প্রশ্ন ৪০ : পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা কুরআনের কোথায় আছে ?


﴿فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ﴾

কাজেই ২২   আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো ২৩   যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় এবং যখন তোমাদের সকাল হয়৷  (সুরা রূম : আয়াত ১৭ )

২২ . এখানে "কাজেই " শব্দটি এ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে যে, যখন তোমরা জানতে পারলে ঈমান ও সৎকাজের এহেন পরিণাম হবে এবং কুফরী ও মিথ্যা আরোপের এহেন পরিণাম হবে তখন তোমাদের এ ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত৷ তাছাড়া "কাজেই" শব্দটির এ অর্থও হয় যে, মুশরিক ও কাফেররা পরকালীন জীবনকে অসম্ভব গণ্য করে আল্লাহকে মূলত অক্ষম ও অপারগ ঘোষণা করছে৷ কাজেই এর মোকাবিলায় তুমি আল্লাহর প্রশংসা করো, তাঁর মহিমা প্রচার করো এবং এ দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত একথা ঘোষণা করে দাও৷ এখানে নবী (সা) কে সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাঁর মাধ্যমে সম্বোধন করা হয়েছে সমগ্র মুমিন সমাজকে৷
২৩ . আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে এই যে, মুশরিকরা নিজেদের শিরক ও আখেরাত অস্বীকারের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি যেসব দোষ- ত্রুটি ও দুর্বলতা আরোপ করে থাকে সেই অনন্য মহামহিম সত্ত্বাকে তা থেকে পাক- পবিত্র ঘোষণা করা এবং একথা প্রকাশ করা৷ এ ঘোষণা ও প্রকাশের সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে নামায৷ এরি ভিত্তিতে ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদাহ, ইবনে যায়েদ ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে "তাসবীহ পাঠ" তথা মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করার অর্থ নামায পড়া৷ এ তাফসীরের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ কুরআনের এ আয়াতের মধ্যেই রয়ে গেছে অর্থাৎ এখানে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য কয়েকটি বিশেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে৷ একথা সুস্পষ্ট, আল্লাহ সমস্ত দোষ- ত্রুটিমুক্ত - এ আকীদা পোষণ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এ জন্য আবার সকাল- সাঁঝে এবং দুপুরে(জোহর) ও রাতের (ঈশা) নামাযের সময় নির্ধারণের প্রশ্নই উঠতো না৷ কারণ এ আকীদা তো মুসলমানদের সবসময়ই পোষণ করতে হবে৷ এভাবে যদি শুধুমাত্র মুখেই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলেও এ সময়গুলো নির্ধারণ করার কোন অর্থ হয় না৷ কারণ মুসলমানকে তো সবসময় এ আকীদা প্রকাশ করতে হবে৷ এভাবে যদি নিছক কণ্ঠের মাধ্যমে আল্লাহর পবিত্রতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলেও এসময়গুলো নির্ধারণ করা অর্থহীন হয়ে পড়ে৷ কারণ মুসলমানকে তো সর্বক্ষণ একথা প্রকাশ করতে হবে৷ তাই সময় নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে আল্লাহর গুণ ও মহিমা প্রচার করার হুকুম নিসন্দেহে তাঁর একটি বিশেষ কার্যকর কাঠামোর প্রতিই ইঙ্গিত করে৷ আর এ কার্যকর কাঠামোটি নামায ছাড়া আর কিছুই নয়৷ 
 
 

﴿وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ﴾

আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে তাঁর জন্যই প্রশংসা এবং (তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো) তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমাদের কাছে এসে যায় যোহরের সময়৷ ২৪   (সুরা রূম : আয়াত ১৮ )


২৪ . এ আয়াতে চারটি সময়ের প্রতি ইশারা করা হয়েছেঃ ফজর , মাগরিব, আসর ও যোহর৷ এ ছাড়াও নামাযের ওয়াক্ত সম্পর্কে কুরআন মজিদে আরো যেসব ইশারা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ


 ﴿أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا﴾

''নাম কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরের সময় কুরআন পাঠ করো৷" (বনী ইসরাঈল ৭৮)



﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ۚ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ۚ ذَٰلِكَ ذِكْرَىٰ لِلذَّاكِرِينَ﴾

"আর নামায কায়েম করো দিনের দুই মাথায় এবং রাতের কিছু অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর৷" (হুদ , ১১৪ আয়াত )

 صْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ۖ وَمِنْ آنَاءِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ

"আর তোমার রবের প্রশংসা সহকারে তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো সূর্য উদিত হবার আগে এবং তাঁর অস্ত যাবার আগে৷ আর রাতের কিছু সময়ও আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং দিনের প্রান্তভাগেও৷" (ত্বাহা , ১৩০ আয়াত)


এর মধ্যে থেকে প্রথম আয়াতটি বলছেঃ নামাযের সময়সীমা হচ্ছে সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে ঈশা পর্যন্ত এবং এরপর হচ্ছে ফজরের সময়৷ দ্বিতীয় আয়াতে দিনের দুই প্রান্ত অর্থ ফজর ও মাগরিবের সময় এবং কিছু রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পরের সময়টি হচ্ছে ঈশার ওয়াক্ত৷ তৃতীয় আয়াতে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে অর্থ ফজরের সময় এবং অস্তমিত হওয়ার পূর্বে অর্থ আসরের সময়৷ রাতের সময়ের মধ্যে মাগরিব ও ঈশা উভয়ই অন্তরভুক্ত৷ আর দিনের প্রান্ত হচ্ছে তিনটিঃ এক, সকাল৷ দুই, সূর্য ঢলে পড়া এবং তিন, মাগরিব৷ এভাবে সারা দুনিয়ার মুসলমানরা আজ যে পাঁচটি সময়ে নামায পড়ে থাকে কুরআন মাজীদ বিভিন্ন স্থানে সে সময়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছে৷কিন্তু একথা স্পষ্ট শুধুমাত্র এ আয়াতগুলো পাঠ করে কোন ব্যক্তিও নামাযের সময় নির্ধারণ করতে পারতো না৷ মহান আল্লাহর নিযুক্ত কুরআনের শিক্ষক মুহাম্মাদ (সা) নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে এ ব্যাপারে তাদেরকে পথনির্দেশনা না দিলে তাদের পক্ষে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া সম্ভবপর ছিল না৷
এখানে একটু থেমে হাদীস অস্বীকারকারীদের ধৃষ্ঠতাঁর কথা ভাবুন৷ তারা "নামায পড়া" কে বিদ্রুপ করে এবং বলে, মুসলমানরা বর্তমানে যে নামায পড়ছে এটা আদতে সে জিনিসই নয় কুরআনে যার হুকুম দেয়া হয়েছে৷ তাদের বক্তব্য হচ্ছে, কুরআন তো নামায কায়েম করার হুকুম দেয় এবং তাঁর অর্থ নামায পড়া নয় বরং "রবুবিয়াতের ব্যবস্থা" কায়েম করা৷ এখন তাদেরকে একটু জিজ্ঞেস করুন, রবুবিয়াতের এ অভিনব ব্যবস্থাটি কোন ধরনের যাকে সূর্য উদিত হবার পূর্বেই কায়েম করা যেতে পারে অথবা আবার সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে কিছু রাত অতিবাহিত হওয়া পর্যন্তও কায়েম করা যায় ? আর কোন ধরনের রবুবিয়াত ব্যবস্থা বিশেষ করে জুমার দিন কায়েম করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ?
----------------------------------------
আর বিশেষ ধরনের এমন কি রবুবিয়াত ব্যবস্থা আছে যা কায়েম করার জন্য মানুষ যখন অগ্রসর হয় তখন প্রথমে মুখমণ্ডল ও কনুই পর্যন্ত হাত ধুয়ে ফেলে গাঁট পর্যন্ত আর এই সাথে মাথাও মসেহ করে নেয়, অন্যথায় তাকে কায়েম করা যেতে পারে না?
--------------------------------------
আর রবুবিয়াত ব্যবস্থার মধ্যে এমন কি বিশেষত্ব আছে, যার ফলে যদি মানুষ নাপাকির অবস্থায় থাকে, তাহলে যতক্ষণ গোসল না করে নেয় ততক্ষণ তাকে কায়েম করতে পারে না?
--------------------
আর এটাই বা কেমন ব্যাপার, যদি কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে মিলন করে এবং সেখানে পানি না পাওয়া যায় তাহলে এ অদ্ভুত রবুবিয়াত ব্যবস্থাকে কায়েম করার জন্য পাক- পবিত্র মাটিতে হাত ঘসে নিয়ে সেই হাত মুখমণ্ডলের ওপর ঘসতে হবে ?
--------------------------------------
আর এ কেমন ধরনের অদ্ভুত রবুবিয়াত ব্যবস্থা যে, যদি কখনো সফর করতে হয় তাহলে মানুষ তাকে পুরোপুরি কায়েম করার পরিবর্তে অর্ধেকটাই কায়েম করে?
---------------------------------
আর এটা কোন ধরনের কৌতুকপ্রদ ব্যাপার যে, যদি মুসলিম সেনাদল শত্রুর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তাহলে সেনাদলের অর্ধেক সিপাহী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে " রবুবিয়াত ব্যবস্থা" কায়েম করতে থাকবে এবং বাকি অর্ধেক ময়দানে শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকবে ? তাঁরপর যখন প্রথম দলটি ইমামের পেছনে রবুবিয়াত ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে একটি সিজদা করে নেবে তখন উঠে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য চলে যাবে এবং দ্বিতীয় দলটি তাদের জায়গায় এসে ইমামের পেছনে "রবুবিয়াত ব্যবস্থা" কায়েম করতে থাকবে ?
------------------------------------
কুরআন মাজীদের এ আয়াতগুলো একথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছে যে নামায কায়েম করার অর্থ হচ্ছে এমন ধরনের নামায কায়েম করা যা সারা দুনিয়ার মুসলমানরা পড়ে থাকে৷কিন্তু হাদীস অস্বীকারকারীদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা নিজেরা পরিবর্তিত না হয়ে ইসলামকে পরিবর্তিত করার জন্য চাপ দিয়ে চলছে৷ আসলে যতক্ষণ কোন ব্যক্তি মহান আল্লাহর মোকাবিলায় একেবারেই শংকাহীন ও নির্লজ্জ না হয়ে যায় ততক্ষণ সে তাঁর বাণীর সাথে এ বিদ্রুপাত্মক আচরণ করতে পারে না, যা এরা করছে ৷ অথবা এমন এক ব্যক্তি কুরআনের সাথে এ তামাশা করতে পারে যে নিজের মনে কুরআনকে আল্লাহর কালাম বলে স্বীকৃতি দেয় না এবং নিছক ধোঁকা দেবার জন্য কুরআন কুরআন বলে চিৎকার করে মুসলমানদেরকে গোমরাহ করতে চায়৷





﴿أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا﴾

 নামায কায়েম করো ৯১ সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে ৯২ নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত ৯৩ এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা করো৷ ৯৪ কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে৷৯৫ (সুরা বনী ইসরাঈল ৭৮ )
 
৯১. পর্বত প্রমাণ সমস্যা ও সংকটের আলোচনা করার পর পরই নামায কায়েম করার হুকুম দেয়া হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইংগিত করেছেন যে, এ অবস্থায় একজন মু'মিনের জন্য যে অবিচলতার প্রয়োজন হয় তা নামায কায়েমের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে ৷
৯২. (আরবী -----------------) এর অনুবাদ করেছি "সূর্য ঢলে পড়া" অবশ্যি কোন কোন সাহাবা ও তাবেঈ "দুলূক" অর্থ নিয়েছেন সূর্যাস্ত ৷ কিন্তু অধিকাংশের মতে এর অর্থ হচ্ছে দুপুরে সূর্যের পশ্চিমে ঢলে পড়া ৷ হযরত উমর, ইবনে উমর, আনাস ইবনে মালিক, আবু বায়যাতাল আসলামী, হাসান বাসরী, শা'বী, আতা, মুজাহিদ এবং একটি বর্ণনামতে ইবনে আব্বাস ও এ মতের সমর্থক ৷ ইমাম মুহাম্মাদ বাকের ও ইমাম জাফর সাদেক থেকেও এই মত বর্ণিত হয়েছে ৷ বরং কোন কোন হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও (আরবী -------------) এর এ ব্যাখ্যাও উদ্ধৃত হয়েছে, যদিও এর সনদ তেমন বেশী শক্তিশালী নয় ৷
৯৩. (আরবী ------------) এর অর্থ কেউ কেউ নিয়েছেন "রাতের পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাওয়া ৷ " আবার কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন মধ্যরাত ৷ যদি প্রথম অর্থটি মেনে নেয়া হয় তাহলে এর মানে হবে এশার প্রথম ওয়াক্ত ৷ আর দ্বিতীয় অর্থটি মেনে নিলে এখানে এশার শেষ ওয়াক্তের দিকে ইংগিত করা হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে ৷
৯৪. ফজর শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ভোর হওয়া বা প্রভাতের উদয় হওয়া অর্থাৎ একেবারে সেই প্রথম লগ্নটি যখন প্রভাতের শুভ্রতা রাতের আঁধার চিরে উঁকি দিতে থাকে ৷ ফজরের কুরআন পাঠ মানে হচ্ছে, ফজরের নামায, কুরআন মজীদে নামায প্রতিশব্দ হিসেবে কোথাও ' সালাত ' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আবার কোথাও বিভিন্ন অংশের মধ্য থেকে কোন একটির নাম নিয়ে সমগ্র নামাযটি ধরা হয়েছে ৷ যেমন তাসবীহ, যিকির, হামদ (প্রশংসা) কিয়াম (দাঁড়ানো) রুকূ ' সিজদাহ ইত্যাদি ৷ অনুরূপভাবে এখানে ফজরের সময় কুরআন পড়ার মানে শুধু কুরআন পাঠ করা নয় বরং নামাযে কুরআন পাঠ করা ৷ এভাবে নামাযের উপাদান ও অংশ কি ধরনের হতে হবে কুরআন মজীদ সেদিকে পরোক্ষ ইংগিত দিয়েছে ৷ আর এ ইংগিতের আলোকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের কাঠামো নির্মাণ করেন ৷ বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে নামাযের এ কাঠামোই প্রচলিত ৷
৯৫. ফজরের কুরআন পরিলক্ষিত হওয়ার মানে হচ্ছে, আল্লাহর ফেরেশতারা এর সাক্ষী হয় ৷ হাদীসে সুস্পষ্ট একথা বর্ণনা করা হয়েছে যদিও ফেরেশতারা প্রত্যেক নামায ও প্রত্যেক সৎকাজের সাক্ষী তবুও যখন ফজরের নামাযের কুরআন পাঠে তাদের সাক্ষের কথা বলা হয়েছে তখন এ থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ কাজটি একটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ৷ এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে দীর্ঘ আয়াত ও সূরা পড়ার পদ্ধতি অবলম্বন করেন ৷ সাহাবায়ে কেরামও তাঁর এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং পরবর্তী ইমামগণ একে মুসতাহাব গণ্য করেন ৷ এ আয়াতে সংক্ষেপে মি'রাজের সময় যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছিল তার সময়গুলো কিভাবে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করা হবে তা বলা হয়েছে ৷ নির্দেশ দেয়া হয়েছে একটি নামায পড়ে নিতে হবে সূর্যোদয়ের আগে ৷ আর বাকি চারটি নামায সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত পড়ে নিতে হবে ৷ তারপর এ হুকুমটি ব্যাখ্যা করার জন্য জিব্রীল আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছে ৷ তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযগুলোর সঠিক সময়ের শিক্ষা দান করেছেন ৷ আবু দাউদ ও তিরমিযীতে বলেন আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
"জিব্রীল দু'বার আমাকে বায়তুল্লাহর কাছাকাছি জায়গায় নামায পড়ান ৷ প্রথম দিন যোহরের নামায ঠিক এমন সময় পড়ান যখন সূর্য সবেমাত্র হেলে পড়েছিল এবং ছায়া জুতার একটি ফিতার চাইতে বেশী লম্বা হয়নি ৷ তারপর আসরের নামায পড়ান এমন এক সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের সমপরিমাণ ছিল ৷ এরপর মাগরিবের নামায এমন সময় পড়ান যখন রোযাদার রোযা ইফতার করে ৷ অতপর পশ্চিমাকাশের লালিমা খতম হবার পরপরই এশার নামায পড়ান আর ফজরের নামায পড়ান ঠিক যখন রোযাদারের ওপর খাওয়া দাওয়া হারাম হয়ে যায় তেমনি সময় ৷ দ্বিতীয় দিন তিনি আমাকে যোহরের নামায এমন সময় পড়ান যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের সমান ছিল ৷ আসরের নামায পড়ান এমন সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের দ্বিগুণ ছিল ৷ মাগরিবের নামায পড়ান এমন সময় যখন রোযাদার রোযা ইফতার করে ৷ এশার নামায পড়ান এমন সময় যখন রাতের তিনভাগের একভাগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং ফজরের নামায পড়ান আলো চারদিকে ভালভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর ৷ তারপর জিব্রীল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে মুহাম্মাদ! এই হচ্ছে নবীদের নামায পড়ার সময় এবং এ দু'টি সময়ের মাঝখানেই হচ্ছে নামাযের সঠিক সময় ৷ "(অর্থাৎ প্রথম দিন প্রত্যেক নামাযের পথম সময় এবং দ্বিতীয় দিন শেষ সময় বর্ণনা করা হয় ৷ প্রত্যেক ওয়াক্তের নামায এ দু'টি সময়ের মাঝখানে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ৷)
কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায়ও পাঁচটি নামাযের এ ওয়াক্তসমূহের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে ৷ যেমন সূরা হূদে বলা হয়েছে:
আরবী ---------------------------------------------------------------------------
"নামায কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরিব) এবং কিছু রাত পার হয়ে গেলে (অর্থাৎ এশা) ৷ "(১১৪ আয়াত)
আরবী --------------------------------------------------------------------------
"আর নিজের রবের হামদ (প্রশংসা) সহকারে তাঁর তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা) করতে থাকো সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসর) এবং রাতের সময় আবার তাসবীহ করো (এশা) আর দিনের প্রান্তসমূহে (অর্থাৎ সকাল, যোহর ও মাগরিব)"(১৩০ আয়াত)
তারপর সূরা রূমে বলা হয়েছে:
আরবী -------------------------------------------------------------------------
"কাজেই আল্লাহর তাসবীহ করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় (মাগরিব) এবং যখন সকাল হয় (ফজর) ৷ তাঁরই জন্য প্রশংসা আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে এবং তাঁর তাসবীহ করো দিনের শেষ অংশে (আসর) এবং যখন তোমাদের দুপুর (যোহর) হয় ৷ "[ ১৭-১৮ আয়াত ]
নামাযের সময় নির্ধারণ করার সময় যেসব প্রয়োজনীয় দিকে নজর রাখা হয়েছে তার মধ্যে সূর্য পূজারীদের ইবাদাতের সময় থেকে দূরে থাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ৷ সকল যুগেই সূর্য মুশরিকদের সবচেয়ে বড় বা অনেক বড় মাবুদের স্থান দখল করেছে ৷ সূর্য উদয় ও অস্তের সময়টায়ই তারা বিশেষ করে তার পূজা করে থাকে ৷ তাই এসব সময় নামায পড়াকে হারাম করা হয়েছে ৷ তাছাড়া সাধারণত সূর্য উদয়ের পর থেকে নিয়ে মধ্য গগণে পৌঁছার সময়ে তার পূজা করা হয়ে থাকে ৷ কাজেই ইসলামে হুকুম দেয়া হয়েছে, দিনের বেলার নামাযগুলো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে পড়া শুরু করতে হবে এবং সকালের নামায সূর্য হবার আগেই পড়ে ফেলতে হবে ৷ এ প্রয়োজনীয় বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনা করেছেন ৷ একটি হাদীসে হযরত আমর ইবনে আবাসাহ (রা) বর্ণনা করছেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযের সময় জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন:
আরবী --------------------------------------------------------------------------
"ফজরের নামায পড়ো এবং সূর্য উদিত হতে থাকলে বিরত হও, সূর্য ওপরে উঠে যাওয়া পর্যন্ত ৷ কারণ সূর্য যখন উদিত হয় তখন শয়তানের শিং দু'টির মাঝখানে দিয়ে বের হতে থাকে এবং এ সময় কাফেররা তাকে সিজদা কর ৷
তারপর তিনি আসরের নামাযের উল্লেখ করার পর বললেন:
আরবী ----------------------------------------------------------------------------
"তারপর নামায থেকে বিরত হও সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত ৷ কেননা, সূর্য শয়তানের শিং দু'টির মাঝখানে অস্ত যায় এবং এ সময় কাফেররা তার পূজা করে"৷ (মুসলিম)
এ হাদীসে সূর্যের শয়তানের শিংয়ের মাঝখানে দিয়ে উদয় হওয়া ও অস্ত যাওয়াকে একটা রূপক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে এ ধারণা দেয়া হয়েছে যে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার সময় শয়তান লোকদের জন্য একটি বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দেয় ৷ লোকেরা যখন সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার সময় তার সামনে সিজদা করে তখন যেন মনে হয় শয়তান তাকে নিজের মাথায় করে এনেছে এবং মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে ৷ রসূল (সা) তাঁর নিজের নিম্নোক্ত বাক্য দিয়ে এ রূপকের রহস্য ভেদ করেছেন "এ সময় কাফেররা তার পূজা করে"৷


=====================


﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ۚ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ۚ ذَٰلِكَ ذِكْرَىٰ لِلذَّاكِرِينَ﴾


 আর দেখো, নামায কায়েম করো দিনের দু’ প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হবার পর৷ ১১৩ আসলে সৎকাজ অসৎকাজকে দূর করে দেয়৷ এটি একটি স্মারক তাদের জন্য যারা আল্লাহকে স্মরণ রাখে৷১১৪ (সুরা হুদ : ১১৪)

১১৩. দিনের দু'প্রান্ত বলতে ফজর ও মাগরিব এবং কিছু রাত অতিবাহিত হবার পর বলতে এশার সময় বুঝানো হয়েছে৷ এ থেকে বুঝা যায়, এ বক্তব্য এমন এক সময়ের যখন পাঁচ ওয়াক্তের নামায নির্ধারিত হয়নি৷ মি'রাজের ঘটনা এরপর সংঘটিত হয় এবং তাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার বিধান দেয়া হয়৷ (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন বনী ইসরাঈল ৯৫, ত্বা-হা ১১১, রুম ১২৪ টীকা)

১১৪. অর্থাৎ যেসব অসৎকাজ দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে এবং সত্যের এ দাওয়াতের প্রতি শত্রুতার ব্যাপারে তোমাদের সাথে যেসব অসৎকাজ করা হচ্ছে এসবগুলো দূর করার আসল পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, তোমরা অনেক বেশী সৎ হয়ে যাও এবং নিজেদের সৎকাজের সাহায্যে এ অসৎকাজকে পরাস্ত করো৷ আর তোমাদের সৎ বানাবার সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে এ নামায৷ নামায আল্লাহর স্মরণকে তরতাজা করতে থাকবে এবং তার শক্তির জোরে তোমরা অসৎকাজের এ সংঘবদ্ধ তুফানী শক্তির কেবল মোকাবিলাই করতে পারবে তাই নয় বরং দুনিয়ায় কার্যত সৎকাজ ও কল্যাণের ব্যবস্থাও কায়েম করতে পারবে৷ (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আনকাবুত ৭৭-৭৯ টীকা)




1 comment:

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...