﴿لَّا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ﴾
৭৯) পবিত্র সত্তাগণ ছাড়া আর কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না৷ ৩৯
৩৯. কাফেররা কুরআনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আরোপ করেতো এটা তার জবাব৷ তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গণক আখ্যায়িত করে বলতো, জিন ও শয়তানরা তাঁকে এসব কথা শিখিয়ে দেয়৷ কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানে এর জবাব দেয়া হয়েছে ৷ যেমনঃ সূরা শূ'আরাতে বলা হয়েছেঃ
"শয়তান এ বাণী নিয়ে আসেনি৷ এটা তার জন্য সাজেও না৷ আর সে এটা করতেও পারে না৷ এ বাণী শোনার সুযোগ থেকেও তাকে দূরে রাখা হয়েছে৷ "
(আয়াত ২১০ থেকে ২১২ এই লেখার শেষ দিকে দেখুন। )
এ বিষয়টিই এখানে এ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, "পবিত্র সত্তা ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না৷ " অর্থাৎ শয়তান কর্তৃক এ বাণী নিয়ে আসা কিংবা নাযিল হওয়ার সময় এতে কর্তৃত্ব খাটানো বা হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা যে সময় 'লওহে মাহফূজ' থেকে তা নবীর (সা) ওপর নাযিল করা হয় সে সময় পবিত্র সত্তাসমূহ অর্থাৎ পবিত্র ফেরেশতারা ছাড়া কেউ তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না৷ ফেরেশতাদের জন্য পবিত্র কথাটি ব্যবহার করার তাৎপর্য হলো মহান আল্লাহ তাদেরকে সব রকমের অপবিত্র আবেগ অনুভূতি এবং ইচ্ছা আকাংখা থেকে পবিত্র রেখেছেন৷
আনাস (রা), ইবনে মালেক, ইবনে আব্বাস (রা), সাঈদ ইবনে জুবাইর, ইকরিমা, মুজাহিদ, কাতাদা, আবুল আলীয়া, সুদ্দী, দাহহাক এবং ইবনে যায়েদ, এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই বর্ণনা করেছেন৷ বাক্য বিন্যাসের সাথেও এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ৷ কারণ, বাক্যের ধারাবাহিকতা থেকে এ কথাই বুঝা যায় যে, তাওহীদ ও আখেরাত সম্পর্কে মক্কার কাফেরদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার প্রতিবাদ করার পর কুরআন মজীদ সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করে তারকা ও গ্রহরাজির "অবস্থান ক্ষেত্র" সমূহে শপথ করে বলা হচ্ছে, এটি একটি অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন গ্রন্থ, আল্লাহর সুরক্ষিত লিপিতে তা লিপিবদ্ধ আছে কোন সৃষ্টির পক্ষে তাতে হস্তক্ষেপ করার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা এমন পদ্ধতিতে নবীর ওপর নাযিল হয় যে, পবিত্র ফেরেশতাগণ ছাড়া কেউ তা স্পর্শও করতে পারে না৷
মুফাসসিরদের মধ্যে কেউ কেউ এ আয়াতের (লা) শব্দটিকে 'না' অর্থে গ্রহণ করেছেন৷ তাঁরা আয়াতের অর্থ করেছেন "পাক পবিত্র নয় এমন কোন ব্যক্তি যেন ত স্পর্শ না করে" "কিংবা এমন কোন ব্যক্তির তা স্পর্শ করা উচিত -নয়, যে না পাক৷ " আরো কতিপয় মুফাসসির যদিও লা শব্দটিকে 'না' অর্থেই গ্রহণ করেছেন এবং আয়াতের অর্থ করেছেন এই গ্রন্থ পবিত্র সত্তাগণ ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করে না৷ কিন্তু তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে 'না' শব্দটি ঠিক তেমনি নির্দেশ সূচক যেমন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী () মুসলমান মুসলমানের ভাই ৷ সে তার ওপর জুলুম করে না) ৷ এর মধ্যে উল্লেখিত 'না' শব্দটি নির্দেশসূচক৷ এখানে যদিও বর্ণনামূলকভাবে বলা হয়েছে যে, মুসলমান মুসলমানের ওপর জুলুম করে না৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, মুসলমান যেন মুসলমানের ওপর জুলুম না করে৷ অনুরূপ এ আয়াতের যদিও বলা হয়েছে যে, পবিত্র লোক ছাড়া কুরআনকে কেউ স্পর্শ করে না৷ কিন্তু তা থেকে এ নির্দেশ পাওয়া যায় যে, তা হচ্ছে, পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি যেন তা স্পর্শ না করে৷
তবে প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাখ্যা আয়াতের পূর্বাপর প্রসংগের সাথে খাপ খায় না৷ পূর্বাপর বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এ বাক্যের এরূপ অর্থ করা যেতে পারে ৷ কিন্তু যে বর্ণনাধারা মধ্যে কথাটি বলা হয়েছে সে প্রেক্ষিতে রেখে একে বিচার করলে এ কথা বলার আর কোন সুযোগই থাকে না, "পবিত্র লোকেরা ছাড়া কেউ যেন এ গ্রন্থ স্পর্শ না করে৷ "কারণ, এখানে সম্বোধন করা হয়েছে কাফেরদেরকে৷ তাদের বলা হচ্ছে, এটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব৷ এ কিতাব সম্পর্কে তোমাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত যে, শয়তানরা নবীকে তা শিখিয়ে দেয়৷ কোন ব্যক্তি পবিত্রতা ছাড়া এ গ্রন্থ স্পর্শ করতে পারবে না শরীয়াতের এই নির্দেশটি এখানে বর্ণনা করার কি যুক্তি ও অবকাশ থাকতে পারে? বড় জোর বলা যেতে পারে তা হচ্ছে, এ নির্দেশ দেয়ার জন্য যদিও আয়াতটি নাযিল হয়নি৷ কিন্তু বাক্যের ভঙ্গি থেকে ইংগিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহর দরবারে যেমন কেবল পবিত্র সত্তারই এ গ্রন্থ স্পর্শ করতে পারে অনুরূপ দুনিয়াতেও অন্তত সেসব ব্যক্তি নাপাক অবস্থায় এ গ্রন্থ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুক৷ যারা এ গ্রন্থের আল্লাহর বাণী হওয়ার সম্পর্কে বিশ্বাস পোষন করে৷
এ মাসায়ালা সম্পর্কে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
একঃ ইমাম মালেক (র) মুয়াত্তা গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে আবী বরক মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযম বর্ণিত এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়ামানের নেতৃবৃন্দের কাছে আমর ইবনে হাযমের মাধ্যমে যে লিখিত নির্দেশনামা পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে এ নির্দেশটিও ছিল যে, () পাক পবিত্র লোক ছাড়া কেউ যেন কুরআন স্পর্শ না করে) ৷ আবু দাউদ তাঁর 'মীরাসীল' গ্রন্থে ইমাম যুহরী থেকে একথাটি উদ্ধৃত করেছেন ৷ অর্থাৎ তিনি আবু মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযমের কাছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লিখিত যে নির্দেশনামা দেখেছিলেন তার মধ্যে এ নির্দেশটিও ছিল৷
দুইঃ হযরত আলী থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে৷ তাতে তিনি বলেছেনঃ
"অপবিত্র অবস্থা ছাড়া অন্য কিছুই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখতে পারতো না৷ " (আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী) ৷
তিনঃ ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
"ঋতুবতী নারী ও নাপাক কোন ব্যক্তি যেন কুরআনের কোন অংশ না পড়ে৷ "
(আবু দাউদ, তিরমিযী) ৷
চারঃ বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে যে পত্র দিয়েছিলেন তাতে পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটিও লিখিত ছিলঃ
সাহাবা কিরাম (রা) ও তাবেয়ীনদের থেকে এ মাসয়লাটি সম্পর্কে যেসব মতামত বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
হযরত সালমান ফারসী (রা) অযু ছাড়া কুরআন শরীফ পড়া দুষণীয় মনে করতেন না৷ তবে তাঁর মতে এরূপ ক্ষেত্রে হাত দিয়ে কুরআন স্পর্শ করা জায়েয নয়৷ হযরত সা'দ (রা) ইবনে আবী ওয়াককাস এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ও এমত অনুসরণ করতেন৷ হযরত হাসান বাসরী ও ইবরাহীম নাখয়ী ও বিনা ওযুতে কুরআন শরীফ স্পর্শ করা মাকরূহ মনে করতেন৷ (আহকামুল কুরআন-জাসসাস) ৷ আতা, তাউস, শা'বী এবং কাসেম ইবনে মুহাম্মাদও এই মত পোষন করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে (আল -মুগনী-ইবনে কুদামাহ) ৷ তবে তাঁদের সবার মতে অযু ছাড়া কুরআন শরীফ স্পর্শ না করে পড়া কিংবা মুখস্ত পড়া জায়েয৷
নাপাক, হায়েজ ও নিফাস অবস্থায় কুরআন শরীফ পড়া হযরত উমর (রা), হযরত আলী (রা), হযরত হাসান বাসরী, হযরত ইবরাহীম নাখয়ী এবং ইমাম যুহরীর মতে মাকরূহ৷ তবে ইবনে আব্বাসের (রা) মত ছিল এই যে, কোন ব্যক্তি কুরআনের যে অংশ সম্ভাবতই মুখে মুখে পড়তে অভ্যস্ত তা মুখস্ত পড়তে পারে৷ তিনি এ মতের ওপর আমলও করতেন৷ এ মাসয়ালা সম্পর্কে হযরত সা'ঈদ ইবনুল মুসাইয়েব এবং সা'ঈদ ইবনে জুবাইরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ তার স্মৃতিতে কি কুরআন সংরক্ষিত নেই? সুতরাং পড়ায় কি দোষ হতে পারে? (আল -মুগনী ও আল-মুহাল্লা-ইবনে হাযম) ৷
এ মাসয়ালা সম্পর্কে ফকীহদের মতামত নিম্নরূপঃ
ইমাম আলাউদ্দীন আল-কাশানী () গ্রন্থে এ বিষয়ে হানাফীদের মতের ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ বিনা অযুতে নামায পড়া জায়েজ নয়, তেমনি কুরআন মজীদ স্পর্শ করাও জায়েজ নয়৷ তবে কুরআন মজীদ যদি গেলাফের মধ্যে থাকে তাহলে স্পর্শ করা যেতে পারে৷ কোন কোন ফকীহর মতে চামড়ার আরবণ এবং করো করো মতে যে কোষ, লেফাফা, বা জুযাদানের মধ্যে কুরআন শরীফ রাখা হয় এবং তা থেকে আবার বের করা যায় তাই গেলাফের পর্যায়ভুক্ত ৷ অনুরূপ বিন অযুতে তাফসীর গ্রন্থসমূহ এবং এমন কোন বস্তু স্পর্শ করা উচিত নয় যার ওপর কুরআনের কোন আয়াত লিখিত আছে ৷ কিন্তু ফিকহার গ্রন্থসমূহ স্পর্শ করা যেতে পারে৷ তবে এ ক্ষেত্রেও উত্তম হচ্ছে বিনা অযুতে স্পর্শ না করা৷ কারণ দলীল প্রমাণ হিসেবে তার মধ্যে কুরআনের আয়াত লিখিত আছে শুধু সেই অংশ বিনা অযুতে স্পর্শ করা ঠিক নয়৷ কিন্তু যে, অংশে টীকা লেখা হয় তা ফাঁকা হোক কিংবা ব্যাখ্যা হিসেবে কিছু লেখা থাক, তা স্পর্শ করায় কোন দোষ নেই৷ তবে সঠিক কথা হলো, টীকা বা ব্যাখ্যাসমূহও কুরআনেই একটা অংশ এবং তা স্পর্শ করা কুরআন মজীদ স্পর্শ করার শামিল৷ এরপর কুরআন শরীফ পড়া সম্পর্কে বলা যায় যে, "বিনা অযুতে কুরআন শরীফ পড়া জায়েজ"৷ ফতোয়ায়ে আলমগিরী গ্রন্থে শিশুদেরকে এই নির্দেশের আওতা বহির্ভূত গণ্য করা হয়েছে৷ অযু থাক বা না থাক শিক্ষার জন্য শিশুদের হাতে কুরআন শরীফ দেয়া যেতে পারে৷
ইমাম নববী (র) () গ্রন্থে শাফেয়ী মাযহাবের মতামত বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ নামায ও তাওয়াফের মত বিন অযুতে কুরআন মজীদ স্পর্শ করা কিংবা তার কোন পাতা স্পর্শ করা হারাম৷ অনুরূপ কুরআনের জিলদ স্পর্শ করাও নিষেধ৷ তাছাড়া কুরআন যদি কোন থলি বা ব্যাগের মধ্যে রাখা থাকে কিংবা গেলাফ বা বাক্সের মধ্যে থাকে বা দরসে কুরআনের জন্য তার কেন অংশ কোন ফলকের ওপরে লিখিত থাকে তাও স্পর্শ করা জায়েজ নয়৷ তবে যদি করো মালপত্রের মধ্যে রাখা থাকে, কিংবা তাফসীর গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ থাকে অথবা কোন মুদ্রার গায়ে তা ক্ষোদিত হয় তাহলে তা স্পর্শ খরা জায়েয৷ শিশুর অযু না থাকলেও সে কুরআন স্পর্শ করতে পারে৷ কেউ যদি অযু ছাড়া কুরআন পাঠ করে তাহলে কাঠ বা অন্য কোন জিনিসের সাহায্যে পাতা উল্টাতে পারে৷
'আল -ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা'আ' গ্রন্থে মালেকী মাযহাবের যে মত উদ্ধৃত করা হয়েছে তা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহদের সাথে তারা এ ব্যাপারে একমত যে, হাত দিয়ে কুরআন মজীদ স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত কিন্তু কুরআন শিক্ষার প্রয়োজনে তারা শিক্ষক ও ছাত্র উভয়কে এ ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন৷ এমনকি তাদের মতে শিক্ষার জন্য ঋতুবর্তী নারীর জন্যও কুরআন স্পর্শ করা জায়েজ৷ ইবনে কুদামা আল মুগনি গ্রন্থে ইমাম মালেকের (র) এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন যে, নাপাক অবস্থায় তো কুরআন শরীফ পড়া নিষেধ৷ কিন্তু ঋতু অবস্থায় নারীর জন্য কুরআন পড়ার অনুমতি আছে৷ কারণ, আমরা যদি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে কুরআন পড়া থেকে বিরত রাখি তাহলে সে তা ভুলে যাবে৷
ইবনে কুদামা হাম্বলী মাযহাবের যেসব বিধি-বিধান উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে, নাপাক এবং হায়েজ ও নিফাক অবস্থায় কুরআন কিংবা কুরআনের পূর্ণ কোন আয়াত পড়া জায়েজ নয়৷ তবে বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি পড়া জায়েয৷ কারণ এগুলো কুরানের কোন না কোন আয়াতের অংশ হলেও সেগুলো পড়ার ক্ষেত্রে কুরআন তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য থাকে না৷ তবে কোন অবস্থায়ই বিনা অযুতে হাত দিয়ে কুরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েজ নয়৷ তবে চিঠিপত্র কিংবা ফিকাহর কোন গ্রন্থ বা অন্যকিছু লিখিত বিষয়ের মধ্যে যদি কুরআনের কোন আয়াত লিপিবদ্ধ থাকে তাহলে তা হাত দিয়ে স্পর্শ করা নিধেষ নয়৷ অনুরূপভাবে যদি কোন জিনিসের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে তাহলে অযু ছাড়াই তা হাত দিয়ে ধরে উঠানো যায়৷ তাফসীর গ্রন্থসমূহ হাত দিয়ে ধরার ক্ষেত্রে অযু শর্ত নয়৷ তাছাড়া তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে অযুহীন কোন লোককে যদি হাত দিয়ে কুরআন শরীফ স্পর্শ করতে হয় তাহলে সে তায়াম্মুম করে নিতে পারে৷ 'আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা'আ গ্রন্থে হাম্বলী মাযহাবের এ মাসয়ালাটিও উল্লেখ আছে যে, শিক্ষার উদ্দেশ্যও শিশুদের বিনা অযুতে কুরআন শরীফ স্পর্শ করা ঠিক নয়৷ তাদের হাতে কুরআন শরীফ দেয়ার আগে তাদের অভিভাবকদের কর্তব্য তাদের অযু করানো৷
এ মাসায়ালা সম্পর্কে জাহেরীদের মতামত হচ্ছে, কেউ বিনা অযুতে থাক বা নাপাক অবস্থায় থাক কিংবা ঋতুবতী স্ত্রীলোক হোক সবার জন্য কুরআন পাঠ করা এবং হাত দিয়ে ত স্পর্শ করা সবর্বাবস্থায় জায়েজ৷ ইবনে হযম তাঁর আল -মুহাল্লা গ্রন্থে (১ম খণ্ড, ৭৭থেকে ৮৪ পৃষ্ঠা) এ মাসায়ালা সম্পর্কে সবিস্তরে আলোচনা করেছেন৷ তাতে এ মতটি সঠিক ও বিশুদ্ধ হওয়া সম্পর্কে বহু দলীল প্রমাণ পেশ করেছেন৷ তিনি বলেছেন, কুরআন পাঠ করা এবং তা স্পর্শ করার ব্যাপারে ফকীহগণ যে শর্তাবলী আরোপ করেছেন তার কোনটিই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত নয়৷
**************
সুরা শুআরায় বলা হয়েছে :
﴿وَمَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيَاطِينُ﴾
২১০) এ (সুস্পষ্ট কিতাবটি) নিয়ে শয়তানরা অবতীর্ণ হয়নি৷১৩০
১৩০. প্রথমে এ বিষয়টির ইতিবাচক দিকের কথা বলা হয়েছিল৷ বলা হয়েছিল, এটি রব্বুল আলামীনের নাযিলকৃত কিতাব এবং রূহুল আমীন এটা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন৷ এখন নেতিবাচক দিক বর্ণনা করা হচ্ছে৷ বলা হয়েছে, শয়তানরা একে নিয়ে অবতীর্ণ হয়নি, যেমন সত্যের দুশমনরা দোষারোপ করছে৷ কুরাইশ বংশীয় কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য যে মিথ্যার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল সেখানে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল এই যে, কুরআনের আকারে যে বিষ্ময়কর বাণী মানুষের সামনে আসছিল এবং তাদের হৃদয়ের গভীরে অনুপ্রবেশ করে চলছিল তার কি ব্যাখ্যা করা যায়৷ এ বাণী মানুষের কাছে পৌঁছাবার পথ বন্ধ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না৷ লোকদের মনে এ সম্পর্কে কুধারণার সৃষ্টি করা এবং এর প্রভাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করা যায়, এটাই ছিল এখন তাদের জন্য একটি পেরেশানীর ব্যাপার৷ এ পেরেশানীর অবস্থার মধ্যে তারা জনগণের মধ্যে যেসব অপবাদ ছড়িয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নাউযুবিল্লাহ) একজন গণক এবং একজন সাধারণ গণকদের মতোও তাঁর মনের মধ্যেও এ বাণী শয়তানরা সঞ্চার করে দেয়৷ এ অপবাদটিকে তারা নিজেদের সবচেয়ে বেশী কার্যকর হাতিয়ার বলে মনে করতো৷ তাদের ধারণা ছিল, এ বাণী কোন ফেরেশতা নিয়ে আসে না বরং নিয়ে আসে শয়তান, কারো কাছে একথা যাচাই করার কি মাধ্যমই বা থাকতে পারে এবং শয়তান মনের মধ্যে সঞ্চার করে দেয়, এ অভিযোগের প্রতিবাদ যদি কেউ করতে চায় তাহলে কিভাবে করবে?
﴿وَمَا يَنبَغِي لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُونَ﴾
২১১) এ কাজটি তাদের শোভাও পায় না৷১৩১ এবং তারা এমনটি করতেই পারে না৷১৩২
১৩১. অর্থাৎ এ বাণী এবং এ বিষয়বস্তু শয়তানের মুখে তো সাজেই না৷ যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারে, কুরআনে যেসব কথা বর্ণনা করা হচ্ছে সেগুলো কি শয়তানের পক্ষ থেকে হতে পারে ? তোমাদের জনপদগুলোতে কি গণৎকার নেই এবং শয়তানদের সাথে যোগসাজস করে যেসব কথা এ ব্যক্তি বলছেন তা কখনো তোমরা কোথাও শুনেছো ? তোমরা কি কখনো শুনেছো , কোন শয়তান কোন গণৎকারের মাধ্যমে লোকদেরকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষা দিয়েছে ? শির্ক ও মূর্তিপূজা থেকে বিরত রেখেছে ? পরকালে জিজ্ঞাসাবাদ করার ভয় দেখিয়েছে ? জুলুম-নিপীড়ন , অসৎ-অশ্লীল কাজ ও নৈতিকতা বিগর্হিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে ? সৎপথে চলা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন এবং আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সদাচার করার উপদেশ দিয়েছে ? শয়তানরা এ প্রকৃতি কোথায় পাবে ? তাদের স্বভাব হচ্ছে তারা মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং তাদেরকে অসৎকাজে উৎসাহিত করে৷ তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী গণকদের কাছে লোকেরা যে কথা জিজ্ঞেস করতে যায় তা হচ্ছে এই যে, প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পাবে কি না ? জুয়ায় কোন দাঁওটা মারলে লাভ হবে ? শত্রুকে হেয় করার জন্য কোন চালটা চালতে হবে ? অমুক ব্যক্তির উট কে চুরি করেছে ? এসব সমস্যা ও বিষয় বাদ দিয়ে গণক ও তার পৃষ্ঠপোষক শয়তানরা আবার কবে থেকে আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ ও সংস্কারের শিক্ষা এবং অসৎ কাজে বাধা দেবার ও সেগুলো উৎখাত করার চিন্তা-ভাবনা করেছে?
১৩২. অর্থাৎ শয়তানরা করতে চাইলেও একাজ করার ক্ষমতাই তাদের নেই৷ সামান্য সময়ের জন্যও নিজেদেরকে মানুষের যথার্থ শিক্ষক ও প্রকৃত আত্ম শুদ্ধিকারীর স্থানে বসিয়ে কুরআন যে নির্ভেজাল সত্য ও নির্ভেজাল কল্যাণের শিক্ষা দিচ্ছে সে শিক্ষা দিতে তারা সক্ষম নয়৷ প্রতারণা করার জন্যও যদি তারা এ কৃত্রিম রূপে আত্মপ্রকাশ করে , তাহলে তাদের কাজ এমন মিশ্রণমুক্ত হতে পারে না , যাতে তাদের মূর্খতা ও তাদের মধ্যে লুকানো শয়তানী স্বভাবের প্রকাশ হবে না৷ যে ব্যক্তি শয়তানদের 'ইলহাম' তথা আসমানী প্রেরণা লাভ করে নেতা হয়ে বসে তার জীবনেও তার শিক্ষার মধ্যে অনিবার্যভাবে নিয়তের ত্রুটি , সংকল্পের অপবিত্রতা ও উদ্দেশ্যের মালিন্য দেখা দেবেই৷ নির্ভেজাল সততা ও নির্ভেজাল সৎকর্মশীলতা কোন শয়তান মানুষের মনে সঞ্চার করতে পারে না এবং শয়তানের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী কখনো এর ধারক হতে পারে না৷ এরপর আছে শিক্ষার উন্নত মান ও পবিত্রতা এবং এর উপর বাড়তি সুনিপুন বাগধারা ও সাহিত্য-অলংকার এবং গভীর তত্ত্বজ্ঞান , যা কুরআনে পাওয়া যায়৷ এরি ভিত্তিতে কুরআনে বারবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে , মানুষ ও জীনরা মিলে চেষ্টা করলেও এ কিতাবের মতো কিছু একটা রচনা করে আনতে পারবে নাঃ
(সূরা ইউনুসঃ ৩৮)
﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
৩৮) তারা কি একথা বলে, পয়ম্বর নিজেই এটা রচনা করেছে?বলো , “তোমাদের এ দোষারুপের ব্যাপারে তোমরা যতি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে এরই মতো একটি সূরা রচনা করে আনো এবং এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাকে ডাকতে পারো সাহায্যের জন্য ডেকে নাও” ৪৬
৪৬ . সাধারণভাবে লোকেরা এ চ্যালেঞ্জটিকে নিছক কুরআনের ভাষাশৈলী অহংকার ও সাহিত্য সুষমার দিক দিয়ে ছিল বলে মনে করে৷ কুরআনের অলৌকিকতার ওপর যেভাবে আলোচনা করা হয়েছে তার ফলে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু কুরআন যে, তার অন্যন্য ও অতুলনীয় হবার দাবীর ভিত্তি নিছক নিজের শাব্দিক সৌন্দর্য সুষমার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেনি, এ ধরনের সীমিত ব্যাপার থেকে কুরআনের মর্যাদা অনেক উর্ধে৷ নিসন্দেহে ভাষাশৈলীর দিক দিয়েও কুরআন নজিরবিহীন৷ কিন্তু মূলত যে জিনিসটির ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, কোন মানবিক মেধা ও প্রতিভা এহেন কিতাব রচনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে তার বিষয়বস্তু ও শিক্ষা৷ এর মধ্যে অলৌকিকতার যেসব দিক রয়েছে এবং যেসব কারণে বলা যায় যে, এটি নিসন্দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা কিতাব এবং কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের কিতাব রচনা করা অসম্ভব তা এ কুরআনেরই বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে৷ এ ধরনের বর্ণনা ইতিপূর্বে যেখানেই এসেছে সেখানে আমরা তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এসেছি এবং পরবর্তীতেও করে যেতে থাকবো৷ তাই কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় এখানে এর আলোচনা করা হলো না৷ (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আত -তুর টীকা ২৬,২৭ )৷
No comments:
Post a Comment