প্রশ্ন: ৪১০ : গান বাজনা সম্পর্কে ।

 কুরআনের ভাষ্য: আল্লাহ তাআলা সূরা লুকমানে আখেরাত-প্রত্যাশী মুমিনদের প্রশংসা করার পর দুনিয়া-প্রত্যাশীদের ব্যাপারে বলছেন,

আর একশ্রেণীর লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত খেল-তামাশার বস্তু ক্রয় করে বান্দাকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার জন্য।-সূরা লুকমান : ৬

উক্ত আয়াতের শানে নুযূলে বলা হয়েছে যে, নযর ইবনে হারিস বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী খরিদ করে এনে তাকে গান-বাজনায় নিয়োজিত করল। কেউ কুরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে গায়িকাকে আদেশ করত এবং বলত মুহাম্মদ তোমাদেরকে কুরআন শুনিয়ে নামায, রোযা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা বলে। এতে শুধু কষ্টই কষ্ট। তার চেয়ে বরং গান শোন এবং জীবনকে উপভোগ কর।-মাআরিফুল কুরআন ৭/৪

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন।

( ৩১ নং সুরা লুকমান এর ৬ নং আয়াত) : 

﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ﴾

৬) আর মানুষদেরই মধ্যে এমনও কেউ আছে, ৫   যে মনোমুগ্ধকর কথা ৬   কিনে আনে লোকদেরকে জ্ঞান ছাড়াই ৭   আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য এবং এ পথের আহ্বানকে হাসি-ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়৷ ৮   এ ধরনের লোকদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব৷ ৯  

৫ . অর্থাৎ একদিকে তো আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পথনির্দেশনা ও অনুগ্রহ এসেছে, যা থেকে কিছু লোক লাভবান হচ্ছে৷ অন্যদিকে ঐ সমস্ত সৌভাগ্যবান লোকদের পাশাপাশি এমন দুর্ভাগ্য লোকেরাও রয়ে গেছে যারা আল্লাহর আয়াতের মোকাবিলায় এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছে৷
৬ . আসল শব্দ হচ্ছে "লাহওয়াল হাদীস" অর্থাৎ এমন কথা যা মানুষকে আত্ম-সমাহিত করে অন্য প্রত্যেকটি জিনিস থেকে গাফিল করে দেয়৷ শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে এ শব্দগুলোর মধ্যে নিন্দার কোন বিষয় নেই৷ কিন্তু খারাপ, বাজে ও অর্থহীন কথা অর্থে শব্দটির ব্যবহার হয়৷ যেমন গালগল্প, পুরাকাহিনী, হাসি-ঠাট্টা, কথা-কাহিনী, গল্প, উপন্যাস, গান বাজনা এবং এ জাতীয় আরো অন্যান্য জিনিস৷

'লাহওয়াল হাদীস' কিনে নেয়ার এ অর্থও হতে পারে যে, ঐ ব্যক্তি সত্য কথা বাদ দিয়ে মিথ্যা কথা গ্রহণ করে এবং সঠিক পথনির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এমন কথার প্রতি আগ্রহান্বিত হয় যার মাধ্যমে তার জন্য দুনিয়াতেও কোন মঙ্গল নেই এবং আখেরাতেও নেই৷ কিন্তু এটি এই বাক্যাংশটির রূপক অর্থ ৷ এর প্রকৃত অর্থ এই যে, মানুষ তার নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে কোন বাজে জিনিস কিনে৷ এ ব্যাখ্যার সমর্থনে বহু হাদীসও রয়েছে৷ ইবনে হিশাম মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন৷ তাতে তিনি বলেছেন, মক্কার কাফেরদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন এ দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েই চলছিল তখন নদ্বর ইবনে হারেস কুরাইশ নেতাদেরকে বললো, তোমরা যেভাবে এ ব্যক্তির মোকাবিলা করছো, তাতে কোন কাজ হবে না৷ এ ব্যক্তি তোমাদের মধ্যেই জীবন যাপন করে শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে৷ আজ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের দিকে দিয়ে সে ছিল তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সত্যবাদী ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক৷ এখন তোমরা বলছো, সে গণক, যাদুকর, কবি, পাগল৷ একথা কে বিশ্বাস করবে ? যাদুকর কোন ধরনের তুকতাক কারবার চালায় তা কি লোকেরা জানে না ? গণকরা কি সব কথাবার্তা বলে তা কি লোকদের জানতে বাকি আছে ? লোকেরা কি কবি ও কবিতা চর্চার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ৷ পাগলার কেমন কেমন করে তাকি লোকেরা জানে না ? এ দোষগুলো মধ্য থেকে কোনটি মুহাম্মদ (সা) এর ওপর প্রযোজ্য হয় যে, সেটি বিশ্বাস করার জন্য তোমরা লোকদেরকে আহ্বান জানাতে পারবে ? থামো, এ রোগের চিকিৎসা আমিই করবো৷ এরপর সে মক্কা থেকে ইরাক চলে গেলো৷ সেখান থেকে অনারব বাদশাহদের কিস্‌সা কাহিনী এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের গল্পকথা সংগ্রহ করে এনে গল্প বলার আসর জমিয়ে তুলতে লাগলো ৷ তার উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে লোকেরা কুরআনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং এসব গল্প- কাহিনীর মধ্যে ডুবে যাবে৷ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, ৩২০-৩২১পৃঃ) আসবাবুন নযুলের মধ্যে এ বর্ণনাটি ওয়াহেদী কালবী ও মুকাতিল থেকে উদ্ধৃত করেছেন৷ ইবনে আব্বাস (রা) এর ওপর আরো এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন যে, নদ্বর এ উদ্দেশ্যে গায়িকা বাঁদীদেরকেও কিনে এনেছিল৷ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে নবী (সা) এর কথায় প্রভাবিত হতে চলেছে বলে তার কাছে খবর এলেই সে তার জন্য নিজের একজন বাঁদী নিযুক্ত করতো এবং তাকে বলে দিতো ওকে খুব ভালো করে পানাহার করাও ও গান শুনাও এবং সবসময় তোমার সাথে জড়িয়ে রেখে ওদিক থেকে ওর মন ফিরিয়ে আনো৷ বিভিন্ন জাতির বড় বড় অপরাধীরা প্রত্যেক যুগে যেসব ধুর্তামী ও চালবাজীর আশ্রয় নিয়ে এসেছে এ প্রায় সে একই ধরনের চালবাজি ছিল৷ তারা জনগণকে খেল-তামাশা ও নাচগানে (কালচার) মশগুল করতে থাকে৷ এভাবে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি নজর দেবার চেতনাই থাকে না এবং এ অস্তিত্ব জগতের মধ্যে তারা একথা অনুভবই করতে পারে না যে, তাদেরকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷

লাহওয়াল হাদীসের এ ব্যাখ্যাই বিপুল সংখ্যক সাহাবী ও তাবেঈ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে৷ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা) জিজ্ঞেস করা হয়, এ আয়াতে যে লাহওয়াল হাদীস শব্দ এসেছে এর তাৎপর্য কি ? তিনি তিনবার জোর দিয়ে বলেন, "আল্লাহর কসম এর অর্থ হচ্ছে গান৷" (ইবনে জারীর, ইবনে আবি শাইবাহ, হাকেম, বায়হাকী) প্রায় এ একই ধরনের উক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) , জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, মুজাহিদ, ইকরামাহ, সাঈদ ইবনে জুবাইর , হাসান বাসরী ও মাকহূল থেকে উদ্ধৃত হয়েছে৷ ইবনে জারীর, ইবনে আবি হাতেম ও তিরমিযী হযরত আবু উমামাহ বাহেলীর (রা) হাদীস উদ্ধৃত করেছেন ৷ তাতে নবী (সা) বলেছেনঃ

----------------------------------------

" গায়িকা মেয়েদের কেনাবেচা ও তাদের ব্যবসায় করা হালাল নয় এবং তাদের দান নেয়াও হালাল নয়৷"

অন্য একটি হাদীসে শেষ বাক্যটির শব্দাবলী হচ্ছেঃ ---------" তাদের মূল্য খাওয়া হারাম৷" অন্য একটি হাদীসে একই আবু উমামাহ থেকে নিম্নোক্ত শব্দাবলী উদ্ধৃত হয়েছেঃ

-----------------------

'বাঁদীদেরকে গান-বাজনা করার শিক্ষা দেয়া এবং তাদের বেচা-কেনা করা হালাল নয় এবং তাদের দাম হারাম৷"

এ তিনটি হাদীসে একথা সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, ----------আয়াতটি এ ব্যাপারেই নাযিল হয়৷ কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী 'আহকামুল কুরআনে' হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ইমাম মালেকের বরাত দিয়ে হযরত আনাস (রা) একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন৷ তাতে বলা হয়েছে , নবী সাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেনঃ

-------------------------

" যে ব্যক্তি গায়িকা বাঁদীর মাহফিলে বসে তার গান শুনবে, কিয়ামতের দিন তার কানে গরম শীসা ঢেলে দেয়া হবে৷ "

(এ প্রসঙ্গে একথা জেনে নেয়া উচিত যে, সে যুগে গান-বাজনার "সংস্কৃতি" বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরং পুরোপুরি বাঁদীদের বদৌলতেই জীবিত ছিল৷ স্বাধীন ও সম্ভ্রান্ত মেয়েরা সেকালে "আর্টিষ্ট" হননি৷ তাই নবী (সা) গায়িকাদের কেনা-বেচার কথা বলেছেন, দাম শব্দের সাহায্যে তাদের "ফী" র ধারণা দিয়েছেন এবং গায়িকা মেয়েদের জন্য "কাইনা"শব্দ ব্যবহার করেছেন৷ আরবী ভাষায় বাঁদীদের জন্য এ শব্দটি বলা হয়৷ )

৭ . "জ্ঞান ছাড়াই" শব্দের সম্পর্কে "কিনে আনে" এর সাথেও হতে পারে আবার "বিচ্যুত করে" এর সাথেও হতে পারে৷ যদি প্রথম বাক্যাংশের সাথে এর সম্পর্ক মেনে নেয়া হয়, তাহলে এর অর্থ হবে, সেই মূর্খ অজ্ঞ লোক এই মনোমুগ্ধকর জিনিসটি কিনে নেয় এবং সে জানে না কেমন মূল্যবান জিনিস বাদ দিয়ে সে কেমন ধ্বংসকর জিনিস কিনে নিচ্ছে৷ একদিকে আছে জ্ঞান ও সঠিক পথনির্দেশনা সমৃদ্ধ আল্লাহর আয়াত৷ বিনামূল্যে সে তা লাভ করছে কিন্তু তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷ অন্যদিকে রয়েছে সব অর্থহীন ও বাজে জিনিস৷ সেগুলো চিন্তা ও চরিত্রশক্তি ধ্বংস করে দেয়৷ নিজের টাকা পয়সা খরচ করে সে সেগুলো লাভ করছে৷ আর যদি একে দ্বিতীয় বাক্যাংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা হয় , তাহলে এর অর্থ হবে যে, সে জ্ঞান ছাড়াই লোকদের পথ দেখাচ্ছে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করে সে যে নিজের ঘাড়ে কত বড় জুলুমের দায়ভাগ চালিয়ে নিচ্ছে, তা সে জানে না৷
৮ . অর্থাৎ এ ব্যক্তি লোকদেরকে কিস্‌সা-কাহিনী গান-বাজনায় মুশগুল করে আল্লাহর আয়াতের প্রতি বিদ্রুপ করতে চায়৷ সে কুরআনের এ দাওয়াতকে ঠাট্টা-তামাশার মধ্যে উড়িয়ে দিতে চায় আল্লাহর দীনের সাথে লড়াই করার জন্য সে যুদ্ধের এমনসব নকশা তৈরি করতে চায় যেখানে একদিকে মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর আয়াত শোনাতে বের হবেন, অন্যদিকে কোন সুশ্রী ও সুকণ্ঠী গায়িকার মাহফিল গুলজার হতে থাকবে, আবার কোথাও কোন বাচাল কথক ইরান-তুরানের কাহিনী শুনাতে থাকবে এবং লোকেরা এসব সাংস্কৃতিক তৎপরতায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে আল্লাহ, আখেরাত ও নৈতিক চরিত্রনীতির কথা শোনার মুডই হারিয়ে ফেলবে৷

৯ . এ শাস্তি তাদের অপরাধের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারিত ৷ তারা আল্লাহর দ্বীন, তার আয়াত ও তার রসূলকে লাঞ্ছিত করতে চায়৷ এর বদলায় আল্লাহ তাকে কঠিন লাঞ্ছনাকর আযাব দেবেন৷

-(তাফহীমুল কুরআন) 

সাহাবী ও তাবেয়ীদের ব্যাখ্যা

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে উক্ত আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদীস’-এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তা হল গান।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. একই কথা বলেন। তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে যুবাইর থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেন, উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যা বান্দাকে কুরআন থেকে গাফেল করে দেয়।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৪৪১

কুরআন মজীদের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজী পেশ করলে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে বললেন,

তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস পদস্খলিত কর।-সূরা ইসরা : ৬৪

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তাই ইবলিসের আওয়াজ। বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন, ইবলিসের আওয়াজ বলতে এখানে গান ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তার মধ্যে গান-বাদ্যই সেরা। এজন্যই একে ইবলিসের আওয়াজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৯

সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী বহু গুনাহর সমষ্টি হল গান ও বাদ্যযন্ত্র। যথা :

ক) নিফাক এর উৎস খ) ব্যভিচারের প্রেরণা জাগ্রতকারী গ) মস্তিষ্কের উপর আবরণ ঘ) কুরআনের প্রতি অনিহা সৃষ্টিকারী ঙ) আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী চ) গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও ছ) জিহাদী চেতনা বিনষ্টকারী।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭ বস্তুত গান বাজনার ক্ষতিকর প্রভাব এত বেশি যে, তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো দলীল খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বহু হাদীসের মাধ্যমে তা প্রমাণিত।হাদীসের ভাষ্য

গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় কর না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রেখ, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১২৮২; ইবনে মাজাহ হাদীস : ২১৬৮

বর্তমানে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে যাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এর সকল উপার্জন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দিবেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস : ৪০২০; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৬৭৫৮

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২

উপরোক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক সৃষ্টি হয়েছে যে, সাহাবীদের ইসলামকে এ যুগে অচল মনে করা হচ্ছে এবং গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের মেলামেশা ইত্যাদিকে হালাল মনে করা হচ্ছে। সহীহ বুখারীতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ৫৫৯০ মুসনাদে আহমদের হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

আল্লাহ তাআলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা বিলোপসাধনের নির্দেশ দিয়েছেন।

হাদীসের আলোয় সাহাবীদের জীবন

দু’একটি ক্ষেত্রে শুধু দফ বাজানোর বিষয়টি ব্যতিক্রম থাকলেও যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস এবং সাহাবীদের বাস্তব আমল তা প্রমাণ করে।

বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত নাফে’ রাহ. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার চলার পথে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। কিছু দূর গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাফে’! এখনো কি আওয়াজ শুনছ? আমি বললাম হ্যাঁ। অতঃপর আমি যখন বললাম, এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল সরালেন এবং বললেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৪৫৩৫; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৪৯২৪ বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. থেকেও এমন একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৯০১

একটু ভেবে দেখুন তো, যে আওয়াজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম মুহূর্তের জন্যও কানে তুলতে রাজি ছিলেন না সেই ইবলিসী আওয়াজের অনুকূলে কথা বলার দুঃসাহস আমরা দেখাতে পারি কি না?

বাজনাদার নুপুর ও ঘুঙুরের আওয়াজও সাহাবায়ে কেরাম বরদাশত করতেন না। তাহলে গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রশ্নই কি অবান্তর নয়? নাসাঈ ও সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, একদিন হযরত আয়েশা রা.-এর নিকট বাজনাদার নুপুর পরে কোনো বালিকা আসলে আয়েশা রা. বললেন, খবরদার, তা কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

যে ঘরে ঘণ্টি থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৪২৩১; সুনানে নাসাঈ হাদীস : ৫২৩৭ সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঘণ্টি, বাজা, ঘুঙুর হল শয়তানের বাদ্যযন্ত্র।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ২১১৪ মৃদু আওয়াজের ঘণ্টি-ঘুঙুরের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আধুনিক সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের বিধান কী হবে তা খুব সহজেই বুঝা যায়। চার ইমামের ভাষ্য

গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-অভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ইমাম মালেক রাহ. কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে।-কুরতুবী ১৪/৫৫ ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন যে, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহমক।

তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবী ১৪/৫৫

হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা আলী মারদভী লেখেন, বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম।-আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৮৮

ইমাম শাফেয়ী রাহ. শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১০৮৯; সহীহ বুখারী হাদীস : ৫১৪৭, ৫১৬২ মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হল বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়।-ফাতহুল বারী ৯/২২৬

দফ-এর পরিচয়

যারা সরাসরি আরবে দফ দেখেছেন, তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, দফ-এর এক পাশ খোলা। বাজালে ঢ্যাব ঢ্যাব আওয়াজ হয়। প্লাস্টিকের গামলা বাজালে যেমন আওয়াজ হবে তেমন। আসলে দফ কোনো বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না।

আওনুল বারী গ্রন্থে দফ-এর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে যে, এর আওয়াজ স্পষ্ট ও চিকন নয় এবং সুরেলা ও আনন্দদায়কও নয়। কোনো দফ-এর আওয়াজ যদি চিকন ও আকর্ষণীয় হয় তখন তা আর দফ থাকবে না; বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হবে।-আওনুল বারী ২/৩৫৭ আর দফ-এর মধ্যে যখন বাদ্যযন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এসে যাবে তখন তা সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েয বলে পরিগণিত হবে।-মিরকাত ৬/২১০

এখন কেউ যদি বলেন, তৎকালীন যুগে দফ ছিল আরবের সর্বোচ্চ বাদ্যযন্ত্র, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তা-ই উন্নত হয়েছে। তাহলে একে অজ্ঞতাপ্রসূত অবাস্তব কথা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি না। কেননা একাধিক হাদীসে ঢোল, তবলাসহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের নাম এসেছে। বাস্তবে না থাকলে এসব বাদ্যযন্ত্রের নাম আসবে কোত্থেকে? তাছাড়া মুহাদ্দিসদের ভাষ্য অনুযায়ী দফ বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না, যা ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি। আরবে এখনো দফ বিদ্যমান আছে।

দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদানী উস্তাদকে ছাত্ররা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, দফ তো বাচ্চাদের জন্য, আর বড়দের জন্য হল কুরআন। পরিণত ব্যক্তিদের জন্য কুরআন ছেড়ে এসবের মধ্যে লিপ্ত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এরপরও যদি মেনে নেওয়া হয় যে, তৎকালীন যুগে দফ সর্বোচ্চ বাদ্যযন্ত্র ছিল তবে তাতেই বা লাভ কী? বাদ্যযন্ত্রকে তো আর জায়েয বানানো যাচ্ছে না। হাদীসে রাসূলই তাকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছে। ইসলামকে আধুনিক বানানোর ‘সদুদ্দেশ্যে’ আজ কেউ কেউ ফতোয়া দিচ্ছেন যে, মেয়েদের সাথে হাত মেলানো জায়েয, নারী-পুরুষের মাঝে পর্দা বিধানের এত কড়াকড়ির প্রয়োজন নেই, গান-বাদ্য, সিনেমা, টেলিভিশন এসব তো বিনোদনেরই অংশ। ক্লীন শেভে কোনো সমস্যা নেই, দাড়ি ইসলামের কোনো জরুরি বিষয় নয় ইত্যাদি বহুবিধ ‘আধুনিক’, ‘অতি আধুনিক’ ফাতাওয়া আজ শুনতে পাওয়া যায়। মনে রাখা উচিত যে, ইসলাম অন্যান্য ‘ধর্মে’র মতো নয়; বরং তা আল্লাহ প্রদত্ত চির আধুনিক আদর্শ, একে নিজেদের পক্ষ থেকে আরো অতি আধুনিক বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ইসলামে যেমন বাড়াবাড়ির অবকাশ নেই, তেমন ছাড়াছাড়িরও সুযোগ নেই। ইসলাম হল মধ্য পন্থা। যে বিধান যতটুকু দেওয়া প্রয়োজন আল্লাহ তাআলা তা ততটুকুই দিয়েছেন। এর পূর্ণ অনুসরণই যে সকল কল্যাণের সূত্র সাহাবায়ে কেরামের পুণ্যযুগই তার বাস্তব প্রমাণ। আমরাও যদি কল্যাণের প্রত্যাশা করি তাহলে আমাদেরকেও ইসলামের সকল বিধানের পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে এবং আমাদের ঈমান, আমল ও ফতোয়া সবকিছুকে যাচাই করতে হবে তাদেরই মানদণ্ডে।

আমরা কেউ তো এ দাবি করতে পারি না যে, সাহাবীদের চেয়ে ইসলামকে ও রাসূলের হাদীসকে চেপ্টা করে আমরা বেশি বুঝে ফেলেছি। বাদ্যসহ কাওয়ালি

সুফী সাধকের নাম ব্যবহারকারী একটি জগতেও আজ আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তাই আধুনিক কিছু সুফী বলে থাকে, বাদ্যসহ যিকির ও কাওয়ালি জায়েয। দলীল হিসেবে তারা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম এ বর্ণিত দুটি বালিকার দফ বাজিয়ে কবিতা গাওয়ার হাদীসটি উপস্থাপন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. লেখেন, উক্ত হাদীসে আয়েশা রা.-এর বর্ণনাই তাদের অবাস্তব দাবির বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট জবাব। গান-বাদ্য যে নাজায়েয এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য হাদীসের রাবী হযরত আয়েশা রা. বলছেন, উক্ত বালিকাদ্বয় কোনো গায়িকা ছিল না। তারা কোনো গান গায়নি।-ফাতহুল বারী ২/৪৪২

ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন, গান বলতে যা বুঝায়, বালিকাদ্বয় তা গায়নি। পাছে কেউ ভুল বুঝতে পারে তাই আয়েশা রা. বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী আরো বলেন, বর্তমানে একশ্রেণীর সুফীরা যে ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটিয়েছে তা সম্পূর্ণ হারাম।-তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫৪ বিখ্যাত সাধক হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাহ. তার যুগে কাওয়ালি শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বর্তমানে কাওয়ালি শোনার শর্তগুলো পালন করা হয় না। তাই আমি এর থেকে তওবা করছি।-আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৯২

প্রশ্ন: ৪০৯ : নামাজ বেহেস্তের চাবি - কথাটি কি সঠিক ?

 পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ

اَلْفَصْلُ الثَّالِثُ

عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ الصَّلَاةُ وَمِفْتَاحُ الصَّلَاةِ الطُّهُورُ. رَوَاهُ أَحْمَدُ

২৯৪-[১৪] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাতের চাবি হলো সালাত (সালাত/নামায/নামাজ)। আর সালাতের চাবি হলো ত্বহারাত (উযূ (ওযু/ওজু/অজু)। (আহমাদ)[1]


পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে ছালাতের ফযীলত সংক্রান্ত অনেক বর্ণনা রয়েছে। যার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দা ছালাতের প্রতি মনোযোগী হতে পারে এবং বিশুদ্ধতা ও একাগ্রতার সাথে একনিষ্ঠচিত্তে ছালাত সম্পাদন করতে পারে। এক কথায় ছালাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অমীয় বাণীই যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমানে সেই অভ্রান্ত বাণী ছেড়ে যঈফ ও জাল হাদীছ, মিথ্যা, উদ্ভট ও কাল্পনিক কাহিনী শুনিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বই-পুস্তক লিখে ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। এগুলো মানুষের হৃদয়ে কোন প্রভাব ফেলে না। আমরা এই অধ্যায়ে সেগুলো উল্লেখ করার পাশাপাশি ছহীহ দলীলগুলোও উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

ছালাত জান্নাতের চাবি :

কথাটি সমাজে বহুল প্রচলিত। অনেকে বুখারীতে আছে বলেও চালিয়ে দেয়। অথচ এর সনদ ত্রুটিপূর্ণ।

(১) عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ الصَّلاَةُ وَمِفْتَاحُ الصَّلاَةِ الطُّهُوْرُ.

(১) জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, জান্নাতের চাবি হল ছালাত। আর ছালাতের চাবি হল পবিত্রতা।[1]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটির প্রথম অংশ যঈফ।[2] আর দ্বিতীয় অংশ পৃথক সনদে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।[3]

প্রথম অংশ যঈফ হওয়ার কারণ হল- উক্ত সনদে দু’জন দুর্বল রাবী আছে। (ক) সুলায়মান বিন করম ও (খ) আবু ইয়াহইয়া আল-ক্বাত্তাত।[4]

জ্ঞাতব্য : জান্নাতের চাবি সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রহঃ) একটি অনুচ্ছেদের বিষয়বস্ত্ত আলোচনা করতে গিয়ে ওহাব ইবনু মুনাবিবহ (রহঃ) থেকে যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাঁকে একদিন জিজ্ঞেস করা হল-

أَلَيْسَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لَيْسَ مِفْتَاحٌ إِلاَّ لَهُ أَسْنَانٌ فَإِنْ جِئْتَ بِمِفْتَاحٍ لَهُ أَسْنَانٌ فُتِحَ لَكَ وَإِلاَّ لَمْ يُفْتَحْ لَكَ.

‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ কি জান্নাতের চাবি নয়? তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে প্রত্যেক চাবির দাঁত রয়েছে। তুমি যদি এমন চাবি নিয়ে আস যার দাঁত রয়েছে, তাহলে তোমার জন্য জান্নাত খোলা হবে। অন্যথা খোলা হবে না’।[5] এছাড়াও আরো অন্যান্য হাদীছ দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয়।[6] বুঝা যাচ্ছে যে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ জান্নাতের চাবি আর শরী‘আতের অন্যান্য আমল-আহকাম অর্থাৎ ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ঐ চাবির দাঁত।

[1]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৭০৩; তিরমিযী হা/৪; মিশকাত হা/২৯৪, পৃঃ ৩৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭৪, ২/৪৩; ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ৮৮।

[2]. যঈফুল জামে‘ হা/৫২৬৫; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৬০৯; যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২১২।

[3]. আবুদাঊদ হা/৬১, ১/৯ পৃঃ; তিরমিযী হা/৩; মিশকাত হা/৩১২, পৃঃ ৪০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৯১, ১/৫১।

[4]. سنده ضعيف فيه سليمن بن قرم عن أبى يحيى القتات وهما ضعيفان لسوء حفظهما -আলবানী, মিশকাত হা/২৯৪-এর টীকা দ্রঃ ১/৯৭ পৃঃ; শু‘আইব আরনাঊত্ব, তাহক্বীক্ব মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৭০৩-এর আলোচনা দ্রঃ।

[5]. ছহীহ বুখারী ১/১৬৫ পৃঃ; হা/১২৩৭-এর পূর্বের আলোচনা দ্রঃ, (ইফাবা হা/১১৬৫-এর পূর্বের আলোচনা, ২/৩৫৫ পৃঃ), ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১।

[6]. ছহীহ বুখারী হা/৫৮২৭, ২/৮৬৭ পৃঃ, ‘পোষাক’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৩; ছহীহ মুসলিম হা/২৮৩, ১/৬৬ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪২; মিশকাত হা/২৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৪, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৯; ছহীহ মুসলিম হা/১৫৬, ১/৪৫ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; মিশকাত হা/৩৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫।

প্রশ্ন: ৪০৮ : আজানের সময় মহিলাদের মাথায় কাপড় দেওয়া ।

 প্রশ্ন : অনেকেই আছেন মাথায় কাপড় দেন না, আবার আজান হলে মাথায় কাপড় দেন। আজান শেষ হলে মাথার কাপড় নামিয়ে ফেলেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, আজানের সময় মাথায় কাপড় না দিলে শয়তান চুলের ফাঁকে এসে আশ্রয় নেয়। এ কথা কতটুকু সত্য? এ সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য জানতে চাই?

উত্তর : না, এটি সত্য কথা নয়। এটি কুসংস্কার। মানে আজানের সময় শয়তান এসে চুলের ফাঁকে ঢুকে যাবে আর অন্য সময় ঢুকবে না, শয়তান মানে কী কারণে আজানের সময় চুলের ফাঁকে ঢুকবে। এটি শুদ্ধ কথা নয়। শয়তান সব অবস্থায় মানুষের কাছে প্রশ্রয় নিতে পারে। আজানের সময় ঢুকতে পারে, আজানের আগে/পরেও ঢুকতে পারে। আর আজানের আগে ও পরে ঢোকার সম্ভাবনা বেশি আজানের সময় চেয়ে। কারণ, আজানের সময় শয়তানের হুঁশ থাকে না। শয়তান দৌড়াতেই থাকে। এ জন্য মাথায় সব সময় কাপড় দেবেন। যাঁদের আশঙ্কা আছে শয়তান ঢুকে যেতে পারে, মাথায় কাপড় দিয়ে বের হবেন। যাতে করে শয়তান আপনাকে কোনোভাবে প্রতারিত করতে না পারে। তবে বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য মাথা ঢেকে রাখা ইসলামের বিধান। তাই সে ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান অনুসরণ করাটাই উচিত।

ডা: মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। 

----------------------------

প্রশ্ন : আমাদের দেশে নারীরা আজানের সময় মাথায় কাপড় টেনে থাকেন এবং মাথাকে ভালোভাবে ঢেকে নেন। এটা আবহমান বাংলার ঐহিত্যে পরিণত হয়েছে। এটা কি আমাদের সংস্কৃতি, নাকি এ ব্যাপারে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে?—আলতাফ হোসাইন, ঢাকা।


জবাব : নারীদের মাথা ঢেকে রাখা এবং মাথায় কাপড় দেওয়া আজানসংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। বরং নারীদের মাথায় কাপড় সব সময় থাকা উচিত। কেননা মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৯)

এ আয়াতে ‘জালাবিব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন। আরবি অভিধানের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লিসানুল আরাব’ (১/২৭৩)-এ রয়েছে, ‘জিলবাব’ ওই চাদরকে বলা হয়, যা নারীরা নিজেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার জন্য ব্যবহার করে।

তাফসিরবিদদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ‘জিলবাব’ এমন কাপড়কে বলা হয়, যার মাধ্যমে নারীরা নিজেদের শরীর ঢেকে রাখেন। আর ‘জিলবাব’ অর্থ বড় চাদর, যা মাথাসহ মুখমণ্ডল ও পূর্ণ দেহ আবৃত করে ফেলে। (তাফসিরে কুরতুবি : ১৪/২৪৩)

আর আমাদের নারীরা আজানের সময় যেভাবে মাথা ঢেকে নেন, এটা মূলত আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যদি কোনো নারীর বাসা-বাড়িতে অসতর্কাবস্থায় মাথায় কাপড় না থাকে, তাহলে আজানের সময় সে যদি সতর্ক হয় এবং মাথায় কাপড় টেনে নেয়, তাহলে এটা ঈমান ও আল্লাহভীতির পরিচায়ক। কেননা আজান আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্ত্বসংবলিত কিছু বাক্যের সমষ্টি, যা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ‘শিআর’ তথা প্রতীক। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘কেউ আল্লাহর প্রতীকে সম্মান প্রদর্শন করলে সেটা তো তার হৃদয়ের খোদাভীতিপ্রসূত।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২)

উত্তর দিয়েছেন

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

প্রশ্ন: ৪০৭ : নফস এর অর্থ ও প্রকার ভেদ ।

 এক কথায়, রূহ হচ্ছে, জীবনী শক্তি ও বিবেকের সমন্বয়। 

আর নফস হচ্ছে, আপনার প্রবৃত্তি, চাহিদা, আপনার আমিত্ব  এর সমন্বয়। 

কুরআনে কয়েক ধরণের নফস এর কথা বলা হয়েছে, যেমন : 


(১) নফসে আম্মারা
(২) নফসে লাওয়ামা
(৩) নফসে মুৎমায়েন্না



১) নফসে আম্মারা :
সুরা ইউসুফ এর ৫৩ নং আয়াত :

﴿وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي ۚ إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي ۚ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৫৩) আমি নিজের নফ্‌সকে দোষমুক্ত করছি না৷ নফ্‌স তো খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে, তবে যদি কারোর প্রতি আমার রবের অনুগ্রহ হয় সে ছাড়া৷ অবশ্যি আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান৷”  


২। নফসে লাওয়ামা :
সুরা কিয়ামাহ এর ২ নং আয়াত :

﴿وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ﴾
২) আর না, আমি শপথ করছি তিরস্কারকারী নফসের৷ ২  
২ . কুরআন মজীদে মানুষের নফসের তিনটি রূপ উল্লেখ করা হয়েছে৷এক,একটি "নফস"মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে৷ এটির নাম "নফসে আম্মারা"৷ দুই, একটি "নফস" ভুল বা অন্যায় কাজ করলে অথবা ভুল বা অন্যায় বিষয়ে চিন্তা করলে কিংবা খারাপ নিয়ত রাখলে লজ্জিত হয় এবং সেজন্য মানুষকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করে৷ এটির নাম "নফসে লাউয়ামাহ"৷ আধুনিক পরিভাষায় একেই আমরা বিবেক বলে থাকি৷ তিন, যে নফসটি সঠিক পথে চললে এবং ভূল ও অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করলে তৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করে তাকে বলে "নফসে মুত্মাইন্নাহা"৷

এ আয়াতে আল্লাহ তা"আলা কি কারণে কিয়ামতের দিন এবং তিরস্কারকারী নফসের কসম করেছেন তা বর্ণনা করেননি৷কারণ পরবর্তী আয়াতটি সে বিষয়টির প্রতিই ইংগিত করছে৷ যে জন্য কসম করা হয়েছে তাহলো, মানুষের মরার পর আল্লাহ তা"আলা পুনরায় তাকে অবশ্যই সৃষ্টি করবেন৷ তা করতে তিনি পুরোপুরি সক্ষম৷ এখন প্রশ্ন হলো এ বিষয়টির জন্য এ দুটি জিনিসের কসম করার পেছনে কি যৌক্তিকতা আছে?

কিয়ামতের দিনের কসম খাওয়ার কারণ হলো, কিয়ামতের আগমন নিশ্চিত ও অনিবার্য৷ গোটা বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনাই প্রমাণ করছে যে, এ ব্যবস্থাপনা অনাদী ও অন্তহীন নয়৷ এর বৈশিষ্ট ও প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে এটা চিরদিন ছিল না এবং চিরদিন থাকতে ও পারে না৷ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি এ ভিত্তিহীন ধ্যান-ধারণার সপক্ষে ইতিপূর্বেও কোন মজবুত দলীল-প্রমান খুঁজে পায়নি যে, প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল এ পৃথিবী কখনো অনাদি ও অবিনশ্বর হতে পারে৷ কিন্তু এ পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে এ বিষয়টি তার কাছে ততই নিশ্চিত হতে থাকে যে, এ চাঞ্চল্য মুখর বিশ্ব-জাহানের একটি শুরু বা সূচনা বিন্দু আছে যার পূর্বে এটি ছিল না৷ আবার অনিবার্যরূপে এর একটি শেষও আছে যার পরে এটি আর থাকবে না৷ এ কারণে আল্লাহ তা"আলা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে কিয়ামতেরই কসম করেছেন ৷ এ কসমটির ধরন এরূপ যেমন আমরা অতিশয় সন্দেহবাদী কোন মানুষকে -যে তার আপন অস্তিত্ব সম্পর্কেও সন্দেহ করছে- সম্বোধন করে বলিঃ তোমার প্রাণ সত্তার কসম, তুমি তো বর্তমান৷ অর্থাৎ তোমার অস্তিত্বই সাক্ষী যে তুমি আছ৷

কিয়ামতের দিনের কসম শুধু এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, একদিন বিশ্ব -জাহানের এ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ এরপর মানুষকে পুনরায় জীবিত করে উঠানো হবে৷ তাকে নিজের সমস্ত কাজের হিসেবে দিতে হবে এবং সে নিজের কৃতকর্মের ভাল বা মন্দ ফলাফল দেখবে৷ এর জন্য পুনরায় "নফসের লাউয়ামাহ" কসম করা হয়েছে৷ পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যার মধ্যে বিবেক বলে কোন জিনিস নেই৷এ বিবেকের মধ্যে অনিবার্যরূপে ভাল এবং মন্দের একটি অনুভূমি বিদ্যমান ৷ মানুষ ভাল এবং মন্দ যাচায়ের যে মানদণ্ডই স্থির করে থাকুক না কেন এবং তা ভুল হোক ব নির্ভুল হোক, চরম অধঃপতিত ও বিভ্রান্ত মানুষের বিবেকও মন্দ কাজ করলে কিংবা ভাল কাজ না করলে তাকে তিরষ্কার করে৷ এটিই প্রমান করে যে, মানুষ নিছক একটি জীব নয়, বরং একটি নৈতিক সত্ত্বাও বটে ৷ প্রকৃতিগতভাবেই তার মধ্যে ভাল এবং মন্দের উপলদ্ধি বিদ্যমান৷ সে নিজেই ভাল এবং মন্দ কাজের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে৷ সে অন্যের সাথে যখন কোন খারাপ আচরণ করে তখন সে ব্যাপারে নিজের বিবেকের দংশনকে দমন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও অন্য কেউ যখন তার সাথে একই আচরণ করে তখন আপনা থেকেই তার বিবেক দাবী করে যে, এ ধরনের আচরণকারীর শাস্তি হওয়া উচিত৷ এখন কথা হলো, মানুষের নিজ সত্তার মধ্যেই যদি এ ধরনের একটি "নফসে লাউয়ামাহ" বা তিরষ্কারকারী বিবেকের উপস্থিতি একটি অনস্বীকার্য সত্য হয়ে থাকে , তাহলে এ সত্যটিও অনস্বীকার্য যে,এ "নফসে লাউয়ামা"ই মৃত্যুর পরের জীবনের এমন একটি প্রমাণ যা মানুষের আপন সত্তার মধ্যে বিদ্যমান৷ কেননা যেসব ভাল এবং মন্দ কাজের জন্য মানুষ দায়ী সেসব কাজের পুরষ্কার বা শান্তি তার অবশ্যই পাওয়া উচিত৷এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবী৷ কিন্তু মৃত্যুর পরের জীবন জীবন ছাড়া আর কোনভাবেই তার এ দাবী পূরণ হতে পারে না৷ মৃত্যুর পরে মানুষের সত্তা যদি বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে তার অনেক ভাল কাজের পুরস্কার থেকে সে নিশ্চিতরূপে বঞ্চিত থেকে যাবে ৷ আবার এমন অনেক মন্দ কাজ আছে যার ন্যায্য শাস্তি থেকে সে অবশ্যই নিস্কৃতি পেয়ে যাবে৷ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন কোন মানুষই এ সত্য অস্বীকার করতে পারে না৷ অযৌক্তিক একটি বিশ্বে বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ জন্মলাভ করে বসেছে এবং নৈতিক উপলদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এমন এ পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে বসেছে মৌলিকভাবে যার পুরা ব্যবস্থাপনায় নৈতিকতার কোন অস্তিত্বই নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ এ অর্থহীন ও অযৌক্তিক কথাটি স্বীকার না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মৃত্যুর পরের জীবনকে অস্বীকার করতে পারে না৷ একইভাবে পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদী দর্শন প্রকৃতির এ দাবীর যথার্থ জবাব নয়৷ কারণ মানুষ যদি নিজের নৈতিক কাজ-কর্মের পুরষ্কার ব শাস্তিলাভের জন্য একের পর এক এ কাজ-কর্ম করতে থাকবে যা নতুন করে পুরষ্কার বা শাস্তি দাবী করবে৷ আর এ অন্তহীন ধারাবাহিকতার ঘুর্ণিপাকে পরে তার হিসেব -নিকেশের কোন ফায়সালা হবে না৷ বরং তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে৷ সুতরাং প্রকৃতির এ দাবী কেবল একটি অব্স্থায়ই পূরণ হতে পারে ৷তাহলো, এ পৃথিবীতে মানুষের একটি মাত্র জীবন হবে এবং গোটা মানব জাতির আগমতের ধারা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরেকটি জীবন হবে সে জীবনে মানুষের সমস্ত কাজকর্ম যথাযথভাবে হিসেব-নিকেশ করে তাকে তার প্রাপ্য পুরো পুরস্কার বা শস্তি দেয়া হবে৷ (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, আল আ"রাফ ,টীকা ৩০)৷





৩। নফস মুৎমায়েন্না :

সুরা আল ফজরের ২৭-৩০ নং আয়াত :

﴿يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ﴾
২৭) ( অন্য দিকে বলা হবে ) হে প্রশান্ত আত্মা !১৮ 
১৮. 'প্রশান্ত আত্মা ' বলে এমন মানুষকে বুঝানো হয়েছে যে, কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় ছাড়াই পূর্ণ নিশ্চিন্ততা সহকারে ঠাণ্ডা মাথায় এক ও লা -শরীক আল্লাহকে নিজের রব এবং নবীগণ যে সত্য দীন এনেছিলেন তাকে নিজের দীন ও জীবন বিধান হিসেবে গণ্য করেছে৷ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে থেকে যে বিশ্বাস ও বিধানই পাওয়া গেছে তাকে সে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিয়েছে৷ আল্লাহর দীন যে জিনিসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাকে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নয় বরং এই বিশ্বাস সহকারে বর্জন করেছে যে , সত্যিই তা খারাপ৷ সত্য প্রীতির পথে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে নির্দ্ধিধায় তা করেছে৷ এই পথে যেসব সংকট , সমস্যা , কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে হাসি মুখে সেগুলো বরদাশত করেছে৷ অন্যায় পথে চলে লোকদের দুনিয়ায় নানান ধরনের স্বার্থ , ঐশ্বর্য ও সুখ - সম্ভার লাভ করার যেসব দৃশ্য সে দেখছে তা থেকে বঞ্চিত থাকার জন্য তার নিজের মধ্যে কোন ক্ষোভ বা আক্ষেপ জাগেনি৷ বরং সত্য দীন অনুসরণ করার ফলে সে যে এই সমস্ত আবর্জনা থেকে মুক্ত থেকেছে , এজন্য সে নিজের মধ্যে পূর্ণ নিশ্চিন্ততা অনুভব করেছে৷ কুরআনের অন্যত্র এই অবস্থাটিকে ' শারহে সদয় ' বা হৃদয় উন্মুক্ত করে দেয়া অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে৷ ( আল আন' আম , ১২৫ )
﴿ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً﴾
২৮) চলো তোমার রবের দিকে , ১৯ এমন অবস্থায় যে তুমি ( নিজের শুভ পরিণতিতে ) সন্তুষ্ট ( এবং তোমরা রবের প্রিয়পাত্র৷  
১৯. একথা তাকে মৃত্যুকালে ও বলা হবে , যখন কিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে যেতে থাকবে সে সময়ও বলা হবে এবং আল্লাহর আদালতে পেশ করার সময় ও তাকে একথা বলা হবে৷ প্রতিটি পর্যাযে তাকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দান করা হবে যে , সে আল্লাহর রহমতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷
﴿فَادْخُلِي فِي عِبَادِي﴾
২৯) শামিল হয়ে যাও আমার ( নেক ) বান্দাদের মধ্যে  
﴿وَادْخُلِي جَنَّتِي﴾
৩০) এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে৷  






==================================


এছাড়াও নফস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত : সুরা আশ শামস এর ৭ - ১০ নং আয়াত :

﴿وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا﴾
৭) মানুসের নফসের ও সেই সত্তার কসম যিনি তাকে ঠিকভাবে গঠন করেছেন৷৪  
৪ . 'ঠিকভাবে গঠন করেছেন ' মানে হচ্ছে , তাকে এমন একটি দেহ দান করেছেন , যা তার সুডৌল গঠনাকৃতি , হাত - পা ও মস্তিস্ক সংযোজনের দিক থেকে মানবিক জীবন যাপন করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ছিল৷ তাকে দেখার , শুনার , স্পর্শ করার , স্বাদ গ্রহণ করার ও ঘ্রাণ নেবার জন্য এমন ইন্দ্রিয় দান করেছেন যা তার বৈশিষ্ট ও আনুপাতিক কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে তার জন্য জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারতো ৷ তাকে চিন্তা ও বুদ্ধি শক্তি , যুক্তি উপস্থাপন ও প্রমাণ পেশ করার শক্তি , কল্পনা শক্তি , স্মৃতি শক্তি , পার্থক্য করার শক্তি , সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার শক্তি , সংকল্প শক্তি এবং এমন অনেক মানসিক শক্তি দান করেছেন যার ফলে সে এই দুনিয়ায় মানুষের মতো কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে৷ এছাড়া "ঠিকভাবে গঠন করার " মধ্যে এ অর্থও রয়েছে যে , তাকে জন্মগত পাপী ও প্রকৃতিগত বদমায়েশ হিসেবে তৈরি না করে বরং সহজ সরল প্রকৃতির ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন৷ তার গঠনাকৃতিতে এমন ধরনের কোন বক্রতা রেখে দেননি যা তাকে সোজাপথ অবলম্বন করতে চাইলেও করতে দিতো না ৷ একথাটিকেই সূরা রূমে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে : আরবী -------------------------------------------------------------------------------------" সেই প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও যার ওপর আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন৷ " ( ২০ আয়াত ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম এ কথাটিকেই একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেন : এমন কোন শিশু নেই যে প্রকৃতি ছাড়া অন্যকিছুর ওপর পয়দা হয়৷ তারপর মা- বাপ তাকে ইহুদি , খৃষ্টান বা অগ্নি উপাসক বানায়৷ এটা তেমনি যেমন পশুর পেট থেকে সুস্থ , সবল ও পূর্ণ অবয়ব বিশিষ্ট বাচ্চা পয়দা হয়৷ তোমরা কি তাদের কাউকে কানকাটা পেয়েছো ? ( বুখারী ও মুসলিম ) অর্থাৎ পরবর্তী কালে মুশরিকরা তাদের জাহেলী কুসংস্কারের কারণে পশুদের কান কেটে দেয়৷ নয়তো আল্লাহ কোন পশুকে তার মায়ের পেট থেকে কানকাটা অবস্থায় পয়দা করেননি৷ অন্য একটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : " আমার রব বলেন , আমার সকল বান্দাকে আমি হানীফ ( সঠিক প্রকৃতির উপর ) সৃষ্টি করেছিলাম৷ তারপর শয়তানরা এসে তাদেরকে তাদের দীন ( অর্থাৎ তাদের প্রাকৃতিক দীন) থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং তাদের ওপর এমন সব জিনিস হারাম করে দিয়েছে যা আমি তাদের জন্য হালাল করে দিয়েছিলাম৷ শয়তানরা আমার সাথে তাদেরকে শরীক করার জন্য তাদেরকে হুকুম দিয়েছে , অথচ আমার সাথে তাদের শরীক হবার ব্যাপারে আমি কোন প্রমাণ নাযিল করিনি৷ " ( মুসনাদে আহমাদ , ইমাম মুসলিম ও প্রায় একই রকম শব্দ সহকারে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন)
﴿فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا﴾
৮) তারপর তার পাপ ও তার তাকওয়া তার প্রতি ইলহাম করেছেন৷৫  
৫ . ইলহাম শব্দটির উৎপত্তি লহম ( আরবী ) থেকে৷ এর মানে গিলে ফেলা৷ যেমন বলা হয় ( আরবী------------) উমুক ব্যক্তি জিনিসটিকে দিলে ফেলেছে৷ আর ( আরবী ------) মানে হয় , আমি উমুক জিনিসটি তাকে গিলিয়ে দিয়েছি বা তার গলায় নীচে নামিয়ে দিয়েছি ৷ এই মৌলিক অর্থের দিক দিয়ে ইলহাম শব্দ পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কল্পনা বা চিন্তাকে অবচেতনভাবে বান্দার মন ও মস্তিষ্কের গোপন প্রদেশে নামিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়৷ মানুষের প্রতি তার পাপ এবং তার নেকী ও তাকওয়া ইলহাম করে দেয়ার দু'টি অর্থ হয়৷ এক, স্রষ্টা তার মধ্যে নেকী ও গোনাহ উভয়ের ঝোঁক প্রবণতা রেখে দিয়েছেন৷ প্রত্যেক ব্যক্তিই এটি অনুভব করে৷ দুই , প্রত্যেক ব্যক্তির অবচেতন মনে আল্লাহ এ চিন্তাটি রেখে দিয়েছেন যে , নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোন জিনিস ভালো ও কোন জিনিস মন্দ এবং সৎ নৈতিক বৃত্তি ও সৎকাজ এবং অসৎ নৈতিক বৃত্তি ও অসৎকাজ সমান নয়৷ ফুজুর ( দুস্কৃতি ও পাপ ) একটি খারাপ জিনিস এবং তাকওয়া ( খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা ) একটি ভালো জিনিস , এ চিন্তাধারা মানুষের জন্য নতুন নয়৷ বরং তার প্রকৃতি এগুলোর সাথে পরিচিত৷ স্রষ্টা তার মধ্যে জন্মগতভাবে ভালো ও মন্দের পার্থক্যবোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন৷ একথাটিই সূরা আল বালাদে এভাবে বলা হয়েছে : আরবী -------------------------------------------------------------------- " আর আমি ভালো ও মন্দ উভয় পথ তার জন্য সুম্পষ্ট করে রেখে দিয়েছি৷" ( ১০ আয়াত ) সূরা আদদাহরে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে : আরবী -------------------- " আমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি , চাইলে তার কৃতজ্ঞ হতে পারে আবার চাইলে হতে পারে অস্বীকারকারী৷ " ( ৩ আয়াত ) একথাটিই সূরা আল কিয়ামাহে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে : মানুষের মধ্যে একটি নফসে লাওয়ামাহ ( বিবেক ) আছে৷ সে অসৎকাজ করলে তাকে তিরস্কার করে৷ (২ আয়াত ) আর প্রত্যেক ব্যক্তি সে যতই ওজর পেশ করুক না কেন সে কি তা সে খুব ভালো করেই জানে৷ ( ১৪- ১৫ আয়াত )

এখানে একথাটি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে , মহান আল্লাহ স্বভাবজাত ও প্রকৃতিগত ইলহাম করেছেন প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি তার মর্যাদা ভুমিকা ও স্বরূপ অনুযায়ী৷ যেমন সূরা ত্বা - হা'য় বলা হয়েছে : আরবী ------------------------------------------------------------------------ " যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন , তারপর তাকে পথ দেখিয়েছেন ৷ " ( ৫০ আয়াত ) যেমন প্রাণীদের প্রত্যেক প্রজাতিকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ইলহামী জ্ঞান দান করা হয়েছে৷ যার ফলে মাছ নিজে নিজেই সাঁতার কাটে৷ পাখি উড়ে বেড়ায় ৷ মৌমাছি মৌচাক তৈরি করে৷ চাতক বাসা বানায় ৷ মানুষকেই তার বিভিন্ন পর্যায় ও ভূমিকার ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক ইলহামী জ্ঞান দান করা হয়েছে৷ মানুষ এক দিক দিয়ে প্রাণী গোষ্ঠীভুক্ত৷ এই দিক দিয়ে তাকে যে ইলহামী জ্ঞান দান করা হয়েছে তার একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে , মানব শিশু জন্মের সাথে সাথেই মায়ের স্তন চুষতে থাকে৷ আল্লাহ যদি প্রকৃতিগতভাবে তাকে এ শিক্ষাটি না দিতেন তাহলে তাকে এ কৌশলটি শিক্ষা দেবার সাধ্য কারো ছিল না৷ অন্যদিক দিয়ে মানুষ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী৷ এদিক দিয়ে তার সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তাকে অনবরত ইলহামী পথনির্দেশনা দিয়ে চলছেন৷ এর ফলে সে একের পর এক উদ্ভাবন ও আবিস্কারের মাধ্যমে মানব সভ্যতার বিকাশ সাধন করছে৷এই সমস্ত উদ্ভাবন ও আবিস্কারের ইতিহাস অধ্যয়নকারী যে কোন ব্যক্তিই একথা অনুভব করবেন যে,সম্ভবত মানুষের চিন্তা ও পরিশ্রমের ফল হিসেবে দু' একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকটি আবিস্কার আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছে৷হঠাৎ এক ব্যক্তির মাথার একটি চিন্তার উদয় হয়েছে এবং তারই ভিত্তিতে সে কোন জিনিস আবিস্কার করেছে৷ এই দু'টি মর্যাদা ছাড়াও মানুষের আর একটি মর্যাদা ও ভূমিকা আছে৷ সে একটি নৈতিক জীবও৷ এই পর্যায়ে আল্লাহ তাকে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি এবং ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ জানার অনুভূতি ইলহাম করেছেন৷এই শক্তি, বোধ ও অনুভূতি একটি বিশ্বজনীন সত্য৷ এর ফলে আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় এমন কোন সমাজসভ্যতা গড়ে ওঠেনি যেখানে ভালো ও মন্দের ধারণা ও চিন্তা কার্যকর ছিল না৷ আর এমন কোন সমাজ ইতিহাসে কোন দিন পাওয়া যায়নি এবং আজো পাওয়া না যেখানকার ব্যবস্থায় ভালো ও মন্দের এবং সৎ ও অসৎকর্মের জন্য পুরস্কার ও শাস্তির কোন না কোন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়নি৷ প্রতিযুগে,প্রত্যেক জায়গায় এবং সভ্যতা - সংস্কৃতির প্রত্যেক পর্যায়ে এই জিনিসটির অস্তিত্বই এর স্বভাবজাত ও প্রকৃতিগত হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ৷এছাড়াও একজন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ স্রষ্টা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই এটি গচ্ছিত রেখেছেন, একথাও এ থেকে প্রমানিত হয়৷ কারণ যেসব উপাদানে মানুষ তৈরি এবং যেসব আইন ও নিয়মের মাধ্যমে জড় জগত চলছে তার কোথাও নৈতিকতার কোন একটি বিষয়ও চিহ্নিত করা যাবে না৷

﴿قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا﴾
৯) নিসন্দেহে সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তির নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে  
﴿وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا﴾
১০) এবং যে তাকে দাবিয়ে দিয়েছে সে ব্যর্থ হয়েছে৷৬  
৬ . একথাটির ওপরই ওপরের আয়াগুলোতে বিভিন্ন জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে৷ ওই জিনিসগুলো থেকে একথাটি কিভাবে প্রমাণ হয় তা এখন চিন্তা করে দেখুন৷ যেসব গভীর তত্ব আল্লাহ মানুকে বুঝাতে চান সেগুলো সম্পর্কে তিনি কুরআনে যে বিশেষ নিয়ম অবলম্বন করেছেন তা হচ্ছে এই যে, সেগুলো প্রমাণ করার জন্য তিনি হাতের কাছের এমন কিছু সুম্পষ্ট ও সর্বজন পরিচিত জিনিস পেশ করেন, যা প্রত্যেক ব্যক্তি তার আশেপাশে অথবা নিজের অস্তিত্বের মধ্যে প্রতিদিন ও প্রতি মুহূর্তে দেখে৷এই নিয়ম অনুযায়ী এখানে এক এক জোড়া জিনিস নিয়ে তাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে পেশ করা হয়েছে৷ তারা পরস্পরের বিপরীতধর্মী কাজেই তাদের প্রভাব ও ফলাফলও সমান নয়৷ বরং অনিবার্যভাবে তারা পরস্পর বিভিন্ন৷ একদিকে সূর্য,অন্যদিকে চাঁদ৷সূর্যের আলো অত্যন্ত প্রখর৷এর মধ্যে রয়েছে তাপ৷ এর তুলনায় চাঁদের নিজের কোন আলো নেই৷ সূর্যের উপস্থিতিতে সে আকাশে থাকলেও আলোহীন থাকে৷ সূর্য ডুবে যাবার পর সে উজ্জ্বল হয়৷ সে সময়ও তার আলোর মধ্যে রাতকে দিন বানিয়ে দেবার ঔজ্জ্বল্য থাকে না৷ সূর্য তার আলোর প্রখরতা দিয়ে দুনিয়ায় যে কাজ করে চাঁদের আলোর মধ্যে সে প্রখরতা থাকে না৷ তবে তার নিজস্ব কিছু প্রভাব রয়েছে৷ এগুলো সূর্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির৷ এভাবে একদিকে আছে দিন এবং অন্যদিকে রাত৷ এরা পরস্পরের বিপরীতধর্মী৷ উভয়ের প্রভাব ও ফলাফল এত বেশী বিভিন্ন যে, এদেরকে কেউ একসাথে জমা করতে পারে না৷ এমন কি সবচেয়ে নিবোর্ধ ব্যক্তিটির পক্ষেও একথা বলা সম্ভব হয় না যে, রাত হলেই বা কি আর দিন হলেই বা কি, এতে কোন পার্থক্য হয় না৷ ঠিক তেমনি একদিকে রয়েছে আকাশ৷ স্রষ্টা তাকে উঁচুতে স্থাপন করেছেন৷ অন্যদিকে রয়েছে পৃথিবী৷ এর স্রষ্টা একে আকাশের তলায় বিছানার মতো করে বিছিয়ে দিয়েছেন৷ এরা উভয়েই একই বিশ্ব জাহানের ও তার ব্যবস্থার সেবা করছে এবং তার প্রয়োজন পূর্ণ করছে৷ কিন্তু উভয়ের কাজ এবং প্রভাব ও ফলাফলের মধ্যে আসমান - যমীন ফারাক৷ উর্ধজগতের এই সাক্ষ প্রমাণগুলো পেশ করার পর মানুষের নিজের শরীর সম্পর্কে বলা হয়েছে,তার অংগ -প্রত্যংগ এবং ইন্দ্রিয় ও মস্তিস্কের শক্তিগুলোকে আনুপাতিক ও সমতাপূর্ণ মিশ্রণের মাধ্যমে সুগঠিত করে স্রষ্টা তার মধ্যে সৎ ও অসৎ প্রবনতা ও কার্যকারণসমূহ রেখে দিয়েছেন৷ এগুলো পরস্পরের বিপরীত ধর্মী ইলহামী তথা অবচেতনভাবে তাকে এদের উভয়ের পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, এদের একটি হচ্ছে ফুজুর - দুষ্কৃতি,তা খারাপ এবং অন্যটি হচ্ছে,তাকওয়া - আল্লাহভীতি,তা ভালো৷এখন যদি সূর্য ও চন্দ্র, রাত ও দিন এবং আকাশ ও পৃথিবী এক না হয়ে থাকে বরং তাদের প্রভাব ও ফলাফল অনিবার্যভাবে পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে থাকে তাহলে,মানুষের নফসের দুস্কৃতি ও তাকওয়া পরস্পরের বিপরীতধর্মী হওয়া সত্ত্বেও এক হতে পারে কেমন করে ? মানুষ নিজেই এই দুনিয়ায় নেকী ও পাপকে এই মনে করে না৷ নিজের মনগড়া দর্শনের দৃষ্টিতে সে ভালো ও মন্দের কিছু মানদণ্ড তৈরি করে নিয়েই থাকে তাহলেও যে জিনিসটিকে সে নেকী মনে করে, সে সম্পর্কে তার অভিমত হচ্ছে এই যে,তা প্রশংসনীয় এবং প্রতিফল ও পুরস্কার লাভের যোগ্য৷ অন্যদিকে যাকে সে অসৎ ও গোনাহ মনে করে,সে সম্পর্কে তার নিজের নিরপেক্ষ অভিমত হচ্ছে এই যে,তা নিন্দনীয় ও শাস্তির যোগ্য৷ কিন্তু আসল ফায়সালা মানুষের হাতে নেই৷ বরং যে স্রষ্টা মানুষের প্রতি তার গোনাহ ও তাকওয়া ইলহাম করেছেন তার হাতেই রয়েছে এর ফায়সালা৷ স্রষ্টার দৃষ্টিতে যা গোনাহ ও দুষ্কৃতি আসলে তাই হচ্ছে গোনাহ ও দুষ্কৃতি এবং তাঁর দৃষ্টিতে যা তাকওয়া আসলে তাই হচ্ছে তাকওয়া৷ স্রষ্টার কাছে এ দু'টি রয়েছে পৃথক পরিণাম৷ একটির পরিণাম হচ্ছে, যে নিজের নফসের পরিশুদ্ধি করবে সে সাফল্য লাভ করবে এবং অন্যটির পরিণাম হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজের নফসকে দাবিয়ে দেবে সে ব্যর্থ হবে ৷

তাযাক্কা আরবী ------- পরিশুদ্ধ করা মানে পাক -পবিত্র করা, বিকশিত করা এবং উদ্বুদ্ধ ও উন্নত করা৷পূর্বাপর সম্পর্কের ভিত্তিতে এর পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ায়, যে ব্যক্তি নিজের নফস ও প্রবৃত্তিকে দুষ্কৃতি থেকে পাক -পবিত্র করে, তাকে উদ্বুদ্ধ ও উন্নত করে তাক‌ওয়ার উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং তার মধ্যে সৎপ্রবণতাকে বিকশিত করে, সে সাফল্য লাভ করবে৷ এর মোকাবেলায় দাসসাহা আরবী ------- শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷এর শব্দমূল হচ্ছে তাদসীয়া আরবী ------------- তাদসীয়া মানে হচ্ছে দাবিয়ে দেয়া, লুকিয়ে ফেলা ,ছিনিয়ে নেয়া,আত্মসাৎ করা ও পথভ্রষ্ট করা৷ পূর্বাপর সম্পর্কের ভিত্তিতে এর অর্থও এখানে সুস্পষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ সেই ব্যক্তি ব্যর্থ হবে,যে নিজের নফসের মধ্যে নেকী ও সৎকর্মের যে প্রবণতা পাওয়া যাচ্ছিল তাকে উদ্দীপিত ও বিকশিত করার পরিবর্তে দাবিয়ে দেয়, তাকে বিভ্রান্ত করে অসৎপ্রবণতার দিকে নিয়ে যায় এবং দুস্কৃতিকে তার ওপর এত বেশী প্রবল করে দেয়া যার ফলে তাকওয়া তার নীচে এমন ভাবে মুখ ঢাকে যেমন কোন লাশকে কবরের মধ্যে রেখে তার ওপর মাটি চাপা দিলে তা ঢেকে যায়৷ কোন কোন তাফসীরকার এই আয়াতের অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন আরবী ------------------ অর্থাৎ যে ব্যক্তির নফসকে আল্লাহ পাক - পবিত্র করে দিয়েছেন সে সাফল্য লাভ করেছে এবং যার নফসকে আল্লাহ দাবিয়ে দিয়েছেন সে ব্যর্থ হয়ে গেছে৷ কিন্তু এ ব্যাখ্যাটি প্রথমত ভাষার দিক দিয়ে কুরআনের বর্ণনাভংগীর পরিপন্থী৷ কারণ আল্লাহর যদি একথা বলাই উদ্দেশ্য হতো তাহলে তিনি এভাবে বলতেন :আরবী ----------------------------------------------------------------------(যে নফসকে আল্লাহ পাক - পবিত্র করে দিয়েছেন সে সফল হয়ে গেছে এবং ব্যর্থ হয়ে গেছে সেই নফস যাকে আল্লাহ দাবিয়ে দিয়েছেন৷) দ্বিতীয়, এই ব্যাখ্যাটি এই বিষয়বস্তু সম্বলিত কুরআনের অন্যান্য বর্ণনার সাথে সংঘর্ষশীল৷ সূরা আ'লায় মহান আল্লাহ বলেছেন :আরবী ----------------------- (সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তি যে পবিত্রতা করেছে - ৪ আয়াত ) সূরা 'আবাসায় মহান আল্লাহ রসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেন :আরবী ------------------------------------------ "তোমাদের ওপর কি দায়িত্ব আছে যদি তারা পবিত্রতা অবলম্বন না করে ?এই দু'টি আয়াতে পবিত্রতা অবলম্বন করাকে বান্দার কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷এ ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ সত্যটি বর্ণনা করা হয়েছে যে,এই দুনিয়ায় মানুষের পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে৷ যেমন সূরা দাহ্‌র - এ বলা হয়েছে :" আমি মানুষকে একটি মিশ্রিত শুক্র থেকে পয়দা করেছি, যাতে তাকে পরীক্ষা করতে পারি ,তাই তাকে আমি শোনার ও দেখার ক্ষমতা দিয়েছি৷" (২ আয়াত ) সূরা মূলকে হয়েছে :"তিনি মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে৷"(২ আয়াত ) যখন একথা সুস্পষ্ট পরীক্ষা গ্রহণকারী যদি আগেভাগেই একজন পরীক্ষার্থীকে সামনে বাড়িয়ে দেয় এবং অন্যজনকে দাবিয়ে দেয় তাহলে আদতে পরীক্ষাই অর্থহীন হয়ে পড়ে৷ কাজেই কাতাদাহ , ইকরামা , মুজাহিদ ও সাঈদ ইবনে জুবাইর যা বলেছেন সেটিই হচ্ছে এর আসাল তাফসীর৷ তারা বলেছেন : যাক্কাহা ও দাসসাহা'র কর্তা হচ্ছে বান্দা , আল্লাহ নন৷ আর ইবনে আবী হাতেম জুওয়াইর ইবনে সাঈদ থেকে এবং তিনি যাহহাক থেকে এবং যাহহাক ইবনে আব্বাস ( রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন , যাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এই আয়াতের অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন : আরবী --------------------------------------------------------------------- ( সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তি যাকে মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ পবিত্র করে দিয়েছেন ) এই হাদীসটি সম্পর্কে বলা যায় , এখানে রসূলুল্লাহ (সা) এর যে উক্তি পেশ করা হয়েছে তা আসলে তাঁর থেকে প্রমাণিত নয়৷ কারণ এই সনদের রাবী জুওয়াইর একজন প্রত্যাখ্যাত রাবী৷ অন্যদিকে ইবনে আব্বাসের সাথে যাহহাকের সাক্ষাত হয়নি৷ তবে ইমাম আহমাদ , মুসলিম , নাসাঈ ও ইবনে আবী শাইবা হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম ( রা) থেকে যে রেওয়ায়াতটি করেছেন সেটি অবশ্যি একটি সহীহ হাদীস৷ তাতে বলা হয়েছে , নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করতেন : আরবী ------------------------------------------------------------------------------------ "হে আল্লাহ !আমার নফসকে তার তাকওয়া দান করো এবং তাকে পবিত্র করো৷তাকে পবিত্র করার জন্যে তুমিই সর্বোত্তম সত্তা৷ তুমিই তার অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক৷' রসূলের প্রায় এই একই ধরনের দোয়া তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া ও ইবনুল মুনযির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এবং ইমাম আহমাদ হযরত আয়েশা থেকে উদ্ধৃত করেছেন৷ মূলত এর অর্থ হচ্ছে,বান্দা কেবল তাকওয়া ও তাযকীয়া তথা পবিত্রতা অবলম্বন করার ইচ্ছাই প্রকাশ করতে পারে৷তবে তা তার ভাগ্যে যাওয়া আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওফীকের ওপর নির্ভর করে৷তাদসীয়া তথা নফসকে দাবিয়ে দেবার ব্যাপারেও এই একই অবস্থা অর্থাৎ আল্লাহ জোর করে কোন নফসকে দাবিয়ে দেন না৷ কিন্তু বান্দা যখন এ ব্যাপারে একেবারে আদা - পানি খেয়ে লাগে তখন তাকে তাকওয়া ও তাযকীয়ার তাওফীক থেকে বঞ্চিত করেন এবং সে তার নফসকে যে ধরনের ময়লা আবর্জনার মধ্যে দাবিয়ে দিতে চায় তার মধ্যেই তাকে ছেড়ে দেন৷






প্রশ্ন: ৪০৬ : ওয়াদা ও কসম এর পার্থক্য এবং ভঙ্গ করার কাফফারা।

 কসম ও ওয়াদার মাঝে পার্থক্য:

১)  এখানে এ বিষয়টি খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, ওয়াদা করা আর কসম খাওয়া এক জিনিস নয়। কেউ হয়ত মনে মনে বা কারো কাছে ওয়াদা করল যে, সে এ কাজটা করবে কিন্তু পরে কোন কারণে তা করতে পারল না। তাহলে তা ‘কসম ভঙ্গ’ হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ সে আল্লাহর নামে কসম করে নি। কিন্তু অবশ্যই তা ওয়াদার খেলাফ বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করার  পর্যায়ে পড়বে, যা ক্ষেত্রবিশেষে কবিরা গুণাহর কারণ হয়ে পড়তে পারে । আর যদি ঐ ওয়াদা অন্য কারো সাথে হয়ে থাকে তবে তা  দ্বীন ভঙ্গের কারণ হয়ে দাড়ায়।  কারণ, মুমিনের একটি প্রধান গুণই হলো সে কখনো ওয়াদার খেলাফ করেনা, সে কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেনা।  

২) পক্ষান্তরে কেউ যদি বলে, “আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, উমুক কাজটা করব।” তাহলে এটা হল কসম। এখন সে যদি উক্ত কাজটা না করে তাহলে তা ‘কসম ভঙ্গ’ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে কসম ভঙ্গের কাফফারা দিতে হবে। কিন্তু সাধারণ ওয়াদা/অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তার কোন কাফফারা নেই। কিন্তু ওয়াদা রক্ষা না করতে পারার কারণে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং যার সাথে ওয়াদা করেছিল তার কাছে ক্ষমা চাইবে। আল্লাহু আলাম।

১) কিন্তু আপনি কারো সাথে যখন ওয়াদা করেন তখন সেইটার গুরুত্ব আবার  অন্যরকম। তা তখন অঙ্গীকার পর্যায়ে চলে যায়। 

অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা, রক্ষা মুমিনের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্ব বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩৪)

অন্যত্র মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১)

আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করো।

 (আল-আনআম, আয়াত: ১৫২)

অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। ’ (সুরা রাদ, আয়াত: ২০)

মহান আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ করো। ’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৯১)।

অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হারাম ও মুনাফেকি
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। অনুরূপ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার মধ্যে দ্বীন নেই। ’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা : ১৫)

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি: কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে চারটি। চতুর্থটি হলো যখন বিবাদ করে, গালাগাল করে। ’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত, ১৭ পৃষ্ঠা)

হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, অঙ্গীকার পূরণের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক আছে। যার ঈমানের ঘাটতি রয়েছে, সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। আর এর ফলে আল্লাহ তাআলা শত্রুদের তাদের ওপর প্রবল ও শক্তিশালী করে দেন।  

আল্লাহ তাআলা তার বিরুদ্ধে বাদী হবেন...
হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। ১. যে ব্যক্তি অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে এবং ৩. যে ব্যক্তি কোনো কর্মচারী নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না’ (সহিহ বুখারি)।

অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ
মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো নেতার আনুগত্যের অঙ্গীকার করে, তার উচিত সাধ্যমতো তার আনুগত্য করা (মুসলিম)। 

আবার,  কাউকে বৈধ কোনো কিছুর প্রতিশ্রুতি দিলে বা অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করা আবশ্যক। বরং, আপনার ওয়াদা দেওয়ার কারণে এবং তা পূর্ণ না করার কারণে ঐ ব্যাক্তি  যদি কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে এর কাফফারা হলো, আপনি তওবা করার সাথে সাথে ঐ ব্যাক্তির ক্ষতিপূরণও দিয়ে দিবেন। 

মহান  আল্লাহ আমাদেরকে অংগীকার ও ওয়াদা সমূহ পূরণ করার  তাওফিক দান করুন। আমীন। 


২) 

কসম ভঙ্গ : 

কসম হচ্ছে, যে ওয়াদা বা অঙ্গীকার আল্লাহর নামে করা হয়। 

কোন ব্যক্তি যদি কোন কাজ করবে বলে আল্লাহর নামে কসম করে তারপর তা ভঙ্গ করে তাহলে তার জন্য কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব।

কসম ভঙ্গের কাফফারা হল:

– দশজন মিসকিনকে মধ্যম ধরণের খাবার খাবার খাওয়ানো।
– অথবা ১০ জন মিসকিনকে পোশাক দেয়া।
– অথবা একজন গোলাম আযাদ করা।
– এ তিনটি কোনটি সম্ভব না হলে তিনটি রোযা রাখা।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّـهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَـٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ الْأَيْمَانَ ۖ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ ۖ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ۚ ذَٰلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ ۚ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; কিন্তু পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্যে যা তোমরা মজবুত করে বাধ। অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; মধ্যম শ্রেনীর খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা, তাদেরকে বস্তু প্রদান করবে অথবা, একজন ক্রীতদাস কিংবা দাসী মুক্ত করে দিবে। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না, সে তিন দিন রোযা রাখবে। এটা কাফফরা তোমাদের শপথের, যখন শপথ করবে। তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” সূরা মায়িদাহ: ৮৯)

সুতরাং কেউ যদি আর্থিক সংকটের কারণে উপরোক্ত তিনটি জিনিসের কোনটি দ্বারা কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে তিনটি রোযা রাখবে।


জমহুর আলেমের অভিমত হচ্ছে– নগদ অর্থ দিয়ে কাফ্‌ফারা দিলে আদায় হবে না।

ইবনে কুদামা বলেন: কাফ্‌ফারা আদায় করার ক্ষেত্রে খাদ্য কিংবা বস্ত্রের মূল্য দিয়ে দিলে কাফ্‌ফারা আদায় হবে না। কেননা আল্লাহ্‌ খাদ্যের কথা উল্লেখ করেছেন সুতরাং অন্য কিছু দিয়ে কাফ্‌ফারা আদায় হবে না। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলা তিনটি পদ্ধতি থেকে একটি চয়ন করার সুযোগ দিয়েছেন। যদি মূল্য দেয়া জায়েয হত তাহলে তিনটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন অর্থ থাকে না।[ইবনে কুদামা এর আল-মুগনি (১১/২৫৬) থেকে সমাপ্ত]

শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন: কাফ্‌ফারা অবশ্যই খাদ্য হতে হবে; অর্থ নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাহ্‌তে খাদ্যের কথাই এসেছে। আবশ্যকীয় পরিমাণ হচ্ছে– অর্ধ সা’ দেশীয় খাদ্যদ্রব্য; যেমন- খেজুর, গম ইত্যাদি। আধুনিক পরিমানের হিসাবে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। আর যদি আপনি তাদেরকে দুপুরের খাবার খাইয়ে দেন বা রাতের খাবার খাইয়ে দেন কিংবা পোশাক পরিয়ে দেয়, যে পোশাক দিয়ে নামায পড়া জায়েয হবে সেটাও যথেষ্ট। এমন পোশাক হচ্ছে– একটা জামা (জুব্বা) কিংবা একটা লুঙ্গি ও চাদর। [ফাতাওয়া ইসলামিয়া (৩/৪৮১)থেকে সমাপ্ত]

শাইখ উছাইমীন বলেন: যদি কেউ ক্রীতদাস না পায়, পোশাক বা খাবার দিতে না পারে তাহলে সে তিনদিন রোযা রাখবে। এ রোযাগুলো লাগাতরভাবে রাখতে হবে। মাঝে কোনদিন রোযা ভাঙ্গা যাবে না।[ফাতাওয়া মানারুল ইসলাম (৩/৬৬৭)

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।


৩) 

প্রশ্ন : অনেকবার আমার স্বামীকে বলেছি, এ রকম কথা আর তোমাকে বলব না। কিন্তু তারপরও বলে ফেলেছি। আবার বলেছি, আল্লাহ, এ রকম কাজ আর কোনোদিন করব না। তার পরও করা হয়েছে। এতে কি আমার ওয়াদা ভঙ্গ হয়েছে? ওয়াদা ভঙ্গ করলে তিনটা রোজা করে দিতে হয়। আমাকে কি রোজা করে দিতে হবে? আর তা করতে হলে কতগুলো রোজা করতে হবে?

উত্তর : এখানে বোন যে কারণে প্রশ্নটি করেছেন, সেটা হলো, তিনি অনেকবার ওয়াদা খেলাফ করেছেন। ওয়াদা খেলাফ করার বিষয়টি মূলত নৈতিক অবক্ষয় এবং জঘন্যতম অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসের মধ্যে বলেছেন, ‘আয়াতুল মুনাফেকে সালাস’ অর্থাৎ মুনাফেকের নিদর্শন হচ্ছে তিনটি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ওয়াদা খেলাফ। মোনাফেক কোনো ওয়াদা করলে, তা খেলাফ করে। সুতরাং ওয়াদা খেলাফ করা কিন্তু জঘন্যতম অন্যায়-অপরাধ। এবং এটি মুনাফেকের লক্ষণ। সুতরাং আপনি বারবার একটি কাজ করবেন না বলছেন, আবার করছেন। এর অর্থ আপনি শুধুমাত্র মৌখিকভাবে এ ওয়াদাটুকু করছেন কিন্তু এর জন্য অন্তরের যে উপলব্ধি দরকার, সংকল্প দরকার, সেটি আপনার আসছে না। সুতরাং যতদিন পর্যন্ত সংকল্প না আসবে ততদিন পর্যন্ত আপনার এ ওয়াদাটুকু শুধুমাত্র একটি মৌখিক ওয়াদা। এর মাধ্যমে আপনি কার্যত কোনো ফল পাবেন না। এবং এর জন্য আপনি গুনাহগার হবেন। যেহেতু এ কাজের মাধ্যমে আপনি অন্যকে প্রতারিত করছেন এবং নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং এটি গুনাহর কাজ সেটি খেয়াল রাখতে হবে। বাকি আপনি নিজেও একটি ফতোয়া দিয়েছেন, যে ফতোয়াটি আপনার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেটা হচ্ছে, এর জন্য তিনদিনের সিয়াম পালন করা।

না। এ ধরনের ওয়াদা ভঙ্গ যদি কেউ করে থাকেন, তাহলে তিনি গুনাহগার হবেন। তার এই কাজটি কবিরা গুনাহ হবে, ওয়াদা খেলাফ করার কারণে। কিন্তু তার জন্য তিনদিনের রোজা রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটি কসম নয়। অর্থাৎ এটি কসমের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়নি।  

কসমের জন্য শর্ত হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নামে যদি কেউ ওয়াদা করে থাকেন এবং সেটি যদি ভঙ্গ করেন, তাহলেই কেবল কসমের যে কাফফারা আছে, সেটি তিনি আদায় করবেন। তবে বোনের এ ওয়াদা কসম নয়, অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নামে তিনি ওয়াদা করেননি। কসম হতে হলে আল্লাহর নামে কসম করছেন বলে উল্লেখ করতে হবে। এ জন্য বোনকে সিয়াম পালন করতে হবে না। তবে অবশ্যই তওবা করার প্রয়োজন রয়েছে এবং নিজেকে সংশোধন করে এ কাজ থেকে ফিরে আসা দরকার, যেহেতু এটি বড় ধরনের ওয়াদা খেলাফের কাজ। 


৪) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কেউ যদি কোন গর্হিত কাজের বা অন্যায় কাজের ওয়াদা করে বা কসম করে, প্রথমত এ ধরণের ওয়াদা বা কসম করাই অন্যায়, আর এর কাফফারা হচ্ছে, ঐ ওয়াদা বা কসম রক্ষা না করা। এবং এ ধরণের ওয়াদা যদি কারো সাথে করে থাকে তবে, তৎক্ষণাত তাকে জানিয়ে দিতে হবে, আমি এই ওয়াদা বা কসম অন্যায় ভাবে করেছি, তাই আমি এ ওয়াদা বা কসম রক্ষা করা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম। এবং এজন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমাও চাইতে হবে। 


মহান আল্লাহ আমাদেরকে ওয়াদা ও কসম এর ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার তৌফিক দান করুন। 


Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...