প্রশ্ন ৩৮: সর্বপ্রথম আল্লাহ কী সৃষ্টি করেছেন ?

মহান আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি কি?

মহান আল্লাহ্‌র প্রথম সৃষ্টি কলম। মহানবী (সঃ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ প্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেন, তা হল কলম। তিনি তাঁকে বললেন, ‘লিখো’। সে বলল, ‘প্রভু! কি লিখব?’ তিনি বললেন, ‘কিয়ামত পর্যন্ত প্র্যত্যেক জিনিসের ভাগ্য লিখো।’
৩৮ (আবূ দাউদ ৪৭০২, তিরমিযী ২১৫৫ নং) (ক্লিক করুন) 


ভূমিকাঃ 
المقدمة
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার এবং তাঁর সকল সাহাবীর উপর। ইসলাম যে কোন আমলের পূর্বে সঠিক আকীদাহ গ্রহণ করার উপর বিশেষ গুরত্ব প্রদান করেছে। তাই আকীদার বিষয়টি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আকীদাহ সঠিক না হলে কারও কোন আমল আল্লাহর দরবারে গৃহিত হবে না। এই জন্যই ইসলাম আকীদাহ সংশোধনের উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে অনেক মুসলিমদের আকীদায় যথেষ্ট ভুল রয়েছে। মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ বিশ্বাস করে যে, তিনি আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি, তিনি নূরের তৈরী, তিনি গায়েব জানতেন ইত্যাদি কুরআন ও সহীহ হাদীছ বিরোধী আরও অনেক আকীদাহ্ ও বিশ্বাস। আমরা এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে একটি ভুল আকীদাহ সংশোধনের চেষ্টা করব।

নবী (সাঃ) প্রথম সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীছটির প্রকৃত অবস্থাঃ
 حالة الحديث المشهور بأن النبي صلى الله عليه وسلم أول المخلوقات

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মাঝে এই কথাটি প্রচলিত আছে যে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ (সাঃ)এর নূর সৃষ্টি করেছেনে। এ ধরণের বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ার কারণ হল আমাদের দেশের বেশ কিছু বক্তা ও আলেম এ ব্যাপারে একটি মাওযু তথা বানোয়াট হাদীছ দিয়ে দলীল গ্রহণ করে থাকেন এবং সুমধুর কণ্ঠে ওয়াজ করে মানুষকে বুঝিয়ে থাকেন। অনেক বক্তার ওয়াজের একমাত্র পূঁজিই হচ্ছে এ জাতীয় কয়েকটি বানোয়াট বিষয়। যদিও কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান তাদের কাছে খুবই নগণ্য। হাদীছটি মানুষের মুখে মুখে শুনা যায়, কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোন হাদীছের কিতাবে তা পাওয়া যায় না। হাদীছটি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

أول ما خلق الله تعالى نوري

অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। অন্য শব্দে এসেছে,

أول ما خلق الله نور نبيك يا جابر

হে জাবের! সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। একই অর্থে এবং বিভিন্ন শব্দে সুফীদের কিতাবসমূহে সনদ বিহীন এই বানোয়াট হাদীছটি উল্লেখিত হয়েছে। মুসান্নাফে আব্দু রাজ্জাকে হাদীছটি থাকলেও লেখক কোন নির্ভরযোগ্য সনদ উল্লেখ করেন নি। এই মর্মে যত হাদীছ বর্ণিত হাদীছ তার সবই বাতিল।

মুহাদ্দিছগণ এই হাদীছকে মাওযু বলেছেন। ইমাম সুয়ুতী (রঃ) বলেনঃ এই হাদীছের কোন নির্ভরযোগ্য সনদ নেই। সুতরাং হাদীছটি মুনকার ও বানোয়াট। হাদীছের কোন কিতাবে এর ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। (দেখুনঃ হাভী ১/৩২৫) ইমাম সাগানীও হাদীছটিকে মাওযু বলেছেন। (দেখুনঃ الموضوعات للصغاني )

ইমাম আলবানী (রঃ) বলেনঃ এটি মানুষের মুখে মুখে প্রসিদ্ধ একটি বাতিল হাদীছ। (দেখুনঃ সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ৪৫৮)। সুফীদের অন্যতম গুরু ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ইবনে আরাবী এই আকীদাই পোষেণ করতেন। আশ্চর্যের বিষয় হল আমাদের দেশের বহু সুন্নী মুসলমানের আকীদাও তাই।

সর্বপ্রথম সৃষ্টি কোনটি? ما هو أول المخلوقات

সহীহ হাদীছের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম সৃষ্টি ছিলেন না এবং তিনি নূরের তৈরীও ছিলেন না। সর্বপ্রথম সৃষ্টির ব্যাপারে আলেমগণ থেকে একাধিক কথা বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ কলমই প্রথম সৃষ্টি। প্রখ্যাত আলেম ইবনে জারীর, ইবনুল আরাবী এমতেরই সমর্থক ছিলেন। পরবর্তীদের মধ্যে ইমাম আলবানী (রঃ) এমতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা নিম্নের সহীহ হাদীছগুলো দিয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

إن أول شيء خلقه الله تعالى القلم ، وأمره أن يكتب كل شيء يكون

রাসূল (সাঃ) বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিষটি সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। তারপর কলমকে কিয়ামত পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে বললেন। {(আবু ইয়ালা (১/১২৬) আল-আসমা ওয়াস সিফাত লিল-বায়হাকী ২৭১), সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ১৩৩)} তিনি আরও বলেনঃ

إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ

“আল্লাহ্ তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেনঃ লিখ। কলম বললঃ হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ্ বললেনঃ কিয়ামত পর্যন্ত আগমণকারী প্রতিটি বস্তুর তাকদীর লিখ”। (দেখুনঃ আবু দাউদ, তিরমিজী, বায়হাকী এবং অন্যান্য)

মালেকী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবী বলেনঃ

قبل القلم لم يكن شيء إلا هو سبحانه

কলমের পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। (দেখুন আরেযাতুল আহওয়াযী)

অপর পক্ষে আরেক দল আলেমের মতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে আরশ। আল্লামা ইবনে তাইমীয়া এবং অন্যান্য আলেম থেকে এধরণের মত পাওয়া যায়। তাদের দলীল হচ্ছে, ইমরান বিন হুসাইন থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ غَيْرُهُ ، وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ ، وَكَتَبَ فِى الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ ، وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ

আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিষ লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তিনি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করলেন। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩১৯১)

উপরের হাদীছ থেকেই দলীল গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ পানি সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করেছেন।


প্রথম পর্যায়ের কতিপয় মাখলুক বা সৃষ্টিঃ بعض الأمثلة من أوائل المخلوقات

এ কথা সত্য যে, আরশ, কুরসী, লাওহে মাহফুয, পানি, আসমান, ফেরেশতা, জিন ইত্যাদি প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টির অন্তর্ভূক্ত। মানুষ কোন ক্রমেই উপরোক্ত সৃষ্টিসমূহের পূর্বে সৃষ্টি হয় নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নন। কলমও প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টি। তবে আমরা যে কলম দিয়ে লেখি সেই কলম সর্বপ্রথম সৃষ্টি নয়; বরং যে কলম দিয়ে লাওহে মাহফুয লেখা হয়েছে সেটিই সর্বপ্রথম সৃষ্টি।

সুতরাং সর্বপ্রথম সৃষ্টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল না থাকায় তা মুসলিমের আকীদাহ হতে পারে না। তাই উপরোক্ত হাদীছগুলো এবং অন্যান্য সহীহ হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরী।

ইমাম মালেক (রঃ) বলেনঃ

ما منا من أحد إلا يؤخذ من قوله أو يرد عليه إلا صاحب هذا القبر ويشير إلى قبر النبي صلى الله عليه وسلم

আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সকল কথাই গ্রহণ করা হেব অর্থাৎ আমাদের কারও কথা গ্রহণ করা যেতে পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করা যেতে পারে। তবে এই কবরের অধিবাসী ব্যতীত। এই কথা বলে তিনি নবী (সাঃ)এর কবরের দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন।

উপসংহারঃ الختام

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে সহীহ হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হল যে, নবী (সাঃ) সর্বপ্রথম সৃষ্টি নন। সুতরাং সহীহ হাদীছ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর কোন মুসলিমের আকীদাহ এটি হতে পারে না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সকল সঠিক আকীদাহ গ্রহণ করার তাওফীক দিন। আমীন। 


প্রশ্ন ৩৭ঃঃ চাউল বা টাকা দিয়ে কি ফিতরা আদায় করা যাবে?

বাচ্চু মিয়া ----01.06.2019 তারিখে প্রশ্ন করেছেন

শিরোনাম: ফিতরা ---প্রশ্ন-বিস্তারিত:

চাউল দিয়ে কি ফিতরা আদায় করা যাবে?

উত্তর দিয়েছেন আসলাম সাঈদী ভাইঃ

Aslam Sayedee

#চাউল দিয়ে ফিতরা আদায় করা বেদ‌আতঃ
সদাকায়ে ফিতর সম্পর্কিত হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়: যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও গম।
,
চাউল দিয়ে ফিতরা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি। রাসুল (সা) চাল দিয়ে ফিতরা দেননি এবং দিতেও বলেননি, তাই হাদিসের বাহিরে গিয়ে চাউল দিয়ে ফিতরা দেওয়া বৈধ হবে না বরং এটি বেদ‌আত।
#যদি চাল দিয়ে ফিতরা আদায় করা বৈধ ফতোয়া দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে তা জনগণের উপকারের কথা ভেবে দিতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে চাল হচ্ছে প্রদান খাদ্যদ্রব্য ফসল। আর হাদীসে বর্ণিত খাদ্যগুলো আমাদের দেশের জন্য খুব একটা উপকারী নয়, তাই চাল দিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
এখন উপকারের কথা ভেবে যদি চাল দিয়ে ফিতরা আদায় করা জায়েজ হয়ে থাকে তাহলে একই উপকারের কথা ভেবে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা কেনো জায়েজ হবে না? বরঞ্চ মানুষের জন্য চাউলের চাইতে টাকার প্রয়োজন আরও বেশি।
,
যদি বলা হয় হাদিসে টাকার কথা বলা হয়নি এই জন্য টাকা দেওয়া যাবে না তাহলে একই কথা তো জুমার খুতবার বলায়‌ও বলা যেতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ আরবীতে খুতবা দিয়েছেন , বাংলায় খুতবা দেন নি, তাই বাংলায় খুতবা দেওয়া জায়েজ হবে না। তখন আবার উদ্দেশ্যের দিকে খেয়াল করে জুমার খুতবা কেউ বাংলা বাংলায় বলা জায়েজ মনে করেন আবার কেউ ওয়াজিব‌ও বলে থাকেন।

#আমি বলি, যে উদ্দেশ্যে আরবি ভাষার পরিবর্তে বাংলায় খুতবা দেওয়া জায়েজ, এক‌ই উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে টাকা দেওয়াও জায়েজ।
এটা দিলাম যুক্তি। যদি আপনি দলিলের দিকে যান এর স্বপক্ষে দলিলও দেখতে পাবেন। সাহাবীদের যুগ থেকে দিনার‍-দিরহাম দিয়ে ফিতরা দেওয়ার প্রচলন চলে আসছে। হযরত মুয়াবিয়া তাঁর শাসনামলে দিরহাম দিয়ে ফিতরা দিয়েছিলেন , হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনার ও দিরহাম দিয়ে ফিতরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

#অতএব যে উদ্দেশ্যে চাল দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েজ, বাংলা ভাষায় খুতবা দেওয়া জায়েজ, এক‌ই উদ্দেশ্যে টাকা দিয়েও ফিতরা দেওয়া জায়েজ । আর যদি বলা হয় যে, হাদিসে খাদ্যদ্রব্যের কথা আছে তাই টাকা দেওয়া যাবে না তাহলে হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি খাদ্য দ্রব্য দিয়েই ফিতরা দিতে হবে, এর বাহিরে যাওয়া যাবে না এবং বাংলায় খুতবা দেওয়াও যাবে না। এখন আপনারা কোন দিকে যাবেন, সেটা দেখার বিষয়।
فهل إلى خروج من سبيل

প্রশ্ন ৩৪ : কোরআন তো ইতিহাসের কিতাব নয় তাহলে এতো ইতিহাস কেন বর্ননা করা হয়েছে???

কারণ হচ্ছে, কুরআন হচ্ছে হিদায়াতের কিতাব আর,  কুরআনের পূর্বেও আল্লাাহ আরো কিতাব অন্যান্য জাতির মধ্যে নাযিল করেছেন, অন্যান্য নবী প্রেরণ করেছেন, কিন্তু সেই নবীদের  আহ্বান না শুনার  কারণে সেইসব জাতিকে কত নির্মম ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে সেই ইতিহাস গুলো তুলে ধরা হয়েছে, আপনিও যদি আল্লাহর এই হিদায়াতকে গ্রহণ না করেন তবে আপনাকেও সেরকম ভাবেই ধ্বংস করা হবে, এই সাবধান বানী বুঝানোর জন্যই পূর্ববর্তী ইতিহাস গুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও যারা কুরআন অনুযায়ী চলতে চায় তাদেরকে কিভাবে হিদায়াত গ্রহণ করতে হবে, পূর্ববর্তী নবীদের  এবং তাদের খাটি অনুসারীদের ইতিহাস দিয়ে শিখানো হয়েছে যে, যারা হিদায়াত গ্রহণ করে তারা কেমন হয়।

সুতরাং, শিক্ষা এবং হিদায়াতের জন্যই ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে, যা অত্যন্ত জরুরী।

প্রশ্ন: ৩৩ : কুরআনে কেন আল্লাহ তায়ালা 'আমরা' বাক্যটি ব্যবহার করেছেন, যদিও আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়??

 =======================

এ ব্যাপারে ডা: জাকির নায়েকের লেকচারটি দেখুন :  ক্লিক করুন

========================
উত্তরঃ মনগড়াভাবে কুরআনের কোন শব্দ বা আয়াতের অর্থ করা যাবে না । ইমাম রাযীন বলেছেন, যে ব্যক্তি তার নিজ মতামত দ্বারা কুরআনের ব্যাপারে কিছু বলে ভুল করল, সে কুফরী করল ।

একদা আবুবকর (রাঃ)-কে একটি অক্ষরের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'যদি কিতাবুল্লাহর একটি অক্ষরের ব্যাপারে এরূপ কথা বলি যেরূপ আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না, তাহলে কোন্ আসমান আমাকে ছায়া দিবে, কোন যমীন আমাকে বিশ্রামের স্থান দিবে? আমি কোথায় যাবো আর কী করবো ? (বিস্তারিত,তাফসীর কুরতুবী মুকাদ্দামা) ।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ স্বীয় সম্মান-মর্যাদা বুঝানোর জন্য এরূপ বহুবচন শব্দ (নাহনু-আমরা) ব্যবহার করেছেন । সেকারণে 'নবীদের কাহিনী' বইয়ে সংশ্লিষ্ট আয়াতে যেখানে বহুবচনের শব্দ এসেছে সেখানে বহু বচনেরই অর্থ করা হয়েছে । মূলতঃ আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব বুঝানের জন্যই বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে । যেটা ভাষার অলংকারের মধ্যেও পড়ে । [from Monthly At-Tahreek, june-2010]


===========================================
 এ ব্যাপারে ডা: জাকির নায়েকের লেকচার:


QUES: Does Islam believe in several gods because the Qur'an uses the word 'We' when God speaks in the Qur'an?

Answer:
Islam is a strictly monotheistic religion. It believes in and adheres to uncompromising monotheism. It believes that God is one, and unique in His attributes. In the Qur'an, God often refers to Himself using the word 'We'. But this does not mean that Islam believes in the existence of more than one God.

Two types of plural

In several languages, there are two types of plurals, one is a plural of numbers to refer to something that occurs in a quantity of more than one. The other plural is a plural of respect.

a. In the English language,the Queen of England refers to herself as 'We' instead of 'I'. This is known as the 'royal plural'.

b. Rajiv Gandhi, the ex-Prime Minister of India used to say in Hindi "Hum dekhna chahte hain". "We want to see." 'Hum' means 'We' which is again a royal plural in Hindi.

c. Similarly in Arabic, when Allah refers to Himself in the Qur'an, He often uses Arabic word 'Nahnu' meaning 'We'. It does not indicate plural of number but plural of respect.

Tawheed or monotheism is one of the pillars of Islam. The existence and uniqueness of one and only one God is mentioned several times in the Qur'an.For instance in Surah Ikhlas, it says :

"Say He is Allah the One and Only."
[Al-Qur'an 112: 1] —
===========================

এ ব্যাপারে ইউটিউবে আরো অনেক ভিডিও আছে দেখুন  :  ক্লিক করুন

প্রশ্ন ৩২ : আমরা ধর্মীয় যে কোন বইতেই শুরুতে লেখক বা সম্পাদক বা প্রকাশক কর্তৃক হামদ সানা দেখতে পাই। অথচ তাফহীমুল কুরআনের কোনো খন্ডেই এটা পাই না।

উত্তর :
সংঘাতিক একখানা ভুল খুজে পেয়েছেন ভাই। আপনাকে ধন্যবাদ।

ধর্মীয় যে কোন বই আর কুরআনের তাফসীর এক নয়।  কুরআন স্বয়ং যেখানে উপস্থিত , যেখানে তাফসীর লেখা হচ্ছে কুরআন লেখার পরে সেখানে আবার হামদ ও সানার অভাব বোধ করছেন।

কুরআনের শুরু করা হয়েছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দিয়ে। এটা কি যথেষ্ট নয় ?

যাদের কাজই হচ্ছে ভুল খোজা তারা যে কোন কিছু দাড় করিয়েই ভুল খুজতে পারে। 

আপনি কয়টি তাফসীর বা কুরআনের অনুবাদ দেখেছেন তা আমার জানা নেই। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ: এর বয়ানুল কুরআনের অনুসরণে মীনা বুক হাউস, আদর্শ পুস্তক বিপনী বিতান, ১৩, বায়তুল  মোকাররম, ঢাকা ১০০০,   থেকে নূরানী বাংলা কোরআন শরীফ  - প্রকাশিত হয়েছে - এতে উচ্চারণ, অনুবাদ ও প্রয়োাজনীয় টিকা রয়েছে। কিন্তু দু:খের বিষয় এই কিতাবটিতেও প্রকাশক বা সম্পাদক  কেউই শুরুতে হামদ বা সানা সংযোজন করেননি।

আপনার দৃষ্টিতে তাদের  এ কিতাবটিও ভুল (!!!!)।  

প্রশ্ন ৩১: এশার সালাতের আগে সুন্নত কত রাকাত জানতে চাই

প্রশ্ন : এশার নামাজের আগে চার রাকাত সুন্নত কোনো নামাজ আছে কি?

উত্তর : না। এশার আগে চার রাকাত সুন্নত নামাজ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। এশার আগে শুধু দুই রাকাত তাহিয়াতুল মসজিদ পড়বেন। যিনি এশার নামাজের জন্য মসজিদে যাবেন, তিনি শুধু দুই রাকাত তাহিয়াতুল নামাজ পড়বেন। চার রাকাত সুন্নত সহিহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি।
যাঁরা বাসায় পড়বেন, তাঁরা শুধু এশার নামাজ আদায় করবেন এবং মসজিদে তাহিয়াতুল মসজিদ পড়বেন।

সূত্র 

প্রশ্ন ৩০ : তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সা্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সব নফল নামাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ তথা রাতের নামাজ।’ (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
আল্লাহ তাআলা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামকে বিশেষভাবে রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে চাদর আবৃত, রাতের সালাতে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া।’ (সুরা মুজাম্মিল : আয়াত ১-২)


প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ইসলামের প্রাথমিক যুগে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে এ নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেন। প্রিয়নবির প্রতি কিছু সময় নামাজ পড়ার নির্দেশ ছিল না বরং রাতের কিছু অংশ ছাড়া সারারাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ের নির্দেশ ছিল।
যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ হলেন তারা, যারা যত্নের সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। কুরআনের বিভিন্ন সুরায় এ নামাজের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িসহ সব যুগের ওলি ও বিদ্বানরা তাহাজ্জুদ নামাজে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন।

তাহাজ্জুদ নামাজের সময়, রাকাআত

- ইশার নামাজ আদায়ের পর থেকে সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত সালাতুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়। তবে অর্ধ রাতের পর থেকে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া ভালো। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা সর্বোত্তম।

আরও পড়ুন > তাহাজ্জুদ নামাজে যে দোয়া পড়তেন বিশ্বনবি

- তাহাজ্জুদ নামাজ ২ থেকে ১২ রাকাআত পর্যন্ত পড়া বর্ণনা পাওযা যায়। সর্ব নিম্ন ২ রাকাআত আর সর্বোচ্চ ১২ রাকাআত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদ পড়তেন। তাই ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদ পড়াই ভালো। তবে এটা পড়া আবশ্যক নয়।
সম্ভব হলে ১২ রাকাআত তাহাজ্জুদ আদায় করা। তবে ৮ রাকাআত আদায় করা উত্তম। সম্ভব না হলে ৪ রাকাআত আদায় করা। যদি তাও সম্ভব না হয় তবে ২ রাকাআত হলেও তাহাজ্জুদ আদায় করা ভালো। তবে তাহাজ্জুদ নামাজের কোনো কাজা নেই।

তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত

نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ رَكَعَتِى التَّهَجُّدِ - اَللهُ اَكْبَر
অর্থ : দুই রাকাআত তাহাজ্জুদের নিয়ত করছি.. অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বেঁধে নামাজ পড়া।

তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম

- প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই দুই রাকাআত করে এ নামাজ আদায় করতেন। যে কোনো সুরা দিয়েই এ নামাজ পড়া যায়। তবে তিনি লম্বা কেরাতে নামাজ আদায় করতেন। তাই লম্বা কেরাতে তাহাজ্জুদ আদায় করা উত্তম।
- তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বাঁধা।
- অতঃপর ছানা পড়া।
- সুরা ফাতেহা পড়া।
- সুরা মিলানো তথা কেরাত পড়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক লম্বা কেরাত পড়তেন। অতঃপর অন্যান্য নামাজের ন্যায় রুকু, সেজদা আদায় করা। এভাবেই দ্বিতীয় রাকাআত আদায় করে তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা।
এভাবে দুই দুই রাকাআত করে ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা উত্তম।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন

সূত্র

প্রশ্ন ২৯ : দোয়া দ্বারা কি ভাগ্যের পরিবর্তন হয় ?

উত্তর : ১ 

প্রশ্ন : দোয়া ছাড়া ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। ধরুন, কোনো ব্যক্তির ভাগ্যে জাহান্নাম লেখা আছে। কিন্তু সে ব্যক্তি সারা জীবন দোয়া করে যাচ্ছে যে আল্লাহ আমাকে জান্নাত দিন। সে ইবাদতও করছে। সে ক্ষেত্রে এটা পরিবর্তন হয়ে আবার জান্নাতে আসবে কি? এ সম্পর্কে একটু বলবেন।
উত্তর : এ ক্ষেত্রে দোয়ার কার্যকারিতা রয়েছে। হজরত সওবান (রা.) বর্ণিত হাদিসের মধ্যে স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে, দোয়ার মাধ্যমে মানুষের যে তাকদির রয়েছে, সে তাকদিরের পরিবর্তন হয়ে থাকে।

সূত্র


======================================

উত্তর : ২ 


প্রশ্ন:- দুয়ার দ্বারা কি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়?

উত্তর :-
(৬২) সৃষ্টির পূর্বে মানুষের ভাগ্যে যা লেখা হয়েছে, তা কি দুয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন করা সম্ভব?
উত্তরঃ সন্দেহ নাই যে, ভাগ্যের লিখন পরিবর্তনে দুয়ার প্রভাব রয়েছে। তবে জেনে রাখা দরকার, এই পরিবর্তনটাও পূর্বে থেকে লেখা আছে যে, দুয়ার মাধ্যমে অমুকের ভাগ্যের পরিবর্তন করা হবে। এই ধারণা যেন না হয় যে, আপনি ভাগ্যের কোন অলিখিত বস্ত পরিবর্তনের জন্যে দুয়া করছেন। সুতরাং দুয়া করবেন, এটাও পূর্ব থেকে লেখা আছে। আর দুয়ার মাধ্যমে যা অর্জিত হবে, তাও লিখিত আছে। এই জন্যই আমরা দেখতে পাই যে, রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করা হলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠে। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কোন একদিকে একদল সৈনিক প্রেরণ করলেন। সেখানে তাঁরা একটি কাফের গোত্রের নিকটে মেহমান হিসাবে উপস্থিত হলে গোত্রের লোকেরা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। রাতের বেলা সেই গোত্রের নেতাকে বিষাক্ত সাপে দংশন করল। তাকে ঝাড়-ফুঁক করার জন্য কবিরাজ অনুসন্ধান করা হল। কিন্তু কোন কবিরাজ পাওয়া গেলনা। অবশেষে লোকেরা সাহাবীদের নিকট এসে কবিরাজ অন্বেষণ করল। একজন সাহাবী বললেন, আমি ঝাড়-ফুঁক করতে রাজি আছি, তবে আমাকে এরজন্যে বিনিময় দিতে হবে। তারা ঝাড়-ফুঁকের বিনিময়ে একশটি ছাগল দিতে রাজি হলে উক্ত সাহাবী রোগীকে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়-ফুঁক করলেন। ফলে রোগী এমনভাবে সুস্থ হয়ে উঠল, মনে হয় যেন রশির বাঁধন হতে মুক্ত করা হল।

উক্ত হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, রোগ মুক্তির জন্য ঝাড়-ফুঁক যথেষ্ট কার্যকর। অনুরূপভাবে, দুয়ার প্রভাব রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দুয়া ছাড়া অন্য কিছু মানুষের তাকদীর (বা ভাগ্যের) পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, উত্তম আচরণ ছাড়া অন্য কিছু মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করতে পারে না। আর মানুষের পাপের কারণে তাকে রিযক হতে বঞ্চিত রাখা হয়।” সুনানে ইবনে মাজাহ, মিশকাতঃ ৪৯২৫।

তবে দুয়ার দ্বারা ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না; বরং ভাগ্যে এটাও লেখা রয়েছে যে, সেই ব্যক্তি দুয়া করবে, অতঃপর তার ভাগ্যের পরিবর্তন করা হবে। সব কিছুই সংঘটিত হয় ভাগ্যের লিখন অনুযায়ী।
মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ, ‘ফতোয়া আরকানুল ইসলাম’, ঈমান অধ্যায়।
_____অধ্যায়ঃ তাক্বদীর, ঈমানের ষষ্ঠ রুকন (পর্ব-৩)

=========================

উত্তর : ৩

নেক আমল ও দো‘আর মাধ্যমে মানুষের তাকদীরের পরিবর্তন হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা করেন তা বহাল রাখেন’ (রা‘দ ৩৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘দো‘আর মাধ্যমে তাকদীর পরিবর্তন হয় এবং সৎ আমলের মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধি হয়’ (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ হা/৯০, ৪০২২; মিশকাত হা/২২৩৩, ৪৯২৫; ছহীহাহ হা/১৫৪)।

সূত্র 

==================================

উত্তর : ৪ 

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?”
এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি।
যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে।
১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি?
অথবা,
২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন?
এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

উদাহরণ – এক।

বিশ্বজগতে আমরা যা কিছু দেখি, এবং যা কিছু চিন্তা করতে পারি, সবকিছুর দুটি দিক থাকে। একটি অংশ পূর্ব থেকে নির্ধারিত, এবং অন্য একটি অংশ পরিবর্তনশীল।
যেমন, ইচ্ছা করলে আপনি এ লেখাটা না পড়ে অন্য লেখায় চোখ বুলাতে পারেন। কিন্তু, ইচ্ছা করলেই চোখ বন্ধ করে নাক দিয়ে এই লেখাটা দেখতে পারবেন না। চোখ বন্ধ করে নাকের সাহায্যে কোনো কিছু দেখার চেষ্টা আপনি করতেই পারেন, কিন্তু মানুষের নাক দিয়ে কোনো কিছুই দেখা সম্ভব না। এই যে নাক দিয়ে মানুষ দেখতে পারে না, এটা আল্লাহ তায়ালা পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই মানুষ নাক দিয়ে কোনো কিছু দেখতে পারে না। আবার, চোখ দিয়ে যে মানুষ যা ইচ্ছা তা দেখতে পারে, এটাও আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
এরপর ধরুন, আপনি ইচ্ছা করলেই আপনার হাতের মোবাইলটা বন্ধ বা চালু করতে পারেন। কিন্তু, আপনি ইচ্ছা করলেও মোবাইলের ব্যাটারিটা খুলে রেখে ঐ মোবাইলটি চালু করতে পারবেন না।
তারপর ধরুন, ফেইসবুকে আপনার যা ইচ্ছা তা পড়তে পারেন ও লিখতে পারেন। কিন্তু, ইচ্ছা করলেই মার্ক জুকারবার্গ ফেইসবুককে আপনি গুগল+ বানিয়ে ফেলতে পারবেন না। মার্ক জুকারবার্গ যে পদ্ধতিতে ফেইসবুক সাজিয়েছে, আপনাকে সে পদ্ধতি মেনে নিয়েই ফেইসবুক ব্যবহার করতে হবে।
বিশ্বের সবকিছুর এমন দুটি দিক আছে। সবকিছুর ক্ষেত্রেই একটু স্বাধীনতা দেয়া আছে, আবার পূর্ব নির্ধারিত একটি ফর্মুলাও দেয়া রয়েছে।
আমাদের জীবনের একটি ইচ্ছা শক্তি আছে, আবার আমাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। আমাদের ইচ্ছা শক্তি অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে পারে, আবার অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে পারে না। মানুষ কি পরিবর্তন করতে পারবে, এবং কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবে, এটা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়। এই নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টাকে বিশ্বাস করার নাম-ই তাকদীর।

উদাহরণ – দুই।

প্রত্যেক মানুষের-ই কিছু না কিছু ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে। তবে, একটি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে তার চেয়ে বড় অন্য একটি ক্ষমতা থাকে।
যেমন, একজন মন্ত্রী চাইলে দেশের জন্যে ভালো কিছু করতে পারে, সে ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা তার চেয়েও বেশি। প্রধানমন্ত্রী চাইলে মন্ত্রীর ক্ষমতাকে রোধ করতে পারে। অর্থাৎ, মন্ত্রীর ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অধীনে।
এরপর ধরুন, কোনো প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজার তার ক্যাশিয়ারকে টাকা গোনার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু যে কোনো সময় ক্যাশিয়ারের সে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার যোগ্যতা ম্যানেজার রাখে। অর্থাৎ, ক্যাশিয়ারের ক্ষমতা ম্যানেজারের ক্ষমতার অধীনে। তেমনি, কোনো অফিসে কর্মচারীর ক্ষমতা তার কর্মকর্তার ক্ষমতার অধীনে।
ঠিক একইভাবে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে কিছু না কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু মানুষের সকল ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার অধীনে। এ বিশ্বাসের নামই ‘তকদীরে’ বিশ্বাস।

উদাহরণ – তিন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কিছু ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন, আবার ইচ্ছার সীমাবদ্ধতাও দিয়েছেন। ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে আমাদের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন পারি ঠিক, কিন্তু আমাদের সেই ইচ্ছা শক্তি এবং ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
কল্পনা করুন, মহা সড়কের পাশে একটি পার্ক আছে। শহরের একটি পরিবার তাদের ৬ বছর বয়সী একটি বাচ্চাকে নিয়ে ঐ পার্কে হাঁটতে গেল। বাচ্চাটির আব্বু-আম্মু তাকে ঐ পার্কের ভিতরে খেলার অনুমতি দিল, কিন্তু রাস্তায় যেতে নিষেধ করল। বাচ্চাটি খেলেতে খেলতে যখনি রাস্তায় চলে যেতে লাগলো, তখনি তার আব্বু-আম্মু তাকে ধরে ফেলল। পার্কের ভিতরে যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীনতা বাচ্চাটির থাকলেও রাস্তায় যাবার স্বাধীনতা বাচ্চাটির নেই। কারণ, রাস্তায় গেলে বাচ্চাটি গাড়ির নিছে পড়বে।
এই যে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, এটা তকদীরের অন্তর্ভুক্ত। আমরা যা কিছু ইচ্ছা করি, সবকিছু করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করার ক্ষমতা আল্লাহর আছে। –এটা বিশ্বাস করার নাম তাকদীর।
এবার মূল প্রশ্নে আসি – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?”
এই প্রশ্নটির মাঝে একটি শব্দ হলো – ‘পূর্ব’। ‘পূর্ব’ শব্দের অর্থ অতীত। মানে, ভাগ্য কি অতীতে থেকে নির্ধারিত থাকে?
‘অতীত’ শব্দটি সময়ের সাথে সম্পর্কিত। সময়কে মানুষ সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করে – অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। মানুষ সময়ের অধীন। সময়ের মাত্রা-জ্ঞান ব্যতীত মানুষ কোনো কিছু কল্পনা করতে পারে না। তাই, মানুষ প্রশ্ন করে, ভাগ্য কি ‘পূর্ব’ থেকে নির্ধারিত? কিন্তু, আল্লাহ সময়ের অধীন নয়, তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কাল বলে কিছু নেই। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলছেন –
وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلَّا كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিয়ামতের ব্যাপারটি তো চোখের পলকের ন্যায়, অথবা তার চাইতেও দ্রুত। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর কাদীর বা শক্তিমান। [সূরা ১৬ /নাহল – ৭৭]
তাকদীর বোঝার জন্যে এই আয়াতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই আয়াতে তাকদীর সম্পর্কে বেশ কিছু অনুসিদ্ধান্ত রয়েছে। যেমন,
অনুসিদ্ধান্ত – এক।
আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিনে সবকিছুর গায়েব জানেন। এখানে গায়েব জানার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা ভবিষ্যতের বিষয়াবলীকে ঠিক সেভাবেই জানেন, যেভাবে তিনি অতীতের বিষয়াবলীকে জানেন। অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার নিকট অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
অনুসিদ্ধান্ত – দুই।
আল্লাহ তায়ালা সময়ের অধীন নয়, তিনি সময়ের অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁর কাছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব একই। ফলে, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এই সময়টা মানুষের কাছে হাজার হাজার মিলিয়ন বছর হলেও আল্লাহর কাছে একটি চোখের পলকের চেয়েও কম সময়। অর্থাৎ, আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এগুলো নেই।
বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত বলি।
দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার মত ‘সময়’ও একটি মাত্রা। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ব্যতীত যেমন কোনো মানুষকে কল্পনা করা যায় না, তেমনি সময় ব্যতীতও কোনো মানুষকে কল্পনা করা যায় না। মানুষ যখন পৃথিবীতে আকৃতি লাভ করে, তখন সে একটি সময়ে প্রবেশ করে; আবার যখন মৃত্যু বরণ করে, তখন এই সময় থেকে বের হয়ে যায়। তাই, মানুষ সময়ের অধীন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার জন্ম ও মৃত্যু নেই, শুরু বা শেষ নেই।[সূত্র আল কোর’আন, ৫৭:৩]। তাই আল্লাহ তায়ালা সময়ের অধীন নয়, বরং সময়-ই আল্লাহ তায়ালার অধীন। মানুষের বর্তমান, অতীত বা ভবিষ্যৎ কাল আছে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল বলে কিছু নেই। মানুষ সময়ের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহর কাছে সব কালই বর্তমান কাল।
অনুসিদ্ধান্ত – তিন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিজগতের সবাইকে কিছু কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মালিক তিনি।
এ তিনটি অনুসিদ্ধান্তের পর আমরা বলতে পারি,
“আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের ভাগ্য ‘পূর্ব’ নির্ধারিত” –এ কথাটা কেবল মানুষের জন্যে প্রযোজ্য। আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, মানুষের জন্যে যা অতীত, আল্লাহর জন্যে তা ‘অতীত’ নয়; আবার, মানুষের জন্যে যা ভবিষ্যৎ, তাও আল্লাহর জন্যে ‘ভবিষ্যৎ’ নয়। আল্লাহর নিকট অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবি এক। তিনি ভবিষ্যতকে অতীতের মতই জানেন। তিনি যখন মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন, তখন অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বলে কোনো কিছু থাকে না। কিন্তু মানুষেরা যেহেতু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের মধ্যে থাকে, তাই মানুষকে বোঝানোর জন্যে রাসূল (স) বলেছেন যে, মানুষের ভাগ্য ‘অতীত’ বা ‘পূর্ব’ থেকেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে।
এবার, কোর’আন থেকে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।

কোর’আনের উদাহরণ – ১

নিচের দুটি আয়াত দেখুন। প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, মানুষের উপর যে বিপদ আসে তা আগেই লিপিবদ্ধ করা থাকে। কিন্তু, দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, মানুষের কৃতকর্মের কারণেই তার উপর বিপদ আসে।
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍۢ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فِىٓ أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِى كِتَـٰبٍۢ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ ۚ إِنَّ ذَ‌ٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٌۭ
পৃথিবীতে এবং তোমাদের উপর যে বিপদ আসে, তা পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। [ সূরা ৫৭/হাদীদ – ২২]

وَمَآ أَصَـٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٍۢ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا۟ عَن كَثِيرٍۢ
তোমাদের উপর যে বিপদ আসে, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। এবং তোমাদের অনেক গোনাহ তিনি ক্ষমা করে দেন। [ সূরা ৪২/শূরা – ৩০]
দেখে মনে হয়, আয়াত দুটি কি পরস্পর বিপরীত? উত্তর – না। একটু লক্ষ্য করলেই দেখব, মানুষ যখন কোনো কাজ করে, তখন সে কাজের একটি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ থাকে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল একই।
তাই দেখুন, বিপদের ব্যাপারটা যখন আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন তিনি বলেছেন – বিপদ আসার আগেই তা আল্লাহ নিকট লেখা থাকে, এবং এটি আল্লাহর জন্যে খুবই সহজ একটি কাজ। কিন্তু, বিপদের ব্যাপারটা যখন মানুষের সাথে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন আল্লাহ বলছেন – মানুষের কৃতকর্মের ফলেই বিপদ আসে। আল্লাহর ক্ষেত্রে সময় এবং মানুষের সময়, – দুটি বিষয়ের পার্থক্য মাথায় রাখলে আয়াত দুটির মাঝে কোনো বৈপরীত্য আর থাকে না।

কোর’আনের উদাহরণ – ২

এবার, অন্য দু’টি আয়াত দেখুন। প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন – ‘তিনি যদি চাইতেন তাহলে মানুষ ‘শিরক’ করতো না’। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলছেন – ‘মুশরিকরা বলছে, আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে মুশরিকরা শিরক করত না’।
وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ مَآ أَشْرَكُوا۟ ۗ وَمَا جَعَلْنَـٰكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًۭا ۖ وَمَآ أَنتَ عَلَيْهِم بِوَكِيلٍۢ
যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে তারা শিরক করত না। আমি আপনাকে তাদের রক্ষক নিযুক্ত করিনি এবং আপনি তাদের কার্যনির্বাহী নন। [সূরা ৬/আনয়াম – ১০৭]

وَقَالَ ٱلَّذِينَ أَشْرَكُوا۟ لَوْ شَآءَ ٱللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِن دُونِهِۦ مِن شَىْءٍۢ نَّحْنُ وَلَآ ءَابَآؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن دُونِهِۦ مِن شَىْءٍۢ ۚ كَذَ‌ٰلِكَ فَعَلَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ فَهَلْ عَلَى ٱلرُّسُلِ إِلَّا ٱلْبَلَـٰغُ ٱلْمُبِينُ
মুশরিকরা বলল: যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে আমরা ও আমাদের পিতৃপুরুষেরা তাঁকে ছাড়া অপর কারও ইবাদত করতাম না, এবং তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোন বস্তুই আমরা হারাম করতাম না। তাদের পূর্ববর্তীরা এমনই করেছে। রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র সুস্পষ্ট বাণী পৌছিয়ে দেয়া।[ সূরা ১৬/নাহল – ৩৫]
লক্ষ্য করুন, দুটি আয়াতে একই কথা বলা হচ্ছে। প্রথম আয়াতে যে কথা বলে আল্লাহর ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে, অথচ দ্বিতীয় আয়াতে সে একই কথা বলেই মুশরিকদের অন্যায়ের কথা বলা হচ্ছে। তাহলে, আয়াত দুটি কি পরস্পর বিরোধী?
উত্তর – না।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিরক করার ক্ষমতা দিয়েছেন বলেই মানুষ শিরক করতে পারে। কিন্তু, শিরক করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, মানুষকে তিনি শিরক করার অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে চোখ দিয়ে দেখার ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু সবকিছু দেখার অনুমতি দেননি। অন্যদিকে, নাক দিয়ে দেখার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দেননি, তাই আমরা শত চেষ্টা করলেও নাক দিয়ে কোনো কিছু দেখতে পারব না। সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সীমাবদ্ধ ক্ষমতার কারণেই আমরা করতে পারি। ভালো বা খারাপ যাই করি না কেন, সেই ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দিয়েছেন বলেই আমরা তা করতে পারি। তিনি তাঁর ক্ষমতা আমাদের থেকে কেড়ে নিলে, আমরা যেমন ভালো কোনো কাজও করতে পারব না, তেমনি খারাপ কোনো কাজও করতে পারব না।
এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। মানুষ যখন কোনো কিছু চায়, তখন তা সময়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মানুষ বর্তমানে কোনো কিছু চাইলে তা ভবিষ্যতে গিয়ে পরিপূর্ণ হয়। কিন্তু, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো কিছু ইচ্ছা করেন, তখন সেটি সময়ের অধীন হয় না। অর্থাৎ, যেহেতু তাঁর কাছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সক একই, তাই তিনি কোনো কিছু চাওয়া মাত্রই তা হয়ে যায়। তাই, আল্লাহর চাওয়া ও মানুষের চাওয়ার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।
এ কারণেই, উপরোক্ত আয়াতে মুশরিকরা যখন দাবী করে – ‘আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমরা শিরক করেছি’ – তখন সেটি একটি ভ্রান্ত দাবীতে পরিণত হয়। অথচ, আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন – আমি চাইলে তারা কেউ শিরক করত না। এখানে, আল্লাহর চাওয়া এবং মানুষের চাওয়ার পার্থক্যটি বোঝা জরুরী।

কোর’আনের উদাহরণ – ৩

কোর’আনের আরো দুটি আয়াত দেখুন। এখানে প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, তাঁর জ্ঞান ব্যতীত একটি গাছের পাতাও ঝরে না। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে তিনি বলছেন, কোনো জাতি নিজেই তার ভাগ্য পরিবর্তন না করলে, আল্লাহ সে জাতীর ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন না।
وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَآ إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِى ٱلْبَرِّ وَٱلْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍۢ فِى ظُلُمَـٰتِ ٱلْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍۢ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِى كِتَـٰبٍۢ مُّبِينٍۢ
অদৃশ্য জগতের চাবি তাঁর কাছেই রয়েছে, এগুলো তিনি ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তা তিনি জানেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না, অথবা রসযুক্ত বা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। [সূরা ৬/আন’আম – ৫৯]
ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
এটি এজন্যে যে, আল্লাহ কখনও সে সব নেয়ামত পরিবর্তন করেন না, যা তিনি কোন জাতিকে দান করেছিলেন, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে নেয়। বস্তুত: আল্লাহ শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। [সূরা ৮/আনফাল – ৫৩]
প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে, গাছের একটি পাতাও আল্লাহর অজ্ঞাতসারে পড়ে না, সব আগে থেকেই কিতাবে লিখা আছে। আর, দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষ তার ভাগ্য পরিবর্তন না করলে আল্লাহ নিজ থেকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন না। তাহলে আয়াত দুটি কি পরস্পর বিরোধী?
উপরের উদাহরণ দুটির মত এখানেও আল্লাহর ক্ষমতা ও মানুষের ক্ষমতার পার্থক্য বোঝা প্রয়োজন। প্রথম আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে মানুষের করণীয় ও মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে।
এখানে দ্বিতীয় আয়াতটি একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই মানুষকে কিছু নিয়ামত বা সুযোগ দিয়ে রেখেছেন। মানুষ যদি সে সুযোগ গ্রহণ করে, তাহলে তার ভাগ্য পরিবর্তন হবে। আর যদি সুযোগ গ্রহণ না করে, তাহলে সে বঞ্চিত হবে।
এখন, মানুষ আল্লাহর নিয়ামত গ্রহণ করবে নাকি বর্জন করবে, এটা আল্লাহর পক্ষে আগ থেকেই জানা সম্ভব। কারণ, মানুষের যেমন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল আছে, আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এমন কোনো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল নেই। মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ কাল আল্লাহর জন্যে একই। তাই, মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই জানেন।
বিষয়টি আরো সহজভাবে বলার জন্যে সর্বশেষ একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
ধরুন, তাজা ঘাসে পরিপূর্ণ একটি মাঠ। একজন রাখাল একটি গরুর গলায় রশি লাগিয়ে তাকে ঐ মাঠে ছেড়ে দিল। মাঠের নির্দিষ্ট অংশে ইচ্ছামত বিচরণ করার ক্ষমতা গরুটির আছে, যেখান থেকে ইচ্ছা সেখান থেকে খাবারের সুযোগও তার আছে। কিন্তু গরুর গলার রশি যতদূর যায়, তার বাইরে গিয়ে ঘাস খাওয়ার সুযোগ গরুটিকে দেয়া হয়নি। এখন, গরুটি ইচ্ছা করলে মাঠের নির্দিষ্ট অংশের তাজা ঘাসগুলো খেয়ে নিজের পেট পূর্ণ করতে পারে, অথবা কিছু না খেয়ে উপাস থাকতে পারে। রাখাল জোর করে ঐ গরুটিকে ঘাস খাইয়ে দিবে না।
এভাবে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কিছু নেয়ামত আগ থেকেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমরা যদি চেষ্টা করি, তাহলে আল্লাহর ঐ নিয়ামত অর্জন করতে পারব; আর চেষ্টা না করলে, ঐ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হব।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। রাখাল যেহেতু মানুষ, তাই সে সময়ের দ্বারা অবদ্ধ। গরুটি ঘাস খাবে কি খাবে না, এটা রাখাল আগ থেকে জানে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যেহেতু সময়ের ঊর্ধ্বে, তাই তিনি আগ থেকে জানেন, মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া নেয়ামত গ্রহণ করবে কি করবে না।
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা সময়ের ঊর্ধ্বে, তাই তিনি মানুষের ভবিষ্যৎ জানেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভবিষ্যৎ জানেন বলে, মানুষ যদি ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের আশা ত্যাগ করে, তাহলে মানুষ ভবিষ্যতকে হারিয়ে ফেলবে। এটাই আল্লাহ তায়ালার সুন্নত। এবং এটার নামই তাকদীর।
সুতরাং, তাকদীর বা ভাগ্য হলো এমন একটি বিষয় যা আল্লাহর সামগ্রিক ইচ্ছা এবং মানুষের সীমাবদ্ধ ইচ্ছার দ্বারা পরিবর্তনশীল। এখানে আল্লাহর ইচ্ছা সময়ের অধীন নয়, কিন্তু মানুষের সময়ের অধীন।

সূত্র 

প্রশ্ন ২৮ : ইতিকাফের গুরুত্ব ও তাাৎপর্য ।

এইচ  এম আব্দুর রহিম : রমজানের শেষ ১০ দিন সব বাঁধন ছিন্ন করে আল্লাহর ঘরে রহমত ও মাগফিরাতের আশায় পড়ে থাকার নাম ইতিকাফ। এ অবস্থায় শবে কদর লাভে সহজসাধ্য হয়। মা হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রমজানের শেষ দশক উপনীত হওয়ার পর আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সংসার ধর্ম পালন ক্ষেত্রে সংযম অবলন্বন করতেন এবং ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে নিতেন। সারারাত জেগে কাটাতেন এবং পরিবারের সবাইকে জাগ্রত থাকতে বলতেন। (বোখারী ও মুসলিম)  রমজানের  পবিত্রতম দিনগুলিতে পাপমুক্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মহানেয়ামত অর্জিত হয় শেষ দশকের ইতিকাফের মাধ্যমে। ইবনে কায়িম (রহঃ) বলেন, মহান আল্লাহর সঙ্গে আত্মার সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। সব ব্যস্ততামুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানমগ্ন হওয়া। পার্থিব সব ধরনের সংশ্রব ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সান্নিধ্যে এসে তাঁর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন। একলাস খাঁটি নিয়ত ও আন্তরিকতাপুর্ণ ইতিকাফ অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত-এতে এতটুকু সন্দেহ নেই। কারণ, ইতিকাফ জগতের তাবত মায়াজাল ছিন্ন করে নিজেকে মহান আল্লাহর হাতে সমর্পণ করতে হয়। একমাত্র তারই ধ্যানে মগ্ন হতে হয়। তাঁর দুয়ারে পড়ে থাকতে হয়। ইতিকাফের গুরুত্ব তাৎপর্য ও ফজিলত অপরিসীম। ইতিকাফ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-আমি ইব্র্র্র্র্র্রাহিম ও ইসমাইলকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীর জন্য আমার ঘর (বাইতুল্লাহ) পবিত্র রাখতে আদেশ করে ছিলাম। (সুরা বাকারা -১২৫)। ইতিকাফের অশেষ সওয়াব ও সওয়াব সম্পর্কে হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে-ইতিকাফকারী সব গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। সফল সৎ কর্মশীল যত ধরনের সৎ কর্ম করে থাকে, ইতিকাফকারীর জন্য সেসবের অনুরূপ সওয়াব লেখা হয়। (যদি ও সে ইতিকাফের কারণে অনেক নেক কাজ করতে পারেন না)। ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা। সওয়াবের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করাকে শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ তিন প্রকার ওয়াজিব সুন্নত নফল। ইতিকাফ মানত করলে তা ওয়াজিব হয়ে যায়। রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। কিছু লোক আদায় করলে দায়মুক্ত হবে। যে কোন সময় অল্প- অধিক যতটুকু সময়ের জন্য হোক ইচ্ছামত মসজিদে প্রবেশের সময় ইতিকাফের নিয়াত করলে নফল ইতিকাফ হয়ে থাকে। এর কোন নির্ধারিত সময়কাল নেই। যে কোন সময় মসজিদে প্রবেশকালে নফল ইতিকাফের নিয়ত করলে মসজিদে অবস্থানের পর নফল ইতিকাফের সওয়াব পাওয়া যাবে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ওফাত পর্যন্ত তিনি ইতিকাফ করে গেছেন। ওফাতের পর তার সহধর্মীনিরা ইতিকাফ করতেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, হযরত রসুল (সাঃ) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ওফাতের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করে গেছেন।
রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফের মহান লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে। শবে কদরের অনুসন্ধান। কেবল ২৭ রমজান রাতে শবে কদর হওয়া সুনিশ্চিত নয়। শেষ দশকের বেজোড় পাঁচ রাতে শবে কদর নিহিত রয়েছে। একজন মানুষ যতক্ষণ ইতিকাফে থাকে তার পুরো সময়টা ইবাদত হিসাবে গণ্য হয়। যারা ইতিকাফে থাকেন তারা ইবাদতের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে থাকেন। ফলে যে রাতে শবে কদর হয় শেষ দশকে ইতিকাফকারীরা তার ফজিলত পেয়ে থাকেন। শবে কদরের খোঁজে রসুল (সাঃ) ইবাদত করতে বলে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিকাফের একটি বিশেষ উপকারিতা হচ্ছে মসজিদে অবস্থানের মাধ্যমে সব গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা। হাদিসেও রয়েছে ইতিকাফকারীরা গোনাহ থেকে বিরত থাকে। ইতিকাফ যেন গোনাহ ও পাপ থেকে আত্মরক্ষার মজবুত বর্ম। পুরুষদের মত মহিলারা ইতিকাফ করতে পারেন। বাসায় বাড়ীতে নামাযের নির্ধারিত স্থান তাদের ইতিকাফ স্থল। রসুল (সাঃ)এর সহধর্মীনিরা নিজ হুজরায় ইতিকাফ করতেন। রমজানে অধিক নেক আমল করা যতনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পাপকাজ থেকে  বেঁচে থাকা অধিক গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। আর সে উদ্দেশ্য সফলে ইতিকাফ মুখ্য ভুমিকা রাখে। শবে কদর প্রাপ্তি রমজানের প্রভুত রহমত বরকত ও মাগফিরাত ও নাজাত। অশেষ সওয়াব লাভ এবং পাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামসহ যুগে যুগে পীর আওলীয়া তাদের মুরিদ, ভক্ত অনুরক্ত সর্বোপরি পরহিযগার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইতিকাফ করেছেন আশা আগ্রহ নিয়ে। অফুরন্ত সওয়াব অবারিত রহমত লাভের সুবর্ণ সুযোগটি আমাদের কাজে লাগানো দরকার।  ইতিকাফ তিন প্রকার এর মধ্যে ওয়াজিব ইতিকাফ হল, নযর মান্নতের ইতিকাফ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি মনস্থ করে যে, আমার অমুক কাজ সমাধান হলে বা অমুক আশা পূরন হলে আমি ইতিকাফ করব। অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ইতিকাফের নিয়ত করে। তবে তার উপর ইতিকাফ ওয়াজিব হয়ে যায়। এবং নিয়তকৃত মেয়াদপুর্ণ করা তার জন্য কর্তব্য। ২.সুন্নত ইতিকাফ ঃ রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ এ শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)  এ দিনগুলিতে ইতিকাফ করেছেন। রমজানের বিশ তারিখ সন্ধ্যা অর্থাৎ সুর্যাস্তের সময় থেকে তা শুরু করতে হয় এবং ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এর মেয়াদ। এই ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা- এ - কেফায়া। ৩. মুস্তাহাব বা নফল ইতিকাফ ঃ ওয়াজিব ও সুন্নত ইতিকাফ ছাড়া  সব ইতিকাফ মুস্তাহাব। বছরের সকল দিনে এ ইতিকাফ পালন করা যায়। স্বল্প মেয়াদের জন্য হলে ও সকলের ইতিকাফে যাওয়া জরুরী। ইতিকাফের মধ্যে অনেক সওয়াব রয়েছে। খোদ আল্লাহর রসুল ইতিকাফের ব্যাপারে যতœবান ছিলেন। ইতিকাফের দ্বারা নির্ঝঞ্ঝাটের মধ্যে থেকে এক নিবিষ্ট চিত্তে  আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যায়। এ সময়টি মধ্যে কায়মনো বাক্যে কোরআন পাঠ, নফল নামায, যিকির-ফিকির তছবীহ তাহলীল, মুনাজাত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একজন লোক আত্মশুদ্ধির এক এক মহত্তর স্তরে নিজেকে পৌছাতে পারে।  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, রমজান মাসে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসে একটি ফরজের সমতুল্য এবং এ মাসের একটি ফরজ অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমতুল্য। এসব কিছু নির্ভর করে ইবাদতকালে একাগ্রচিত্রতার উপর। ইতিকাফ মুর্হুতে যেহেতু এ প্রবল  থাকে তাই সওয়াব বেশী হওয়া স্বাভাবিক।  রমজানে তারাবীহ, নফল নামায, কুরআন অধ্যয়ন,যিকির ফিকির, তাসবীহখানি ইত্যাদি কাজ হুকুমের দিক থেকে অপরিহার্যতার পর্যায়ভুক্ত না হলেও আরও নানান দিকের বিচারে এগুলোর সওয়াবের পরিমাণ রমযান মাসে অধিক হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআনে প্রিয় বান্দার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তারা আপন প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাযে দন্ডায়মান এবং সিজদার মধ্য দিয়ে রাত্রি যাপন করে।                                                                                                      
আমার নিকট এ বলে  প্রার্থনা করো যে,  “হে প্রভু  আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে দুরে রাখ” কুরআন মজীদের অন্যত্র মহানবীর প্রতি এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাত্রে ঘুম থেকে জাগা কুপ্রবৃত্তি দমনের একটি কঠোর পন্থা। এবং বক্তব্য হিসেবে সুদৃঢ়।  দিনের বেলা তোমার অনেক ব্যস্ততা থাকে। সুতরাং রাতের বেলা  তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করো এবং সকল কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র তাঁর দিকেই রুজু হয়ে যাও।  উল্লেখ্য যে, মহানবীর দিনের বেলায় কর্মতৎপরতা নবুয়তী কাজের বাইরে ছিল না। তারপরও রাতের গভীরে আল্লাহর প্রতি সম্পুর্ণ রুজু হওয়ার নির্দেশ থেকে একান্ত আল্লাহর ধ্যানের গুরুত্বই স্পষ্ট  হয়ে ওঠে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এ মহৎ কাজগুলো মাহে রমজানের মধ্যে বিশেষ করে রাতের অংশে এবং ইতিকাফে ও মহিমান্বিত শবে কদরে অধিক কল্যাণবাহী হয়ে থাকে। আর এমনি করে রোজার অপরিসীম সওয়াব প্রাপ্তিতে ও লক্ষ্য অর্জনে সোনায় সোহাগার মত কাজ করে থাকে। ইতিকাফ খোদাপ্রেমিক রোজাদারের মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবে ফরজ, ওয়াাজিব, সুন্নত ও নফল ইত্যাদি আমলের সওয়াবের অধিকারী ব্যাক্তি  সম্পর্কেই সে শুভ সংবাদ প্রযোজ্য হয় যেখানে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি রমজানের রোজা যথারীতি  পালন করবে সে যেন সদ্য জন্ম নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মাসুম-বেগুনাহ বান্দায় পরিণত হয়। আল্লামা ইবনে কাইয়েম বলেন, ইতিকাফের উদ্দেশ্য তাৎপর্য হল, আল্লাহর ইচ্ছার সাথে নিজেকে একাকার করে নেয়া। ইতিকাফকারী সব ভুলে গিয়ে প্রভু প্রেমে এত বিভোর হয়ে পড়ে যে, তার সকল ধ্যান ধারণা, চিন্তা ভাবনা একমাত্র  আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সংসারের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। এ সম্পর্ক ভালবাসা তার কবরের সঙ্গী-সাথীহীন অবস্থার সহায়ক হবে। ইতিকাফকারীর শয়ন -স্বপ্ন সব কিছু ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে। তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হন।  হাদিস শরীফে আছে, যে আমার প্রতি এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার পানে এক হাত অগ্রসর হই। যে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।

সূত্র

প্রশ্ন ২৭ : বাংলাদেশের জন্য ফিতরা আদায়ের পদ্ধতি ।

  1. ফিতরা

    উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
    ফিতরা বা ফেতরা(فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন।[১] যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা সকালের খাদ্য গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে যাকাতুল ফিতর বা সকাল‌ের আহারের যাকাত বলা হয়। [২]
    নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রাঃ) থেকে জানা যায়ঃ
    فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم- زكاة الفطر صاعاً من تمر أو صاعاً من شعير، على الذكر والأنثى والصغير والكبير والحر والعبد من المسلمين، وأمر أن تؤدى قبل خروج الناس للصلاة” متفق عليه রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব ফরজ করেছেন। তিনি লোকদের ঈদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।[৩][৪]

    ফিতরার বিধান

    কে ফিতরা দেবে

    ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য আছে (একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকলে) এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করা ফরজ যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার উপরে অর্পিত হয়েছে।[৫] যার নিকট এক দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু নেই তার ফিতরা দেয়ার প্রয়োজন নেই।[৬]

    কে ফিতরা পাবে

    গরীব, দুঃস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ব্যক্তিকে ফিতরা প্রদান করা যাবে।

    কাজের লোককে ফিতরা দেয়া

    বেতনভুক্ত কাজের ব্যক্তির পক্ষে ফিতরা প্রদান করা মালিকের উপর আবশ্যক নয়। তবে মালিক ইচ্ছে করলে কাজের লোককে ফিতরা প্রদান করতে পারবেন। তবে তিনি বেতন বা পারিশ্রমিক হিসেবে ফিতরা প্রদান করতে পারবেন না।

    যা দিয়ে ফিতরা দেয়া যাবে

    আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন: “আমরা-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ।[৭][৮] এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল: কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিগত হওয়ার পরে মুআবীয়া (রাযিঃ)-এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরা দিতেন।[৯][১০]

    খাদ্য দ্রব্য দিয়ে কি ফিতরা দেয়া

    সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায় খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা প্রদানের কথা। যেহেতু চাল বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান খাদ্য সেহেতু চাল দিয়েও ফিতরা প্রদান করা যাবে। চালের বদলে ধান দিয়ে ফিতরা দিতে হলে ওজনের ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। কারণ এক সা ধান এক সা চালের সম মূল্যের হবে না। কুরআন থেকে জানা যায়ঃ
    و لا تيمموا الخبيث منه تنفقون و لستم بآخذيه إلآ أن تغمضوا فيه তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প করিও না। অথচ তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নও।[১১]
    তবে ধানের থেকে চাল দিয়ে ফিতরা প্রদান করা উত্তম। নিম্নোক্ত কিয়াস থেকে এই ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়ঃ
    যবের উপর কেয়াস (অনুমান) খাটাইয়া ধানের ফিতরা জায়েয হইবে না, কারণ ধান আদৌ আহার্য সামগ্রী ‘তাআম’ নয়। আহার্য বস্তুর উপর কিয়াস করিয়া যব বা খুর্মার ফিতরা দেওয়া হয় না মনসূস ( কুরআন বা হাদীসে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত) বলিয়াই দেওয়া হইয়া থাকে। তাআম বা আহার্য সামগ্রীরূপে ফিতরা দিতে হইলে এক সা চাউল দিতে হইবে। [১২]

    টাকা দিয়ে কি ফিতরা দেয়া

    মুহাম্মদ (সঃ) এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দিরহাম প্রচলিত ছিলো। দিরহামের দ্বারা কেনা কাটা, দান খয়রাত করা হতো। তবু সাহাবী খুদরী বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায় মুহাম্মদ (সঃ) খাদ্য বস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করতেন। এজন্য মুসলমান পন্ডিতদের বড় অংশ টাকা দিয়ে ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষন করেন। ইমাম আহমদ (রঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বরখেলাফ হওয়ার কারণে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না।[১৩]
    তবে প্রয়োজনে টাকা দিয়েও ফিতরা আদায় করা বৈধ। বাংলাদেশের মুসলিমগণ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চাইলে ২.৪০ (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম) মধ্য মানের চাউলের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। অবশ্য বাংলাদেশ যাকাত বোর্ড প্রতিবছর শহর ও গ্রাম এলাকার জন্য ফিতরার মূল্য নির্ধারণ করে দেন। তবে সম্ভব হলে ধান বা খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করা উচিত।

    সা এবং অর্ধ সা

    ফিতরা প্রদানের পরিমাপ সংক্রান্ত আলোচনায় সা বহুল আলোচিত শব্দ। সা হচ্ছে আরবদেশে ওজন বা পরিমাপে ব্যবহৃত পাত্র। বাংলাদেশে যেমন ধান পরিমাপের জন্য একসময় কাঠা ব্যবহৃত হত। একজন মাঝামাঝি শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক সা।[১৪][১৫]
    হাদিস থেকে সুস্পষ্ট জানা যায় মুহাম্মদ (সঃ) এক সা পরিমাণ ফিতরা প্রদানের কথা। মুহাম্মদ (সঃ) এবং চার খলিফার মৃত্যুর পরে মুআবিয়া (রাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্ক স্থানান্তরিত করেন, তখন তারা গমের সাথে পরিচিত হন। সে কালে সিরিয়ার গমের মূল্য খেঁজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলিফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বরে বলেন: আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এর পর থেকে মুসলিম জনগনের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়।[১৬]

    আরো পড়ুন

    তথ্য উৎস


  2. আল মুজাম আল ওয়াসিত, পৃষ্ঠা ৬৯৪

  3. ফাতহুল বারী ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৩

  4. সহীহ বুখারী http://sunnah.com/bukhari

  5. সহীহ মুসলিম http://sunnah.com/muslim

  6. আল মুগনী, ৪/৩০৭, বুখারী হাদীস নং ১৫০৩

  7. সউদী ফাতাওয়া বোর্ড, ৯/৩৮৭

  8. বুখারী শরীফ, হাদিস ১৫০৬

  9. মুসলিম শরীফ, হাদিস ২২৮১

  10. বুখারী হাদীস নং ১৫০৮

  11. মুসলিম ২২৮১

  12. আল কুরআন সুরা বাক্বারাহ - ২৬৭ নং বাক্য

  13. তর্জুমানুল হাদীস, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, রবিউল আওয়াল, ১৩৭০ হি

  14. মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৪/২৯৫

  15. ফাতাওয়া মাসায়েল/ ১৭২-১৭৩

  16. সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খণ্ড ৯য় পৃ: ৩৬৫

  17. মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: যাকাতুল ফিতর হাদীস নং ২২৮১ এবং ৮২

প্রশ্ন ২৬ : যাকাত বন্টনের ৮ টি খাত বিস্তারিত জানতে চাই ।

যাকাত বণ্টনের খাত ৮ টি

মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْعَامِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِيْ الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ-
‘নিশ্চয়ই ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্ল­াহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, আর আল্লাহ  মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। নিম্নে প্রত্যেকটি খাত আলাদাভাবে আলোচনা করা হল-
(১) ফকীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী। যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের ৮টি খাতের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفَقْرِ ‘ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্য থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।[1] অতএব ফকীর যাকাতের মাল পাওয়ার হকদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنْ تُبْدُوْا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوْهَا وَتُؤْتُوْهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ-  
‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে ছাদাক্বাহ প্রদান কর তবে উহা ভাল; আর যদি তা গোপনে কর এবং দরিদ্রদেরকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভাল’ (বাক্বারাহ ২/২৭১)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ، تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ-
‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তাদের সম্পদে ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) ফরয করেছেন। যেটা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গৃহীত হবে আর তাদের দরিদ্রের মাঝে বণ্টন হবে’।[2]
(২) মিসকীন : যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের মধ্যে দ্বিতীয় খাত হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা মিসকীনকে উল্লেখ করেছেন। আর মিসকীন হল ঐ ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَيْسَ الْمِسْكِيْنُ الَّذِى يَطُوْفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَلَكِنِ الْمِسْكِيْنُ الَّذِى لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيْهِ، وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ، وَلاَ يَقُوْمُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ-
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, এমন ব্যক্তি মিসকীন নয় যে এক মুঠো-দু’মুঠো খাবারের জন্য বা দুই একটি খেজুরের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তাকে তা দেওয়া হলে ফিরে আসে। বরং প্রকৃত মিসকীন হল সেই ব্যক্তি যার প্রয়োজন পূরণ করার মত যথেষ্ট সঙ্গতী নেই। অথচ তাকে চেনাও যায় না যাতে লোকে তাকে ছাদাক্বাহ্ করতে পারে এবং সে নিজেও মানুষের নিকট কিছু চায় না।[3]
(৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারী : আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের তৃতীয় খাত হিসাবে ঐ ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি যাকাত আদায়, হেফাযত ও বণ্টনের কাজে নিয়োজিত। অতএব উক্ত ব্যক্তি সম্পদশালী হলেও সে চাইলে যাকাতের অংশ গ্রহণ করতে পারবে।[4]
হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ السَّاعِدِىِّ الْمَالِكِىِّ أَنَّهُ قَالَ اسْتَعْمَلَنِيْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رضى الله عنه عَلَى الصَّدَقَةِ فَلَمَّا فَرَغْتُ مِنْهَا وَأَدَّيْتُهَا إِلَيْهِ أَمَرَ لِيْ بِعُمَالَةٍ فَقُلْتُ إِنَّمَا عَمِلْتُ لِلَّهِ وَأَجْرِى عَلَى اللهِ، فَقَالَ خُذْ مَا أُعْطِيْتَ فَإِنِّيْ عَمِلْتُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَعَمَّلَنِيْ فَقُلْتُ مِثْلَ قَوْلِكَ فَقَالَ لِيْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أُعْطِيْتَ شَيْئًا مِنْ غَيْرِ أَنْ تَسْأَلَ فَكُلْ وَتَصَدَّقْ-
ইবনু সায়ে‘দী আল-মালেকী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম এবং তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিলাম তখন তিনি নির্দেশ দিলেন আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি ইহা করেছি। সুতরাং আমি আল্লাহর নিকট থেকেই এর প্রতিদান নেব। তিনি বললেন, আমি যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। কেননা আমিও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় যাকাত আদায়কারীর কাজ করেছি। তখন তিনিও আমাকে পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন আমিও তোমার মত এরূপ কথা বলেছিলাম। রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, যখন তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কিছু দেওয়া হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ কর। তুমি তা নিজে খাও অথবা ছাদাক্বাহ্ কর।[5]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِىٍّ إِلاَّ لِخَمْسَةٍ لِغَازٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَوْ لِعَامِلٍ عَلَيْهَا أَوْ لِغَارِمٍ أَوْ لِرَجُلٍ اشْتَرَاهَا بِمَالِهِ أَوْ لِرَجُلٍ كَانَ لَهُ جَارٌ مِسْكِيْنٌ فَتُصُدِّقَ عَلَى الْمِسْكِيْنِ فَأَهْدَاهَا الْمِسْكِيْنُ لِلْغَنِىِّ
আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[6]
(৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোন অমুসলিমকে যাকাত প্রদান করা : ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কোন অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।[7]
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ بَعَثَ عَلِىٌّ رضى الله عنه وَهُوَ بِالْيَمَنِ بِذَهَبَةٍ فِيْ تُرْبَتِهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَسَمَهَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ الأَقْرَعُ بْنُ حَابِسٍ الْحَنْظَلِىُّ وَعُيَيْنَةُ بْنُ بَدْرٍ الْفَزَارِىُّ وَعَلْقَمَةُ بْنُ عُلاَثَةَ الْعَامِرِىُّ ثُمَّ أَحَدُ بَنِيْ كِلاَبٍ وَزَيْدُ الْخَيْرِ الطَّائِىُّ ثُمَّ أَحَدُ بَنِيْ نَبْهَانَ قَالَ فَغَضِبَتْ قُرَيْشٌ فَقَالُوْا أَتُعْطِى صَنَادِيْدَ نَجْدٍ وَتَدَعُنَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنِّيْ إِنَّمَا فَعَلْتُ ذَلِكَ لأَتَأَلَّفَهُمْ فَجَاءَ رَجُلٌ كَثُّ اللِّحْيَةِ مُشْرِفُ الْوَجْنَتَيْنِ غَائِرُ الْعَيْنَيْنِ نَاتِئُ الْجَبِيْنِ مَحْلُوْقُ الرَّأْسِ فَقَالَ اتَّقِ اللهَ يَا مُحَمَّدُ قَالَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَمَنْ يُطِعِ اللهَ إِنْ عَصَيْتُهُ أَيَأْمَنُنِيْ عَلَى أَهْلِ الأَرْضِ وَلاَ تَأْمَنُوْنِيْ قَالَ ثُمَّ أَدْبَرَ الرَّجُلُ فَاسْتَأْذَنَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ فِيْ قَتْلِهِ يُرَوْنَ أَنَّهُ خَالِدُ بْنُ الْوَلِيْدِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَقْتُلُوْنَ أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَيَدَعُوْنَ أَهْلَ الأَوْثَانِ يَمْرُقُوْنَ مِنَ الإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ-
আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) নবী (ছাঃ)-এর নিকট কিছু স্বর্ণের টুকরো পাঠালেন। তিনি তা চার ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দিলেন। (১) আল-আকরা ইবনু হানযালী যিনি মাজায়েশী গোত্রের লোক ছিলেন। (২) উআইনা ইবনু বাদার ফাযারী। (৩) যায়েদ ত্বায়ী, যিনি পরে বনী নাবহান গোত্রের ছিলেন। (৪) আলকামাহ ইবনু উলাছাহ আমেরী, যিনি বনী কিলাব গোত্রের ছিলেন। এতে কুরাইশ ও আনসারগণ অসন্তুষ্ট হলেন এবং বলতে লাগলেন, নবী (ছাঃ) নজদবাসী নেতৃবৃন্দকে দিচ্ছেন আর আমাদেরকে দিচ্ছেন না। তখন নবী (ছাঃ) বললেন, আমি তো তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য এমন মনরঞ্জন করছি। তখন এক ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসল, যার চোখ দু’টি কোটরাগত, গন্ডদ্বয় ঝুলে পড়া, কপাল উঁচু, ঘন দাড়ি এবং মাথা মোড়ানো ছিল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। তখন তিনি বললেন, আমিই যদি নাফরমানী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন, আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করছ না। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল। (আবু সা‘ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি তাকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ বলে ধারণা করছি। কিন্তু নবী (ছাঃ) তাকে নিষেধ করলেন। অতঃপর যখন অভিযোগকারী লোকটি ফিরে গেল, তখন নবী (ছাঃ) বললেন, এ ব্যক্তির বংশ হতে বা এ ব্যক্তির পরে এমন কিছু সংখ্যক লোক হবে তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন হতে তারা এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমনি ধনুক হতে তীর বেরিয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে আর মুর্তি পূজারীদেরকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে। আমি যদি তাদেরকে পেতাম তাহলে তাদেরকে আদ জাতির মত অবশ্যই হত্যা করতাম।[8]
(৫) দাস মুক্তির জন্য : যারা লিখিত কোন চুক্তির বিনিময়ে দাসে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে মালিকের নিকট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়। অনুরূপভাবে বর্তমানে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমদের হাতে বন্দি হলে সে ব্যক্তিও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে।[9]
হাদীছে এসেছে,
عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ دُلَّنِيْ عَلَى عَمَلٍ يُقَرِّبُنِيْ مِنَ الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُنِيْ مِنَ النَّارِ قَالَ لَئِنْ كُنْتَ أَقْصَرْتَ الْخُطْبَةَ لَقَدْ أَعْرَضْتَ الْمَسْأَلَةَ أَعْتِقِ النَّسَمَةَ وَفُكَّ الرَّقَبَةَ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَوَلَيْسَا وَاحِدًا قَالَ لاَ عِتْقُ النَّسَمَةِ أَنْ تُفْرِدَ بِعِتْقِهَا وَفَكُّ الرَّقَبَةِ أَنْ تُعِيْنَ فِيْ ثَمَنِهَا وَالْمِنْحَةُ الْوَكُوْفُ وَالْفَىْءُ عَلَى ذِى الرَّحِمِ الظَّالِمِ فَإِنْ لَمْ تُطِقْ ذَلِكَ فَكُفَّ لِسَانَكَ إِلاَّ مِنْ خَيْرٍ-
বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, প্রশ্ন তো তুমি অল্প কথায় বলে ফেললে; কিন্তু তুমি অত্যন্ত ব্যাপক বিষয় জানতে চেয়েছ। তুমি একটি প্রাণী আযাদ করে দাও এবং একটি দাস মুক্ত করে দাও। লোকটি বলল, এ উভয়টি কি একই কাজ নয়? তিনি বললেন, না (উভয়টি এক নয়)। কেননা একটি প্রাণী আযাদ করার মানে হল, তুমি একাকী গোটা প্রাণীকে মুক্ত করে দিবে। আর একটি দাস মুক্ত করার অর্থ হল, তার মুক্তির জন্য কিছু মূল্য প্রাদানের মাধ্যমে সাহায্য করবে। (এদ্ভিন্ন জান্নাতে প্রবেশকারী কাজের মধ্যে অন্যতম হল) প্রচুর দুধ প্রদানকারী জানোয়ার দান করা এবং এমন নিকটতম আত্নীয়ের প্রতি অনুগ্রহ করা, যে তোমার উপর অত্যাচারী। যদি তুমি এ সমস্ত কাজ করতে সক্ষম না হও, ক্ষুদার্থকে খাদ্য দান কর এবং পিপাসিতকে পানি পান করাও। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর। আর যদি তোমার দ্বারা এ কাজ করাও সম্ভব না হয়, তবে কল্যাণকর কথা ব্যতীত অন্য কথা থেকে তোমার জিহবাকে সংযত রাখ।[10]
উল্লিখিত হাদীছে ইসলাম দাসমুক্তিকে জান্নাত লাভের বিশেষ মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করেছে। আর দাসমুক্তির জন্য যেহেতু প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, সেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস যাকাত বণ্টনের খাত সমূহের মধ্যে দাসমুক্তিকে উল্লেখ করেছেন।
(৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ قَبِيصَةَ بْنِ مُخَارِقٍ الْهِلاَلِىِّ قَالَ تَحَمَّلْتُ حَمَالَةً فَأَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَسْأَلُهُ فِيْهَا فَقَالَ أَقِمْ حَتَّى تَأْتِيَنَا الصَّدَقَةُ فَنَأْمُرَ لَكَ بِهَا قَالَ ثُمَّ قَالَ يَا قَبِيْصَةُ إِنَّ الْمَسْأَلَةَ لاَ تَحِلُّ إِلاَّ لأَحَدِ ثَلاَثَةٍ رَجُلٍ تَحَمَّلَ حَمَالَةً فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيْبَهَا ثُمَّ يُمْسِكُ وَرَجُلٍ أَصَابَتْهُ جَائِحَةٌ اجْتَاحَتْ مَالَهُ فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيْبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ وَرَجُلٍ أَصَابَتْهُ فَاقَةٌ حَتَّى يَقُوْمَ ثَلاَثَةٌ مِنْ ذَوِى الْحِجَا مِنْ قَوْمِهِ لَقَدْ أَصَابَتْ فُلاَنًا فَاقَةٌ فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيْبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ فَمَا سِوَاهُنَّ مِنَ الْمَسْأَلَةِ يَا قَبِيْصَةُ سُحْتًا يَأْكُلُهَا صَاحِبُهَا سُحْتًا-  
কাবীছা ইবনু মাখারেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি কিছু ঋণের যিম্মাদার হয়েছিলাম। অতএব এ ব্যাপারে কিছু চাওয়ার জন্য আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, (মদ্বীনায়) আবস্থান কর যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট যাকাতের মাল না আসে। তখন আমি তা হতে তোমাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দান করব। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, মনে রেখ হে কাবীছা! তিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল নয়। (১) যে ব্যক্তি কোন ঋণের যিম্মাদার হয়েছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তা পরিশোধ করে। তারপর তা বন্ধ করে দিবে। (২) যে ব্যক্তি কোন বালা মুছীবতে আক্রান্ত হয়েছে যাতে তার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না তার প্রয়োজন পূর্ণ করার মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কোন কিছু লাভ করে এবং (৩) যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত হয়েছে এমনকি তার প্রতিবেশীদের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন তিন জন ব্যক্তি তার দারিদ্র্যের ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করেছে তার জন্য (যাকাতের মাল থেকে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তার জীবিকা নির্বাহের মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কিছু লাভ করে। হে কাবীছা! এরা ব্যতীত যারা (যাকাতের মাল থেকে) চায় তারা হারাম খাচ্ছে।[11]
(৭) আল্লাহর রাস্তায় : আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে যে কোন ধরনের প্রচেষ্টা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বা আল্লাহর রাস্তার অন্তর্ভুক্ত। জিহাদ, দ্বীনী ইলম অর্জনের যাবতীয় পথ এবং দ্বীন প্রচারের যাবতীয় মাধ্যম এ খাতের অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে এসেছে,
আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[12]
(৮) মুসাফির : সফরে গিয়ে যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে যাকাতের অর্থ দান করা যাবে। এক্ষেত্রে উক্ত মুসাফির সম্পদশালী হলেও তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।

প্রশ্ন ২৫ : তারাবীর নামায কত রাকাত

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।  

আলেমদের ইজতিহাদনির্ভর মাসয়ালাগুলো নিয়ে কোন মুসলিমের সংবেদনশীল আচরণ করাকে আমরা সমীচীন মনে করি না। যে আচরণের কারণে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ ও ফিতনা সৃষ্টি হয়।
শাইখ ইবনে উছাইমীন রহিমাহুল্লাহকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যিনি ইমামের সাথে ১০ রাকাত তারাবী নামায পড়ে বিতিরের নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকেন, ইমামের সাথে অবশিষ্ট তারাবী নামায পড়েন না, তখন তিনি বলেন:
“এটি খুবই দুঃখজনক যে, আমরা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এমন একটি দল দেখি যারা ভিন্ন মতের সুযোগ আছে এমন বিষয় নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেন। এই ভিন্ন মতকে তারা অন্তরগুলোর বিচ্ছেদের কারণ বানিয়ে ফেলেন। সাহাবীদের সময়েও এই উম্মতের মাঝে মতভেদ ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের অন্তরগুলো ছিল ঐক্যবদ্ধ। তাই দ্বীনদারদের কর্তব্য, বিশেষভাবে যুব-সমাজের কর্তব্য হচ্ছে- ঐক্যবদ্ধ থাকা। কারণ শত্রুরা তাদেরকে নানারকম ফাঁদে ফেলানোর জন্য ওঁত পেতে বসে আছে।”[আশ-শারহুল মুমতি‘ (৪২২৫)]
এই মাসয়ালার ব্যাপারে দুই পক্ষই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে। প্রথম পক্ষের লোকেরা যারা ১১  রাকাতের বেশি তারাবী পড়েন তাদের আমলকে একেবারে অস্বীকার করে এ আমলকে বিদআত আখ্যায়িত করেন। আর দ্বিতীয় পক্ষের লোকেরা যারা শুধু ১১ রাকাতে সীমাবদ্ধ থাকেন তাদের আমলকে অস্বীকার করে বলেন: তারা ইজমা‘ এর খেলাফ করছে।
চলুন আমরা এ ব্যাপারে শাইখ ইবনে উছাইমীন রহিমাহুল্লাহ এর উপদেশ শুনি, বলেন:
“এ ক্ষেত্রে আমরা বলব: বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা কোনটাই উচিত নয়। কেউ কেউ আছেন সুন্নাহ্ তে বর্ণিত সংখ্যা মানার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেন এবং বলেন: সুন্নাহ্ তে যে সংখ্যার বর্ণনা এসেছে তা থেকে বাড়ানো নাজায়েয। যে ব্যক্তি সে সংখ্যার বেশী তারাবী পড়ে তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, সে গুনাহগার ও সীমালঙ্ঘণকারী।
এই দৃষ্টিভঙ্গি যে ভুল এতে কোন সন্দেহ নেই। কিভাবে সে ব্যক্তি গুনাহগার বা সীমালঙ্ঘণকারী হবে যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লামকে রাতের সালাত (কিয়ামুল লাইল) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন:দুই রাকাত দুই রাকাত তিনি তো কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেননি। এ কথা সবারই জানা আছে যে,যেই সাহাবী রাতের সালাত সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি রাতের নামাযের সংখ্যা জানতেন না। কারণ যিনি সালাতের পদ্ধতিই জানেন না,রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে তার না-জানবারই কথা। আর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সেবকও ছিলেন না যে আমরা এ কথা বলব- তিনি রাসূলের বাসার ভিতরের আমল কি সেটা জানতেন। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সাহাবীকে কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেননি, শুধু সালাতের পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন,এতে জানা গেল যে, এ বিষয়টি উন্মুক্ত। সুতরাং যে কেউ ইচ্ছা করলে ১০০ রাকাত তারাবীর নামায ও ১ রাকাত  বিতির নামায আদায় করতে পারেন।
আর রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বাণী :
 صلوا كما رأيتموني أصلي 
"তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখলে সেভাবে সালাত আদায় কর।"
এই হাদিসটির বিধান সাধারণ নয়; এমনকি এ মতাবলম্বীদের নিকটও নয়। তাই তো তারা কোন ব্যক্তির উপর একবার ৫ রাকাত,একবার ৭ রাকাত, অন্যবার ৯ রাকাত বিতির আদায় করা ওয়াজিব বলেন না। আমরা যদি এ হাদিসকে সাধারণভাবে গ্রহণ করি তাহলে আমাদেরকে বলতে হবে যে বিতিরের নামায কোনবার ৫ রাকাত, কোনবার ৭ রাকাত এবং কোনবার ৯ রাকাত আদায় করা ওয়াজিব। বরং তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখলে সেভাবে সালাত আদায় কর-এ হাদিস দ্বারা সালাত আদায়ের পদ্ধতি বুঝানো উদ্দেশ্য; সালাতের রাকাত সংখ্যা নয়। তবে রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে এমন অন্য কোন দলীল পাওয়া গেলে সেটা ভিন্ন কথা।
যাই হোক, যে বিষয়ে শরিয়তে প্রশস্ততা আছে সে বিষয়ে কারো উপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। ব্যাপারটি এ পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, আমরা দেখেছি কিছু ভাই এ বিষয়টি নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি করেন যে, যেসব ইমাম ১১ রাকাতের বেশি তারাবী নামায পড়েন এরা তাদের উপর বিদআতের অপবাদ দেন এবং (১১ রাকাতের পর) মসজিদ ত্যাগ করেন। এতে করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বর্ণিত সওয়াব থেকে বঞ্চিত হন। তিনি বলেছেন: ইমাম নামায শেষ করা পর্যন্ত যে ব্যক্তি ইমামের সাথে কিয়ামুল লাইল (রাতের নামায) পড়বে তার জন্য সম্পূর্ণ রাতে নামায পড়ার সওয়াব লেখা হবে[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযি (৮০৬) এবং ‘সহীহুত তিরমিযি গ্রন্থে (৬৪৬)আলবানী হাদিসটিকে সহীহ্ আখ্যায়িত করেছেন] এ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে অনেকে ১০ রাকাত বিতির আদায় করে বসে থাকে; ফলে কাতার ভঙ্গ হয়। আবার কখনও তারা কথাবার্তা বলে; যার ফলে মুসল্লিদের সালাতে অসুবিধা হয়।
আমরা এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ পোষণ করছি না যে তাঁরা ভাল চাচ্ছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁরা মুজতাহিদ; কিন্তু সব মুজতাহিদ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন না।
আর দ্বিতীয় পক্ষটি প্রথম পক্ষের সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা ১১ রাকাতের মধ্যে তারাবীকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান— এরা তাদের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, তুমি ইজমা থেকে বের হয়ে গেছ। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: "আর যে তার কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে আমি তাকে সেদিকে পরিচালিত করব যে দিকে সে অভিমুখী হয় এবং আমি তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর তা কতই না খারাপ প্রর্ত্যাবর্তন।"[সূরা আন-নিসা, ৪:১১৫]
তারা বলেন যে, আপনার আগে যারা অতিবাহিত হয়েছেন তাঁরা শুধু ২৩ রাকাত তারাবীই জানতেন। এরপর তারা বিপক্ষবাদীদের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। এটাও ভুল।[আশশারহুল মুমতি (৩/৭৩-৭৫)]
যারা ৮ রাকাতের বেশি তারাবীর নামায পড়া নাজায়েয মনে করেন তারা যে দলীল দেন সেটা হলো আবু সালামাহ্ ইবনে আব্দুর রহমান এর হাদিস যাতে তিনি আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে প্রশ্ন করেছিলেন: “রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে বা রমজানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি আদায় করতেন না। তিনি ৪  রাকাত সালাত আদায় করতেন- এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না (অর্থাৎ তা এতই সুন্দর ও দীর্ঘ হত) এরপর তিনি আরো ৪ রাকাত  সালাত আদায় করতেন-এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না (অর্থাৎ তা এতই সুন্দর ও দীর্ঘ হত) এরপর তিনি ৩ রাকাত সালাত আদায় করতেন। আমি বলতাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি বিতির পড়ার আগে  ঘুমিয়ে যাবেন?” তিনি বলতেন: হে আয়েশা! আমার চোখ দুটি ঘুমালেও অন্তর ঘুমায় না[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (১৯০৯) ও ইমাম মুসলিম (৭৩৮)]
তারা বলেন: এই হাদিসটি নির্দেশ করছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে ও রমজানের বাইরে রাতের বেলা নিয়মিত এভাবেই সালাত আদায় করতেন। আলেমগণ এ হাদিস দিয়ে দলীলের বিপক্ষে বলেন যে, এই হাদিসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল সাব্যস্ত করছে। কিন্তু কোন আমল দ্বারা তো ওয়াজিব সাব্যস্ত করা যায় না।
আর রাতের সালাত (এর মধ্যে তারাবীর নামাযও শামিল) যে কোন সংখ্যার মধ্যে সুনির্দিষ্ট নয় এ ব্যাপারে বর্ণিত স্পষ্ট দলীলগুলোর মধ্যে একটি হলো ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস- “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লামকে রাতের সালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: রাতের সালাত দুই রাকাত, দুই রাকাতআপনাদের মধ্যে কেউ যদি ফজরের ওয়াক্ত য়ে যাওয়ার আশংকা করেতবে তিনি যেন আরো এক রাকাত নামায পড়ে নেন। যাতে করে এ রাকাতটি পূর্বে আদায়কৃত সংখ্যাকে বিতির (বেজোড়) করে দেয়।[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন,ইমাম বুখারী (৯৪৬)ও ইমাম মুসলিম (৭৪৯)]
বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ফিক্বহী মাজহাবের আলেমগণের মতামতের দিকে দৃষ্টি দিলে পরিষ্কার হয় যে, এ বিষয়ে প্রশস্ততা আছে। ১১ রাকাতের অধিক রাকাত তারাবী পড়তে দোষের কিছু নেই।
হানাফী মাজহাবের আলেম ইমাম আস্‌সারখাসী বলেন: “আমাদের মতে বিতির ছাড়া তারাবী ২০ রাকাত ।”[আল্‌মাবসুত (২/১৪৫)]
ইবনে ক্বুদামাহ বলেন: “আবু-আবদুল্লাহ অর্থাৎ ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর কাছে পছন্দনীয় মত হলো তারাবী ২০ রাকাত। এই মতে আরো রয়েছেন ইমাম ছাওরী, ইমাম আবু-হানীফা ও ইমাম শাফেয়ী। আর ইমাম মালেক বলেছেন: “তারবীহ ৩৬ রাকাত।”[আলমুগনী (১/৪৫৭)]
ইমাম নববী বলেছেন:
“আলেমগণের ইজমা অনুযায়ী তারাবীর সালাত পড়া সুন্নত। আর আমাদের মাজহাব হচ্ছে- তারাবীর নামায ১০ সালামে ২০ রাকাত। একাকী পড়াও জায়েয, জামাতের সাথে পড়াও জায়েয।”[আলমাজমূ (৪/৩১)]
এই হচ্ছে তারাবী নামাযের রাকাতের সংখ্যার ব্যাপারে চার মাজহাবের অভিমত। তাঁদের সবাই ১১ রাকাতের বেশী পড়ার ব্যাপারে  বলেছেন। সম্ভবত যে কারণে তাঁরা ১১ রাকাতের বেশি পড়ার কথা বলেছেন সেটা হলো:
১.তাঁরা দেখেছেন যে, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এর হাদিস নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নির্ধারণ করে না।
২.পূর্ববর্তী সাহাবী ও তাবেয়ীগণের অনেকের কাছ থেকে ১১ রাকাতের বেশি তারাবী পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।[আল-মুগনী (২/৬০৪)ও আল-মাজমূ (৪/৩২)]
৩.নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ১১ রাকাত সালাত আদায় করতেন তা এত দীর্ঘ করতেন যে এতে পুরো রাত লেগে যেত। এমনও ঘটেছে এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি  ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে তারাবীর সালাত আদায় করতে করতে ফজর হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে শেষ করেছিলেন। এমনকি সাহাবীগণ সেহেরী খেতে না-পারার আশঙ্কা করেছিলেন। সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে সালাত আদায় করতে পছন্দ করতেন এবং এটা তাঁদের কাছে দীর্ঘ মনে হত না। কিন্তু আলেমগণ খেয়াল করলেন ইমাম যদি এভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে সালাত আদায় করেন তবে মুসল্লিদের জন্য তা কষ্টকর হবে। যা তাদেরকে তারাবীর নামায থেকে বিমুখ করতে পারে। তাই তাঁরা তেলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে রাকাত সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে মত দিলেন।
সার কথা হলো- যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত পদ্ধতিতে ১১ রাকাত  সালাত পড়েন সেটা ভাল এবং এতে সুন্নাহ পালন হয়। আর যিনি তেলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে রাকাতের সংখ্যা বাড়িয়ে পড়েন সেটাও ভাল। যিনি এই দুইটির কোন একটি করেন তাঁকে নিন্দা করার কিছু নেই।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন:
“যিনি ইমাম আবু হানীফা শাফেয়ী ও আহমাদের মাজহাব অনুসারে ২০ রাকাত তারাবী সালাত আদায় করল অথবা ইমাম মালেকের মাজহাব অনুসারে ৩৬  রাকাত তারাবী আদায় করল অথবা ১৩ বা ১১ রাকাত তারাবী আদায় করল প্রত্যেকেই ভাল আমল করল। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকার কারণে ইমাম আহমাদ এ মতই পোষণ করতেন। তাই তেলাওয়াত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করার অনুপাত অনুযায়ী রাকাত  সংখ্যা বেশি বা কম হবে।”[আল-ইখতিয়ারাত, পৃষ্ঠা- ৬৪]
আস-সুয়ুতী বলেছেন:
“রমজানে ক্বিয়াম তথা রাতের নামায আদায় করার আদেশ দিয়ে ও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে অনেক সহীহ ও হাসান হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন সংখ্যাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকাত তারাবী পড়েছেন বলে সাব্যস্ত হয়নি। বরং তিনি রাতে সালাত আদায় করেছেন। কিন্তু কত রাকাত আদায় করেছেন এই সংখ্যা উল্লেখিত হয়নি। এরপর ৪র্থ রাতে দেরি করলেন এই আশঙ্কায় যে তারাবীর সালাত তাঁদের উপর ফরয করে দেয়া হতে পারে, পরে তাঁর উম্মত তা পালন করতে অসমর্থ হবেন।”
ইবনে হাজার হাইসামী বলেছেন:
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তারাবীর সালাত ২০ রাকাত হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়নি। আর এই ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে- “তিনি ২০ রাকাত সালাত আদায় করতেন; তা অত্যন্ত জয়ীফ (দুর্বল)।”[আল্‌মাওসূ‘আহ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (২৭/১৪২-১৪৫)]
অতএব প্রশ্নকারী ভাই, আপনি তারাবীর সালাত ২০ রাকাত হওয়ার ব্যাপারে অবাক হবেন না। কারণ এর আগে ইমামগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা পালন করেছেন। আর তাঁদের সবার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।

প্রশ্ন ২৪ : তাওহীদ কাকে বলে? উহা কত প্রকার ও কি কি?


তাওহীদ শব্দটি (وحد) ক্রিয়ামূল থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ কোন জিনিসকে একক হিসাবে নির্ধারণ করা। ‘না’ বাচক ও ‘হ্যাঁ’ বাচক উক্তি ব্যতীত এটির বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ একককৃত বস্ত ব্যতীত অন্য বস্ত হতে কোন বিধানকে অস্বীকার করে একককৃত বস্তর জন্য তা সাব্যস্ত করা। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলব, “আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা’বূদ নেই” একথার সাক্ষ্য দেয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তির তাওহীদ পূর্ণ হবে না। যে ব্যক্তি এই সাক্ষ্য প্রদান করবে, সে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত হতে উলুহিয়্যাতকে (ইবাদত) অস্বীকার করে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করবে। কারণ শুধুমাত্র নাফী বা ‘না’ বাচক বাক্যের মাধ্যমে কোন বস্তকে গুণাগুণ থেকে মুক্ত করা হয়। আর শুধুমাত্র ‘হ্যাঁ’ বাচক বাক্যের মাধ্যমে কোন বস্তর জন্য কোন বিধান সাব্যস্ত করলে সেই বিধানে অন্যের অংশ গ্রহণকে বাধা প্রদান করে না। যেমন উদাহরণ স্বরূপ যদি আপনি বলেন, ‘অমুক ব্যক্তি দাঁড়ানো’। এই বাক্যে আপনি তার জন্য দন্ডায়মান হওয়াকে সাব্যস্ত করলেন। তবে আপনি তাকে দন্ডায়মান গুণের মাধ্যমে একক হিসাবে সাব্যস্ত করলেন না। হতে পারে এই গুণের মাঝে অন্যরাও শরীক আছে। অর্থাৎ অমুক ব্যক্তির সাথে অন্যান্য ব্যক্তিগণও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আর যদি বল, “যায়েদ ব্যতীত আর কেউ দাঁড়ানো নেই” তবে আপনি দন্ডায়মান হওয়াকে শুধুমাত্র যায়েদের সাথে সীমিত করে দিলেন। এই বাক্যে আপনি দন্ডায়মানের মাধ্যমে যায়েদকে একক করে দিলেন এবং দাঁড়ানো গুণটিকে যায়েদ ব্যতীত অন্যের জন্য হওয়াকে অস্বীকার করলেন। এভাবেই তাওহীদের প্রকৃত রূপ বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ নাফী (না বোধক) ও ইছবাত (হ্যাঁ বোধক) বাক্যের সমন্বয় ব্যতীত তাওহীদ কখনো প্রকৃত তাওহীদ হিসাবে গণ্য হবে না। মুসলিম বিদ্বানগণ তাওহীদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন।

১) তাওহীদুর্‌ রুবূবীয়্যাহ

২) তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ

৩) তাওহীদুল আসমা অস্‌ সিফাত

কুরআন ও হাদীছ গভীরভাবে গবেষণা করে আলেমগণ এই সিদ্ধানে- উপনীত হয়েছেন যে, তাওহীদ উপরোক্ত তিন প্রকারের মাঝে সীমিত।

প্রথমতঃ তাওহীদে রুবূবীয়্যার বিস্তারিত পরিচয়ঃ

সৃষ্টি, রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও পরিচালনায় আল্লাহকে এক হিসাবে বিশ্বাস করার নাম তাওহীদে রুবূবীয়্যাহ্‌।

১- সৃষ্টিতে আল্লাহর একত্বঃ 

আল্লাহ একাই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
) هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالاَرْضِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ (
“আল্লাহ ছাড়া কোন স্রষ্টা আছে কি? যে তোমাদেরকে আকাশ ও জমিন হতে জীবিকা প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা’বূদ নেই।” (সূরা ফাতিরঃ ৩) কাফিরদের অন্তসার শুন্য মা’বূদদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আল্লাহ বলেন,
)أَفَمَنْ يَخْلُقُ كَمَنْ لاَ يَخْلُقُ أَفَلاَ تَذَكَّرُوْنَ(
“সুতরাং যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তারই মত, যে সৃষ্টি করে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?” (সূরা নাহলঃ ১৭) সুতরাং আল্লাহ তাআ’লাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি সকল বস্ত সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআ’লার কর্ম এবং মাখলুকাতের কর্ম সবই আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। তাই আল্লাহ তাআ’লা মানুষের কর্মসমূহও সৃষ্টি করেছেন্ত একথার উপর ঈমান আনলেই তাকদীরের উপর ঈমান আনা পূর্ণতা লাভ করবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
)وَ اللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُوْنَ(
“আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমাদের কর্মসমূহকেও সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আস্তসাফ্‌ফাতঃ ৯৬) মানুষের কাজসমূহ মানুষের গুণের অন্তর্ভুক্ত। আর মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। কোন জিনিষের স্রষ্টা উক্ত জিনিষের গুণাবলীরও স্রষ্টা।
যদি বলা হয় আল্লাহ ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রেও তো সৃষ্টি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
)تَبَارَكَ اللَّهُ اَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ (
“আল্লাহ সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে উত্তম সৃষ্টিকর্তা।” (সূরা মুমিনূনঃ ১৪) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কিয়ামতের দিন ছবি অংকনকারীদেরকে বলা হবে, তোমরা দুনিয়াতে যা সৃষ্টি করেছিলে, তাতে রূহের সঞ্চার কর। উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর এই যে, আল্লাহর মত করে কোন মানুষ কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম। মানুষের পক্ষে কোন অসি-ত্বহীনকে অসি-ত্ব দেয়া সম্ভব নয়। কোন মৃত প্রাণীকেও জীবন দান করা সম্ভব নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্যের তৈরী করার অর্থ হল নিছক পরিবর্তন করা এবং এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত করা মাত্র। মূলতঃ তা আল্লাহরই সৃষ্টি। ফটোগ্রাফার যখন কোন বস্তর ছবি তুলে, তখন সে উহাকে সৃষ্টি করে না। বরং বস্তটিকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করে মাত্র। যেমন মানুষ মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি তৈরী করে এবং অন্যান্য জীব-জন্তু বানায়। সাদা কাগজকে রঙ্গীন কাগজে পরিণত করে। এখানে মূল বস্ত তথা কালি, রং ও সাদা কাগজ সবই তো আল্লাহর সৃষ্টি। এখানেই আল্লাহর সৃষ্টি এবং মানুষের সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।

২- রাজত্বে আল্লাহর একত্বঃ

মহান রাজাধিরাজ একমাত্র আল্লাহ তাআ’লা। তিনি বলেনঃ
)تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(
“সেই মহান সত্বা অতীব বরকতময়, যার হাতে রয়েছে সকল রাজত্ব। আর তিনি প্রতিটি বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।” (সূরা মুলকঃ ১) আল্লাহ আরো বলেন,
)قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ(
“হে নবী! আপনি জিজ্ঞাসা করুন, সব কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে? যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার উপর কোন আশ্রয় দাতা নেই।” (সূরা মুমিনূনঃ ৮৮) সুতরাং সর্ব সাধারণের বাদশাহ একমাত্র আল্লাহ তাআ’লা। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে বাদশাহ বলা হলে তা সীমিত অর্থে বুঝতে হবে। আল্লাহ তাআ’লা অন্যের জন্যেও রাজত্ব ও কর্তৃত্ব সাব্যস্ত করেছেন। তবে তা সীমিত অর্থে। যেমন তিনি বলেন,
)أَوْ مَا مَلَكْتُمْ مَفَاتِحَهُ(
“অথবা তোমরা যার চাবি-কাঠির (নিয়ন্ত্রনের) মালিক হয়েছো।” (সূরা নূরঃ ৬১)
আল্লাহ আরো বলেনঃ
)إِلا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ(
“তবে তোমাদের স্ত্রীগণ অথবা তোমাদের আয়ত্বধীন দাসীগণ ব্যতীত।” (সূরা মুমিনূনঃ ৬) আরো অনেক দলীলের মাধ্যমে জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও রাজত্ব রয়েছে। তবে এই রাজত্ব আল্লাহর রাজত্বের মত নয়। সেটা অসম্পূর্ণ রাজত্ব। তা ব্যাপক রাজত্ব নয়। বরং তা একটা নির্দিষ্ট সীমা রেখার ভিতরে। তাই উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, যায়েদের বাড়ীতে রয়েছে একমাত্র যায়েদেরই কর্তৃত্ব ও রাজত্ব। তাতে আমরের হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নেই এবং বিপরীত পক্ষে আমরের বাড়ীতে যায়েদও কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তারপরও মানুষ আপন মালিকানাধীন বস্তর উপর আল্লাহ প্রদত্ত নির্ধারিত সীমা-রেখার ভিতরে থেকে তাঁর আইন্তকানুন মেনেই রাজত্ব করে থাকে। এজন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অকারণে সম্পদ বিনষ্ট করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمْ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيَامًا(
“যে সমস্ত ধন্তসম্পদ আল্লাহ তোমাদের জীবন ধারণের উপকরণ স্বরূপ দান করেছেন, তা তোমরা নির্বোধ লোকদের হাতে তুলে দিওনা।” (সূরা নিসাঃ ৫) মানুষের রাজত্ব ও মুলূকিয়ত খুবই সীমিত। আর আল্লাহর মালিকান ও রাজত্ব সর্বব্যাপী এবং সকল বস্তকে বেষ্টনকারী। তিনি তাঁর রাজত্বে যা ইচ্ছা, তাই করেন। তাঁর কর্মের কৈফিয়ত তলব করার মত কেউ নেই। অথচ সকল মানুষ তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

৩- পরিচালনায় আল্লাহর একত্বঃ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক ও অদ্বিতীয় ব্যবস্থাপক এবং পরিচালক। তিনি সকল মাখলূকাত এবং আসমান্তযমিনের সব কিছু পরিচালনা করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
)أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ(
“সৃষ্টি করা ও আদেশ দানের মালিক একমাত্র তিনি। বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলা অতীব বরকতময়।” (সূরা আ’রাফঃ ৫৪) আল্লাহর এই পরিচালনা সর্বব্যাপী। কোন শক্তিই আল্লাহর পরিচালনাকে রুখে দাঁড়তে পারে না। কোন কোন মাখলূকের জন্যও কিছু কিছু পরিচালনার অধিকার থাকে। যেমন মানুষ তার ধন্তসম্পদ, সন্তান্তসন্ততি এবং কর্মচারীদের উপর কর্তৃত্ব করে থাকে। কিন্তু এ কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট একটি সীমার ভিতরে। উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হল যে, তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অর্থ সৃষ্টি, রাজত্ব এবং পরিচালনায় আল্লাহকে একক হিসাবে বিশ্বাস করা।

দ্বিতীয়তঃ তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ্‌ঃ

এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার নাম তাওহীদে উলুহীয়্যাহ। মানুষ যেভাবে আল্লাহর এবাদত করে এবং নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে, অনুরূপ অন্য কাউকে এবাদতের জন্য গ্রহণ না করা। তাওহীদে উলুহীয়্যাতের ভিতরেই ছিল আরবের মুশরিকদের গোমরাহী। এ তাওহীদে উলূহিয়াকে ক্রেন্দ্র করেই তাদের সাথে জিহাদ করে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের জান্তমাল, ঘরবাড়ী ও জমি-জায়গা হরণ হালাল মনে করেছিলেন। তাদের নারী-শিশুদেরকে দাস্তদাসীতে পরিণত করেছিলেন। এই প্রকার তাওহীদ দিয়েই আল্লাহ তাআ’লা রাসূলগণকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সমস্ত আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। যদিও তাওহীদে রুবূবীয়্যাত এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্‌ সিফাতও নবীদের দাওয়াতের বিষয়বস্ত ছিল, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই নবীগণ তাদের স্বজাতীয় লোকদেরকে তাওহীদে উলুহীয়্যার প্রতি আহবান জানাতেন। মানুষ যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য এবাদতের কোন অংশই পেশ না করে, সদাসর্বদা রাসূলগণ তাদের উম্মতদেরকে এই আদেশই দিতেন। চাই সে হোক নৈকট্যশীল ফেরেশতা, আল্লাহর প্রেরিত নবী, আল্লাহর সৎকর্মপরায়ণ অলী বা অন্য কোন মাখলুক। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও এবাদত করা বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এই প্রকার তাওহীদে ত্রুটি করবে, সে কাফির মুশরিক। যদিও সে তাওহীদে রুবূবীয়াহ এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্‌ সিফাতের স্বীকৃতী প্রদান করে থাকে। সুতরাং কোন মানুষ যদি এ বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকারী, একমাত্র মালিক এবং সব কিছুর পরিচালক, কিন্তু আল্লাহর এবাদতে যদি অন্য কাউকে শরীক করে, তবে তার এই স্বীকৃতী ও বিশ্বাস কোন কাজে আসবে না। যদি ধরে নেয়া হয় যে, একজন মানুষ তাওহীদে রুবূবীয়াতে এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্‌ সিফাতে পূর্ণ বিশ্বাস করে, কিন্তু সে কবরের কাছে যায় এবং কবরবাসীর এবাদত করে কিংবা তার জন্য কুরবানী পেশ করে বা পশু জবেহ করে তাহলে সে কাফির এবং মুশরিক। মৃত্যুর পর সে হবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
)إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ(
“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হবে, আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা মায়িদাঃ ৭২) কুরআনের প্রতিটি পাঠকই একথা অবগত আছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সমস্ত কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, তাদের জান্তমাল হালাল মনে করেছেন এবং তাদের নারী-শিশুকে বন্দী করেছেন ও তাদের দেশকে গণীমত হিসাবে দখল করেছেন, তারা সবাই একথা স্বীকার করত যে, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তারা এতে কোন সন্দেহ পোষণ করত না। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে অন্যেরও উপাসনা করত, তাই তারা মুশরিক হিসাবে গণ্য হয়েছে এবং তাদের জান্তমাল হরণ হালাল বিবেচিত হয়েছে।

তৃতীয়তঃ তাওহীদুল্‌ আসমা ওয়াস্‌ সিফাতঃ

তাওহীদুল্‌ আসমা ওয়াস্‌ সিফাতের অর্থ হল, আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাবে নিজেকে যে সমস্ত গুণে গুণাম্বিত করেছেন সে সমস্ত নাম ও গুণাবলীতে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় হিসাবে মেনে নেওয়া। আল্লাহ নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, তাতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, তার ধরণ বর্ণনা এবং কোন রূপ উদাহরণ পেশ করা ব্যতীত আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করার মাধ্যমেই এ তাওহীদ বাস্তবায়ন হতে পারে। সুতরাং আল্লাহ নিজেকে যে নামে পরিচয় দিয়েছেন বা নিজেকে যে গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছেন, তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। এ সমস্ত নাম ও গুণাবলীর আসল অর্থ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে তার উপর ঈমান আনতে হবে- কোন প্রকার ধরণ বর্ণনা করা বা দৃষ্টান্ত পেশ করা যাবেনা। এই প্রকারের তাওহীদে আহলে কিবলা তথা মুসলমানদের বিরাট একটি অংশ গোমরাহীতে পতিত হয়েছে। এক শ্রেণীর লোক আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকারের ক্ষেত্রে এতই বাড়াবাড়ি করেছে যে, এর কারণে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। আর এক শ্রেণীর লোক মধ্যম পন’া অবলম্বন করেছে। আর এক শ্রেণীর লোক আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কাছাকাছি। কিন্তু সালাফে সালেহীনের মানহাজ হল, আল্লাহ নিজের জন্য যে নাম নির্ধারণ করেছেন এবং নিজেকে যে সবগুণে গুণাম্বিত করেছেন, সে সব নাম ও গুণাবলীরর উপর ঈমান আনয়ন করতে হবে।
লিংক

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...