প্রশ্ন: ৯৭ : বসে নামাজ পড়ার মাসয়ালাহ।

প্রশ্ন : বসে বসে নামাজ পড়ার মাসালা একটু আলোচনা করবেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্যগত সমস্যা না থাকলেও অনেকে সুন্নত ও নফল নামাজ বসে পড়ে থাকেন।
উত্তর : ফরজ সালাত ছাড়া যত সুন্নত সালাত আছে সেগুলো বসে আদায় করা জায়েজ। সেখানে বসার অনুমোদন আছে। কিন্তু এ অনুমোদনটুকু এমন যে, সুস্থ থাকলেও পড়তে পারবেন, তবে সওয়াবের ক্ষেত্রে কম-বেশি হয়ে যাবে।
সুতরাং কোনো কাজের অনুমোদন পেলেই সে কাজটা করলে শুদ্ধ নয়। দাঁড়িয়ে পড়লে যে মর্যাদা বা সওয়াব পাওয়া যাবে, বসে পড়লে সে মর্যাদা বা সওয়াব পাওয়া যাবে না। এটিই হলো পার্থক্য।

=====================

প্রশ্ন : আমার আম্মা হচ্ছেন কিডনির রোগী। উনাকে ডাক্তার একদম হাঁটু গেড়ে বসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তো, উনি চেয়ারে বসে নামাজ পড়েন। সূরা ও রুকু দাঁড়িয়ে করেন। কিন্তু সেজদাহ চেয়ারে বসে বালিশে দেন অথবা ইশারায় সেজদাহ দেন। কিন্তু আমি আমাদের এলাকার মসজিদে লেখা দেখলাম যে চেয়ারে বসে নামাজ পড়া অকাট্যভাবে নাজায়েজ। তাহলে আমার আম্মা কীভাবে নামাজ পড়বেন, যেহেতু তাঁর বসা একদম নিষেধ।
উত্তর : চেয়ারে বসে নামাজ পড়া অকাট্যভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ, এ রকম কোনো দলিল আছে বলে আমার জানা নেই। অকাট্যভাবে এটি দলিলবিহীন কথা। কারণ, ওজরের জন্য যেকোনো অবস্থায় সালাত আদায় করা জায়েজ। ওজরের জন্য যদি শুয়ে নামাজ পড়া যায়, ইশারায় নামাজ পড়া যায়, তাহলে বসে পড়া যাবে না কেন?
কোরআনে কারিমের মধ্যে আল্লাহ সুবানাহুতায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের সাধ্যে যতটুকু কুলায়’ (সূরা-তাগাবু)। সুতরাং কেউ যদি দাঁড়াতে না পারেন, তিনি বসে পড়বেন; কেউ যদি বসতে না পারেন, তিনি শুয়ে পড়বেন; আর শুয়েও পড়তে না পারলে তিনি যেভাবে পারেন, সেভাবেই নামাজ পড়বেন। এটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান। সুতরাং ‘অকাট্যভাবে’ এটি দলিলবিহীন বক্তব্য।
ওজরের মাসয়ালা কোনোভাবেই স্বাভাবিক মাসয়ালার ওপর     করার বৈধতা নেই। ইমাম শাফি (রা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো কারণে মানুষের ওপর কোনো বিষয় কঠিন, সংকীর্ণ হয়ে যায়, তখন ইসলাম এটাকে প্রশস্ত করে দেয়, সহজ করে দেয়।’ এটা সহজ করে দেওয়া হয়েছে। এটি একেবারেই জায়েজ। যাঁরা ফতোয়া দিয়েছেন, তাঁরা আন্দাজে ফতোয়া দিয়েছেন।

==============

ইসলাম মানুষের সহজাত ও স্বভাবজাত ধর্ম। মানুষের সাধ্যাতীত কোনো বিধান ইসলামে দেওয়া হয়নি। নামাজ আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় বিধান। অসুস্থ হলেও নামাজ আদায় করতে হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইসলাম কিছুটা অবকাশ দিয়েছে। বিকল্প পন্থা ও পদ্ধতিতে নামাজ আদায়ের সুযোগ দিয়েছে। তবে এর জন্য রয়েছে বিশেষ নীতিমালা। দাঁড়াতে ও সিজদা করতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির জন্য নামাজে কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরজ। যদি দাঁড়ানো বা সিজদাদানে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কেউ ফরজ-ওয়াজিব নামাজ বসে আদায় করে, তবে নামাজের ফরজ ছেড়ে দেওয়ার কারণে তার নামাজ হবে না। নামাজ পুনরায় পড়তে হবে। (দুররে মুখতার, যাকারিয়া বুক ডিপো ২/১৩২)
এমনকি সিজদা করতে সক্ষম ব্যক্তি যদি নামাজের কিছু অংশে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, কিন্তু পুরো সময় দাঁড়িয়ে থাকতে অপারগ থাকে, তবে যেটুকু সময় দাঁড়াতে পারবে, তা কোনো লাঠি বা দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে হলেও সেটুকু দাঁড়ানো ফরজ। এমতাবস্থায় যদি না দাঁড়ায় এবং কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়ানোর পরিবর্তে বসেই নামাজ আদায় করে, তবে নামাজ হবে না। (দুররে মুখতার ২/২৬৭)
কেউ যদি দাঁড়াতে সক্ষম, কিন্তু রুকু-সিজদা বা শুধু সিজদা করতে সক্ষম না হয়, তার জন্য বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ। সে ইশারার মাধ্যমে রুকু-সিজদা করবে। এ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করার চেয়ে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করা উত্তম। (দুররে মুখতার ২/৫৬৭, ফতোয়ায়ে আলমগিরি ১/১৩৬)
যেসব অক্ষমতার কারণে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা রহিত হয়ে যায়, তা দুই প্রকার :
১. হাকিকি বা মৌলিক অর্থাৎ এমন অক্ষম, যে দাঁড়াতে পারে না।
২. হুকমি বা বিধানগত অর্থাৎ সে এমন অক্ষম নয় যে দাঁড়াতে পারে না, বরং দাঁড়ালে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অথবা এমন দুর্বলতা থাকে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা বলে বিবেচিত। যেমন অসুস্থতা, যার ব্যাপারে অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তাররা পরামর্শ দেন যে দাঁড়ালে রোগ বৃদ্ধি পাবে অথবা সুস্থতা ফিরে আসতে বিলম্ব হবে কিংবা দাঁড়ানোর কারণে অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হয়- এসব অবস্থায় বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ। (দুররে মুখতার মাআ রদ্দুল মুহতার-২/৫৬৫)
যদি অসহনীয় ও অস্বাভাবিক ব্যথা না হয়, বরং সামান্য ব্যথা অনুভব হয়, তবে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা বলে বিবেচিত হবে না। এমতাবস্থায় বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ নেই। (তাতারখানিয়া-যাকারিয়া বুক ডিপো-২/৬৬৭)
যে ব্যক্তি দাঁড়াতে অক্ষম, কিন্তু মাটিতে বসে সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে সক্ষম, তবে তাকে মাটিতে বসে সিজদাসহকারে নামাজ আদায় করতে হবে। মাটিতে সিজদা না করে চেয়ারের ওপর বসে বা মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না। (তাতারখানিয়া-যাকারিয়া বুক ডিপো-২/৬৬৭)
যদি সে রুকু-সিজদা করতে অপারগ হয়, কিন্তু মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয়, তবে যেভাবেই সম্ভব মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করবে। কারণ শরিয়ত এমন অপারগদের মাটিতে বসার ব্যাপারে পূর্ণ ছাড় দিয়েছে। যে আসনে সম্ভব হয়, সেভাবেই বসে নামাজ আদায় করবে। (দুররে মুখতার মাআশ-শামি ২/৫৬৬)
এমন ব্যক্তি প্রয়োজন ছাড়া চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা অনুচিত। যদি কোনোভাবেই মাটিতে বসে নামাজ আদায় করার সাধ্য ও সামর্থ্য না থাকে, তবে চেয়ারে বসে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করা যাবে। কিন্তু যদি যেকোনোভাবে মাটিতে বসে রুকু-সিজদা করার সামর্থ্য থাকে, তবে চেয়ারে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না।
যে ক্ষেত্রে শরয়ি ওজরের কারণে চেয়ারে বসে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করার অনুমতি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সিজদার সময় ইশারার ওপরই ক্ষান্ত হওয়া উচিত। উল্লিখিত দীর্ঘ আলোচনার সংক্ষিপ্ত নিম্নরূপ :
১. যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম নয়, কিন্তু যেকোনোভাবে মাটিতে বসে রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করতে পারে, তাকে মাটিতে বসেই রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করতে হবে। চেয়ার ইত্যাদিতে বসে ইশারায় রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না।
২. আর কেউ যদি দাঁড়াতে পারে, কিন্তু কোমর বা হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ায় সিজদা করার শক্তি না রাখে অথবা সে মাটিতে বসতে পারে কিন্তু রুকু-সিজদার শক্তি রাখে না, এরূপ লোক মাটিতে বসে নামাজ আদায় করবে। চেয়ার ইত্যাদির ব্যবহার তাদের জন্য উচিত নয়। হ্যাঁ, যদি কোনোভাবেই মাটিতে বসা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, তখন চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় চেয়ার ব্যবহার করলেও সাদামাটা চেয়ার ব্যবহার করবে। আসলে অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থাভেদে চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ের বিভিন্ন হুকুম হতে পারে। তাই এ বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য কাম্য নয়।
লেখক : মুফতি ও সিনিয়র মুহাদ্দিস,
ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...