প্রশ্ন: ৪৫২। মহিলাদের ইদ্দত ।

১। 

কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করে থাকে তাহলে তার ইদ্দত হলো তিন মাসিক পর্যন্ত। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
‘‘আর তালাকপ্রাপ্ত নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন মাসিক পর্যন্ত।’’ (সূরা বাকারা,আয়াতঃ ২২৮)


২। 

জাহেলি যুগে স্বামীর মৃত্যুর পর এক বছর পর্যন্ত নারী অন্য কোথাও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না এবং বাড়ির বাইরেও যেতে পারত না। এ নিয়ম চালু থাকায় মানুষ সমস্যার সম্মুখীন হতো। আল্লাহ তাআলা এ বিধান সহজ করে দিয়েছেন। এক বছরের পরিবর্তে শুধু চার মাস ১০ দিনের ইদ্দত নির্ধারণ করেছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের স্ত্রীরা চার মাস ১০ দিন প্রতীক্ষায় থাকবে...।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৪)


================================================================


 ১৯৬৮. প্রশ্ন এক মহিলার স্বামী মারা যাওয়ায় সে ইদ্দত পালন করছে। এ অবস্থায় কি সে নাকফুল পরতে পারবে? রঙিন কাপড় পরতে পারবে? চুল আচড়াতে পারবে? একজন বললেন, চুল আচড়ানো নিষেধ। তাহলে এত লম্বা চুল না আচড়ালে তো জট বেঁধে যাবে? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর জন্য ইদ্দত অবস্থায় সকল প্রকার সাজসজ্জা ত্যাগ করা জরুরি। তাই অলংকার পরা যাবে না। এমনকি নাকফুলও খুলে রাখতে হবে। আর রঙিন সাধারণ ব্যবহৃত কাপড় পরতে পারবে। সাদা কাপড় পরা বাধ্যতামূলক নয়। তবে পুরাতন কাপড় থাকলে নতুন কাপড় পরবে না। তদ্রূপ ঝলমলে কাপড় থেকেও বিরত থাকবে। সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে চুল আচড়াতে পারবে না। তবে চুলের স্বাভাবিকতা রক্ষা করার জন্য আচড়ানোর প্রয়োজন হলে তা পারবে। এটা নিষিদ্ধ নয়।

সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩০৪; মুসনাদে আহমদ ৬/৩০২; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৫৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫৩৩; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৩/২৬৬


৩৩৬০. প্রশ্ন.  আমাদের সমাজে নারীদেরকে স্বামীর মৃত্যুর পর তার জন্য শোক প্রকাশার্থে সাজসজ্জা থেকে বিরত থাকতে দেখা যায়। তাছাড়া বিধবা নারীদের সাদা কাপড় পরিধান করার প্রচলন প্রায় সব অঞ্চলেই আছে। অনেকে এটিকে শুধু একটি সামাজিক প্রথা মনে করে থাকে। আবার অনেকে এটিকে শরীয়তের বিধান মনে করলেও এ ব্যাপারে এতটা যত্নশীল নয়। তদ্রূপ অনেকে এসব বিষয়কে কুসংস্কার বলেও মন্তব্য করে থাকে। জানার বিষয় হল, আসলে এ বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা কী? স্বামীর মৃত্যুর পর একজন স্ত্রীর এ ব্যাপারে করণীয় কী?

উত্তর: স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর ইদ্দতকালীন সময় (অন্তঃসত্ত্বা হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অন্যথায় ৪ মাস ১০ দিন) সব ধরনের সাজসজ্জা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব বিধান।

সহীহ বুখারীতে উম্মে হাবীবা রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী কোনো নারীর জন্য তার স্বামী ব্যতীত অন্য কারো মৃত্যুতে তিনদিনের বেশি সময় হিদাদ (শোক করা ও সাজসজ্জা থেকে বিরত থাকা) বৈধ নয়। আর স্বামীর মৃত্যুতে ৪ মাস ১০ দিন হিদাদ পালন করবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৩৪

উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে স্ত্রী লোকের স্বামী মৃত্যুবরণ করে সে যেন ইদ্দতকালীন সময়ে রঙিন এবং কারুকার্যমণ্ডিত কাপড় ও অলংকার পরিধান না করে। আর সে যেন খিযাব ও সুরমা ব্যবহার না করে।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২২৯৮

আল্লামা কুরতুবী রাহ. তার বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘আলজামে লিআহকামিল কুরআন’ও ইদ্দত সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, হিদাদ পালনের অর্থ হল, মহিলা তার ইদ্দতকালীন সুগন্ধি, সুরমা, মেহেদি,অলঙ্কারাদিসহ পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রে যাবতীয় সাজসজ্জা ত্যাগ করবে। -আল জামে’ লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবী ৩/১১৮

সুতরাং কোনো মহিলার স্বামী মারা যাওয়ার পর ৪ মাস ১০ দিন অথবা অন্তঃসত্ত্বা হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত যে কোনো ধরনের সাজসজ্জা যা উৎসবাদিতে পরা হয় এমন চাকচিক্যপূর্ণ পোশাক পরিধান করা,সুগন্ধি ও অন্যান্য সাজসজ্জার প্রসাধনী ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তদ্রƒপ মেহেদি লাগানো, সুরমা দেওয়া থেকেও বিরত থাকা আবশ্যক। অবশ্য ব্যবহৃত রঙিন কাপড় যদি চাকচিক্যপূর্ণ না হয় তাহলে তা পরিধান করতে কোনো অসুবিধা নেই।

ইদ্দত অবস্থায় সাদা কাপড় পরা আবশ্যক নয়। বরং সাদা কাপড় পরিধান করাকে জরুরি মনে করা ঠিক নয়।

প্রকাশ থাকে যে, ইদ্দত অবস্থায় মহিলার জন্য সাজগোজ ত্যাগ করার বিধান একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্ব এসেছে। এটি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সুতরাং একে সামাজিক প্রথা বা কুসংস্কার মনে করা অন্যায়। বরং আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী সকল মুসলমানের উচিত উক্ত বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। নারীদের কর্তব্য উক্ত বিধান পালনে যত্নশীল হওয়া।

-আলমাবসূত, সারাখসী ৬/৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৫৩০-৫৩২; মিরকাতুল মাফাতীহ ৬/৪৫২; তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ১/২৩১; বাদায়েউস সানায়ে ৩/৩৩০; ফাতহুল বারী ৯/৪০১, ৩৯৫


৩৭৫১. প্রশ্ন.  গত রবিউল আওয়াল মাসের নয় তারিখে আমার আব্বু মারা যান। আর আমার আম্মু জীবিত আছেন। আর আমরা জানি,স্বামী মারা যাওয়ার পর চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হয়। এখন প্রশ্ন হল, আব্বু যেহেতু মাসের কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ইন্তেকাল করেছেন তাই এ অবস্থায় চার মাস দশ দিনের হিসাব কীভাবে করবে?

উত্তর: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনার আব্বার মৃত্যু যেহেতু মাস শুরু হওয়ার পর হয়েছে তাই আপনার আম্মা এক শত ত্রিশ দিন ইদ্দত পালন করবেন। এক্ষেত্রে মাসের হিসাব ধর্তব্য হবে না।

-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫২২; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৫৪৯-৫৫০; বাদায়েউস সানায়ে ৩/৩১০; আলমুহীতুল বুরহানী ৪/২২৭; আলবাহরুর রায়েক ৪/১৩২


৩৭৫৩ . প্রশ্ন. আমার স্বামী আমাকে নিয়ে তার শশুরালয়ে অর্থাৎ আমার পিতার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। ঘটনাক্রমে সেখানেই তার ইন্তেকাল হয়ে যায়। এখন হুযুরের নিকট আমার জানার বিষয় হল, আমি স্বামীর মৃত্যুর ইদ্দত কোথায় পালন করব? আমার স্বামীর বাড়িতে না পিতার বাড়িতে? দয়া করে উত্তরটা জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনার পিত্রালয়ে স্বামীর মৃত্যু হলেও আপনাকে স্বামীর বাড়িতেই ইদ্দত পালন করতে হবে।

কেননা ইদ্দত স্বামীর বাড়িতেই পালন করা জরুরি। একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক মহিলার স্বামী ইন্তেকাল করলে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিজের পিত্রালয়ে চলে যাওয়ার অনুমতি চায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন,

امْكُثِي فِي بَيْتِكِ حَتَّى يَبْلُغَ الكِتَابُ أَجَلَهُ.

তুমি ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত তোমার (স্বামীর) ঘরেই অবস্থান কর। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৪

আর ইদ্দত হচ্ছে চার মাস দশদিন অথবা অন্তসত্তা হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত।

-সূরা বাকারা (২) : ২৩৪; সূরা তালাক (৬৫) : ৪; আলবাহরুর রায়েক ৪/১৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫৩৫; আলমুহীতুল বুরহানী ৫/২৩৯; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৫৩৬


৪১৬৩. প্রশ্ন.  আমরা জানি, স্বামীর মৃত্যুর পর চার মাস দশদিন স্ত্রীকে ইদ্দত পালন করতে হয়। এ সময় বিশেষ কিছু বিধান তার মেনে চলতে হয়। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি বিধান হল, এ সময় সে অন্যত্র বিয়ে করতে পারে না। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায়, মেয়েকে উপযুক্ত মনে হলে ইদ্দতের মধ্যেই কাবিন নামা তৈরি করে রাখা হয়। এবং ইদ্দত শেষে বিয়ের বাকি কাজ সম্পন্ন হয়। এখন প্রশ্ন হল, এভাবে ইদ্দতের মধ্যেই কাবিননামা লিখে রাখা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয হবে কি?

উত্তর: ইদ্দতের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াই নাজায়েয। সেখানে একেবারে কাবিননামা তৈরি করে ফেলা আরো মারাত্মক অন্যায় ও গুনাহের কাজ। কুরআনে কারীমে এসেছে, আল্লাহ পাক বলেন,

وَ لَا تَعْزِمُوْا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتّٰی یَبْلُغَ الْكِتٰبُ اَجَلَهٗ

আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ইদ্দতের নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত বিবাহের আকদ পাকা করার ইচ্ছাও করো না। -সূরা বাকারা (২) : ২৩৫

সুতরাং ইদ্দতের মধ্যে কাবিননামা লিখে রাখা যাবে না। তবে ইশারা-ইঙ্গিতে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করা যেতে পারে। আল্লাহ পাক বলেন,তোমরা স্ত্রীলোকদের বিয়ের প্রস্তাব সম্বন্ধে ইঙ্গিতে যা ব্যক্ত কর অথবা নিজেদের মনে গোপন রাখ,তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই। (সূরা বাকারা (২) : ২৩৫) প্রকাশ থাকে যে, কাবিননামা হচ্ছে বিবাহের নিবন্ধন ফরম যা বিবাহ সংঘটিত হওয়ার পর পূরণ করা নিয়ম। বিবাহের পূর্বে তা পূরণ করলে অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে। তাই এহেন কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

-শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৪/৩৪১; বাদায়েউস সনায়ে ৩/৩২৩; আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ১/৪২২; আলবাহরুর রায়েক ৪/১৫১; ফাতহুল কাদীর ৪/১৬৫


৩৫৯৯. প্রশ্ন.  বাবার মৃত্যুর পর আমার মা ইদ্দত পালন করছেন না। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে বাসার বাইরে চলে যান। তাকে বললে তিনি শোনেন না। তাই ইদ্দত পালন না করলে কী আযাব এবং জাহান্নামের ভয়াবহতা রয়েছে তা জানতে চাই। যাতে করে আমার মাকে জানালে তিনি সঠিকভাবে ইদ্দত পালন করতে পারেন।

উত্তর:  স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে চার মাস দশ দিন স্ত্রীর জন্য নিজ গৃহে ইদ্দত পালন করা শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব বিধান। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করে এবং স্ত্রীদেরকে রেখে যায়, উক্ত স্ত্রীগণ নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষায় রাখবে (ইদ্দত পালন করবে)। -সূরা বাকারা (২) : ২৩৪

খুসাইফ রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করলাম,যে মহিলার স্বামী মারা গেছে সে (ইদ্দত অবস্থায়) কি ঘর থেকে বের হতে পারবে? তিনি বললেন,না। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১৯১৯৮

সুতরাং বিনা ওজরে ঘর থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয হবে না। আর শরীয়তের হুকুমের লঙ্ঘন করাই পাপ। আর পাপ বলতেই ঈমানের উন্নতির পথে বাধা এবং আখেরাত ও কবরের যিন্দেগী সুখময় হতে বাধা। মুমিনের জন্য শুধু এতটুকু কথাই কোনো ফরয-ওয়াজিব বিধান পালনের জন্য যথেষ্ট।

অবশ্য জীবিকা কিংবা অন্য কোনো মানবিক প্রয়োজনে দিনের বেলা বাইরে যাওয়ার অবকাশ আছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শেষ হওয়ার পর আবার বাড়িতে ফিরে আসা জরুরি। আর দিনে কোনো বিশেষ ওজরে বের হলেও রাতে অবশ্যই নিজ গৃহেই অবস্থান করতে হবে।

-ফাতহুল কাদীর ৪/১৬৬-১৬৭; আলমুহীতুল বুরহানী ৫/২৩৬; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৫/২২৮; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৫৩৬


মূল লিংক

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...