৩৬। তাফহীমুল কুরআন : মানচিত্র সমূহ : মাদয়ান উপত্যকা

৩৬। তাফহীমুল কুরআন :  মানচিত্র সমূহ  :  মাদয়ান উপত্যকা

 


وَلَمَّا وَرَدَ مَاءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِّنَ النَّاسِ يَسْقُونَ وَوَجَدَ مِن دُونِهِمُ امْرَأَتَيْنِ تَذُودَانِ ۖ قَالَ مَا خَطْبُكُمَا ۖ قَالَتَا لَا نَسْقِي حَتَّىٰ يُصْدِرَ الرِّعَاءُ ۖ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ

(২৮-ক্বাসাস:২৩.)  আর যখন সে মাদয়ানের কুয়ার কাছে পৌঁছল,৩৩ সে দেখলো, অনেক লোক তাদের পশুদের পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের থেকে আলাদা হয়ে একদিকে দু’টি মেয়ে নিজেদের পশুগুলো আগলে রাখছে। মূসা মেয়ে দু’টিকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের সমস্যা কি?” তারা বললো, “আমরা আমাদের জানোয়ারগুলোকে পানি পান করাতে পারি না যতক্ষণ না এ রাখালেরা তাদের জানোয়ারগুলো সরিয়ে নিয়ে যায়, আর আমাদের পিতা একজন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তি।”৩৪


[[টিকা:৩৩) এ স্থানটি, যেখানে হযরত মূসা পৌঁছেছিলেন, এটি ছিল আরবীয় বর্ণনা অনুযায়ী আকাবা উপসাগরের পশ্চিম তীরে মানকা থেকে কয়েক মাইল উত্তর দিকে অবস্থিত। বর্তমানে এ জায়গাটিকে আল বিদ্’আ বলা হয়। সেখানে একটি ছোট মতো শহর গড়ে উঠেছে। আমি ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তাবুক থেকে আকাবায় যাওয়ার পথে এ জায়গাটি দেখেছি। স্থানীয় অধিবাসীরা আমাকে জানিয়েছে, বাপ-দাদাদের আমল থেকে আমরা শুনে আসছি মাদয়ান এখানেই অবস্থিত ছিল। ইউসিফুস থেকে নিয়ে বাটন পর্যন্ত প্রাচীন ও আধুনিক পরিব্রাজক ও ভূগোলবিদগণও সাধারণভাবে এ স্থানটিকেই মাদয়ান বলে চিহ্নিত করেছেন। এর সন্নিকটে সামান্য দূরে একটি স্থানকে বর্তমানে “মাগায়েরে শু’আইব” বা “মাগারাতে শু’আইব” বলা হয়। সেখানে সামূদী প্যাটার্নের কিছু ইমারত রয়েছে। আর এর প্রায় এক মাইল দু’মাইল দূরে কিছু প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এর মধ্যে আমরা দেখেছি দু’টি অন্ধকূপ। স্থানীয় লোকেরা আমাদের জানিয়েছে, নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু বলতে পারি না তবে আমাদের এখানে একথাই প্রচলিত যে, এ দু’টি কূয়ার মধ্য থেকে একটি কূয়ায় মূসা তাঁর ছাগলের পানি পান করিয়েছেন। একথাটি আবুল ফিদা (মৃত্যু ৭৩২ হিঃ) তাকবীমুল বুলদানে এবং ইয়াকুত মু’জামুল বুলদানে আবু যায়েদ আনসারীর (মৃত্যু ২১৬ হিঃ) বরাত দিয়ে উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ এলাকার অধিবাসীরা এ স্থানেই মূসার ঐ কূয়াটি চিহ্নিত করে থাকে। এ থেকে জানা যায়, এ বর্ণনাটি শত শত বছর থেকে সেখানকার লোকদের মুখে মুখে বংশানুক্রমে চলে আসছে এবং এরই ভিত্তিতে দৃঢ়তার সাথে বলা যেতে পারে, কুরআন মজীদে যে স্থানটির কথা বলা হয়েছে এটা সেই স্থান।]]


[[টিকা:৩৪) অর্থাৎ আমরা মেয়ে মানুষ। এ রাখালদের সাথে টক্কর দিয়ে ও সংঘর্ষ বাঁধিয়ে নিজেদের জানোয়ারগুলোকে আগে পানি পান করাবার সামর্থ্য আমাদের নেই। অন্যদিকে আমাদের পিতাও এত বেশী বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন যে, তিনি নিজে আর কষ্টের কাজ করতে পারেন না। আমাদের পরিবারে আর দ্বিতীয় কোন পুরুষ নেই। তাই আমরা মেয়েরাই এ কাজ করতে বের হয়েছি। সব রাখালদের তাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে নিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। মেয়ে দু’টি শুধুমাত্র একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যের মাধ্যমে এ বক্তব্য উপস্থাপন করে। এ থেকে একদিকে তাদের লজ্জাশীলতার প্রকাশ ঘটে। অর্থ্যাৎ একজন পর পুরুষের সাথে তারা বেশি কথাও বলতে চাচ্ছিল না। আবার এটাও পছন্দ করছিল না যে, এ ভিন দেশী অপরিচিত লোকটি তাদের ঘটনা সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা পোষণ করুক এবং মনে মনে ভাবুক যে, এরা কেমন লোক যাদের পুরুষরা ঘরে বসে রয়েছে আর ঘরের মেয়েদেরকে এ কাজ করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।


এ মেয়েদের বাপের ব্যাপারে আমাদের এখানে এ কথা প্রচার হয়ে গেছে যে, তিনি ছিলেন হযরত শু’আইব আলাইহিস সালাম। কিন্তু কুরআন মজীদে ইশারা ইঙ্গিতে কোথাও এমন কথা বলা হয়নি যা থেকে বুঝা যেতে পারে তিনি শু’আইব আলাইহিস সালাম ছিলেন। অথচ শু’আইব আলাইহিস সালাম কুরআন মজীদে একটি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। এ মেয়েদের পিতা যদি তিনিই হতেন তাহলে এখানে একথা সুস্পষ্ট না করে দেয়ার কোন কারণই ছিল না। নিঃসন্দেহে কোন কোন হাদীসে তাঁর নাম স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লামা ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর উভয়ে এ ব্যাপারে একমত যে, এগুলোর কোনটিরও সনদ তথা বর্ণনাসূত্র নির্ভুল নয়। তাই ইবনে আব্বাস, ইবনে বসরী, আবু উবাইদাহ ও সাঈদ ইবনে জুবাইরের ন্যায় বড় বড় তফসীরকারক বনী ইসরাইলের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তালমূদ ইত্যাদি গ্রন্থে এ মনীষীর যে নাম উল্লেখিত হয়েছে সেটিই বলেছেন। অন্যথায় বলা নিষ্প্রয়োজন, যদি নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হযরত শু’আইবের নাম স্পষ্ট করে বলা হতো তাহলে তাঁরা কখনো অন্য নাম উল্লেখ করতেন না।


বাইবেলের এক জায়গায় এ মনীষীর নাম বলা হয়েছে রূয়েল এবং অন্য জায়গায় বলা হয়েছে যিথ্রো এবং বলা হয়েছে তিনি মাদয়ানের যাজক ছিলেন। (যাত্রা পুস্তক ২: ১৬-১৮, ৩: ১ এবং ১৮: ৫) তালমূদীয় সাহিত্যে রূয়েল, যিথ্রো ও হুবাব তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম বলা হয়েছে। আধুনিক ইহুদী আলেমগণের মতে যিথ্রো ছিল ‘হিজ এক্সেলেন্সী’ এর সমার্থক একটি উপাধি এবং আসল নাম ছিল রূয়েল বা হুবাব। অনুরূপভাবে কাহেন বা যাজক (Kohen Midian) শব্দটির ব্যাখ্যার ব্যাপারেও ইহুদী আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ একে পুরোহিত (Priest) বা এর সমার্থক হিসেবে নিয়েছেন আবার কেউ রইস বা আমীর (Prince) অর্থে নিয়েছেন।


তালমূদে তাঁর যে জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসার জন্মের পূর্বে ফেরাউনের কাছে তাঁর যাওয়া-আসা ছিল। ফেরাউন তাঁর জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রতি আস্থা রাখতো। কিন্তু যখন বণী ইসরাঈলের ওপর জুলুম-শোষণ চালাবার জন্য মিশরের রাজ পরিষদে পরামর্শ হতে লাগলো এবং তাদের সন্তানদের জন্মের পর পরই হত্যা করার সিদ্ধান্ত হলো তখন তিনি ফেরাউনকে এ অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য অনেক চেষ্টা চালান। তাকে এ জুলুমের অশুভ পরিণামের ভয় দেখালেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, এদের অস্তিত্ব যদি আপনার কাছে এতই অসহনীয় হয়ে থাকে তাহলে এদেরকে মিসর থেকে বের করে এদের পিতৃ পুরুষের দেশ কেনানের দিকে পাঠিয়ে দিন। তাঁর এ ভূমিকায় ফেরাউন তাঁর প্রতি অসন্তষ্ট হয়ে তাঁকে অপদস্থ করে নিজের দরবার থেকে বের করে দিয়েছিল। সে সময় থেকে তিনি নিজের দেশ মাদ্‌য়ানে চলে এসে সেখানেই অবস্থান করছিলেন।


তাঁর ধর্ম সম্পর্কে অনুমান করা হয়, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মতো তিনিও ইবরাহীমী দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। কেননা, যেভাবে হযরত মূসা ছিলেন ইসহাক ইবনে ইবরাহীমের (আলাইহিস সালাম) আউলাদ ঠিক তেমনি তিনিও ছিলেন মাদ্‌য়ান ইবনে ইবরাহীমের বংশধর। এ সম্পর্কের কারণেই সম্ভবত তিনি ফেরাউনকে বনী ইসরাঈলের ওপর জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন করতে নিষেধ করেন এবং তার বিরাগভাজন হন। কুরআন ব্যাখ্যাতা নিশাপুরী হযরত হাসান বাসরীর বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ


أَنَّهُ كَانَ رَجُلاً مُسْلِمًا قَبْلَ الدَّيْنِ مِنْ شُعَيْبِ


“তিনি একজন মুসলমান ছিলেন। হযরত শু’আইবের দ্বীন তিনি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।”


তালমূদে বলা হয়েছে, তিনি মাদ্‌য়ানবাসীদের মূর্তি পূজাকে প্রকাশ্যে নির্বুদ্ধিতা বলে সমালোচনা করতেন। তাই মাদয়ানবাসীরা তাঁর বিরোধী হয়ে গিয়েছিল।]]



No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...