২৭ নং সুরা নমল এর ৪৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা

মাওলানা মওদুদী রাহ: এর বক্তব্য :

২৭ নং সুরা নমল এর ৪৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন :


[[টিকা:৫৬) হযরত সুলাইমান (আ) ও সাবার রাণীর এ কাহিনী বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মে এবং ইহুদী বর্ণনাবলীতে সব জায়গায় বিভিন্ন ভংগীতে এসেছে। কিন্তু কুরআনের বর্ণনা এদের সবার থেকে আলাদা। পুরাতন নিয়মে এ কাহিনী এভাবে বর্ণিত হয়েছে- “আর শিবার রাণী সদাপ্রভুর নামের পক্ষে শলোমনের কীর্তি শুনিয়া গূঢ়বাক্য দ্বারা তাঁহার পরীক্ষা করিতে আসিলেন। তিনি অতি বিপুল ঐশ্বর্যসহ, সুগন্ধি দ্রব্য, অতি বিস্তর স্বর্ণ ও মণিবাহক উষ্ট্রগণ সঙ্গে লইয়া যিরুশালেমে আসিলেন এবং শলোমনের নিকটে আসিয়া নিজের মনে যাহা ছিল, তাঁহাকে সমস্তই কহিলেন। আর শলোমন তাঁহার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর করিলেন;................ এই প্রকারে শিবার রাণী শলোমনের সমস্ত জ্ঞান ও তাঁহার নির্মিত গৃহ এবং তাঁহার মেজের খাদ্য দ্রব্য ও তাঁহার সেবকদের উপবেশন ও দণ্ডায়মান পরিচারকদের শ্রেণী ও তাহাদের পরিচ্ছদ এবং তাঁহার পানপাত্র বাহকগণ ও সদাপ্রভুর গৃহে উঠিবার জন্য তাঁহার নির্মিত সোপান, এই সকল দেখিয়া হতজ্ঞান হইলেন। আর তিনি রাজাকে কহিলেন, আমি আপন দেশে থাকিয়া আপনার বাক্য ও জ্ঞানের বিষয় যে কথা শুনিয়াছিলাম, তাহা সত্য। কিন্তু আমি যাবৎ আসিয়া স্বচক্ষে না দেখিলাম, তাবৎ সেই কথায় আমার বিশ্বাস হয় নাই; আর দেখুন, অর্ধেকও আমাকে বলা হয় নাই; আমি যে খ্যাতি শুনিয়াছিলাম, তাহা হইতেও আপনার জ্ঞান ও মঙ্গল অধিক। ধন্য আপনার লোকেরা, ধন্য আপনার এই দাসেরা, যাহারা প্রতিনিয়ত আপনার সম্মুখে দাঁড়ায়, যাহারা আপনার জ্ঞানের উক্তি শুনে। ধন্য আপনার ইশ্বর সদাপ্রভু, যিনি আপনাকে ইসরাঈলের সিংহাসনে বসাইবার জন্য আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন.............পরে তিনি বাদশাহকে একশত বিশ তালন্ত স্বর্ণ ও অতি প্রচুর সুগন্ধি দ্রব্য ও মণি উপঢৌকন দিলেন, শিবার রাণী শলোমন রাজাকে যত সুগন্ধি দ্রব্য দিলেন, তত প্রচুর সুগন্ধি দ্রব্য আর কখনো আসে নাই। .........আর শলোমন রাজা শিবার রাণীর বাসনা অনুসারে তাঁহার যাবতীয় বাঞ্ছিত দ্রব্য দিলেন, তাহা ছাড়া শলোমন আপন রাজকীয় দানশীলতা অনুসারে তাঁহাকে আরও দিলেন। পরে তিনি ও তাঁহার দাসগণ স্বদেশে ফিরিয়া গেলেন।” ( ১-রাজাবলী ১০: ১-১৩ প্রায় একই বিষয়বস্তু সম্বলিত কথা ২-বংশাবলী ৯: ১-১২ তেও এসেছে। ) নতুন নিয়মে হযরত ঈসার ভাষণের শুধুমাত্র একটি বাক্য সাবার রাণী সম্পর্কে উদ্ধৃত হয়েছেঃ “দক্ষিণ দেশের রাণী বিচারে এই কালের লোকদের সহিত উঠিয়া ইহাদিগকে দোষী করিবেন; কেননা শলোমনের জ্ঞানের কথা শুনিবার জন্য তিনি পৃথিবীর প্রান্ত হইতে আসিয়াছিলেন, আর দেখ শলোমন হইতে মহান এক ব্যক্তি এখানে আছেন।” (মথি ১২: ৪২ এবং লুক ১১: ৩১) ইহুদী রব্বীরা হযরত সুলাইমান ও সাবার রাণীর যে কাহিনী বর্ণনা করেছেন তার বেশীর ভাগ বিস্তারিত বিবরণ কুরআনের সাথে মিলে যায়। হুদহুদ পাখির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, তারপর ফিরে এসে তার সাবার রাণীর অবস্থা বর্ণনা করা, তার মাধ্যমে হযরত সুলাইমানের পত্র পাঠানো, হুদহুদের পত্রটি ঠিক তখনই রাণীর সামনে ফেলে দেয়া যখন তিনি সূর্য পূজা করতে যাচ্ছিলেন, পত্রটি দেখে রাণীর মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠান করা, তারপর রাণীর একটি মূল্যবান উপঢৌকন সুলাইমানের কাছে পাঠানো, নিজে জেরুসালেমে এসে তাঁর সাথে সাক্ষাত করা, সুলাইমানের মহলে এসে বাদশাহ জলাধারের মধ্যে বসে আছেন বলে মনে করা এবং তাতে নেমে পড়ার জন্য নিজের পরণের কাপড় হাঁটুর কাছে উঠিয়ে নেয়া---এসব সে বর্ণনাগুলোতে কুরআনে যেমনি আছে ঠিক তেমনিভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু এ উপঢৌকন লাভ করার পর হযরত সুলাইমানের জবাব, রাণীর সিংহাসন উঠিয়ে আনা, প্রত্যেকটি ঘটনায় তাঁর আল্লাহর সামনে মাথা নত করা এবং সবশেষে তাঁর হাতে রাণীর ঈমান আনা-এসব কথা এমনকি আল্লাহর আনুগত্য ও তাওহীদের সমস্ত কথাই এ বর্ণনাগুলোতে অনুপস্থিত। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এই জালেমরা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে, তিনি সাবার রাণীর সাথে নাউযুবিল্লাহ ব্যভিচার করেন। আর এর ফলে যে জারজ সন্তানটি জন্মলাভ করে সে-ই হয় পরবর্তীকালে বাইতুল মাকদিস ধ্বংসকারী ব্যবিলনের বাদশাহ বখতে নাসসার। (জুয়িশ ইনসাইক্লোপিডিয়া, ১১শ খণ্ড, ৪৪৩ পৃষ্ঠা) আসল ব্যাপার হচ্ছে, ইহুদী আলেমদের একটি দল হযরত সুলাইমানের কঠোর বিরোধী ছিল। তারা তাঁর বিরুদ্ধে তাওরাতের বিরুদ্ধাচরণ, রাষ্ট্র পরিচালনায় আত্মম্ভরিতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অহংকার, নারী আসক্তি, বিলাসী জীবন যাপন এবং শিরক ও মূর্তিপূজার জঘন্য অভিযোগ এনেছেন। (জুয়িশ ইনসাইক্লোপিডিয়া, ১১শ খণ্ড ৪৩৯-৪৪১ পৃষ্ঠা) এ প্রচারনার প্রভাবে বাইবেল তাঁকে নবীর পরিবর্তে নিছক একজন বাদশাহ হিসেবেই উল্লেখ করেছে। আবার বাদশাহও এমন যিনি নাউযুবিল্লাহ আল্লাহর হুকুমের বরখেলাফ করে মুশরিক মেয়েদের প্রেমে মত্ত হয়ে গেছেন। যাঁর অন্তর আল্লাহ‌ বিমুখ হয়ে গেছে এবং যিনি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য মাবুদদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন। (১ রাজাবলী ১১: ১-১১) এসব দেখে বুঝা যায় কুরআন বনী ইসরাঈলদের প্রতি কত বড় অনুগ্রহ করেছে। নিজেদের জাতীয় মনীষীদের জীবন ও চরিত্রকে তারা নিজেরাই কলূষিত করেছে এবং কুরআন সেই কলূষ কালিমা ধূয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে। অথচ এ বনী ইসরাঈল কতই অকৃতজ্ঞ জাতি, এরপরও তারা কুরআন ও তার বাহককে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে।]]

No comments:

Post a Comment

Featured Post

প্রশ্নোত্তর পর্বসমূহ

আস সালামু আলাইকুম । আপনারা তাফহীমুল কুরআন এ্যাপের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো করেছেন এখানে সেগুলোর উত্তর তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে।  বিগত দিনের ...