প্রথমত: হযরত মুহাম্মদ সা:, হযরত ইবরাহীম আ: এবং হযরত নূহ আ: এর জীবনী থেকে বিষয়টি তুলে ধরা হলো :
সুরা তওবা: আয়াত নং : ৮৪, ব্যাখ্যা সহ :
﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰ أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِ ۖ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ﴾
৮৪) আর আগামীতে তাদের মধ্য থেকে কেউ মারা গেলে তার জানাযার নামাযও তুমি কখ্খনো পড়বে না৷ এবং কখনো তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না৷ কারণ তারা আল্লাহ ও তার রসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে ফাসেক অবস্থায়৷ ৮৮
৮৮ . তাবুক থেকে ফিরে আসার পর বেশী দিন যেতে না যেতেই মুনাফীক নেতা আবুদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেলো৷ তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান৷ তিনি নবী(সা) এর খেদমতে হাযির হয়ে কাফনে ব্যবহারের জন্য তাঁর কোর্তা চাইলেন ৷ তিনি অত্যন্ত উদার হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে কোর্তা দিয়ে দিলেন৷ তারপর আবদুল্লাহ তাঁকেই জানাযার নামায পড়াবার জন্য অনুরোধ করলেন৷ তিনি এ জন্যও তৈরী হয়ে গেলেন৷ হযরত উমর (রা) বারবার এ মর্মে আবেদন জানাতে লাগলেন -হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এমন ব্যক্তির জানাযার নামায পড়াবেন যে অমুক অমুক কাজ করেছে? কিন্তু তিনি তার এ সমস্ত কথা শুনে মুচকি হাসতে লাগলেন৷ তার অন্তরে শত্রু মিত্র সবার প্রতি যে করূনার ধারা প্রবাহিত ছিল তারি কারণে তিনি ইসলামের এ নিকৃষ্টতম শত্রুর মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেও ইতস্তত করলেন না৷ শেষে যখন, তিনি জানাযার নামায পড়াবার হুকুমে তাকে নামায পড়াবার জন্য দাঁড়িয়েই গেলেন, তখন এ আয়াতটি নাযিল হলো৷ এবং সরাসরি আল্লাহর হুকুমে তাঁকে জানাযা পড়ানো থেকে বিরত রাখা হলো৷ কারণ এ সময় মুনাফিকদের ব্যাপারে স্থায়ী নীতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, যে, মুসলমানদের সমাজে আর মুনাফিকদেরকে কোন প্রকারে শিকড় গেড়ে বসার সুযোগ দেয়া যাবে না এবং এমন কোন কাজ করা যাবে না যাতে এ দলটির সাহস বেড়ে যায়৷
এ থেকে শরীয়াতের এ বিষয়টি স্থিরকৃত হয়েছে যে,ফাসেক , অশ্লীল ও নৈতিকতা বিরোধী কাজকর্মের লিপ্ত ব্যক্তি এবং ফাসেক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির জানাযার নামায মুসলমানদের ইমাম ও নেতৃস্থানীয় লোকদের পড়ানো উচিত নয়৷ তাতে শরীক হওয়াও উচিত নয়৷ এ আয়াতগুলো নাযিল হবার পর নবী (সা) নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে কোন জানাযার শরীক হবার জন্য তাকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন৷ জিজ্ঞেস করতেন, সে কেমন ছিল৷ যদি জানতে পারতেন সে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পারো৷
====================================
সুরা হুদ: আয়াত নং : ৪৫-৪৮ : ব্যাখ্যা সহ :
﴿وَنَادَىٰ نُوحٌ رَّبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ﴾
৪৫) নূহ তার রবকে ডাকলো৷ বললো, “ হে আমার রব! আমার ছেলে আমার পরিবারভুক্ত এবং তোমার প্রতিশ্রুতি সত্য ৪৭ আর তুমি সমস্ত শাসকদের মধ্যে সবেচেয়ে বড় ও উত্তম শাসক৷” ৪৮
৪৮. অর্থাৎ তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এরপর আর কোন আবেদন নিবেদন খাটবে না৷ আর তুমি নির্ভেজাল জ্ঞান ও পূর্ণ ইনসাফের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকো৷
﴿قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ ۖ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ ۖ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۖ إِنِّي أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ﴾
৪৬) জবাবে বলা হলো, “হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়৷ সে তো অসৎ কর্মপরায়ণ৷ ৪৯ কাজেই তুমি আমার কাছে এমন বিষয়ের আবেদন করো না যার প্রকৃত তত্ত্ব তোমার জানা নেই৷ আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, নিজেকে অজ্ঞদের মতো বানিয়ে ফেলো না”৷৫০
৪৯. ব্যাপারটা ঠিক এ রকম, যেমন এক ব্যক্তির শরীরের কোন একটা অংশ পচে গেছে৷ ডাক্তার অংগটি কেটে ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ এখন রোগী ডাক্তারকে বলছে, এটা তো আমার শরীরের একটা অংশ, আপনি কেটে ফেলে দেবেন? ডাক্তার জবাবে বলেন, এটা তোমার শরীরের অংশ নয়৷ কারণ এটা পচে গেছে৷ এ জবাবের অর্থ কখনো এ নয় যে, প্রকৃতপক্ষে এ অংগটির শরীরের সাথে কোন সম্পর্ক নেই৷ বরং এর অর্থ হবে, তোমার শরীরের জন্য সুস্থ ও কার্যকর অংগের প্রয়োজন, পচা অংগের নয়৷ কারণ পচা অংগ একদিকে যেমন শরীরের কোন কাজে আসে না তেমনি অন্যদিকে বাদবাকি সমস্ত শরীরটাকেও নষ্ট করে দেয়৷ কাজেই যে অংগটি পচে গেছে সেটি আর এ অর্থে তোমার শরীরের কোন অংশ নয় যে অর্থে শরীরের সাথে অংগের সম্পর্কের প্রয়োজন হয়৷ ঠিক এমনিভাবেই একজন সৎ ও সত্যনিষ্ঠ পিতাকে যখন একথা বলা হয় যে, এ ছেলেটি তোমার পরিজনদের অন্তরভুক্ত নয়, কারণ চরিত্র ও কর্মের দিক দিয়ে সে ধ্বংস হয়ে গেছে তখন এর অর্থ এ হয় না যে, এর মাধ্যমে তার ছেলে হবার বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে বরং এর অর্থ এ হয় না যে, এর মাধ্যমে তার ছেলে হবার বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে বরং এর অর্থ শুধু এতটুকুই হয় যে, বিকৃত ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া লোক তোমার সৎ পরিবারের সদস্য হতে পারে না৷ সে তোমার রক্ত সম্পর্কীয় পরিবারের একজন সদস্য হতে পারে কিন্তু তোমার নৈতিক পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই৷ আর আজ যে বিষয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে সেটি বংশগত বা জাতি-গোষ্ঠীগত কোন বিরোধের ব্যাপার নয়৷ এক বংশের লোকদের রক্ষা করা হবে এবং অন্য বংশের লোকদের ধ্বংস করে দেয়া হবে, ব্যাপারটি এমন নয়৷ বরং এটি হচ্ছে কুফরী ও ঈমানের বিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার৷ এখানে শুধুমাত্র যারা সৎ তাদেরকে রক্ষা করা হবে এবং যারা অসৎ ও নষ্ট হয়ে গেছে তাদেরকে খতম করে দেয়া হবে৷
ছেলেকে অসৎকর্ম পরায়ণ বলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে৷ স্থুল দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা সন্তানকে ভালোবাসে ও লালন করে শুধু এজন্যে যে, তারা তাদের পেটে বা ঔরসে জন্ম নিয়েছে এবং তাদের সাথে তাদের রক্ত সম্পর্ক রয়েছে৷ তাদের সৎ বা অসৎ হওয়ার ব্যাপারটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ কিন্তু মুমিনের দৃষ্টি হতে হবে সত্যের প্রতি নিবদ্ধ৷ তাকে তো ছেলেমেয়েদেরকে এ দৃষ্টিতে দেখতে হবে যে, এরা আল্লাহর সৃষ্টি কতিপয় মানুষ৷ প্রাকৃতিক নিয়মে আল্লাহ এদেরকে তার হাতে সোপর্দ করেছেন৷ এদেরকে লালন-পালান করে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ দুনিয়ায় মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য তৈরী করতে হবে৷ এখন তার যাবতীয় পরিশ্রম ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও তার ঘরে জন্ম নেয়া কোন ব্যক্তি যদি সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য তৈরী হতে না পারে এবং যিনি তাকে মুমিন বাপের হাতে সোপর্দ করেছিলেন নিজের সেই রবেরই বিশ্বস্ত খাদেম হতে না পারে, তাহলে সেই বাপকে অবশ্যি বুঝতে হবে যে, তার সমস্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে৷ এরপর এ ধরনের ছেলে-মেয়েদের সাথে তার মানসিক যোগ থাকার কোন কারণই থাকতে পারে না৷
তারপর সংসারের সবচেয়ে প্রিয় ছেলেমেয়েদের ব্যাপারটি যখন এই তখন অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে মুমিনের দৃষ্টিভংগী যাকিছু হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ ঈমান একটি চিন্তাগত ও নৈতিক গুণ৷ এ গুণের প্রেক্ষিতেই মুমিনকে মুমিন বলা হয়৷ মুমিন হওয়ার দিক দিয়ে অন্য মানুষের সাথে তার নৈতিক ও ঈমানী সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্কই নেই৷ রক্ত-মাংসের সম্পর্কযুক্ত কেউ যদি তার সাথে এ গুণের ক্ষেত্রে সম্পর্কিত হয় তাহলে নিসন্দেহে সে তার আত্মীয়৷ কিন্তু যদি সে এ গুণ শূন্য হয় তাহলে মুমিন শুধুমাত্র রক্তমাংসের দিক দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক রাখবে৷ তার হৃদয় ও আত্মার সম্পর্ক তার সাথে হতে পারে না৷ আর ঈমান ও কুফরীর বিরোধের ক্ষেত্রে যদি সে তার মুখোমুখি দাঁড়ায় তাহলে এ অবস্থায় সে এবং একজন অপরিচিত কাফের তার চোখে সমান হয়ে দেখা দেবে৷
৫০. এ উক্তি দেখে কারো এ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, হযরত নূহের (আ) মধ্যে ঈমানী চেতনার অভাব ছিল অথবা তাঁর ঈমানে জাহেলিয়াতের কোন গন্ধ ছিল৷ আসল কথা হচ্ছে, নবীগণও মানুষ৷ আর মুমিনের পূর্ণতার জন্য যে সর্বোচ্চ মানদণ্ড কায়েম করা হয়েছে সর্বক্ষণ তার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করে থাকা কোন মানুষের সাধ্যায়াত্ত নয়৷ কোন কোন সময় কোন নাজুক মনস্থাত্বিক অবস্থায় নবীর মতো উচ্চ মর্যদাসম্পন্ন লোকও মুহূর্তকালের জন্য হলেও নিজের মানবিক দুর্বলতার কাছে পরাস্ত হন৷ কিন্তু যখনই তিনি অনুভব করেন অথবা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর মধ্যে এ অনুভূতি জাগানো হয় যে, তিনি কাংখিত মানের নিচে নেমে যাচ্ছেন তখনই তিনি তাওবা করেন এবং নিজের ভুলের সংশোধন করে নেবার ব্যাপারে এক মুহূর্তও ইতস্তত করেন না৷ হযরত নূহের নৈতিক উচ্চমানের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, জওয়ান ছেলেকে চোখের সমানে ডুবে যেতে দেখছেন! এ দৃশ্য দেখে তাঁর কলিজা ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছে৷ কিন্তু যখনই আল্লাহ সবাধান করে জানিয়ে দেন, যে ছেলে হককে ত্যাগ করে বাতিলের সহযোগী হয়েছে তাকে নিছক তোমার ঔরসজাত বলেই নিজের ছেলে মনে করা একটি জাহেলী ভাবাবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ তখনই তিনি নিজের মানসিক আঘাতের ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে ইসলামের কাংখিত চিন্তা ও ভাবধারার দিকে ফিরে আসেন৷
﴿قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ ۖ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ﴾
৪৭) নূহ তখনই বললো, “হে আমার রব! যে জিনিসের ব্যাপারে আমার জ্ঞান নেই তা তোমার কাছে চাইবো- এ থেকে আমি তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি৷ যদি তুমি আমাকে মাফ না করো এবং আমার প্রতি রহমত না করো তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাবো৷”৫১
৫১. নূহের ছেলের এ ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী প্রদ্ধতিতে তাঁর ইনসাফ যে কি পরিমাণ পক্ষপাতহীন এবং তাঁর ফায়সালা যে কত চূড়ান্ত হয়ে থাকে তা বলেছেন৷ মক্কার মুশরিকরা মনে করতো, আমরা যাই করি না কেন আমাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হতে পারে না৷ কারণ আমরা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আওলাদ এবং বড় বড় দেবদেবীর ভক্ত৷ ইহুদী ও খৃষ্টানরাও এমনি ধরনের কিছু ধারণা পোষণ করতো এবং এখনো পোষণ করে থাকে৷অনেক ভ্রষ্টাচারী মুসলমানও এ ধরনের কিছু মিথ্যা ধারণার ওপর নির্ভর করে বসে আছে৷ তারা মনে করে, আমরা অকুক বোজর্গের আওলাদ এবং অমুক বোজর্গের ভক্ত৷ কাজেই তাদের সুপারিশই আমাদের আল্লাহর শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবে৷ কিন্তু এখানে এর বিপরীতে যে দৃশ্য দেখানো হচ্ছে তা হচ্ছে এই যে, একজন মহান মর্যাদাশালী নবী নিজের চোখের সামনে নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে ডুবে যেতে দেখছেন এবং অস্থির হয়ে সন্তানের গোনাহ মাফ করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানাচ্ছেন৷ কিন্তু আল্লাহর দরবার থেকে জবাবে তাকে ধমক দেয়া হচ্ছে৷ বাপের পয়গম্বরীর মর্যাদাও ছেলেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারছে না৷
=======================
সুরা তওবা: আয়াত নং: ১১৪ : ব্যাখ্যা সহ :
﴿وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ ۚ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ﴾
১১৪) ইবরাহীম তার বাপের জন্য যে মাগফিরাতের দোয়া করেছিল তা তো সেই ওয়াদার কারণে ছিল যা সে তার বাপের সাথে করেছিল্ ১১২ কিন্তু যখন তার কাছে একথা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, তার বাপ আল্লাহর দুশমন তখন সে তার প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে৷ যথার্থই ইবরাহীম কোমল হৃদয়, আল্লাহভীরু ও ধৈর্যশীল ছিল৷ ১১৩
১১২ . হযরত ইবরাহীম তার মুশরিক পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় যে কথা বলেছিলেন সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে ৷ তিনি বলেছিলেনঃ
আপনার প্রতি সালাম, আপনার জন্য আমি আমার রবের কাছে দোয়া করবো যেন তিনি আপনাকে মাফ করে দেন৷ তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান৷ (মারয়ামঃ ৪৭ )
তিনি আরো বলেছিলেনঃ
আমি আপনার জন্য অবশি ক্ষমা চাইবো৷ তবে আপনাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই৷ (আল মুমতাহিনাঃ ৪)
উপরক্ত ওয়াদার ভিত্তিতে তিনি নিজের পিতার জন্য এ দোয়া করেছিলেনঃ
আর আমার পিতাকে মাফ করে দাও, তিনি পথভ্রষ্টদের অন্তরভুক্ত ছিলেন৷ আর যেদিন সকল মানুষকে উঠানো হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না৷ যেদিন ধনসম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি কারোর কোন কাজে লাগবে না৷ একমাত্র সেই নাজাত পাবে , যে আল্লাহর সামনে হাযির হবে বিদ্রোহমুক্ত হৃদয় নিয়ে৷ (আশ শুআরাঃ ৮৬-৮৯)
এ দোয়া তো প্রথমত অত্যন্ত সতর্ক ও সংযত ভাষায় করা হয়েছিল৷ কিন্তু পরক্ষনেরই হযরত ইবরাহীম চিন্তা করলেন যে, তিনি যে ব্যক্তির জন্য দোয়া করেছেন সে তো ছিল প্রকাশ্য আল্লাহদ্রোহী এবং আল্লাহর দীনের ঘোরতর শত্রু তখন তিনি এ থেকে বিরত হলেন এবং একজন যথার্থ বিশ্বস্ত মুমিনের মত বিদ্রোহীর প্রতি সহানুভূতি দেখানো থেকে পরিষ্কারভাবে সরে দাঁড়লেন৷ অথচ এ বিদ্রোহী ছিল তার পিতা ,যে এক সময় স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে লালন পালন করেছিল৷
১১৩ . মূলে -----(আওওয়াহুন) ও --------(হালীমুন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ আওওয়াহুন মানে হচ্ছে, যে অনেক বেশী হা -হুতাশ করে, কান্নাকাটি করে, ভয় পায় ও আক্ষেপ করে ৷ আর হালীম এমন ব্যক্তিকে বলা হয় , যে নিজের মেজায সংযত রাখে, রাগে, শত্রুতায় ও বিরোধিতায় বেসামাল আচরণ করে না এবং অন্যদিকে ভালবাসায়, বন্ধুত্বের ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে যায় না৷এখানে এ শব্দ দুটি দ্বিবিধ অর্থ প্রকাশ করছে৷ হযরত ইবরাহীম (আ) তার পিতার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করেছেন ৷ কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল হৃদয় বৃত্তির অধিকারী৷ তার পিতা জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হবে, একথা ভেবে তিনি কেঁপে উঠেছিলেন৷ আবার তিনি ছিলেন "হালিম" -সংযমী ও ধৈর্যশীল৷ তার পিতা ইসলামের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে বাধা দেবার জন্য তার ওপর যে জুলুম নির্যাতন চালিয়েছিল তা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে পিতার জন্য দোয়া বের হয়ে গিয়েছিল৷ তারপর তিনি দেখলেন , তাঁর পিতা আল্লাহর দুশমন ,তাই তিনি তার থেকে নিজেকে দায়মুক্ত করে নিলেন ৷ কারণ তিনি আল্লাহকে ভয় করতেন এবং কারোর প্রতি ভালোবাসায় সীমা অতিক্রম করতেন না৷
========================
১। কোন অমুসলিম মারা গেলে সে জাহান্নামে যাবে না জান্নাতে যাবে এ জাতীয় আলাপ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। কোনো মানুষ জাহান্নামে যাবে যা জান্নাতে যাবে এই ব্যাপারটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত, এই ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা। আমরা যাকে কুফরী করে মারা যাতে দেখছি সে হয়ত মরার আগে তাওবা করেছিলো, আবার আমরা যাকে ফেরেশতার মতো মনে করি সে হয়তো ভেতরে ভেতরে মুনাফিক ছিলো! কাজেই, এই কথা আমরা বলতে পারবো যে আমাদের জানা মতে অমুক লোক অমুসলিম (কাফের) হিসাবে মারা গেছে, কিন্তু কোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে আমরা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারবো না সে জান্নাতী বা জাহান্নামী হবে।
২। যে মারা গেছে সে ভালো কাজ করে থাকলে আমরা তার সেই কাজগুলোর প্রশংসা করবো। যেমন, রাসূলুল্লাহ(সা) এর গোত্র বনু হাশিমকে যখন কুরাইশের অন্যান্য গোত্র বয়কট করেছিলো তখন মুতিম ইবনে ‘আদি কাফের হওয়া সত্ত্বেও খাবার সরবরাহ করে মুসলিমদের সাহায্য করেছিলেন। আর তাই, বদর-যুদ্ধে বিজয়ের পর কুরাইশী যুদ্ধবন্দীদের সামনে রেখে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছিলেন, ‘আজ যদি মুতিম বেঁচে থাকতো আর এই নোংরা লোকগুলোর জন্য সুপারিশ করতো, আমি অবশ্যই তার কারণে এদেরকে মাফ করে দিতাম’। (বুখারী ৫/৫৯/৩৫৮)
৩। অমুসলিমের ভালো কাজগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যাবে, তার ভালো উপদেশগুলো গ্রহণ করা যাবে। রাসূলুল্লাহ(সা) আবু হুরাইরাকে শিক্ষা দিয়েছেন যে সত্য কথা এমনকি শয়তান বললেও গ্রহণ করা যাবে।
৪। মৃত মানুষের কোন রকম বদনাম করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: মৃতদের গালাগাল কোরো না, তারা তাদের কর্মের কাছে পৌঁছে গেছে।
৫। সফলতা মানে কোটি টাকা কামাই করা নয়, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নয়। ইসলামী বিশ্বাস মতে একজন মানুষের জীবন ব্যর্থ হবে যদি সে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ না করে থাকে (অর্থাৎ মুসলিম না হয়ে থাকে)। আর, সেই ব্যক্তি সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন যার মধ্যে তাকওয়া (আল্লাহভীরুতা) সবচেয়ে বেশী (সূরা হুজুরাত:১৩)।
৬। অমুসলিমের মৃত্যুতে তার জন্য দু’আ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ(সা) তাঁর চাচা (আবু তালিব) এবং এমনকি তার মা এর জন্যও দু’আ করার অনুমতি পান নাই।
ওদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনো ওর ওপর (জানাজার) নামাজ পড়বে না এবং ওর কবরের পাশে দাঁড়াবে না। ওরা তো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল, আর অবাধ্য অবস্থাতেই ওদের মৃত্যু হয়েছে। (সূরা তাওবা:৮৪)
তুমি ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো বা না করো একই কথা, তুমি সত্তরবার (অর্থাৎ অসংখ্যবার) ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ্ ওদেরকে কখনোই ক্ষমা করবেন না। এ এজন্য যে, ওরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ্ অবাধ্য সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। - (সূরা তাওবা:৮০)
৭। অমুসলিমের মৃত্যুতে RIP বলা যাবে না। RIP অর্থ হলো Rest In Peace, যার মানে দাড়ায় মৃত ব্যক্তির জন্য শান্তি কামনা করা। কিন্তু, ইসলামে অমুসলিমের মৃত্যুর পর তার জন্য শান্তি কামনা করা ও দু’আ করা নিষেধ। তবে, সে বেঁচে থাকতে তার হেদায়েতের জন্য দু’আ করা যাবে।
=====================
অমুসলিম অবস্থায় মারা গেলে তার জন্য দোয়া করা যায় কিনা?
জিজ্ঞাসা–১০০: আমার পরিচিত একব্যক্তি আমেরিকায় থাকে। সেখানে এক অমুসলিম মেয়ে বিয়ে করেছিল। কিছুদিন আগে ঐ দেশের হাসপাতালে মেয়েটি মারা যায়। লোকটি দেশে আসার পর মহল্লার মসজিদে স্ত্রীর জন্য দোয়ার আয়োজন করে। প্রশ্ন হল,অমুসলিম অবস্থায় মারা গেলে তার জন্য এরকম দোয়ার আয়োজন করা জায়েয আছে কিনা?–tareqbdz@gmail.com
জবাব: কোনো ব্যক্তি অমুসলিম অবস্থায় মারা গেলে তার জন্য এরকম দোয়ার আয়োজন করা নাজায়েয। আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا كَانَ لِلنَّبِیِّ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْ یَّسْتَغْفِرُوْا لِلْمُشْرِكِیْنَ وَ لَوْ كَانُوْۤا اُولِیْ قُرْبٰی مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمْ اَنَّهُمْ اَصْحٰبُ الْجَحِیْمِ
“নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের পক্ষে মুশরিকদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা সংগত নয়, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন হলেই বা কি এসে যায়, যখন একথা সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামেরই উপযুক্ত।”(সূরা আত তওবা : ১১৩)
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
===========================
প্রশ্ন : অমুসলিমদের জন্য দুনিয়ার বিষয়ে কল্যাণের দোয়া করা কি জায়েজ?
উত্তর : অমুসলিমদের জন্য ইমানদার ব্যক্তি দোয়া করবে তাদের হেদায়েতের জন্য; দুনিয়ার বিষয়ে কল্যাণের জন্য নয়। দুনিয়ার কল্যাণের বিষয়ে তারা ভালো জানে। আল্লাহ অমুসলিমদের উদ্দেশে কোরআনুল কারিমের মধ্যে বলেছেন, ‘তোমরা দুনিয়ার জীবনকেই বেশি প্রাধান্য দাও।’ ফলে অমুসলিম-কাফের যারা রয়েছে, তাদের কাছে দুনিয়ার বিষয়ই হলো মূল লক্ষ্য। তাদের জন্য যে দোয়া করা উত্তম সেটা হলো, তাদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে পারেন। কিন্তু তাদের জন্য মৃত্যুর পর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা জায়েজ নেই।
( ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।)
No comments:
Post a Comment