প্রশ্ন: ১৮৫ : সুদ খাওয়ার শাস্তি ।

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম : সুদকে আরবিতে রিবা, ইংরেজীতে Interest বলা হয়। একই জাতীয় বস্তু পরস্পর বিনিময়ের মাধ্যমে কমবেশী  আদান প্রদান করাকে পরিভাষায় সুদ বলে। হারাম ও অবৈধ পন্থায় সম্পদ বৃদ্ধির জঘন্যতম পন্থা হল সুদ। উহা শোষণের ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার। তা এমন এক ব্যাধি যা ব্যক্তি ও সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। সাতটি আয়াতে এবং চল্লিশটি হাদীসে সুদের আলোচনা করা হয়েছে। সুদ দেশ ও জাতিকে জালের ন্যায় আবদ্ধ করে ফেলেছে। আমাদের অর্থনীতির চাকা যেন সুদ ছাড়া অচল।
সুদ হারাম : আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন (সূরা আল বাকারা- ২৭৫)।
সুদখোর  মাতাল হয়ে হাশরে উঠবে : আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন যারা সুদ খায় তারা ঐ ব্যক্তির ন্যায় (হাশরের ময়দানে) দাঁড়াবে, যাকে শয়তান র্স্পশ করে পাগল করে দেয়। এটা  এ জন্যে যে তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদেরই মত (সূরা আল বাকারা-২৭৫)।
সুদ হালাল জীবিকা গ্রহণের অন্তরায় : আল্লাহ তা’য়ালা চান মু’মিনগণ হালাল জীবিকা গ্রহণ করুক। তাই আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী থেকে আহার্য গ্রহণ কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি (সূরা: বাকার আয়াত: ১৭২)। অনত্র ইরশাদ করেছেন, হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার্য গ্রহণ কর এবং সৎকর্ম কর (সূরা: মু’মিনুন- ৫১)। সুদ হালাল উপায়ে জীবিকা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। মানুষকে অসৎ পথে অর্থ উপার্জনে উদ্বুদ্ধ করে।
সুদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহর যুদ্ধ : আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- অতঃপর তোমরা যদি তা (বকেয়া সুদ) না ছাড়, তবে জেনে রেখ এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না (সুরা আল বাকারা-২৭৯)।
সুদ খাওয়া মু’মিনের কাজ নয় : মু’মিন আদৌ সুদখোর হতে পারে না। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- হে বিশ্বাসীগণ!  তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা প্রাকৃত বিশ্বাসী হয়ে থাক (সূরা আল বাকারা-২৭৮)।
সুদখোর জাহান্নামী : সুদখোর চির জাহান্নামী হবে। আল্লাহ তা’য়ালার বাণী- আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে (সূরা আল বাকারা-২৭৫)।
সুদের দ্বারা মূলত সম্পদ বাড়ে না : সুদ খাওয়ার দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি পায় না; বরং কমে। আল্লাহর বাণী- আল্লাহ সুদকে কমিয়ে দেন এবং দান-খয়রাতকে বড়িয়ে দেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে পছন্দ করেন না (সূরা আল বাকারা-২৭৬)। আরো ইরশাদ করেন- তোমরা  যে সুদ দিয়ে থাক, যাতে মানুষের মালের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা মোটেও বাড়ে না (সূরা রূম-৩৯)। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স:) বলেন- সুদের অর্থ জমা করার পরিণাম হচ্ছে অসচ্ছলতা। অপর র্বণনায় রয়েছে সুদের অর্থ যতই অধিক হোক না কেন অবশেষে তার পরিণতি হয় অসচ্ছলতা (তারগীব ও তারহীব, ইবন মাজাহ, হাকিম)।
সুদখোর অভিশপ্ত : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (র) হতে বর্ণিত, নিশ্চয়ই মহা নবী (স) সুদখোর, সুদ দাতা, সুদী কারবারের সাক্ষী এবং সুদের চুক্তি লেখক সকলকে ভৎর্সনা করেছেন।
সুদের এক টাকা ছত্রিশবার ব্যভিচারের চেয়ে মারাত্মক : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (গাসিলুল মালাইকা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন মহানবী (স) বলেছেন- কোন ব্যক্তির সুদের একটি টাকা খাওয়া তার ছত্রিশবার ব্যভিচার করা অপেক্ষাও জঘন্য অপরাধ (মুসনাদ আহমদ,মিশকাত- পৃ.২৪৫-২৪৬)।
সুদখোরের পেট হবে গৃহের ন্যায় : সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- মিরাজের সময় আমি এমন একদল লোকের নিকট পৌঁছলাম যাদের পেটগুলো ছিল গৃহের ন্যায় বড়। আর পেট গুলোর ভিতরে বহু সর্প বিদ্যমান যা বাইরে থেকে দৃশ্যমান। আমি বললাম, হে জিবরাঈল এরা কারা? তিনি বলেন- এরা হলো সুদখোর (মুসনাদ আহমদ, ইবন মাজাহ, মিশকাত-পৃ.২৪৬)
সুদের নিম্নতম গুনাহ স্বীয় মাকে বিবাহ করা : হযরত আবু হুরায়রা (র) থেকে বণিত, তিনি  বলেন-রাসুলুুল্লাহ (স) বলেছেন, সুদের রয়েছে সওর প্রকার গুনাহ। তন্মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ হলো স্বীয় মাকে বিবাহ করা। (ইবন মাজাহ- হাদীস নং-২২৬৫)
সুদী নিজেকে আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত করে : মহানবী (স) বলেছেন- কোন সম্প্রদায়ে যখন সুদ ও ব্যভিচার প্রকাশ্যে ঘটতে থাকে তখন তারা নিজেদেরকে আল্লাহ তা’য়ালার আজাবের উপযুক্ত করে নেয় (মুসনাদ আহমদ- হাদীস নং-৩৬১৮)। হযরত আবু ইয়ালা ও হাকেম (র) হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, মহানবী (স) বলেছেন- যখন কোন জাতি ব্যভিচার ও সুদে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে ধ্বংস করার অনুমতি দেন।
সুদের ফলে পাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় : মহানবী (স) বলেছেন- কোন সমাজে সুদের প্রচলন বৃদ্ধি পেলে  সে সমাজে পাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় (বায্যায, ইবন মাজাহ, বায়হাকী, হাকেম)।
সুদখোর রক্তের নদীতে সাতাঁর কাটবে : রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- সুদখোর মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত রক্তে পরিপূর্ণ নদীতে সাতাঁর কেটে কেটে আযাব ভোগ করতে থাকবে এবং  তাকে পাথর ভক্ষণ করানো হবে। ঐ নদী হচ্ছে তার দুনিয়ার উপার্জিত হারাম সম্পদ, যার মধ্যে তাকে হাবুডুবু খেতে বাধ্য করা হবে (সহীহ আল বুখারী)। রাসূলুল্লাহ (সা) একদা স্বপ্নে দু’জন ফেরেশতার সাথে জান্নাত জাহান্নাম দেখেছেন, জাহান্নামে বিভিন্ন অপরাধীদেও শাস্তির ধরণ অবলোকন করেছেন। তিনি জনৈক ব্যক্তি রক্তের নদীতে সাতাঁর কাটছে, নদীর তীরে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন ব্যক্তি। লোকটি সাঁতার কাটতে কাটতে যখনই কিনারে আসছে, তখনই তীরে দন্ডায়মান লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে। তখন সে পূর্বের স্থানে মাঝ নদীতে চলে যাচ্ছে। এভাবে সে নদী থেকে যখনই বের হতে চাচ্ছে, তখনই পাথর মেরে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নদীর মধ্যকার লোকটি হচ্ছে সুদখোর (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।
সুদখোর জান্নাতে প্রবেশ করবেনা : মহানবী (স) বলেছেন- চার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করতে না দেয়া এবং জান্নাতের নিয়ামত ভোগ করতে না দেয়া আল্লাহ তা’য়ালা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন। তারা হলো মদখোর, সুদখোর, ইয়াতীমের মাল আত্মসাতকারী ও পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, যতক্ষণ না তারা তাওবাহ করে।
সর্বনাশা সাতটি গুনাহের মধ্যে একটি সুদ : মহানবী (স) বলেছেন- সাতটি গুনাহ হলো সর্বনাশা। তা হলো- ১. আল্লাহর সাথে শিরক করা। ২. যাদু করা। ৩. অন্যায়ভাবে হত্যা করা। ৪. সুদ খাওয়া। ৫. ইয়াতীমের মাল অন্যায় ভাবে ভক্ষণ করা। ৬. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা। ৭. পূত-পবিত্রা নারীর প্রতি ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ দেয়া (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং-৪৬)
সুদখোরের দোয়া কবুল হয় না : মহানবী (সা) বলেছেন- যে দীর্ঘ সফর করে এলুকেশ ও ধূলাময় পোশাক নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ডাকতে থাকে হে আমার প্রতিপালক! হে রব! অথচ সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের পোশাক পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় তার দোয়া কি করে হতে পারে? (সহীহ মুসলিম)। সুদ থেকে বেঁচে থাকা সকল মু’মিনের অপরিহার্য কর্তব্য। কারণ, সুদের পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ ও ভয়ংকর। হে আল্লাহ! আমাদেরকে এ জঘন্য পাপ থেকে বাঁচার তৌফিক দান করুন।
লেখক : প্রধান মুফতি, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী।

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...