প্রশ্ন: ৯৮: পাঁচ ভায়ের মধ্যে প্রত্যেকের উপর কুরবানী ওয়াজিব, বড় ভাই যদি প্রত্যেকের পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় করে দেয় তাহলে সকলের ওয়াজিব আদায় হবে কিনা?জানতে ইচ্ছুক ।

এক কুরবানী পরিবারের সবার পক্ষ থেকে হয়ে যায় মর্মে সহীহ মুসলিমে হাদীস আছে?



প্রশ্ন
From: মো: মাহবুব
বিষয়ঃ কোরবানীর মাসায়েল
একটি পরিবারে যতযন সদস্য থাকে সবার পক্ষে কোরবানির জন্য একটি বকরি যথেষ্ট।
وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَابْنُ، بَشَّارٍ – وَاللَّفْظُ لاِبْنِ الْمُثَنَّى – قَالاَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ، بْنُ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ زُبَيْدٍ الإِيَامِيِّ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا نُصَلِّي ثُمَّ نَرْجِعُ فَنَنْحَرُ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا وَمَنْ ذَبَحَ فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَىْءٍ ‏”‏ ‏.‏ وَكَانَ أَبُو بُرْدَةَ بْنُ نِيَارٍ قَدْ ذَبَحَ فَقَالَ عِنْدِي جَذَعَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُسِنَّةٍ فَقَالَ ‏”‏ اذْبَحْهَا وَلَنْ تَجْزِيَ عَنْ أَحَدٍ بَعْدَكَ ‏”‏ ‏.‏
বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ)
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আজকের দিনে আমাদের প্রথম কাজ হলো সলাত আদায় করা। তারপর আমরা ফিরে গিয়ে কুরবানী করব। যে লোক এরূপ করলো সে আমাদের সুন্নাত পালন করলো। আর যে লোক (সলাতের আগে) যাবাহ করলো, সেটা কেবল গোশ্‌ত (খাওয়ার জন্য) হলো, যা সে নিজের পরিবারের জন্য অগ্রিম ব্যবস্থা করলো। সেটা কুরবানীর কিছুই হলো না। আবূ বুরদাহ্‌ ইবনু নিয়ার (রাঃ) পূর্বেই কুরবানীর নিয়্যাতে যাবাহ করে ফেলেছিলেন। তাই তিনি বললেন, আমার কাছে একটি ছয় মাসের বকরীর বাচ্ছা আছে যা এক বছরের বাচ্চার চেয়েও হৃষ্টপুষ্ট। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি সেটিই কুরবানী করো। তোমার পরে আর কারো জন্য এটা যথেষ্ট হবে না। (ই.ফা. ৪৯১৩, ই.সে. ৪৯১৭)
সহিহ মুসলিম,হাদিস নং ৪৯৬৭
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
(এ কথাটির সত্যতা কতটুকু, এর বিস্তারিত উত্তর পেলে খুব উপকৃত হব)
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত উক্ত হাদীসের দুই হাদীস পূর্বের হাদীসটি পড়লেই এ মাসআলা পরিস্কার হয়ে যাবে। হাদীসটি পড়ুন প্রথমেঃ
عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ، أَنَّ خَالَهُ أَبَا بُرْدَةَ بْنَ نِيَارٍ، ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يَذْبَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ هَذَا يَوْمٌ اللَّحْمُ فِيهِ مَكْرُوهٌ، وَإِنِّي عَجَّلْتُ نَسِيكَتِي لِأُطْعِمَ أَهْلِي وَجِيرَانِي وَأَهْلَ دَارِي، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَعِدْ نُسُكًا»، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ عِنْدِي عَنَاقَ لَبَنٍ هِيَ خَيْرٌ مِنْ شَاتَيْ لَحْمٍ، فَقَالَ: «هِيَ خَيْرُ نَسِيكَتَيْكَ، وَلَا تَجْزِي جَذَعَةٌ عَنْ أَحَدٍ بَعْدَكَ
হযরত বারা বিন আযিব রাঃ থেকে বর্ণিত। তার মামা আবু বুরদা বিন নায়ার রাঃ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগেই কুরবানী করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আজকের দিনতো গোশত খাবার দিন। সুতরাং এ দিনে গোশত খেতে বিলম্ব করা অপছন্দ লেগেছে। তাই আমি আমার পরিবার-পরিজন, পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের গোশত খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে নামাযের আগেই আমার বকরী যবেহ করে দিয়েছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তদস্থলে আরেকটি বকরী কুরবানী কর। আমার মামা বললেন, আমার নিকট এক বছরের কম বয়সের একটি দুধের বকরী আছে, যা গোশতের দিক থেকে দু’টি বকরীর চেয়ে উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার কুরবানীর জন্য সেটাই উত্তম। তবে তোমার পরে আর কারো জন্য ছয় মাসের বকরী দ্বারা (কুরবানী) যথেষ্ট হবে না। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৯৬১, ইফাবা-৪৯৬৪, ই:সে:-৪৯১৪]
দু’টি হাদীসকে এক সাথে করে দেখুন। উভয় হাদীস একত্র করলে পরিস্কার হচ্ছে যে,সাহাবী এক বছরের চেয়ে কম বয়সী বকরী দিয়ে কুরবানী করতে চাইলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু এবারের জন্য এক বছরের কম বয়সী বকরী দিয়ে কুরবানী করার অনুমতি প্রদান করলেন।এর পর আর এক বছরের কম বয়সী বকরী দিয়ে কুরবানী দিলে হবে না মর্মেও জানিয়ে দিলেন।
যা পরিস্কার প্রমাণ করছে, এখানে কোন বয়সী বকরী জবাই করা যাবে? আর কুরবানী করার সময় কী? এটা বুঝানো উক্ত হাদীসের মূল বিষয়।
যদি পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক সবার উপর কুরবানী আবশ্যক হয়,আর তাদের পক্ষ থেকে একজন এক বকরী কুরবানী দিলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবার কোন কথাই এ হাদীসে উদ্ধৃত হয়নি।
সুতরাং এ কুরবানী পরিবারের সবার জন্য যথেষ্ট হবার দাবীর স্বপক্ষে এ হাদীস পেশ করা কোনভাবেই সঠিক নয়।
আর পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক কয়েকজনের উপর কুরবানী আবশ্যক হলে একজন একটি কুরবানী দিলে তা সবার পক্ষ থেকে আদায় হবে না। হতে পারে না।
তবে যদি অর্থ এই ধরা হয় যে, পরিবারের একজনের উপর কুরবানী আবশ্যক। তিনি কুরবানী করলেন। তখন তার কুরবানীর গোশত পরিবারের সবার জন্যই ভক্ষণ করা জায়েজ। সেই হিসেবে যদি বলা হয় “গোশত খাবার দিক থেকে একজনের কুরবানী পরিবারের জন্য যথেষ্ট” তাহলে একথাটি ঠিক আছে।
এক পরিবারের এক সদস্যের একটি কুরবানী পরিবারের সবার জন্য গোশত খাবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সবার কুরবানীর জন্য তা যথেষ্ট হতেই পারে না।
কারণ,কুরবানী একটি ইবাদত। আর ইবাদত প্রতিটি ব্যক্তির উপর আলাদা আবশ্যক হয়। একজনের ইবাদত দ্বারা আরেকজনের ইবাদত আদায় হয় না। শুধু সওয়াব পৌঁছানো যেতে পারে। যেমন নামায আদায় করে অপরের জন্য সওয়াব পাঠানোর নিয়ত করল। এর দ্বারা সওয়াব পৌঁছবে। কিন্ত অপরের নামায আদায় হবে না।
আরো পরিস্কার করে বলি!
এক পরিবারের পক্ষ থেকে একজন কুরবানী আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে কিছুতেই কুরবানী আদায় হবে না। এক পরিবারের পক্ষ থেকে একজন রোযা রাখলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হবে?
এক পরিবারের পক্ষ থেকে একজন হজ্ব করলে সবার পক্ষ থেকে হজ্ব আদায় হবে?
এক পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সদকায়ে ফিতির আদায় করলে সবার সদকায়ে ফিতির আদায় হয়ে যাবে?
একজন নামায পড়লে সবার আদায় হবে?
যদি না হয়,তাহলে একজন কুরবানী করলে সবার আদায় হবে কিভাবে?
নামায, রোযা, হজ্বের মত কুরবানীও একটি ইবাদত। যা প্রতিটি ব্যক্তির উপর আলাদাভাবে আবশ্যক হয়। একজন আদায় করলে আরেকজনের আদায় হবে কিভাবে? এটিতো একটি অযৌক্তিক ও হাস্যকর কথা।
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ [٥٣:٣٨
কিতাবে এই আছে যে,কোন ব্যক্তি কারও বোঝা নিজে বহন করবে না। [সূরা নাজম-৩৮}
কিছু হাদীসের মাধ্যমে যে বুঝা যায় যে, সাহাবাগণ প্রথম যুগে পুরো পরিবারের মাঝে একনজই কুরবানী করতেন, এসব হাদীসের মানে হল, আমরাও বলি পরিবারের মাঝে যার উপর কুরবানী আবশ্যক সে কুরবানী করবে। যদি দুইজনের উপর আবশ্যক থাকে তাহলে দুইজন করবে। আর যদি একজনের উপর আবশ্যক থাকে, তাহলে একজন করবে।
তো ইসলামের শুরু যুগে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে দারিদ্রতা ছিল। এতটা স্বচ্ছলতা ছিল না। আর পরিবারের মাঝে উপার্জনকারী যেহেতু একজনই হতো, তাই স্বাভাবিকভাবে ঘরের কর্তার উপরই কুরবানী আবশ্যক হতো, আর তিনি কুরবানী করতেন। আর এর গোস্ত পুরো পরিবারই খেতো। এ হল পুরো পরিবারের পক্ষ থেকে সাহাবীদের কুরবানী করার মানে।
এর মানে এটা কখনোই ছিল না যে, পরিবারের সবার উপর কুরবানী আবশ্যক। কিন্তু তারা কেউ কুরবানী করতো না, শুধু একজনই করতেন। সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে এমনটি কিছুতেই ভাবা যায় না।
তাছাড়া কেউ কেউ এ দলীল পেশ করেন যে, রাসূল সাঃ এক বকরী পুরো উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন। তাই এক কুরবানী পুরো পরিবারের পক্ষ থেকে হয়ে যাবে।
একথাটিও ঠিক নয়। কারণ এক হল দায়িত্ব হিসেবে কুরবানী করা। আরেক হল সওয়াব পৌছানো। আবশ্যক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কুরবানী একজন ব্যক্তির জন্য একটিই হবে। বাকি একজন কুরবানী করে কোটি মানুষের জন্য ঈসালে সওয়াব করতে পারবে। এতে কোন সমস্যা নেই। যেমন রাসূল সাঃ নিজের কুরবানী করার পর। সেটির ঈসালে সওয়াব সমস্ত উম্মতের জন্য করেছেন। এর দ্বারা পুরো পরিবারের ওয়াজিব কুরবানী একজন আদায় করলেই হয়ে যাবার কোন প্রমাণ হয় না। [তুহফাতুল আলমায়ী-৪/৪৩৭-৪৩৮]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...