ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে যাবতীয় ক্ষতিকর বা অকল্যাণকর বস্তু ও বিষয়কে হারাম করা হয়েছে এবং যাবতীয় কল্যাণকর বিষয় বা বস্তুকে করা হয়েছে হালাল।
পূর্ববর্তী একটি আলোচনায় ইসলামের যাবতীয় হারাম ও হালাল বিষয়কে আলোকপাত করা হয়েছে। আজকের আলোচ্য বিষয় পর্দা।
পর্দা না করা ইসলামে হারাম। কারণ ইসলামে পর্দা করার ফরজ এবং সরাসরি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় বার বার পর্দা করার কথা বলা হয়েছে। নারী এবং পুরুষ উভয় পক্ষের জন্যই পর্দা করা আবশ্যকীয়। ইসলামের বিধানে উভয়কেই পর্দা পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পর্দা পালন করা একজন মুসলিম নারী ও পুরুষের অনন্য রুচিবোধ এবং সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। পর্দা পুরুষের উন্নত চরিত্র গঠনের পাশাপাশি নারীর মান-সম্মান, ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচও বটে।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সবসময় নারীদের পর্দার কথা আলোচনা করা হয় এবং সেই সঙ্গে ভুলে যায় পুরুষের পর্দা পালনের কথা। আর তাই আজকের মূল আলোচ্য বিষয় ইসলামী শরিয়তে পুরুষের পর্দার বিধান।
পবিত্র কোরআন মাজীদে সূরা নূরের ৩০ নং আয়াতে মহান আল্লাহপাক বলছেন, ‘হে নবী! মুমিনদের (পুরুষ) বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতেই তাদের জন্য পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে, আল্লাহ তা সম্পর্কে অবহিত আছেন।’ (সূরা: আন-নূর, আয়াত: ৩০)
এই আয়াতের শুরুতেই ঈমানদার পুরুষদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে। ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত কিংবা তাকানোই হচ্ছে- যৌন প্রবৃত্তির শুরুর এবং এর শেষ পরিণতি পাপ ও ফেতনাসহ জিনা ব্যভিচার যার পরিণাম ভয়ঙ্কর।
মানুষের জীবনে পোশাক একটি অপরিহার্য বিষয়। ইসলামেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। পোশাক মূলত লজ্জা নিবারণের উপকরণ হলেও মানবজীবনে পোশাকের ভূমিকা অনেক পরিব্যপ্ত। সাজ-সজ্জা বা সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ থেকে শুরু করে আর্থিক মুনাফা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো এই পোশাক-পরিচ্ছদ। ইসলামে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা পোশাকের বিধান রয়েছে।
ইসলামে পুরুষের পর্দা পালন করার নিয়ম-কানুন পবিত্র কোরআন ও সহীহ হাদীস সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে নিয়ম গুলো আলোচনা করা হলো-
(১) পুরুষের নাভীর ওপর থেকে হাঁটুর নিচে এবং টাকনুর ওপর পর্যন্ত ঢাকতে হবে। পুরুষের হাটুর ওপরে এবং টাকনুর নিচে কাপড় পরা কবিরা গুনাহ ।
(১) পুরুষের নাভীর ওপর থেকে হাঁটুর নিচে এবং টাকনুর ওপর পর্যন্ত ঢাকতে হবে। পুরুষের হাটুর ওপরে এবং টাকনুর নিচে কাপড় পরা কবিরা গুনাহ ।
(২) এমন পোশাক পরিধান করবে, যা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আবেদনময় হবে না এবং বিকৃত চিন্তার জন্ম দিবেনা।
(৩) পোশাক এমন পাতলা হওয়া যাবেনা যাতে কাপড় পরা সত্বেও ওপর দিয়ে ভেতরের চামড়া নজরে আসে। কারণ এমন কাপড় পরা না পরা একই কথা।
(৪) পোশাক হতে হবে ঢিলেঢালা এবং মার্জিত। এমন আঁট-সাঁট (টাইটফিট) হওয়া যাবেনা যাতে দেহের উঁচু-নিচু গঠন বোঝা যায় ।
(৫) পোশাকটি যেন কোনো অবিশ্বাসী/কাফেরদের অনুকৃত না হয়। প্রিয় নবীজী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন (পোশাকে, চাল-চলনে অনুকরণ) করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত।’ (আবূ দাউদ, মিশকাত: ৪৩৪৭)
(৬) পোশাকটি যেন বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের অনুরূপ না হয়। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন-সেই সমস্ত নারীদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে এবং সেই সমস্ত পুরুষদেরকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের বেশ ধারণ করে। (আবূ দাউদ: ৪০৯৭, ইবনে মাজাহ: ১৯০৪)
(৭) পোশাক যেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রসিদ্ধিজনক না হয়। কারণ, এমন ধরনের পোশাক পরলে সাধারণত পরিধানকারীর মনে অহংকারের সৃষ্টি হয়। তাই মহানবী (সা.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধিজনক পোশাক পরবে, আল্লাহ্ তাকে কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। (আহমাদ, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত: ৪৩৪৬)
পোশাকের পর্দা ছাড়াও একজন পুরুষের চোখের পর্দা, মনের পর্দা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন পুরুষের চোখ শুধুমাত্র তার নিজের স্ত্রীর সৌন্দর্য দর্শন করার অনুমতি পায়। একজন পুরুষের জন্য নিজ স্ত্রী এবং কিছু নির্ধারিত নারী ব্যতীত অন্য কোন নারীর চেহারার সৌন্দর্য চোখে দেখা বা দেহের আকৃতি অন্তরে অনুভব করাও ‘হারাম’।
বুরায়দা (রা.) কতৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার হজরত আলী (রা.)-কে বলেন, ‘হে আলী! তুমি দৃষ্টির পর দৃষ্টি ফেলো না। হঠাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবে যে দৃষ্টি পড়ে তার জন্য তুমি ক্ষমা পাবে। কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য বৈধ নয়।’ (আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাউদ, দারেমী, মিশকাত: ৩১১০)
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা আন-নূরের ৩০নং আয়াতে নারীদের পর্দা করার কথা বলার আগে পুরুষের চোখের পর্দা হেফাজত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর যখন কেউ তা জেনেও এই নির্দেশ অমান্য করল সে মহান আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করল।
আর সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ বলেছেন যে, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যারা আমার আয়াত সমূহকে অবজ্ঞা করবে, আমি তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের শরীরের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, আমি সেখানে আবার নতুন চামড়া দিব, যেন তারা আজাবের স্বাদ পূর্ণভাবে আস্বাদন করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।’ (সূরা: আন নিসা, আয়াত: ৫৬)
একজন পুরুষের জন্য নির্ধারিত কতকজন নারীকে দেখা ইসলামে জায়েজ রয়েছে তারা হলেন:
একজন পুরুষের জন্য নির্ধারিত কতকজন নারীকে দেখা ইসলামে জায়েজ রয়েছে তারা হলেন:
(১) মা (আপন ও সৎ উভয় ),
(২) দাদী, পরদাদী,
(৩) নানী, পরনানী,
(৪) মেয়ে ( বৈপিত্রেয়া, বৈমাত্রিয়া মেয়ে ও দুধ মেয়ে ),
(৫) পুতনী ( দুধ ছেলে, বৈমাত্রেয়া ও বৈপিত্রেয় ছেলের মেয়ে ),
(৬) নাতনী ( দুধ মেয়ে ও বৈপিত্রেয়া মেয়ের মেয়ে),
(৭) বোন (তিন প্রকার: আপন, বৈমাত্রিয়া বোন ও বৈপিত্রিয়া বোন ),
(৮) ফুফু (আপন ফুফু, বৈমাত্রিয়া ফুফু, বৈপিত্রিয়া ফুফু ও দুধ ফুফু ),
(৯) খালা (আপন খালা, বৈমাত্রিয়া খালা, বৈপিত্রিয়া ও দুধ খালা )
(১০) ভাতিজী,
(১১) ভাগ্নী,
(১২) দুধ মা (আড়াই বছরের মধ্যে যার দুধ পান করা হয়েছে),
(১৩) দুধ বোন,
(১৪) শাশুড়ী(শুধু আপন শাশুড়ী),
(১৫) ঔরসজাত ও দুধ পুত্রের বধু বা স্ত্রী, এবং
(১৬) অতি বৃদ্ধা মহিলা, যাদের প্রতি তাকালে আকর্ষণ বিকর্ষণে পরিণত হয়।
পরিশেষে বলতে হয়, পর্দার কিছু বিধান আছে যা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন সতরের বিধান, নজরের বিধান, নারী-পুরুষের মেলামেশার বিধান ইত্যাদি।
তবে কিছু বিধান শুধু মৌলিকভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন: পরিবারের কর্তা হিসেবে অধীনস্তদের পর্দা সম্পর্কে অবগত করার বিধান এবং তাদের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের বিধান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে সর্বশ্রেণীর মুসলিম নর-নারীর জন্য পর্দার বিধান।
মূলকথা হচ্ছে ইসলামী শরিয়তে পর্দার বিধান শুধু নারীর জন্য প্রযোজ্য নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তেমনি পর্দার বিধান শুধুই ব্যক্তিজীবনের বিষয় নয় বরং পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেরও ক্ষেত্রেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তাই সকল মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য, পর্দার বিধানের দিকে ফিরে আসা তাহলেই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ এবং রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্বস্থি ও পবিত্রতা ফিরে আসবে।
ডেইলি বাংলাদেশ/আরএজে
No comments:
Post a Comment