যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
(৪র্থ কিস্তি)
স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত
‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে আর বলা হবে, এটাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর’ (তওবা ৯/৩৪-৩৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَا مِنْ
صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلاَ فِضَّةٍ لاَ يُؤَدِّى مِنْهَا حَقَّهَا إِلاَّ إِذَا
كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحَ مِنْ نَارٍ
فَأُحْمِىَ عَلَيْهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ
وَجَبِيْنُهُ وَظَهْرُهُ كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيْدَتْ لَهُ فِىْ يَوْمٍ
كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ
الْعِبَادِ فَيُرَى سَبِيْلُهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى
النَّارِ-
‘প্রত্যেক স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক যে তার হক (যাকাত) আদায়
করে না, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরী করা হবে এবং সে
সমুদয়কে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগ
দেওয়া হবে। যখনই তা ঠান্ডা হয়ে যাবে তখন পুনরায় তাকে গরম করা হবে। (তার
সাথে এরূপ করা হবে) সেদিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। (তার এ
শাস্তি চলতে থাকবে) যতদিন না বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সে তার
পথ ধরবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে’।[1]
স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিছাব
স্বর্ণের নিছাব :
এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَلَيْسَ عَلَيْكَ شَىْءٌ يَعْنِيْ فِيْ الذَّهَبِ حَتَّى يَكُوْنَ لَكَ عِشْرُوْنَ دِيْنَارًا فَإِذَا كَانَ لَكَ عِشْرُوْنَ دِيْنَارًا وَحَالَ عَلَيْهَا الْحَوْلُ فَفِيْهَا نِصْفُ دِيْنَارٍ فَمَا زَادَ فَبِحِسَابِ ذَلِكَ- ‘বিশ দীনারের কম স্বর্ণে যাকাত ফরয নয়। যদি কোন ব্যক্তির নিকট ২০ দীনার পরিমাণ স্বর্ণ এক বছর যাবৎ থাকে তবে এর জন্য অর্ধ দীনার যাকাত দিতে হবে। এরপরে যা বৃদ্ধি পাবে তার হিসাব ঐভাবেই হবে’।[2]
উল্লেখ্য যে, হাদীছে বর্ণিত ১ দীনার সমান ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ। অতএব ২০ দীনার সমান ২০×৪.২৫=৮৫ গ্রাম স্বর্ণ। ১ ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম হ’লে, ৮৫÷১১.৬৬=৭.২৯ ভরি স্বর্ণ। অর্থাৎ কারো নিকটে উল্লিখিত পরিমাণ স্বর্ণ এক বছর যাবৎ থাকলে তার উপর বর্তমান বাজার মূল্যের হিসাবে মোট সম্পদের ২.৫০% যাকাত দেওয়া ফরয।
রৌপ্যের নিছাব :
রৌপ্যের নিছাব উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَلاَ فِيْ أَقَلَّ مِنْ خَمْسِ أَوَاقٍ مِنَ الْوَرِقِ صَدَقَةٌ ‘পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রৌপ্যে যাকাত নেই’।[3]
উল্লেখ্য, ১ উকিয়া সমান ৪০ দিরহাম। অতএব ৫ উকিয়া সমান ৪০×৫=২০০ দিরহাম।
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, هَاتُوْا رُبْعَ الْعُشُوْرِ مِنْ كُلِّ أَرْبَعِيْنَ دِرْهَمًا دِرْهَمٌ وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ شَىْءٌ حَتَّى تَتِمَّ مِائَتَىْ دِرْهَمٍ فَإِذَا كَانَتْ مِائَتَىْ دِرْهَمٍ فَفِيْهَا خَمْسَةُ دَرَاهِمَ فَمَا زَادَ فَعَلَى حِسَابِ ذَلِكَ- ‘তোমরা প্রতি ৪০ দিরহামে ১ দিরহাম যাকাত আদায় করবে। ২০০ দিরহাম পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের প্রতি কিছুই ফরয নয়। ২০০ দিরহাম পূর্ণ হ’লে এর যাকাত হবে পাঁচ দিরহাম এবং এর অতিরিক্ত হ’লে তার যাকাত উপরোক্ত হিসাব অনুযায়ী প্রদান করতে হবে’।[4]
অত্র হাদীছে বর্ণিত ২০০ দিরহাম সমান ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য। ১ ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম হ’লে ৫৯৫ গ্রাম সমান ৫৯৫÷১১.৬৬=৫১.০২ ভরি রৌপ্য হয়। উক্ত পরিমাণ রৌপ্য কারো নিকটে এক বছর যাবৎ থাকলে তার উপর বর্তমান বাজার মূল্যের হিসাবে মোট সম্পদের ২.৫০% যাকাত আদায় করা ফরয।
স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয়টি মিলে নিছাব পরিমাণ হ’লে যাকাত ফরয হবে কি? :
কারো নিকটে স্বর্ণ ও রৌপ্য পৃথকভাবে কোনটিই নিছাব পরিমাণ নেই। কিন্তু উভয়টি মিলে নিছাব পরিমাণ হয়। এক্ষণে তার উপর যাকাত ফরয হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হ’ল, স্বর্ণ ও রৌপ্য দু’টি ভিন্ন বস্ত্ত। একটি অপরটির নিছাব পূর্ণ করতে সক্ষম নয়। সুতরাং এ দু’টি পৃথকভাবে নিছাব পরিমাণ না হ’লে যাকাত ফরয নয়।[5]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রৌপ্যে যাকাত নেই’।[6] তিনি অন্যত্র বলেন, ‘বিশ দীনারের কম স্বর্ণে যাকাত ফরয নয়’।[7]
উল্লিখিত হাদীছ দু’টিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিছাব আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। কারণ দু’টি বস্ত্ত অভিন্ন নয় বরং আলাদা। অতএব পৃথকভাবে দু’টির নিছাব পূর্ণ হ’লেই কেবল যাকাত ফরয হবে। অন্যথা ফরয নয়।
যাকাত ফরয় হওয়ার জন্য একক মালিকানায় নিছাব পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য থাকা শর্ত কি? :
কোন পরিবারে একাধিক ব্যক্তির মালিকানায় কিছু স্বর্ণ অথবা রৌপ্য রয়েছে যা পৃথকভাবে কারোরই নিছাব পরিমাণ হয় না। কিন্তু তাদের সকলের স্বর্ণ অথবা রৌপ্য একত্রিত করলে নিছাব পরিমাণ হয়। যেমন মায়ের ৫ ভরি ও মেয়ের ৩ ভরি স্বর্ণ রয়েছে যা আলাদাভাবে কারোরই নিছাব পরিমাণ নয়। কিন্তু মা ও মেয়ের স্বর্ণ একত্রিত করলে নিছাব পরিমাণ হয়। এমতাবস্থায় তাদের উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা যাকাত ফরয হওয়ার অন্যতম শর্ত হ’ল, ব্যক্তিকে নিছাব পরিমাণ সম্পদের পূর্ণ মালিক হ’তে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلاَ فِضَّةٍ لاَ يُؤَدِّى مِنْهَا حَقَّهَا إِلاَّ إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحَ مِنْ نَارٍ ‘প্রত্যেক স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক যে তার হক (যাকাত) আদায় করে না, নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরী করা হবে’।[8]
এখানে মালিক বলতে ব্যক্তি মালিকানাকে বুঝানো হয়েছে। অতএব ব্যক্তি মালিকানায় নিছাব পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রৌপ্য থাকলেই কেবল যাকাত ফরয। অন্যথা ফরয নয়।
ব্যবহৃত অলংকারের যাকাত
পক্ষান্তরে বৈধ পন্থায় নারীর ব্যবহৃত অলংকারের যাকাত ফরয কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হ’ল, নারীর ব্যবহৃত অলংকারে যাকাত ফরয। নারীর ব্যবহারিক অলংকারের যাকাত সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
عَنْ
عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله
عليه وسلم وَمَعَهَا ابْنَةٌ لَهَا وَفِيْ يَدِ ابْنَتِهَا مَسَكَتَانِ
غَلِيْظَتَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهَا أَتُعْطِيْنَ زَكَاةَ هَذَا
قَالَتْ لاَ قَالَ أَيَسُرُّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللهُ بِهِمَا يَوْمَ
الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ قَالَ فَخَلَعَتْهُمَا
فَأَلْقَتْهُمَا إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَقَالَتْ هُمَا
لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُوْلِهِ-
আমর ইবনু শু‘আইব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক মহিলা তার কন্যাসহ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে আসলেন। তার কন্যার হাতে মোটা দু’টি স্বর্ণের
বালা ছিল। তিনি তাকে বললেন, তুমি কি এর যাকাত দাও? মহিলাটি বললেন, না। তখন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি কি পসন্দ কর যে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ
তা‘আলা এর পরিবর্তে তোমাকে এক জোড়া আগুনের বালা পরিধান করান? রাবী বলেন,
একথা শুনে মেয়েটি তার হাত থেকে তা খুলে নবী (ছাঃ)-এর সামনে রেখে দিয়ে বলল,
এ দু’টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য।[9] অন্য হাদীছে বর্ণিত আছে, মা আয়েশা (রাঃ) বলেন,
دَخَلَ
عَلَىَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَرَأَى فِيْ يَدِيْ فَتَخَاتٍ
مِنْ وَرِقٍ فَقَالَ مَا هَذَا يَا عَائِشَةُ فَقُلْتُ صَنَعْتُهُنَّ
أَتَزَيَّنُ لَكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ أَتُؤَدِّيْنَ زَكَاتَهُنَّ
قُلْتُ لاَ أَوْ مَا شَاءَ اللهُ قَالَ هُوَ حَسْبُكِ مِنَ النَّارِ-
‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার নিকট উপস্থিত হয়ে আমার হাতে
রূপার বড় বড় আংটি দেখতে পান এবং বলেন, হে আয়েশা! এটা কি? আমি বললাম, হে
রাসূল (ছাঃ)! আপনার উদ্দেশ্যে সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য তা তৈরী করেছি।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এর যাকাত দাও? আমি বললাম, না অথবা আল্লাহ্র
যা ইচ্ছা ছিল। তিনি বললেন, তোমাকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটাই
যথেষ্ট।[10] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ
أَسْمَاءَ بِنْتِ يَزِيْدَ قَالَتْ دَخَلْتُ أَنَا وَخَالَتِيْ عَلَى
النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهَا أَسْوِرَةٌ مِنْ ذَهَبٍ
فَقَالَ لَنَا أَتُعْطِيَانِ زَكَاتَهُ قَالَتْ فَقُلْنَا لاَ قَالَ أَمَا
تَخَافَانِ أَنْ يُسَوِّرَكُمَا اللهُ أَسْوِرَةً مِنْ نَارٍ أَدِّيَا
زَكَاتَهُ-
আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ও
আমার খালা হাতে স্বর্ণের বালা পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে
প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে বললেন, তোমরা এর যাকাত দাও
কি? তিনি বলেন, তখন আমরা বললাম, না। তখন তিনি (ছাঃ) বললেন, ‘তোমরা কি ভয়
কর না যে, এর পরিবর্তে আল্লাহ তা‘আলা আগুনের বালা পরিধান করাবেন। সুতরাং
তোমরা যাকাত আদায় কর’।[11] ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন,
سَأَلَتْهُ
امْرَأَةٌ عَنْ حُلِيٍّ لَهَا أَفِيْهِ زَكَاةٌ؟ قَالَ إِذَا بَلَغَ
مِائَتَيْ دِرْهَمٍ فَزَكِّيْهِ، قَالَتْ إِنَّ فِيْ حِجْرِيْ أَيْتَامًا
فَأَدْفُعُهُ إِلَيْهِمْ؟ قَالَ نَعَمْ-
‘এক মহিলা
তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, অলংকারের যাকাত দিতে হবে কি? তিনি বললেন, যদি তা
দুইশত দিরহামে পৌঁছে, তাহ’লে তার যাকাত আদায় করবে। মহিলাটি বললেন, আমার
ঘরে কতিপয় ইয়াতীম রয়েছে, তাদেরকে কি (যাকাত) প্রদান করতে পারব? তিনি
বললেন, হ্যাঁ’।[12] আয়েশা (রাঃ) বলেন, لاَ بَأْسَ بِلُبْسِ الْحُلِيِّ إِذَا أَعْطَى زَكَاتَهُ ‘অলংকার পরিধানে কোন সমস্যা নেই, যদি তার যাকাত দেওয়া হয়’।[13]
উপরোল্লিখিত হাদীছ ও আছার সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নারীর ব্যবহৃত অলংকার নিছাব পরিমাণ হ’লে যাকাত দিতে হবে।
নারীর ব্যবহৃত অলংকারে যাকাত ফরয নয় মর্মে পেশকৃত দলীলের জবাব :
কিছু সংখ্যক বিদ্বান নারীর ব্যবহৃত অলংকারে যাকাত ফরয নয় বলে মত পোষণ করেছেন এবং তাদের মতের স্বপক্ষে কতিপয় দলীল পেশ করেছেন। নিম্নে সেই দলীলগুলো উল্লেখ করতঃ তার জবাব দেওয়া হ’ল।
প্রথম দলীল : আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, لَيْسَ فِيْ الْحُلِىِّ زَكَاةٌ ‘অলংকারের যাকাত নেই’।[14]
জবাব : প্রথমত হাদীছটি যঈফ। ইমাম দারাকুত্বনী হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।[15] ইমাম বায়হাক্বী হাদীছটিকে ভিত্তিহীন বলেছেন।[16] নাছিরুদ্দীন আলবানীও হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।[17] অতএব উক্ত হাদীছটি যঈফ বলে দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়তঃ হাদীছটি উপরোল্লিখিত ছহীহ হাদীছ ও আছার সমূহের বিরোধী হওয়ায় তা পরিত্যাজ্য।
দ্বিতীয় দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَصَدَّقْنَ وَلَوْ مِنْ حُلِيِّكُنَّ ‘তোমরা তোমাদের অলংকার দ্বারা হ’লেও যাকাত আদায় কর’।[18] অলংকারের যাকাত ফরয হ’লে রাসূল (ছাঃ) ‘তোমাদের অলংকার দ্বারা হ’লেও’ না বলে বলতেন ‘তোমাদের অলংকারের যাকাত আদায় কর’।
জবাব : অত্র হাদীছ ব্যবহৃত অলংকারের যাকাত ফরয না হওয়া প্রমাণ করে না। কেননা যদি কেউ কারো ব্যয়ভার বহন করার লক্ষ্যে এমন অর্থ প্রদান করে, যা নিছাব পরিমাণ হয়। অতঃপর সে যদি বলে, তুমি যাকাত আদায় করবে যদিও তোমাকে প্রদানকৃত অর্থ থেকে হয়। তার এরূপ কথা যেমন উক্ত অর্থের যাকাত ফরয না হওয়া প্রমাণ করে না, তেমনি উল্লিখিত হাদীছ দ্বারাও ব্যবহৃত অলংকারের যাকাত ফরয না হওয়া প্রমাণ করে না।[19]
তৃতীয় দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَيْسَ عَلَى الْمُسْلِمِ فِيْ عَبْدِهِ وَلاَ فَرَسِهِ صَدَقَةٌ ‘মুসলিমের উপর তার দাস ও ঘোড়ার যাকাত নেই’।[20] দাস এবং ঘোড়া মানুষের প্রয়োজনীয় বস্ত্ত হওয়ায় যাকাত ফরয নয়। তেমনি নারীর ব্যবহৃত অলংকার প্রয়োজনীয় বস্ত্ত হওয়ায় যাকাত ফরয নয়।
জবাব : নারীর ব্যবহৃত অলংকারকে দাস ও ঘোড়ার উপর ক্বিয়াস করা দু’টি কারণে সঠিক নয়। (ক) উক্ত ক্বিয়াস উপরোল্লিখিত ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী। আর ছহীহ হাদীছ বিরোধী ক্বিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। (খ) উক্ত ক্বিয়াস অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা মৌলিক দিক থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত ফরয। পক্ষান্তরে দাস ও ঘোড়ার যাকাত ফরয নয়। অতএব মৌলিক দিক থেকে যাকাত ফরয নয় এমন বস্ত্তর সাথে যাকাত ফরয হওয়া বস্ত্তর ক্বিয়াস করা সঠিক নয়।[21]
চতুর্থ দলীল : নারীর ব্যবহৃত অলংকার বর্ধনশীল নয়। অতএব অবর্ধনশীল বস্ত্তর যাকাত ফরয নয়।
জবাব : স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত ফরয হওয়ার জন্য বর্ধনশীল হওয়া শর্ত নয়। যেমন কেউ যদি তার নিকট নিছাব পরিমাণ টাকা জমা করে রাখে, যা দিয়ে সে কোন ব্যবসা করে না। বরং সেই টাকা থেকে শুধু খায় ও পান করে। তবুও তার উপর যাকাত ফরয। অতএব ব্যবহৃত অলংকার বর্ধনশীল না হ’লেও তার উপর যাকাত ফরয।[22]
নগদ অর্থের যাকাত
প্রাথমিক যুগের মানুষ নগদ অর্থ বলতে কিছুই জানত না। তারা
পণ্যের বিনিময়ে পণ্য লেনদেন করত। তারপর ধীরে ধীরে নগদ অর্থের ব্যবহার শুরু
হয়েছে। সাথে সাথে স্বর্ণ ও রৌপ্য বিশেষ বস্ত্ত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। যখন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রেরিত হ’লেন, তৎকালীন আরব সমাজ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার
মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করত। স্বর্ণ দিয়ে তৈরী হ’ত
‘দীনার’, আর রৌপ্য দিয়ে তৈরী হ’ত ‘দিরহাম’। কিন্তু তা ছোট ও বড় হওয়ায়
ওযনের তারতম্য হ’ত। এই কারণে জাহেলী যুগে মক্কার লোকেরা তা গণনার ভিত্তিতে
ব্যবহার করত না, বরং তারা ওযনের ভিত্তিতে ব্যবহার করত। মূলত এই কারণেই
স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিছাব যথাক্রমে ২০ দীনার ও ২০০ দিরহামকে ওযনের ভিত্তিতে
৮৫ গ্রাম স্বর্ণ ও ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য ধার্য্য করা হয়েছে।
নগদ অর্থের নিছাব
বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ যে মুদ্রার মাধ্যমে লেন দেন করছে
সেটা দিরহাম, দীনার, ডলার, টাকা যাই হোক না কেন, তা যদি স্বর্ণ বা রৌপ্যের
নিছাবের মূল্যে পৌঁছে এবং ঐ মুদ্রার উপর এক বৎসর সময়কাল অতিবাহিত হয়,
তাহ’লে তার উপর যাকাত ফরয। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এক দীনার সমান দশ দিরহাম হ’ত। সুতরাং বিশ দীনার স্বর্ণ ও দুইশত দিরহাম রৌপ্যের মান সমান ছিল। যার কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিছাব যথাক্রমে বিশ দীনার ও দুইশত দিরহাম বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে উল্লিখিত পরিমাণ স্বর্ণ রৌপ্যের মানে বড় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এক্ষণে আমরা কি নগদ অর্থের নিছাব স্বর্ণের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করব, না রৌপ্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করব? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। স্বর্ণের মূল্যমান রূপা অপেক্ষা স্থিতিশীল এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য বিধায় অধিকাংশ বিদ্বান স্বর্ণের হিসাব অনুযায়ী যাকাত দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তবে যেহেতু যাকাত সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হওয়ার মাধ্যম তাই রৌপ্যের হিসাবেও অর্থের যাকাত প্রদান করা যেতে পারে।
মুদ্রাসমূহের যাকাত বের করার পদ্ধতি
মুদ্রার যাকাত বের করার জন্য সমস্ত সম্পদকে ৪০ দ্বারা ভাগ
করে এক ভাগ বা ২.৫০% যাকাত দিতে হবে। আর এটাই স্বর্ণ-রৌপ্য ও এর হুকুমে যা
আসে তার যাকাত। যেমন কারো নিকট ৪,০০,০০০/= টাকা রয়েছে। উক্ত টাকার যাকাত
বের করার নিয়ম হ’ল, ৪,০০,০০০÷৪০ =১০,০০০/= টাকা। উল্লিখিত পদ্ধতিতে
৪,০০,০০০/= টাকা থেকে যাকাত হিসাবে ১০,০০০/= টাকা দান করতে হবে।
[2]. আবূদাউদ হা/১৫৭৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, আলবানী, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/১৪৮৪, ‘যাকাত’ অধ্যায়, মুসলিম হা/৯৭৯; মিশকাত হা/১৭৯৪।
[4]. আবূদাউদ হা/১৫৭২, ‘যাকাত’ অধ্যায়, আলবানী, সনদ ছহীহ।
[5]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ৬/১০১-১০২ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১৮ পৃঃ; তামামুল মিন্নাহ ৩৬০ পৃঃ।
[6]. বুখারী হা/১৪৮৪, ‘যাকাত’ অধ্যায়, মুসলিম হা/৯৭৯; মিশকাত হা/১৭৯৪।
[7]. আবূদাউদ হা/১৫৭৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, আলবানী, সনদ ছহীহ।
[8]. মুসলিম হা/৯৮৭; মিশকাত হা/১৭৭৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[9]. আবূদাউদ হা/১৫৬৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘গচ্ছিত সম্পদ ও অলংকারের যাকাত’ অনুচ্ছেদ, সনদ হাসান।
[10]. আবূদাউদ হা/১৫৬৫, সনদ ছহীহ।
[11]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৭৬৫৫; ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৭৭০, সনদ ছহীহ লিগায়রিহি (হাসান)।
[12]. মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক ৪/৮৩ পৃঃ; মু‘জামুল কাবীর লিত ত্ববারানী ৯/৩৭১ পৃঃ; সনদ ছহীহ লিগায়রিহি।
[13]. দারাকুত্বনী ২/১০৭ পৃঃ; বায়হাক্বী ৪/১৩৯ পৃঃ; সনদ হাসান।
[14]. তিরমিযী হা/৬৩৬; দারাকুত্বনী ২/১০৭ পৃঃ।
[15]. নাছবুর রিওয়ায়া ২/৩৪৭ পৃঃ।
[16]. মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার ৩/২৯৮ পৃঃ।
[17]. জামেউছ ছাগীর হা/৪৯০৬।
[18]. বুখারী হা/১৪৬৬; মুসলিম হা/১০০০; মিশকাত হা/১৮০৮।
[19]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ৬/১৩০ পৃঃ।
[20]. বুখারী হা/১৪৬৪; মুসলিম হা/৯৮২।
[21]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ৬/১৩০ পৃঃ।
No comments:
Post a Comment