উত্তর : এটি আরবী বাক রীতির অংশ। সেখানে এক ব্যক্তি ‘আমি’ বলে। মহান অর্থে ‘আমি’র জায়গায় ‘আমরা’ও বলে। এটা কেবল কোরআন শরীফে নয়, আরবী সাহিত্যে প্রচুর দেখা যায়। যেমন, একজনকে বলা হয় ‘আলাইকা’ কিন্তু আমরা সালামের সময় বলি ‘আলাইকুম’। যার অর্থ ‘আপনাদের ওপর’। বাংলায় তরজমার সময় কোরআনের আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই করা কর্তব্য। যেখানে আল্লাহ নিজেকে ‘আমি’ বলেছেন, সেখানে আমি। যেখানে ‘আমরা’ বলেছেন, সেখানে ‘আমরা’ বলাই শুদ্ধ। এই ‘আমরা’ বহু বচনের জন্য নয়। মহত্বের জন্য।
সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।
উত্তর দিয়েছেন : আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী
================
উত্তর দিয়েছেন : আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী
================
প্রশ্নঃ আমরা জানি আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় । কিন্তু 'পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর শানে 'আমরা' ব্যবহার করা হয়েছে । এর কারণ কী ?
উত্তরঃ মনগড়াভাবে কুরআনের কোন শব্দ বা আয়াতের অর্থ করা যাবে না । ইমাম রাযীন বলেছেন, যে ব্যক্তি তার নিজ মতামত দ্বারা কুরআনের ব্যাপারে কিছু বলে ভুল করল, সে কুফরী করল ।
একদা আবুবকর (রাঃ)-কে একটি অক্ষরের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'যদি কিতাবুল্লাহর একটি অক্ষরের ব্যাপারে এরূপ কথা বলি যেরূপ আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না, তাহলে কোন্ আসমান আমাকে ছায়া দিবে, কোন যমীন আমাকে বিশ্রামের স্থান দিবে? আমি কোথায় যাবো আর কী করবো ? (বিস্তারিত,তাফসীর কুরতুবী মুকাদ্দামা) ।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ স্বীয় সম্মান-মর্যাদা বুঝানোর জন্য এরূপ বহুবচন শব্দ (নাহনু-আমরা) ব্যবহার করেছেন । সেকারণে 'নবীদের কাহিনী' বইয়ে সংশ্লিষ্ট আয়াতে যেখানে বহুবচনের শব্দ এসেছে সেখানে বহু বচনেরই অর্থ করা হয়েছে । মূলতঃ আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব বুঝানের জন্যই বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে । যেটা ভাষার অলংকারের মধ্যেও পড়ে । [from Monthly At-Tahreek, june-2010]
================
প্রশ্ন : (ক) কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য কোথাও সীগায়ে ওয়াহিদ (একবচন) ব্যবহার করেছেন আবার কোথাও সীগায়ে জমা (বহুবচন) ব্যবহার করেছেন। আবার কোথাও একই আয়াতে সীগায়ে ওয়াহিদ ও জমা উভয়টি ব্যবহার করেছেন। যেমন
فَذَرْنِي وَمَنْ يُكَذِّبُ بِهَذَا الْحَدِيثِ سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ ، وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ (القلم : 44)
তো আল্লাহ তাআলার জন্য ব্যবহৃত সীগায়ে ওয়াহিদ ও জমা-এর বাংলা অনুবাদে আমরা সাধারণত কোনো পার্থক্য করি না; বরং সর্বাবস্থায় সীগায়ে ওয়াহিদ দ্বারাই অনুবাদ করে থাকি।
আরবী আদব ও তাফসীরের সাথে মুনাসাবাত রাখেন এমন একজন আলেমের জোরালো দাবি হচ্ছে, ‘আলোচ্য ক্ষেত্রসমূহেও তরজমায় ওয়াহিদ ও জমার পার্থক্য করা জরুরি। অন্যথায় তা হবে কুরআনে কারীমের বালাগাত পরিপন্থী এবং তাহরীফে মা‘নবীর সূক্ষ্ম একটি প্রকার’।
তিনি বলেন, ফার্সী, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় রচিত কুরআনুল কারীমের তরজমাগুলোতে এ ধরনের স্থানেও ওয়াহিদ ও জমার পার্থক্য করা হয়েছে। কিন্তু বাংলা তরজমাগুলোতে এই পার্থক্যটা করা হয়নি। তবে ব্যতিক্রম হল, ইংরেজি তরজমা থেকে যারা বাংলা অনুবাদ করেছেন, তারা অবশ্য উপরোক্ত পার্থক্য রক্ষা করেছেন।
অতএব নিমেণাক্ত প্রশ্ন দুটির বিসত্মারিত উত্তর জানানোর জন্য বিশেষভাবে আবেদন করছি।
(ক) কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধে জমার সীগা ব্যবহারের হেকমত কী?
(খ) আরবী ও বাংলা সাহিত্য অনুসারে এবং তরজমাতুল কুরআনের উসূল মোতাবেক এ ধরনের জমার সীগার বাংলা তরজমা কী হওয়া উচিত? এবং এ বিষয়ে ঐ আলেমের বক্তব্য কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
উত্তর: আল্লাহ তাআলার কালাম কুরআনুল কারীমের ভাষা হচ্ছে খাঁটি ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : وهذا لسان عربي مبين (আর এটা সুস্পষ্ট আরবী ভাষা)। অর্থাৎ এই আরবী কুরআনের ভাষা হল, আরবী ভাষার অনন্য সাধারণ বাকরীতিসম্মত এবং আরবীর অনুপম অলংকার ও সাহিত্যগুণসম্পন্ন।
সুতরাং কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলার শানে যে ‘যমীরে মুতাকালিস্নম’ বা বক্তাপক্ষের[1] কোথাও একবচনের সর্বনাম, কোথাও বহুবচনের সর্বনাম এবং কোথাও পাশাপাশি একবচন ও বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার হয়েছে, তা আরবী বাকরীতি ও অলংকারসম্মত হবে বৈকি। আল্লাহ তাআলা সব দিক থেকে এক অদ্বিতীয় ও ‘লা-শারীক’-এই বিবেচনায় তাঁর সম্বন্ধে একবচনের সর্বনাম ব্যবহার হতে পারে। আবার আল্লাহ তাআলা হলেন মহামহিম, সার্বভৌমত্বের মালিক এবং সকল গুণাবলীর আধার- এই মহিমা ও গুণাবলীর বহুত্ব বরং অসীমতা ও অপরিমেয়তার বিবেচনায় তাঁর সম্বন্ধে বহুবচনের যমীর ও সর্বনাম ব্যবহার হতে পারে।
আরবী ভাষায় কোনো মহান ও সম্মানিত ব্যক্তির জন্য বহুবচনের ব্যবহার সুপরিচিত। এটিকে সম্মানার্থে বহুবচন বলা হয়।বরং এটিকে অনেক আরবী ভাষাবিদ ‘বহুবচন’ না বলে ‘মহিমাজ্ঞাপক একবচনের সর্বনাম’ বলেছেন। তাঁদের ভাষায় এর নাম হলো: ضمير العظمة، نون العظمة، ضمير المتكلم المعظم نفسه، ضمير المتكلم الواحد المطاع، لفظ المتكلم المطاع ইত্যাদি। [2]
ফার্সি-উর্দু-হিন্দীতে কি সাহিত্যের ভাষা, কি কথ্য ভাষা উভয়টাতেই সমানভাবে বক্তাপক্ষ ও শ্রোতাপক্ষের সর্বনামে সম্মানার্থে বহুবচনের প্রয়োগ সুপ্রচলিত। এছাড়া উর্দূ-হিন্দীতে ‘আপ’এই বিশেষ সর্বনামটি সম্মানার্থে শ্রোতা ও অন্যপক্ষের জন্যে ব্যবহার হয়ে থাকে। এসব ভাষাভাষী এবং এসব ভাষার সাথে পরিচিত যে কোনো ব্যক্তিই এ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, এসব ভাষার যে কোনো অভিধান ও ব্যাকরণগ্রন্থেই এ বিষয়টির উলেস্নখ পাওয়া যাবে। নমুনাস্বরূপ দেখা যেতে পারে : ‘ফীরুযুল লুগাহ’ (‘হাম’ ও ‘তোম’ শব্দ দুটি) এবং ‘উর্দু ছারফ ও নাহব’, বাবায়ে উর্দু, ড. আব্দুল হক, উর্দু একাডেমী, করাচি (যমীরের আলোচনা)।
পক্ষান্তরে আমাদের আধুনিক বাংলা ভাষায় সম্মানার্থে বহুবচনের ব্যবহার অজ্ঞাত। এ ছাড়া বাংলা ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য হল, এতে ক্রিয়া ও সর্বনামের সাধারণ, অন্তরঙ্গ বা তুচ্ছতাবোধক এবং গৌরববাচক বিশেষরূপ রয়েছে। যথা : মধ্যম ও প্রথম পুরুষে বলা হয়: তুই চলিস, তুমি চল, আপনি চলেন, সে চলে, তিনি চলেন। (ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৪৩০)
আর বক্তাপক্ষে একবচনের ‘আমি’ সর্বনামটি সাধারণরূপ। সকলেই নিজের সম্বন্ধে এটি ব্যবহার করতে পারেন, তবে মৌলিকভাবে ‘আমি’ সর্বনামটি মান্যার্থে ব্যবহৃত এবং ‘মুই’ সর্বনামটি তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত। (দ্রষ্টব্য : বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ পৃ. ৭৫)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন: ‘মুই’ এককালে উত্তমপুরুষ সর্বনামের সাধারণ ব্যবহারে প্রচলিত ছিল, প্রাচীন কাব্যগ্রন্থে তা দেখতে পাই। ‘আমহি’ ক্রমশ ‘আমি’ রূপ ধরে ওকে করল কোণঠাসা, ও রইল গ্রাম্য ভাষার আড়ালে। সেকালের সাহিত্যে ওকে দেখা গেছে দীনতা প্রকাশের কাজে। যেমন মুঞি অতি অভাগিনী। নিজের প্রতি অবজ্ঞা স্বাভাবিক নয় তাই ওকে সংকোচে সরে দাঁড়াতে হল। কিন্তু মধ্যম পুরুষের বেলায় যথাস্থানে কুণ্ঠার কোনো কারণ নেই, তাই ‘তুই’ শব্দে বাধা ঘটেনি, নীচের বেঞ্চিতে ও রয়ে গেল।’ ‘তুহিঁ’ ‘তুমি’ রূপে ভর্তি হয়েছে উপরের কোঠায়। এরও গৌরবার্থ অনেকখানি ক্ষয়ে গেল, বোধ করি নির্বিচার সৌজন্যের আতিশয্যে। তাই উপরওয়ালাদের জন্যে আরও একটা শব্দের আমদানি করতে হয়েছে, ‘আপহিঁ’ থেকে ‘আপনি’। (দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষার পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরিচ্ছেদ-১৪)
মজার বিষয় হল, বাংলা ভাষায় সম্মানসূচক উপরোক্ত সর্বনামগুলো ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে গৌরবে বহুবচন থেকেই উৎপন্ন। ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের প্রখ্যাত পন্ডিত ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন- একবচনের রূপ ‘তুই’ তুচ্ছতাবোধক হইয়া দাঁড়ালে বহুবচনের ‘তুমি’ গৌরবে বা আদরে একবচনের রূপ ধারণ করে। তদনন্তর ‘তুমি’-এর নূতন বহুবচনের রূপ ‘তোমরা’ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়। ‘তুই-মুই করা’- এই বাক্যে ‘তুই মুই’ পদদ্বয়ের দ্বারা তুচ্ছতা বা অসম্মানজ্ঞাপক প্রয়োগের কথা সূচিত হইতেছে। (দ্রষ্টব্য : ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ২৭৭)
তুলনামূলক ব্যাকরণের আলোচনায় তিনি লিখেছেন: ‘গৌরবে বহুবচনের প্রয়োগ হইতে উৎপন্ন কতকগুলি সর্বনামের গৌরবে প্রয়োগ বাঙ্গালাতে দেখা যায়। সংস্কৃতে উহা অজ্ঞাত। যথা : এ-ইনি, সে-তিনি, তাহার-তাঁহার’ ইত্যাদি।’
(দ্রষ্টব্য : প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩০; আরও দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষার পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরিচ্ছেদ -১৪)
একইভাবে, মান্যার্থে ব্যবহৃত এক বচনের ‘আমি’ মূলে বহুবচন ছিল। ভাষা তাত্ত্বিক ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘প্রাচীন বাঙ্গালায় ‘মুই’ মূলত : একবচনের পদ। আমি (আহ্মি = আমহি, আহ্মে = আমহে) বহুবচনের; আসামীতে এখনও মুই একবচনে ও আমি বহুবচনে ব্যবহৃত হয়। তদ্রূপ উড়িয়াতে ‘মুঁ’ (একবচন) ‘আম্ভে’ বহুবচন, হিন্দুসত্মানীতে ‘মৈঁ’ (একবচন), ‘হম’ (বহুবচন)। বহুবচনের ‘আমি’ ক্রমে একবচনেও ব্যবহৃত হইতে থাকে। এবং একবচনের ‘মুই’ বিরল-প্রচার বা অপ্রচলিত হইয়া যায়। ‘আমি’ তখন পুরোপুরি একবচনেরই পদ হইয়া দাঁড়ায়, এবং বহুবচনের জন্য ‘আমি’ হইতে ‘আমরা-সব’, ‘আমরা’ প্রভৃতি নূতন রূপের সৃষ্টি হয়। (দ্রষ্টব্য : ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ পৃ. ২৭২) আরও দ্রষ্টব্য : বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান : (আমি, অহং, অস্মদ, আহ্মা); বাংলা একাডেমী, বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান; (আমি, আমী শব্দের বিবর্তন)
ইংরেজি ভাষায়ও সম্মানার্থে উত্তমপুরুষের বহুবচনের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পক্ষ হতে ভারতের প্রধান ও জনগণের প্রতি ঘোষণাপত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘোষণাপত্রটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ এখানে উল্লেখ করছি-
Whereas, for divers weighty reasons, We have resolved, by and with the advice and consent of the lords Spiritual and Temporal, and Commons, in Parliament assembled, to take upon Ourselves the Government of the Territories in India heretofore administered in trust for Us by the Honorable East India Company:
Now, therefore, We do by these presents notify and declare that, by the advice and consent aforesaid, We have taken upon Ourselves the said Government; and We hereby call upon all OurSubjects within the said Territories to be faithful, and to bear true Allegiance to Us, Our Heirs, and Successors, and to submit themselves to the authority of those whom We may hereafter, from time to time, see fit to appoint to administer the Government of Our said Territories, in Our name and on Our behalf:
(Queen's proclamation, P-2) উপরোক্ত উদ্বৃতিতে রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্য সম্মানার্থে প্লুরাল রূপ ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজিতে একে 'Royal we' বলা হয়। দ্রষ্টব্য: Oxford Advanced Learner's Dictionary, P-1337। কিন্তু বর্তমান ইংরেজি সাধারণ কথ্য ভাষায় ও সাহিত্যের ভাষায় এর প্রচলন কতটুকু তা এমুহূর্তে আমার জানবার সুযোগ হয়নি। এ বিষয়ে ইংরেজি ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকদের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।
যাহোক, বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্তির মর্যাদা ও গৌরব প্রকাশের জন্য একবচনের স্থলে বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার হয়ে থাকে। এর কারণ সম্ভবত এই যে, একজন মান্য ও বরেণ্য ব্যক্তি সাধারণত একলা থাকেন না, বা নিঃসঙ্গ ও নিঃসহায় হন না। বরং তাঁর সাথে থাকে তাঁর সহচর ও সহযোগী, খাদেম ও সেবক এবং ভক্ত ও সমর্থক।
তিনি যদি হন কোনো সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান তবে তো তাঁর সাথে থাকবে উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতা এবং আজ্ঞাবহ বিভিন্ন বাহিনী। এই বিবেচনায় একজন মান্য ও মহৎ ব্যক্তির পক্ষে বহুবচনের সর্বনাম প্রয়োগ তাঁর গৌরব ও মাহাত্ম্যের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। এ ধরনের ব্যাখ্যাই হাফেজ সালাহুদ্দীন খলীল সাফাদী (মৃত্যু : ৭৬৪ হি.) পেশ করেছেন। দেখুন : নুছরাতুছ-ছায়ির আলাল মাছালিছ সায়ির (১/৭১, আল মাকতাবাতুশ শামিলা সংস্করণ)
ইমামুন নাহব রযীউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (মৃত্যু : ৬৮৬ হি.) ‘আল ওয়াফিয়া শারহুল কাফিয়া’ গ্রন্থে (ফেয়েলে মুযারের বহছ ৪/১৮)- যা ‘শরহুর রযী’ নামে প্রসিদ্ধ- বলেন:
ويقول الواحد المعظم أيضا : نفعل وفعلنا، وهو مجاز عن الجمع لعدهم المعظم كالجماعة অর্থাৎ সম্মানী ও মহান ব্যক্তি একজন হলেও বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার করে বলেন, نفعل বা فعلنا । এটি বহুবচনের রূপকার্থ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কারণ, একজন মহান ব্যক্তি একাই অনেক জনের সমষ্টিতুল্য।
তবে কুরআনে কারীমে যে বহুবচনরূপী ضمير العظمة (মহিমাব্যঞ্জক সর্বনাম) ব্যবহার হয়েছে তা নিজস্ব ব্যঞ্জনা এবং শব্দালংকার ও অর্থালংকারে সমৃদ্ধ। এ বিষয়ে ‘তাফসীরুল কুরআন’-এর অনেক কিতাবে সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে কোথাও সংক্ষিপ্তভাবে এবং কোথাও কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে অতি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় পেশ করছি :
এক. পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধে বহুবচনরূপী ضمير المتكلم الواحد المعظم نفسه ব্যবহারের একটি উদ্দেশ্য হল- তাঁর শানে জালাল ও মহিমা এবং সব বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করা। অর্থাৎ এখানে এমন একটি আবহ তৈরি হয় যেন মহামহিম আল্লাহ ضمير العظمة-এর মাধ্যমে আপন মহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। ফলে শ্রোতাগণের উপর মহিমা ও গৌরবের এমন তাজাল্লীর বিচ্ছুরণ হয় যা আয়াতের ভাব ও মর্মবাণীকে তাদের অন্তরের গভীর অনুভূতির সাথে পূর্ণ একাত্ম করে দেয়। কুরআনী বালাগাতের এই রহস্য সম্পর্কে নিমেণাক্ত তাফসীরগ্রন্থগুলো দেখা যেতে পারে-
(১) নাযমুদ দুরার ফি তানাসুবিল আয়াতি ওয়াস সুয়ার, হাফেজ বুরহানুদ্দীন আল বিকায়ী (মৃত্যু : ৮৮৫ হি.)। এতে ‘যমীরুল আযামাহ’-এর প্রতিটি স্থানের তাফসীর দেখার মত। কারণ এতে প্রতিটি স্থানে ‘যমীরুল আযামাহ’-এর তাফসীর সযত্নে পুনরুক্ত হয়েছে।
(২) আল কাশশাফ, জারুল্লাহ যমখশারী (মৃত্যু : ৫৩৮ হি.) (দ্রষ্টব্য : সূরা ত্বহা ১-৪, ৫৩; সূরা নামল : ১৬ আয়াতসমূহের তাফসীর)
(৩) আল বাহরুল মুহীত, আবূ হায়্যান আন্দালুসী, (মৃত্যু : ৭৪৫ হি.) (বিশেষত সূরা বাকারা-২৩, ৩৪, ৪৯ আয়াতসমূহের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
(৪) তাফসীরু আবিস সুউদ, কাযী আবুস সুউদ আল হানাফী (মৃত্যু : ৯৮২ হি.)
(৫) আশরাফুত তাফাসীর, (বিভিন্ন আয়াত সর্ম্পকে হযরত থানভী রাহ. -এর তাফসীরের সংকলন) ২/৯৪, ৩/৮৯-৯০
কুরআনুল কারীমে ضمير العظمة প্রয়োগের মাধ্যমে শানে জালাল ও মহিমা প্রকাশের বিশেষ কিছু ক্ষেত্র লক্ষ করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ কিছু ক্ষেত্রের উল্লেখ এখানে করা হচ্ছে :
(ক) مقام الأمر والنهي- অনুজ্ঞা ও নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে। যেমন-
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآَدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ (البقرة 3434:2)
وَقُلْنَا يَا آَدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا (البقرة ২: ৩৫)
قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا (البقرة ২: ৩৮)
قُلْنَا يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ (الأنبياء 69:21)
وَقُلْنَا مِنْ بَعْدِهِ لِبَنِي إِسْرَائِيلَ اسْكُنُوا الْأَرْضَ (الإسراء1104:17 )
وَقُلْنَا لَهُمُ ادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا (النساء 154:4)
وَقُلْنَا لَهُمْ لَا تَعْدُوا فِي السَّبْتِ (النساء 154:4)
(খ) مقام إهلاك الكافرين وتعذيبهم কাফেরদেরকে ধ্বংস ও শাসিত্ম প্রদান প্রসঙ্গে। এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন-
فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُنْهَمِرٍ (سورة القمر 11:54)
نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى عَذَابٍ عَظِيمٍ (سورة التوبة 101:9)
(গ) مقام التوبيخ ومقام التهويل তিরস্কারের স্থলে এবং কোনো কিছুর ভয়াবহতা বর্ণনা প্রসঙ্গে।
(ঘ) مقام الامتنان بالفضل والعطاء আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো দান ও অনুগ্রহের আলোচনা প্রসঙ্গে। যেমন-
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا (سورة الفتح 48:1)
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ---- (سورة الكوثر 1:108)
(ঙ) مقام مقام الامتنان بالخلق والرزق والإحياء والبعث والتفضيل সৃজন, রিযিক দান, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবন দান ইত্যাদির আলোচনা প্রসঙ্গে। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে।
(চ) অধিকতর বড় কোনো নিআমতের উলেস্নখ প্রসঙ্গে। যেমন-
وَإِذْ نَجَّيْنَاكُمْ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ (البقرة২ : ২৪)
দ্রষ্টব্য : আল বাহরুল মুহীত- আবু হায়্যান, ১/২৭৩,
দুই. ‘মুতাকাল্লিম’ বা বক্তাপক্ষের ضمير العظمة-এর বাচনভঙ্গি অত্যন্ত উচ্চমর্যাদার বালাগাতমন্ডিত হয়ে থাকে। কারণ এতে বালাগাতের পরিভাষায় "الالتفات" এবং "التفنن" নামক দুটি সৌন্দর্য তৈরি হয়। الالتفات হল বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে বক্তব্যের যমীর বা সর্বনামের ধারা পরিবর্তন করা। এর বিভিন্ন ধরন ও প্রকার রয়েছে। আমরা কুরআনে কারীমে লক্ষ করেছি যে, যেখানেই আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধে বহুবচনরূপী ضمير العظمة ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই এর পূর্বে বা পরে তাঁর সম্বন্ধে ইসমে যাহের কিংবা যমীরে ওয়াহেদ গায়েব তথা অন্যপক্ষের একবচনের সর্বনাম কিংবা ওয়াহেদ মুতাকালিস্নম তথা বক্তাপক্ষের একবচনের সর্বনাম ব্যবহার হয়েছে। এতে যেমন بلاغة الالتفات -এর সৌন্দর্য এসেছে তেমনি গৌরব ও সম্মানার্থে একবচনের জায়গায় বহুবচনের রূপ ব্যবহারের বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে বুঝে এসেছে।
প্রতিটি التفات -এর স্থানগত সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি নিজস্ব সৌন্দর্যও রয়েছে। যেমন আকস্মিক ধারা পরিবর্তন দ্বারা ‘তাফান্নুন’ ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়, ফলে শ্রোতা সচকিত হয়ে বিষয়বস্ত্তর প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়। সেই সাথে কালাম ইজাযপূর্ণ ও সুসংক্ষিপ্ত হয়। তাছাড়া ইলতিফাত দ্বারা উদ্দিষ্ট ভাব ও মর্মটি ইঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়। আর ইঙ্গিতময়তা প্রত্যক্ষভাষণের চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।
তিন. হাফেজ ইবনে তাইমিয়া রাহ.সহ কারো কারো মতে ضمير العظمة ব্যবহারের একটি হিকমত বা অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কোথাও কোথাও এদিকে ইঙ্গিত করা যে, আলোচ্য কাজটি আল্লাহ তাআলার হুকুমে তাঁর সেসকল কর্মীবাহিনী ও ফেরেশতাগণ আঞ্জাম দিয়ে থাকেন, যাদেরকে তিনি তাঁর তাকবীনী হুকুম কার্যকর করার জন্য নিযুক্ত রেখেছেন।
বলাবাহুল্য, মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর এ সৃষ্টিজগতের পরিচালনার জন্য কারো মুখাপেক্ষী নন। আর এ জন্যই তিনি পৃথিবীর রাজা-বাদশাহদের মতো নন, যাদের প্রয়োজন হয় উযীর বা মন্ত্রীর এবং বিভিন্ন বাহিনীর। আল্লাহ হলেন কুল জাহানের স্রষ্টা ও পালনকর্তা। তিনি আবার কার মুখাপেক্ষী? বরং সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তাঁর শান তো এই-
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (سورة يس ৮২:৩৬)
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন হিকমত ও উদ্দেশ্যে ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত রেখেছেন। তাদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা ইখতিয়ার নেই। তারা কেবল আল্লাহ তাআলার হুকুম তামীল করেন। তাদেরকে যে কাজেরই নির্দেশ দেয়া হয় সেটাকেই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আঞ্জাম দেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট এবং তাঁর পূর্ণ আজ্ঞাধীন ও নিয়ন্ত্রনাধীন হওয়ার কারণে যদি ফেরেশতাদের কথা মহান আল্লাহ তাআলার সাথে বহুবচনরূপী ضمير ضمير العظمة -এর মধ্যে উল্লিখিত হয় তবে তা আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অভিব্যক্তিই প্রকাশ করবে এবং এতে তাঁর গৌরব ও মহিমাই ফুটে উঠবে।ضمير العظمة -এর এই হিকমত ও রহস্য সম্পর্কে নিমেণাক্ত কিতাবসমূহ দেখা যেতে পারে।
(ক) মাজমূউল ফাতাওয়া- শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ৩/৬৫, ৫/৫০৮-৫০৯, ১৩/১৪৫,২৭৬
(খ) নাযমুদ দুরার, বুরহানুদ্দীন বিকায়ী, (সূরা আরাফ : ১৮২, সূরা কলাম : ৪৪, সূরা তূর : ৪৮ আয়াতসমূহের তাফসীর)
চার. মুতাকাল্লিম বা বক্তাপক্ষের ضمير العظمة -এর একাধিক ব্যঞ্জনার্থ রয়েছে। যেমন, ইসনাদ কিংবা ইযাফাতের মাধ্যমেضمير العظمة -এর দিকে সম্বন্ধকৃত বিষয়ের প্রতি শ্রোতার অন্তরে সমীহবোধ জাগ্রত করা। মুসনাদের প্রতি ইহতেমাম ও যত্ন প্রদর্শন করা। মুসনাদের বিশেষত্ব প্রকাশ করা। আদিষ্ট বিষয়ের প্রতি সম্বোধিত ব্যক্তির অন্তরে অধিকতর গুরুত্ববোধ সৃষ্টি করা এবং কোনো কিছুর ভয়াবহতা তুলে ধরা। অথবা কোনো কিছু শুধু আল্লাহ তাআলাই করতে পারেন, এই ইখতেসাস ও বিশেষায়ণ ইত্যাদি ভাব ও মর্মের ব্যঞ্জনা। উদাহরণস্বরূপ নিমেণাক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর দ্রষ্টব্য:
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ (البقرة 3223:2 )
وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا (الأعراف 64:7)
وَمَنْ رَزَقْنَاهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا (النحل 75:16)
إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا (الكهف 29:18)
فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآَنَهُ (القيامة 18:75)
وَاللَّهُ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَسُقْنَاهُ إِلَى بَلَدٍ مَيِّتٍ (الفاطر: 9:35)
وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا (الأنعام 34:6)
উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর ‘তাফসীরে রুহুল মা‘আনী’, ‘নাযমুদ দুরার’, ‘তাফসীরু আবিস সুউদ’ থেকে বিশেষভাবে দেখা যেতে পারে।
পাঁচ. উপরোক্ত কারণসমূহ ছাড়াও শব্দগত, অর্থগত এবং প্রসঙ্গের পারিপার্শ্বিকতার সূক্ষ্ম বিচারেও যমীরে ওয়াহেদ এবং বহুবচনরূপী ‘যমীরুল আযামাহ’ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে তাফসীরে রুহুল মাআনী ও তাফসীরু আবিস সুউদ থেকে নিমেণাক্ত আয়াতসমূহের তাফসীর দেখা যেতে পারে:
وَلَوْ شِئْنَا لَآَتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (سورة السجدة 113:32)
وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ ، وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ (سورة الأعراف 182:7)
তরজমা ও তরজমাতুল কুরআন প্রসঙ্গ
ضمير العظمة -এর বাংলা তরজমা সংক্রান্ত আলোচনায় প্রবেশের আগে তরজমা এবং তরজমাতুল কুরআন সংক্রান্ত মৌলিক কয়েকটি কথা আলোচনা করা প্রয়োজন।
(ক) তরজমা ও অনুবাদের প্রচলিত মূল অর্থ ভাষান্তর। এ অর্থে যে কোনো গ্রন্থ বিশেষত সাহিত্যগুণসম্পন্ন কোনো কিছু এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় যথার্থ তরজমা করা সত্যিকার অর্থেই এক দুরূহ কাজ। একথা বহুবার বহুজন বলেছেন। কেননা প্রত্যেকটি ভাষা আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। প্রত্যেক ভাষাতেই আছে তার নিজস্ব প্রকাশরীতি, প্রতীকী বাকভঙ্গিমা ও অভিব্যক্তি। তাই ভাষাগত ঐসব বৈশিষ্ট্যের অনুবাদ সহজ নয়। এই কারণে অনেক সময় কোনো সাহিত্য এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় আক্ষরিক অনুবাদ করতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায় এবং তাতে মূলের ভাবোদ্দীপনা সঞ্চারিত হয় না। আর যদি অনুবাদের ভাষাকে পুষ্পিত, লালিত্যপূর্ণ ও গতিময় করবার জন্য মূলের ভাবটা দিয়ে সেটাকে নতুন করে সৃষ্টি করা হয়; শব্দ, বাক্য, উপমা, প্রবাদ, বাগধারা স্বাধীনভাবে পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন করা হয়, তবে তো তাকে আর নিছক তরজমা বা অনুবাদ বলা যায় না। এটাকে তরজমার ভাষায় মূলের তরজুমানী ও প্রতিনিধিত্ব বলা যেতে পারে। সুতরাং তরজমা মূলানুগ হওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেটা হবে যদি তরজমার ভাষাটা ভাষার স্বাভাবিক বাগভঙ্গিমা ও প্রকাশরীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
(খ) বাস্তব সত্য এই যে, আল্লাহর কালাম কুরআনুল কারীমের যথাযথ তরজমা করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ কুরআন হলো كلام معجز (অক্ষমকারী কালাম),যার সমতুল্য ছোট একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়। মূল আরবী ভাষায়ও সম্ভব নয় এবং অন্য কোনো ভাষায়ও সম্ভব নয়। জিন ও ইনসান মিলেও যদি চেষ্টা করে তবু নয়। তাছাড়া কুরআন হল আরবী নযম ও শব্দ এবং অর্থ ও মর্মের সমষ্টি। কুরআনের অন্যতম প্রধান ‘ইজায’ ও অলৌকিকত্ব হল তার বালাগাত-ফাসাহাত অর্থাৎ ভাষার অনন্য সাধারণ বিশুদ্ধতা, অলংকারময়তা, গতি-স্বাচ্ছন্দ্য, ধ্বনি-গাম্ভীর্য ও ব্যঞ্জনা। তাই কুরআনের ঐসব অনন্য বৈশিষ্ট্য ও আবেদন তরজমার ভাষায় প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়।
সে কারণেই সাধারণভাবে আমরা যদিও বলি, ‘তরজমাতুল কুরআন’ কিন্তু আরবের সুবিজ্ঞ আলিমগণ অতি গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তা থেকে অতিরিক্ত শব্দ যোগ করে বলে থাকেন:
ترجمة معاني القرآن الكريم বা ترجمة تفسير القرآن الكريم
(গ) উদ্দেশ্যভেদে এবং পাঠকদের রুচিবৈচিত্র্যের কারণে কুরআনুল কারীমের তরজমা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ‘বা-মোহাওয়ারাহ’ ও সরল তরজমা, আদবী ও সাহিত্যপূর্ণ তরজমা, মূলানুগ তরজমা এবং শাব্দিক ও আক্ষরিক তরজমা। এসবের প্রত্যেকটিরই রয়েছে বিভিন্ন স্তর, মাত্রা ও ধরন। তাই তরজমাতুল কুরআনের পথিকৃত আকাবির আহলে ইলমের তরজমায় বিভিন্নতা রয়েছে। এ বিষয়টি বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। এখন সে সুযোগ নেই। তবে সর্বক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হল আয়াতের মূল আবেদন, ওহীর ভাবগাম্ভীর্য এবং কালামুল্লাহর শানে জামাল ও শানে জালাল যেন যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ থাকে। তেমনি ‘নযমে কুরআন’ -এর ছাপ ও ছায়াও যদ্দুর সম্ভব রক্ষিত থাকে।
(ঘ) কুরআনের আরবী ভাষা ও আমাদের হিন্দুস্তানী ভাষাসমূহের বাকরীতি, বাক্যকাঠামো এবং পদবিন্যাসে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এ কারণে মূল আরবীর হুবহু অনুসরণে আক্ষরিক অনুবাদ করতে গেলে তা কখনো কখনো নিতান্ত শ্রুতিকটু ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। তেমনি শাব্দিক তরজমায় কুরআনে কারীমে ব্যবহৃত বিশেষ আরবী বাগধারা, অলংকার ও প্রবচনগুলোর অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট হয় না। তাই সহজায়ন বা সরলায়নের জন্য অনুবাদের ভাষায় মূলের বিন্যাস ও কাঠামোতে পরিবর্তন কখনো অনিবার্য হয়, কখনো উত্তম হয়, কখনো বৈধ হয়। স্পষ্টায়নের জন্য অনুবাদের ভাষায় আরবীর বিশেষ বাগধারা, অলংকার ও প্রবচনের সমার্থবোধক বাগধারা ও অলংকার ব্যবহার করা হয়। আর যেসব ক্ষেত্রে সমার্থবোধক বাগধারা ও অলংকার পাওয়া যায় না সেসব স্থানে তরজমায় মর্মার্থ দেয়া হয় বা ভাব তরজমা করা হয়।
ফার্সী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় রচিত নির্ভরযোগ্য তরজমাগুলো পর্যালোচনা করা হলে এবং ভূমিকা অংশ পড়া হলে উপরোক্ত কথাই বুঝে আসে। বিশেষত নিমেণাক্ত তরজমাগুলোর ভূমিকা দ্রষ্টব্য:
১। তরজমায়ে শাইখুল হিন্দ
২। তাফসীরে মাজেদী
৩। হক্কানী তাফসীর, ছদর ছাহেব রাহ.
৪। এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গানুবাদ নূরানী কোরআন শরীফ’ (যা কয়েকজন আকাবির আহলে ইলম কর্তৃক সম্পাদিত)
৫। আলকুরআনুল কারীম (বঙ্গানুবাদ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। (যা দেশের বিশিষ্ট আহলে ইলম, ভাষাবিদ এবং সাহিত্যিকদের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা হয়েছে।)
ضمير العظمة -এর বাংলা অনুবাদ প্রসঙ্গ
প্রাচীন বাংলা ভাষায় ‘গৌরবে বহুবচন’ বলে একটি বিষয় ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার এখনকার যা স্বাভাবিক প্রকাশরীতি- বিশেষত কথ্যভাষা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা- তাতে ‘গৌরবে বহুবচন’ জনসাধারণের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত। অধিকন্তু বাংলা ভাষায় সর্বনাম ও ক্রিয়ার গৌরবসূচক বিশেষ রূপ ব্যবহার হয়ে থাকে, যা পূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি। এজন্যই সম্ভবত বাংলাভাষার আধুনিক শব্দকোষ ও ব্যাকরণগ্রন্থে ‘গৌরবে বহুবচনে’র উল্লেখ করা হয় না। বরং শ্রোতা ও অন্যপক্ষের সর্বনামের সাধারণ, মানী এবং অন্তরঙ্গ বা তুচ্ছতাবোধক- এই তিনটি রূপ উল্লেখ করা হয়।
বর্তমান বাংলা ভাষায় একবচনের জায়গায় বহুবচন ব্যবহারের নযীর আছে। কিন্তু তা ‘গৌরবে’ নয়। বিনয় প্রকাশের জন্য। ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যবহার বিধি’ (পৃ. ১৫৭-১৫৮) থেকে একটি উদ্ধৃতি দেখুন- ‘বিনয়ে বহুবচনে’র প্রয়োগ দেখা যায় বাংলায়, বাচনে বা লেখায়, বক্তৃতায় বক্তা বা লেখকেরা অনেক সময় ‘আমি’ ‘আমার’ ইত্যাদি ব্যবহার না করে ‘আমরা’ ‘আমাদের’ ব্যবহার করেন: আমরা এই ঐক্যবুদ্ধিরই জয়গান গাই, আমাদের মনে হয় এ নীতি ভ্রান্ত ইত্যাদি।’
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনৈতিক নেতা, কোনো দল বা সংগঠনের প্রধান, প্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা কোনো মান্য ও গুরুজন নিজের কোনো সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায় ঘোষণা করার ক্ষেত্রে অনেক সময় ‘আমি’ ‘আমার’ না বলে, বহুবচনের ‘আমরা’ ‘আমাদের’ বলে থাকেন, এ থেকে কারো মনে হতে পারে যে, এই ‘আমরা’ ‘আমাদের’ এবং আরবী ‘যমীরুল আযামাহ’ অভিন্ন জিনিস। কিন্তু এই ধারণা বাস্তবসম্মত মনে হয় না। কারণ এ ধরনের বক্তব্যে বক্তা প্রকৃত বিচারে মাত্র একজন নন। এতে প্রধান বক্তা ও তার অধীন ও অনুগত বা ভক্ত ও সমর্থক- এই দুয়ে মিলে ‘আমরা’ ‘আমাদের’ কথাটি প্রয়োগ করা হয়। এই ‘আমরা’ তো অংশীদারিভাবে কাজটি সকলের করণীয় এই অভিব্যক্তি নির্দেশ করে। সুতরাং এটাকে -‘গৌরবে বহুবচনে’র ব্যবহার বলা চলে না। এর একটি প্রমাণ হল সম্মানী ব্যক্তিকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে এখনকার বাংলা ভাষায় বহুবচনের প্রয়োগ নেই। বরং এর জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র শব্দ ‘আপনি’।
অতএব কুরআনী ‘যামীরুল আযামাহ’-এর অনুবাদ যদি বাংলায় বহুবচনের ‘আমরা’ ‘আমাদের’ দ্বারা করা হয় তা হবে শাব্দিক অনুবাদ। এতে আরবীর শব্দ-গৌরব, অলংকার ও ব্যঞ্জনা উঠে আসবে না। অধিকন্তু এতে বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকের অন্তরে ‘আকিদায়ে তাওহীদ’ বিষয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে এবং প্রকাশরীতি আড়ষ্ট বা অস্বাভাবিক হওয়ায় পাঠকের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু বাংলা তরজমায় যদি ‘আমি’ ও ‘আমার’ (যাতে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে কিছুটা হলেও গৌরবার্থ রয়েছে) প্রয়োগ করা হয়, তবে মূল আরবীর পূর্ণ ব্যঞ্জনা ও আবেদন প্রকাশ না পেলেও উপরোক্ত আশংকা দুটি থেকে মুক্ত থাকবে। এসব কারণে সাধারণ পাঠকদের উদ্দেশ্যে রচিত তরজমাতুল কুরআনে কুরআনী ‘যামীরুল আযামাহ’-এর বাংলা অনুবাদ বর্তমান সময়ে ‘আমি’ ‘আমার’ করাই শ্রেয় মনে হয়। বাংলা ভাষায় তরজমাতুল কুরআনের পথিকৃত আকাবির আলেমগণ এ নীতিই অবলম্বন করেছেন। এখান থেকে সরে আসার অনিবার্য কোনো কারণ এখন আছে বলে মনে হয় না। তবে বর্তমানেও যদি শব্দে শব্দে আভিধানিক এবং ব্যাকরণিক অর্থ জানবার উদ্দেশ্যে ‘তাহতা-লফযী’ আক্ষরিক তরজমা করা হয়, তবে তা ভিন্ন কথা। এ ধরনের তরজমায় ‘যামীরুল আযামাহ’-এর অনুবাদ বহুবচনের ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, কবি গোলাম মুস্তফাসহ[3] আরো কেউ কেউ আরবী-ফার্সী-উর্দূ ও ইংরেজির অনুকরণে আরবী ‘যামীরুল আযামাহ’-এর বাংলা তরজমা বহুবচনের ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ দ্বারা করার যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু এই আক্ষরিক অনুকরণ সরল ও বাংলা-‘বা-মোহাওয়ারাহ’ তরজমায় সঙ্গত মনে হয় না। এর কারণগুলো ইতোপূর্বে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে।
মনে রাখতে হবে অন্যান্য অনেক ভাষার মত বাংলা ভাষাও আজন্ম দাঁড়িয়ে থাকেনি একই জায়গায় অথবা একই চেহারায়। একদিকে যেমন অন্য নানা ভাষা থেকে নতুন নতুন শব্দ গ্রহণ ও আত্মস্থ করে সে বাড়িয়ে নিয়েছে তার শব্দভান্ডার, অন্যদিকে তেমনি ধীরে ধীরে তার প্রকাশরীতিও অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। প্রকাশরীতি ধীরে ধীরেই পাল্টায়, গায়ের জোরে রাতারাতি তাকে পাল্টানো যায় না। সুতরাং ভবিষ্যতে যদি বাংলা ভাষায় আবারও ‘গৌরবে বহুবচন’ প্রয়োগের প্রচলন ঘটে তখন সমকালীন বাকরীতি অনুসারে আরবী ‘যামীরুল আযামাহ’-এর তরজমা বহুবচন দ্বারা করা যেতে পারে।
কেবল ‘যামীরুল আযমাহ’ কেন ভাষাবিদদের মতে বাংলা ও আরবী ভাষার মাঝে সাদৃশ্য অপেক্ষা পার্থক্যই অধিক। কারণ এই দুই ভাষা সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন দুইটি ভাষা-গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত। সংস্কৃত, বাঙ্গালা, ফার্সী, হিন্দুস্তানী ও ইংরেজি প্রভৃতি আর্য-গোষ্ঠীর ভাষার গঠন-প্রণালী ও ব্যাকরণ এবং শেমীয়-গোষ্ঠীর ভাষা আরবীর গঠন-প্রণালী ও ব্যাকরণ নানা দিক দিয়ে পরস্পর হতে খুবই পৃথক। যেমন, অনেক আরবী বর্ণের বিশুদ্ধ আরবী উচ্চারণ অনুসারে প্রতিবর্ণীকরণ সম্ভব নয়।
আরবীতে ও সংস্কৃতে ফেয়েল ও ক্রিয়ার তিনটি বচন আছে, কিন্তু বাংলায় ক্রিয়ার বচন-ভেদ নেই। একবচন ও বহুবচনে ক্রিয়ার রূপ অভিন্ন।
আরবী ও ইংরেজিতে সর্বনামের লিঙ্গভেদ রয়েছে, কিন্তু প্রমিত বাংলা ভাষায় সর্বনাম শব্দে নারী-পুরুষবাচক পার্থক্য করা হয় না। আমি, তুমি, সে, তারা, এটা, ওটা ইত্যাদি সর্বনাম স্ত্রী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে একই রূপে ব্যবহৃত হয়।
আরবী ও সংস্কৃত ভাষায় সংখ্যা অনুযায়ী বিশেষ্যপদের বচন পাল্টে যায়। তাই আরবীতে বলা হয় রজুলুন, রজুলানি, রিজালুন। সংস্কৃতে বলা হয়, নর:, নরৌ, নরা:। কিন্তু বাংলায় সংখ্যা যা-ই হোক, সেই অনুযায়ী বিশেষ্যপদের বচন পাল্টানোর দরকার হয় না। তাই ১ -এর ক্ষেত্রে যা ‘মানুষ’, সংখ্যাটা ১ -এর বেশি হলেও তা মানুষই থেকে যায়, ‘দুজন মানুষেরা’ বা ‘তিনজন মানুষেরা’ লিখবার দরকার হয় না বাংলা ভাষায়। ইংরেজিতে দ্বিবচনের বিশেষ রূপ নেই, আছে শুধুই একবচন ও বহুবচন। সিঙ্গুলার ও পস্নুরাল। সংখ্যাটা ১ হলে ‘Man’, ১-এর বেশি হলেই ‘Men’। এ ধরনের আরো অনেক পার্থক্যই রয়েছে, যা বাংলা ভাষায় অবিকল নকল করা সম্ভব নয়।
আরবী বাকরীতি বাংলায় অপ্রচলিত হওয়ার কারণে তরজমার ক্ষেত্রে তা পরিবর্তন করে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বাকরীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তরজমা করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। দুটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করছি :
১. মোখাতাব ও শ্রোতার অন্তরে ভবিষ্যতে ঘটিতব্য কোনো ঘটনার সুনিশ্চয়তার বিশ্বাস বদ্ধমূল করার উদ্দেশ্যে ‘‘সীগায়ে মুসতাকবাল’’-এর পরিবর্তে ‘‘সীগায়ে মাযী’’ ব্যবহার হয়। এ ধরনের সীগায়ে মাযী-এর বাংলা তরজমা কোথাও কোথাও ‘মাযী’ বা অতীত কালের ক্রিয়া দিয়ে করা সম্ভব। কিন্তু সব জায়গায় তা খাটবে না। উদাহরণস্বরূপ কুরআনে কারীমের কয়েকটি আয়াত লক্ষ্য করুন-
(ক) সূরাতুল আরাফের ৪৩ ও ৪৪ নং আয়াত। এ আয়াতে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের কিছু অবস্থা ও সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ঘটবে। কিন্তু ঘটনার সুনিশ্চয়তা বোঝানোর জন্য সীগায়ে মাযী ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য ভাষায় এই ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যবহারের প্রচলন নেই বলেই সকল নির্ভরযোগ্য তরজমায় ভবিষ্যতের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে।
(খ) সূরাতুন নামল : ৮৭ নং আয়াত সম্পর্কেও একই কথা।
(গ) أَتَى أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ সূরা নাহলের প্রথম আয়াত। এখানে অবশ্য বাংলায় অতীতকালের ক্রিয়া ব্যবহার করা সম্ভব। তাই তা অনেকে করেছেন। মুফতী মুহাম্মাদ তকী উসমানী দা.বা.-এর ‘আসান তরজমায়ে কুরআন’য়ে আয়াতের তরজমা ও তার টীকা দ্রষ্টব্য।
২. আরবী ভাষায় অনেক সময় মর্যাদাগত দূরত্ব ও সুউচ্চতার প্রতি ইঙ্গিত করার উদ্দেশ্যে নিকটবর্তী জিনিসের জন্য দূরবর্তী ‘ইসমুল ইশারাহ’ ذلك ، أولئك ব্যবহার হয়ে থাকে। এই প্রকাশরীতি অন্যভাষায় অপ্রচলিত। তাই এই দূরবর্তী ‘ইসমুল ইশারাহ’-এর তরজমা নিকট-নির্দেশক সর্বনাম দ্বারাই করা হয়। উদাহরণস্বরূপ কুরআনে কারীমের সূরা বাকারার ذَلِكَ الْكِتَابُ لَارَيْبَ فِيهِ এবং
أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
আয়াতের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
সর্বশেষ কথা হল, ‘গৌরবে বহুবচন’ এখনকার বাংলা ভাষায়, বিশেষত কথ্য ভাষায় জনসাধারণের কাছে অজ্ঞাত। এ অবস্থায় বাংলা অনুবাদে সম্মানার্থে ‘বহুবচন’ প্রয়োগের দরকার হয় না। সেটা রীতিও নয়। এ সত্ত্বেও যদি অন্যান্য ভাষার অনুসরণে কেউ তা তরজমাতুল কুরআনে ব্যবহার করতে চান, তবে তাঁর জন্য অবশ্যকরণীয় হল, তিনি টীকায় সতর্ক করবেন যে, এটি সম্মানার্থে বহুবচন, সংখ্যাবাচক বহুবচন নয়। l
[1] আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় যা মুতাকাল্লিম, হাযের ও গায়েব তা প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষ নামে পরিচিত। এতে মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুকরণ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’য়ে এ স্থলে ‘বক্তাপক্ষ’, ‘শ্রোতাপক্ষ’ ও ‘অন্যপক্ষ’- এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
[2] দ্রষ্টব্য : তাফসীরুল বাহরিল মুহীত, আবূ হাইয়ান আন্দালুসী (মৃত্যু : ৭৪৫ হি.) (সূরা বাকারা : ৩৪,৩৯); আল কাশশাফ, জারুল্লাহ যমখশারী (মৃত্যু : ৫৩৮ হি.) সূরা ত্বহা : ১-৪,৫৩); রুহুল মাআনী, আলস্নামা মাহমুদ আলূসী, (মৃত্যু : ১২৭০ হি.) (সূরা আলে ইমরান : ৮৪, সাজদা : ১৩, হিজর : ১২, কাসাস : ৯); আল মুযহির ফি উলূমিল লুগাহ ওয়া আনওয়ায়িহা, সুয়ূতী : ১/৩৩৩; আন নাহবুল ওয়াফী (যমীরের আলোচনা); আল মু‘জামুল ওয়াসীত (‘নাহনু’ মাদ্দা)
মহিলা সাহাবীদের নামের তালিকা দেখুন। ইসলামের সৌভাগ্যবান ৭৯ জন মহিলা সাহাবীদের নাম
ReplyDeletehttps://islami-bangla.blogspot.com/2020/02/blog-post_139.html