ইসলাম ধর্মে নানান কারণে মহরমের গুরুত্ব থাকলেও আমরা মহরমকে চিনি বেদনা বিধুর মাস হিসেবে। প্রতি বছর আমাদের কাছে মহরম আসে শোকের বার্তা নিয়ে। এই দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পালন করেন বিশ্বের মুসলমানগণ। বাংলাদেশেও যথেষ্ট ভাব গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ১০ই মহরম পালন করা হয়।
শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত আলি (রা.) ও বিবি ফাতেমার আদরের সন্তান হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ও মাবিয়ার পুত্র স্বৈরাচার এজিদকে গণতন্ত্রের মাধ্যমে ও ইসলামিক ভাবধারায় দেশের শাসনভার গ্রহণ এবং পরিচালনার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি বাদশাহর পুত্র বাদশাহ হবে এই ভাবধারায় জোরপূর্বক মক্কার শাসনভার গ্রহণ করে নেন এবং স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। তখন হজরত ইমাম হোসেন (রা.) স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এজিদ শাসকগোষ্ঠীর সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হন। এজিদ বাহিনী সম্মুখ সমরে না-গিয়ে ষড়যন্ত্র করে কুফা নামক স্থানে আমন্ত্রণ করে রাস্তায় অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে এবং কারবালার প্রান্তরে তাদের ঘিরে ফেলে ও পানীয় জল বন্ধ করে দেয়। ইমাম হোসেন (রা.)-এর পরিবারসহ অন্যান্য লোকেরা বীর বিক্রমে অগ্রসর হয়ে অনেকেই শত্রুদের হাতে শহিদ হন। ইমাম হোসেন (রা.) যুদ্ধ করে পানি সংগ্রহ করে পান করার সময় দেখেন তার স্বজনগণ শহিদ হয়ে গিয়েছে। তখন তিনি স্বজনহারার বেদনায় পানি হাতে নিয়েও আর পান করেননি। স্বৈরাচারীর সঙ্গে কোনো ধরনের আপস না-করে শহিদ হন।
মহরম মাসের ১০ তারিখে বিশ্বের বুকে প্রথম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর সাথে আপসহীন, সংগ্রাম করে আত্মাহুতি দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে কারবালার মরুপ্রান্তর রক্তে রঞ্জিত করে পৃথিবীর মানুষকে যুগান্তকারী অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় পথ প্রদর্শন করে গেছেন হজরত ইমাম হোসেন (রা.)। যে কারণে পবিত্র আশুরার এই দিনটি শোকাবহ হলেও এ দিনটি চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে গণতন্ত্রকামী মানুষের মনে।
হিজরি বর্ষ বা আরবি প্রথম মাসকে বলা হয় মাহে মহরম। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় ফজিলতের মাস। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে মাহে মহরমের গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাসের ১০ তারিখে বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে ১০ মহরম তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বলে নামকরণ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, মহান আল্লাহতা’লা বিশ্বে ধরিত্রীকে সৃষ্টির সূচনা শুরু করেন ১০ মহরম তারিখে, আর মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) এই ১০ মহরম তারিখে সৃষ্টি করা হয় এবং দুনিয়াতে নিক্ষেপের দিনটিও ছিল ১০ মহরম দিবস। আদম ও হাওয়া’র (আ.) সুদীর্ঘ সাড়ে তিনশ বছর পর এই দিনেই আরাফতের মাঠে প্রথম মিলন সংঘঠিত হয়। এই দিনেই কেয়ামত বা মহাপ্রলয় অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনেই সর্বপ্রথম দুনিয়াতে রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ হয়। এক কথায় আল্লাহতা’লা জগতের সকল বস্তুসামগ্রী সৃষ্টি করে তাঁর আরশে আজিমে সমাসীন হয়ে প্রভু হিসেবে অভিসিক্ত হন ১০ মহরম তারিখে আশুরার দিনে।
এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলতও বহুগুণে বেশি। মাহে মহরমের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত পৃথিবীর সূচনাকাল থেকেই আছে এবং কেয়ামত বা মহাপ্রলয় কাল পর্যন্ত থাকবে। ইসলামের পূর্বাপরে এ মাসটি অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাশীল হিসেবে পরিগণিত হয়। আইয়ামে জাহেলিয়াতে আরববাসীরা এ মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা রক্ষার্থে কোনো প্রকার অন্যায়, অবিচার, জুলুম, অত্যাচার, যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না। মহান আল্লাহতা’লা যে ৪টি মাসকে সম্মানিত করেছেন তা হল জিলক্কদ, জিলহজ, মহরম ও সফর। সেই চারটি মাসের মধ্যে মাহে মহরম অন্যতম ফজিলতপূর্ণ বরকতময় মাস। যার বর্ণনা কোরআন ও হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে। মাহে মহরমের ১০ তারিখের কিছু ঘটনাবলি যেমন হজরত আদম (আ.) সৃষ্টি, আদম (আ.)-এর বেহেশত প্রবেশ, বাবা আদম ও মা হাওয়া নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণের ভুলের ফলে দুনিয়াতে নিক্ষিপ্ত হওয়া, ৩৫০ বছর পর বাবা আদম ও মা হাওয়ার (আ.) প্রথম মিলন, আরাফাতের ময়দানে আদম-হাওয়ার দোয়া কবুল এবং মুক্তির সুসংবাদ, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্ম, নমরুদের অগ্নি থেকে মুক্তি, মূসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন ও নবুওয়াতি এবং তাওরাত কিতাব লাভ। নীলনদ পার হওয়া, ফেরাউন সদলবলে নীলনদে ডুবে মরা, আইয়ূব (আ.) ১৮ বছর রোগে ভোগার পর মুক্তি লাভ, সোলেমান (আ.)-এর বাদশাহি লাভ, দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল, ইয়াকুব (আ.) ও ইউসুফ (আ.) পিতা-পুত্রের মিলন, নুহ (আ.) প্রবল বন্যায় নৌকাতে ৪০ দিন অবস্থানের পর জুদিপাহাড়ে নৌকা ভিড়ানো, ইশা (আ.) সশরীরে ৪র্থ আকাশে গমণ, ইউনূস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভসহ যাবতীয় ঘটনা ১০ মহররম তথা আশুরার এই দিনে অনুষ্ঠিত হয়।
মাহে মহরমের গুরুত্ব-তাৎপর্য অপরিসীম। সে কারণেই এ মাসটি অধিক মর্যাদাশীল, সম্মানিত ও বরকতময়। শরিয়ত সমর্থিতভাবে এ মাসের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করে তার মূল্যায়ন করা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত। মহান আল্লাহতা’লা আশুরার দিন ২ হাজার নবী-রাসূলকে দুনিয়াতে পাঠান। আবার এই দিনে ২ হাজার নবী-রাসূলের দোয়া কবুল করেন।=================================
মহররম হিজরি বছরের প্রথম মাস। এই মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। বছরের প্রথম মাস আশুরা অত্যন্ত সম্মানিত; এর রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। অনুরূপ ১০ মহররম বা আশুরার রয়েছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস।
ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজন-প্রক্রিয়ার সূচনা হয় আশুরায়। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও পৃথিবীতে অবতরণ—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। হজরত নুহ (আ.)-এর নৌযানের যাত্রা আরম্ভ এবং বন্যা-প্লাবনের সমাপ্তি আশুরাতেই ঘটেছিল।
হজরত মুসা (আ.) সমুদ্রপথে রওনা হওয়ার দিনটি ছিল আশুরা। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) আশুরায় কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আশুরা এলে তিনি বিনয়ে বিনম্র থাকতেন এবং রোজা পালন করতেন। (তাফসিরে তাবারি, মুহাম্মাদ ইবনে জারির)।
আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ ১০। আর আশুরা মানে দশম। ইসলামি পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ফলে আশুরার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবীর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে সর্বাধিক স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।
আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে নবীজি (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের এই দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলেন। জানতে পারলেন—এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের জেলখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যান। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য। এরপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ মহররম অথবা ১১ মহররম মিলিয়ে ২টি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজা রাখার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ব্যতীত অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)।
১০ মহররম আশুরার রোজা রাখা সুন্নত। আশুরার দিনে ও রাতে নফল নামাজ পড়া। মহররম মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিদের সুন্নত রোজা; ২০, ২৯ ও ৩০ তারিখ নফল রোজা এবং প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার সুন্নত রোজা। এ মাসে প্রতি রাতে ১০০ বার দরুদ শরিফ ও ৭০ বার ইস্তিগফার পড়া অত্যন্ত ফজিলতের আমল। [তরিকত শিক্ষা, খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (রহ.) পৃষ্ঠা: ৩০ ও ৯৬; রাহাতুল কুলুব, ইমাম রাজিন (রহ.)]।
আশুরার রোজা রাখার চারটি নিয়ম রয়েছে: যথা—প্রথম থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত মোট ১০টি রোজা রাখা। তা সম্ভবপর না হলে ৯, ১০ ও ১১ তারিখ মোট ৩টি রোজা রাখা। তাও সম্ভব না হলে ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলিয়ে ২টি রোজা রাখা। এটাও সম্ভব না হলে শুধু ১০ তারিখে ১টি রোজাও রাখা যাবে। যদি কেউ শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখেন এবং ৯ বা ১১ তারিখ রাখতে না পারেন; তবে এই ১টি রোজার জোড়া মেলানোর জন্য অন্য দিন রোজা রাখার প্রয়োজন হবে না।
হজরত কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমাদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ; যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।’
আসুন, আশুরার দিনে (আগে বা পরে এক দিনসহ) আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
মহরম মাসের ১০ তারিখে বিশ্বের বুকে প্রথম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর সাথে আপসহীন, সংগ্রাম করে আত্মাহুতি দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে কারবালার মরুপ্রান্তর রক্তে রঞ্জিত করে পৃথিবীর মানুষকে যুগান্তকারী অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় পথ প্রদর্শন করে গেছেন হজরত ইমাম হোসেন (রা.)। যে কারণে পবিত্র আশুরার এই দিনটি শোকাবহ হলেও এ দিনটি চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে গণতন্ত্রকামী মানুষের মনে।
হিজরি বর্ষ বা আরবি প্রথম মাসকে বলা হয় মাহে মহরম। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় ফজিলতের মাস। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে মাহে মহরমের গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাসের ১০ তারিখে বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে ১০ মহরম তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বলে নামকরণ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, মহান আল্লাহতা’লা বিশ্বে ধরিত্রীকে সৃষ্টির সূচনা শুরু করেন ১০ মহরম তারিখে, আর মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) এই ১০ মহরম তারিখে সৃষ্টি করা হয় এবং দুনিয়াতে নিক্ষেপের দিনটিও ছিল ১০ মহরম দিবস। আদম ও হাওয়া’র (আ.) সুদীর্ঘ সাড়ে তিনশ বছর পর এই দিনেই আরাফতের মাঠে প্রথম মিলন সংঘঠিত হয়। এই দিনেই কেয়ামত বা মহাপ্রলয় অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনেই সর্বপ্রথম দুনিয়াতে রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ হয়। এক কথায় আল্লাহতা’লা জগতের সকল বস্তুসামগ্রী সৃষ্টি করে তাঁর আরশে আজিমে সমাসীন হয়ে প্রভু হিসেবে অভিসিক্ত হন ১০ মহরম তারিখে আশুরার দিনে।
এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলতও বহুগুণে বেশি। মাহে মহরমের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত পৃথিবীর সূচনাকাল থেকেই আছে এবং কেয়ামত বা মহাপ্রলয় কাল পর্যন্ত থাকবে। ইসলামের পূর্বাপরে এ মাসটি অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাশীল হিসেবে পরিগণিত হয়। আইয়ামে জাহেলিয়াতে আরববাসীরা এ মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা রক্ষার্থে কোনো প্রকার অন্যায়, অবিচার, জুলুম, অত্যাচার, যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না। মহান আল্লাহতা’লা যে ৪টি মাসকে সম্মানিত করেছেন তা হল জিলক্কদ, জিলহজ, মহরম ও সফর। সেই চারটি মাসের মধ্যে মাহে মহরম অন্যতম ফজিলতপূর্ণ বরকতময় মাস। যার বর্ণনা কোরআন ও হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে। মাহে মহরমের ১০ তারিখের কিছু ঘটনাবলি যেমন হজরত আদম (আ.) সৃষ্টি, আদম (আ.)-এর বেহেশত প্রবেশ, বাবা আদম ও মা হাওয়া নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণের ভুলের ফলে দুনিয়াতে নিক্ষিপ্ত হওয়া, ৩৫০ বছর পর বাবা আদম ও মা হাওয়ার (আ.) প্রথম মিলন, আরাফাতের ময়দানে আদম-হাওয়ার দোয়া কবুল এবং মুক্তির সুসংবাদ, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্ম, নমরুদের অগ্নি থেকে মুক্তি, মূসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন ও নবুওয়াতি এবং তাওরাত কিতাব লাভ। নীলনদ পার হওয়া, ফেরাউন সদলবলে নীলনদে ডুবে মরা, আইয়ূব (আ.) ১৮ বছর রোগে ভোগার পর মুক্তি লাভ, সোলেমান (আ.)-এর বাদশাহি লাভ, দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল, ইয়াকুব (আ.) ও ইউসুফ (আ.) পিতা-পুত্রের মিলন, নুহ (আ.) প্রবল বন্যায় নৌকাতে ৪০ দিন অবস্থানের পর জুদিপাহাড়ে নৌকা ভিড়ানো, ইশা (আ.) সশরীরে ৪র্থ আকাশে গমণ, ইউনূস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভসহ যাবতীয় ঘটনা ১০ মহররম তথা আশুরার এই দিনে অনুষ্ঠিত হয়।
মাহে মহরমের গুরুত্ব-তাৎপর্য অপরিসীম। সে কারণেই এ মাসটি অধিক মর্যাদাশীল, সম্মানিত ও বরকতময়। শরিয়ত সমর্থিতভাবে এ মাসের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করে তার মূল্যায়ন করা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত। মহান আল্লাহতা’লা আশুরার দিন ২ হাজার নবী-রাসূলকে দুনিয়াতে পাঠান। আবার এই দিনে ২ হাজার নবী-রাসূলের দোয়া কবুল করেন।
=================================
মহররম হিজরি বছরের প্রথম মাস। এই মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। বছরের প্রথম মাস আশুরা অত্যন্ত সম্মানিত; এর রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। অনুরূপ ১০ মহররম বা আশুরার রয়েছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস।
ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজন-প্রক্রিয়ার সূচনা হয় আশুরায়। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও পৃথিবীতে অবতরণ—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। হজরত নুহ (আ.)-এর নৌযানের যাত্রা আরম্ভ এবং বন্যা-প্লাবনের সমাপ্তি আশুরাতেই ঘটেছিল।
হজরত মুসা (আ.) সমুদ্রপথে রওনা হওয়ার দিনটি ছিল আশুরা। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) আশুরায় কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আশুরা এলে তিনি বিনয়ে বিনম্র থাকতেন এবং রোজা পালন করতেন। (তাফসিরে তাবারি, মুহাম্মাদ ইবনে জারির)।
আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ ১০। আর আশুরা মানে দশম। ইসলামি পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ফলে আশুরার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবীর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে সর্বাধিক স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।
আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে নবীজি (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের এই দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলেন। জানতে পারলেন—এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের জেলখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যান। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য। এরপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ মহররম অথবা ১১ মহররম মিলিয়ে ২টি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজা রাখার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ব্যতীত অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)।
১০ মহররম আশুরার রোজা রাখা সুন্নত। আশুরার দিনে ও রাতে নফল নামাজ পড়া। মহররম মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিদের সুন্নত রোজা; ২০, ২৯ ও ৩০ তারিখ নফল রোজা এবং প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার সুন্নত রোজা। এ মাসে প্রতি রাতে ১০০ বার দরুদ শরিফ ও ৭০ বার ইস্তিগফার পড়া অত্যন্ত ফজিলতের আমল। [তরিকত শিক্ষা, খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (রহ.) পৃষ্ঠা: ৩০ ও ৯৬; রাহাতুল কুলুব, ইমাম রাজিন (রহ.)]।
আশুরার রোজা রাখার চারটি নিয়ম রয়েছে: যথা—প্রথম থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত মোট ১০টি রোজা রাখা। তা সম্ভবপর না হলে ৯, ১০ ও ১১ তারিখ মোট ৩টি রোজা রাখা। তাও সম্ভব না হলে ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলিয়ে ২টি রোজা রাখা। এটাও সম্ভব না হলে শুধু ১০ তারিখে ১টি রোজাও রাখা যাবে। যদি কেউ শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখেন এবং ৯ বা ১১ তারিখ রাখতে না পারেন; তবে এই ১টি রোজার জোড়া মেলানোর জন্য অন্য দিন রোজা রাখার প্রয়োজন হবে না।
হজরত কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমাদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ; যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।’
আসুন, আশুরার দিনে (আগে বা পরে এক দিনসহ) আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
No comments:
Post a Comment