প্রশ্ন-৩: পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আক্বীমুদ্দিন বলতে কি বুঝায়? আক্বীমুদ্দিন এবং বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক কী? ইনশাআল্লাহ, বিস্তারিত বুঝিয়ে বললে খুশি হব।

 আলহামদুলিল্লাহ। দ্বীন কায়েম করা যে ফরজ এ বিষয়ে সব আলেম একমত। এ নিয়ে মতবিরোধ করার সুযোগও নেই; রবং মতবিরোধ করা হারাম, (সূরা শুরা-১৩)।
এখন মতবিরোধ হলো-
দ্বীন কায়েমের অর্থ কি? এবং দ্বীন কায়েমের পন্হা কি হবে? তা নিয়ে।
দ্বীন কায়েম মানে কি তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা?
না কি ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সব জায়গায় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা?
কোন টা?

* দ্বীন কায়েম করার পন্থা কি হবে?শুধু কি দাওয়াতই দ্বীন কায়েমের মাধ্যম?না কি রাজনৈতিক ভাবেও দ্বীন কায়েম করা যায়?কোনটা।

  • চলুন একটু আলোচনা করি:-

তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা, এদুটো কি ভিন্ন জিনিষ,না কি একই জিনিষ এটাই প্রথমে জানা দরকার।
যে ব্যক্তি তাওহীদ মেনে নেবে, সে আল্লাহ ছাড়া অন্যের আইন মানবে কিভাবে? অন্যের আইন মানলে কি তাওহীদ মানা হবে? নিশ্চয় না।
তাওহীদ মানে একত্ববাদ। আর একত্ববাদতো শুধু আল্লাহ একজন এটা মেনে নেয়া নয়; বরং এক আল্লাহর সকল বিধান মেনে নেয়াও তাওহীদ বা একত্ববাদের অবিচ্ছদ্য অংশ। এ দুটোকে আলাদা করার কোন সুযোগ নেই। এদুটো মিলেই তাওহীদ।
আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই,( সূরা বাক্বারাহ- ২৫৫)।
আল্লাহ ব্যতীত কারো বিধান চলবে না, (সূরা আনআম-৫৭ )।
সৃষ্টি যার, আইন চলবে শুধু তার, (সূরা আরাফ- ৫৪)।

যে ব্যক্তি আল্লাহ একজন এটা মানতে রাজি, কিন্তু আল্লাহর আইন মানতে রাজি নয়, যেমন সে বললো- মদ হারাম সে এটা মানবে না। সব আলিম একমত, লোকটি কাফের।
 তাহলে দ্বীন কায়েমের অর্থ কি দাড়ালো? শুধু কি আল্লাহ একজন, এটা মানা? না কি তার আইনগুলোও মানা? এ সবটাই তাওহীদ।
আপনি তাওহীদও মানবেন, আবার মানুষের বানানো আইনও মানবেন এটা হতে পারে না, (সূরা- বাক্বারাহ- ২৫৬)।

এখন এই দ্বীন কায়েম কিভাবে করা হবে, তা নিয়ে মত পার্থক্য হতেই পারে।
 একদল আলেম বলছেন, দ্বীন কায়েমের জন্য রাজনীতির প্রয়োজন নেই, দাওয়াতই যেথষ্ট।
আমি বিনয়ের সাথে এ মত পোষণকারী ওলামাগণ কে প্রশ্ন করতে চাই।
 যারা রাজনৈতিক উপায়ে দ্বীন কায়েম করতে চান, তারা কি তাদের কর্মসূচি থেকে দাওয়াত বাদ দিয়েছে? না কি তাদের কর্মসূচিতে দাওয়াতও আছে?
যদি তাদের কর্মসূচিতে দাওয়াত থাকে, তাহলে বিতর্ক কি নিয়ে করছেন?
বরং আমিতো দেখতে পাচ্ছি যারা শুধু দাওয়াত কে দ্বীন কায়েমের মাধ্যম বলছেন, তারা জীবনের সর্ব স্তরে দ্বীন কায়েমের আসবাব ও লাওয়াজিমাতের ব্যাপারে অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছেন।
ভাবুন, আপনি দাওয়াত দিলেন, লোকজন তাওহীদ মেনেও নিল, আর এতেই দ্বীন কায়েম হয়ে যাবে?
রাগ করবেন না প্লিজ। বাস্তবতা সামনে রেখে বলছি- দেশের সর্ব স্তরে (তথা অফিস, আদালত, সংসদ, সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায়) আল্লাহ দ্বীন কায়েমের জন্য যে পরিমাণ যোগ্য ও দক্ষ লোক তৈরি করা দরকার, সে লোক তৈরীর দৃশ্যমান কোন কাজ কি আপনারা শুরু করেছেন?
শুধু দাওয়াত দিলেই দ্বীন কায়েম হবে না, যারা দাওয়াত কবুল করবে তাদেরকে প্রশিক্ষণও দিতে হবে।
আর যারা রাজনৈতিক ভাবে দ্বীন কায়েম করতে চান, তারাও নিশ্চয় দাওয়াতের মাধ্যমেই তাদের কাজ শুরু করে থাকেন। আর এটাই স্বাভাবিক।
আর এ দাওয়াত শুরু হয় ব্যক্তি সংশোধনের মাধ্যমে। যারা দাওয়াত কবুল করেন তাদের কে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের সর্ব স্তরে দ্বীন কায়মের পরিকল্পনা নিয়ে তারাও কাজ করে যাচ্ছেন।
তবে তাদেরও মনে রাখা দরকার, জোর আল্লাহর আইন চাপিয়ে দেয়ার নাম দ্বীন কায়েম নয়। যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা দখল করলেই দ্বীন কায়েম হয়ে যাবে, এ চিন্তা একে বারে অমূকল। বরং দাওয়াতের মাধ্যমে দ্বীন মেনে চলার মানসিকতা সম্পন্ন লোক তৈরি না করে ক্ষমতা হাতে পেলেও দ্বীন কায়েম হবেনা।

সার কথা এই যে, দ্বীন কায়েমের জন্য শুধু দাওয়াত নয়, আবার দাওয়াত বিহীন শুধু ক্ষমতার মসনদে বস স্বপ্নও নয়। বরং এ দুটোর সমন্বয় বড়ই জরুরী।
তাই আমরা যারা দ্বীন কায়েমের ব্যাপারে একমত, তারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ নই বরং আমরা পরস্পর বন্ধু। আসুন, আমরা পরস্পর গঠনমূলক সমালোচনা করে আত্নসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির মানজিল পৌছতে চাই। আল্লাহ আমাদেরকে তার সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।
                                                                                                                                           (আমিন)



আল কোরআনের আলোকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর আওতাভুক্ত যে কাজগুলোর আলোচনা করা হলো, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এই সবগুলো কাজই ফরজ। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন যে ফরজ এতে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ফরজে কেফায়া ফরজই এবং যে কোন নফল ও সুন্নাত কাজের তুলনায় বহুগুনে উত্তম ও অনেক বেশী মর্যাদাসম্পন্ন কাজ। উপরন্তু ফরযে কেফায়ার প্রসঙ্গটা আসে কেবল কিতালের পর্যায়েই। কিতালের ব্যাপারে বৃদ্ধ, রুগ্ন প্রভৃতিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। দাওয়াতের কাজ যে কোন স্থানে যে কোন অবস্থায় একজন মানুষ আঞ্জাম দিতে পারে। সত্যের সাক্ষ্য পেশের ব্যাপারটাও এই পর্যায়েরই। ইকামাতে দ্বীন তো ব্যাপক অর্থবোধক একটি পরিভাষা যার মধ্যে দাওয়াত, শাহাদাত, কিতাল এবং আমর বিল মা’রূফ ও নেহী আনিল মুনকারও শামিল। সুতরাং এর বেশীর ভাগ কাজগুলো যে কোন মানুষ যে কোন অবস্থায় আঞ্জাম দিতে পারে।

কোরআন এবং সুন্নাহর আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করলে আরও সুস্পষ্টভাবে যে সত্যটি আমাদের সামনে ভেসে উঠে তা হলো- ইসলামী আন্দোলন বা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজ শুধু ফরজ তাই নয়, সব ফরজের বড় ফরজ। অন্যান্য ফরজ কাজ সমূহের আঞ্জাম দেয়া সম্ভবই নয়- এই ফরজ আদায় না করে। নিম্নে ছয়টি বিষয়ের আলোকে বিচার করলে আমরা এর গুরুত্ব আরও ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারব।

১. মানুষ আল্লাহর খলিফা। খলিফা হিসেবে দুনিয়ায় তাকে যে কাজটি করতে বলা হয়েছে তা হলো আল্লাহর দ্বীনের ভিত্তিতে জীবন যাপন করা। একমাত্র আল্লাহর হুকুম-আহকাম মেনে চলা-জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও বিভাগে এটা করতে হলে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া গত্যন্তর নেই।

২. আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষ এই দুনিয়ায় কি দায়িত্ব পালন করবে, কিভাবে সে দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে তা শেখানোর জন্যেই এসেছেন যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলায়হিমুস সালাম) তারা সবাই আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। কোন একজন নবীর জীবনেও এর ব্যতিক্রম কিছু দেখা যায় না।

৩. শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর কাজ সম্পর্কে আল কোরআন যে সব ঘোষণা দিয়েছে তার মূল কথা আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার সংগ্রাম পরিচালনা এবং নেতৃত্ব দান ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি ২৩ বছরের জীবনে বাস্তব যা করেছেন তাও একটি বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা। শুধু তাই নয়, কিয়ামত পর্যন্ত অনুরূপ আন্দোলন পরিচালনা ব্যবস্থাও তিনি রেখে গেছেন। যে কাজটি তিনি নিজে আঞ্জাম দিয়েছেন, সে কাজটি কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখার দায়িত্ব তিনি তাঁর উম্মতের উপর অর্পণ করেছেন।

৪. সুতরাং উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে পরিচয় দিতে হলে এই দায়িত্ব পালন অবশ্যই করতে হবে। উম্মত মুহাম্মদী হিসেবে এই দায়িত্ব পালনের তাকিদ প্রথমত: সরাসরি আল কোরআন থেকে প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত: সুন্নাতে রাসূলও এর সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তৃতীয়ত: এই ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের (রা.) ইজমা রয়েছে।

৫. আল কোরআন এবং সুন্নাতে রাসূলে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজটাকে ঈমানের অনিবার্য দাবী হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে:
الَّذِينَ آَمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ
অর্থ: যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে, খোদা-দ্রোহিতার পথে। (আন নিসা: ৭৬)

৬. আল কোরআনে আখিরাতে নাজাতের উপায়, একমাত্র উপায় হিসেবে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের সাথে সাথে আল্লাহর পথে মাল দিয়ে ও জান দিয়ে সংগ্রাম করার, জিহাদ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সুতরাং ইসলামী আন্দোলন নিছক কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। এই যুগের কোন নতুন আবিষ্কারও নয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই শরীয়তের প্রধানতম ফরজ কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব। সমস্ত নবী রাসূলগণের তরিকা অনুসরণ করতে হলে উম্মতে মুহাম্মদীর হক আদায় করতে হলে, ঈমানের দাবী পূরণ করতে হলে, সর্বোপরি আখিরাতে নাজাতের পথে চলতে হলে ইসলামী আন্দোলনে যোগদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

ইসলামী আন্দোলনের কাজ আল্লাহর কাজ

মানুষের জীবনে ও আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজটা মূলত আল্লাহর কাজ। সৃষ্টির সর্বত্র আল্লাহর হুকুম নিজেই সরাসরি কার্যকর করেছেন। মানুষের সমাজেও তারই হুকুম চলুক এটাই তার ইচ্ছা। এখানে ব্যতিক্রম এতটুকু যে, মানুষকে সীমিত অর্থে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সৃষ্টি জগতের কোথাও আর কারও কোন স্বাধীনতা নেই। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সবাই আল্লাহর হুকুম বা তাঁর দেয়া নিয়ম-নীতি মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ এভাবে বাধ্য করেননি। নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে মানুষকে এইটুকু সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন যে, সে আল্লাহর দেয়া নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলতে পারবে, আবার এটা অমান্যও করতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ চান যে, মানুষ তার এই স্বাধীন ইচ্ছাকে আল্লাহর হুকুম মানার কাজে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। এই কারণেই দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে আনসারুল্লাহ- আল্লাহর সাহায্যকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কোরবানে ঘোষণা করেছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللَّهِ

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। (আস সফ: ১৪)

অর্থাৎ মানুষের সমাজে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা হোক আল্লাহর এই ইচ্ছা বাস্তবায়নে সাহায্য কর। এভাবে আল্লাহর কাজে সাহায্য করার অনিবার্য দাবী হলো আল্লাহর সাহায্য পাওয়া। আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ
অর্থঃ অর্থ: তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তাহলে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের স্থিতি সুদৃঢ় করে দেবেন। (মুহাম্মদ: ৭)

সুতরাং যারা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যায়, আর আল্লাহও তাদের সাহায্যকারী হয়ে যান। আর আল্লাহ যাদের সাহায্যকারী হয়ে যান তাদেরকে দুনিয়ার কোন শক্তিই পরাভূত করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এভাবে যারা আল্লাহর সাহায্যকারীর তালিকাভুক্ত হয়ে যায় তারই আল্লাহর অলি হিসেবে গৃহীত হয়। যার এই অলিদের বিরোধিতা করে, আল্লাহ নিজে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দেন। হাদিসে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ বলেন:

من عاد لى و ليا فقد اذنته للحرب
যে আমার অলিদের সাথে শত্রুতা করে, আমি তাকে যুদ্ধের আহবান জানাই।

অবশ্য আল্লাহর সাহায্যকারীগণ সত্যিই আল্লাহর সাহায্যকারী কি না, সত্যি সত্যি আল্লাহকে ভালবাসে কি না এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি ব্যবস্থা আল্লাহ রেখেছেন। এই পরীক্ষায় পাশ করা ছাড়া তিনি কাউকেই অলি বা বন্ধু হিসেবে কবুল করেন না। এই পরীক্ষা সব নবী-রাসূল এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের নেয়া হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে আল্লাহ বিশ্বজোড়া মানুষের ইমামত দান করার আগে চরম পরীক্ষা নিয়েছেন। এসব পরীক্ষায় পাশ করার পরই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:
إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا

অর্থঃ আমি তোমাকে বিশ্বের সমস্ত মানুষের ঈমাম বা নেতা বানাতে চাই। (আল বাকারা: ১২৪)
আল্লাহ তায়ালা এভাবে তার সাহায্যকারীদের পরীক্ষা নেয়ার কথা আল কোরআনে বিভিন্ন ভাবে ব্যক্ত করেছেন।
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
অর্থঃ অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষার সম্মুখীন করবো যাতে তোমাদের মধ্যে কারা সংগ্রামী ও ধৈর্য ধারণকারী তা জেনে নিতে পারি এবং তোমাদের অবস্থা যাচাই করতে পারি। (মুহাম্মদ ৩১)

أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آَمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
অর্থঃ মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এতটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে - তাদের পরীক্ষা নেয়া হবে না? (আল আনকাবুত: ২)
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
অর্থঃ তোমরা কি ভেবে নিয়েছ যে, এমনিতেই বেহেশতে পৌঁছে যাবে? অথচ তোমাদের পূর্বের লোকদের সামনে যেসব কঠিন মুহূর্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় এসেছে তারতো কিছুই এখনও তোমাদের সামনে আসেনি। তাদের উপর কঠিন থেকে কঠিনতর মুহূর্ত এসেছে - বিপদ-মুসিবত তাদেরকে প্রকম্পিত করে তুলেছে- এমন কি নবী রাসূলগণ ও তাদের সাথীগণ সমস্বরে বলে উঠেছে আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে। (আল বাকারা:২১৪)

এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আল্লাহ তায়ালা তার সব নেক বান্দাদেরই নিয়েছেন এবং নিয়ে থাকেন। তাই হাদিসে বলা হয়েছে:
اشد البلاء الانبياء
সবচেয়ে বশী বিপদ-মুসিবত তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন আম্বিয়ায়ে কেরামগণ। তারপর তাদের অনুসরণের ক্ষেত্রে যারা যত বেশী অগ্রসর তাদেরকে তত বেশী বিপদ-মুসিবত বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা কি চান তাও পরিষ্কার করে বলেছেন:
إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (140) وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ
অর্থঃ তোমদের যদিও বা কিছুটা ক্ষতি ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে- তাতে কি আর আসে যায়, তোমাদের প্রতিপক্ষেরও তো অনুরূপ বিপর্যয় এসেছে। এই দিনসমূহ (সুদিন বা দুর্দিন) তো আমরই হাতে। আমি মানুষের মাঝে তা আবর্তিত করে থাকি। এভাবে আল্লাহ জেনে নিতে চান, কারা সত্যিকারের ঈমানদার এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না। তিনি আরও চান, ঈসানদারদের মধ্যে খাঁটি-অখাঁটি হিসেবে ছাঁটাই-বাছাই করতে এবং কুফরী শক্তির মূলোৎপাটন করতে। (আলে ইমরান: ১৪০-১৪১)

আল্লাহ পাকের উক্ত ঘোষণার আলোক পরিষ্কারভাবে আমরা বুঝতে পারি, পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথমত: ঈমানের দাবীর সত্যতা ও যথার্থতা প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয়ত: কিছু লোক আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে মকবুল হয়। তৃতীয়ত: শহীদদের সাথীদের এক অংশ এই কাফেলা থেকে ছিটকে পড়ে। চতুর্থত: পরীক্ষার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে শহীদদের সাথীদের মধ্য থেকে যারা ছবর এ ইস্তেকামাতের পরাকাষ্ঠা দেখাতে সক্ষম হয় - আল্লাহ তাদের হাতে দ্বীন ইসলামের বিজয় পতাকা দান করেন এবং তাদের মাধ্যমে কুফরী শক্তির মূলোৎপাটন করে দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের পথে বাধা-প্রতিবন্ধকতা, বিপদ-মুছিবত যা আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণ হিসেবেই আসে। তাই যাদের দিলে সঠিক ঈমানের আলো আছে, তারা এসব মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না।

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ
অর্থঃ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া, নির্দেশ ছাড়া তো কোন বিপদ মুছিবত আসতেই পারে না। আর যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে আল্লাহ তাদের দিলকে সঠিক হেদায়াত দান করেন। (আত তাগাবুন: ১১)

বস্তুত ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলনের পথে এমন একটা মুহূর্ত তো আসতেই হবে যেখানে পৌঁছে আন্দোলনের কর্মীগণ আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আর কোন কিছুর উপর নির্ভর করবে না, করত পারবে না। এমনকি মুহূর্তেই আল্লাহর নৈকট্য লাভের মুহূর্ত - মেরাজের মুহূর্ত। ইসলামী আন্দোলনের কাফেলার সঙ্গী-সাথীগণ যখন এই পর্যায়ে উপনীত হতে সক্ষম হয়, তখনই আল্লাহ তায়ালা তাদের বিজয় দানের ফায়সালা করেন।

এ কাজে শরীক হওয়ার জন্যেও আল্লাহর অনুমোদন প্রয়োজন

ইসলামী আন্দোলনের কাজটা আল্লাহর কাজ। সুতরাং এই কাজে শরীক হতে পারাটাও আল্লাহর অনুমোদন সাপেক্ষ। অবশ্য যারাই নিষ্ঠার সাথে এই পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়, আল্লাহ তাদের সিদ্ধান্তকে কবুল করেন।

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
অর্থঃ যারাই আমার পথে সংগ্রাম-সাধনায় আত্মনিয়োগ করে আমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে থাকি। (আল আনকাবূতঃ ৬৯)
আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাথে যারা এই কাজে অংশগ্রহণ করছেন তাদের লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেছেনঃ
هواجتباكم
অর্থঃ তিনি তোমাদেরকে এই কাজের জন্যে বাছাই করেছেন। (আল হজ্জ)
مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
অর্থঃ তোমাদের মধ্য থেকে যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তাদের পরিবর্তে আল্লাহ অন্য কোন সম্প্রদায়কে এই কাজরে দায়িত্ব দেবেন- তারা আল্লাহকে ভালবাসবে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসবেন, তারা মুমিনদের প্রতি হবে দয়ালু আর কাফিরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে- কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদের পরোয়া করবে না... এটাতো আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী, তিনি যাকে ইচ্ছা তার প্রতি এই বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ তো গভীর জ্ঞানের অধিকারী। (আল মায়েদাঃ ৫৪)

উক্ত ঘোষণার স্পষ্ট প্রতীয়মন হয় যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলনের সুযোগ পাওয়াটা আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীর উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ গভীর জ্ঞানের অধিকারী, আল্লাহ জেনে বুঝেই এ মেহেরবানী প্রদর্শন করে থাকেন। কারা আল্লাহর এই বিশেষ মেহেরবানী পাওয়ার যোগ্য, তাও আল্লাহ পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন - যারা আল্লাহকে ভালবাসবে এবং আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার মত কাজ করে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হবে, যারা এই পথে প্রাণান্তকর সংগ্রাম করবে এবং এই পথে চলতে গিয়ে কোন প্রকারের বাধা, বিপত্তি, নিন্দাবাদ, জুলুম, নির্যাতন কোন কিছুর পরোয়া করবে না অর্থাৎ দুনিয়ায় সবকিছু থেকে বেপরোয়া হতে পারবে, তাদেরকেই আল্লাহ এই কাজের জন্যে যথাযথ পাত্র হিসেবে গণ্য করে গ্রহণ করবেন।

এই কাজের সুযোগ পাওয়া যেমন আল্লাহর মেহেরবানী তেমনি এই কাজের উপর টিকে থাকাও আল্লাহর মেহেরবানীর উপর নির্ভরশীল। এই কারণেই আল্লাহ তায়ালা দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেনঃ
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
অর্থঃ হে আমাদের রব! একবার হেদায়াত দানের পর আবার আমাদের দিলকে বাঁকা পথে নিও না। তোমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে খাছ রহমত দান কর, তুমিই মহান দাতা। (আল ইমরানঃ ৮)

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...