প্রশ্ন: ৩৪২ : আরাফাতের দিন কোনটি ? এই দিনটির তাৎপর্য ।

বছরের শ্রেষ্ঠ রাত (সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত) হলো লাইলাতুল কাদর বা কদরের রাত, যা রমজান মাসের শেষ দশ রাতের যেকোনো একটি বেজোড় রাত। অন্য দিকে, বছরের শ্রেষ্ঠ দিন (বিশেষ করে জোহরের সময় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) হলো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ যা ইয়াওমু আরাফাত বা আরাফাতের দিন হিসেবে পরিচিত। তাই বছরের সর্বোত্তম দিন হিসেবে এ দিন স্বীকৃত। এ দিনের রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত; যেমন- এক. ক. এ দিন হলো আরাফাতের দিন যে দিনের কসম খেয়েছেন মহান আল্লাহ তার কালামে। (অনুবাদার্থে) ‘এবং কসম জোড় ও বেজোড়ের’ (সূরা ফাজর-৩)।

এ বেজোড় হলো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ যা ইয়াওমু ‘আরাফাত নামে প্রসিদ্ধ। খ. কুরআনে এ দিনকে ‘মাশহুদ’ (দৃষ্ট) বলা হয়েছে এবং এর কসম খাওয়া হয়েছে (সূরা বুরুজ-৩)। দুই. হাদিসে ‘মাশহুদ’কে আরাফাতের দিন বলা হয়েছে (তিরমিজি)। হাদিসের আলোকে ইয়াওমু আরাফাত তথা আরাফাতের দিনকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন বলা হয়েছে (সহিহ ইবন হিব্বান)। তিন. এ দিনকে ইয়াওমুল ‘ইতকি মিনান নার বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিনও বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত যে, আরাফাতের দিনের চেয়ে আর কোনো দিন এমন নেই যেদিন আল্লাহ বান্দাদেরকে জাহান্নাম থেকে সর্বাধিক সংখ্যায় মুক্তি দেন; তিনি সেদিন নিকটবর্তী হন অতঃপর তিনি তাঁর ফেরেশতাদের সাথে গর্ব প্রকাশ করেন এবং বলেন, তারা কী চায়? (সহিহ মুসলিম)।
এদিন করণীয় আমল 
এক. এদিনে সাওম পালন করা। হাদিস শরিফে এ প্রসঙ্গে নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘ইয়াওমু আরাফাত তথা আরাফাতের দিনের সিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর জন্য আগের ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (সহিহ মুসলিম)। সাওম পালন করার বিষয়টি যারা হজ করবে না, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যারা হজ পালন করবেন তাদের সিয়াম পালনের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া এবং এ জন্য সঠিকভাবে ইবাদতে মশগুল হতে না পারার আশঙ্কায় কোনো কোনো আলেম তাদের ক্ষেত্রে সাওম পালন করা মাকরুহ বলেছেন। তবে সিদ্ধান্তমূলক কথা হলো- যারা সাওম পালন করেও এ দিনের ইবাদত-বন্দেগিতে দুর্বলতা অনুভব করবেন না, তারাও সাওম পালন করতে পারবেন। আর যারা দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা করবেন, তারা সাওম পালন না করে বিভিন্ন ইবাদতে মশগুল হবেন। আরাফাতের দিনে মূল বিষয় হচ্ছে- ইবাদতে মশগুল থাকা ও যত বেশি সম্ভব দোয়া করা।
দুই. এ দিন ফজরের সালাতের পর থেকে ১৩ তারিখ আসরের সালাত পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর তাকবির পড়া শুরু করবেন। তাকবিরের জন্য বিভিন্ন শব্দাবলি রয়েছে; তবে বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলি হলো- অবশ্যই আরবিতে বিশুদ্ধ উচ্চারণ করতে হবে (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদু)। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, (অনুবাদার্থে) ‘তোমরা নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে’ (সূরা বাকারাহ-২০৩)। কতবার তাকবির পড়তে হবে এর জন্য নির্ধারিত কোনো সংখ্যা বর্ণিত নেই। তাই তাকবির একবার পড়াই যথেষ্ট। অনুচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করবেন, যেন পরে আসা মুসল্লিদের সালাতে ব্যাঘাত না ঘটে। সুর দিয়ে একই সাথে সবাই মিলে তাকবির পড়া অনেকের দৃষ্টিতে বিদয়াত। কারণ এতে যেমন পরে আসা মাসবুক মুসল্লিদের সূরা কিরাত ও তাসবিহ আদায়ে কষ্ট হয়, তেমনি তা কুরআনে বর্ণিত জিকরের আদব পরিপন্থী। কুরআনে আল্লাহ পাক জিকরের আদব প্রসঙ্গে বলেন, (অনুবাদার্থে) ‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশঙ্কচিত্তে অনুচ্চস্বরে স্মরণ করো’ (সূরা আরাফ-২০৫)। একাকী যারা সালাত আদায় করবেন তারা এবং মহিলারাও তাকবির পাঠ করবেন।
তিন. দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এ দিন যাবতীয় পাপাচার থেকে হিফাজত করবেন। ইমাম আহমাদ একটি হাদিস বর্ণনা করেন যে, ‘আরাফাতের দিন; যে ব্যক্তি এদিন নিজের কান (শ্রবণশক্তি) চোখ (দৃষ্টিশক্তি) এবং জিহ্বাকে হিফাজত করবেন, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (মুসনাদে আহমাদ)।

চার. একাগ্রতা, ইখলাস, নিষ্ঠা, সততা ও ঈমানের সাথে যত বেশি সম্ভব নবী সা: থেকে প্রাপ্ত দোয়া করবেন। যেমন- একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, আরাফাতের দিন নবী সা: যে দোয়াটি বেশি পাঠ করতেন তা হলো- ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু বিয়াদিহিল খাইরু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ (মুসনাদে আহমাদ)। তিরমিজির বর্ণনায় রয়েছে, নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘সর্বত্তোম দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীরা যে দোয়া করেছি তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো- লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয় হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ (সুনানে তিরমিজি)। উচ্চারণিক ভুল থেকে বাঁচার জন্য দোয়াগুলো অবশ্যই আরবিতে বিশুদ্ধ উচ্চারণে শিখতে হবে।
পাঁচ. এক কথায় বলা যায়, এ দিনের একটি মুহূর্তও যেন বেকার না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। হ্যাঁ, হাজী সাহেবদের জন্য প্রয়োজনে জোহরের আগেই একটু বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে। এরপর সালাত, তিলাওয়াত, জিকর, তাসবিহ, তাহলিল, তাকবির, তাহমিদ ও ইস্তিগফার ইত্যাদিসহ দোয়া করতে থাকবেন।
সৌদি আরবের বাইরে কোন দিন আরাফাতের দিন হিসেবে গণ্য করা হবে : বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে বেশ বিতর্ক। আসলে বিতর্কের মূল বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টীয় সনের মতো একই সাথে একই সময় হিজরি সন পালন করা যায় কি না। কেউ কেউ এমন ধারণা পোষণ করে এর পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখে চলেছেন। আরবি স্যাটেলাইট ক্যালেন্ডারের কথাও শোনা যাচ্ছে। এ জন্য তারা বেশ কিছু যুক্তির অবতারণা করে থাকেন, যেগুলোর আলোচনা এ স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলা যায়, আল্লাহ পাক যে নিয়মে চন্দ্র-সূর্যের পরিক্রমা পরিচালনার ব্যবস্থা করেছেন তাতে বোধ হয় এটা কোনো দিনই সম্ভব হবে না। দেখুন, মাগরিবের সালাত বছরের এক সময় পড়তে হয় ৫টার কিছু পর; আবার সেই একই মাগরিবের সালাত আদায় করতে হচ্ছে অন্য সময় সন্ধ্যে ৭টার পর।
পার্থক্য প্রায় দুই ঘণ্টার মতো। অনুরূপ অন্যান্য সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন যদি বলা হয়, না একই নিয়মে বছরব্যাপী সালাতের সময় নির্ধারণ করতে হবে, তা হলে তা কি সম্ভব? না, অবশ্যই না। কারণ এটা সূর্যের পরিক্রমার সাথে সম্পৃক্ত। অনুরূপ ক্যালেন্ডারের তারিখও একই সময় নির্ধারণ এখনো অসম্ভব বলেই মনে হয়। কেননা আরবি তথা চন্দ্র মাসের সূচনা হয় চাঁদের উদয়ের সাথে। অর্থাৎ আরবি মাসের সূচনা হয় সন্ধ্যার আগমনের সাথে। রাত ১২টার পরে নয়। তাই কোনো দেশে এক ঘণ্টা বা কোনো দেশে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা বা ১১ ঘণ্টা পরে দিনের সূচনা হবে। অন্য দিকে, যেমন অনেকে বলে থাকেন, আজ বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগেও এমন কথা বলা বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক। কারণ, স্যাটিলাইটের বদৌলতে নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি আরাফাতের ময়দান লোকে লোকারণ্য। হাজী সাহেবান হজের মূল রুকন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান পালন করছেন। সে দেশের লোকেরা আজ সাওম পালন করছে এবং অন্যান্য ইবাদত করছে। তাহলে আমরা কেন একই তারিখে আরাফাতের দিন পালন করতে পারব না?
উত্তরে বক্তব্য হলো- তাহলে এমনটি করলে কেমন হয় যে, তারা যখন যে সময় দিনের বিভিন্ন সালাত আদায় করেন আমরাও সে সময় একই সালাত আদায় করব। কারণ চোখেই দেখতে পাচ্ছি তারা আমাদের সময় সকাল প্রায় ৮টায় ফজরের সালাত আদায় করছে। চোখে দেখেও আমরা কিভাবে এর বিরোধিতা করতে পারি? তা ছাড়া তারা আগামীকাল ঈদুল আজহা পালন করবে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও কি তা করতে পারি? আসলে কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। বিষয়টি হলো- প্রথমত. আরাফার দিন বলতে কোন দিনকে বুঝানো হয়? সর্বসম্মতভাবে সেটা ৯ জিলহজ যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ তারিখেই সৌদি আরবে আরাফার দিন পালিত হয়। তাই যে যেদিন ৯ জিলহজ হবে, সেদিনেই আরাফার রোজা রাখা হবে। এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত. মূল কথা হলো- আল্লাহর হুকুম মানা। আল্লাহ আমাদের জন্য এক বা দু’দিন পর আরাফাতের দিন বা ‘ঈদের দিন নির্ধারণ করেছেন; যেমন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময় নির্ধারণ করেছেন যা সূর্যের সাথে সম্পর্কিত।
অতএব আমরা আমাদের দেশের হিসাব অনুযায়ী যদি আল্লাহর হুকুম পালন করি, তাহলে অসুবিধা কোথায়? এতে কি সওয়াব পাওয়া যাবে না? নাকি সওয়াবে কমতি হবে? আমরা তো আল্লাহর হুকুমই পালন করছি। এখানেই আল্লাহ পাকের কুদরতের নিশানা পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপী পালিত হোক ঈদ ও আরাফাতের দিন। সব মানুষ যে যেখানে আছেন, সে দেশের হিসাব অনুযায়ী পালন করবে আল্লাহর বিধান-আহকাম।

  • ড. হাফিজ এ বি এম হিজবুল্লাহ
লেখক : প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

1 comment:

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...