প্রশ্ন: ৩৩১ : সুন্নাত সম্পর্কে বিস্তারিত ।

সুন্নাতঃ

সুন্নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ : ‘পথ’।
সুন্নাহ (السنة) শব্দটি يسن ـ سن থেকে ক্রিয়ামূল। যার অর্থ তরীকা বা পন্থা, পদ্ধতি, রীতিনীতি, হুকুম ইত্যাদি। এই পদ্ধতি ও রীতিনীতি নন্দিত বা নিন্দিত কিংবা প্রশংসিত বা ধিকৃত উভয়ই হতে পারে। যেমন- الله من السنة (আল্লাহর নীতি)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনার পূর্বে আমি যত রাসূল প্রেরণ করেছি, তাদের ক্ষেত্রে এরূপ নিয়ম চালু ছিল। আপনি আমার নিয়মের কোন ব্যতিক্রম পাবেন না’। (ঈসরা ১৭/৭৭; আবু নাফিয লিলাবার আল-বারাদী; আত-তাহরীক)।

কোরআন মাজীদে এই ‘সুন্নাত’শব্দটি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এবং এটাই ‘সুন্নাতুল্লাহ বা ‘আল্লাহর সুন্নাত’। আর এটি ব্যবহৃত হয়েছে পথ, পন্থা, নিয়ম, পদ্ধতি অর্থে। এক কথায় আল্লাহর সুনির্দিষ্ট করণ বিধানকে আল্লাহর সুন্নাত বলা হয়।
আর এ বিধান (আল্লাহর সুন্নাত) কোরআন মাজীদের মাধ্যমে তার বান্দার জন্য সুনির্ধারিত হয়েছে।
(সূরা আযহাব-৩৮)।
(আল্লাহর সুন্নাত)এটিই আল্লাহর বিধান, যা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে; তুমি আল্লাহর এ বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না। (সূরা ফাতহ-২৩, সূরা আযহাব-৬২)।
তুমি আল্লাহর (সুন্নাতে) বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানের কোন ব্যতিক্রমও দেখবে না। (সূরা ফাতির-৪৩)।
নবী(ছাঃ)এর সুন্নাত : শারঈ পরিভাষায় সুন্নাত হল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর ঐ সকল বাণী, যা দ্বারা তিনি কোন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ, বিশ্লেষণ, মৌণ সম্মতি ও সমর্থন দিয়েছেন এবং কথা ও কর্মের মাধ্যমে অনুমোদন করেছেন, যা সঠিকভাবে জানা যায় তাকে সুন্নাহ বলা হয়। {শাইখ যাকারিয়া আল-আনছারী, ফাতহুল বাকী আলা আলাফিল ইরাকী (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, তা. বি.) পৃ: ১২}।

সুন্নাতের প্রকারভেদ : অনুসরণ ও বর্জনের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ) এর অনুসরণের ক্ষেত্রে সুন্নাত দুই প্রকারঃ

১.সুন্নাতেফে’লিয়্যাহঃ (তথা কর্মে সুন্নাত)।সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলের প্রত্যেকটি আমল প্রতি পদে মেনে চলেছেন। আবু বকর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) যা আমল করতেন, আমি তাই আমল করব, আমি তার কোন কিছুই ছেড়ে দিতে পারি না। কেননা আমি আশঙ্কা করি যে, তার জন্য কোন নির্দেশ ছেড়ে দিয়ে আমি যেন পথভ্রষ্ট হয়ে না যায়। (বুখারী হা/৩০৯৩, মুসলিম হা/১৭৫৯)।

২.সুন্নাতে তারকিয়্যাহঃ(তথা বর্জনে সুন্নাত)। রাসূল(ছাঃ)যে ইবাদত করেননি, করতে বলেননি এবং সম্মতি প্রদান করেননি এমন ইবাদত বর্জন করাই সুন্নাত।
ইমাম শাতেবী (রহঃ) সুন্নাতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সুন্নাত হলো নবী (ছাঃ) এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে যা বর্ণিত হয়েছে এবং যা সাহাবায়ে কেরাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পক্ষ থেকে এসেছে।
আল্লামা ফয়সাল ইবনে আব্দুল আযিয আলে মুবারক (রহঃ) বলেন, সুন্নাত হলো যা নবী (ছাঃ) এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে যা বর্ণিত হয়েছে। (মুকামুর রাশাদ ১/২৫ পৃষ্ঠা)।

আল্লামা মুহাম্মদ বশীর শাহসোয়ানীর ভাষায় : যেই বিশেষ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি, যা নবী করীম (ছাঃ) এর সময় থেকেই দ্বীন ও ইসলামের ব্যাপারে কোন কাজ করার বা না করার দিক দিয়ে বাস্তবভাবে অনুসরণ করা হয়Ñ যার ওপর দিয়ে চলাচল করা হয়।

আল্লামা সফিউদ্দীন আল হাম্বলী লিখেছেন : কোরআন ছাড়া রাসূলের যে কথা, যে কাজ বা অনুমোদন বর্ণনার সুত্রে পাওয়া গেছে- তাই সুন্নাত।

সাহাবাদের সুন্নাত : রাসূল (ছাঃ) এর কথা, কাজ, সম্মতি ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যা সাহাবাগণ অনুসরণ করেছেন যেভাবে করতে বলেছেন সে ভাবে আমল করেছেন। এবং সাহাবগণ একত্রে কোন বিষয়ে কোন রকম বিরোধীতা ব্যতিরেকে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন সেটাই সাহাবগণের সুন্নাত।

সাধারণ মানুষের সুন্নাত : সাধারণ মানুষের পূর্ব প্রচলিত রীতি পদ্ধতি ও ‘সুন্নাত’ নামে পরিচিত। যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন আমার দাদা হুজুর এ রকম চুল রাখতেন এবং আমাদেরকে চুল রাখতে বলতেন। এটা তার দাদা হুজুরের সুন্নাত (প্রচলিত রীতি) যেমন, ইসলাম গ্রহণের পূর্ব যুগের মানুষেরা তাদের দেবীর জন্য হজ্জের ইহরাম বাঁধত। এটা তাদের বাপ-দাদাদের ‘সুন্নাত’ ছিল। (মুসলিম হা/১২৭৭)।

মাওলানা আব্দুর রহিম (রহঃ) সুন্নাত সম্বন্ধে যেভাবে আলোচনা করেছেন অনুরূপই বলতে হয় (সুন্নাত ও বিদ’আত ১৪/১৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন): সুন্নাতের সেই অর্থ আলোচ্য নয়, যা হাদীস বিজ্ঞানীরা পরিভাষা হিসেবে গ্রহন করেছেন; সেই অর্থও নয়, যা ফিকাহ শাস্ত্রে গ্রহন করা হয়েছে।

হাদীস-বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় ‘সুন্নাত’ হচ্ছে রাসূলে করীম (ছাঃ) এর মুখের কথা, কাজ ও সমর্থন অনুমোদনের বর্ণনা-যাকে, প্রচলিত কথায় বলা হয় ‘হাদীস’। আর ফিকাহ শাস্ত্রে ‘সুন্নাত’ বলা হয় এমন কাজকে, যা ফরয বা ওয়াজিব নয় বটে; কিন্তু নবী করীম(ছাঃ) তা প্রায়ই করেছেন। এখানে দুটো সুন্নাতের কোনটিই আলোচ্য নয়। এখানে আলোচ্য হচ্ছে ‘সুন্নাত’ তার মূলগত অর্থের দিক দিয়ে যা মৌলিক আদর্শ রীতি-নীতি, পথ, পন্থা ও পদ্ধতি বোঝায়। বস্তুত এ হিসেবে সুন্নাত হলো সেই মূল আদর্শ, যা আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব-মানবের জন্যে নাযিল করেছেন, যা রাসূলে করীম (ছাঃ) নিজে তার বাস্তব জীবনে দ্বীনি দায়িত্ব পালনের বিশাল ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন; অনুসরণ করার জন্যে পেশ করেছেন দুনিয়ার মানুষের সামনে। মূল ইসলামেরই বিকল্প শব্দ হচ্ছে সুন্নাত, যা আমরা এখানে আলোচনা করছি। তার উৎস হলো ওহীÑ যা আল্লাহর নিকট থেকে তিনি লাভ করেছেন। এ ‘ওহী’ দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে, আল্লাহর জানিয়ে দেওয়া বিধান ও নির্দেশ। রাসূলে করীম (ছাঃ) এর বাস্তব কর্মজীবনে এ দুটোরই সমন্বয়, সেখানে এ সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটেছে পুরোপুরিভাবে। রাসূলের বাস্তব জীবন বিশ্লেষণ করলে এ সব কয়টিরই প্রকটভাবে সন্ধান লাভ করা যাবে। আর তাই হচ্ছে ‘সুন্নাত’, তাই হচ্ছে পরিপূর্ণ দ্বীন-ইসলাম। কোরআন মাজীদে রাসূলের এ বাস্তব জীবনের সত্যিকার রূপ সুস্পষ্ট করে তুলবার জন্যেই তাঁর জবানীতে বলা হয়েছেঃ আমি কোন আদর্শই অনুসরণ করি না; করি শুধু তাই যা আমার নিকট ওহীর সুত্রে নাযিল হয়।
ওহীর সুত্রে নাযিল হওয়ার আদর্শই রাসূলে করীম (ছাঃ) বাস্তব কাজে ও কর্মে অনুসরণ করেছেন, তা-ই হচ্ছে এই গ্রন্থের আলোচ্য ‘সুন্নাত’। এই সুন্নাতেরই অপর নাম ইসলাম।
কোরআন মাজীদে এই সুন্নাতকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূলের জবানীতে কোরআন মাজীদে ঘোষণা করা হয়েছে : নিশ্চয় এ হচ্ছে আমার সঠিক সরল দৃঢ় পথ। অতএব তোমরা এ পথই অনুসরণ করে চলবে, এ ছাড়া অন্যান্য পথের অনুসরণ তোমরা করবে না। তা করলে তা তোমাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দুরে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের এরূপ-ই নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা ভয় করে চলো। (সূরা আনআম-১৫৩)।
এ আয়াতে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলতে সেই জিনিসকেই বোঝানো হয়েছে, যা বোঝায় ‘সুন্নাত’ শব্দ থেকে।

সুন্নাত আমল করা কি আবশ্যক?

মুসলিম হওয়ার জন্য কুরআন মেনে চলা যেমন আব্যশক,তেমনি সুন্নাহ মেনে চলা অপরিহার্য। সুন্নাহকে বাদ দিয়ে কুরআন অনুসরন করা অসম্ভব।সুন্নাহকে উপেক্ষা করলে পরকালে কঠিন শাস্তির সন্মুখীন হতে হবে।
আল্লাহ বলেনঃহে ইমানদারগণ!তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর,আনুগত্য কর রাসূলের’(নিসা-৫৯)।

‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে,সে তো আল্লাহর আনুগত্য করলো’(নিসা-৮০)।
‘আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর,যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। (আল-ইমরান,১৩২)।
রাসূল (ছাঃ) বলেনঃ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ -এর আনুগত্য করলো,সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ -এর অবাধ্যতা করল,সে যেন আল্লাহরই অবাধ্যতা করল’।(বুখারী হা/৭২৮১)।
‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিল,সে আমার দলভুক্ত নয়’(বুখারী হা/৫০৬৩;মুসলিম হা/১৪০১)।
রাসূলের সুন্নাহ তথা সহীহ হাদীসের অনুসরনকে ওয়াজিব করে আল্লাহ কুরআনে অনূন্য ৪০ জায়গাতে বর্ণনা করেছে। (হাদীসের প্রামানিকতা পৃঃ৮)।

আক্বীদা আহকাম সকল বিষয়ে হাদীস হল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দানকারী (তদেব,পৃঃ১১)।
হাদীসের অনুসরন ব্যতিত ইসলামের অনুসরন কল্পনা করা যায় না। সুতারাং রাসূল আমাদের সামনে যে সুন্নাত পেশ করেছেন,তা কোনরুপ বিকৃত বা বিরোধিতা না করে,সঠিক ভাবে গ্রহণ করা ওয়াজিব। (আবূ নাফিজ লিলাবর আল বারাদি,আত তাহরীক)

মহান আল্লাহ বলেন,‘আর রাসূল তোমাদের যা দেন তা তোমরা তা গ্রহন কর এবং যা কিছু নিষেধ করেন ,তা থেকে বিরত থাকো’(হাশর-৭)
সুন্নাহ্র বিরোধিতা ও বিকৃত করা কুফরী (আল ইমরান-৩২)।
‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় (কুরআন -সুন্নাহ্) অস্বীকার করে,তার সকল শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’(মায়েদা-৫)।
বিশ্বাসের বিষয় কুরআরেন একটি আয়াত কিংবা সহীহ হাদীসের একটি অংশও কোনভাবেই অস্বীকার করাযাবেনা। আর যদি কেউ অস্বীকার করে কিংম্বা রদবদল করে পালন(আমল)করে,তবে সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এখানে (استقم)-এর ব্যাখ্যা হ’ল রাসূল (ছাঃ) যে সুষ্ঠু ও সঠিক মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন,তার মধ্যে বিন্দুমাএ হ্রাস-বৃদ্ধি বা পরিবর্ধন-পরিমার্জনকারী পথভ্রষ্ট হবে। তার নিয়ত যত ভালই হোক না কেন। তাছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার লক্ষ্যে আল্লাহ ও তার রাসূল যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার মধ্যে কোনরুপ কমতি বা গাফলতি মানুষকে যেমন ইস্তেকামাতের আর্দশ হ‘তে বিচ্যুত করে। অনুরুপভাবে তার মধ্যে নিজের পক্ষ হ‘তে বাড়াবাড়ি মানুষকে বিদ‘আতে লিপ্ত করে। যদিও সে মনে করে,আমি আল্লাহর সন্তষ্টি হাছিল করছি। অথচ ক্রমবায়ে--সে আল্লাহর বিরাগভাজন হ‘তে থাকে। (তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন,পৃঃ৬৪৫)।

সুন্নাতে সাহাবা কি আমাদের দলীল?

খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণের কথা বা কর্ম শরীয়তের দলীল বা অনুকরণীয় আদর্শ কি-না তা সে বিষয়ে ফকীহ ও ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। সকলেই একমত যে, যে ক্ষেত্রে কুরআন বা সুন্নাহতে নির্দেশনা রয়েছে, বা যেখানে স্পষ্ট সুন্নাতে নববী রয়েছে, সেখানে আর সাহাবীগণের সুন্নাত বা তাঁদের মতামত ও কর্ম বিবেচ্য নয়। কিন্তু যেখানে সুন্নাতে নববীর কোনো নির্দেশনা নেই সেখানে তাঁদেরকে অনুসরণ করা যাবে কিনা তা নিয়ে তাঁরা মতবিরোধ করেছেন। ইমাম শাফেঈ (২০৪ হিঃ) ও অন্যান্য কোনো কোনো ইমাম ও ফকীহ সাহাবীগণের কোনো কর্ম বা মতামতকে শরীয়তের দলীল হিসাবে গ্রহণ করতে ঘোর আপত্তি করেছেন। তাঁদের মতে শুধুমাত্র কুরআন কারীম ও সুন্নাতে রাসূল শরীয়তের দলীল। যেক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহতে কোনো বিধান নেই সেক্ষেত্রে এজমা বা প্রয়োজনে ক্বিয়াস শরীয়তের দললি হিসাবে বিবেচ্য হবে। সাহাবীগণের এজমা সর্বোত্তম এজমা হিসাবে গণ্য হবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো একবা একাধিক সাহাবীর কর্ম বা মতামত কোনো অবস্থাতেই অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হবে না। অনেক সাহাবীর কর্ম বা মত তো আমরা গ্রহণ করি না। যেমন, কোনো কোনো সাহাবী

রোযা অবস্থা বৃষ্টির সাথে বরফ বা ‘শিল’ খাওয়া জায়েয বলেছেন।

কেউ নগদ লেনদেন কম-বেশির সুদ জায়েয বলেছেন।

কেউ বা অস্থায়ী বিবাহ জায়েয বলেছেন। কাজেই, তাদের কর্ম সুন্নাত হবে কী-ভাবে?
যারা সাহাবীগণের কথা বা কর্মকে অনুকরণীয় আদর্শ মনে করেন ইমাম গাযালী (৫০৫ হিঃ) কঠোর ভাষায় তাঁদের সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন। তাঁর ও অন্যান্য শাফেঈ আলেমের দাবি হলো যে, সাহাবীগণ অন্যান্য মানুষের মতোই, তাঁদের ভুল হতে পারে, অজ্ঞতা থাকতে পারে। কাজেই, তাঁদেরকে অনুসরণীয় বা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। তাঁদের মতে যেখানে সুন্নাতে-নববী নেই সেখানে কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।

অপরদিকে ইমাম আবু হানীফা (১৫০ হিঃ), ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (২৪১ হিঃ), তাঁদের অনুসরণীয় ও অন্যান্য অনেক আলেমের মতে যে ক্ষেত্রে সুন্নাতে-নববীর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে সাহাবীগণ যদি ঐক্যমত পোষণ করেন, অথবা কোনো প্রতিবাদ না করেন তাহলে সাহাবীর মতামত বা কর্ম অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। তাঁরা বলেন যে, সাহাবীগণ ভুলের উর্ধে না হলেও কোরআন ও হাদীসে বারবার তাদের পরিপূর্ণ মর্যাদার কথা ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাঁদের অনুসরণ করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এই অনুসরণ শুধু সুন্নাতে নববীর অনুসরণের ক্ষেত্রেই নয়, সুন্নাতে নববীর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও। তাঁরা বলেন, যে ক্ষেত্রে সুন্নাতে নববীর কোনো নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে সাহাবীর মত বা কর্ম হয়তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)এর ব্যক্তিগত মতামতও হয় তাহলেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর সাহচার্য,আরব ভাষার পরিপুর্ণ জ্ঞান ও কোরআন-হাদীসের পটভূমি সার্বিকভাবে জানা থাকার ফলে তাঁর মতামত বিশুদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা পরবর্তী ইমামগণের মতামতের বিশুদ্ধতার সম্ভাবনা থেকে অনেক বেশি। কাজেই তাঁদের অনুসরণ করাই কর্তব্য। (আবু বকর সারাখসী, আল-মুহাররাব ফী উসুলিল ফিকহ ২/৮১-৯১, আবু হামেদ গাযালী (৫০৫ হিঃ) আল-মুসতাসফা ১/৬১৬-৬২৬, আলাউদ্দীন বুখারী (৭৩০ হিঃ) কাশফুল আসরার আন উসুলিল বাযদাবী, ৩/৪০৬-৪২২, মুহাম্মদ ইবনু হুসাইন আল-জিযানী, মাআলিমু উসুলিল ফিকহী, পৃঃ ২২২-২২৭)।

খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেই খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত বা রীতি প্রচলনের অধিকার প্রদান করেছেন।
এখন প্রশ্ন তাঁরা কি ইচ্ছামতো কোনো রীতি প্রচলন করতেন? কখনই নয়। আসলে তাঁরা কখনই তাঁর সুন্নাতের বাইরে চলেননি। আবু বকর (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রথম ভাষণ প্রদান কালে বলেন : ‘আমাকে আপনারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রদান করেছেন, যদিও আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম নই। তবে আল্লাহ কোরআন নাযিল করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) সুন্নাত প্রচলিত করে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা তা শিখে নিয়েছি।.. আপনারা জেনে রাখুন (---)আমি শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) -এর অনুসরণ করব, কোনো নব-উদ্ভাবন বা বিদ’আত রীতি প্রচলন করব না। আমি যদি ভালো করি তাহলে আমাকে সহযোগিতা করবেন। আর যদি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি তাহলে আমাকে সোজা করবেন। (ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ৩/১৩৬)।

কোন কাজ কেন করেছেন বা কেন বর্জন করেছেন তা তাঁরাই ভালো জানতেন। যেহেতু তাঁরা আজীবন ইন্তেকাল পর্যন্ত সদা সর্বদা তাঁর সাহচর্যে থেকেছেন, একান্ত কাছে থেকে তাঁর সকল আদেশ নিষেধ জেনেছেন, তাঁরই নূরে আলোকিত হয়েছেন, তাই তিনি যে কাজ বর্জন করেছেন তা প্রয়োজনে করার সুযোগ আছে কি-না, অথবা তিনি যা করেছেন তা প্রয়োজনে বর্জন করা যাবে কি-না তা তাঁরা সবচেয়ে ভালো বুঝতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)এর সুন্নাত বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের বিবেচনাই ছিল সর্বোত্তম। এজন্য রাসূলুল্লাহ বিশেষ করে তাঁদের সুন্নাত অনুসরণের কথা বলেছেন।

দ্বিতীয়ত: মুসলিম উমমাহর আল্লাহর পথে চলার, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সকল পথ,পদ্ধতি ও রীতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)শিখিয়ে গিয়েছেন। তবে স্বাভাবতই যুগে যুগে জাগতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে যা রাসূলুল্লাহ এর যুগে ছিল না। এ সকল সমস্যার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর শিক্ষার আলোকে কিভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে হবে তা আমরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত বা পদ্ধতি থেকে জানতে পারি। যুদ্ধ বিগ্রহ, রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজে শান্তিনিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধান, নতুন নতুন অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধ পদ্ধতি দমন করে শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন, ইবাদত বন্দেগী পালনের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি হলে তা অপসারিত করে রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাত অনুসারে ইবাদত বন্দেগী পালন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তাঁদের উম্মতের আদর্শ।

(ক) সুন্নাতু আবী বকর : ধর্মদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ, কোরআন সংকলন।

(খ) রাষ্ট্র পরিচালনা উমর (রাঃ) এর বিভিন্ন সুন্নাত।

(গ)উসমান ও আলী (রাঃ)এরসুন্নাত:কোরআন প্রচার, স্বরচিহৃ, আরবী ব্যকরণ।

(ঘ) জুম’আর সালাতের প্রথম আযান ইত্যাদি।

তৃতীয়: সুন্নাতে সাহাবা : পরিচিতি ও পরিধি

খুলাফায়ে রাশেদীন ছাড়াও সামগ্রিকভাবে সাহাবীগণের সুন্নাত আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ, যা ইতঃপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। যে কাজ রাসূলুল্লাহ করতে বলেছেন, বা করলে কোনো ফযীলত আছে বলে জানিয়েছেন, কিন্তু নিজে করেননি, সেক্ষেত্রে তাঁর বর্জনের কারন জানতে হবে এবং সাহাবীদের কর্মপদ্ধতির আলোকে তা বর্জন করাই সুন্নাত বলে গণ্য হবে। সাহাবীগণের মতামত, কর্ম বা অনুমোদনও সুন্নাত বলে গণ্য বিবেচিত হবে। সুন্নাত বোঝার ও সুন্নাতের অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন কারীম, সুন্নাতে নববী ও উম্মতের সকল অনুসরণীয় ইমাম ও আলেমের মত অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরামগণ সমষ্টিকভাবে সুন্নাত পালনের আদর্শ। তবে তাঁদের কেউ কেউ হয়ত কোনো কোনো সুন্নাত জানতেন না। সময় ও স্থানের দুরুত্বের কারণে অনেকে সবসময় তাঁর কাছে অবস্থান করতে পারেননি। পরে অন্যদের নিকট থেকে জেনেছেন বা জানেননি। কোনো বিষয়ে যদি রাসূলুল্লাহ এর কোনো সুন্নাত থাকে তাহলে সেখানে আর সাহাবীদের সুন্নাতের প্রয়োজন হয় না, গৃহীত হয় না। কারণ তাঁর সুন্নাতের মোকাবিলায় কারো মতামতই থাকে না। যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর সুন্নাতে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই, অথবা সুন্নাত বোঝার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রয়েছে সে ক্ষেত্রে সাহাবগণের সুন্নাত বা রীতি পদ্ধতি আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর সুন্নাত বুঝতে সাহায্য করবে। কোনো বিষয়ে একাধিক প্রকারের সুন্নাত বর্ণিত হলে তন্মধ্যে কোনো সুন্নাত মুনসূখ হয়েছে কিনা এ বিষয়ে জানতে সাহায্য করবে
(শাতেবী, আল-ইতিসাম ১/১১৬-১১৯)।

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...