্তম বলে।
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন, ঈমানের লযযত ঐ ব্যক্তি পেয়েছে, যে আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে রাসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে।
তিন.
গায়রে মাহরাম পুরুষের সাথে নারীর পর্দা আছে। সাধারণত গায়রে মাহরামের অর্থ করা হয় বেগানা বা পরপুরুষ। এই তরজমা সূক্ষ্ম ও সঠিক নয়। কারণ অনেক আত্মীয়ও এমন আছে যারা গায়রে মাহরাম, অর্থাৎ তাদের সাথে পর্দা করা জরুরি। অনেকে অনাত্মীয়দের সাথে পর্দা করলেও গায়রে মাহরাম আত্মীয়দের সাথে পর্দা করেন না। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মীয়দের মাধ্যমেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি থাকে। কিছু দিন আগে ভাসুরের হাতে ভ্রাতৃবধুর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো অনেক আগেই বলে গেছেন-আলহামভু আলমাওত। অর্থাৎ স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় তো মৃত্যু। এ কথাটি তিনি বলেছিলেন গায়রে মাহরাম আত্মীয়ের সাথে পর্দার অপরিহার্যতা বর্ণনা করে।
ভাসুর, দেবর, চাচা শশুর, মামা শশুর, ভাসুরের ছেলে, দেবরের ছেলে, ননদের ছেলে, স্বামীর খালু-ফুফা, খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো ভাই, এদের সবার সাথে পর্দা আছে। তেমনি নিজের খালু, ফুফা, খালাতো-ফুফাতো ভাই এবং মামাতো-চাচাতো ভাইয়ের সাথেও পর্দা আছে। একজন পর্দানশীন নারীকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়া অপরিহার্য।
স্বামীর কর্তব্য, এ বিষয়ে স্ত্রীকে সহযোগিতা করা। কারণ স্ত্রী অজ্ঞ বা অসচেতন হলে তাকে সচেতন করা এবং পর্দায় অভ্যস্থ করা ছিল স্বামীর কর্তব্য; তো স্ত্রী যখন স্বেচ্ছায় পর্দা করতে আগ্রহী তখন তো একে আল্লাহর মহা নেয়ামত মনে করা উচিত। বস্ত্তত এমন স্ত্রীই হচ্ছেন নবীজীর আলমারআতুস সালিহা বা নেককার রমণী, যাকে তিনি খাইরু মাতায়িদ দুনিয়া বা জগতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলে অভিহিত করেছেন।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মাহরাম পুরুষের মাঝেও স্তরভেদ আছে। সকল মাহরাম এক পর্যায়ের নয়। উপরন্তু কোনো মাহরাম যদি ফাসিক হয় কিংবা তার আচার-আচরণ মার্জিত ও শোভন না হয় তখন তো অনেক বেশি সতর্কতার প্রয়োজন। আল্লাহ পাক মানুষের সৃষ্টিকর্তা, তিনি শরীয়ত দান করেছেন। মানুষ যা জানে না তিনি তা জানেন, মানুষ যা বোঝে না তিনি তা বোঝেন। নামায-রোযার মতো হজ্বও একটি ফরয ইবাদত। কিন্তু শরীয়তের বিধান হল ফাসিক মাহরামের সাথে নারী হজ্বে যেতে পারবে না। সুতরাং মাহরাম হলেই আর কোনো সতর্কতার প্রয়োজন নেই এমন নয়। এখন তো অনেক পরিবারে-আল্লাহ হেফাযত করুন-শশুরের মাধ্যমেও পুত্রবধুদের নির্যাতিত হওয়ার কথা শোনা যায়। তেমনি কিছুদিন আগে পত্রিকায় এসেছিল শাশুড়ি-জামাই বিয়ে এবং এ নিয়ে সালিশ-দরবারের একটি সংবাদ। এসব কথা লিখতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এগুলোই এখন বাস্তবতার অংশ। সুতরাং সচেতন না হয়ে উপায় নেই।
চার.
পর্দানশীন নারীকেও কখনো কখনো পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। চিকিৎসকরা হচ্ছেন আমাদের সমাজের অভিজাত শ্রেণী। তাদের মধ্যে যেমন বিনয়ী ও চরিত্রবান ব্যক্তি আছেন, তেমনি কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যার দৃষ্টান্ত মাঝে মাঝে পত্রিকার পাতায় দেখা যায়।
আমরা মুসলিম পর্দানশীন নারী। প্রথমেই আমরা খুঁজব একজন নারী চিকিৎসক। পুরোপুরি পর্দানশীন চিকিৎসক পাওয়া তো মুশকিল, তবে পর্দানশীন নারীদের শ্রদ্ধা করেন, অন্তত ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করেন এমন নারী চিকিৎসক এখনও আছেন। তবে কষ্ট করে তাঁদের খুঁজে নিতে হয়।
আমরা প্রথমেই কেন যাব পুরুষ চিকিৎসকের কাছে? আমার স্বামী দাঁতের চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখেছেন যে, সেখানে সিরিয়াল নিয়ে বেশ কয়েকজন বোরকাপরা নারীও বসে আছেন। অথচ দাঁতের ভালো চিকিৎসা করেন এমন নারী চিকিৎসক দুর্লভ নন।
দাঁতের চিকিৎসায় রোগীকে দীর্ঘ সময় চিকিৎসকের নিকট-সান্নিধ্যে থাকতে হয়। এসময় রোগিনীর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক, বিশেষত তরুণী ও যুবতী রোগিনীর ক্ষেত্রে এটা আরও সত্য।
মধ্য প্রাচ্যের একটি দেশের একজন দাঁতের চিকিৎসকের কথা সেখানকার পত্র-পত্রিকায় এসেছিল, যিনি প্রায় প্রতিটি রোগিনীর সাথেই অশোভন আচরণ করেছেন। এমনকি সেই সব দৃশ্য গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে তাদের অনেককে অবৈধ সম্পর্কেও বাধ্য করেছেন।
আমাদের দেশেও কি এ ধরনের ঘটনা ঘটছে না? তো আমরা যারা পর্দা মেনে চলি তাদের সাবধান থাকা প্রয়োজন। একান্ত অপারগ অবস্থায় যদি পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যেতেই হয় তাহলেও মাহরাম পুরুষকে সাথে নিয়ে চিকিৎসকের সামনে যাওয়া উচিত। কোনো অবস্থাতেই একা যাওয়া উচিত নয়। হাদীস শরীফে কি বেগানা নারী-পুরুষের একান্ত সাক্ষাতকে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়নি?
পাঁচ.
মোবাইল ফোন এখন আমাদের অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। একটি মোবাইল নেই এমন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। মোবাইল ফোনের কারণে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও প্রয়োজনীয় যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। এটা মোবাইলের সুফল। অন্যদিকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান মেনে না চলার কারণে মোবাইলের মাধ্যমে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটছে। আমাদের জানাশোনার মধ্যে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সারসংক্ষেপ হল, এক ভদ্র পরিবারের পুত্রবধু, যার স্বামী মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কর্মরত। স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য তার কাছে একটি ফোন ছিল। সেই ফোনেই মিসডকলের মাধ্যমে এক ব্যক্তির সাথে তার পরিচয় হল। একপর্যায়ে স্বামীর সংসার ও নিজের তিনটি সন্তান রেখে মহিলাটি উধাও হয়ে গেল। এমন ঘটনা তো নতুন নয় তবে  পরিবারটি যেহেতু ভদ্র ও মোটামুটি ধার্মিক হিসেবে পরিচিত ছিল তাই গ্রামে তোলপাড় শুরু হল এবং পঞ্চায়েত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল যে, এই গ্রামের কোনো নারীর কাছে মোবাইল ফোন থাকতে পারবে না। যদি কারো কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া যায় তাহলে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোবাইল ফোন ব্যবহার করার বিষয়ে আমরা কিছু সতর্কতা রক্ষা করতে পারি। পরিচিত আত্মীয়-স্বজনের নাম্বার সংরক্ষণ করে রাখতে পারি এবং অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলে স্বামী বা অন্য কারো মাধ্যমে রিসিভ করাতে পারি। মহিলার কণ্ঠ শুনলেই অনেকে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা শুরু করে দেয় সেগুলোর জবাব না দিয়ে চুপচাপ মোবাইল বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আর প্রয়োজনে গায়রে মাহরাম পুরুষের সাথে কথা বলতে হলে কুরআনের বিধান অনুযায়ী অনাকর্ষণীয় কণ্ঠে কথা বলা উচিত।
ছয়.
আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত পীরভক্ত। ভক্তি-শ্রদ্ধা যদি সঠিক মাত্রায় হয় এবং সঠিক পাত্রে হয় তাহলে দোষের কিছু নেই। হক্কানী পীর-মাশায়েখ মানুষকে তাকওয়া-পরহেযগারী শিক্ষা দেন এবং আত্মশুদ্ধির দীক্ষা দেন, সর্বোপরি তাঁরা মানুষকে কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালিত করেন। তাই আল্লাহওয়ালা বুযুর্গের সাথে ইসলাহ ও সংশোধনের সম্পর্ক রাখা ফায়েদাজনক। তবে চকচকে সবকিছুই যেমন সোনা নয় তেমনি পীর নামধারী ব্যক্তিমাত্রই আল্লাহওয়ালা নয়। সবকিছুর মতো এখানেও ভেজাল আছে। কিছু প্রতারক আছে, যারা নিজেদেরকে পীর নামে পরিচয় দেয় এবং নারী-পুরুষের সকল সমস্যার সমাধানের গ্যারান্টি দেয়। বলাবাহুল্য, এরা পীর নয়। এদের একটি বড় পরিচয় এরা পর্দা করে না। সকল বয়েসের নারী অবাধে এদের কাছে যায় আর ওরাও নানারকম তেলেসমাতি দেখিয়ে মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলে। বন্ধ্যাত্ব থেকে শুরু করে কত শত রোগের যে তারা সমাধান দেয় তার ইয়ত্তা নেই!
এই পর্দাহীনতার সপক্ষে তারা নানা রকম ব্যাখ্যাও দিয়ে থাকে। যেমন কেউ বলে, পীর হচ্ছে রূহানী পিতা, সুতরাং তার সাথে পর্দা কেন? কেউ বলে, ভিতরের পর্দাই বড় পর্দা, বাইরের পর্দার প্রয়োজন কী? কিন্তু মনে রাখতে হবে, সকল পীরের বড় পীর কোরআন মজীদ; সকল মুরশিদের বড় মুরশিদ নবীর সুন্নাহ। সুতরাং কোরআন-সুন্নাহর বিপরীতে কোনো পীরের পীরালি গ্রহণযোগ্য নয়।
তো যারা নিজেদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষায় আগ্রহী তাদেরকে এ সকল ভন্ড প্রতারকদের কাছ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। পর্দা হচ্ছে কুরআনের অকাট্য বিধান। এই বিধান লঙ্ঘনকারী-সে যে পরিচয়ই ধারণ করুক-কোনোভাবেই আল্লাহর খাস বান্দা হতে পারে না।
শেষকথা
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অসতর্কতার কিছু ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হল। চিন্তা করলে দেখা যাবে, এ ধরনের আরো অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে পর্দার বিষয়ে অসর্তকতা প্রদর্শন করা হয়। আমাদের কর্তব্য, ঐ সকল ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া এবং পুরোপুরিভাবে পর্দা মেনে চলার চেষ্টা করা। একমাত্র আল্লাহর বিধানেই রয়েছে আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন এবং তাওফীক দান করুন। আমীন।

ফ্রান্সে বোরকায় জরিমানা এবং ...
শরীফ মুহাম্মদ
বোরকা বা নেকাব পরা মুসলমান নারীর অধিকার। ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটি তাদের জন্য অবশ্য-পালনীয়ও বটে। কিন্তু ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে বোরকা পরার বিরুদ্ধে আইন করা হয়েছে। আইন থাকলেও অন্য দেশগুলোতে এ আইনটি কার্যকর করা বা এর জন্য ধর-পাকড় করার কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ব্যতিক্রম ফ্রান্স। সেখানে গত এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ থেকে এ আইনটি জোরালোভাবে কার্যকর করা হচ্ছে। ওই আইন অনুযায়ী বোরকা পরা কোনো মহিলা যদি তার মুখমন্ডল দেখাতে না চান, তবে পুলিশ তাকে সর্বোচ্চ ১৫০ ইউরো বা ২১৬ ডলার জরিমানা করতে পারে। ফ্রান্সের এ আইনটির আগ্রাসী আরেকটি রূপ হল, এতে ফরাসী বা বিদেশী যে কোনো বোরকা পরা মহিলাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে-যদি তিনি রাস্তা, পার্ক বা শপিংমলের মতো প্রকাশ্যস্থানে বোরকা পরে বের হন।
তবে এএফপি ও বিবিসির সূত্রে ১২ এপ্রিল ঢাকার পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, বোরকা বিরোধী আইন কার্যকর করার প্রথম দিনেই সচেতনভাবে মুসলিম নারীরা এ আইনটি ভাঙতে শুরু করেছেন। ফ্রান্সের আভিগনন শহর থেকে প্যারিসগামী ট্রেনে উঠার আগে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে আইন ভেঙ্গে বোরকা পরা নারী কানিজা দিদার (৩২) বলেন, ফরাসী এ আইন তার ইউরোপীয় অধিকার লঙ্ঘন করেছে। আইনভাঙ্গার কারণে তাকে জরিমানার অর্থ গুণতে হয়েছে। তাকে নিয়ে ওই দিন ফরাসী মিডিয়াতে যথেষ্ট হৈ চৈ হয়েছে। কিন্তু এতে তিনি মোটেও দমে যাননি। জরিমানা দিয়ে হলেও এ উল্টো আইন ভেঙ্গে বোরকা পরে চলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এদিকে বোরকা পরার অপরাধে আইন অনুযায়ী মুসলিম নারীদের ওপর যে জরিমানা চাপানো হবে সে জরিমানার অর্থ যোগান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এক ফরাসী মুসলিম ব্যবসায়ী। তিনি ফ্রান্সে বোরকা পরা নারীদের সহযোগিতার জন্য তার ২০ লাখ ইউরো মূল্যের সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রস্ত্ততি নিয়েছেন। তিনি চান, বোরকা পরায় অভ্যস্ত ও আগ্রহী মুসলিম নারী যেন আইনের কারণে বোরকা না খুলেন। আইন ভাঙ্গার কারণে জরিমানা যা গুনতে হবে সেটা তিনি দেবেন। ধারণা করা হচ্ছে, তার মতো আরো বহু মুসলিম ব্যবসায়ী ফরাসী মুসলিম নারীদের সাহায্যে দাঁড়িয়ে যাবেন।
বোরকা বিরোধী এ আইনটির বিরুদ্ধে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পরিকল্পনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামী মানবাধিকার কমিশন বলেছে, এ আইন জারি ও কার্যকর করার ফলে দেশটিতে রাষ্ট্রীয় মদদে ইসলাম-আতঙ্ক ও মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদের সূচনা হবে। কমিশনের সভাপতি বলেছেন, ২০০৪ সালে ফ্রান্সের স্কুলগুলোতে উড়না বা স্কার্ফ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে অনেক মুসলিম মেয়ে পড়াশোনা ও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। দেশটিতে মুসলমানদের ওপর হামলা বাড়তে থাকায় তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীতা বাড়ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৬০ লাখ মুসলমানের বসবাসক্ষেত্র ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন স্থানীয় ভোটারদের মন জয় করতে। এদিকে বোরকা বিরোধী আইনের এ দেশটি উপরে উপরে সভ্যতা ও মানবাধিকারের ডংকা বাজালেও দেখা যাচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রকাশ্য নারী কেলেঙ্কারি ও নারী নির্যাতনের নানা ঘটনায় তোলপাড় চলছে দুনিয়াজুড়ে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সারকোজি তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে কয়েক বছর যাবত বিয়ে না করেই ঘর-সংসার করছেন সাবেক এক মডেলের সঙ্গে। তাকে ফার্স্ট লেডির মর্যাদা দিয়ে সঙ্গে নিয়ে দেশ-বিদেশে সফরও করছেন তিনি। অপর দিকে আগামী নির্বাচনে তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সদ্যবিদায়ী আইএমএফ প্রধান সম্প্রতি জোরপূর্বক এক হোটেল-সেবিকার ওপর চড়াও হওয়ায় গ্রেফতার হয়ে আমেরিকায় বন্দি জীবন যাপন করছেন। তার সামনে এখন দীর্ঘ কারাবাসের হাতছানি।
এখানে দেখা যাচ্ছে, যে দেশটিতে আইন করে বোরকা নিষেধ করা হয়, বোরকা পরলে জরিমানা দিতে হয়, সর্বোচ্চ স্তরে প্রকাশ্য লাম্পট্য আর ঘৃণ্য যৌন নির্যাতনের কালোদাগ সে দেশের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। অপরদিকে আইন করে, জরিমানা ধার্য করেও মুসলিম নারীদেরকে বোরকাবিহীন জীবনে বাধ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। নিজেদের শালীনতা ও ইসলামসম্মত পোশাকরীতি বজায় রাখতে তারা যে কোনো মূল্যেই প্রস্ত্তত। এমনকি তাদের এই নৈতিক কাজে সহযোগিতার জন্য ক্ষতি স্বীকার করেও আর্থিক যোগান দিতে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মুসলিম ভাইয়েরা পিছপা হচ্ছেন না। আল্লাহর দ্বীনের প্রতি অবজ্ঞার ফল ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ভালবাসার ধারা যুগে যুগে এ রকমই হয়ে থাকে।

পথিক! তুমি পথ হারিয়েছ!
উম্মে হানী বিনতে আহমদ
বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ অসীম। বান্দাকে তিনি দান করেছেন অসংখ্য নেয়ামত। তাঁর বড় নেয়ামতসমূহের একটি পোশাক, যার কথা আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেছেন। পোশাক হচ্ছে নর-নারীর অঙ্গের ভূষণ এবং লজ্জার আবরণ। আল্লাহ রাববুল আলামীনের নিকট বান্দার পোশাক-শোভিত রূপটিই পছন্দনীয়। তাই বিশেষভাবে ইবাদতের সময় তিনি বান্দাকে আদেশ করেছেন যেন সে পোশাক-সৌন্দর্য গ্রহণ করে।  পক্ষান্তরে শয়তানের কাছে পছন্দনীয় হচ্ছে মানুষের নগ্ন ও বিকৃত রূপ। আর তা হবেই না কেন, সে তো আদম সন্তানের প্রকাশ্য দুশমন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কার পছন্দ গ্রহণ করব-রাহমানের, না শয়তানের?
দুই.
পোশাকের মানদন্ডে বিচার করলেও বোঝা যায় পশ্চিমা সভ্যতা হচ্ছে শয়তানের প্রতিভূ। আর এ কারণেই পশ্চিমা আদর্শের অনুসারীদের পোশাক দিন দিন সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। প্রথমে পোশাক ছিল হাটুর নীচ পর্যন্ত, এরপর তা উঠে এল হাটুর উপরে। এরপর এল প্যান্ট-ফতুয়া, এল নেটের জামা, এল টাইটস-সর্টস। যেন হাদীসে বর্ণিত পোশাক পরিহিতা নগ্ন নারীর দৃষ্টান্ত একের পর প্রকাশিত হতে লাগল, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা বেহেশতের ঘ্রাণটুকুও পাবে। বেদনার বিষয় এই যে, এই সব দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের মুসলিম-সমাজে। পশ্চিমা সভ্যতা আমাদের তাহলে কোন দিকে নিয়ে চলেছে?
তিন.
বোন! আমরা ভুল পথে চলেছি। পশ্চিমা সংস্কৃতি কখনো আমাদের অনুকরণের বস্ত্ত হতে পারে না। ঐ সভ্যতায় কি নারীর বিন্দুমাত্র মর্যাদা আছে? সেখানে তো নারী নিছক ভোগের বস্ত্ত। বিভিন্ন উপায়ে নারীকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে পুরুষের আনন্দের চিতায় আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য। এতেই নাকি আধুনিক! নারীর পরম মোক্ষলাভ!
প্রিয় বোন! তুমি যদি হও স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী, তোমার বুকে যদি থাকে মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি তাহলে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কর ঐসব প্রতারণার প্রলোভন এবং ফিরে এসো সেই পথে, যার শেষে আছে চির শান্তির আশ্রয়।
তোমার উপর বর্ষিত হোক রাববুল আলামীনের অপার করুণা।
আরো বিস্তারিত দেখুন : ইসলামে নারীদের পর্দার বিধান 




প্রশ্ন: ৩৪২ : আরাফাতের দিন কোনটি ? এই দিনটির তাৎপর্য ।

বছরের শ্রেষ্ঠ রাত (সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত) হলো লাইলাতুল কাদর বা কদরের রাত, যা রমজান মাসের শেষ দশ রাতের যেকোনো একটি বেজোড় রাত। অন্য দিকে, বছরের শ্রেষ্ঠ দিন (বিশেষ করে জোহরের সময় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) হলো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ যা ইয়াওমু আরাফাত বা আরাফাতের দিন হিসেবে পরিচিত। তাই বছরের সর্বোত্তম দিন হিসেবে এ দিন স্বীকৃত। এ দিনের রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত; যেমন- এক. ক. এ দিন হলো আরাফাতের দিন যে দিনের কসম খেয়েছেন মহান আল্লাহ তার কালামে। (অনুবাদার্থে) ‘এবং কসম জোড় ও বেজোড়ের’ (সূরা ফাজর-৩)।

এ বেজোড় হলো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ যা ইয়াওমু ‘আরাফাত নামে প্রসিদ্ধ। খ. কুরআনে এ দিনকে ‘মাশহুদ’ (দৃষ্ট) বলা হয়েছে এবং এর কসম খাওয়া হয়েছে (সূরা বুরুজ-৩)। দুই. হাদিসে ‘মাশহুদ’কে আরাফাতের দিন বলা হয়েছে (তিরমিজি)। হাদিসের আলোকে ইয়াওমু আরাফাত তথা আরাফাতের দিনকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন বলা হয়েছে (সহিহ ইবন হিব্বান)। তিন. এ দিনকে ইয়াওমুল ‘ইতকি মিনান নার বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিনও বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত যে, আরাফাতের দিনের চেয়ে আর কোনো দিন এমন নেই যেদিন আল্লাহ বান্দাদেরকে জাহান্নাম থেকে সর্বাধিক সংখ্যায় মুক্তি দেন; তিনি সেদিন নিকটবর্তী হন অতঃপর তিনি তাঁর ফেরেশতাদের সাথে গর্ব প্রকাশ করেন এবং বলেন, তারা কী চায়? (সহিহ মুসলিম)।
এদিন করণীয় আমল 
এক. এদিনে সাওম পালন করা। হাদিস শরিফে এ প্রসঙ্গে নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘ইয়াওমু আরাফাত তথা আরাফাতের দিনের সিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর জন্য আগের ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (সহিহ মুসলিম)। সাওম পালন করার বিষয়টি যারা হজ করবে না, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যারা হজ পালন করবেন তাদের সিয়াম পালনের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া এবং এ জন্য সঠিকভাবে ইবাদতে মশগুল হতে না পারার আশঙ্কায় কোনো কোনো আলেম তাদের ক্ষেত্রে সাওম পালন করা মাকরুহ বলেছেন। তবে সিদ্ধান্তমূলক কথা হলো- যারা সাওম পালন করেও এ দিনের ইবাদত-বন্দেগিতে দুর্বলতা অনুভব করবেন না, তারাও সাওম পালন করতে পারবেন। আর যারা দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা করবেন, তারা সাওম পালন না করে বিভিন্ন ইবাদতে মশগুল হবেন। আরাফাতের দিনে মূল বিষয় হচ্ছে- ইবাদতে মশগুল থাকা ও যত বেশি সম্ভব দোয়া করা।
দুই. এ দিন ফজরের সালাতের পর থেকে ১৩ তারিখ আসরের সালাত পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর তাকবির পড়া শুরু করবেন। তাকবিরের জন্য বিভিন্ন শব্দাবলি রয়েছে; তবে বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলি হলো- অবশ্যই আরবিতে বিশুদ্ধ উচ্চারণ করতে হবে (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদু)। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, (অনুবাদার্থে) ‘তোমরা নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে’ (সূরা বাকারাহ-২০৩)। কতবার তাকবির পড়তে হবে এর জন্য নির্ধারিত কোনো সংখ্যা বর্ণিত নেই। তাই তাকবির একবার পড়াই যথেষ্ট। অনুচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করবেন, যেন পরে আসা মুসল্লিদের সালাতে ব্যাঘাত না ঘটে। সুর দিয়ে একই সাথে সবাই মিলে তাকবির পড়া অনেকের দৃষ্টিতে বিদয়াত। কারণ এতে যেমন পরে আসা মাসবুক মুসল্লিদের সূরা কিরাত ও তাসবিহ আদায়ে কষ্ট হয়, তেমনি তা কুরআনে বর্ণিত জিকরের আদব পরিপন্থী। কুরআনে আল্লাহ পাক জিকরের আদব প্রসঙ্গে বলেন, (অনুবাদার্থে) ‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশঙ্কচিত্তে অনুচ্চস্বরে স্মরণ করো’ (সূরা আরাফ-২০৫)। একাকী যারা সালাত আদায় করবেন তারা এবং মহিলারাও তাকবির পাঠ করবেন।
তিন. দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এ দিন যাবতীয় পাপাচার থেকে হিফাজত করবেন। ইমাম আহমাদ একটি হাদিস বর্ণনা করেন যে, ‘আরাফাতের দিন; যে ব্যক্তি এদিন নিজের কান (শ্রবণশক্তি) চোখ (দৃষ্টিশক্তি) এবং জিহ্বাকে হিফাজত করবেন, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (মুসনাদে আহমাদ)।

চার. একাগ্রতা, ইখলাস, নিষ্ঠা, সততা ও ঈমানের সাথে যত বেশি সম্ভব নবী সা: থেকে প্রাপ্ত দোয়া করবেন। যেমন- একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, আরাফাতের দিন নবী সা: যে দোয়াটি বেশি পাঠ করতেন তা হলো- ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু বিয়াদিহিল খাইরু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ (মুসনাদে আহমাদ)। তিরমিজির বর্ণনায় রয়েছে, নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘সর্বত্তোম দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীরা যে দোয়া করেছি তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো- লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয় হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ (সুনানে তিরমিজি)। উচ্চারণিক ভুল থেকে বাঁচার জন্য দোয়াগুলো অবশ্যই আরবিতে বিশুদ্ধ উচ্চারণে শিখতে হবে।
পাঁচ. এক কথায় বলা যায়, এ দিনের একটি মুহূর্তও যেন বেকার না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। হ্যাঁ, হাজী সাহেবদের জন্য প্রয়োজনে জোহরের আগেই একটু বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে। এরপর সালাত, তিলাওয়াত, জিকর, তাসবিহ, তাহলিল, তাকবির, তাহমিদ ও ইস্তিগফার ইত্যাদিসহ দোয়া করতে থাকবেন।
সৌদি আরবের বাইরে কোন দিন আরাফাতের দিন হিসেবে গণ্য করা হবে : বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে বেশ বিতর্ক। আসলে বিতর্কের মূল বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টীয় সনের মতো একই সাথে একই সময় হিজরি সন পালন করা যায় কি না। কেউ কেউ এমন ধারণা পোষণ করে এর পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখে চলেছেন। আরবি স্যাটেলাইট ক্যালেন্ডারের কথাও শোনা যাচ্ছে। এ জন্য তারা বেশ কিছু যুক্তির অবতারণা করে থাকেন, যেগুলোর আলোচনা এ স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলা যায়, আল্লাহ পাক যে নিয়মে চন্দ্র-সূর্যের পরিক্রমা পরিচালনার ব্যবস্থা করেছেন তাতে বোধ হয় এটা কোনো দিনই সম্ভব হবে না। দেখুন, মাগরিবের সালাত বছরের এক সময় পড়তে হয় ৫টার কিছু পর; আবার সেই একই মাগরিবের সালাত আদায় করতে হচ্ছে অন্য সময় সন্ধ্যে ৭টার পর।
পার্থক্য প্রায় দুই ঘণ্টার মতো। অনুরূপ অন্যান্য সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন যদি বলা হয়, না একই নিয়মে বছরব্যাপী সালাতের সময় নির্ধারণ করতে হবে, তা হলে তা কি সম্ভব? না, অবশ্যই না। কারণ এটা সূর্যের পরিক্রমার সাথে সম্পৃক্ত। অনুরূপ ক্যালেন্ডারের তারিখও একই সময় নির্ধারণ এখনো অসম্ভব বলেই মনে হয়। কেননা আরবি তথা চন্দ্র মাসের সূচনা হয় চাঁদের উদয়ের সাথে। অর্থাৎ আরবি মাসের সূচনা হয় সন্ধ্যার আগমনের সাথে। রাত ১২টার পরে নয়। তাই কোনো দেশে এক ঘণ্টা বা কোনো দেশে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা বা ১১ ঘণ্টা পরে দিনের সূচনা হবে। অন্য দিকে, যেমন অনেকে বলে থাকেন, আজ বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগেও এমন কথা বলা বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক। কারণ, স্যাটিলাইটের বদৌলতে নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি আরাফাতের ময়দান লোকে লোকারণ্য। হাজী সাহেবান হজের মূল রুকন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান পালন করছেন। সে দেশের লোকেরা আজ সাওম পালন করছে এবং অন্যান্য ইবাদত করছে। তাহলে আমরা কেন একই তারিখে আরাফাতের দিন পালন করতে পারব না?
উত্তরে বক্তব্য হলো- তাহলে এমনটি করলে কেমন হয় যে, তারা যখন যে সময় দিনের বিভিন্ন সালাত আদায় করেন আমরাও সে সময় একই সালাত আদায় করব। কারণ চোখেই দেখতে পাচ্ছি তারা আমাদের সময় সকাল প্রায় ৮টায় ফজরের সালাত আদায় করছে। চোখে দেখেও আমরা কিভাবে এর বিরোধিতা করতে পারি? তা ছাড়া তারা আগামীকাল ঈদুল আজহা পালন করবে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও কি তা করতে পারি? আসলে কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। বিষয়টি হলো- প্রথমত. আরাফার দিন বলতে কোন দিনকে বুঝানো হয়? সর্বসম্মতভাবে সেটা ৯ জিলহজ যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ তারিখেই সৌদি আরবে আরাফার দিন পালিত হয়। তাই যে যেদিন ৯ জিলহজ হবে, সেদিনেই আরাফার রোজা রাখা হবে। এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত. মূল কথা হলো- আল্লাহর হুকুম মানা। আল্লাহ আমাদের জন্য এক বা দু’দিন পর আরাফাতের দিন বা ‘ঈদের দিন নির্ধারণ করেছেন; যেমন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময় নির্ধারণ করেছেন যা সূর্যের সাথে সম্পর্কিত।
অতএব আমরা আমাদের দেশের হিসাব অনুযায়ী যদি আল্লাহর হুকুম পালন করি, তাহলে অসুবিধা কোথায়? এতে কি সওয়াব পাওয়া যাবে না? নাকি সওয়াবে কমতি হবে? আমরা তো আল্লাহর হুকুমই পালন করছি। এখানেই আল্লাহ পাকের কুদরতের নিশানা পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপী পালিত হোক ঈদ ও আরাফাতের দিন। সব মানুষ যে যেখানে আছেন, সে দেশের হিসাব অনুযায়ী পালন করবে আল্লাহর বিধান-আহকাম।

  • ড. হাফিজ এ বি এম হিজবুল্লাহ
লেখক : প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

প্রশ্ন: ৩৪১ : আল কুরআনের মুতাশাবিহাত আয়াাত বলতে কি বুঝায় ।

সুরা আলে  ইমরান, আয়াত নং : ৭ :

﴿هُوَ الَّذِي أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ﴾
৭) তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন ৷ এ কিতাবে দুই ধরনের আয়াত আছেঃ এক হচ্ছে, মুহ্কামাত, যেগুলো কিতাবের আসল বুনিয়াদ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, মুতাশাবিহাত৷ যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে থাকে৷ অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না ৷ বিপরীত পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ ‘‘আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে’’ ৷ আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই কোন বিষয় থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে৷ 
৫. মুহকাম পাকাপোক্ত জিনিসকে বলা হয়৷ এর বহুবচন 'মুহকামাত'৷ 'মুহকামাত আয়াত' বলতে এমন সব আয়াত বুঝায় যেগুলোর ভাষা একেবারেই সুস্পষ্ট, যেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করার ব্যাপারে কোন প্রকার সংশয়-সন্দেহে অবকাশ থাকে না, যে শব্দগুলো দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং যেগুলোর অর্থ বিকৃত করার সুযোগ লাভ করা বড়ই কঠিন৷ এ আয়াতগুলো 'কিতাবের আসল বুনিয়াদ' ৷ অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে এ আয়াতগুলো সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করে৷ এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে দুনিয়াবাসীকে ইসলামের দিকে আহবান জানানো হয়েছে৷ এগুলোতেই শিক্ষা ও উপদেশের কথা বর্ণিত হয়েছে৷ ভ্রষ্টতার গলদ তুলে ধরে সত্য-সঠিক পথের চেহারা সুস্পষ্ট করা হয়েছে৷ দীনের মূলনীতি এবং আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, চরিত্রনীতি,দায়িত্ব-কর্তব্য ও আদেশ-নিষেধের বিধান এ আয়াতগুলোতেই বর্ণিত হয়েছে৷ কাজেই কোন সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি কোন্ পথে চলবে এবং
৬. 'মুতাশাবিহাত' অর্থ যেসব আয়াতের অর্থ গ্রহণে সন্দেহ-সংশয়ের ও বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে দেবার অবকাশ রয়েছে৷
বিশ্ব-জাহানের অন্তর্নিহিত সত্য ও তাৎপর্য, তার সূচনা ও পরিণতি, সেখানে মানুষের অবস্থান, মর্যাদা ও ভূমিকা এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বনিম্ন অপরিহার্য তথ্যাবলী মানুষকে সরবরাহ না করা পর্যন্ত মানুষের জীবন পথে চলার জন্য কোন পথনির্দেশ দেয়া যেতে পারে না, এটি একটি সর্বজন বিদিত সত্য৷ আবার একথাও সত্য, মানবিক ইন্দ্রিয়ানভুতির বাইরের বস্তু-বিষয়গুলো, যেগুলো মানবিক জ্ঞানের আওতায় কখনো আসেনি এবং আসতেও পারে না, যেগুলোকে সে কখনো দেখেনি, স্পর্শ করেনি এবং যেগুলোর স্বাদও গ্রহণ করেনি, সেগুলো বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষার ভাণ্ডারে কোন শব্দও রচিত হয়নি এবং প্রত্যেক শ্রোতার মনে তাদের নির্ভুল ছবি অংকিত করার মতো কোন পরিচিত বর্ণনা পদ্ধতিও পাওয়া যায় না৷ কাজেই এ ধরনের বিষয় বুঝাবার জন্য এমন সব শব্দ ও বর্ণনা পদ্ধথিত অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যেগুলো প্রকৃত সত্যের সাথে নিকটতর সাদৃশ্যের অধিকারী অনুভবযোগ্য জিনিসগুলো বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষায় পাওয়া যায়৷ এ জন্য অতি প্রাকৃতিক তথা মানবিক জ্ঞানের ঊর্ধের ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়গুলো বুঝাবার জন্য কুরআন মজীদে এ ধরনের শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে৷ যেসব আয়াতে এ ধরনের ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোকেই 'মুতাশাবিহাত' বলা হয়৷
কিন্তু এ ভাষা ব্যবহারের ফলে মানুষ বড়জোর সত্যের কাছাকাছি পৌছতে পারে অথবা সত্যের অস্পষ্ট ধারণা তার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে, এর বেশী নয়৷ এ ধরনের আয়াতের অর্থ নির্ণয়ের ও নির্দিষ্ট করনের জন্য যত বেশী চেষ্টা করা হবে তত বেশী সংশয়-সন্দেহ ও সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে৷ ফলে মানুষ প্রকৃত সত্যের নিকটতর হবার চাইতে বরং তার থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷ কাজেই যারা সত্যসন্ধানী এবং আজেবাজে অর্থহীন বিষয়ের চর্চা করার মানসিকতা যাদের নেই, তারা 'মুতাশাবিহাত' থেকে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা লাভ করেই সন্তুষ্ট থাকে৷ এতটুকুন ধারণাই তাদের কাজ চালাবার জন্য যথেষ্ট হয়৷ তারপর তারা 'মুহ্‌কামাত' এর পেছনে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে৷ কিন্তু যারা ফিত্‌নাবাজ অথবা বাজে কাজে সময় নষ্ট করতে অব্যস্ত, তাদের কাজই হয় মুতাশাবিহাতের আলোচনায় মশগুল থাকা এবং তার সাহায্যেই তারা পেছন দিয়ে সিঁদ কাটে৷
৭. এখানে এ অমূলক সন্দেহ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না যে, মুতাশাবিহাতের সঠিক অর্থ যখন তারা জানে না তখন তারা তার ওপর কেমন করে ঈমান আনে? আসলে একজন সচেতন বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তির মনে মুতাশাবিহাত আয়াতগুলোর দূরবর্তী অসংগত বিশ্লেষন ও অস্পষ্ট বিকৃত ব্যাখার মাধ্যমে কুরআন আল্লাহর কিতাব হবার বিশ্বাস জন্মে না৷ এ বিশ্বাস জন্মে মুহকামাত আয়াতগুলো অধ্যায়নের মাধ্যমে৷ মুহকামাত আয়াতগুরোর মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পর যখন তার মনে কুরআন আল্লাহর কিতবা হবার ব্যপারে পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ততা আসে তখন মুতাশাবিহাত তার মনে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব ও সংশয় সৃষ্টিতে সক্ষম হয় না৷ তাদের যতটুকু সরল অর্থ সে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় ততটুকুই গ্রহণ করে নেয় করার নামে উল্‌টা সিধা অর্থ করার পরিবর্তে সে আল্লাহর কালামের ওপর সামগ্রিকভাবে ঈমান এনে কাজের কথাগুলোর দিকে নিজে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়৷
(তাফহীমুল কুরআন) 

প্রশ্ন: ৩৪০ : রাসুল সা: এর সন্তান সন্ততি ।

হযরত রাসুল পাক (সঃ)-এর সন্তান সন্তুতি ....................
রাহ্‌মাতাল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তিন পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন । তাঁর পুত্রগণ ছিলেন-
১। হযরত কাশেম (রাঃ),
২। হযরত আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ) ওরফে তাহের (রাঃ) ওরফে তৌয়ব (রাঃ) এবং
৩। হযরত ইব্রাহীম (রাঃ) ।
আর কন্যাগণ ছিলেন-
১। হযরত জয়নাব (রাঃ),
২। হযরত রোকেয়া (রাঃ),
৩। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এবং
৪। হযরত ফাতেমা (রাঃ) ।
হযরত রাসুল (সঃ)-এর পুত্রগণ শৈশবেই ইন্তেকাল করেন । ফলে তাঁদের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি । তাছাড়া তাঁদের সংখ্যা নিয়েও মতভেদ রয়েছে । হযরত রাসুল (সঃ)-এর তিন পুত্র ছিল । তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ)-এর উপাধি ছিল 'তাহের' এবং 'তৌয়ব' । এ কারণে কেউ কেউ বলেন, হযরত রাসুল (সঃ)-এর চার পুত্র ছিল । পক্ষান্তরে হযরত রাসুল (সঃ)-এর কন্যাগণ ইসলামী যুগ দেখতে পেয়েছেন এবং মদীনায় হিজরতের অংশ নিয়েছেন । এ কারণে কন্যাদের সম্পর্কে কোন মতভেদ নেই ।
১. হযরত কাসিম (রাঃ) : হযরত রাসুল (সঃ)-এর প্রথম সন্তান ছিলেন হযরত কাসিম (রাঃ) । হযরতের বিয়ের তিন বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন । হযরত কাসিম (রাঃ) দুই বছর বয়সে পরলোক গমন করেন । তাঁর নাম অনুসারেই হযরত রাসুল (সঃ)-কে আবুল কাসিম না কাসিমের পিতা বলা হতো । হযরত রাসুল (সঃ) এই শব্দটি খুব ভালবাসতেন । এই জন্যই সাহাবীগণ অতি ভক্তি ও ভালবাসার সাথে তাঁর কথা উল্লেখ করতে আবুল কাসিম (সঃ) বলতেন ।
২. হযরত জয়নাব (রাঃ) : হযরত রাসুল (সঃ)-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা ছিলেন হযরত জয়নাব (রাঃ) । হযরতের বিয়ের পাঁচ বছর পরে, অর্থাৎ তাঁর ত্রিশ বছর হলে তাঁর খালাতো ভাই আবু আস্‌ ইবনে রবির সাথে তাঁর বিয়ে হয় । হযরত রাসুল (সঃ) নবুয়ত লাভের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁর স্বামী আবু আস ইসলাম গ্রহণ করেনি ।
হযরত জয়নাব (রাঃ) বদরের যুদ্ধের পর মদিনায় হিজরত করার পথে কাফেরগণ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন এবং দীর্ঘদিন শয্যাশায়িনী থাকার পর হিজরী ৮ম সালে ইন্তেকাল করেন । হযরত জয়নাব (রাঃ)-এর স্বামী আবু আস হিজরী ৭ম সালে ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন ।
হযরত জয়নাব (রাঃ)-এর গর্ভে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন । পুত্রটির নাম ছিল আলী ও কন্যাটির নাম ছিল উমামা । আলী তার মাতার মৃত্যুর পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হয় । হযরত রাসুল (সঃ)-এর মৃত্যুর পরে হযরত আলী (রাঃ) উমামাকে বিয়ে করেন । হিজরী ৫০ সালে হযরত উমামা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন । তাঁর কোন সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করেনি ।
৩. হযরত রোকেয়া (রাঃ): হযরত রোকেয়া (রাঃ) তাঁর বোন হযরত জয়নাব (রাঃ)-এর তিন বছরের ছোট ছিলেন । আবু লাহাবের পুত্র ওতবার সাথে তাঁর বিয়ে হয় । আবু লাহাবের আর এক পুত্রের সাথে হযরত রোকেয়া (রাঃ)-এর ছোট বোন হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)-এর বিয়ে হয় ।
যখন পবিত্র কুরানের সূরা লাহাব নাজিল হয় তখন আবু লাহাব হযরত রাসুল (সঃ)-এর প্রতি রাগান্বিত হয়ে তার উভয় পুত্রকে বলেন, তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দাও । মুহাম্মদের কন্যাদেরকে তালাক না দিলে আমি তোমাদের মুখ দর্শন করবো না । তারা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্তেও হযরত রাসুল (সঃ)-এর দু'কন্যাকে তালাক দিতে বাধ্য হয় ।
এ উভয় মেয়ের বিয়েই বাল্যকালে সম্পন্ন হয়েছিল । তখনও তাঁদের কোন সন্তানাদি জন্মে নাই । অতঃপর মক্কা বিজয়ের পর ওত্‌বা ইসলাম গ্রহণ করে । ওত্‌বা হযরত রোকেয়া (রাঃ)-কে তালাক দেয়ার পর হযরত রাসুল (সঃ) তাঁকে হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাথে বিয়ে দেন । হযরত উসমান (রাঃ) আবিসিনিয়ায় হিজরত করার সময় হযরত রোকেয়া (রাঃ)-কেও সাথে নিয়ে যান । তৎপর হযরত রাসুল (সঃ) মদীনা হিজরত করার পরে হযরত উসমান (রাঃ) তাঁর স্ত্রী হযরত রোকেয়া (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মদীনা চলে যান ।
হযরত রাসুল (সঃ) যখন বদরের যুদ্ধে যান তখন হযরত রোকেয়া (রাঃ) কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে শয্যা শায়িনী ছিলেন । সেজন্য তাঁকে দেখাশুনা করার জন্য হযরত উসমান (রাঃ) যুদ্ধে যেতে পারেন নি । হযরত রাসুল (সঃ) বদরের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পূর্বেই হযরত রোকেয়া (রাঃ) ইন্তেকাল করেন । আবিসিনিয়ায় অবস্থানকালে হযরত উসমান (রাঃ)-এর ঔরসে হযরত রোকেয়া (রাঃ)-এর একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল, তার নাম রাখা হয়েছিল আবদুল্লাহ্‌ । মাতার ইন্তেকালের কিছুদিন পরেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন ।
৪. হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ): হযরত রোকেয়া (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর হযরত রাসুল (সঃ) তাঁর তৃতীয় কন্যা হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)-কে হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাথে বিয়ে দেন । এজন্য হযরত উসমান (রাঃ)-এর একটি উপাধি হয় "জিন্নুবায়েন" অর্থাৎ দুটি নূরের অধিকারী । হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)-এর কোন সন্তানাদি জন্মেনি । হিজরী নবম সালের শাবান মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন ।
৫. হযরত ফাতিমা জোহরা (রাঃ): বিশ্ব নবী হযরত রাসুল (সঃ)-এর সর্ব কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল হযরত ফাতিমাতুজ জোহ্‌রা (রাঃ) । হযরত রাসুল (সঃ)-এর নবুয়ত লাভের পরের বছর তিনি জন্মগ্রহণ করেন । হিজরী ৬ষ্ঠ সালে আল্লাহ্‌ তায়ালার নির্দেশেই হযরত রাসুল (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর সাথে বিয়ে দেন । বিয়ের ৭মাস ১৫ দিন পর তাঁদের প্রথম বাসর রাত যাপন করা হয় । বিয়ের সময় হযরত ফাতিমার বয়স ছিল ১৫ বছর ৫ মাস এবং হযরত আলী (রাঃ) বয়স হয়েছিল ২১ বছর ৫ মাস ।
হযরত রাসুল (সঃ) তাঁর কন্যাদের মধ্যে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে সর্বাপেক্ষা অধিক স্নেহ করতেন । তিনি কোথাও যাওয়ার সময় সর্বশেষে তাঁর নিকট থেকে বিদায় নিতেন । তাঁকে না বলে তিনি কোথাও যেতেন না । আবার কোন স্থান থেকে বাড়ী ফিরে তিনি সর্বপ্রথম কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর সাথে দেখা সাক্ষাৎ না করে কিছু ও কিছু কথাবার্তা না বলে কারও সাথে দেখা বা আলাপ করতেন না ।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) তাঁর স্বামী হযরত আলী (রাঃ)-কে অত্যন্ত ভালবাসতেন, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও খেদমত করতেন । তিনি নবী কন্যা বলে কখনও স্বামীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতেন না । হযরত আলী (রাঃ)-ও তাঁর স্ত্রী হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে নিজের প্রানাপেক্ষা বেশি ভালবাসতেন । হযরত ফাতিমা (রাঃ) জীবিত থাক্লা পর্যন্ত হযরত আলী (রাঃ) অন্য কোন বিয়ে করেননি । তাঁর ইন্তেকালের পরে সংসার অচল হয়ে পড়ায় উমামা (রাঃ)-কে বিয়ে করেছিলেন ।
হযরত রাসুল (সঃ)-এর ওফাতের ছ'মাস পরে হযরত ফাতিমা (রাঃ) জান্নাতবাসিনী হন । হযরত রাসুল (সঃ) ওফাতের আগেই কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে জানিয়েছিলেন- মা! তুমি আমার ইন্তেকালে দুঃখিত হয়ো না, আমার মৃত্যুর ঠিক ছ'মাস পরেই তুমি জান্নাতে আমার সাথে মিলিত হবে ।
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর বংশ একমাত্র হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর বংশ থেকেই দুনিয়ায় জারী রয়েছে । তাঁর তিনি পুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিলেন । পুত্রদের নাম যথাক্রমে হযরত ইমাম হাসান (রাঃ), হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও হযরত ইমাম মোহসিন (রাঃ) । হযরত ইমাম মোহসিন (রাঃ) শিশুকালেই মৃত্যু মুখে পতিত হন । কন্যাদের নাম যথাক্রমে হযরত রোকেয়া (রাঃ), হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) ও হযরত জয়নাব (রাঃ) । জ্যেষ্ঠা কন্যা হযরত রোকেয়া (রাঃ) শৈশবকালেই ইন্তেকাল করেন । হযরত ইমাম হাসান (রাঃ)-এর ১৫ পুত্র ও ৮ কন্যা জন্মগ্রহণ করেন । আর হযরত হোসাইন (রাঃ)-এর ৬ পুত্র ও ৩ কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তাঁদের বংশধরগণই আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় বিদ্যমান রয়েছেন- তাঁরাই প্রকৃত সৈয়দ বংশ নামে অভিহিত ।
৬. হযরত আবদুল্লাহ্‌ (রাঃ) : হযরত আবদুল্লাহ্‌ (রাঃ)-এর উপাধি ছিল তৈয়ব ও তাহির । হযরত রাসুল (সঃ) নবুয়ত লাভের পর তাঁর জন্ম হয় এবং শৈশবেই তিনি পরলোক গমন করেন । তাঁর মৃত্যু সম্পর্কেই সূরা আল্‌ কাওছার অবতীর্ণ হয় । হযরত আবদুল্লাহ্‌ (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য কেউ থাকবে না ভেবে একদিন আস ইবন ওয়ায়িল বলল, মুহাম্মদ (সঃ) পুত্রহীন নির্বংশ । তাঁর নাম লওয়ার জন্যও কেউ থাকবে না , তিনি মরে গেলে তাঁর উৎপাত হতে তোমরা শান্তি লাভ করবে । তখনই সূরা কাওসার অবতীর্ণ করে আল্লাহ্‌ তায়ালা তার প্রতিউত্তরে বলে দিলেনঃ
নির্বোধ কফেরগন বহু পুত্রের পিতা হওয়ার গৌরবে এবং জনবহুল বংশের মত্ত হয়ে রাসুল (সঃ)-কে এসব কথা বলেছিল । যবুর ও কোরআনে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর সম্বন্ধে কি বলেছেন, তা তারা জানত না । পবিত্র যবূরে মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রশংসায় লিখিত হয়েছে, আমি তোমার নাম সমস্ত পুরুষ-পরম্পরায় স্মরণ করবো । এই জাতিরা যুগে যুগে চিরকাল তোমার প্রশংসা করবে । হযরত রাসুল (সঃ)-এর প্রশংসায় যবূরে অন্যত্র আছে, তাঁর নাম অনন্তকাল থাকবে; সূর্যের স্তিতি পর্যন্ত তাঁর নাম সতেজ থাকবে, মানুষেরা তাতে আশীর্বাদ পাবে, সমুদয় জাতি তাঁকে ধন্য ধন্য বলবে ।
পবিত্র যবূর ও কোরানের ঘোষণার ফলে আজ বিশ্ব জগতে হযরত রাসুল (সঃ)-এর নাম সুনাম ও সুখ্যাতি সকলের নিকটই প্রিয় । শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সকলেই তাঁর সুখ্যাতি ও যশকীর্তি গাইতে বাধ্য । অসংখ্য মুসলমান অন্তরে বাহিরে, সুখে-দুঃখে, আনন্দে বিপদে সর্বাবস্থায় আজানে, ইকামতে, তাশাহুদে, নামাজে, কালিমায় সর্বদা তাঁর পবিত্র নাম স্মরণ করে এবং মুগ্ধ প্রাণে তাঁর যশকীর্তি গাইতে থাকে । আর যারা নিজেদের জনবহুল বংশের অহংকারে মত্ত ছিল, আজ কোথাও তাদের নাম গন্ধ শুনতে পাওয়া যায় না ।
৭. হযরত ইব্রাহীম (রাঃ) : হযরত ইব্রাহীম (রাঃ) অষ্টম হিজরীর জিলহজ্জ মাসে হযরত মারিয়া কিবতিয়া(রাঃ)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন । মদীনা মুনাওয়ারার আলিয়া নামক স্থানে হযরত রাসুল (সঃ) হযরত মারিয়া (রাঃ)-এর সাথে বাসস্থান নির্মাণ করেছিলেন । সেখানেই তাঁর জন্ম হয় । এই জন্য আলিয়া মহল্লাটি মাশরবায়ে ইব্রাহীম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে ।
হযরত ইব্রাহীম (রাঃ) হযরত রাসুল (সঃ)-এর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র । সালমা নামক ধাত্রী সূতিকা গৃহে নবজাতক ইব্রাহীম (রাঃ)-এর পরিচর্যা করেন এবং তার স্বামী আবু রাফি হযরত রাসুল (সঃ)-এর নিকট এই সুসংবাদ পৌঁছান । এই সংবাদে সন্তুষ্ট হয়ে হযরত রাসুল (সঃ) আবু রাফিকে একটি গোলাম দান করেন ।
সপ্তম দিবসে হযরত রাসুল (সঃ) তাঁর আকীকানুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন । তাঁর মাথার চুল কেটে চুলের সমপরিমাণ রূপা দান করলেন । হযরত রাসুল (সঃ)-এর ভক্তিভাজন পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহীম (রাঃ)-এর নামানুসারে তাঁর নাম রাখলেন ইব্রাহীম । অতঃপর তাঁকে দুগ্ধ পান করানোর জন্য উম্মু বুরদা আন্‌সারিয়াকে ধাত্রী নিযুক্ত করলেন পারিশ্রমিক সরূপ তাঁকে এক কিত্তা খেজুর-বাগান দান করলেন । উম্মু বুরদার ঘরেই হযরত ইব্রাহীম (রাঃ)-এর ইন্তেকাল হয় । সংবাদ পেয়ে হযরত রাসুল (সঃ) হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে উম্মু বুরদার বাড়ীতে গেলেন । তিনি গিয়ে দেখতে পেলেন, প্রাণ-প্রতীম ইব্রাহীম (রাঃ) অন্তিম অবস্থায় আছেন, যেন পিতার নিকট হতে শেষ বিদায় গ্রহণের অপক্ষা করছেন । তিনি তাঁকে তুলে কোলে নিলেন । তাঁর পবিত্র নয়নযুগল হতে দরদর করে অশ্রুজল প্রবাহিত হতে লাগল । হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রাঃ) বললেন- হুজুর, আপনারও এ-অবস্থা? তিনি বললেন, ইয়া রহমত । তিনি আরও বললেন- "হে প্রিয় ইব্রাহীম, তোমার কারণে আমরা চিন্তিত, নয়নে অশ্রু, অন্তরে দুঃখ, কিন্তু আমরা এমন কোন কথা বলব না যা আল্লাহ্‌র নিকট অপছন্দনীয় ।"
হযরত ইব্‌ন আওফ (রাঃ) বলেন, তিনি (হযরত ইব্রাহীম) শৈশবেই পরলোক গমন করেছেন ।
->রাহ্‌মাতাল্লিল আলামীনের গৌরবময় জীবনকথা ।
(দাগন ভূইয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা)

প্রশ্ন: ৩৩৯: আত্মহত্যার শাস্তি কি চিরস্থায়ী জাহান্নাম ?

আত্মহত্যার শাস্তি
আত্মহত্যাকারী নিজেকে যে উপায়ে হত্যা করবে, তাকে সেভাবে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামে লাফ দিতে থাকবে স্থায়ীভাবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে স্থায়ীভাবে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবে, জাহান্নামে সেই ছুরি তার হাতে থাকবে। তা দিয়ে সে তার পেটে আঘাত করবে, তাতে সে স্থায়ীভাবে থাকবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৭৮)
আত্মহত্যাকারী কি স্থায়ী জাহান্নামি?
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হলো, যারা ইমান নিয়ে দুনিয়া থেকে যাবে, তারা স্থায়ী জাহান্নামি হবে না। যে হাদিসে আত্মহত্যাকারীর জন্য স্থায়ী জাহান্নামের কথা রয়েছে, তার ব্যাখ্যা হলো—তা ওই লোকের জন্য, যে তাকে হালাল মনে করেছে। তখন তো সে কাফির হয়ে যাবে। তাই আত্মহত্যাকারীকে যত দিন ইচ্ছা আল্লাহ শাস্তি দিয়ে পরে ইমানের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আত্মহত্যাকারীর জানাজা ও দাফন
যারা আত্মহত্যা করবে, তাদের জানাজা পড়া যাবে। তবে সম্ভ্রান্ত লোক ও আলিমরা তাতে শরিক না হওয়া উত্তম। প্রখ্যাত তাবেয়ি ইবরাহিম নখয়ি বলেন, ‘যারা আত্মহত্যা করবে, তাদের জন্য জানাজা পড়া যাবে। তেমনি জেনার কারণে বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে যেসব নারী মারা যাবে, তাদেরও জানাজা পড়া যাবে। একইভাবে যে ব্যক্তি মদ পানের কারণে মারা যাবে, তারও জানাজা পড়া যাবে।’ (ইব্ন আবি শায়বা, হাদিস : ১১৯৮৪)
অন্য হাদিসে এসেছে : জাবির ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.)-এর দরবারে এক লোককে হাজির করা হয়, তীরের ফলা দ্বারা যে নিজেকে হত্যা করেছে। তখন তিনি তার ওপর নামাজ পড়েননি।’ (মুসলিম, হাদিস : ৯৭৮) তাই আমির, আলিম ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ওই ব্যক্তির জানাজায় শরিক হবেন না।

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...