প্রশ্ন: ৫৩: কুরআন একত্রে নাযিল করা হলো না কেন ? কুরআন সংকলণের ইতিহাস।

সুরা ফুরকান :
﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً ۚ كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا﴾

৩২) অস্বীকারকারীরা বলে, “এ ব্যক্তির কাছে সমগ্র কুরআন একই সাথে নাযিল করা হলো না কেন?”৪৪ হ্যাঁ, এমন করা হয়েছে এজন্য, যাতে আমি একে ভালোভাবে তোমার মনে গেঁথে দিতে থাকি৪৫ এবং (এ উদ্দেশ্যে) একে একটি বিশেষ ক্রমধারা অনুযায়ী আলাদা আলাদা অংশে সাজিয়ে দিয়েছি৷  


৪৪. এই আপত্তিটাই ছিল মক্কার কাফেরদের খুবই প্রিয় ও যুৎসই৷ তাদের মতে এ আপত্তিটি খুবই শক্তিশালী৷ এজন্যে বারবার তারা এর পুনরাবৃত্তি করতো৷ কুরআনেও বিভিন্ন স্থানে এটি উদ্ধৃত করে এর জবাব দেয়া হয়েছে৷ (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নমল ১০১-১০৬ ও বনী ইসরাঈল ১১৯ টীকা) তাদের প্রশ্নের অর্থ ছিল, যদি ব্যক্তি নিজে চিন্তা-ভাবনা করে অথবা কারো কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে এবং বিভিন্ন কিতাব থেকে নকল করে এসব বিষয়বস্তু না এনে থাকে বরং যদি সত্যিসত্যিই এটি আল্লাহর কিতাব হয়, তাহলে সমগ্র কিতাবটি একই সময়ে একই সংগে নাযিল হচ্ছে না কেন? আল্লাহ যা বলতে চান তা তো তিনি ভালো করেই জানেন৷ যদি তিনি এগুলোর নাযিলকারী হতেন তাহলে সব কথা এক সাথেই বলে দিতেন৷ এই যে চিন্তা-ভাবনা করে বিভিন্ন সময় কিছু কিছু বিষয় আনা হচ্ছে এগুলো একথার সুস্পষ্ট আলামত যে, অহী উপর থেকে নয় বরং এখানেই কোথাও থেকে আহরণ করা হচ্ছে অথবা নিজেই তৈরী করে সরবরাহ করার কাজ চলছে৷
৪৫. অন্য অনুবাদ এও হতে পারেঃ "এর মাধ্যমে আমি তোমার অন্তরকে শক্তিশালী করি" অথবা "তোমার বুকে হিম্মত সঞ্চার করি৷ " শব্দগুলোর মধ্যে উভয় অর্থই রয়েছে এবং উভয় অর্থই এখানে প্রযোজ্য৷ এভাবে একই বাক্যে কুরআন পর্যায়ক্রমে নাযিল করার বহুতর কারণ বর্ণনা করা হয়েছে: এক : স্মৃতির ভাণ্ডারে একে হুবহু ও অক্ষরে অক্ষরে সংরক্ষণ করা যেতে পারে৷ লেখার আকারে নয় বরং একজন নিরক্ষর নবীর মাধ্যমে নিরক্ষর মানব গোষ্ঠীর মধ্যে মৌখিক ভাষণের আকারে এর প্রচার ও প্রসার হচ্ছে৷
দুই : এর শিক্ষাগুলো ভালোভাবে হৃদয়ংগম করা যেতে পারে৷ এজন্য থেমে থেমে সামান্য সামান্য কথা বলা এবং একই কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করাই বেশী উপযোগী হয়৷
তিন : এ কিতাব যে জীবন পদ্ধতির কথা বলেছে তার উপর মন স্থির হয়ে যেতে থাকে৷ এজন্য নির্দেশ ও বিধানসমূহ পর্যায়ক্রমে নাযিল হওয়াটাই বেশী যুক্তিসংগত৷ অন্যথায় যদি সমস্ত আইন-কানুন এবং সমগ্র জীবন ব্যবস্থা একই সংগে বর্ণনা করে তা প্রতিষ্ঠিত করার হুকুম দেয়া হতো তা হলে চেতনা বিশৃংখল হয়ে যেতো৷ তাছাড়া এটাও বাস্তব সত্য যে , প্রত্যেকটি হুকুম যদি যথাযথ ও উপযুক্ত সময়ে দেয়া হয় তাহলে তার জ্ঞানবত্তা ও প্রাণসত্তা বেশী ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়৷ অন্যদিকে সমস্ত বিধান ,ধারা ও উপধারা অনুসারে সাজিয়ে একই সংগে দিয়ে দিলে এ ফল পাওয়া যেতে পারে না৷
চার : ইসলামী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে যখন হক ও বাতিলের লাগাতার সংঘাত চলে সে সময় নবী ও তাঁর অনুসারীদের মনে সাহস সঞ্চার করে যেতে হবে৷ এ জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একবার একটি লম্বা-চওড়া নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিয়ে সারা জীবন সমগ্র দুনিয়ার যাবতীয় বাধাবিপত্তির মোকাবিলা করার জন্য তাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেবার তুলনায় বার বার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের কাছে পয়গাম আসা বেশী কার্যকর হয়ে থাকে৷ প্রথম অবস্থায় মানুষ মনে করে সে প্রবল বাত্যা বিক্ষুব্ধ তরংগের মুখে পড়ে গেছে৷ আর দ্বিতীয় অবস্থায় মানুষ অনুভব করে , যে আল্লাহ তাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছেন তিনি তার প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন৷ তার কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন , তার অবস্থা দেখছেন , তার সমস্যা ও সংকটে তাকে পথ দেখাচ্ছেন এবং প্রত্যেকটি প্রয়োজনের সময় তাকে তাঁর সামনে হাজির হবার ও সম্বোধন করার সৌভাগ্য দান করে তার সাথে নিজের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে থেকেছেন৷ এ জিনিসটি তার উৎসাহ বৃদ্ধি এবং সংকল্প সুদৃঢ় করে৷ 

সুরা তুর : 


﴿فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِّثْلِهِ إِن كَانُوا صَادِقِينَ﴾

৩৪) তাদের একথার ব্যাপারে তারা যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এ বাণীর মত একটি বাণী তৈরি করে আনুক৷২৭
 

২৭. অর্থাৎ কথা শুধু এ টুকু নয় যে, এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী নয়, বরং এটা আদৌ মানুষের কথা নয় ৷ এ রকম বাণী রচনা করাও মানুষের সাধ্যাতীত ৷ তোমরা যদি একে মানুষের কথা বলতে চাও তাহলে মানুষের রচিত এ মানের কোন কথা এনে প্রমান করো ৷ শুধু কুরাইশদের নয়, বরং দুনিয়ার মানুষকে এ আয়াতের মাধ্যম সর্বপ্রথম এ চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল ৷ এরপর পুনরায় মক্কায় তিনবার এবং মদীনায় শেষ বারের মত এ চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে ৷ ( দেখুন ইউনুস, আয়াত ৩৮;হূদ, ১৩; বনী ইসরাঈল, ৮৮; আল বাকারা , ২৩) ৷ কিন্তু সে সময়ও কেউ এর জবাব দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি ৷ তার পরেও আজ পর্যন্ত কেউ কুরআনের মোকাবিলায় মানুষের রচিত কোন কিছু পেশ করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি ৷ কেউ কেউ এ চ্যালেঞ্জের প্রকৃত ধরন না বুঝার কারণে বলে থাকে, শুধু কুরআন কেন, কোন একক ব্যক্তির নিজস্ব রীতিতেও অন্য কেউ গদ্য বা কবিতা লিখতে সমর্থ হয় না ৷ হোমার, রুমী, সেক্সপিয়ার, গেটে, গালিব, ঠাকুর , ইকবাল, সবাই এদিক দিয়ে অনুপম যে তাদের অনুকরণ করে তাদের মত কথা রচনা করার সাধ্য কারোই নেই ৷ কুরআনের চ্যালেঞ্জের এ জবাবদাতারা প্রকৃতপক্ষে এ বিভ্রান্তিত আছে যে, ( ) আয়াতাংশের অর্থ হুবহু কুরআনের মতই কোন গ্রন্থ রচনা করে দেয়া ৷ অথচ এর অর্থ বাকরীতির দিক দিয়ে সমমান নয় ৷ এর অর্থ সামগ্রিকভাবে এর গুরুত্ব ও মর্যাদার সমপর্যায়ের কোন গ্রন্থ নিয়ে এসো ৷ যেসব বৈশিষ্টের কারণে কুরআন একটি মু'জিযা ঐ গ্রন্থও সে একই রকম বৈশিষ্ট মণ্ডিত সমপর্যায়ের হতে হবে ৷ যেসব বড় বড় বৈশিষ্টের কারণে কুরআন পূর্বেও মু'জিযা ছিল এবং এখনো মু'জিযা তার কায়েকটি সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
একঃ যে ভাষায় কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে তা সে ভাষায় সাহিত্যে উচ্চতম ও পূর্ণাঙ্গ নমুনা ৷ গোটা গ্রন্থের একটি শব্দ বা একটি বাক্যও মানের নিচে নয় ৷ যে বিষয়টিই ব্যক্ত করা হয়েছে সেটিই উপযুক্ত শব্দ ও উপযুক্ত বাচনভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে ৷ একই বিষয় বার বার বর্ণিত হয়েছে এবং প্রতিবারই বর্ণনার নতুন ভংগী গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু সেজন্য পৌনপুনকতার দৃষ্টিকটূতা ও শ্রুতিকটূতা কোথাও সৃষ্টি হয়নি ৷ গোটা গ্রন্থে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দের গাঁথুনি এমন যেন আংটির মুল্যবান পাথারগুলো ছেঁটে ছেঁটে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ৷ কথা এতটা মর্মস্পর্শী যে, তা শুনে ভাষাভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই মাথা নিচু না করে থাকতে পারে না ৷ এমন কি অমান্যকারী এবং বিরোধী ব্যক্তির মনপ্রাণ ও ভাবাবেগ পর্যন্ত উদ্বেলিত হয়ে ওঠে ৷ ১৪ শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আজ অবধি এ গ্রন্থ তার ভাষায় সাহিত্যের সবচেয়ে উন্নত নমুনা ৷ এর সমপর্যায়ের তো দূরের কথা সাহিত্যিক মর্যাদা ও মূল্যমানে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ আজ পর্যন্ত এর ধারে কাছেও পৌছনি ৷ শুধু তাই নয়, এ গ্রন্থ আরবী ভাষাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে বসেছে যে, ১৪ শত বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এ ভাষার বিশুদ্ধতার মান তাই আছে যা এ গ্রন্থ প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল ৷ অথচ এ সময়ের মধ্যে ভাষাসমূহ পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে ৷ পৃথিবীতে আর কোন ভাষা এমন নেই যা এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লিখন পদ্ধতি, রচনা রীতি, বাচনভংগী, ভাষার নিয়মকানুন এবং শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই রূপ নিয়ে টিকে আছে ৷ এর সাহিত্যমান আজ পর্যন্ত আরবী ভাষার উচ্চ মানের সাহিত্য ৷ ১৪ শত বছর আগে কুরআনে যে বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল বক্তৃতা ও লেখার আজও সেটাই বিশুদ্ধ ভাষা বলে মানা হচ্ছে ৷ দুনিয়ার কোন ভাষায় মানুষের রচিত কোন গ্রন্থ কি এ মর্যাদা লাভ করেছে ৷ !
দুইঃ এটা পৃথিবীর একমাত্র গ্রন্থ যা মানব জাতির ধ্যান-ধারণা , স্বভাব -চরিত্র , সভ্যতা, -সংস্কৃতি এবং জীবন প্রণালির ওপর এমন ব্যাপক, এমন গভীর এবং এমন সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে যে, পৃথিবীতে তার কোন নজির পাওয়া যায় না ৷ এর প্রভাব প্রথমে একটা জাতির মধ্যে পরিবর্তন আনলো ৷ অতপর সেই জাতি তৎপর হয়ে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশে পরিবর্তন আনলো ৷ দ্বিতীয় আর কোন গ্রন্থ নেই যা এতটা বিপ্লবাত্মক প্রমাণিত হয়েছে ৷ এ গ্রন্থ কেবলমাত্র কাগজের পৃষ্ঠাসমূহেই লিপিবদ্ধ থাকেনি বরং তার এক একটি শব্দ ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করেছে এবং একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা নির্মাণ করেছে ৷ ১৪ শত বছর ধরে তার এ প্রভাব চলে আসছে এবং দিনে দিনে তা আরো বিস্তৃত হচ্ছে ৷
তিনঃ এ গ্রন্থ যে বিষয়ে আলোচনা করে তা একটি ব্যাপকত বিষয় ৷ এর পরিধি আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত গোটা বিশ্ব -জাহানকে পরিব্যাপ্ত করে আছে ৷ এ গ্রন্থ বিশ্ব-জাহানের তাৎপর্য তার শুরু ও শেষ এবং তার নিয়ম-শৃংখলা সম্পর্কে বক্তব্য ও মত পেশ করে ৷ এ গ্রন্থ বলে দেয় এ বিশ্ব -জাহানের স্রষ্টা, শৃংখলাবিধানকারী এবং পরিচালক কে? কি তাঁর গুণাবলী , কি তাঁর ইখতিয়ার ও ক্ষমতা এবং কি সেই মূল ও আসল বিষয় আর যার ভিত্তিতে তিনি এ গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছেন ৷ সে এ পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে বলে দেয় যে, এটা তার স্বাভাবিক অবস্থান এবং এটা তার জন্মগত মর্যাদা ৷ সে এ অবস্থান ও মর্যাদা পাল্টে দিতে সক্ষম নয় ৷ এ অবস্থান ও মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের জন্য সত্য ও বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল সঠিক পথ কি এবং সত্য ও বাস্তবের সাথে সংঘাতপূর্ণ ভ্রান্ত পথ কি তা সে বলে দেয় ৷ সঠিক পথের সঠিক হওয়া এবং ভ্রান্ত পথের ভ্রান্ত হওয়া প্রমাণের জন্য সে যমীন ও আসমানের এক একটি বস্তু থেকে মহাবিশ্ব ব্যবস্থার এক একটি প্রান্ত থেকে মানুষের নিজের আত্মা ও সত্তা থেকে এবং মানুষেরই নিজের ইতিহাস থেকে অসংখ্য যুক্তি -প্রমাণ পেশ করে ৷ এর সাথে সে বলে দেয় মানুষ কিভাবে ও কি কি কারণে ভ্রান্ত পথে চলেছে এবং প্রতি যুগে তাকে কিভাবে সঠিক পথ বাতলে দেয়া হয়েছে যা সবসময় একই ছিল এবং একই থাকবে ৷ সে কেবল সঠিক পথ দেখিয়েই ক্ষান্ত হয় না ৷ বরং সে পথে চলার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার চিত্র পেশ করে যার মধ্যে আকায়েদ, আখলাক, আত্মার পরিশুদ্ধি , ইবাদত, -বন্দেগী , সামাজিকতা, তাহযীব , তামাদ্দুন, অর্থনীতি, রাজনীতি, ন্যায়বিচার , আইন-কানুন, এক কথায় মানব জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে অত্যন্ত সুসংবদ্ধ বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে ৷ তাছাড়া এ সঠিক পথ অনুসরণ করার এবং ভ্রান্ত পথসমূহে চলার কি কি ফলাফল এ দুনিয়ায় দেখা দেবে এবং দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পর অন্য আরেকটি জগতে দেখা দেবে তাও সে বিস্তারিত বলে দেয় ৷ সে এ দুনিয়ার পরিসমাপ্তি এবং আরেকটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠার অবস্থা অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে, এ পরিবর্তনের সমস্ত স্তর এক এক করে বলে দেয়, দৃষ্টির সামনে পরজগতের পূর্ণ চিত্র অংকন করে এবং সেখানে মানুষ কিভাবে আরেকটি জীবন লাভ করবে তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করে, কিভাবে তার পার্থিব জীবনের কার্যাবলীর হিসেব-নিকেশ হবে, কোন কোন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, কেন অনস্বীকার্য রূপে তার সামনে তার আমলনামা পেশ করা হবে ৷ সেসব কাজের প্রমাণ স্বরূপ কি ধরনের অকাট্য সাক্ষসমূহ পেশ করা হবে, পুরস্কার ও শাস্তিলাভকারী কেন পুরস্কার ও শাস্তিলাভ করবে ৷ পুরস্কার লাভকারীরা কি ধরনের পুরস্কারলাভ করবে এবং শাস্তি প্রাপ্তরা কি কি ভাবে তাদের কার্যাবলীর মন্দফল ভোগ করবে, এ ব্যাপক বিষয়ে যে বক্তব্য এ গ্রন্থে পেশ করা হয়েছে তার মর্যাদা এমন নয় যে তার রচয়িতা তর্ক শাস্ত্রের কিছু যুক্তিতর্ক একত্রিত করে কতকগুলো অনুমানের প্রসাদ নির্মাণ করেছেন, বরং এর রচয়িতা প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান, রাখের তার দৃষ্টি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু দেখছে ৷ সমস্ত সত্য তাঁর কাছে উন্মুক্ত ৷ মহাবিশ্বের গোটাটাই তাঁর কাছে একখানা উন্মুক্ত গ্রন্থের মত ৷ মানব জাতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই শুধু নয় ৷ লয় প্রাপ্তির পর তার অপর জীবনও তিনি যুগপৎ এক দৃষ্টিতে দেখছেন এবং শুধু অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে নয়, জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষকে পথপ্রদর্শন করেছেন ৷ এ গ্রন্থ যেসব সত্যকে তাত্বিকভাবে পেশ করে থাকে আজ পর্যন্ত তার কোন একটিকে ভুল বা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায়নি ৷ বিশ্ব-জাহান ও মানুষ সম্পর্কে সে যে ধারণা পেশ করে তা সমস্ত দৃশ্যমান বস্তু ও ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পেশ করে এবং জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় গবেষণার ভিত্তি রচনা করে ৷ দর্শন বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের সমস্ত সাম্প্রতিকতম প্রশ্নের জবাব তার বাণীতে বর্তমান এবং এসবের মধ্যে এমন একটা যৌক্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান, যে, ঐগুলোকে ভিত্তি করে একটা পূর্ণাংগ সুসংবদ্ধ ও ব্যাপক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে ওঠে ৷ তাছাড়া জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে সে মানুষকে যে বাস্তব পথনির্দেশনা দিয়েছে তা শুধু যে, সর্বোচ্চ মানের যুক্তিগ্রাহ্য ও অত্যন্ত পবিত্র তাই নয় ৷ বরং ১৪ শত বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন আনাচে কানাচে অসংখ্য মানুষ কার্যত তার অনুসরণ করেছে ৷ আর অভিজ্ঞতা তাকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা বলে প্রমাণিত করেছে ৷ এরূপ মর্যাদার মানব রচিত কোন গ্রন্থ কি দুনিয়ায় আছে কিংবা কোন সময় ছিল, যা এ গ্রন্থের মোকাবিলায় এনে দাঁড় করিয়ে যেতে পারে?
চারঃ এ গ্রন্থ পুরোটা একেবারে লিখে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়নি ৷ বরং কতকগুলো প্রাথমিক নির্দেশনা নিয়ে একটি সংস্কার আন্দোলন শুরু করা হয়েছিল ৷ এরপর ২৩ বছর পর্যন্ত উক্ত আন্দোলন যেসব স্তর অতিক্রম করেছে তার অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে ঐ আন্দোলনের নেতার মুখ দিয়ে এর বিভিন্ন অংশ কখনো দীর্ঘ ভাষণ এবং কখনো সংক্ষিপ্ত বাক্যের আকারে উচ্চারিত হয়েছে ৷ অতপর এ কার্যক্রম পূর্ণতা লাভের পর বিভিন্ন সময়ে মুখ থেকে উচ্চারিত এসব অংশ পূর্ণাংগ গ্রন্থের আকারে সাজিয়ে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়েছে যাকে, 'কুরআন' নামে অভিহিত করা হয়েছে ৷ আন্দোলনের নেতার বক্তব্য হলো, এসব ভাষন ও বাক্য তার রচিত নয়, বরং তা বিশ্ব -জাহানের রবের পক্ষ থেকে তার কাছে নাযিল হয়েছে ৷ কেউ যদি একে ঐ নেতার নিজের রচিত বলে অভিহিত করে , তাহলে সে দুনিয়ার গোটা ইতিহাস থেকে এমন একটি নজির পেশ করুক যে, কোন মানুষ বছরের পর বছর নিজে একাধারে একটি বড় সংঘবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কখনো একজন বক্তা এবং কখনো একজন নৈতিক শিক্ষক, হিসেবে, কখনো একটি মজলূম দলের নেতা হিসেবে , কখনো একটি রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে, কখনো আইন ও বিধান দাতা হিসেবে মোটকথা অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থেকে ভিন্ন ভিন্ন যেসব বক্তব্য পেশ করেছেন, কিংবা কথা বলেছেন, তা একত্রিত হয়ে একটি পূর্ণাংগ , সুসংবদ্ধ ও সর্বাত্মক চিন্তা ও কর্মপ্রণালীতে পরিণত হয়েছে এবং তার মধ্যে কোথাও কোন বৈপরীত্য পাওয়া যায় না , তার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটিই মাত্র কেন্দ্রীয় ধারণা ও চিন্তার ধারাবাহিকতা সক্রিয় দেখা যায় ৷ প্রথম দিন থেকে তিনি তাঁর আন্দোলনের যে ভিত্তি বর্ণনা করেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত সে ভিত্তি অনুসারে আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যাবলীর এমন একটি ব্যাপক ও সার্বজনীন আদর্শ নির্মাণ করেছেন যার প্রতিটি অংশ অন্যান্য অংশের সাথে পূর্ণরূপে সামঞ্জস্য রাখে এবং এ সংকলন অধ্যয়নকারী কোন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিই একথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে আন্দোলনের সূচনাকালে আন্দোলনকারীর সামনে আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত গোটা আন্দোলনের পূর্ণাংগ চিত্র বর্তমান ছিল ৷ এমন কখনো হয়নি মধ্য পথে কোন স্থানে তাঁর মাথায় এমন কোন ধারণার উদ্ভব হয়েছে যা পূর্বে তার কাছে পরিস্কার ছিল না অথবা যা পরে পরিবর্তন এমন কোন মানুষ যদি কোন সময় জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে তা দেখিয়ে দেয়া হোক ৷
পাঁচঃ যে নেতার মুখ থেকে এসব ভাষণ ও বাণীসমূহ উচ্চারিত হয়েছে, তিনি হঠাৎ কোন গোপন আস্তানা থেকে শুধু এগুলো শোনানোর জন্য বেরিয়ে আসতেন না এবং শোনাবার পর আবার কোথাও চলে যেতেন না ৷ এ আন্দোলন শুরু করার পূর্বেও তিনি মানব সমাজে জীবন যাপন করেছিলেন এবং পরও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবসময় ঐ সমাজেই থাকতেন ৷ মানুষ তার আলোচনা ও বক্তব্যের ভাষা এবং বাচনভংগীর সাথে ভালভাবে পরিচিত ছিল ৷ হাদীসসমূহ তার একটি বড় অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে ৷ পরবর্তী সময়ের আরবী ভাষাবিজ্ঞ মানুষ যা পড়ে সহজেই দেখতে পারে না যে, সেই নেতার বাচনভংগী কেমন ছিল ৷ তার স্বাভাষী মানুষ সে সময়ও পরিস্কার উপলব্ধি করতো এবং আরবী ভাষা জানা মানুষ আজও উপলব্ধি করে যে, এ গ্রন্থের ( কুরআন, ) ভাষা ও বাকরীতি সেই নেতার ভাষা ও বাকরীতি থেকে অনেক ভিন্ন ৷ এমন কি তার ভাষণের মধ্যে যেখানে এ গ্রন্থের কোন বাক্যের উদ্ধৃতি আসে তখন উভয়ের ভাষার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় ৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীতে কোন মানুষ কি কখনো দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্টাইলে বছরের পর বছর কথা বলার ভান করতে সক্ষম হয়েছে ব হতে পারে অথচ দুটিই যে, একই ব্যক্তির স্টাইলে , সে রহস্য কখনো প্রকাশ পায় না? এ ধরনের ভান বা অভিনয় করে আকস্মিক বা সাময়িকভাবে সফল হওয়া সম্ভব ৷ কিন্তু একাধারে ২৩ বছর পর্যন্ত এমনটি হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, এক ব্যক্তি যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অহী হিসেবে কথা বলে তখন তার ভাষা ও স্টাইল এক রকম হবে আবার যখন নিজের পক্ষ থেকে কথা বলে যা বক্তৃতা করে তখন তার ভাষা ও স্টাইলে সম্পূর্ণ আরেক রকম হবে ৷
ছয়ঃ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দান কালে সেই নেতা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সম্মুখীন হয়েছেন ৷ কখনো তিনি বছরের পর বছর স্বদেশবাসী ও স্বগোত্রীয় লোকদের উপহাস, অবজ্ঞা ও চরম জুলুম -নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কখনো তাঁর সংগী-সাথীদের ওপর এমন জুলুম করা হয়েছে যে, তারা দেশ ছেড়ে চল যেতে বাধ্য হয়েছেন ৷ কখনো শত্রুরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, কখনো তার নিজেকেই স্বদেশভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছে ৷ কখনো তাঁকে চরম দারিদ্রকষ্ট সইতে এবং ভুখা জীবন কাটাতে হয়েছে ৷ কখনো তাঁকে একের পর এক লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং তাতে বিজয় ও পরাজয় উভয়টিই এসেছে ৷ কখনো তিনি দুশমনদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন এবং যেসব দুশমন তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরকেই তাঁর সামনে অধোবদন হতে হয়েছে ৷ কখনো তিনি এমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করেছেন যা খুব কম লোকের ভাগ্যেই জুটে থাকে ৷ একথা স্পষ্ট যে, এ ধরনের নানা পরিস্থিতিতে কোন মানুষের আবেগ অনুভূতি এক রকম থাকতে পারে না ৷ এসব রকমারি ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে সেই নেতা যখনই তার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে কথা বলেছেন তখনই তার মধ্যে স্বভাবসূলভ মানবোচিত আবেগ অনুভূতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে যা এরূপ ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে একজন মানুষের মনে সচারাচার সৃষ্টি হয়ে থাকে ৷ কিন্তু এসব পরিস্থিতিতে তার মুখ হতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অহী হিসেবে যেসব কথা শোনা গিয়েছে তা ছিল মানবিক আবেগ-অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ৷ কোন একটি ক্ষেত্রেও কোন কট্রর সমালোচকও অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতে পারবে না যে, এখানে মানবিক আবেগ-অনুভূতির প্রভাব পড়েছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে ৷
সাতঃ এ গ্রন্থে যে ব্যাপক ও পূর্ণাংগ জ্ঞান পাওয়া যায় তা সে যুগের আরববাসী, রোমান, গ্রীক, ও ইরানবাসীদের কাছে তো দূরের কথা এ বিংশ শতাব্দীর বড় বড় পণ্ডিতদেরও কারো ঝুলিতে নেই ৷ বর্তমানে অবস্থা এই যে, দর্শন , বিজ্ঞান এবং সমাজ বিদ্যার কোন একটি শাখার অধ্যয়নে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরই কেবল কোন ব্যক্তি জ্ঞানের সেই শাখার সর্বশেষ সমস্যাবলী জানতে পারে ৷ তারপর যখন গভীর দৃষ্টি নিয়ে সে কুরআন অধ্যয়ন করে তখন জানতে পারে যে, এ গ্রন্থে সেসব সমস্যার একটি সুস্পষ্ট জবাব বিদ্যমান ৷ এ অবস্থা জ্ঞানের কোন একটি শাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসব জ্ঞান বিশ্ব-জাহান ও মানুষের সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই সঠিক ৷ কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে যে, ১৪ শত বছর পূর্বে আরব -মরুর এক নিরক্ষর ব্যক্তি জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমন ব্যাপক দক্ষ ছিল এবং তিনি প্রতিটি মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা -ভাবনা করে সেগুলোর একটি পরিস্কার ও চূড়ান্ত জওয়াব খুঁজে পেয়েছিলেন?
কুরআনের মু'জিযা হওয়ার যদিও আরো অনেক কারণ আছে ৷ তবে কেউ যদি শুধু এ কয়টি কারণ নিয়ে চিন্তা করে তাহলে সে জানতে পারবে কুরআন নাযিল হওয়ার যুগে কুরআনের মু'জিযা হওয়া যতটা স্পষ্ট ছিল আজ তার চেয়ে অনেক গুণে বেশী স্পষ্ট এবং ইনশায়াল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত স্পষ্টতম হতে থাকবে।


=================


কোরআন মূলত আল্লাহর কালাম। এজন্য কোরআনে কারিম লৌহে আমল থেকে লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিল। যেমন কোরআনে আছে, বরং এটাতো সম্মানিত কিতাব যা লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত। অতঃপর বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ী পুরো কোরআনে কারিমকে কদরের রজনীতে লৌহে মাহফুজ থেকে সামায়ে দুনিয়ায় বা প্রথম আকাশে বাইতুল ইজ্জত নামক ঘরে অবতীর্ণ করা হয়। বাইতুল ইজ্জতকে বাইতুল মামুরও বলে, যা কাবা শরিফের ঠিক বরাবর প্রথম আসমানে অবস্থিত। অতঃপর জিবরাইল (আ.) বাইতুল ইজ্জত থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী অল্প অল্প নিয়ে হুজুর (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হতেন। যার ধারাবাহিকতা ২৩ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে।

 

পবিত্র কোরআনের সংকলন পদ্ধতি: পবিত্র কোরআন একত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে আরবিতে জমউল কোরআন বলা হয়। জমা শব্দটি দু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সে হিসেবে আল কোরআন জমা করা দুই প্রকার- প্রথমত: হিফজ বা মুখস্থের মাধ্যমে আল কোরআন একত্র ও সংরক্ষণ করা। দ্বিতীয়ত: লিখিত আকারে সমগ্র কোরআন একত্র ও সংরক্ষণ করা।
প্রথম প্রকার: হিফজ বা মুখস্থের মাধ্যমে আল কোরআন একত্র ও সংরক্ষণ করা। আল্লাহ তাআলার বাণী, কোরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার জিহ্বাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না। নিশ্চয়ই এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমার দায়িত্বে। অতঃপর যখন আমি তা পাঠ করি তখন তুমি তার পাঠের অনুসরণ কর। তারপর তার বর্ণনার দায়িত্ব আমারই। [সূরা আল কিয়ামাহ:১৬-১৯] উক্ত আয়াতে জমা শব্দের অর্থ মুখস্থ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোরআন জমা ও সংরক্ষণ করা। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হিসেবে পেশ করা যায়।
তিনি বলেন, রাসূলের (সা.) প্রতি যখন কোরআন নাজিল হওয়া শুরু হতো, তিনি তা মুখস্থ করার জন্য অত্যধিক শ্রম দিতেন। তিনি তার জিহবা নাড়াতেন এই ভয়ে যে পাছে নাজিলকৃত ওহীর কোনো কিছু ছুটে না যায়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন- কোরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার জিহবাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না। নিশ্চয়ই এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমার দায়িত্বে।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তোমার বক্ষে তা একত্র করা, অতঃপর তুমি তা পড়বে। অতঃপর যখন আমি তা পাঠ করি তখন তুমি তার পাঠের অনুসরণ কর। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এরপর থেকে তিনি মনোযোগসহ শুনতেন ও চুপ থাকতেন এবং জিবরাইল (আ.) চলে গেলে তিনি তা পড়তেন যেভাবে জিবরাইল (আ.) তাঁকে পড়িয়েছেন। [বুখারি, খণ্ড:-০১, পৃ:৪; মুসলিম, খণ্ড:-০১, পৃ:৩৩০-৩৩১]
চতুর্থ হিজরিতে বীরে মাউনার বেদনাদায়ক ঘটনায় ৭০ জন সাহাবির ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, তারা সবাই ভালো কোরআন তেলাওয়াতকারী ছিল। তারা দিনের বেলায় কাঠ কেটে আহলে সুফফার লোকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করত এবং কোরআন শিখত ও শিখাত আর রাতে আল্লাহর নিকট দোয়া ও নামাজ আদায়ে ব্যস্ত থাকত। সাহাবায়ে কিরামের এ আগ্রহের ফলাফল এই ছিল যে, রাসূল (সা.) -এর জীবদ্দশায়ই হাফেজগণের একটি বড় দল গড়ে উঠেছিল। ওই দলের মধ্যে ছিল- ১। আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ২। ওমর ফারুক (রা.) ৩। ওসমান গনী (রা.) ৪। আলী (রা.) ৫। তালহা (রা.) ৬। সাদ (রা.) ৭। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ৮। হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.) ৯। সালেম (রা.) ১০। আবু হুরায়রা (রা.) ১১। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার (রা.) ১২। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ১৩। মুয়াবিয়া (রা.) ১৪। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) ১৫। আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) ১৬। আয়েশা (রা.) ১৭। হাফসা (রা.) ১৮। উম্মু সালামা (রা.) এই নামগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ১১ হিজরিতে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০০ হাফেজে কোরআনের শাহাদাত বরণে এ কথা স্পষ্ট যে, ওই সময় পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ হাফেজ গড়ে উঠেছিল। মুখস্থ করার মাধ্যমে কোরআন মাজিদ সংরক্ষণের এ ধারা নবী (সা.)-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা চালু থাকবে। (ইনশাআল্লাহ)।
দ্বিতীয় প্রকার: লিখিত আকারে পবিত্র কোরআন জমা করা। লিখিত আকারে মোট তিনবার পবিত্র কোরআন জমা করা হয়েছে। প্রথম বার: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায়। দ্বিতীয়বার: আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-র খেলাফত আমলে। তৃতীয়বার: উসমান (রা.) খেলাফত আমলে।

প্রথমবার: রাসূল (সা.)-এর যুগে পবিত্র কোরআন জমা করা তথা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা। শুধু বক্ষে সংরক্ষণের রীতি অনুসরণ করেই পবিত্র কোরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে যত্ন নেয়া হয়নি। বরং লিখিত আকারে সংরক্ষণের ওপরও সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। লিখিত আকারে কোরআন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহী লেখার জন্য বড় বড় সাহাবীদের (রা.) দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং যখনই কোনো আয়াত নাজিল হত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের তা লিখে নেয়ার নির্দেশ দিতেন। কোন সূরার কোথায় তা রাখতে হবে তাও বলে দিতেন।  কোরআন মুখস্থ করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া সত্ত্বেও কোরআন লিখে রাখার গুরুত্বের কথা রাসূল (সা.) মোটেও ভুলে যাননি। এ উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) শিক্ষিত সাহাবাগণকে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, অহি নাজিল হওয়া মাত্রই তারা তা লিখে রাখবে। যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) তার নির্দিষ্ট অহির লেখক ছিল। এ ছাড়াও তিনি সরকারি অন্যান্য বিষয়াবলি লিখে রাখার দায়িত্বপ্রাপ্তও ছিলেন। স্বয়ং রাসূল (সা.) তাকে বিদেশি ভাষা শেখার এবং লেখার জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অহি লেখকেরা হলেন- ১. আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ২. ওমর ফারুক (রা.) ৩. ওসমান (রা.) ৪. আলী (রা.) ৫. ওবাই ইবনে কা’ব (রা.) ৬. যুবাইর ইবনে আওয়াম (রা.) ৭. মোয়াবিয়া বিন সুফিয়ান (রা.) ৮. মুগীরা ইবনে শো’বা (রা.) ৯. খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) ১০. আবান ইবনে সাঈদ (রা.) ১১. আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ ইবনে আস (রা.) যায়েরদ ইবনে সাবেত (রা) জাহেলিয়াতের যুগেও লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। [উলুমুল কোরআন, ড. মাওলানা শাসমুল হক সিদ্দিক]
রাসূল (সা.) তাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, সে যেন সাহাবা কেরামগণকে লিখা শিখায়, বলা হয়ে থাকে যে, নবী (সা.) এর যুগে অহি লেখকগণের সংখ্যা ৪০ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। রাসূল (সা.)-এর অভ্যাস ছিল যে, যখনই কোরআন কারীমের কোনো আয়াত অবতীর্ণ হতো তখন তিনি অহি লেখকদেরকে পরিপূর্ণভাবে নির্দেশ দিতেন যে, এ আয়াতটি ওমুক ওমুক সূরায় ওমুক ওমুক আয়াতের পরে লিখ, তখন ওহী লেখকগণ পাথর, চামড়া, খেজুরের ডাল, গাছের পাতা, হাড্ডি বা কোনো কিছুর ওপর লিখে রাখতেন। এভাবে নবী (সা.)-এর যুগে কোরআন কারীমের এমন একটি কপি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল যা রাসূল (সা.) নিজের তত্ত্বাবধানে লিখেয়েছেন। বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল (সা.) -এর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত অগোছালোভাবে ১৭টির অধিক মাসহাফের (কোরআনের কপি) সন্ধান পাওয়া যায়। [দেখুন: ইবনে হাযম, জাওয়ামিউস সীরা, পৃধ২৬-২৭; ইবনুল কাইয়েম, যাদুল মাআদ, খণ্ড:১, পৃ:২৯]
দ্বিতীয় বার: আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফত আমলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর সিদ্দীক (রা.) খলিফা হন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের ওয়াফাতের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যাপকহারে আরবদের ইসলাম থেকে ফিরে যাওয়ার অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির  মোকাবিলা করা। আবু বকর সিদ্দীক (রা.) সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠান। এ সূত্রেই ১২ হিজরিতে ইয়ামামার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে হাফেজ সাহাবীদের (রা.) বড় একটি সংখ্যা অংশ নিয়েছিলেন। হাফেজ সাহাবীদের ৭০ জন তাতে শাহাদতবরণ করেন। বিষয়টি উমর ইবনুল খাত্তাবকে (রা.) আতঙ্কিত করে তুলল। তিনি আবু বকর সিদ্দীক (রা.) -এর কাছে গেলেন এবং লিখিত আকারে সমগ্র কোরআন একত্রীকরণের ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন; কেননা অন্যকোনো যুদ্ধে এভাবে হাফেজ সাহাবীদের শাহাদত বরণ হলে আল কোরআন হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। শুরুতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বিষয়টি মেনে নিতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম করে যাননি, তা করা উচিত হবে না। তবে উমর (রা.) তার প্রস্তাব বার বার উপস্থাপন করে গেলেন। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা আবু বকর সিদ্দীক (রা.) অন্তরকে এ ব্যাপারে খুলে দিলেন। তিনি সম্মত হলেন এবং যায়েদ ইবনে ছাবেতকে (রা.) ডেকে পাঠালেন। আবু বকর সিদ্দীক (রা.) উমরের (রা.) পরামর্শের ব্যাপারে তাকে জানালেন। শুরুতে আবু বকর সিদ্দীকের (রা.) মতোই যায়েদ ইবনে ছাবেত (রা.) অসম্মতি জানালেন। যে কাজটি রাসূল (সা.) করে যাননি সে কাজে আবু বকর এবং উমর (রা.) কী করে হাত দিচ্ছেন, তা ভেবে তিনি নিজেকে বুঝাতে পারছিলেন না। উপরন্তু ছড়িয়ে থাকা কুরাআন একত্রীকরণ এমন এক কঠিন কাজ যা, যায়েদ ইবনে ছাবেতের (রা.) ভাষ্যানুযায়ী- এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কোনো পাহাড় সরিয়ে নেয়ার চেয়েও কঠিন। (বুখারী) তবে পরবর্তীতে তিনি সম্মত হলেন এবং হিফযকৃত ও লিখিত আকারে ছড়িয়ে থাকা আল কোরআননের নানা অংশ একত্রীকরণের মহান কাজে হাত দিলেন। যায়েদ ইবনে ছাবেত (রা.) যথার্থরূপে তার দায়িত্ব পালন করে একত্রীকৃত কোরআন আবু বকর সিদ্দীক (রা.) কাছে সোপর্দ করেন। আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-র মৃত্যু পর্যন্ত এ কোরআন তার কাছেই সংরক্ষিত থাকে। ১৩ হিজরিতে যখন তিনি ইন্তেকাল করেন তখন তা উমর (রা.)-এর কাছে চলে যায়। উমর (রা.)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত এ কোরআন তার কাছেই থাকে। এরপর তা উমর (রা.)-এর মেয়ে হাফসার (রা.) কাছে সংরক্ষিত থাকে। উসমান (রা.)-এর খিলাফতের প্রাথমিক পর্যায়ে এ কোরআন তার কাছেই থাকে। [উলুমুল কোরআন, ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক]
তৃতীয় বার: উসমান (রা.) খেলাফত আমলে। আল কোরআন নাজিল হয়েছিল মূলত কুরাইশদের আরবি উচ্চারণ অনুযায়ী। তবে এর পাশাপাশি আরও ছয়টি আরবি উপভাষায়ও কোরআন চর্চা ও তিলাওয়াতের অনুমোদন ছিল। জিবরাইল আলাইহিস সালাম সে উপভাষাগুলোতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরআন চর্চা শেখান। বরং কোরআন নাজিলের সময় সাত ভাষার প্রত্যেকটির উচ্চারণ ভঙ্গির ও শব্দের গঠনাকৃতির পার্থক্যসহ-ই নাজিল করতেন। সে হিসেবে পবিত্র কোরআন সাত হরফ বা ভাষায় নাজিল হয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীতে আসছে। উসমানের (রা.) খেলাফতের পূর্বেই ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার আওতাভুক্ত হয় নতুন নতুন বহু অঞ্চল। ফলে কোরআনের হাফেজগণ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েন। হাফেজদের সবাই যে কুরাইশদের আঞ্চলিক উচ্চারণে কোরআন মুখস্থ করেছিলেন বিষয়টি সে রকম নয়। বরং প্রত্যেকেই যার অঞ্চলের উচ্চারণরীতি অনুযায়ী কোরআন মুখস্থ করেছেন।
পরিশেষে তারা যখন বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়লেন, নিজ নিজ উচ্চারণ রীতি অনুযায়ী ওই শহরের লোকদেরকে কোরআন শেখাতে থাকেন। এরপর যখন কোনো উপলক্ষে- যেমন কোনো দাওয়াতী অভিযানে- বিভিন্ন শহরের লোকজন একত্র হতেন, এক অঞ্চলের লোকজন অন্য অঞ্চলের লোকদের কিরাত শুনে আশ্চর্য হতেন।  মূলত আরবদের কেউ যেন- তার ভাষার উচ্চারণরীতি বা শব্দের গঠন যাই হোক না কেন- এই অজুহাতে যাতে কোরআন থেকে দূরে না থাকে যে, কোরআন আমাদের ভাষায় নাজিল হয়নি, আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা নজর দেননি। অথবা কুআইশদের ভাষায় নাজিল হওয়া আরবি আমাদের পক্ষে তিলাওয়াত করা সম্ভব নয়। এসব বিবেচনায় রেখে এবং আরও অনেক কারণে আল কোরআন সাত ভাষা তথা আঞ্চলিক উচ্চারণরীতির অনুবর্তিতায় নাজিল করা হয়।
সাত আরব্য আঞ্চলিক ভাষায় কুআরান শেখা লোকদের প্রথম লক্ষ্যণীয় সমাবেশ ঘটে আরমেনিয়া আজারবাইন যুদ্ধে। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন ইরাকবাসী ও সিরিয়াবাসী মুসলমানরা। ইরাকবাসীরা কোরআন শিখতেন আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-র উচ্চারণরীতি অনুযায়ী আর সিরিয়াবাসীরা কোরআন শিখতেন উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর উচ্চারণরীতি অনুযায়ী। তারা যখন একে অপরের কোরআন শুনে ভাবলেন যে, অপর পক্ষ আল কোরআন পাঠে মারাত্মক ধরনের ভুল করছে। তারা একে অপরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করতে লাগলেন। [দেখুন ইবনে হাজার আল আসকালানী, ফাতহুল বারী, খণ্ড:৯, পৃ:১৮]
হুযায়ফা ইবনে ইয়ামানও এ যুদ্ধদ্বয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণ কোরআন শেখা লোকদের পরস্পরে ঝগড়া-বিতণ্ডা প্রকটভাবে লক্ষ্য করলেন এবং বিষয়টি উম্মতের মধ্যে বিশাল ইখতিলাফের কারণ হবে ভেবে উসমান (রা.)-এর কাছে ছুটে গেলেন। তিনি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে উসমানকে (রা.) বললেন, ‘ইহুদি নাসারাদের ন্যায় ইখতিলাফ-মতানৈক্য লিপ্ত হওয়ার পূর্বেই আপনি উম্মতকে বাঁচান। অতঃপর উসমান (রা.) হাফসাকে (রা.) এই বলে বার্তা পাঠান যে আপনি আমাদের কাছে কোরআনের সহীফাগুলো পাঠিয়ে দিন। আমরা তা থেকে অনুলিপি তৈরি করে আপনার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেব। হাফসা (রা.) তা উসমান (রা.) -এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এমনকি খোদ মদীনা মুনাওরায় কোরআন পাঠ নিয়ে এ ধরনের ইখতিলাফ-মতানৈক্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। মদীনায় যারা বাচ্চাদের কোরআন শেখাতেন তাদের প্রত্যেকেই যার যার উচ্চারণরীতি অনুযায়ী শেখাতেন। এরপর বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে কোরআন-শেখা বাচ্চারা যখন একত্র হতো, একজন অপরজনের কোরআন পাঠকে ভুল বলত, অশুদ্ধ ভেবে তা অস্বীকার করত। উসমান (রা.) এ কথা জানতে পেরে বক্তব্য দিয়ে বললেন, ‘আপনারা আমার পাশেই মতানৈক্য ও ভুলভ্রান্তি করছেন। আর যারা আমার থেকে দূরে বিভিন্ন অঞ্চলে তারা তো আরও কঠিন ভুলভ্রান্তি ও মতানৈক্য করছে। হে মুহ্ম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ, আপনার মানুষের জন্য একটি ‘ইমাম’ লিখে দিন। [ইবনে আবি দাউদ, আল মাসাহেফ, পৃ:২৯]

উসমান (রা.)-এর শাসনামলের পর কোরআন সংকলনের চিত্র: উসমান (রা.) কোরআন মাজীদের যে কপিটি প্রস্তুত করিয়েছিলেন তা ছিল যের, যবর, পেশ এবং নোক্তা (ফোটা) বিহীন। আরবি ভাষীদের জন্য এ ধরনের কোরআন তেলাওয়াত করা ততটা কঠিন ছিল না। কিন্তু অনারবদের জন্য তা যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। বলা হয়ে থাকে যে সর্বপ্রথম বসরার গভর্নর যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান একজন আলেম আবুল আসওয়াদ আদদুয়াইলীকে এ বিষয়ে একটি সমাধান খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি অক্ষরগুলোর ওপর নোক্তা (ফোটা) দেয়ার পরামর্শ দিলেন এবং তা করা হল। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান (৬৫-৮৬ হি.) তার শাসনামলে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবনে ইয়ামার এবং নাসার বিন আসেম লাইসী ও হাসান বাসরী (রাহিমাহুমুল্লাহর) পরামর্শক্রমে যের, যবর, পেশ সংযোগ করেছে। আবার বলা হয়ে থাকে যে, হামযা এবং তাশদীদের আলামতসমূহ খালীল ইবনে আহমদ (রা.) স্থাপন করেছেন।
সাহাবা আজমাইন এবং তাবেয়ীনগণের অভ্যাস ছিল যে, তারা সপ্তাহে একবার কোরআন মাজীদ খতম করতেন। এ উদ্দেশ্যে তারা পূর্ণ কোরআন মাজীদকে সাত ভাগে ভাগ করেছেন, যাকে হিযব বা মানজীল বলা হয়। মূলত এই হিযব বা মানজীলের ভাগ সাহাবায়ে কিরামের যুগে হয়েছিল। অবশ্য কোরআন মাজীদকে ৩০ পারায় ভাগ করা, প্রত্যেক পারাকে চার ভাগে ভাগ করা অর্থাৎ চতুর্থাশে, অর্ধেক, তৃতীয়াংশ, এমনকি রুকুর আলামত, আয়াত নাম্বার, ওয়াকফ (থামার চিহ্ন) যোগ করা ইত্যাদি মাসহাফ উসমানী তথা উসমান (রা.)-এর যুগে একত্রীতকরণ কোরআনের পরে করা হয়েছে। যার সংযোজন একমাত্র কোরআন মাজীদের তেলাওয়াত এবং মুখস্থ করাকে সহজ করার জন্য করা হয়েছে। কোরআন মাজীদ অবতীর্ণের সময়কালের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং শরীয়তের দৃষ্টিতেও এর কোনো বিশেষ বিধান নেই।
পবিত্র কোরআনে যের, যবর, পেশ ও নুকতা সংযোজন: হযরত উসমান রা. যে মুসহাফ তৈরি করেছেন তাতে হরফসমূহে নুকতা ও হরকত যের, যবর ও পেশ ছিল না। পরবর্তীতে কে এই মহৎ কাজটি করেছেন-এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভেদ আছে। তবে আল্লামা তকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম ‘উলূমুল কোরআন’-এ বলেন, এ সম্পর্কিত সকল বর্ণনা সামনে রাখলে প্রতীয়মান হয় যে, হরকত (যের, যবর ও পেশ) সর্বপ্রথম হযরত আবুল আসওয়াদ দুয়ালী রাহ. আবিষ্কার করেন। কিন্তু হরকতের রূপ এখন যেমন দেখা যায় তেমন ছিল না। তখন ছিল ফোঁটার মতো। যবরের জন্য উপরে এক ফোঁটা দেওয়া হতো, যেরের জন্য নিচে এক ফোঁটা আর পেশের জন্য সামনে এক ফোঁটা দেওয়া হতো। তানভীনের জন্য দুই ফোঁটা ব্যবহৃত হত। এরপর খলীল বিন আহমদ রাহ. হামযাহ ও তাশদীদের বর্তমান রূপটি আবিষ্কার করেন। এরপর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইয়াহইয়া বিন ইয়ামার (রহ.) ও নাসর বিন আসেম (রহ.) -এর মাধ্যমে কোরআনে কারীমে হরফসমূহে নুকতা লাগানোর ব্যবস্থা করেন। এই সময়ই মূলত নুকতা ও হরকতের পার্থক্যের উদ্দেশ্যে হরকতের বর্তমান রূপটি অবলম্বন করা হয়। [আলইতকান ২/৪১৯; সুবহুল আ‘শা ৩/১৬০-১৬১; আলবুরহান ১/২৫০; উলূমুল কোরআন পৃ. ১৯৫]
কোরআন মুদ্রণের ইতিহাস: কোরআন নাযিলের সূচনালগ্ন থেকে আরম্ভ করে দীর্ঘকাল পর্যন্ত হস্তলিপির সাহায্যে এর সঙ্কলনের কাজ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। একদল নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান এ কাজটিকে নিজেদের জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। তারা কোরআনের অসংখ্য কপি তৈরি করে মুসলিম বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রেরণ করতে থাকেন। ফলে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার বহু পূর্বেই বিশ্বের আনাচে-কানাচে কোরআনের লক্ষ লক্ষ কপি পৌঁছে যায়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ‘হিংক্যাল ম্যান’ ‘হ্যামবুগ’ শহরে সর্বপ্রথম কোরআন মুদ্রণের কাজ সম্পন্ন করেন। অবশ্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, এরও বহু পূর্বে জনৈক প্রাচ্যবিদের বিশেষ উদ্যোগে ‘আল-বান্দকিয়া’ নামক স্থানে কোরআন মুদ্রিত হয়েছিল। তবে তখন কে এই মুদ্রণকাজ সম্পাদন করেছিলেন, তা নিশ্চিত জানা যায় নি। যাক, এরপর ‘মারাকি’ নামক আরেক প্রাচ্যবিদ ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পাডু’ শহরে কোরআন মুদ্রণ করেন। কিন্তু খ্রিস্টানরা চরম ইসলাম বিদ্বেষী হওয়ার কারণে তাদের মুদ্রিত এসব কপি মুসলিম বিশ্বে আদৌ সমাদৃত হয়নি।
মুসলমানদের মাঝে সর্বপ্রথম মাওলায়ে ওসমান রহ. কোরআন মুদ্রণের গৌরব অর্জন করেন। তিনি ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সেন্টপিটার্স শহরে ইসলামী ছাপাখানায় তা সম্পন্ন করেন। তার মুদ্রিত কপি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত হয়। উপরন্তু প্রায় একই সময়ে ‘কাযান’ শহরেও মুসলমানদের ছাপাখানায় কোরআন মুদ্রিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তৎপরবর্তীতে ইরানের তেহরান ও তিবরিয শহরে আঞ্চলিক মুলমানদের উদ্যোগে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে নতুনভাবে কোরআন মুদ্রিত হয়। এ দিকে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘লিপযিগ’ শহরে প্রাচ্যবিদ মিস্টার ফ্লুযিল অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নতুনভাবে কোরআন মুদ্রণ করেন। তার মুদ্রিত কপি ইউরোপে ব্যাপক সমাদৃত হলেও মুসলিম বিশ্বে কোনো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এর কিছুকাল পর পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর কয়েকবার কুরআান মুদ্রিত হয়।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে কোরআন মুদ্রিত হয় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে। এরপর মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিজের তত্ত্বাবধানে নতুনরূপে কোরআন মুদ্রণ করেন; যা পুরো বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত হয়। এরপর থেকে পৃথিবীর সর্বত্র কোরআন মুদ্রণের কাজ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে কোরআন শরিফের সবচেয়ে বড় ছাপাখানা হল ‘বাদশাহ ফাহাদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প’। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ খাদিমুল হারামাইনিশ শরিফাইন ফাহাদ ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তা প্রতিষ্ঠা করেন। যা দৈনিক ৫০ হাজার কপি কোরআন ছাপার ক্ষমতা রাখে। এ প্রকল্প থেকে শুধু মূল কোরআন শরিফই নয় বরং বিভিন্ন ভাষায় কোরআনের অনুবাদ ও তাফসির ছেপে সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীদের অঞ্চলে বিতরণ করা হয়। 
সম্পাদনা: ফকির কামরুল

মূল: লিংক:

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...