ইসলামী শরীয়তে চুল রাখা বিষয়ে নীতিমালা কী?
প্রশ্ন
প্রশ্ন ঃ ইসলামিক শরীয়ত ভিত্তিক চুল রাখার নিয়ম কি। নবীজি কিভাবে চুল রেখেছেন এবং বাবরী চুল রাখার নিয়ম কিভাবে ও কি কি????
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحمن
রাসূল সাঃ সর্বদাই বাবরী রেখেছেন। তাই বাবরী রাখা রাসূল সাঃ এর সুন্নত।
বাবরী তিনি কিভাবে রাখতেন?
এ বিষয়ে তিন ধরণের বর্ণনা এসেছে। যথা-
১
ওয়াফরা তথা কানের লতি পর্যন্ত চুল।
২
লিম্মা তথা গর্দান ও কানের লতির মাঝামাঝি বরাবর বড় রাখা।
৩
জুম্মা তথা ঘাড় পর্যন্ত আলম্বিত চুল।
عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: «كَانَ شَعْرُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى شَحْمَةِ أُذُنَيْهِ» (سنن ابى داود، رقم الحديث-4185)
হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ এর চুল তাঁর দুই কানের লতি পর্যন্ত লম্বা ছিল। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৮৫}
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: «كَانَ شَعْرُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوْقَ الْوَفْرَةِ، وَدُونَالْجُمَّةِ» (سنن ابى داود، رقم الحديث–
4187)
হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ এর চুল ঘাড়ের উপর এবং কানের নীচ পর্যন্ত লম্বা ছিল। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৮৭}
عَنِ الْبَرَاءِ، قَالَ: «مَا رَأَيْتُ مِنْ ذِي لِمَّةٍ أَحْسَنَ فِي حُلَّةٍ حَمْرَاءَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» زَادَ مُحَمَّدُ بْنُ سُلَيْمَانَ: «لَهُ شَعْرٌ يَضْرِبُ مَنْكِبَيْهِ» (سنن ابى داود، رقم الحديث-4183)
হযরত বারা বিন আজেব রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কোন ব্যক্তিকে কান পর্যন্ত বাবরীধারী, লাল ইয়ামেনী চাদরের আবরণে রাসূল সাঃ থেকে অধিক সুন্দর দেখিনি। রাবী মুহাম্মদ রহঃ অতিরিক্ত বর্ণনা করে বলেন যে, তাঁর চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ছিল। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৮৩}
হজ্ব শেষে চুল কামানো, আর অন্য সময় উপরোক্ত তিন পদ্ধতির বাবরি রাখাই রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত। আর কোন পদ্ধতির চুল রাখার কোন বর্ণনা রাসূল সাঃ থেকে প্রমানিত নয়।
তাই বাবরি রাখাই রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত সুন্নত। অন্য কোন পদ্ধতি রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত সুন্নত বলা যাবে না।
হ্যাঁ, হযরত আলী রাঃ সহ আরো কিছু সাহাবী থেকে চুল কামিয়ে ফেলা প্রমাণিত। যা চুল কামানোকে জায়েজ প্রমাণিত করে। কিন্তু এটি রাসূল সাঃ এর সুন্নত বলা যাবে না। সাহাবায়ে কেরামের সুন্নত বলা যাবে।
চুল রাখার ক্ষেত্রে একটি নিষিদ্ধ পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেটি হল, মাথার এক পাশের চুল কামিয়ে ফেলা, আরেকদিকের চুলকে রেখে দেয়া। এ পদ্ধতি নিষিদ্ধ তথা হারাম। তাই এ পদ্ধতিতে চুল রাখা জায়েজ নয়।
আর কোন পদ্ধতির জায়েজ বা নাজায়েজের কোন কথা পরিস্কার ভাষায় হাদীসে বর্ণিত হয়নি। বা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত নয়। তাই উপরোক্ত নিষিদ্ধ পদ্ধতি বাদ দিয়ে যেকোন পদ্ধতিতে চুল রাখা জায়েজ। যেমন সমস্ত মাথার চুল সমান করে কাটা। বা সামনে খানিক বড় পিছনে ছোট। বা একদিকে বড় আরেক দিকে ছোট ইত্যাদি পদ্ধতি যতক্ষণ না কোন বিধর্মীর অনুসরণে করা না হবে ততক্ষণ তা নাজায়েজ বলার কোন সুযোগ নেই।
তবে এক্ষেত্রে অন্য সকল বিষয়ের মত চুল রাখার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, তা হল, চুলের কাটিং যেন কোন ফাসিক বা কাফির তথা বিধর্মী কোন ব্যক্তি বা দলের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ না হয়। যদি কোন কাফের বা ফাসিকের সাথে সাদৃশ্য রেখে চুল রাখা হয় তাহলে তা জায়েজ হবে না।
যেমন কোন বিধর্মী খেলোয়ারের হেয়ার স্টাইল নকল করে তার মত চুলে স্টাইল করা ইত্যাদি।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: «نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ القَزَعِ»، وَالْقَزَعُ: أَنْ يُحْلَقَ رَأْسُ الصَّبِيِّ فَيُتْرَكَ بَعْضُ شَعْرِهِ (سنن ابى داود، رقم الحديث-4193)
হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ কুযা করতে নিষেধ করেছেন। “কুযা” বলা হয়, বাচ্চার মাথার একাংশ কামিয়ে ফেলা, আরেকাংশের চুল না কামানো। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৯৩}
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪০৩১}
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: كَانَتْ لِي ذُؤَابَةٌ، فَقَالَتْ لِي أُمِّي: لَا أَجُزُّهَا، «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمُدُّهَا، وَيَأْخُذُ بِهَا» (سنن ابى داود، رقم الحديث-4197)
হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মাথায় চুলের খোঁপা ছিল। আমার মা বলেন, আমি তা কাটবো না। কেননা, রাসূল সাঃ তা ধরে লম্বা করতেন এবং কাছে টেনে নিতেন। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৯৭}
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
=============================
বর্তমান প্রজন্ম অত্যন্ত ফ্যাশনপ্রিয়। নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রত্যেকেরই ফ্যাশন সচেতনতার ধরন ভিন্ন। তারই ধারাবাহিকতায় এখনকার যুগের ছেলেরাও চুলের যত্নে বেশ সচেতন। যদিও এ ব্যাপারে ইসলামের কোনো নির্দেশনা আছে কি না, সে ব্যাপারে তারা অচেতনই রয়ে গেছে। নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে তারা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে নতুন নতুন হেয়ার স্টাইলের দিকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পায় বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের হেয়ার স্টাইলগুলোই। অথচ রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩১)
বর্তমানে আমাদের দেশে যে হেয়ার স্টাইলগুলো জনপ্রিয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, শর্ট কাট বা আন্ডার কাট, ক্লাসিক কাট, ফেড কাট, ক্রু কাট, বাজ কাট, লেয়ার স্পাইক, ইমো সুইপ ইত্যাদি। যেগুলোর কোনোটিকেই ইসলাম সমর্থিত কাট বলা যায় না। কারণ প্রতিটি স্টাইলেই মাথার কিছু অংশে বড় চুল ও কিছু অংশে ছোট চুল রাখা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু অংশ ছেঁটে ফেলা হয়। রাসুল (সাঃ) এভাবে চুল কাটতে নিষেধ করেছেন।
হজরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সাঃ)-কে ‘কাজা’ থেকে নিষেধ করতে শুনেছি। (বর্ণনাকারী ওবায়দুল্লাহ বলেন) আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাজা’ কী? তখন আবদুল্লাহ (রাঃ) আমাদের ইঙ্গিতে দেখিয়ে বললেন, শিশুদের যখন চুল কামানো হয়, তখন এখানে-ওখানে চুল রেখে দেয়। এ কথা বলার সময় ওবায়দুল্লাহ তাঁর কপাল ও মাথার দুই পাশে দেখালেন। ওবায়দুল্লাহকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো, বালক ও বালিকার জন্য কি একই নির্দেশ? তিনি বলেন, আমি জানি না। এভাবে তিনি বালকের কথা বলেছেন। ওবায়দুল্লাহ বলেন, আমি এ কথা আবার জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, পুরুষ শিশুর মাথার সামনের ও পেছনের দিকের চুল কামানো দোষণীয় নয়। আর (অন্য এক ব্যাখ্যা মতে) ‘কাজা’ বলা হয়—কপালের ওপরে কিছু চুল রেখে বাকি মাথার কোথাও চুল না রাখা। তেমনিভাবে মাথার চুল এক পাশ থেকে অথবা অন্য পাশ থেকে কাটা। (বুখারি, হাদিস : ৫৯২১)
পুরুষের চুল রাখা ও কাটার ব্যাপারে ইসলামী শরিয়ত তিনটি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এক. বাবরি চুল রাখা। বাবরি চুল রাখার তিনটি সুন্নত পদ্ধতি রয়েছে। ১. ওয়াফরা তথা কানের লতি পর্যন্ত চুল রাখা। (আবু দাউদ, ৪১৮৫)
২. লিম্মা তথা ঘাড় ও কানের লতির মাঝামাঝি পর্যন্ত চুল রাখা। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৮৭)
৩. জুম্মা তথা ঘাড় পর্যন্ত রাখা। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৮৩)
দুই. মুণ্ডিয়ে ফেলা। ইসলামের দৃষ্টিতে মাথা মুণ্ডিয়ে ফেলাও সুন্নত। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৫/১৪৯, ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ১২/৪৩)
তিন. সব চুল সমান করে কাটা। যাদের হেয়ার স্টাইলের শর্ট কাট বা আন্ডার কাট, তারা একটু সচেতনভাবে কাটলেই গুনাহ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। আর নিয়ত থাকতে হবে ইসলামের প্রতি সম্মান। কোনো অমুসলিম সেলিব্রেটির অনুসরণ নয়। কারণ প্রতিটি কাজই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।
No comments:
Post a Comment